একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৫

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৫
সাদিয়া জাহান উম্মি

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হেমন্ত আর হিয়াজ শিকদার।হিয়াজ শিকদার হলেন অর্থ’র বাবা।হিয়াজ শিকদার আর হিয়ান্ত শিককদার হলেন আপন দুই ভাই।হিয়াজের দুই ছেলে মেয়ে অর্থ আর হিয়া।আর হিয়ান্ত’র একটাই ছেলে হেমন্ত।সবার বড় অর্থ তারপর হেমন্ত আর সবার ছোট হিয়া।বড় আদরের সবার ও।
অর্থ’র জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা দুজন।অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো। অর্থ ফার্স্ট টার্মিনাল দিয়ে এগিয়ে আসছে।সাথে আছে আরাফ।অর্থ আর আরাফ সালাম জানালো।হিয়াজ জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে।

-‘ কেমন আছিস বাবা?’
-‘ ভালো আব্বু।তুমি কেমন আছো?’
-‘ এইযে তোকে দেখেছি না? এখন একদম ভালো আছি।’
হিয়াজ এইবার আরাফকে জিজ্ঞেস করেন,
-‘ আরাফ কেমন আছো?’
আরাফ হাসিমুখে বলে,
-‘ ভালো আঙেল।আপনি কেমন আছেন?’
-‘ আলহামদুলিল্লাহ!’
হেমন্ত অর্থকে জড়িয়ে ধরে আছে।অর্থও ভাইয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলো।ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করা হলো।আরাফের সাথেও কথা হলো।হিয়াজ এইবার বলে উঠেন,
-‘ এইবার বাড়ি চলো।অনেক হলো।রায়হানা আর হেনা সেই কখন থেকে বসে আছে তোমার জন্যে বার বার ফোন করে জিজ্ঞেস করছে অর্থকে নিয়ে আসছি না কেন?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অর্থ আর আরাফ হিয়াজের কথায় সম্মতি জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।কি জানি একটা অনুভব করে অর্থ আবারও গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালো।ওর কেন যেন মনে হচ্ছিলো কে যেন ওকে দেখছে।গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করে দেখছে।হয়তো মনের ভুল হবে ভেবে অতোটা ধ্যান দিলো না।শা করে ওদের গাড়িটা ছুটে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। এদিকে অর্থ’রা যেতেই লুকানো অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এলো প্রাহি।আর একটু হলেই দেখে ফেলতো অর্থ ওকে। চোখে জল মুখে হাসি।কতো বছর পর দেখলো অর্থকে ও।লোকটা আগের থেকে আরো বেশি সুদর্শন হয়ে গিয়েছে।প্রানটা জুড়িয়ে গিয়েছে প্রাহির।চারদিকে ভালোলাগা আর ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ওর মনে। অর্থ আজ আসবে আর প্রাহি তাকে দেখবে না?এটা অসম্ভব।সবার আগেই এয়াপোর্টে এসে হাজির হয়েছে প্রাহি।প্রিয় মানুষটিকে একপলক দেখার জন্যে।অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্যে।অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার ইতি টানা হলো।এখন শুধু সময় অর্থ’র কাছে নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করার।

বাড়ি ফিরতেই অর্থকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে অস্থির রায়হানা আর হেনা।হেনা অর্থ’র চাচি হলেও ওর মা থেকে কোন অংশে কম ভালোবাসেন না তিনি।এই দুই মাকে বহু কষ্টে সামলিয়ে কান্না থামিয়েছে অর্থ।টুকাটাকি কথা বলে ফ্রেস হতে চলে যায় অর্থ আর আরাফ।ফ্রেস হয়ে এসে ড্রয়িংরুমে এসে দাড়াতেই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রায় একপ্রকার ভুমিকম্প সৃষ্টি করে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে অর্থকে জড়িয়ে ধরে।অর্থ নিজেকে সামলে নিলো আকস্মিক ধাক্কায়।তারপর নিজেও মৃদ্যু হেসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে।মেয়েটা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠে,
-‘ আই মিস্ড ইউ সো মাচ ভাইয়া।’
-‘ আমিও আমার পুচকিকে অনেক মিস করেছি।তা আমার পুচকিটা কি ভালো আছে?’ বলে অর্থ।
মেয়েটা অর্থকে ছেড়ে দিয়ে হাসি মুখে বলে,
-‘ নিজেই দেখে নেও।আমি একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি।’
হেমন্ত মাঝখান থেকে বলে,
-‘ হ্যা সারাদিন হাতির মতো খেলে তো ফিট এন্ড ফাইন থাকবিই।আর কয়দিন পর পুরাই একটা আটার বস্তার মতো লাগবে।’

-‘ ভাইয়া এই হেমন্ত ভাইয়াকে কিছু বলবা?সারাদিন আমার সাথে ঝগরা লাগানোর ধান্দায় থাকে।’ কাঁদো কন্ঠ মেয়েটার।
অর্থ হেমন্তকে একটু মিথ্যে রাগ দেখালো।বিনিময়ে হেমন্তও ভয় পাওয়ার অভিনয় করলো।
এদিকে এতোক্ষন ভ্রু-কুচকে সবটা দেখছিলো আরাফ।এইবার বলেই ফেললো,
-‘ অর্থ? এটা কি সেই বাচ্চা মেয়ে তোর বোন হিয়া?’
অর্থ হ্যাসূচক মাথা নাড়ালো।আরাফ হেসে দিয়ে বলে,
-‘ আগে যেমন বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতো এখনো দেখি সেভাবেই কাঁদে।’
হিয়া রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আরাফের দিকে।তেজ নিয়ে বলে,
-‘ এসব ভালো হচ্ছেনা কিন্তু আরাফ ভাইয়া।’
বলেই হনহন করে চলে গেলো মা, কাকি আর বাবা,কাকাদের সাথে দেখা করতে।এদিকে হিয়ার এতো রাগ দেখে মুচঁকি হাসলো আরাফ।মনে মনে বলে,
-‘ আজও রাগলে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে হিয়া।আর আমি বার বার তোমার এই রূপে ঘায়েল হয়ে যাই। মন হারিয়ে বসে আছি তো সেই কবেই তোমার কাছে।এইবার পালা তোমার মন চুরি করার।শীঘ্রই সেটা করে নেবো।’
রায়হানা বেগমের ডাক শোনা গেলো।তিনি সবাইকে ডাকছেন ডিনার করার জন্যে।সবাই আজ কতোদিন পর একসাথে ডিনার করবে।পুরো শিকদার পরিবার আজ হাসিতে খুশিতে ভরপুর।

খাবার টেবিলে হিয়াজ শিকদার হঠাৎ বলে উঠেন,
-‘ অর্থ’র আসার উপলক্ষে কাল আমি একটা পার্টির আয়োজন করবো।কি বলো অর্থ?’
অর্থ খাওয়া থামিয়ে দিলো।ভ্রু-কুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-‘ এসবের কোন দরকার নেই বাবা।’
হিয়া চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ তোমার দরকার নেই। আমার দরকার আছে।আমি আমার সব ফ্রেন্ডদের ইনভাইটেশন দিয়ে দিয়েছি।ওরা কাল আসবে।আমার ভাইয়া এসেছে আর আমি সেলিব্রেট করবো না। এটা কি হয়?’
-‘ কিন্তু……!’
-‘ কোন কিন্তু না ভাইয়া কাল পার্টি হবে ব্যস।’
বোনের জেদের কাছে হার মানে অর্থ।সম্মতি দিয়ে দেয় সে।রায়হানা বেগম অর্থ’র প্লেটে খাবার দিচ্ছেন।এইবার হেমন্ত’র উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ হেমন্ত?প্রাহি আর ইশি মেয়ে দুটোকেও ইনভাইটেশন দিয়ে দিস পার্টির।তোর আর কোন ফ্রেন্ড থাকলে তাদেরকেও বলিস।’

-‘ আচ্ছা বড় মা!’ বলল হেমন্ত।
এদিকে প্রাহি আর ইশি নামটা কেমন যেন একটু চেনা চেনা লাগছে ওর কাছে।কিছু একটা মনে করেই খাওয়া থামিয়ে হেমন্তকে বললো,
-‘ প্রাহি আর ইশি?এরা দুজন তোর ওই মেয়ে ফ্রেন্ড দুটো না?’
হেমন্ত চাঁদ হাতে পেলো।এইতো সুযোগ প্রাহির একটু গুনগান গাওয়া যাক ভাইয়ের সামনে।এতে ক্ষতি কি?
হেমন্ত উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে,
-‘ হ্যা ভাইয়া।জানো ওরা খুবই ভালো।প্রাহির তো কোন জবাবই নেই।একদম শান্ত, ভদ্র,নম্র একজন মেয়ে। আমার ফ্রেন্ড্সদের মাঝে প্রাহি আর ইশিই সবচেয়ে বেশি ক্লোজ মানে বেষ্টফ্রেন্ড।আর জানো প্রাহি তো একেবারে আমাদের আপনজনের মতো।আমাদের ফ্যামিলির সবাইকে প্রচুর ভালোবাসে মেয়েটা।আর…….!’
-‘ ব্যস! অনেক হয়েছে।আমি শুধু একটু জিজ্ঞেস করলাম।ওমনি তুই তো পুরো জন্মসষ্টি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলে!জাস্ট লিসেন ওয়ান থিংক আই ডোন্ট লাইক টু টক টু মাচ মাইসেল্ফ।এন্ড আই এলসো ডোন্ট লাইক এনিওয়ান টু টক টু মি টু মাচ।’
কথাগুলো শেষ করেই খাবার টেবিল হতে উঠে চলে গেলো অর্থ।হেমন্ত’র মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কিভাবে যে ভাইয়ের মনে প্রাহির জন্যে জায়গা তৈরি করবে। ইসস,এতোটা বোকা কেন হলো ও?আগে তো ওদের দুজনকে একসাথে করতে হবে।দুজনের প্রথম সাক্ষাৎটা যেন একটু রোমাঞ্চকর হয় এমন ব্যবস্থা করবে হেমন্ত।চেষ্টায় কোন কমতি রাখবে না ও।যে করেই হোক প্রাহিকেই ওর ভাইয়ের বউ করে আনতে হবে।

-‘ স্যার ইলফা ম্যাম ইস প্লানিং টু কাম টু বাংলাদেশ টুমোরো।’
অর্থ’র আন্ডারে কাজ করা একজন লোকের মুখে এমন কথা শুনে রাগে কপালের শিরা উপশিরা ফুলে উঠলো। রাগে চোখজোড়া লাল হয়ে উঠলো।মনে মনে বিশ্রি গালি দিলো ইলফাকে ‘ দ্যাট ব্লাডি বিচ।’ চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠে অর্থ,
-‘ স্টোপ দ্যাট ক্রেজি গার্ল এনিওয়ে।আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার এনি এক্সকিউসেস।ব্লক হার পাসপোর্ট নো ম্যাটার হাও মাচ ইট কোস্টস্!’

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৪

ফোনটা কেটে দিয়ে সজোড়ে পাশে টেবিলে রাখা ফুলদানিটা আছার মারলো অর্থ।এই মেয়েটা জানলো কিভাবে ওরা দেশে এসেছে।ওইটাকে না জানানোর জন্যে লুকিয়ে চুরিয়ে কতো প্লানিং করে ও আর আরাফ এসেছে বাংলাদেশে।আর সেই মুসিবত কিনা সয়ং এখানে এসে হাজির হওয়ার পায়তারা করছে।না এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।মেয়েটা আস্ত একটা ঝামেলা।আর অর্থ নিজেকে কোন ঝামেলায় জড়াতে চায়না।আর এইসব ঝামেলাদের কিভাবে নিজের কাছ থেকে দূরে সরানো যায় তা খুব ভালো করেই জানে অর্থ।মনে মনে কথাগুলো ভেবে বাঁকা হাসলো অর্থ।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৬