আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৯

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সারা বাড়িতে বিরিয়ানির কড়া সুগন্ধ ছড়িয়ে পরে মূহূর্তেই।শানের নাক এড়ায় না সে সুগন্ধ।ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো পিটপিট করে খুলতেই বিরিয়ানির গন্ধে ঘুম উবে যায় মূহুর্তেই।ঠাওর করতে পারে না এতো সকাল সকাল এ বাড়িতে বিরিয়ানির আয়োজন কে করছে!দ্রুত উঠে স্লিপার জোড়া পরে নেয়।ঘর থেকে বের হতেই মাতাল করা সে সুগন্ধ শানকে কাছে টানছে মাত্রাতিরিক্তভাবে।এর একটাই কারণ, শান বিরিয়ানি পাগল।
নিচে নামতে নামতে ড্রয়িং রুমে রাহেলা বেগম সহ ইনায়াহ্’কে খেলতে দেখে শান।

“পাখি কেথায়?”,ওদের মাঝে পাখিকে না পেয়ে আনমনে বলে ওঠে।তখনি রান্নাঘর থেকে হাতা খুন্তির শব্দে শান ধীরপায়ে এগিয়ে যায়।ইনায়াহ্ শানকে দেখে বলে,”আজ ফ্রাই ডে পাইছো না?তাই এতো বেলা করে উঠলে।”
মুচকি হেসে ইনায়াহ্’কে কাছে ডাকে শান।দৌঁড়ে আসে ইনায়াহ্।
“বলো তো আজ কি রান্না হচ্ছে?গেজ গেজ”,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শান বুঝতে পেরেছে কি রান্না হচ্ছে তবুও ভাবুকের মতো মিছেমিছি বলে,”কি হচ্ছে মাম?উমম আমি তো গেজ করতে পারছি না”
“হিহিহি,,,,,আজ তোমার ফেভারিট বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে।আর কে রাঁধছে বলো তো?”
শান এবার বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,”কে? ”
“মুন সাইন”

পাখির কথা বুঝতেই অজানা ভালো লাগায় ছেঁয়ে যায় শানের চোখমুখ। প্রশান্তিতে ভরে ওঠে বুকের ভেতর।এদিকে শান আর ইনায়াহ্’র কান্ড দেখে মিটমিট করে হাসছে রাহেলা বেগম।আগ বাড়িয়ে বলেন,”ও নাকি আজ নিজে হাতে বিরিয়ানি রেঁধে আমাদের সবাইকে খাওয়াবে।তাই রান্না ঘরের ত্রিসীমানাতেও আমায় ঢুকতে দেয় নি শান বাবা।একা একা সব করেছে।”

শান মুচকি হেসে ওঠে।প্রিয় মানুষের করা যেকোন কাজ নাকি প্রিয় একটা অনুভূতি জাগায়।সেখানে যদি হয় নিজের পছন্দের খাবার তাহলে তো কথাই নেই।ইনায়াহ্’কে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে ঢোকে শান।
“উহুহম উহুহম”,দুইবার গলা খাঁকারি দিতে পাখি পিছু ফিরে একবার তাকাতেই সমস্ত মনোযোগ যেন নষ্ট হয়ে যায়।রান্না থেকে মনের সংযোগ টা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মূহূর্তেই।এলোমেলো নজরে সেদিকে আরেকবার চেয়ে কাজে পূনরায় মনোনিবেশ করে পাখি।

“কি রান্না হচ্ছে?”,মাথাটা এগিয়ে চুলার উপর রাখা পাতিলের উপর তাক করে বলে শান।পাখি পাশে সরে যায় তৎক্ষণাৎ।
ইনায়াহ্ বিরক্ত হয়ে বলে,”উফ,সান সাইন। এখনি তো বললাম বিরিয়ানি হচ্ছে।তাও জিজ্ঞেসা করছো কেন?”
চোর ধরা পরার মতো অবস্থা হয় শানের।কারণ সে চাইছে পাখি নিজেই তাকে বলুক।
পাখির ঘর্মাক্ত মুখোবয়বের দিকে তাকাতেই শানের কেমন যেন লাগলো।বাহিরে থেকে টাওয়াল ভিজিয়ে এনে বলে,”এটা ইউজ করো।”

পাখি সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে।ক্ষীনস্বরে বলে,”লাগবে না ”
“নিতে বলছি নাও”,শান একরোখা জবাব দেয়।
পাখি কিছু না বলে টাওয়াল টা হাত বাড়িয়ে নেয়।শান তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পাখিকে দেখে চলছে।কেমন যেন বিব্রতকর পরিস্থিতি লাগছে পাখির কাছে।শান ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে বাহিরে চলে যায়।

“ওয়াও, মুন সাইন এটা সত্যিই খুব টেষ্টি”,খেতে খেতে বলছিলো ইনায়াহ্।আব্দুল্লাহ্ মুচকি হাসি ঠোঁটে এলিয়ে বলে,”সত্যিই মা তোমার রান্নার হাত অনেক সুন্দর”
পাখি সবার প্রশংসা শুনে শুকনো হেসে শানের দিকে তাকায়।কারন তার এই মানুষটার প্রশংসা শোনার জন্যে কান যেন অধীর আগ্রহে বসে আছে।কিন্তু শান কোন কথা ছাড়াই প্রথম থেকেই খেয়েই চলেছে।পাখি পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে কিছু বলতে যাবে তার আগে রাহেলা বেগম বলে ওঠেন,”কি ব্যপার শান বাবা তুমি যে কিছু বলছো না?”

এতোক্ষনে মাথা তুলে তাকায় শান।মাংসের টুকরাটা মুখে পুরে দিতে দিতে বলে, “কি বলব? ”
“আরে ভালো হয়েছে সেটা জানি।তোমার কাছে কেমন লেগেছে সেটা বলো”
পাখির দিকে তাকিয়ে শান চোখমুখে গাম্ভীরযতা বজায় রেখে বলে,”হুমম ভালো”
থমথমে হয়ে যায় পাখির মুখ।ঘনকালো অন্ধকারে বিষিয়ে ওঠে মনটা।আনমনে ভাবতে থাকে, “শুধু ভালো”
শান সেদিকে একবার তাকাতেই পাখির চোখে চোখ পড়ে যায়।দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।

সবার খাওয়া শেষ হলে বাকি খাবার গুলো রান্নাঘরে নিয়ে যায় পাখি।শান ছোট ছোট চোখে ওর দিকে তাকায়।এরপর চারপাশে তাকিয়ে কাউকে কোথাও না পেয়ে সন্তর্পণে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।কয়েক ইঞ্চি দূরে পাখির পিছনে দাঁড়ায় শান।পিছনে হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ঘুরে তাকাতেই শানের সাথে ধাক্কা লাগে পাখির।হকচকিয়ে দুপা পিছাতেই কিচেন ডেস্কের সাথে পা থেমে যায়।শানের দিকে একনজর তাকাতেই ঐ চোখে অন্যরকম ঘোর বুঝতে পারে পাখি।দ্রুত চোখ সরিয়ে বলে,”কি?”
শান ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই জবাব দেয়,”কি?”

পাখি আরেকবার ভ্রুকুচকে তাকাতেই মুচকি হেসে ওঠে শান।একদৃষ্টে পাখি চেয়ে থাকে সেদিকে।ভুবন ভোলানো সে হাসি,জ্বালাময়ী সে হাসি।খুব ইচ্ছে হয় সামনে হাস্যরত মানুষটার হাসিটাকে একবার ছুঁয়ে দিতে।

অজানা ভালো লাগায় নিজের অজান্তে শানের বাম গালে হাত রাখে পাখি।শান গালের উপর রাখা পাখির হাতটার দিকে একবার চেয়ে ছোট ছোট চোখে পাখির দিকে তাকায়।আবেগ গুলো অন্যরকম পরিস্থিতির জানান দেয়।শান দ্রুত দুই পা পিছিয়ে যায়।শানের নড়ে যাওয়াতে দ্বিতীয় দফা হকচকিয়ে ওঠে পাখি।নিজের হাতের অবস্থান দেখে বেশ লজ্জায় পরে যায় সে।হাত সরিয়ে পিছন ঘুরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।লজ্জায় মরি মরি অবস্থা হয় পাখির।ঠোঁটের ঢগায় বিড়বিড় করে,”কেন নিজেকে নিজেতে রাখতে পারি না।কেন এনার সামনে এতো দূর্বল হয়ে পরি!”

“বিরিয়ানি অনেননেক বেশিই টেষ্টি হয়েছিলো”,পাখির ভাবনার মাঝে কথাটা বলে শান রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

বিকেলে বাড়ির সবাই ড্রয়িং রুমে বসে ইনায়াহ্’র সাথে খেলছে।শান উপরে নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।এমন সময় দুজন লোক বাড়িতে ঢুকে যায়।আব্দুল্লাহ্ সহাস্যমুখে এগিয়ে এসে বলে,”এতো দেরি করলে কেন তোমরা?শানবাবা জানতে পারলে রেগে যাবে”
নত মস্তকে লোকদুজন জবাব দেয়,”আসলে স্যার আরো দুইটা ইভেন্ট ছিলো আজ তাই….. ”

“হয়েছে আর বাহানার দরকার নাই”,কথার মাঝে শান বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামে।পাখি সেদিকে একবার তাকিয়ে পূনরায় লোক দজনের দিকে তাকায়।কারণ সে বুঝতে পারছে না এনারা কে!
“দেরি করো না। আমি আর কোন দেরি মানতে পারব না।কাল অনেক কাজ আমি চাই না কালকে অবধি তোমাদের কাজ চলমান থাকুক”,শানের বলা কড়া কথাটায় লোকদুজন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলে,”ওকে স্যার”

পাখি জিজ্ঞাসিত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়।রাহেলা বেগমের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,”কি ব্যপার চাচি?”
“আমিও তো বুঝতে পারছি না”
শান ওদের দুজনের কথার ফিসফিসানি শুনে সেদিকে তাকায়।পাখি মুখ বন্ধ করে, চোখ নামিয়ে নেয়।
শান ইনায়াহ্’র দিকে এগিয়ে কোলে তুলে নেয়।দুই গালে চুমু এঁকে পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”আগামি পরশু মানে চব্বিশ মে আমার মামের জন্মদিন”

শানের কথা শেষ হতেই ইনায়াহ্ অবাক হয়ে যায়।খুশিতে ঝলমল করে ওঠে পাখির চোখ।
“সান সাইন আমার তো মনেই ছিলো না”,অবাক বিষ্ময়ে বলে ইনায়াহ্।
“তোমার সান সাইন কি করে ভুলে যায় বলতো!”
রাহেলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচি উনারা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে এসেছে।বাড়িটা পুরো সাজাবে।আমার পূর্বপরিচিত।একটু দেখে নিও ”

পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার ফ্রেন্ড রাখি সহ ইনায়াহ্’র প্রিন্সিপাল ম্যামকেও ইনভাইট করো।যদিও আমি করব, তবুও তুমি একটু জানাইও”
ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে পাখি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
শান স্বগতোক্তি করে বলে,”গেস্ট বলতে ইনায়াহ্’র ফ্রেন্ডস,তাদের ফ্যামিলি,আমার কয়েকজন কলিগ”

কেটে যায় মাঝখানের একটি দিন।সকাল সকাল ইনায়াহ্’কে গোসল করিয়ে রেডি করিয়ে দেয় পাখি।সুন্দর টকটক লাল রঙ্গের সিন্ড্রেলা ড্রেসে ইনায়াহ্’কে দেখতে একদম পরীর মতোই লাগছে।আয়নায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে ইনায়াহ্।ওর কান্ড দেখে পাখি না হেসে থাকতে পারে না।কোলে উঠিয়ে নিয়ে দু গালে আদোর করে বলে,”পাঁচ বছরে পা রাখলো আমাদের প্রিন্সেস”
ইনায়াহ্ হেসে পাখির গলা জড়িয়ে ধরে।হাত ধরে টেনে এনে বিছানায় বসায়।

“এদিকে আসো তো মুন সাইন”
পাখি ভ্রুকুচকে সেদিকে চলে যায়।
“আজ আমার পাঁচতম জন্মদিন।আমি তো জানি সান সাইন আমায় অনেক অনেক গিফ্ট দেবে।”
এরপর ভাবুক ভঙ্গিতে আবার বলে,”উমম,জানি আমার ফ্রেন্ডসরাও অনেক গিফ্ট করবে।”
পাখি মুচকি হেসে বলে,”হুমমম করবেই তো।”
“হ্যা, তো তুমি আমায় কি দিবা হুমম হুমম?”,ভ্রু নাচিয়ে বলে ইনায়াহ্।
পাখি কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবে,”সত্যিই তো, কি দিবো আমি?স্কুলের বেতন তো পাই নি এখনো।আর আমি টাকা কোথায় পাবো?”

“ওহহ মুন সাইন বলো না প্লিজ”
ইনায়াহ্’র ডাকে চমকে ফিরে পাখি বলে,”কি চায় আমার মা টা?”
“যা চাইব দেবে তো?”
“হুমম দিবো তো। বলো না”,ইনায়াহ্’কে আশ্বস্ত করে পাখি।
“আমায় কোনদিন ছেড়ে যাবে না, কথা দাও”,ছলছলে চোখে ইনায়াহ্ নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় কথা নেয়ার আশায়।

এই ছোট্ট মানুষটার মুখ থেকে এমন আবদার বের হবে পাখি ভাবতেও পারে নি।বুকের ভেতর অজানা মায়ার ঝড় উঠে যায়।ডান হাতে ইনায়াহ’কে দ্রুত কাছে টেনে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।
“আমি তোমায় কক্ষনো ছেড়ে যাব না মা।আজকের পর তো নয়’ই”,বলেই ইনায়াহ্’র মাথায় চুমু খায়।
সময় গড়াবার সাথে সাথে সকল গেস্টরা চলে আসে।শান রেডি হয়ে নিচে নামে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে।চারিদিকে চেয়ে সবাইকেই পায় ;পাখিকে ছাড়া।ইনায়াহ্ ওর বন্ধুদের সাথে খেলছে।
আশপাশে আরেকবার চোখ বুলাতে নাবিদ বলে ওঠে,”কি ভাই কাকে খুঁজছো বলোতো?সবাই তো এসছি?”

শান ওর দিকে না তাকিয়েই বলে,”আরে না তেমন কেউ না।”
নাবিদ সন্দিহান চোখে চেয়ে বলে, “আচ্ছা তোর পাখি কোথায়?”
“হ্যা ওরেই তো খুঁজ……”,বাকি কথা না বলতেই শানের হুশ ফেরে।বুঝতে পারে কি বলতে চলছিলো সে।নাবিদ শব্দ করে হেসে বলে,”ভালোবাসা কখনো লুকিয়ে রাখার জিনিস না।বেড়িয়ে আসবেই”

“আরে ওরকম কিছু না”,কথা শেষ করে উপরে তাকাতেই পাখির দিকে চোখ পড়ে শানের।
হালকা নেভি ব্লু রঙ্গের জামা পরেছে সে।লম্বা, কালো, মসৃন চুল গুলোর অর্ধেকটা কাঁধের উপরে ঝোলানো বাকিটা পিঠের উপর ছড়ানো।শানের যেন নজর সরানো দায় হয়ে পরল।অপলকে চেয়ে আছে সেদিকে।নাবিদ সেদিকে একবার চেয়ে শানের দিকে তাকায়।আশেপাশের সবারই ব্যপারটা নজরে আসে।
পাখি নিচে সবাইকে দেখে কেমন চুপসে যায়। কারণ এখানকার কেউই তার পরিচিত না। শুধুমাত্র পাশে থাকা রাখি ছাড়া।সে কিছুতেই আসতে চায়নি নিচে,রাখি একপ্রকার জোড় করেই এসেছে।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই আশেপাশে ফিসফিসানি শুরু হয়ে যায়।

“হ্যা এই মেয়েটাই মেবি”
“হুম ডক্টর শানের নতুন জিএফ”
“এভাবে না থেকে, বিয়েটা সেড়ে নিলেই তো হয়”
“আরে বড়লোকদের ব্যপার সেপার।বুঝো না”

একেজন মানুষের একেকটা মন্তব্যে জর্জরিত শান-পাখির নামবিহীন এই সম্পর্ক।
পাখি বেশ বুঝতে পারছে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে সবার মাঝে।
শানের ঘাড়ে ডান হাতটা রেখে নাবিদ বলে,”আরে ভাই পরে দেখ।আমাদেরও একটু সময় দে”
বলেই হো হো শব্দে হেসে দেয় শানের পাশে থাকা সব ছেলে বন্ধুরা।শান ভীষণ বিব্রতবোধ করে বলে,”যেরকম ভাবছো সেরকম টা নয়”

“হুম বুঝতে পেরেছি।তবে ভাই এগিয়ে যাওয়া উচিত”,পাশ থেকে একজন ছেলে বলে ওঠে।শান পূনরায় পাখির দিকে তাকাতে রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে।যে রাগ পাখির নজর এড়ায় না।বাড়িভরা মানুষের সমাগমের মাঝে শান বার বার আড়চোখে পাখির দিকে তাকাচ্ছে। পাখির সাথে চোখাচোখি হতেই দ্রুত নজর সরিয়ে নিচ্ছে।কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতির উদয় হচ্ছে।

“তোর ডাক্তার সাহেব তো তোকে চোখে হারাচ্ছে পাখি”,খেতে খেতে বলে রাখি।লজ্জায় কুঁকড়ে যায় পাখি।কপোট রাগ দেখিয়ে বলে, “সেসব কিছু না”
এরপর শানের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হয় পাখি।ও চোখে এক রাশ রাগের বলিরেখা ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে পারছে না পাখি।নিজেকে প্রশ্ন করে,”আবার কি করলাম?এতো রেগে তাকাচ্ছে কেন?”

মানুষের সমাগম একটু কমে গেলে শান পাখির কাছকাছি চলে আসে।দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “ভিতরে যাও”
পাখি অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ কি এমন হলো যে তাকে ভিতরে যেতে হবে।বুঝতে না পেরে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পাখি।শান আবার বলে,”ভিতরে যাও”
পাখি এবার রিনরিন স্বরে প্রশ্ন করে,”কেন?”
“যেতে বলছি, যাও”

পাখি ছোট ছোট চোখ করে তাকাতােই শান চাপা ধমক দিয়ে কাঁধের দিকে ইশারা করে বলে,”লাল স্লিভ টা আমায় ছাড়া এখানে উপস্থিত সবারই নজর কাড়ছে।কাইন্ডলি যদি ভিতরে গিয়ে দেখে আসতেন”
পাখি অবুজের মতো কাঁধে হাত দিতেই বুঝতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসটার অস্তিত্ব। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সত্যিই সকলের নজর তার উপর নিবদ্ধ।লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে পাখির।শানের সামনে থেকে সরতে পারলে যেন বেঁচে যায় সে।দ্রুত পায়ে উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।এরপর পুরো সময়টা দরজা বন্ধই রাখে।

“কি হয়েছে চাচি?”,রাহেলা বেগমের অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে শান।বিমর্ষ চিত্তে রাহেলা জবাব দেয়,”আশপাশে কান টেকানো যাচ্ছে না বাবা।ইনায়াহ্’র জন্মদিনের পর থেকে তো আরো বেশি সমালোচনা চলছে”
শান স্মিত হেসে বলে,”কোন ব্যপারে? ”
“তোমার আর পাখি……”,কথা বলতে বলতেই শানের দিকে তাকাতে বাকি কথাটা হারিয়ে যায় রাহেলার।রাগে চোয়াল শক্ত করে বলে,”চাচি আই ডোন্ট কেয়ার”
ফোনে হঠাৎ কারো কল আসায় শান রিসিভ করে কানে ধরে।
“হ্যা বল”

“আসবি না নাকি প্রাণ পাখি আসতে দিচ্ছে না?আরে ভাই প্রফেশনে মন দাও বুঝলে”,নাফিসের তেড়ছাভাবে বলা কথাটা বড্ডো গায়ে লাগে শানের।শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না জল অনেকটা বেশিই ঘোলা হয়ে গেছে।রাগে কোন কথা না বলে ফোন কেটে দেয়।এরপর চলে যায় হাসপাতালে।
কাজের ফাঁকে সচরাচর কারো ফোন এলাউ করে না শান।তবুও একটা নম্বর থেকে বার বার কল আসায় বাধ্য হয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে?”
শান রেগে গিয়ে ফোনটা কাটতেই আবার বলে,” কাটিও না।কথা শেষ হবে তারপর কাটবে।শান চুপচাপ শুধু শুনে যায়।

“আমি আমার ছেলের কাছে পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মা হতে পারি, আমার ছেলে আমার কাছে খারাপ নয়।চারপাশে অনেক কথা শুনা যাচ্ছে।যদি সত্যিই বাড়ির ঐ মেয়েটার সাথে তেমন কম্পর্ক থাকে তবে বিয়ে করে নাও।আমার বিশ্বাস, আমার ছেলে পশ্চিমা বিশ্বের মতো নিজেকে বাঁধবে না”
শান রাগে ফোনটা মেঝেতে আছাড় মারে।মূহূর্তেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সবটা।ব্যপারটা এতো সিরিয়াস ছিলো না ইনায়াহ্’র বার্থডের আগ পর্যন্ত।কাজ শেষে বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরে শান।

“তাহলে তুমিই সেই মেয়ে তাই না? “,বলেই ভদ্রমহিলা পাখির দিকে কটাক্ষের চোখে তাকায়।পাশের মহিলারা বলাবলি করে, “এতো সুন্দর সে আবার এসব করে বেড়ায় ছিহ।কি যুগ আইলো রে বিয়ে ছাড়াই কি সব চলছে!”
রাহেলা এগিয়ে এসে বলে,”আপনারা এসব কি বলেন?আমি তো থাকি এ বাড়িতে একটা দিনও তো কিছু দেখলাম না আর আপনারা বাহিরে থেকেই সবটা দেখতে পারলেন?”

পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না এনারা পাড়া প্রতিবেশি।একেকজনের কথার টিপ্পনী যে এতো নোংড়া ছিলো তা পাখির ধারনারও বাহিরে।রেগে গিয়ে পাখি বলে,”কি সমস্যা আপনাদের?আপনারা কি জানেন ডাক্তারের সাথে আমার কি সম্পর্ক?মানে, না জেনেই কিছু একটা বলে দিতে পারলে যেন বেঁচে যান। তাই না?”
“এই মেয়ে থামো, জ্ঞান দিতে আসবে না একদম”,পাশ থেকে বলে ওঠে একজন।
“তোমাদের মতো মেয়েদের জন্যেই পাড়ার ছেলেরা খারাপ হয়ে যায়।আচ্ছা তোমার কি লজ্জাবোধ বলতে কিছু নেই?বিয়ে ছাড়াই এভাবে!ছিহ ছিহ ছিহ”

চোখ মুখ শক্ত করে পাখি তর্জনী আঙ্গুল উচিয়ে বলে,”মুখ সামলে কথা বলবেন। আমায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো ভাববেন না যারা এসব কথা শুনে চোখের জল ফেলবে।অপরের ব্যপারে কিছু বলার আগে ভালো করে জেনে নিন।”
ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ একজন মহিলা কটাক্ষ করে বললেন, “তোমাদের মতো মেয়েরা নির্লজ্জ হয়;ঠিক তোমার মতোই”

পাখি কিছু বলতে যাবে তার আতে রাহেলা ওকে থামতে ইশারা করে। এরপর পূর্বের ঐ মহিলা আবার বলতে থাকেন,”কতোটা শেইমলেস তুমি ভেবেছো?একেতো বিয়ে ছাড়াই সংসার পাতছো, তারউপর আবার বড় বড় কথা।তা বলি, এসব এ পাড়ায় চলবে না মা।”

পাখি না পারছে রাহেলার কথার অমান্য করতে না পারছে মহিলাগুলোর বিশ্রী কথার সঠিক জবাব দিতে।
“কি হয়েছে”,ভরসন্ধ্যা বেলায় ড্রয়িংরুমে মহিলা সমাগাম দেখে কিছুটা ভরকে গিয়ে বলে শান।পুরুষালী মোটা স্বরে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় দরজার দিকে।উপস্থিত মহিলাদের মাঝে একজন সহাস্যে বলে,”আরে শান যে।তোমারই অপেক্ষা করছিলাম বাবা।”

“আস্সালামু আলাইকুম চাচি, আপনি!এ সময়!বসেন বসেন “,চোখেমুখে আভিজাত্যের রেখা, সকলের মধ্যমণি অত্র এলাকার চেয়ারম্যানের স্ত্রীকে দেখে সালাম বিনিময় করে শান বসতে বলে।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, বসতে আসি নি বাবা। কিছু কথা বলতে এসেছিলাম।এসে তো দেখি পরিবেশ একদম ভিন্ন।”,বলেই পাখির দিকে নোংড়াভাবে তাকাচ্ছিলেন তিনি।
শান পাখির দিকে একবার তাকাতেই বুঝতে পারে পাখির চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।ভ্রকুচকে সেদিকে চেয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে বাড়িতে কি হয়েছে।

“তা বলছিলাম কি, তোমার চাচা তো এলাকার অনেক গন্যমান্য মানুষ সহ তোমায় বলেছিলো তুমি শুনো নাই।তাই ভাবছিলাম আমরা ক’জন মহিলা মিলে মেয়েটাকে বুঝাই”,বলে পাখির দিকে ইশারা করে আবার বলেন,”কিন্তু তোমার বাড়ির আশ্রিতা এই মেয়ের তো বেশ উচু গলা দেখি”
শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না এনারা কি বলতে এসেছেন।সিনা টান করে মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনাদের কার কি বলার শখ আমায় বলুন?কি জানার আছে আমায় জানান?”
উপস্থিত সবাই একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে আর চোখের ভাষায় নোংড়া কিছু বোঝাচ্ছে।

“তাহলে বাবা সরাসরি বলি,এ পাড়ায় এসব চলবে না”,কাটকাট স্বরে বলে একজন মহিলা।
শান স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়, “আপনারা কতোটুকু জানেন? আর কি জানেন আমায় একটু জানাবেন?”

“আমরা যা’ই জানি। এ মহল্লায় তোমরা দুটো যুবক ছেলে মেয়ে একসাথে থাকতে পারবে না।অন্তত এসব নোংড়ামি আমরা মানব না।এটা আবাসিক এলাকা।তুমি ফ্ল্যাটের কোন ভাড়াটিয়া হলে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিলো না।বলতে গেলে তুমি স্থানীয়।তাই এসব বরদাস্ত হবে না এখানে”

মহিলাদের কথা শেষ হতে না হতেই পাখি শানের দিকে একপলক চেয়ে ছলছলে চোখে দৌঁড়ে উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।সবাই সেদিকে একবার চেয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে,”তুমি যদি চাও বিয়ে করে সংসার করতে পারো।তাহলে কেউ কিছু বলবে না কিন্তু এসব আমরা কেউ মানব না”
সবাই সমস্বরে বলে, “হ্যা মানব না।আমাদের সন্তানরা কি শিখবে এসব থেকে!”,
শান গম্ভীর মুখে বলে, “দেখছি কি করা যায়।”
মুখ ফিরিয়ে বলে, “আরো কিছু?কিছু বলার থাকলে বলুন নয়ত এবার আসতে পারেন”

“পাখি খেয়েছে চাচি”,ডিনার টেবিলে বলে শান।রাহেলা থমথমে মুখে জবাব দেয়,”সেই যে সন্ধ্যা বেলা ঘরে ঢুুকল আর বের হয় নি; কথাও বলে নি।শুধু ইনায়াহ্’র সাথে থেকেছে।ইনায়াহ্’র মনও খারাপ”
শান আর কিছু না বলে কিছু একটা ভাবনায় পরে যায়।
“একটা কথা বলব বাবা?”,শানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে উত্তরের অপেক্ষা করে রাহেলা।
“হুমম কি কথা চাচি?”

“বলি কি, এতো বদনামের থেকে ততুমি বরঞ্চ পাপাখিকে বিয়ে করে নাও।তোমরা দুজনে অনেক ভালো থাকবে”,রাহেলা ভয়ে ভয়ে বলে চুপসে যায়।
শান অবাক হয়ে যায়।কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”চাচি তোমার কি মাথা ঠিক আছে?আমি?আর বিয়ে?অসম্ভব”

“এভাবে কতোদিন চলবে তুমি। শোন সবার জীবনে একজন করে সঙ্গীর প্রয়োজন”
“আমার লাগবে না চাচি”,একরোখা জবাব দেয় শান।রাহেলা গমগমে স্বরে জবাব দেয়,”মেয়েটার তাহলে কি দোষ?ওকে কেন বিনা কারণে বদনাম কুড়াতে হচ্ছে!”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৮

“চাচি তুমি কি সবটা ভুলে গেলে?আমায় ছোটবেলা বড় করে তুললে আর আমার লাইফের ঘটনা গুলোই ভুলে গেলে চাচি?”,রাগ দেখিয়ে বলে শান।
রাহেলা স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয়,”আমি কিচ্ছু ভুলি নি। তবে তোমার জানার কিছু ভুল এখনো রয়েছে।”,
“আমার মৃত্যুশয্যাশায়ী বাবা মিথ্যে বলেছে, এটা বিশ্বাস করতে বলো আমায়,হুমমম?”,জোড়ে চিল্লিয়ে বলে শান।রাহেলা চুপ করে যায় শানের রাগের কাছে।

স্বগতোক্তি করে শান বলে,”আমি কোন মেয়েকেই বিশ্বাস করি না চাচি।তবে হ্যা, পাখির প্রতি কোন অন্যায় আমি হতে দেবো না।কারণ ও আলাদা।ও সম্মানের প্রাপ্য;ঘৃনার নয়”
রাহেলা সুযোগ বুঝে বলে,”ওকে যদি সম্মান করতে চাও তাহলে বিয়ে করে সম্মান দিও”
বলেই রাহেলা কপোট রাগ দেখিয়ে চলে যায়।
শান অবাক চোখে ভাবতে থাকে,”কিভাবে কি করব?মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কি করে বিশ্বাস করব তৃতীয় কোন মেয়েকে!হ্যা আমি পাখিকে ছাড়া থাকতে পারি না।মন শুধু পাখিকে দেখতে চায়।এটা যদি ভালোবাসা হয় তবে তাই।তাই বলে বিয়ে!”

রাতে ঘুমানো টা দায় হয়ে পরে শানের।বার বার রাহেলার কথাগুলো মাথায় ঘোরপাক খায়।সাথে সারদিনের ঘটা সমস্ত ঘটনা।ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ফোন করে ব্যারিস্টার রাশেদের কাছে।
“হ্যা ঐ কাগজপাতি গুলো রেডি হয়েছে না? হলে, ইমিডিয়েট আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন।”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২০