আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৮

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“এইইই পাখি, এইই…এই উঠো… কি করে তুমি এমন করতে পারো!”,
পাখির দুইগালে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকিয়ে বলে শান।এরপর দ্রুত পাল্স চেক করে নেয়।কিছুটা আশা মনের মাঝে তখন নতুন করে সঞ্চার হয়।ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটে শানের।পকেট হাতরিয়ে ফোন করে হসপিটালে।

“ইমারজেন্সি কেবিন রেডি করো, কুইক।আর ডক্টর আনভীরকে বলো নাইট শিফট তার ,এই মূহূর্তে।”
দুইহাতে পাখির মুখের উপর থেকে রক্ত গুলো মুছে দেয়।নিথর একটা দেহ যেন কোলের উপর পরে আছে।অনবরত চোখের পানি ঝড়ছে শানের।প্রিয়তমার বিষাদের নীলে কোন পুরুষের এমন কান্না কি সাজে? নাকি ভালোবাসার বেলায় আবেগের কাছে পুরুষরাও ব্যর্থ মাঝে মাঝে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চোখরের পানি মুছে কপালে, গালে, ঠোঁটে অজস্র চুমু এঁকে দেয় পাখির।এরপর রক্তাক্ত শরীরটা কোলে উঠিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে আসে বাড়ির বাইরে।গাড়িতে খুব সাবধানতার সাথে পাখিকে শুয়ে দেয়।কেমন যেন কষ্টকর,দম বন্ধকর একটা পিরিস্থিতি তৈরী হয়।

রাগে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে বাড়ির সকলের কথা ভেবে।গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করে এগিয়ে যায় গেইটের কাছে।কয়েকবার হর্ণ দিয়েও সালামের কোন খবর পায় না শান।গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”তোমায় তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি।নিমোকহারামির পরিনাম তোমাকে পেতে হবে”
এরপর নিজেই গেইট খুলে দিয়ে আবার গাড়িতে বসে।

“কি হয়ে গেলো রাহেলা,রান্নাঘরে এতো রক্ত কিসের। বাবু তো সেন্টার থেকে বের হয়েছে। ও কি বাড়িতে এসেছিলে?বাড়ির সব দরজা খোলা কেন?আমার বউ মা ঠিক আছে তো?”

বাড়ি থেকে শানের বেড়িয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ির সবাই ফিরে আসে বিয়ের সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করে।বাড়ি এসে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে রক্তের স্তুপ দেখতে পায়।রাহেলা রান্নাঘরে ঢুকেই দেখে সেখানেও রক্তের ছড়াছড়ি।কিচেন ডেস্ক থেকে তখনো তাজা রক্ত চুয়ে চুয়ে পরছে।আঁতকে উঠে চিৎকার করে রাহেলা।সকলে এসে দেখে ভয়ানক এক পরিস্থিতি।সবার মাঝে চাপা একটা আতঙ্ক কাজ করছে।রাখি এসছে থেকে হেঁচকি তুলে কাঁদছে মেয়েটা।আর বার বার দুজনের কাটানো মূহূর্তগুলো ভাবছে।

“সব ঠিকাছে তো!”,আহত চিত্তে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে সোফায় গা এলিয়ে দেয় খান সাহেব।
শর্মিলা সেটা শুনে আবারও বলে,”কিচ্ছু ঠিক নাই গো, কিচ্ছু নাই।আমার বোঝা হয়েছে। রনি আমার ছেলে বউমা কোথায় রনি।একটু খোঁজ নে বাপ”
বলতে বলতে কেঁদে ওঠে শর্মিলা।

এমন একটা পরিস্থিতি কেউ কাউকে সামলানোর মতো নেই।রাহেলা রক্তের ঘনত্বে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে বাড়িতে কি ঘটেছে।একধ্যানে চেয়ে থাকে মেঝের দিকে।
রনি বিষন্ন মুখে শানের নম্বর ডায়াল করে।তখনো চলন্ত গাড়িতে শান।একবার পিছনে শোয়ানো তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখছে কখনো সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে।হঠাৎ ফোনে কারো কল আসায় বিরক্ত হয়ে যায় শান।ইচ্ছে করেই ফোনটা দেখে না কল রিসিভ তো দূরের কথা।তার কাছে পাখিকে মেডিকেলে দ্রুত নিয়ে যাওয়াই মূখ্য।

এদিকে রনি অনবরত কল করেই যাচ্ছে।
আর কিছুক্ষনের মাঝেই পৌঁছে যায় মেডিকেলের গেইটে।গেইট দিয়ে ঢুকে গাড়ি পার্ক করে রাখে শান।গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে ফোন হাতে নিয়ে রনির কল রিসিভ করে।
“হ্যা হ্যালো, হ্যালো ভাই কই তুমি?ভাবি কই? পাইছো ভাবিকে?”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে রনি।
শান স্থীর দৃষ্টিতে অন্যদিকে চেয়ে বলে,”মেডিকেলে, তোর ভাবিকে নিয়ে…”
এটুকু বলেই কল কেটে দেয় শান।

গার্ডকে হাত ইশারা করে কাছে ডেকে নেয়।
“শোন এখন আমি তোমায় যা করতে বলব ঠিক তাই করবে…আর এই একটা কথাও যদি কোথাও লিক হয় তাহলে তোমার চাকরির রফাদফা করব আমি ঠিকাছে”
“জ্বি স্যার বলুন কি করতে হবে?”
“এই মূহূর্তে মেডিকেলের সমস্ত বিদ্যুৎ সংযোগ তোমার বিচ্ছিন্ন করতে হবে।একটা লাইটের ছিটেফোঁটাও যেন না জ্বলতে দেখি।”

“ওকে স্যার, নিশ্চিত থাকুন”
“আর আমার নির্দেশের আগ পর্যন্ত মেডিকেল কোন আলো জ্বলবে না। মনে থাকবে?”
“ওকে স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না”
“গো, রাইট নাউ”

গার্ড ছেলেটা দৌঁড়ে ছুটে চলে মেডিকেলের সুইচবোর্ডের দিকে।শান দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আলো নিভে যাওয়ার।কয়েক মিনিটের মাথায় অন্ধকারে ছেঁয়ে যায় পুরো মেডিকেল।সকলের মাঝে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে যায়।আর এটাই মূখ্যম সময় পাখিকে ভিতরে নেয়ার।কাল বিলম্ব না করে শান ফোনের ফ্লাশটা জ্বালিয়ে ফোনটা মুখে চেপে নেয়।এরপর গাড়ি থেকে বের করে নেয় পাখিকে।নিস্তেজ মুখটার দিকে তাকাতেই পুরো পৃথিবী থমকে যায় শানের।অপলোক দৃষ্টিতে খত বিক্ষত মুখটা দেখে বলে,”আমাদের অনেকদিন বেঁচে থাকার কথা ছিলো।এভাবে লুকাতে দিবো না তোমায়”

রাতের অন্ধকারকে ভর করে শান পাখিকে নিয়ে আসে মেডিকেলের ভিতরে।আগে থেকে রেডি রাখা কেবিনে নিয়ে যায় পাখিকে।
“ইকরা ইমিডিয়েট আনভীরকে আমার কথা বলো ১০১ নং কেবিনে আসতে”, হন্তদন্ত হয়ে শান বলে।
” ওকে স্যার ”
“আর শোন,একটা জনপ্রানীও যেন না জানে কোন কিছু”
পা থেমে যায় ইকরার।কৌতূহল বশত প্রশ্ন করেই ফেলে, “স্যার পেশেন্ট কে?”

বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয় শানের মাঝে।নজর এদিক সেদিক করে পাখির কাত হওয়া মুখটায় হাত বুলিয়ে বলে, “আমার ওয়াইফ”
আঁতকে ওঠে ইকরা।আপনাআপনি মুখটা হা হয়ে যায়।এতোদিনের নার্সিং অভিজ্ঞতায় এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না এতো ব্লিডিং এর কারণ কি!
“আমি এক্ষুনি আসছি স্যার”, বলে ভয়ে আতঙ্কে দৌঁড়ে বের হয়ে আসে ইকরা।

” আমি জীবনে কাউকে কোন অনুরোধ করি নি ডক্টর আনভীর।আজ তোমাকে করছি,আল্লাহ্’র দোহাই লাগে আনভীর আমার ওয়াইফকে সুস্থ করে দাও”,ডক্টর আনভীরের হাত ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুরোধ করে শান।
“স্যার কি করছেন কি আপনি?আপনাকে এভাবে…..মানায় না স্যার”
“আমি কিচ্ছু জানি না, তুমি শুধু ওকে সুস্থ করে দাও”

“আপনি শান্ত হয়ে বসুন স্যার, আমি দেখছি।ইকরা স্যারকে বাহিরে নিয়ে বসাও, আমি দেখছি”, বলেই আনভীর পাখিকে পরোখ করে নেয় একবার।
শান বাহিরে সোফায় বসে আছে দুহাতে মুখ চেপে।হঠাৎ মনে হয় মেডিকেলের বিদ্যুৎসংযোগের কথা।দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গার্ডবয়কে ডেকে সুইচ অন করতে বলে।কিছুক্ষন পরেই আবারও জ্বলজ্বল করে ওঠে পুরো মেডিকেল।

শান টলমলে পায়ে ফিরে এসে আবারও এমারজেন্সি কেবিনের বাহিরে অপেক্ষা করে।
এরপর আনভীর আরো দুজন ডাক্তার আর দুজন নার্সকে নিয়ে অটিতে ঢুকে পরে।শানের বুকের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন হাতুড়ির ন্যায় পেটাচ্ছে যেন।চোখ বন্ধ করলেই পাখির মুখ টা চোখে ভাসছে।দুইহাতে মুখ চেপে অপেক্ষা করছে কোন একটা সংবাদের।কাঁধে একটা হাত ভীষণ প্রয়োজন মনে হচ্ছে।কিন্তু যে মানুষটা কাঁধে হাত রাখার মতো সে’ই তো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

” কি হয়ে গেলো জান!এভাবে সবটা উলোটপালোট হবে ভাবতেও পারি নি।সব আমার জন্যে।কেন এক্সট্রা ড্রেস নিতে বললাম,কেন তালা দিতে বললাম,কেন মিটিংটা ক্যানসেল করলাম না,কেন ফোন টা ধরলাম না।আমি ব্যর্থ পাখি। আমি তোমার যোগ্য সঙ্গী হতে পারলাম না।আমায় ক্ষমা করে দিও জানপাখি।আমি পারলাম না তোমাকে এই অপূরনীয় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে।সবটাই আমার দোষ”,আনমনে নিজেকেই দোষারোপ করে কেঁদে চলেছে শান।

হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে মাথা তুলে তাকায় শান।হাতের কনুইয়ের কাছে শার্টের অংশে চোখ মুখ মুছে সচকিতে মাথা তুলে তাকায়।
“আমায় মাফ করে দিস বাবু আমি বউ মাকে দেখে রাখতে পারি নি রে”, কেঁদে কেঁদে বলে পাশে দাঁড়ায় শর্মিলা।
শান কিছু না বলে চোখ নিচু করে দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল খুঁটে চলে। ঠোঁট টিপে কান্না সংবরনের চেষ্টা করে।চোখ যেন বাঁধা মানছে না কিছুতেই।
আচমকাই শর্মিলার কোমড় জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

” আম্মা আমি ওরে আগলে রাখতে পারলাম না আম্মা।আমার দোষে আজ ও মৃত্যুর মতো কঠিন দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে।আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে আম্মা।কি থেকে কি হলো!আমার এতো সুখের সংসার।আমার দোষেই পাখি আমায় ফাঁকি দিলো আম্মা।আমিই ওরে বলেছিলাম এক্সট্রা ড্রেস নিতে,বাড়িতে তালা দিতে আর ও সেগুলো আনতেই বাড়ি ফিরেছিলো আম্মা”
শর্মিলাসহ উপস্থিত সকলেই কেঁদে চলেছে।শানের কান্নাটা প্রত্যেকটা মানুষের অন্তরকে নাড়িয়ে দিলো যেন।মুখে আঁচল চেপে কান্নার শব্দটা ক্ষীন করার চেষ্টা করছে শর্মিলা।ছেলের এতো কষ্ট তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।

“আম্মা, ও আমায় ফোন দিয়েছিলো।বাঁচার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছিলো আমি কলটা রিসিভ করিনি।সব দোষ আমার।কেন মিটিং টা পিছিয়ে দিলাম না।কেন আম্মা? কেন আজকেই ঝড় বৃষ্টিটাকে আসতে হলো?আমার পাখি আজ মৃত্যুর দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্যে।আমি ওকে ছাড়া বাঁচব কি করে?বলো না আম্মা!ওর কিছু হলে আমি কি নিয়ে থাকব।আমার শুধু ওকেই চাই, ওর মতো পাখিকেই চাই মা।আমার ওকে চাই”

ইনায়াহ্ রাখির কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে অনবরত।পাখি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মেয়েটা কাঁদছে।কোনমতে ধাতস্থ করে রাখি।তবুও পাখিকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইছে না সে।
শানের কান্না দেখে রনি মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছ নিচ্ছে।রনির বাবা কাছে এসে শানের কাঁধে হাত রাখতেই শর্মিলা ইশারা করে তাকে থামিয়ে দেয়।কাঁদতে দেয় শানকে।তিনি মনে করেন খুব কষ্ট পেলে কাঁদা উচিত।তাহলে মনটা হালকা হয়।

কিছুক্ষন পরে অটির দরজা খুলে যায়।শান মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে আনভীরের সামনে দাঁড়ায়।অসহায় মুখ করে চেয়ে থাকে।কিছু জিজ্ঞেসা করার সাহস কুলাচ্ছে না শানের।আনভীর জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,”অপারেশন ডান স্যার।ম্যাম এখন আউট অব ডেঞ্জার।আইসিউতে শিফট করতে হবে”

বুকের উপর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে যায় শানের।ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি ফুটে ওঠে।
অজানা কারণে শানের থেকে চোখ সরিয়ে নেয় আনভীর।
শান দুইবার নাকে ছিঁচকে শব্দ করে অটিতে ঢোকা সবাইকে বলে,”তোমরা আমার সাথে আসো একটু প্লিজ”
সবাই শানের কথামতো শানের পিছনে যায়।

“আমি জানি আমার ওয়াইফের সাথে কি ঘটেছে!তোমাদের সকলের কাছে আমার হাতজোড় অনুরোধ থাকবে ব্যপারটা নিজেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখার।ওর লাইফে এর কোন ইফেক্ট আমি পড়তে দিতে চাই না।” হাতজোড় করে প্রতিটা ডক্টর নার্সকে অনুরোধ করে শান।
সকলেই শানকে আশ্বস্ত করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।আনভীর বলে,”স্যার ম্যামের ব্যপারে কিছু কথা ছিলো”

“জানি আনভীর, তুমি কি বলতে চাও”
আনভীর নিশ্চুপ হয়ে যায় মূহূর্তেই।শান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমার বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে তাই না আনভীর!”
“জজ্বি স্যার।যেটা বুঝতে পেরেছি তলপেটে অসহনীয় আঘাতের মাধ্যমে প্রথমে গর্ভপাত করানো হয় আর তার পরপরই জোরজবরদস্তি মাত্রাতিরিক্ত বিকৃত…….”
বাকিটা বলতে পারে না আনভীর।কেমন পাংশুটে মুখে শানের দিকে চেয়ে থাকে।শান অভয় দিয়ে বলে,”সি ইজ রেইপ্ড। তাই না?”

আনভীর মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানিয়ে বলে,”ফফলে স্যার ভীষণ বাজে ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় ম্যামের ইউটেরাস।…. উই আর রিয়েলি ভেরি সরি স্যার।আমাদের হাতে কোন অপশন ছিলো না।ম্যাম আর কখনোই মা হতে পারবে না”
বন্ধচোখে শান ভাবতে থাকে তাদের কটানো মূহূর্তগুলোর কথা। ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে, “ফুলের আঁচড়ও লাগতে দেই নি”

কথাগুলো বলতে বেশ বেগ পেতে হয় আনভীরকে।কারণ যে কথাগুলো ডাক্তার হিসেবে উগড়ানো সহজ তা একজন স্বামী হিসেবে হজম করা তার থেকেও হাজার গুনে কঠিন।ভেঙ্গে ভেঙ্গে শানকে অপারেশনের সমস্ত আপডেট জানায় আনভীর।
আনভীরের বলা শেষ কথাটা মূহূর্তেই শানের সাজানো দুনিয়া ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় যেন।চোখ বন্ধ করে সবটা আবার রিমাইন্ড করে শান।

“স্যার ম্যামের শরীরের প্রতিটা স্থান জখম হয়েছে।তবে মাথায় অনেক বেশি। মনে তো হচ্ছে কেউ এবড়োখেবড়ো কোন রড দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করেছে।উদ্দেশ্যই ছিলো মেরে ফেলার।বেশ হৃদয়বিদারক স্যার”
পাখির অবস্থার কথা চিন্তা করে বন্ধচোখের কোণ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পরে নোনা জলের ধারা।

“ও বেঁচে আছে তো আনভীর!”, কান্নাজড়িত কন্ঠে জানতে চায় শান।
টেবিলের উপরে রাখা শানের হাতটা ধরে আনভীর বলে,” জ্বী স্যার।তবে অবস্থা খুব একটা ভালো না।আমার হাতে যা ছিলো তা আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।বাকিটা আল্লাহ্’র হাতে।২৪ঘন্টার মাঝেই আশা করা যায় ম্যামের জ্ঞান ফিরবে।আপনি এভাবে ভেঙ্গে পরবেন না স্যার।আপনার মতো মানুষও যদি এভাবে ভেঙ্গে পরে তবে কেমনে হবে স্যার!”

“ও আমার জান আনভীর।আমার খারাপ সময়ের সঙ্গী ও।আমায় মিথ্যের কুপ থেকে বের করে আনা মানুষটাই ও।ওর এই অবস্থা আমি কিভাবে মেনে নিবো ”
দুহাতে চোখ মুখ মুছে স্বগতোক্তি করে শান বলে,”ও বেঁচে তো আছে।এটাই অনেক”
“কিছু কি করার আছে স্যার।সবটাই উপরওয়ালার হাতে।তবে ম্যামের ব্রেইনের অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক।সে জন্যে আইসিইউতে নিতে হয়েছে”

আইসিইউ এর বেডে পরে রয়েছে পাখির জখম হওয়া শরীরটা।
শার্টের ইন টার এক অংশ খুলে নিচে ঝুলে গেছে,এলোমেলো হয়ে,কুচকানো পুরো শার্ট প্যান্ট, চোখের কোণে চিকচিকে জল,চোখের নিচে পুরু কালির আস্তরন। একটা দিনের ব্যবধানে কতোবছরের ক্লান্ত পথিক মনে হয় শানকে।ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ভোর বেলাতেই উদ্বাস্তুর ন্যায় টলমলে পায়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে শান। নিস্তেজ হয়ে পরে রয়েছে পাখির শরীর।পায়ের গতি আজ শূন্যের কোঠায়।মনের জোড়ে এগিয়ে যায় বেডে শুয়ে থাকা মানবীর দিকে। পুরো মাথাটা ব্যান্ডেজে মোড়ানো।নাকে, চোখে,কপালে আঘাতের পর আঘাতের চিহ্ন।গলার নিচে কামড়ের বিশ্রী দাগ।সবটাই একে একে খুঁটিয়ে দেখছে শান।

গলার কাছে জখমের চিহ্নটায় হাত বুলিয়ে দিতেই গা শিউরে ওঠে শানের।এতো নির্দয়ভাবেও যে কাউকে আঘাত করা যায় তা বোধগম্যের বাহিরে।
দাগহীন মসৃন দুই গালে পাঁচ আঙ্গুলের কালশিটে দাগ পরেছে।ছোপ ছোপ নখের খামচানোর আঁচড় গর্ত হয়ে গেছে গালের চারপাশে।কাঁপা কাঁপা হাতে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় পাখির দুই গাল।
পাশে রাখা টুলটা টেনে বসে গাল ছুঁয়ে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে শান,”আমার পুতুলের মতো পাখিটাকে কে এভাবে কষ্ট দিয়েছো?কি ক্ষতি করেছিলো এই মেয়েটা?”

ক্যানুলা লাগানো ডানহাতটা পেটের উপর রেখে বাম হাতটা দুহাতে শক্ত করে ধরে রাখে শান।এক নজরে চেয়ে থাকে পাখির মলিন মুখটার দিকে।যেন পলক ফললেই ফসকে যাবে হাত থেকে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে নার্স।
“স্যার,স্যার”, অত্যন্ত শান্তস্বরে ডাকে পাপিয়া।
” হু”
“ম্যামের স্যালাইন শেষে হয়ে গেছে স্যার।আর ড্রেসটাও…… ”
বলতেই হকচকিয়ে মাথা তুলে তাকায় শান।
“হ্যা,হ্যা…”

“আপনার বাড়ির লোক বাহিরে অপেক্ষা করছে স্যার।আপনি বরং বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন”
শানের করূন অবস্থা দেখে সহানুভূতিতে কথাটা বলে পাপিয়া।
কিন্তু শান নিরুত্তর।নির্ঘুম ক্লান্ত চোখ দুটোয় ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই।যেন এভাবেই চোখের পাতা খুলে কাটাতে পারবে সারাজীবন।
পাপিয়া আবার বলে,”স্যার যান না স্যার।আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।আপনি এমন করলে ম্যামকে দেখবে কে?”

“তুমি তোমার কাজ করো, আমি বাহিরে আছি।আর সাবধান ওকে কোন প্রকার ব্যথা দেবে না”, পাখির মাথায় হাত দিয়ে বলে শান।মাথাটা নিচু করে কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুপ করে থাকে।এ দৃশ্যের স্বাক্ষী হওয়ার সুযোগ সবাই পায় না।চোখের কোণ ভরে ওঠে পাপিয়ার।
কয়েক সেকেন্ড পর শান বাহিরে চলে আসতেই দরজার সামনে বাড়ির সবার মুখোমুখি হতে হয় শানকে।গতরাতে জোড় করে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়েছে। আর আজ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সবাই এসে হাজির।সবাইকে পাশ কাটিয়ে শান পাশের চেয়ারগুলোয় বসে।

শর্মিলা এগিয়ে পাশে বসে বলে,” বাবু একটু ফ্রেশ হয়ে নে না বাপ।আমরা আছি তো এখানে”
স্থীরদৃষ্টিতে চেয়ে শান জবাব দেয়,”২৪ ঘন্টার মাঝে ওর জ্ঞান ফিরবে আম্মা।যদি আবারও আমায় না দেখতে পায়, না দেখতে পেয়ে যদি খুব কষ্ট পায়,কষ্টে যদি ওপাড়ে চলে যায়!”
ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারে না শর্মিলা।ভরে ওঠা চোখদুটো আঁচলে মুছে বলে, “বউ মার কি হয়েছিলো?”

শান এক কথায় জবাব দেয়,”মিসক্যারেজ ”
“বলিস কি?”
“হহ্যা, মিসক্যারেজ হয়েছে আম্মা আর কিছু না”
শান যে কিছু একটা লুকাতে চাইছে তা স্পষ্ট শর্মিলার কাছে।তবুও ছেলেকে এই মূহূর্তেই কিছুই তিনি জিজ্ঞেসা করতে চান না।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৭

সবাই যে যার মতো বাহিরে বসে অপেক্ষা করছে পাখির জ্ঞান ফেরার।শান একমনে পাশে বসে হাতটা ধরে আছে আবারও।ফোনের মেসেজে সম্বিৎ ফিরে পকেট থেকে ফোন বের করে। ভেসে ওঠে হাসিমুখে থাকা পাখির ছবিখানা।আহত মুখে শান একবার ছবির দিকে আরেকবার শুয়ে থাকা পাখির দিকে তাকায়।ভিতরটা বিষিয়ে ওঠে মূহূর্তেই।
হঠাৎ ফোনের স্ক্রীনে পরশের নামটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলটা রিসিভ করে।
“হ্যা শান, খবর শুনেছিস কি?”
“কিসের?”অত্যন্ত শান্তস্বরে প্রশ্ন শানের।
” নিউজ দেখ”
পরশের কথা শুনতেই বুকটা আঁতকে ওঠে শানের।

“কোনমতে ব্যপারটা লিক হলো কি?”, আনমনে ভেবে শান উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,” কিসের নিউজ”
“আমার যতোদূর মনে পড়ছে তোর ওয়াইফের চাচা আর তার বড় ছেলেকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে পিবিআই।আর ছোট ছেলে লাপাত্তা।গোপনে তারা ড্রাগের রমরমা বিজনেস করতো”
কথাটা শুনেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে শানের। সে কি করে আয়ানের ব্যপারটা মাথা থেকে ঝাড়তে পারলো।

“তারমানে আয়ানই কি পাখির সাথে!”,অবাক বিষ্ময়ে ভাবতেই কল কেটে ডাটা অন করে শান।চোয়ালে চোয়াল লেগে আসে রাগের চোটে।আর সাথে সাথে মেসেঞ্জারে টুং টাং করে চলে আসে একের পর এক পাখি অনেকগুলো ছবি।বিভিন্ন এঙ্গেলে ওঠা ছবিগুলো বুকে বিষাদের বিশাল পাহার গড়ে তোলে সাথে সাথেই।একের পর এক ছবিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে।একটা ছবিতে এসে হাত আটকে যায় শানের।পেটের উপর হাত রাখা ছবিটার উপর।জুম করে করে দেখে নেয় শান।টুপ করে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে।
আনমনে বিড়বিড় করে,” আমরা আর কখনোই বাবা মা হতে পারব না জান”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৯