একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৯

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৯
সাদিয়া জাহান উম্মি

প্রাহি মন খারাপ করে বারান্দার দোলনায় বসে আছে।ওর মনের আকাশে মেঘ জমেছে।তাও কার জন্যে জমেছে অর্থ’র জন্যে।লোকটা হুটহাট এমন গম্ভীরমুখ করে রাখে যে ভয়ে প্রাহি কারনটাও জিজ্ঞেস করতে পারেনা।এমন কেন লোকটা?উনি যদি কিছু নিয়ে চিন্তা করে তাহলে তো প্রাহিকে বলতে পারে তাই নাহ?এমন তো না যে প্রাহি লোকটার দূরের কেউ।প্রাহি অর্থ’র স্ত্রী।আর স্ত্রীর কাছে তার স্বামি সকল কথা সেয়ার করবে আর স্ত্রীরও একই কাজ করবে।তাহলে না দুজনে মিলে প্রোবলেমটা সল্ভ করতে পারবে।

কিন্তু না। এই লোক তো প্রাহিকে কিছু বলেই না।যত্তসব গুমরো মুখো গন্ডার একটা।মনে মনে অর্থ’কে গালি দিতে লাগলো প্রাহি।প্রাহির মন খারাপ কারন আজ অর্থ আজ ভার্সিটি ছুটির পর ওরা এরশাদ সাহেবের কবর দেখে তারপর বাড়িতে এসেছে।কিন্তু এর মাঝে অর্থ প্রাহির সাথে একটা কথাও বলেনি।প্রাহি সাহস করে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেও হু না তে জবাব দিয়ে শেষ।এরপর আর প্রাহিও কোন কথা বলেনি।সারাটাক্ষন মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে।কি এতো ভাবে লোকটা?কিসের এতো চিন্তা,অস্থিরতা?ওকেও তো একটু বলতে পারে তাই নাহ?কিন্তু অর্থ সেটা বলেনা,করেও না।তাই প্রাহি আর কোন কথা অর্থ’র সাথে বলেনি।ফ্রেস হয়ে,খাওয়া দাওয়া করে সেইযে এসে বারান্দায় এসে বসেছে আর ঘরমুখো হয়নি প্রাহি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে নিজের লোকদের কিছু দরকারি কথাবার্তা শেষ করে ঘরে আসে অর্থ।ঘরে এসেই ভ্রু-কুচকে ফেলে অর্থ প্রাহিকে না দেখে।এই সময়ে তো মেয়েটা ঘুমিয়ে থাকে।তাহলে আজ গেলো কোথায়?অর্থ কি মনে করে যেন বারান্দায় গেলো।সেখানে পেয়েও গেলো প্রাহিকে।নিস্তব্ধে প্রাহির দিকে এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

‘ এখানে কি করছো?প্রতিদিন তো এই টাইমে ঘুমিয়ে থাকো।তাহলে আজ কেন ঘুমোও নি?পরে পড়তে বসবে কিভাবে?বই সামনে নিয়ে ঝিমালেই হলো মার একটু মাটিতে পরবে নাহ!’
অর্থ’র এরূপ প্রায় ধমকে বলা কথাগুলো শুনে তড়িঘড়ি করে দোলনা থেকে উঠতে নিতেই দোলনার হাতলের কোণায় হাতটা লেগে অনেকখানি ছিলে যায় প্রাহির।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে প্রাহি।ক্ষতস্থানটা আরেকহাত দিয়ে চেপে ধরে পূনরায় দোলনায় বসে পরে ও।এদিকে আকস্মিক কি হলো ঠাওর করতে একটু সময় লাগলো অর্থ।পরক্ষনে সবটা বুঝতে পেরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় প্রাহির কাছে।প্রাহির সামনে হাটু গেরে বসে অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো,

‘ আ’ম সরি প্রাহি।আমার ওইভাবে হঠাৎ কথা বলা ঠিক হয়নি।আমার কারনেই তুমি ব্যাথা পেলে।ইসস,দেখি হাত সরাও আমাকে দেখতে দেও কতোখানি লেগেছে।হাত সরাও প্রাহি।’
অর্থ জোড় করে প্রাহির হাতটা ক্ষতস্থান থেকে সরিয়ে ফেললো।বেশ অনেকক্ষানি ছিলে গিয়েছে।অর্থ অপরাধি ভঙ্গিতে প্রাহির দিকে তাকাতেই চমকে গেলো।ফর্সা মুখশ্রীটা লাল টকটকে হয়ে আছে,চোখে জল টলমল করছে, চোখজোড়াও ভয়ানক লাল হয়ে আছে।চেহারার অবস্থা পুরো খারাপ।অর্থ দ্রুত প্রাহিকে ধরে উঠিয়ে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।প্রাথমিক চিকিৎসার বক্সটা এনে প্রাহির হাতটা ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে দিলো।অতঃপর উঠে গিয়ে প্রাহির পাশে বসলো।প্রাহির কান্নারত চোখজোড়া নিজ হাতে মুছিয়ে দিয়ে প্রাহিকে ওর বুকে চেঁপে ধরলো।প্রাহি আর নিজের কান্না আটকে রাখতে পারলো না। হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিলো।অর্থ করুন গলায় বলে,

‘ কাঁদছো কেন প্রাহি?বেশি জ্বলছে ক্ষতটা? ‘
প্রাহি না বোধক মাথা নাড়ালো।
‘ তাহলে?’
প্রাহি কিছু বললো না সময় নিয়ে আরেকটু কান্না করলো।অতঃপর নিজেকে বহু কষ্টে সামলে হিঁচকি দিতে দিতে বলে,
‘ আপনি অনেক খারাপ।খুব খুব খারাপ।’
অর্থ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ও আবার কি করলো যার কারনে এইভাবে ওকে খারাপ বলছে প্রাহি।অর্থ বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে,
‘ কেন?আমি এতো খারাপ হলাম কেন?কারনটা জানতে পারি?’
প্রাহি জিব দিয়ে ওর শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
‘ আপনি আমাকে ভার্সিটি নিতে আসার পর থেকে একটা কথাও বলেননি আমার সাথে।কেন বলেন নি?আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর দেননি।এমন কেন করেছেন?’
অর্থ ভ্রু-কুচকে প্রশ্ন করলো,

‘ তার মানে তুমি ব্যাথা পেয়েছো সেইজন্যে কাঁদোনি।আমি কথা বলিনি এইজন্যে কাঁদছো?’
প্রাহি হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।অর্থ মুচঁকি হাসলো প্রাহির কথায়।মেয়েটা যে এই কারনে এইভাবে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে তা একটুও বুঝতে পারেনি।ও তো ইলফার করা কান্ড আর জয়কে কিভাবে ধরতে পারবে সেই কারনে একটু চিন্তিত ছিলো।কিন্তু মেয়েটা যে এতোটা কষ্ট পাবে ভাবেনি অর্থ।অর্থ নরম গলায় বলে,
‘ আচ্ছা আর মন খারাপ করে কাঁদতে হবে না।আমি আর কখনই এমন করবো না।’
প্রাহি অভিমানি কন্ঠে বলে,

‘ আপনি কোন কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত সেটা আমি বুঝতে পারছি।আমি জানি আমি জানতে চাইলেও আপনি বলবেন নাহ।এমন কেন আপনি?আমার সাথে সেয়ার করলে কি হয়?’
অর্থ কি বলবে ভেবে পেলো না।মেয়েটাকে সব বলে শুধু টেন্সন দেওয়া হবে।এমনিতেই কয়দিন পর পরিক্ষা।এইসব জানালে ওকে মেয়েটা পরিক্ষার প্রিপারেশন ভালোভাবে করতে পারবে না।তাই অর্থ মিথ্যে বললো,
‘ আমি তো বললাম আমি আমার কোরিয়ার বিজন্যাসটা বাংলাদেশে স্যাটেল করছি।ওইজন্যেই একটু টেন্সন। এই আরকি।’
প্রাহি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
‘ সত্যি?’
‘ হ্যা! একদম সত্যি! এইবার ঘুমাও তো একটু।নাহলে রাতে পড়তে পারবে নাহ।’
অর্থ প্রাহিকে বুকে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।কিছুক্ষন পর প্রাহি ঘুমিয়ে যেতে।অর্থ ওকে আস্তে করে বালিশে সুইয়ে দিয়ে।ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজের ব্যস্ত হয়ে পরলো।

‘ আপনি ইদানিং আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেন নাহ।’ অভিমানি কন্ঠ হিয়ার।
আরাফ মুঁচকি হাসে।দুষ্টু কন্ঠে বলে,
‘ আমি কথা বললেই কি আর না বললেই কি?তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে?’
আরাফের এমন প্রশ্নে হিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।আসলেই তো আরাফ ওর সাথে কথা না বললে ওর কি?ওর এতো খারাপ লাগে কেন?কেন এতো ব্যাকুল হয়ে থাকে ওর হৃদয়?কেন আরাফকে দেখার জন্যে মনটা এতো ছটফট করে?কেন আরাফের শূন্যতা ওর ভীতরটা এতো পুড়ায়? কেন?এই কেনো’র উত্তর হিয়া এতো ভেবেও মিলাতে পারে নাহ।হিয়াকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে আরাফ আবারো বলে,

‘ কি হলো হিয়া বলো নাহ?’
হিয়া তুতলিয়ে বলে,
‘ আ..আমি জানি নাহ।’
আরাফ কেমন যেন অন্যরকম একটা কন্ঠে বলে,
‘ নিজের মনকে প্রশ্ন করো।যেদিন যেদিন উত্তর তা জেনে তা আমাকে জানাতে পারবে সেদিনেই আমি তোমার কাছে আসবো তার আগে না।রাখছি ভালো থেকো নিজের খেয়াল রেখো।’
হিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিলো আরাফ। হিয়া ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে।
রাত ১১টা__________

‘ প্রাহি ঘুমাতে এসো! আমার কাজ শেষ। তুমিও জলদি এসো।এতো পড়া লাগবে না।সেই মাগরিবের নামাজ পরে পড়তে বসেছো।শুধু এর মাঝে উঠে ডিনার করেছো।এসো জলদি এসো।’ অর্থ’র কথায় প্রাহি মুঁচকি হেসে পড়া বন্ধ করে উঠে আসলো অর্থ’র কাছে।আজ প্রচুর ভ্যাপসা গরম লাগছে।প্রাহি সব লাইট নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পরলো।অর্থ একটা স্লিভলেস গেঞ্জি পরে এসে প্রাহির পাশে শুতেই প্রাহি একপলক তাকালো অর্থ’র দিকে।বুকটা ধরাস ধরাস করছে অর্থকে এমনভাবে দেখে।পাথরের মতো সোজা হয়ে শুয়ে রইলো প্রাহি।অর্থ’র দিকে আর তাকাবে না ও।কিন্তু বেহায়া চোখদুটো বার বার সেদিকেই তাকানোর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে।কি এক জ্বালায় পরলো প্রাহি।এদিকে অর্থ ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে প্রাহির দিকে।কি হলো মেয়েটাকে তো ওর বুকে আসার কথা বলা লাগে না?তাহলে আজ কেন আসছে না ওর কাছে?সকালের ঘটনা নিয়ে কি এখনো রাগ করে আছে ওর সাথে?অর্থ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘ কি হলো প্রাহি?এনি প্রোবলেম?এইভাবে শুয়ে আছো কেন?’
প্রাহি চমকে উঠলো অর্থ’র কথায়।শুকনো ঢোক গিলে তাকালো অর্থ’র দিকে।সাথে সাথে চোখ নিচে নামিয়ে নিলো।অর্থ আবারো বলে,
‘ এমন করছো কেন?বুকে আসবে নাহ?’
প্রাহি কিছুই বললো না।শুধু আসতে করে অর্থ’র কাছে গিয়ে ওর বুকে মুখ গুজে দিলো।অর্থ’ও দুহাতে আগলে নিলো প্রাহিকে।আর্থ ভ্রু উচুঁ করে তাকিয়ে,
‘ লজ্জা পাচ্ছো কেন?’
প্রাহি খামছে ধরলো অর্থ’র পিঠ।বললো,
‘ কো..কোথায় ল..লজ্জা পাচ্ছি।’

‘ আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার কান গরম হয়ে আছে।আর এমনটা তখনই হয় যখন তুমি লজ্জা পাও।’
প্রাহি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে।অর্থ প্রাহির কানের কাছে মুখ নিলো।অর্থ’র গরম নিশ্বাস প্রাহির কানে আর ঘাড়ে এসে বারি খাচ্ছে।কেঁপে উঠে প্রাহি আরেকটু ভালোভাবে অর্থ’র বুকের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা চালাতে লাগলো।অর্থ ফিসফিস করে বলে,

‘ এইভাবে লজ্জা পেও না লজ্জাবতী।আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললে কিন্তু তখন লজ্জা লুকানোর বিন্দুমাত্রও সুযোগ পাবে না তুমি।সো আমাকে এইভাবে পাগল বানানো বন্ধ করো।’
চমকে উঠলো অর্থ’র এরূপ কথায়।অর্থ এর আগে কোনদিন এইভাবে কথা বলেনি।আজ প্রথম অর্থ’র মুখে ‘ লজ্জাবতী!’ ডাকটা শুনে বুকের ভীতর কেমন যেন করে উঠলো।পরক্ষনে অর্থ’র বাকি কথাগুলো স্মরন হতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো ওর সর্বাঙ্গ।কি বললো লোকটা এগুলো?এইভাবে এইসব বললে তো প্রাহি লজ্জায় মরেই যাবে।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৮

প্রাহি অর্থ’র পিঠে আলতো ঘুশি মেরে বলে,
‘ অসভ্য কথাবার্তা বন্ধ করে ঘুমান!’
অর্থ হেসে দিলো প্রাহির কথায়।তারপর চুপচাপ প্রাহিকে বুকে নিয়েই দুজনে ঘুমের দেশে পারি দিলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২০