আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

রাত হয়েছে অনেক আগে।এলাকাবাসীরা চলে গেছে নিজেদের বাড়ি বাড়ি।পাখিদের পুরোনো বাড়ির বড় লিভিং রুম টা সাজানো হয়েছে তাদের ফুলশয্যার উদ্দেশ্যে।পাখির অবর্তমানে এ বাড়িতে রায়ানের রাসলীলা চলত তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না।চারদিকে মদের বোতল, নেশা জতীয় দ্রব্য,ইউজ্ড প্যাকেট সবই ছিলো। রানী মাসি কয়েকজন ছেলে মেয়ে সমেত বাড়িটা ঝকঝকে তকতকে করে দিয়েছে।বিয়ের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার পর থেকে শান পাখি এখনো কেউ কারোর সামনে যায় নি।ব্যারিস্টার সুমন তার সহযোগী সহ অনেক আগেই চলে গেছে।যাওয়ার সুযোগ শানেরও ছিলো কিন্তু সে যায় নি।কেন যায় নি তার উত্তরও শানের কাছে নেই।

বাড়ির পিছনে বাগান বাড়িতে বসার মতো বেঞ্চ পাতা আছে।পাখির বাবা শৌখিন গোছের লোক ছিলেন।মাঝে মাঝে সেখানে বসতেন তিনি আর প্রকৃতি উপভোগ করতেন।সে সময়ে সিমেন্ট দিয়ে সুন্দর করে কয়েকটা বেঞ্চ পাতিয়ে নেয় বাগানে।শান সাড়া বাড়ি খুঁজেও পাখিকে পায় না।এরপর বেঞ্চের একমাথায় এসে বসে।চাঁদের আলোয় আলোকিত চারদিক।ব্যপার টা মন্দ লাগছে না শানের।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বিয়েটা তো হয়ে গেছে কোনভাবেই হোক,চলে যাওয়ার সুযোগও ছিলো। তবে আমি থেকে গেলাম কেন?আর আমার মনে যে দ্বিধারর সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিলো তা নেই কেন?তবে কি আমিও চেয়েছিলাম বিয়েটা হোক!…..”
ভাবতে ভাবতে সামনে খানিক দূরে চোখ পড়ে শানের।বুঝতে পারে পুকুর ওটা।তবে কোন মেয়ে যে সেখানে বসা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।ভ্রুকুচকে ভাবতে থাকে,”এতো রাতে পুকুর পাড়ে কোন মেয়ে এভাবে কেন থাকবে!”

চাঁদের আলোর সাথে পাখিদের বাড়ির গেইটের লাইটের ক্ষীন আলোয় বুঝতে পারে ওটা পাখি।মনে কেমন যেন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।আগপিছ না ভেবে পা বাড়াতেই ফোনে কল আসে।রাহেলা বেগম ফোন করেছেন।
“হ্যা চাচি বলো! ”
“তুমি কি আজ আসবে না বাবা?”
“না চাচি, এখানে একটা কাজে আটকা পরেছি।ইনায়াহ্’কে একটু বুঝিয়ে রেখো।আমি কাল চলে আসব”
“আচ্ছা”

বলেই ফোন পকেটে রেখে দেয় শান।এরপর বাগান থেকে পুকুর পাড়ে যাওয়ার সরু রাস্তাটা ধরে রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে থামে।
খুব সাবধানে গিয়ে থামে পাখির পিছনে।সিমেন্টে বাঁধাই করা পুকুর পাড়।চাঁদের আলোয় পানিতে মুক্তা ঝড়ছে যেন।চারপাশটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাখির দিকে তাকায় শান।দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে মাথা ঠেকিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে পানিতে প্রতিফলিত চাঁদের আলোর দিকে।পাখির এই বিধ্বস্ত রূপ শানের হার্টের প্রতিটা বিটকে আরো দ্রুতগামী করে তুলছে।তার এই সময় কি করা উচিত বুঝছে না সে।

“পাখির সাথে কথা বলব?কি কথা বলব?নাকি বলব না!যেভাবে এসেছি সেভাবেই চলে যাই বরং”,দোটানা মন নিয়ে শান আবার পা বাড়াতেই পাখি ডেকে ওঠে।
“দাঁড়ান”

থমকে যায় শান।ও স্বরের কাছে নিজের ইচ্ছেশক্তি কিছুই না যেন!পা বাড়ানোর ইচ্ছে করছে না আর।
“সবকিছুর জন্যে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।আপনি চলে যান আমি ব্যবস্থা করছি “,শানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে খনখনে গলায় বলে পাখি।খুব শান্ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে শান তাকিয়ে আছে পাখির দিকে।
শানের থেকে প্রতিউত্তর না পেয়ে পাখি মাথা তুলে তাকায়।চোখে চোখ পড়তেই রাগে চোখ সরিয়ে নেয়।পাখির চোখ দেখে বোঝার বাকি থাকে না এতোসময় এখানে বসে বসে কেঁদেছে নে।কান্নার দাগ এখনো মুছে যায় নি।চাঁদের আলোয় বড় বেশি মোহনীয় লাগছে পাখিকে।নিজেকে নিজের মাঝে সংবরন করা দায় হয়ে পরছে শানের।চাইলেও আজ মনের লাগামহীন আবেগ গুলোর রাশ ধরতে পারছে না সে।পাখি সেদিকে আরেকবার চেয়ে বলে,”আমার জন্যে আপনার লাইফে কোন প্রবলেম হোক তা আমি চাই না। আপনি চলে যান এখান থেকে”

“তুমি?”,হঠাৎ প্রশ্ন করে শান।নিজের করা প্রশ্নে নিজেই অবাক হয়। ভাবতে থাকে,”আমি কি পাখিকে সাথে নিয়ে যেতে চাই?”
দাঁতে দাঁত পিষে পাখি বলে,”আপনার কাছ থেকে উপহার স্বরূপ অনেক কিছু পেয়েছি। আর কিছু চাই না আমার। এখানে যদি মরে পঁচে গলেও যাই তবু আপনার মতো মানুষের কাছে ফিরব না আর”
বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই ডান হাত ধরে হেচকা টানে পাখিকে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে শান।হকচকিয়ে ওঠে পাখি। শানের বুকের এতো কাছে নিজেকে ভেবে বুকের ল্যাবডাব শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুন।যেন বাহিরে থেকে শোনা যাবে।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে পাখি।

শান একহাতে পাখির কোমড় জড়িয়ে আরেকটা হাত খুব সন্তর্পণে কপালের উপর লেপ্টে থাকা চুল গুলো ছুঁয়ে দেয়।কেঁপে কেঁপে ওঠে পাখির পুরো শরীর।কারো মুখে কোন কথা নেই।
শান হাত টা কপাল থেকে নামিয়ে বাম গালটা দখল করে নেয়।শুকনো দুটো ঢোক গিলে চেয়ে থাকে পাখির পিটপিট করা চোখের দিকে।খুব ইচ্ছে করছে ও চোখের পাপড়ি গুলো ঠোঁটে ছুঁয়ে দিতে।

থমকে চেয়ে থাকে জোৎস্না স্নানে ডুবে থাকা নারী মুখের দিকে।কম্পনরত চোখজোড়া খুলে পাখি শানের দিকে তাকায়।শান কোমড়ে জড়ানো হাতটা উঠিয়ে আরেক গালে রেখে মুখটা আঁজলা ভরে তুলে ধরে।শানের পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে পেরে পাখি কেঁপে উঠে চট করে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। শান এগিয়ে যায় তাক করা পাখির ওষ্ঠযুগলের দিকে।
মূহূর্তে ঠোঁটের নিচের তিলটা জ্বলজ্বল করে চোখে ধরা পরে শানের।চোখের জ্বলুনি শুরু হয় তখনি।চোখদুটো বন্ধ করে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে শান।

“কি করতে চলেছি এসব? “ভাবতে ভাবতে অনুতাপের স্পষ্ট রেখা শানের চোখে মুখে ভেসে ওঠে।পাখি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে শান সরে গেছে দুই ইঞ্চি।পাখি করুন চোখে তাকাতেই শান গাল থেকে হাত সরিয়ে পিছনে ঘুরে আসতে ধরে।নিজের শার্টের কলারে টান ধরায় থেমে যায় শান।সাবধানে পিছন ঘুরে বুঝতে পারে পাখি শার্টের কলার চেপে ধরেছে পিছন থেকে।ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ ফেলে শান একবার পাখির দিকে আরেকবার নিজের কলারের দিকে চেয়ে দেখে।রাগত দৃষ্টিতে পাখি শানের দিকে তাকিয়ে থাকে।ভ্রু নাচিয়ে শান বলে,”কি?”

পাখি কিছু না বলে মাটিতে ভর দেয়া শানের দুই পায়ের উপর দাঁড়াতেই শান কিছুটা সরে যায়।স্বাভাবিক চাহনিতে চেয়ে পাখি শানের দিকে এগিয়ে যায়।এতোটাই কাছে চলে যায় যে পাখির মাথা গিয়ে ঠেকে শানের মুখের কাছে।চুলের সুগন্ধে মাদকতার ছোঁয়া শানকে নির্দিষ্ট স্থানেই বেঁধে রাখে।পাখি মাথা তুলে সন্তর্পনে শানের দুই গালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।দুইহাতে শানের মাথাটা নিচু করে কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়।হতভম্বের মতো পাখির কান্ড দেখে চলেছে শান।মাথার দুইপাশে হাত রেখে শানের আরো কাছে যেতেই পাখির হাতদুটো ধরে ফেলে সে।

“কি করছো এসব?”,কপোট রাগ দেখিয়ে বলে শান।পাখি শুকনো ঠোঁট দুটো জিহ্বায় ভিজিয়ে সম্মোহিত চোখে তাকিয়ে থাকে শানের দিকে।যে দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার সাধ্য কোন পুরুষের নেই।শান নজর সরিয়ে বলে, “ঘরে চলো”
পাখি নিরুত্তর হয়ে পা দুটা উচিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে শানের।নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শান।ফুফিয়ে কেঁদে ফেলে পাখি।জড়ানো গলায় মুখ গুঁজে কেঁদে কেঁদে বলে,”আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।আমি জানি আপনিও আমায় ভালোবাসেন।কিন্তু আপনি কারণে অকারণে আমাকে তাড়ানোর পায়তারা করেণ।কেন?কারণ কি?আমি কি এতোটাই খারাপ? ”

খুব করে ইচ্ছে করছে পাখিকেও তার হাতের শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলতে।কিন্তু শান নিরুপায়।হাতের মুঠি শক্ত করে নিজেকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে।পাখি আরো শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে শানের।শরীরের দুইপাশে এলানো শানের হাত দুটো নিজের পিঠে ধরিয়ে দিয়ে আবার বলে,”আমি চাইনি এভাবে আমাদের বিয়েটা হোক।যেহেতু হয়ে গেছে আর কি করার থাকে বলুন!পৃথিবীর সবথেকে ভালো বউ হবো আমি, প্রমিজ”
শান না চাইতেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।নিজের এতোটা কাছে পাখিকে বুঝতে পেরে আবেগ গুলো আর সংবরন করতে পারে না।মুখ গুঁজে দেয় পাখির ঘাড়ের উপর এলিয়ে দেয়া চুলের ভাঁজে।প্রতিটা স্পর্শেই নতুন এক পাখিকে আবিষ্কার করে পাখি।দুহাতে আরো শক্ত করে জড়াতেই শান সিটকে সরে আসে আরো দুহাত পিছনে।

পাখিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত চলে আসে বাড়ির পথে।পাখি সেদিকে চেয়ে নীরব অশ্রু বিষর্জন দিয়ে ভাবে,”ভালোবেসেও কেন এতো দূরত্ব আজ?কী সে কারণ যা আমার থেকে আপনাকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে?”
চোখ মুছে বিড়বিড় করে বলে,”আপনার অনুভূতি আমি বুঝেছি ডাক্তার সাহেব, আমার অনুভূতিও বুঝিয়েছি এরপর আর দূরত্বটা সহ্য হচ্ছে না।কবে সবটা জানতে পারব! তবে কথা দিচ্ছি লুকানো যে কারণই থাকুক তা আপনার জীবন থেকে চিরতরে মুছে দেবো আমি”
এরপর রাত গভীর হওয়ায় পাখিও চলে আসে বাড়ির ভিতর।

বাড়িতে ঢুকে চারপাশ তাকিয়ে কোথাও খুঁজে পায় না শানকে।কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে যায় পাখির।অজানা ভয় চেপে ধরে পাখিকে।
“আয়ান ভাই তার কোন ক্ষতি……
না না কি ভাবছি এসব?কেন খারাপ ভাবছি? ”
বলতে বলতে বাড়ির বাহিরটাও খোঁজে পাখি।কোথাও পায় না শানকে।চিন্তিত মলিন মুখটা নিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ভাবে,”আমায় রেখে চলে গেলেন! ”
ভাবতেই দুচোখের কোণ ভরে ওঠে।

“হ্যা হ্যা, ওটাই করুন।আর আমি কালকেই পৌঁছাচ্ছি।নো প্রবলেম।”, পাশের ঘর থেকে শানের গলার আওয়াজে চমকে ওঠে পাখি।দ্রুত উঠে সে ঘরে যেতে বুঝতে পারে শান জানলার একদম কাছ ঘেঁষে ফোনে কথা বলছে।কথা বলা অবস্থায় পাখির দিকে একনজর তাকিয়ে পূনরায় বাহিরে তাকাতেই হঠাৎ কানেকশন ফেইল্ড হয়।মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে শান বিড়বিড় করে, “ক্ষ্যাতমার্কা এলাকা,নেটওয়ার্ক নাই কিছু নাই”
শানের কথায় পাখি ফিক করে হেসে দেয়।শান ওর দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে আবারও নেটওয়ার্কের খোঁজে ফোনটা জানলার ভিতর-বাহির করে।

ব্যর্থ হয়ে দরজার কাছে চলে আসতেই পাখি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।এক ইঞ্চিও নড়ে না।শান সন্দিহান চোখে সেদিকে একবার চেয়ে আবার পাশ কাটাতেই পাখি সেপাশে সরে যায়।বুকে দুহাত গুঁজে ভ্রু নাচায় পাখি।শান বিরক্তিমাখা মুখে বলে,”সরো, যেতে দাও”
“আটকাইছি কখন।আর দানবের মতো এই শরীর আটকাবার সাধ্য আমার মতো আটান্ন কেজি মানুষের নাই।হুহহ”

শান পাখির মতিগতি বুঝতে পারছে না।হঠাৎ পরিবর্তন শানকে দোটানায় ফেলে।
একহাত দিয়ে পাখিকে সরিয়ে দিতেই পাখি ফট করে শানের বাম গুলে চুমু এঁকে দিয়ে নিজেই সরে যায়।
শান হা করে গালে হাত রেখে কিছুক্ষন বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর পাখির পিছু পিছু এগিয়ে বলে,”কি করলা এইটা?”

পাখি ভাব নিয়ে ঘরের এতোদিনের পুরোনো জিনিস গুলো ছুঁয়ে দেখে।
পাখির গা ছাড়া ভাব দেখে শানের রাগ উঠে যায়।হাতটা টেনে নিজের মুখোমুখি করে বলে,”ঢং ছাড়ো। একটু আগে কি করলা এইটা?”
“কি করছি”,ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে পাখি।
“কি করছো মানে, একটু আগে আমার গা….”
বলতেই শান বন্ধ হয়ে যায়।

“গা……কি ডাক্তার বাবু?”,অবুঝ হবার ভঙ্গিতে বলে পাখি।
শান মুখটা সামান্য বাঁকিয়ে ভাবুকের ন্যায় চেয়ে থাকে।
“কি হলো বলুন!গা….কি?”,শানের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে পাখি।
শান পিছনে মাথাটা হেলিয়ে সরুচোখে চেয়ে বলে,”কিছু না”

স্বগতোক্তি করে তর্জনী আঙ্গুল উচিয়ে বলে,”এরকম দূঃসাহস আর দেখাবে না।ফল ভালো হবে না”
“একশ বার করব, হাজার বার করব। আগে করতে পারতাম না কারণ আগে বর ছিলেন না।এখন হাজার বার করব।আমার বর, আমার অধিকার”,শানের চোখে চোখ রেখে একরোখা জবাব দেয় পাখি।সে চোখের মায়া বড্ডো বিষাক্ত লাগে শানের কাছে, যেন ও চোখে তিলে তিলে গড়ে তোলা নিজের অহমিকা ধ্বংসের আহ্বান দেখতে পায় শান।

নজর সরিয়ে বলে,”এরকম ভাবে কোন বিয়ে হয়!ধরে বেঁধে বিয়ে!আমি মানি না এ বিয়ে”
শানের কথাটা বুকের কোথাও গিয়ে লাগে পাখির।নিজেকে সংবরন করে বলে,”যেভাবেই হোক হয়েছে তো!”
শান মিছে রাগ দেখিয়ে পাখিকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পাখি এগিয়ে এসে বলে,”এখন আপনার চৌদ্দগুষ্টি মানবে”
“সরো,সরো বলছি “,রাগ দেখিয়ে বলে শান।
রাগত স্বরে কথাটা বললেও আগের মতো রাগ বা অপমান করার মনমানসিকতা শানের চোখে খুঁজে পায় না পাখি।সাহস যুগিয়ে বলে, “আপনি চাই মানুন,চাই না মানুন আমি আপনার স্ত্রী। কথাটা মগজে গেঁথে নিন”
বলেই সরে আসে পাখি।

জোৎস্নাকে আড়াল করে বৃষ্টির আলাপন।ঝুম বৃষ্টিতে চারপাশ টিপটিপ করছে।ফুলসজ্জারর খাটে শান একা শুয়ে আছে।সাহস আর লজ্জা ভুলে শানকে জড়িয়ে ধরা বা কিস করা গেলেও সারারাত এক বিছানায় থাকার কথা ভাবতেই কেমন যেন লাগে।তাই রাতটা পাশের ঘরে থাকার চিন্তা করে পাখি।
এ ঘরে বিছানায় শুইতে ছোটবেলার হাজার স্মৃতি মানষপটে ফুটে ওঠে।স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে পাখি বুঝতে পারে ঝুম বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।হঠাৎ বাজ পরার বিকট শব্দে পাখি জোড়ে চিল্লিয়ে কান চেপে ধরে। ভয়ে বুকটা ধকধক করে তার।পাখির আকষ্মিক চিল্লানোতে শান ছুটে আসে।হন্তদন্ত হয়ে বলে,”কি ,কি হয়েছে তোমার?”

মাথা তুলে পাখি মিনমিন করে বলে, “ককিছু না”
“তাহলে চিল্লাইলা কেন?”
“এমনি”
পাখির কথায় শান আবার ফিরে যেতে আরেকটা বাজ পরে পাখি বিছানা থেকে তিড়িং করে লাফ মেরে মেঝেতে শানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়।শানের বোঝার বাকি নেই কিসে ভয় পাচ্ছে পাখি।মুচকি হেসে নেয়।পাখি তাকাতেই সে হাসি নিজেতে মিলিয়ে নেয় শান।মাথাটা একটু নিচু করে বলে,”উইপোকা চেনো?”

পাখি বুঝতে পারে না হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ কি!কোন উত্তর না করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।শান আবার বলে,”উইপোকার মুখ শক্ত থাকে আর বাম নরম।শক্ত মুখটা দিয়ে কি কি’ই না নষ্ট করে। হাতে নিয়ে দেখো ওর বাম কতোটা নরম।তুমি হচ্ছো সেই উইপোকা।মুখে বড় বড় কথা খালি”
বলে শান চলে যায় পাশের রুমে।
পাখি চোখ মুখ কুচকে বলে,”আমি উইপোকা!আমার মুখ শক্ত আর বা……”
রাগে গজগজ করে শানের ঘরে এসে বলে, “আমি মোটেও উইপোকা নই।ঠিকাছে?”

“হুম বুঝলাম।এবার লাইট অফ করে চলে যাও”
পাখি রিনরিনে স্বরে বলে, “ও ঘররে পানি পরে”
শান বেশ বুঝতে পারে পাখি কিসের ভয়ে ও ঘরে যেতে চাইছে না।
কপোট রাগ দেখিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,”তো তুমি কি এ ঘরে থাকার প্ল্যান করছো?”
পাখি অসহায়ের মতো মুখটা করে তাকায়।
“আর তুমি মিথ্যে বলছো কেন?কই পানি পরে।তোমার বাবা বেশ পোক্ত কাজ করেছেন; বুঝা যায়।এ ছাদ ফুটো হতে মিনিমাম আরো পঞ্চাশ বছরের দরকার”
তাই ঢং না করে ও ঘরে ঘুমাও গিয়ে।

পাখি বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায় না।শান ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”লাইট অফ করে চলে যাও। ঘুমাব আমি।কাল সকালে এখান থেকে বের হতে পারলে যেন বাঁচি”
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বলে শান।তবুও গিয়ে পৌঁছায় পাখির কানে।রাগে এগিয়ে এসে বলে,”কে থাকতে বলেছিলো আপনাকে?ঢং করছেন এখন”
শান আর পিছু ফিরে তাকায় না।চোখ বন্ধ করেই শুয়ে থাকে।
বিড়বিড় করতে করতে পাখি বিছানার একদম একপাশে ভয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে পরে।তড়িৎগতিতে শান বলে ওঠে,”হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিজ!তুমি এখানে কেন?”

“বর যেখানে, বউ সেখানেই থাকবে।আর আজ আআামাদের ফুলসজ্জা”
“তোহ!”
“তো আবার কি, আমি এখানে ঘুমাব ব্যাস”,ঝনঝনে গলায় জবাব দেয় পাখি।শান কিছু বলতে যাবে তার আগে বেড সুইচ টিপে পাখি ঘর অন্ধকার করে নেয়।
“সাহস দেখিয়ে শুয়ে তো পরলাম, যদি অধিকার ফলায়! আর ও ঘরে একা আমি পারব না থাকতে”, ভাবতে ভাবতে ঠোঁট উল্টে ফেলে পাখি।
শান কিছু বলতে চেয়েও পারে না।কারণ বেশ বুঝতে পেরেছে পাখি বজ্রপাতে ভয় পাচ্ছে।চুপচাপ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল সকাল শান রেডি হয় ঢাকা ফেরার উদ্দেশ্যে।খাবারের জন্যে অনেকবার জিদ করলেও রানী মাসির জিদকে রাখতে পারে না শান।আশ্বস্ত করে বলে, “পরে আসব কোন একসময়।”
শান রেডি হয়ে রানী মাসিকে বলে,”পাখি এখানে থাকুক।ওর যা যাবতীয় খরচ আমি বহন করব।আপনারা ওকে দেখে রাখবেন।আমার পক্ষে ওকে নিয়ে সাথে রাখা সম্ভব নয়”
রানী মাসি অবাক হয়ে বলে,”এ কেমন কথা? বিয়ে করলে কাল আর আজ রেখে যাচ্ছো বাবা!”

“বিয়েটা জোড় করে দেয়া হয়েছে।এতে আমার কোন ইচ্ছে ছিলো না”
“হাজার হোক, তারপরেও তো।কিভাবে দেখে রাখব ওকে আমি। তুমি আয়ানকে চেনো না তাহলে। পাখিকে জ্যান্ত মেরে ফেলবে সে”,ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কথাগুলো বলে রানী মাসি।
শান অনেক ভেবে বলে,”কিচ্ছু হবে না। কোর্ট থেকে আমি কাগজ নিয়েই এসেছি।পাখির কিছু করতে পারবে না ওরা”,

বলেই শান আর এক মূহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে আসে।পাশের ঘর থেকে সম্পূর্ণ কথা শুনে পাখি চোখের জলটা মুখে বলে,”নিয়ে তো আপনি যাবেনই।আমি আপনারই সংসার করবো এটা ফাইনাল।আমার জন্যে জমানো ভালোবাসাটা একদিন আমি ঠিকই আদায় করে নিবো”
চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে পাখির।
শান দ্রুত এসে চাবি নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে সিট বেল্ট বাঁধতে পাখি রানী মাসির থেকে বিদায় নিয়ে দৌড় দেয়।গাড়ির দরজা খুলে বসে পরে সিটে।

“চলুন চলুন, তাড়াতাড়ি যেতে হবে তো”,বলতে বলতে সিট বেল্ট বাঁধার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয় পাখি।শান ভ্রু কুচকে সানগ্লাস টা নামিয়ে বলে, “তুমি!তুমি কোথায় যাচ্ছো,ড্যাম ইট?”
“ওমা, বিয়ে হয়েছে আমি স্বামীর ঘরে যাবো না।”
“পাখি দিস ইজ টু মাচ”,চোখ মুখ বন্ধ করে বলে শান।
“আমি যখন ভেবেছি যাব তখন যাবোই। কিছুদিন থেকে আবার চলে আসব”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২০

শান বুঝতে পেরেছে একে আটকানো মানে নিজের সময় অপচয় করা।কারণ সে কোনভাবেই মানবে না কোন কথা।
স্টেয়ারিং এ হাত রেখে বলে,”যাবে ভালো কথা।কাউকে ঘূনাক্ষরেও বলতে পারবে না আমাদের বিয়ের কথা।রাজি?”
মনটা বিষিয়ে ওঠে পাখির।কোনমতে নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,”রাজি।তবে আবার যদি সবাই বাজে কথা বলে?”

“সেটা দেখার বিষয় আমার না।তুমি যদি বাজে কথা,বদনাম সহ্য করে থাকতে চাও তবে তোমার ইচ্ছে”,তেড়ছাভাবে বলে শান গাড়ি স্টার্ট করে।
পাখি হাফ ছেড়ে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে,”আগে তো যাই তারপর দেখা যাবে।সবার মুখে টেপ মেরে দিবো”
“যা বলার জোড়ে বলো”,গাড়ি চালাতে চালাতে বলে শান।
অবাক হয়ে পাখি বলে,”শুনলেন কি করে?”
শান কিছু না বলে স্মুথলি ড্রাইভ করে চলে।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২২