এই মন তোমারি পর্ব ৩৭

এই মন তোমারি পর্ব ৩৭
নুজাইফা নূন

-” সূরা কে হসপিটাল থেকে চৌধুরী ভিলায় নিয়ে আসা হয়েছে।সূরা গাড়ি থেকে নেমে চৌধুরী ভিলার বাইরে থেকে এতো বড়ো বাড়ি দেখে অবাক হয়ে যায়। গাছগাছালি ঘেরা সবুজের আড়ালে পাঁচ তলা বাড়ি। তবে দোতলা বাদে বাকি সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া।

শাহিন চৌধুরী আর মনিরা চৌধুরীর বেশিরভাগ সময় চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে কেটে যায়।একটা সন্তানের জন্য তারা কতো কি করছে অথচ আল্লাহ তায়ালা তাদের কে সন্তান দান করছেন না। এইতো সূরা কে পাওয়ার কয়েকদিন আগে মনিরা চৌধুরী নিজের উপর বিরক্ত হয়ে শাহিন চৌধুরী কে বলেন, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করো।তোমার বাবা ডাক শোনার অধিকার আছে। আমি চাই না আমার জন্য তুমি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হ‌ও।প্রতিত্তরে শাহিন চৌধুরী তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

-” আমি এমন কোনো সন্তানের ‌বাবা হতে চাই না যে সন্তান তুমি তোমার গর্ভে ধারণ করবে না।এতে যদি আমি সারাজীবন ও নিঃসন্তান থাকি তবুও আমার কোনো আফসোস থাকবে না। তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনী ।আমার সুখ দুঃখের সাথী। তোমার সুখের সময় যেমন তোমার পাশে থেকেছি তেমন তোমার দুঃখের সময় ও আমি তোমার পাশে থাকবো।”

-” এমনটা হয় না শাহিন। তুমি তোমার বাবা মায়ের কথা মেনে নাও।ফিরে যাও তাদের কাছে। তাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হ‌ও বলতে গিয়ে গলা ভিজে গেলো মনিরা চৌধুরীর।”
-” তোমার মন পড়তে পাড়ি আমি মনিরা। আমি খুব ভালো করে জানি এটা তোমার মনের কথা নয়।”

-” হ্যাঁ আমার মনের কথা নয়। কিন্তু আমি কি করবো বলো তো? আমি সত্যিই কখনো মা হতে পারবো না। আমার উপর যে আমার শ্বাশুড়ি মায়ের অভিশাপ লেগেছে।কারণ আমি যে তোমার বাবার অফিসের সাধারণ একজন কর্মচারীর মেয়ে।আমি তার পছন্দের ব‌উমা না। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করো। বিয়ের পর রোজ রোজ মা আমাকে গরীবের মেয়ে বলে খোঁটা দিতো, বাড়ির একজন কাজের মেয়ের যেটুকু সম্মান ছিলো আমাকে সেটুকু সম্মান ও দেওয়া হতো না।এক পর্যায়ে তুমি আমাকে আলাদা ফ্ল্যাটে নিয়ে চলো আসো।আর তখন শ্বাশুড়ি মা আমাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন,

-” ফকিরের বাচ্চা তুই আমার বুক থেকে আমার কলিজার টুকরা ছেলে কে কেড়ে নিয়ে আমার কোল খালি করে দিলি। আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তোর কোল ও যেনো সারাজীবন এমন খালি থাকে। আল্লাহ তায়ালা যেনো তোকে কোনদিন মা ডাক শুনতে না দেয়। তুই যাতে সারাজীবন উপলব্ধি করতে পারিস যে একজন মায়ের কোল খালি থাকার যন্ত্রণা কতটুকু?আর দেখো মায়ের কথাটা সত্যি হয়ে গেলো।আমি প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতে পারছি সন্তান না থাকার যন্ত্রণা।”

-” মা তোমাকে অভিশাপ দিয়েছে বলেই যে আমাদের সন্তান হচ্ছে না এটা তোমার ভুল ধারণা মনিরা। আল্লাহ তায়ালা সব পারেন। তুমি দেখো তিনি ঠিকই আমাদের সন্তান ‌দান করবেন।”

-“তাই যেনো হয় শাহিন। আমি যেনো আমার সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনে আমার অশান্ত হৃদয় শান্ত করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা যেনো মনিরার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।মনিরা সূরা কে পেয়ে দিন দুনিয়া ভুলে সারাক্ষণ হসপিটালে সূরার পাশে থেকেছেন।সূরাকে বুকে জড়িয়ে তার অশান্ত হৃদয় শান্ত করেছেন।তিনি সূরা কে নিয়ে চৌধুরী ভিলায় প্রবেশ করে দেখেন ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ারা সবাই ফুল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

তারা সূরা কে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে সূরা কে বরন করে নেন।যদিও সূরা নতুন জায়গা, নতুন মুখ , নতুন পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করছে তবুও সবার মুখে হাসি দেখে সে নিজেও তাদের তালে তাল মেলাতে শুরু করে।সূরার আগমন উপলক্ষ্যে শাহিন চৌধুরী তার ফ্ল্যাটের সব ভাড়াটিয়াদের ডিনারের দাওয়াত দিয়েছেন।সাথে এটাও বলেছেন কিছু দিন পরে তিনি বড়ো করে পার্টির আয়োজন করবেন।

আজকের এই ছোট খাটো ডিনার পার্টির জন্য মনিরা চৌধুরীসহ অন্য ভাড়াটিয়া মহিলারা মিলে রান্নার কাজে লেগে পড়েন। সবমিলিয়ে চৌধুরী ভিলায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শাহিন চৌধুরী সূরার জন্য অনেক জামা কাপড় সাথে একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে এসেছেন। সূরা মোটামুটি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে জানে। শাফায়াত তাকে শিখিয়েছিলো ।

তবু ও শাহিন চৌধুরী সূরা কে ফোনের ব্যাপারে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে সূরার কপালে চুমু দিয়ে সূরার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।ফোন দেখে সূরার ছটফটানি বেড়ে গেল।মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে উঠলো তার সুন্দর ব্যাডা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে। শাফায়াতের ফোন নাম্বার সূরার মুখস্থ ছিলো। শাফায়াত নিজে সূরা কে তার ফোন নাম্বার মুখস্থ করিয়েছিলো। সূরা কালবিলম্ব না করে ফোনে শাফায়াতের নাম্বার উঠিয়ে কল দিতে গিয়ে রিং হওয়ার আগেই ফোন কেটে দিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললো,

-” ছিঃ সূরা ছিঃ। তুই আসলেই একটা নির্লজ্জ , বেহায়া।তোর নিজের আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই।যে মানুষ টা তোর না তাকে কেনো এখনো নিজের ভাবছিস ? সে নিশ্চিত নতুন ব‌উ নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করছে।যার সুখের জন্য তাকে ছেড়ে চলে এসেছিস তার সাথে কথা বলাটা তোর বেমানান সূরা। তুই কল দিবি না পুলিশের নাম্বারে।সূরা নিজেকে নিজে বুঝিয়েও মন কে শান্ত করতে পারলো না।সে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে আবারো শাফায়াতের নাম্বারে কল করলো। কিন্তু রিং হওয়ার আগেই ফোন কেটে দিয়ে ফোন নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। এইভাবে সপ্তম বার করলো। কিন্তু অষ্টম বার এক বুক সাহস সঞ্চার করে শাফায়াতের নাম্বারে কল দিলো সূরা।”

-” শাফায়াতের অবস্থা বেশ শোচনীয়।সে সূরার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে।এমনকি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। একদিকে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর শোক। অন্যদিকে তার বাবা হাজতে হয়েছে। নাজমা দেওয়ান সারাক্ষণ চোখের পানি ফেলেন। নিজের আম্মির কষ্ট সহ্য হয় না শাফায়াতের। সব মিলিয়ে শাফায়াতের অবস্থা পাগলপ্রায়। কিছুতেই সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না।

নিজেকে শান্ত করতে সূরার ছবি বুকে নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে চিৎকার করে বললো, আমি একজন ব্যর্থ পুলিশ।একজন ব্যর্থ স্বামী।আমি কেনো সেদিন সূরার কথা বিশ্বাস করলাম না?কেনো সেদিন সবটা হেসে উড়িয়ে দিলাম? সেদিন যদি আমি সূরার ব্যাপার টা সিরিয়াস ভাবে নিতাম তাহলে আজ সূরা কে হারাতে হতো না।আমার বুকের বাঁ পাশ টা পরিপূর্ণ থাকতো ।আমি কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো ? আমি যে অপরাধী।

শাফায়াত চোখের পানি মুছে সূরার ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।আর তখনি আননোন নাম্বার থেকে শাফায়াতের ফোনে কল এলো। শাফায়াতের বিরক্তি তে মুখ থেকে চ জাতীয় শব্দ বের হয়ে এলো। শাফায়াত কল কেটে দিতে গিয়েও কি মনে করে কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই সূরা হুঁ হুঁ কান্না করে দিলো। গলা ভিজে এলো তার।

এই মন তোমারি পর্ব ৩৬

কতোদিন পরে সে তার সুন্দর ব্যাডা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। মূহুর্তের মধ্যে যেনো তার অশান্ত মন শান্ত হয়ে এলো।তার হার্টবিট বেড়ে গেল। সূরা শাফায়াতের নাক টানার আওয়াজ শুনতে পেলো।সূরা কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, পুলিশ কি কান্না করছে? তার তো তরী আপুকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকার কথা। কিন্তু তার কণ্ঠ ভেজা ছিলো।টান টানার আওয়াজ আসছিলো।কি হয়েছে আমার পুলিশের? সে ঠিক আছে তো?”

এই মন তোমারি পর্ব ৩৮