আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪২

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“কি এইটা?”,মুখে হাসি, মনে সংশয় দ্বিধান্বিত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে শান।
পাখির পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শানের দিকে একবার দেখে চোখ মুখ কুচকে নেয়।আবারও বমি বমি আসে পাখির;কিন্তু বমি হয় না।
মুখটা কুচকানো রেখে কম্পিত স্বরে বলে,” আআমি প্রেগন্যান্ট ”

কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে শানের দিকে তাকায়।এদিকে চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে পাখির। একটু পরে কি হতে চলেছে সেটা ভেবেই পাখির হাত পা হিম হয়ে আসে।হাত দুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজেকে সংবরনের চেষ্টা করে ।
ভয়ে ভয়ে শানের দিকে দ্বিতীয় দফায় তাকায়।বোঝার চেষ্টা করে এই মূহূর্তে শানের মনে কি চলছে!
“কি বলছো?বুঝতে পারি নি তো জান”, খুব শান্ত কন্ঠে দৃষ্টি স্থীর রেখে প্রশ্ন করে শান।
পাখি আগেপিছে না ভেবে পা উচিয়ে শানের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।হারানোর ভয় বড্ডো জেঁকে ধরেছে তাকে।এদিকে শানের কোনই প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারছে না সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাঁধ ভিজিয়ে গলা জড়ানো অবস্থাতেই বলে,”আমি কারোর সাথে কিচ্ছু করি নি ডাক্তার সাহেব।আপনি ব্যতিত কারোর সংস্পর্শে আসি নি আমি।কিভাবে কি হলো আমি কিচ্ছু জানি না।আমার খুব ভয় করছে,খুউউউব”
শান খুব সন্তোর্পনে পাখিকে এনে সোফায় বসায়।পা যেন চলছে না তার তবুও জোড়পূর্বক হেঁটে পট থেকে পানি ঢেলে গ্লাস এগিয়ে দেয় পাখির দিকে।অনবরত চোখের পানি মুছে চলেছে পাখি।সামনে আগত গ্লাস টা থাবা মেরে নিয়ে পুরো পানি টা গিলে ফেলে।

“এবার, বলো তো জান একটু আগে কি বলছিলে?প্রেগন্যান্ট না কি যেন বলছিলে?কে প্রেগন্যান্ট? “, পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিয়ে বলে শান।
মাথা তুলে পাখি শানের চোখে চোখ রেখে বলে, ” আআমি”

হঠাৎ বুঝতে পারে মাথার উপর থেকে হাতটা খুব সাবধানে নেমে গেলো।পাখি হাতের দিকে দেখে শানের দিকে চোখ রাখে।শান একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে,আরেকবার বিছানার দিকে তো কখনো কাবার্ডের দিকে।এক কথায় সে কোনদিকেই দৃষ্টি স্থীর রাখতে পারছে না।ঠোঁট দুটো গোল করে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ে।ডান হাত দিয়ে পুরো মুখটা মুছে নেয়।এরপর পাখির দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়।
এই দৃষ্টি যেন ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে প্রস্তুত পাখির জরাজীর্ণ তনুমন।
ডান হাত টা বাড়িয়ে শানের বাম গাল ছুঁতেই শান উঠে দাঁড়ায়।পাখি চট করে সোফা থেকে নেমে শানের পায়ের কাছে বসে পরে।

“বিশ্বাস করুন,আমি কারোর সংস্পর্শে যাই নি”
কান্নার শব্দ টা আর মুখ ফুটে বের হচ্ছে না পাখির। কেমন যেন কন্ঠনালীর কাছে দলা পাকাচ্ছে আর গা গুলিয়ে বমি আসছে।হঠাৎ বুঝতে পারে সে হাওয়ার উপর ভাসছে।হকচকিয়ে নিজের দিকে তাকায়।বুঝতে পারে শান তাকে কোলে তুলে নিয়েছে।পাখি কিছু জিজ্ঞেসা করার পূর্বেই শান ওকে বিছানায় খুব সাবধানে শুইয়ে দেয়।

কোন প্রকার কোন বাক্য ব্যয় না করে আদ্র ঠোঁট দুটো ঠেকিয়ে দেয় পাখির কপালে।পাখি ভয়ে বিছানার চাদর খামছে চোখ মুখ খিঁচে রাখে।কপালের উপর দুফোটা গরম জল পরতেই চোখ মেলে তাকায় পাখি।শান তখনও নিশ্চুপ থাকে।এভাবেই চলে যায় কিছুটা মূহূর্ত।
শান উঠে বাম হাতের উল্টো পিঠে নাকটা মুছে নেয়।চোখ দুটো মুছে নেয় খুব সাবধানে।লাল টসটসে চোখ দুটো দেখে অবাক হয় পাখি।বুঝতে অসুবিধা হয় না কান্না সংবরন করছে তার ডাক্তার সাহেব।কিন্তু শানের কোন অনুভূতিই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

হঠাৎ করে শান এগিয়ে গিয়ে পাখির সারামুখে অজস্র চুমু এঁকে দেয়।সদ্য গোসল নেয়া চুল গুলো থেকে শ্যাম্পুর ঘ্রান পাখির নাকে গিয়ে ঠেকে।সে গন্ধে ভিতর থেকে উল্টি আসে।নিঃশ্বাস আটকে রাখে কিছুক্ষন।
“আআপনি এএমন ককরছেন…..?”,কম্পিত দ্বিধান্বিত কন্ঠে মাত্র তিনটা শব্দই মুখ দিয়ে বের করতে পারে পাখি।বাকি কথা শেষ না হতেই শান একটা কান্ড করে বসে।
পাখির বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে;চুপচাপ থাকে।

” আমার কেমন যেন লাগছে জান!আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, ওহহ না না খুব হাসতে ইচ্ছে করছে….উফফ আমার কি যেন করতে ইচ্ছে করছে”,নিজের মাঝে এই মূহূর্তে কোন অনুভূতির উদয় হয়েছে তা শান বুঝতে পারছে না।আবোল তাবোল বকে চলেছে।
পাখি হাত উঠিয়ে শানের চুলে হাত দিতেই মাথাটা তোলে শান।
“সরি সরি সরি, আমি তো বুঝতে পারি নি, এখন তো এখানে কেউ একজন আছে”, অপরাধীর মতো দৃষ্টি করে পাখির পেটে হাত রেখে বলে শান।

ঠোঁটে হাসি অথচ চোখের কোণে চিকচিক করছে জলের কণা, দুই তিনবার নাকে ছিঁচকে শব্দ করে শান পাখির দুই বাহু ধরে খুব সাবধানে উঠিয়ে বসায়।পাখি যেন একদলা তুলোর স্তুপ।
পাখি কিছুই ঠাওর করতে পারছে ন। শুধু অবুঝের মতো শানের পাগলামি দেখে চলেছে।
” কি দেখছো ওভাবে?আরে আমি আজ পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি।তুমি জানো না পাখি আমার মনের মাঝে আজ কতো আনন্দ ঢেউ খেলছে।আমি বাবা হবো জানপাখি, এর থেকে আনন্দের আর কি আছে”,বলতে বলতে পাখিকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।
পাখি তখনো নির্বাক।এতোক্ষনের আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস টা ছেড়ে পাখি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,”আপনার রিপোর্ট যে…..”

“ওসব ভুয়া ”
“জানতেন?”
“এই যে এখন জানলাম”
“মানলেন,আর বিশ্বাস?করলেন?”
“এ পৃথিবী মিথ্যের আবরনে ঢেকে যাক, তোমার তুমিটা শুধু সত্যি হয়ে বেঁচে থাক।এই আমি তুমিটাই বেছে নেবো।”

স্বগতোক্তি করে শান বলে,”পূর্বেই বোঝা উচিত ছিলো রিপোর্টে হয়ত কোন প্রবলেম আছে।জানো পাখি বাবাটাকে এতো ভালোবাসতাম, এতো বিশ্বাস করতাম যে আর কখনোই নিজের অক্ষমতাটা খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করি নি।তবে আজকের মিথ্যেটা আমায় পৃথিবীর সর্বসুখ এনে দিয়েছে।”
পাখি শক্ত করে শানের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আরে আরে কাঁদছো কেন? এই সময় কান্না করা যাবে না তো….দেখি তো মুখটা “, বলতে বলতে শান পাখিকে নিজের থেকে ছাড়াতে নিলে পাখি আরো শক্ত করে ধরে নেয়।
শান আর কিছু না বলে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

” আমি আমি মনে করেছি, আপনি আমায় ভভুল বুঝবেন।আর তারপর, তারপর আমায় আপনার থেকে আলাদা করে দিবেন”,হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে পাখি।
“এতোটা নোংড়া মাইন্ডের ভেবেছো আমায়?অবিশ্বাস করব! তাও তোমায়?
আরে জান তুমি তো আমার মরুর বুকের তপ্ত বালিতে এক পশলা বৃষ্টি,
তুমি যে স্রষ্টার অনন্য এক সৃষ্টি।

যে সৃষ্টিতে আমার সকল সাধনার তুষ্টি
আমার মতো পথহারা পথিকের অন্ধকার রাতের আলোকবর্তিকা হাতে মহীয়সী নারী তুমি…..তুমি ভুল হলে তো আমার পুরো জীবনের মানেটাই ভুল”
শানের কথায় যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায় পাখির।শান মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,”এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে পাখি।এভাবে কান্না করা যাবে না তো”

পাখি খুব কষ্টে নিজেকে সংবরন করে নেয়।কান্নার বেগ কমে এলে শান ওকে আস্তে করে আগের স্থানে বসায়।দুহাতে চোখ মুছিয়ে বলে,”এই কারণেই চেহারা খারাপ হচ্ছে,আমাকেও কাছে সহ্য করতে পারো না, তাই না?ইশ!প্রেগন্যান্সির এতো স্পষ্ট সিমটম গুলো কি করে আমার নজর এড়ালো?”
বলতে বলতে শান নিজেকে দোষারোপ করে।
কি যেন একটা মনে হতেই শানের ভ্রুতে ভাঁজ চলে আসে।পাখির মুখটা তুলে বলে,”এই তোমার না গত মাসে….. ”

“সবাই বলেছে এরকমও নাকি হয় কারোর কারোর ক্ষেত্রে”, হেঁচকি তোলা কন্ঠে বলে পাখি।
” সবাই বলতে!”
“মা, চাচি,রাখি,রেহানা ম্যাম ”
“তারমানে সবাই জানে! ”
“কাল বৈঠকের পর আপনি হসপিটালে চলে যান। তখন আমার খুব বমির চাপ আসে। মা চাচি বুঝে যায় সবটা।তার পর বাকি আরো অনেক কিছু আমার থেকে জেনে নেয়”

শান উঠে দাঁড়ায়। একহাত কোমড়ে আরেকটা হাত কপালে স্লাইড করতে করতে বলে,”আমার বাচ্চা আমি জানি না অথচ বাড়ির সবাই জানে।ছিহহ, কতোটা কেয়ারলেস হয়ে গেছি আমি”
চট করে পাখির পাশে বসে বলে,”এরকম টা যে হয় না তা নয়, হয় তবে অনেক রিস্ক হয় জান”
পাখি জবাবে একটা অনুভূতিহীন চাহনী উপহার দেয়।
শান আবারও বলে ওঠে, “কাল তোমায় ডাক্তারের কাছে নিবো”
ভ্রু কুচকে যায় পাখির।

“কি ভাবছো? তোমার বর ডাক্তার অথচ অন্য ডাক্তারের কাছে কেন নিতে চাইছে!তাই তো?”,পাখির মুখোভাব দেখে বলে শান।
মাথা উপর নিচ করে পাখি হ্যা সূচক জবাব দেয়।
” একজন ডাক্তার হিসেবে না, একজন পেশেন্ট হিসেবে তোমায় অন্য ডাক্তারের কাছে নিবো।ইদানিং ডাক্তারের দায়িত্বে বেশি সময় দিতে দিতে এটাই ভুলে গেছি আমিও কারো হাজব্যান্ড।শেইম অন মি”,মুখটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে একা একাই বিড়বিড় করে শান।

পাখি উঠে এসে কাঁধে হাত রাখে।শান পিছু ফিরে হন্তদন্ত হয় বলে,”আরে নামছো কেন তুমি?এ সময় তোমার পুরো বেড রেস্টে থাকতে হবে।নিয়মে কোন গাফিলতি আমি সহ্য করব না পাখি।”
পাখিকে আবারও বিছানায় বসিয়ে দেয়।হাত দুটো মুঠোভরে নিয়ে পর পর কতো গুলো চুমু খেয়ে বলে,”আমার লাইফের বেষ্ট ডে ছিলো তোমায় আপন করে পাওয়া আর আজকের পর থেকে আজকের দিনটা বেষ্ট দিন হিসেবে স্মৃতির পাতায় লেখায় থাকবে।আমার কিছুই চাই না পাখি শুধু বাবা ডাকটা শুনতে সহায্য করো আমায়”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪১

শেষের কথাটা বেশ অনুনয়ের স্বরে বলে শান।
পাখিকে কিছু বলতে না দিয়ে আবারও বলে ওঠে,”এই চাওয়াটাকে দাফন করে রেখেছিলাম আজ আবারও সেটার জানান দিচ্ছে মনের মাঝে।প্লিজ জান আমার বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনো”
বলতে বলতে কন্ঠ ভারী হয়ে আসে শানের।
পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বলে,”ইন শা আল্লাহ্”

“হ্যা আম্মা, ঘুমাইছো?”
“নারে বাবু… বল”
“আম্মা আমি বাবা হবো আম্মা”,উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে শান।
শর্মিলা ছেলের খুশিতে ভীষণ খুশি আজ।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,” জানি বাপ।”
“আম্মা আমার কি যে খুশি লাগছে কি করে বোঝাই!”
“শোন, বউ মাকে বিশ্রামে রাখবি সবসময়।সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠানামা করতে দিস না”, ধমকের স্বরে বলে শর্মিলা।

” আম্মা আমি ডাক্তার।ভুলে গেছো?”
শর্মিলা নিঃশব্দ হেসে দেয়। এরপর টুকিটাকি কথা বলে কল কেটে দেয় শান।
পাখির দিকে এগিয়ে শান বলে, “সকালটা তোমার জন্যে অনেক উপহারের ডালা নিয়ে বসে আছে জান।”
পাখি প্রশান্তি ভরা চিত্তে শানের দিকে তাকায়।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৩