এই মন তোমারি পর্ব ৩৮

এই মন তোমারি পর্ব ৩৮
নুজাইফা নূন

-” অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে শাফায়াত।তার সাথে রয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা।সবার চোখে মুখে প্রিয় মানুষ কে হারানোর ভয়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। দেখতে দেখতে সবার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে দশটা বছর।

দশটা বছরে সবার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শাফায়াতের চুলে পাক ধরেছে। নাজমা দেওয়ান ,নাইমা দুজনেরই গায়ের চামড়া কুঁচকে এসেছে। দশ বছর আগে শাফায়াত পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর নিজেদের বিজনেস সামলাচ্ছে।সে এখন শহরের অন্যতম একজন সফল ব্যবসায়ী।আগের থেকে ও নাম , খ্যাতি হয়েছে তার। সবাই তাকে এখন বিজনেস ম্যান শাফায়াত দেওয়ান নামে চিনে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

তবু দিনশেষে শাফায়াত একজন কাঙ্গাল।ভালোবাসার কাঙ্গাল।এই দশ বছরে নাজমা দেওয়ান শাফায়াতের বিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্টা করেন নি । কিন্তু তিনি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন।সবাই সূরা কে ভুলে গেলেও শাফায়াত তাকে ভুলতে পারে নি। শাফায়াত সূরার ছবি দিয়ে তার রুমের দেয়াল ভর্তি করে রেখেছে।যাতে করে সে রোজ ঘুমোতে যাওয়ার আগে এবং ঘুম ভাঙ্গার পরে সূরার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখতে পারে।

শাফায়াত অন্যমনস্ক হয়ে তার বাবার কথা ভাবছিলো এমন সময় পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এসে শাফায়াতে কে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি কি কান্না করছো বড়ো আব্বু?আমার কষ্ট হচ্ছে তো। তুমি জানো না আমি তোমার চোখে পানি দেখতে পারি না। প্রতিত্তরে শাফায়াত মেয়েটা কে কোলে তুলে নিয়ে কপালে অসংখ্য চুমু তে ভরিয়ে দিতে লাগলো। মেয়েটা শাফায়াতের প্রাণ।একদম সূরার চেহারা পেয়েছে মেয়েটা।

যে কেউ দেখে বলবে এটা নুজাইফার নয় সূরার মেয়ে।দশ বছর আগে সূরার মারা যাওয়ার খবর শুনে ভেঙ্গে পড়ে আরাব। সে নিজের কান কে যেনো বিশ্বাস করতে পারে না।সে দৌড়ে নাজমা মঞ্জিলে চলে আসে। নাজমা মঞ্জিলে এসে শাফায়াতের পাগলামি দেখে বুঝতে পারে সূরার সাথে তার শুধু মাত্র কাজিনের সম্পর্ক না। তাদের সম্পর্ক আরো গভীর।আরাব নিঃশব্দে নাজমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে আসে।

কিন্তু নিজেকে কিছুতেই স্থির করতে পারে না। বারবার সূরার মায়াবী চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।সারাটা দিন আরাবের বিষন্ন মন নিয়ে কেটে যায়।রাতে ডিনার না করে’ই আরাব ঘুমোনোর জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু তার চোখে ঘুম ধরা দেয় না। বারবার সূরার হাসির শব্দ তার কানে বাজতে থাকে। অনেকক্ষণ যাবৎ বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে সবে আরাবের চোখ লেগে এসেছে ঠিক তখনি কর্কশ শব্দে আরাবের ফোন বেজে উঠলো।

আরাব দেখলো স্ক্রিনে নুজাইফা নাম টা জ্বলজ্বল করছে।আরাব বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে দেয়। কিন্তু নুজাইফা যেনো পণ করছে আরাব ফোন রিসিভ না করা পর্যন্ত সে কল দিতেই থাকবে।আর করছে ও তাই।আরাব কল রিসিভ করে ভাবলো নুজাইফা কে কঠিন কথা শুনিয়ে দিবে। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নুজাইফার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর শুনে আরাব নরম স্বরে বললো, তোর কি হয়েছে নাজু? কান্না করছিস কেনো?”

-” আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে আরাব ভাই।মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে এক্ষুনি মা’রা যাবো।আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি একটু আমাদের ছাদে আসবেন আরাব ভাই?”
-“পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? এতো রাতে আমি ছাদে যাবো? না না আমি পারবো না।রাখছি আমি। তুই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

-” আপনি যদি না আসেন আমি এক্ষুনি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মা’রা যাবো আরাব ভাই।আর আমার মৃত্যুর জন্য শুধু মাত্র আপনি দায়ী থাকবেন।”
-” কি সব আবোল তাবোল বকছিস নাজু? তুই এরকম কিছু করবি না।”

-” আপনি না আসলে আমি এমনটাই করবো আরাব ভাই বলে নুজাইফা ফোন কেটে দেয়। আরাব বিরক্তি তে নিজের চুল টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।নুজাইফার ডাকে সাড়া দেওয়ার ইচ্ছা না থাকার পরেও সে গুটিগুটি পায়ে নিজেদের ছাদে যায়। তাদের পাশাপাশি ফ্ল্যাট হ‌ওয়ার খুব সহজেই আরাব নিজেদের ছাদ থেকে নুজাইফাদের ছাদে চলে আস ।আরাব নুজাইফার কাছে এসে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, এসবের মানে কি নুজাইফা?কেনো পাগলামি করছিস?”

-” আপনি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারেন না আরাব ভাই? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেন? প্রতিত্তরে আরাব কিছু বলতে পারে না।কারণ তার বলার মতো কিছু নেই।সে নিজেও জানে নুজাইফা তাকে ভালোবেসে।নুজাইফা ঠিক কতোটা তাকে নিজের করে চায়? কিন্তু সে যে এক নিষিদ্ধ মানবী কে তার মন দিয়ে দিয়েছে।আরাবের থেকে রেসপন্স না পেয়ে নুজাইফা আবারো বললো,

-“আমাকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পান আপনি?আমি জানি আপনি ভাবিমনি কে পছন্দ করতেন। কিন্তু ভাবিমনি ভাইয়া একে অপর কে অনেক বেশি ভালোবাসে। তারা হয়তো কখনো তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে নি।একে অপর কে ভালোবাসি কথাটা বলে নি। কিন্তু ভালোবাসি ভালোবাসি বলে ফেনা তুলে ফেললেই ভালোবাসা হয়ে যায় না।

ভালোবাসা অনুভব করতে হয়। ঠিক যেমন টা আমি আপনার জন্য করি।আমি কি খুব বেশি অসুন্দর দেখতে আরাব ভাই? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না?আমাকে একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখুন আরাব ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবো। কক্ষনো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।প্লিজ আরাব ভাই আমাকে আপনি ফিরিয়ে দিবেন না।আমি যে বড্ড একা হয়ে পড়েছি।ভাবিমনি কে হারিয়েছি, বাবা কে হারিয়েছি।আমি আর নিতে পারছি না আরাব ভাই।

নুজাইফার চোখের পানি আরাবের হৃদয় স্পর্শ করে।আরাব নুজাইফা কে বুকে টেনে নেয়। এরপর তাদের ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়।বিয়ের চার বছর পর তাদের ঘর আলো করে সিজদা আসে।সিজদা কে পেয়ে যেনো শাফায়াত নতুন ভাবে বাঁচতে শিখে। মেয়েটার মাঝে সে সূরা কে দেখতে পায়। শফিকুল দেওয়ান কে ও জামিন করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়।তিনি তার অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সে সম্পূর্ণ বদলে যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বেশিরভাগ সময় মসজিদে কাটিয়ে দেয়।নিজ উদ্যোগে একটা এতিমখানা তৈরি করে তার দায়িত্ব নেয়। সবকিছু ভালোই চলছিলো হুট করে শফিকুল দেওয়ান অসুস্থ হয়ে পড়েন।তার কঠিন অসুখ ধরা পড়ে। নামকরা নামকরা হসপিটাল থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

কোনো ডক্টর তার চিকিৎসা করতে চায়ছেন না। তাদের ধারণা শফিকুল দেওয়ান এর অপারেশন সাকসেসফুল হবে না। এমন সংবাদে সবার মধ্যে বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। সবাই অনেক ভেঙ্গে পড়ে। হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে শাফায়াত কে জানায় দু দিন আগে কানাডা থেকে একজন নামকরা ডক্টর বাংলাদেশে এসেছেন।তিনি শফিকুল দেওয়ান এর অপারেশন করতে চান।

এমন সংবাদে যেনো সবাই প্রাণ ফিরে পায়। যথারীতি শফিকুল দেওয়ান এর অপারেশন শুরু হয়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে সবাই অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।সবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শাফায়াত পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলো।তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে।

এই মন তোমারি পর্ব ৩৭

সে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটা দিয়ে এসে দেখলো অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন মহিলা ডক্টর বের হচ্ছে।যার মুখে মাস্ক পরা রয়েছে। কিন্তু শাফায়াতের যেন ডক্টর কে চেনা চেনা মনে হলো।ডক্টর সামনে এগিয়ে আসতে’ই শাফায়াতের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। শাফায়াত অবাক হয়ে অনেক টা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, আমার লজ্জাবতী ললিতা!”

এই মন তোমারি পর্ব ৩৯