শেষ থেকে শুরু পর্ব ৫

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৫
লাবণ্য ইয়াসমিন

এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে দেরি হলো কিন্তু হৈমন্তীর নামতে দেরী হলো না। দৌড়ে গিয়ে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ভাবিকে ঝাপটে ধরে কেঁদে ফেলল। হঠাৎ এই মানুষটাকে দেখে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চয়নিকা হৈমন্তীর সঙ্গে পাল্লা লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলো। ততক্ষণে দুভাই ওদের কাছে চলে এসেছে। সকলের চোখে পানি তবে ঠোঁটে হাসি। চোখের পানি সব সময় দুঃখের হয়না আনন্দেরও হয়। হৈমন্তী ভাবিকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
> তোমার পিচ্চিটা কোথায়? তাকে ডাকো একটু দেখি। ফুপি আম্মা এসেছে অথচ সে লুকিয়ে আছে।
হৈমন্তী চয়নিকার থেকে চোখ ফিরিয়ে পাশে তাঁকালো। গুটি গুটি পায়ে ছোট একটা বাচ্চা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বাচ্চাটার চোখেমুখে আতঙ্ক। হয়তো অচেনা লোকজন দেখে ঘাবড়ে গেছে। হৈমন্তী ওর মুখের ভাবসাব দেখে শব্দ করে হেসে চয়নিকাকে বলল,

ভাবি তোমার ছেলে দেখি আমার কার্বন কপি হয়েছে। কিন্তু মুখের ভাব দেখো ও হয়তো আমাদের দেখে পছন্দ করছে না।
হৈমন্তী কোলে নিতে গেল কিন্তু বাচ্চাটা ওর কোলে আসলো না।চয়নিকা মৃদু হেসে রনিকে কোলে তুলে নিলো। রাজীব ওদেরকে ভেতরে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে তাই হৈমন্তী আর কথা বাড়ালো না। ভেতরে চলে গেলো। হৈমন্তী নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় আরাফাত ওর রুমে আসলো। হৈমন্তী ভাইকে দেখে জিঞ্জাসা করলো,
> কিছু বলবে?
>আমাদের উপলক্ষ্যে বড় ভাইয়া বাড়িতে ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বাইরের কেউ আসবে না। তোর কি অসুবিধা হবে?
> অদ্ভুত কথাবার্তা বলছো ভাইয়া। আমার অসুবিধা হবে কেনো? তুমি যাওতো আমার ঘুম পাচ্ছে। মেজ ভাইয়া আসলে ডেকে দিও। তোমাদের সব অনুষ্ঠান আয়োজনে অংশ নিচ্ছি চিন্তা করো না।
আরাফাত খুশী হলো। হৈমন্তী একা থাকতে পছন্দ করে। কখনও কোনো পার্টি পিকনিকে গিয়েছে কি সন্দেহ আছে। ওকে চলে যেতে দেখে হৈমন্তী ডেকে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

> এসব আমি তোমার জন্য করছি ভাইয়া।
আরাফাত অবাক হয়ে বলল,
> আমার জন্য?
> তোমার জন্য মেয়ে খুঁজতে হলে আমাকে এখন থেকে বড় বড় অনুষ্ঠান আয়োজনে যেতে হবে। ওসব ঘটক ফটক দিয়ে হবে না।মেয়ে আমার দুই ভাবির মতো হওয়া চাই।
আরাফাত ভড়কে গেলো হৈমন্তীর কথা শুনে। ও চোখ দুটো ছোট করে বলল,
> ক্ষমা কর বোন। এসবে আমাকে জড়িয়ে মারবি নাকি? এখনো বিয়ের বয়স হয়নি আমার।
> তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ চুলগুলো পাক ধরবে দুদিন পরে। তখন বিয়ের বয়স হবে। ভাইয়া যাওতো। আমার কথার বাইরে কথা বললে কিন্তু খারাপ হবে। যাও এখন।

হৈমন্তী বিরক্ত হয়ে পেছন ঘুরে শুয়ে পড়লো। আরাফাত কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলো। এই মেয়েটার মাথায় শুধু উল্টোপাল্টা বুদ্ধি ঘুরছে। একবার যদি বড় ভাই ভাবির কানে যায় এবার আর ছাড় পাওয়া যাবে না। তিনজন মিলে পেছনে হাত ধুয়ে পড়বে কি যন্ত্রণা। আরাফাত ডাইনিং রুমের সোফায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো। আশেই রনি ড্রয়িং খাতায় কি সব হাবিজাবি ছবি আঁকছে। ছেলেটা বেশ কিউট। আরাফাত ওকে নিজের কোলের মধ্যে বসিয়ে নিয়ে ওর গল দুটো টিপে দিলো। আরাফাতের হঠাৎ এমন আচরণে রনি ভ‍্যা ভ‍্যা করে কাঁদতে শুরু করলো। চয়নিকা রান্নাঘরে ছিল দৌড়ে এসে রনিকে নিজের কোলে নিয়ে আরাফাতের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে মনে হয়।
> ভয় না ভাবি তোমার ছেলের গাল টিপে দিয়েছি বেচারা ভড়কে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে।
> তুমিও না। বাচ্চাদের সঙ্গে এমন করতে নেই। ভাব করো দেখবে তখন আর ভয় করবে না।
> বাচ্চাটা অনেক কিউট। তুমি ওকে ভীষন ভালোবাসো তাইনা?
চয়নিকা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রনিকে দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,
> ওর জন্য আমি মরতেও পারি। ও আমার মাতৃত্বের স্বাদ পূরণ করেছে আরাফাত। বুঝতে পারছো কতটা কাঙ্ক্ষিত ও আমি জন্য।
> আগলে রেখো।
চয়নিকা কোনো কথা বললো না। রনিকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। আরাফাত সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমঘুম লাগছে রুমে যেতে যেতে ঘুম কেটে যাবে। তাছাড়া অলসতা ওকে ঝাপটে ধরেছে। তাই এখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।

ঢাকার একটা আলিশান বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। মাসুদ বউ বাচ্চা নিয়ে বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরেছে। হৈমন্তী মেজ ভাইকে খুব কম কাছে পেয়েছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত চার ভাইবোন জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে। বড় বোন ইন্ডিয়া গেছে স্বামীর সঙ্গে ছুটি কাটাতে ফিরবে এক মাস পরে। ভিডিও কলে তার সঙ্গেও কথা বলা হলো। হৈমন্তীর বহুকাল পরে মনে হলো আমার মতো সুখী পৃথিবীতে আর একটাও নেই। এতো এতো ভালোবাসা তবুও মনের মধ্যে কেমন চাপা কষ্ট। এই কষ্টের উৎস কোথায় ঠিক খুজে পাওয়া গেলো না।হৈমন্তি রাতের পার্টির জন্য সুন্দর একটা সাদা গাউন পড়ে নিলো। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে হিজাব পরল। দেশে থাকতে গায়ের রঙটা কেমন চাপা ছিল কিন্তু এখন আর নেই। অতিরিক্ত ফর্সা হয়ে গেছে। হৈমন্তী হালকা লিপস্টিক দিতে গিয়েও রেখে দিলো। এতো সাজুগুজু অর্থহীন মনে হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলো। চয়নিকা রনিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। লোকজন দেখলে কান্নাকাটি করে একাকার করে ফেলবে। তাছাড়া রোহান এসেছে একা না দুজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। ওদেরকে একটু সময় দেওেয়া উচিৎ। চয়নিকা ডাইনিং রুমে গিয়ে রোহানকে খোঁজ করলো। ছেলেটা বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। চয়নিকা গিয়ে সোজাসুজি ওর কান ওরলো। রোহান চমকে উঠে নিজেকে ছাড়াতে ব‍্যস্ত হয়ে ঘুরে তাঁকিয়ে ছলছল চোখে বলল,

> আপা লাগছে। আমি আর ছোট নেই।
> খুব বড় হয়েছিস যে বোনকে দেখতে আসার সময় হয়না। রনি তোর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে।
> সরি আপা। একটা প্রজেক্টরের ঝামেলায় আটকে ছিলাম এখন ফ্রি আছি। কান ছেড়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ তো করে নে।
চয়নিকা ওর কান ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে একজনকে পেলো। ওর সঙ্গে আলাপ করে নিলো। আরেকজন এসেছে কিন্তু তাকে পেলো না। বাইরে গেছে ফোন এসেছিল কথা বল‍তে। চয়নিকা সবাইকে বসিয়ে রেখে উঠে গেলো। ঘর ভর্তি মেহমান না হলেও কম হলো না। মোটামুটি বেশ ভালো আয়োজন। এখানে কোনো মিউজিকের আয়োজক নেই। পার্টি বলতে পুরাতন নতুন মিলে সব বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতার আয়োজন। কথাবার্তা বলবে আড্ডা দিবে তারপর খাওয়া দাওয়া করে ফিরবে।

হৈমন্তী গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো। উপস্থিত কয়েকজনের নজর ওর দিকে। হৈমন্তীর সেদিকে খেয়াল নেই। খুব সাবধানে নেমে এসে চেনাজানা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে নিলো। দূরে রোহান বসে আছে। ছেলেটার চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। আগের দেখা হৈমন্তীর সঙ্গে এই হৈমন্তীর একটুও মিল পেলো না। মুগ্ধ হয়ে গেলো। ও উঠে আসলো হৈমন্তীর সঙ্গে আলাপ করার জন্য। হৈমন্তী রোহানকে চিনে তাই মলিন হেসে ভদ্রতার সহিত বলল,
> কেমন আছেন ভাইয়া? আপনাকে ছবিতে দেখেছি তাই চিনতে অসুবিধা হলো না নয়তো চিনতেই পারতাম না। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম ভাবা যায়।
হৈমন্তী একদমে কথাগুলো বলে থামলো। রোহানের বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। এই মেয়েটার কিছু মনে নেই কিন্তু ওরতো সব মনে আছে। ওর যেনো এক এক করে সব মনে পড়ে যাচ্ছে তাই কথা বলতে কেমন জড়তা কাজ করছে। তবুও মিনমিনে কন্ঠে উত্তর দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে বসলো। রোহান পাশের বন্ধুকে বলল,
> আবির এখানেও কি ব‍্যবসার কাজকর্ম করবে বলতো? সেই বাইরে গেলো ফেরার নাম নেই। আহাম্মক একটা। রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
রোহান ভ্রু কুচকে ফেলল। আবির ওর ছোটবেলার বন্ধু। দেখতে বেশ সুদর্শন সব দিক থেকে ভালো এটাই সমস্যা প্রচণ্ড জেদি।

চারদিকে লোকজন কথাবার্তা বলছে আড্ডা দিচ্ছে।তার মধ্যে হৈমন্তী চয়নিকার পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> বড় ভাইয়া কোথায় দেখছি না কেনো?
> ভদ্রলোক বাইরের বাগানে রান্নাবান্নার তদারকি করছে। এতগুলো মানুষকে খাওয়াতে হবে যদি রান্না খারাপ হয় সেই ভয়ে তার আত্না শুকিয়ে আসছে।
হৈমন্তী মৃদু হাসলো। বড় ভাইয়ের সম্পর্কে ওর জানা আছে। কিন্তু এখানে তো ওর দরকার আছে। ও আর কথা বাড়ালো না দ্রুতগতিতে বাগানের দিকে ছুটলো। বাগানে গিয়ে দুর থেকে ভাইকে দেখে আশেপাশের না তাকিয়ে ছুটতে গিয়ে সামনে একজনের সঙ্গে লেগে গেলো ধাক্কা। দুজন দুদিকে ছিঁটকে পড়েছে। হৈমন্তীর হাতের তালুতে বেশ আঘাত লেগেছে। ওর শান্ত মেজাজ এবার প্রচণ্ড অশান্ত হলো। বিড়বিড় করে আচ্ছা করে এই অগন্তুকে গালি দিয়ে উঠতে গেলো। এতক্ষণ এক জোড়া চোখ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই। হৈমন্তীর সারা মুখে বিরক্তি ছেয়ে আছে। হঠাৎ উপরের দিকে তাকিয়ে ওই চোখে চোখ পড়ে গেলো। হৈমন্তীর মেজাজ তুঙ্গে। ছেলেটা ওকে ফেলে দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কতবড় সাহস। ওর ইচ্ছে করলো থাপ্পড় দিয়ে ব‍্যাটার দাঁত ভেঙে দিতে কিন্তু বাড়িতে অশান্তি হবে। কথাটা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> দেখা শেষ হয়েছে?
আবির হৈমন্তীর এমন কথা শুনে ঢোক গিলে বলল,
> সরি আসলে খেয়াল ছিল না। হুটকরে সামনে চলে এসেছেন।
হৈমন্তী ছেলেটার কথায় পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসের ধুলা পরিস্কার করতে করতে বলল,
> আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? জীবনে মেয়ে দেখেননি?
> আপনার নামটা যদি বলতেন।
হৈমন্তী বিরক্তি নিয়ে যেতে যেতে বলে গেলো,
> হৈমন্তী মির্জা।
আবির কয়েকবার নামটা মনের মধ্যে আওড়ে নিলো। হৈমন্তী সংক্ষেপে হৈমি। আহা কি মধুর নাম। আবির আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে রোহানের কাছে বসলো। কোনো রিস্ক নেওয়া চলবে না। আজকেই আম্মুকে বলবে মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। কিন্তু তার আগে তো রোহানের সঙ্গে কথা বলতে হবে? আবির এহসানের মনে এই প্রথমবার একটা মেয়ে ধরেছে ছ‍্যাকা ব‍্যাকা হওয়ার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। তাছাড়া আম্মু শুনলে বেশ খুশী হবে কথাটা ভেবেই মনের মধ্যে আনন্দ দোলা দিচ্ছে। আবিরকে এমন মিটিমিটি হাসতে দেখে রোহান একটু রেগে গিয়ে বলল,

> এই তোর আসার সময় হলো? এসেছিস ভালো কথা ভূতে ধরা মানুষের মতো হাসছিস কেনো?
> আমার কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে জানিস?
রোহান ওর কথা শুনে হতবাক। আবিরের ঠোঁটেকাটা স্বাভাবের কথা ওর অজানা নেই। কিন্তু তাই বলে প্রেম? বিয়ে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া ছেলেটা বলে নাকি তার প্রেম পাচ্ছে। কি অদ্ভুত। রোহান নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
> রঙিন শরবত খাওয়া শেষ? দুলাভাই বাড়িতে মদের ব‍্যবস্থা করছে কোই আমি তো জানিনা?
আবির ওকে ইগনোর করে বলল,
> হৈমন্তীকে পছন্দ হয়েছে আগামীকাল আব্বু আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি। তুই একটু সাহায্য কর।
রোহান বেজায় রেগে গেলো আবিরের এমন কথাবার্তা শুনে। জানা নেই চেনা নেই হঠাৎ একটা মেয়ে দেখে পছন্দ হয়ে গেলো আর পরদিন বিয়ে করবে। মেয়েটার সম্পর্কে জানাতে হবে না। রোমান নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
> ওদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করিস না। মেয়েটা বিবাহিত।
আবির মন খারাপ করে বলল,
> দেখে মনে হয়না। যাইহোক ওর স্বামী কি করে?
> ডিভোর্সী, শোন ও বিয়ে টিয়ে করবে না। তাছাড়া ওর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাচ্চা হয়েছিল ওর স্বামী বলেছে বাচ্চাটা নাকি ওর না। এটা সত্যি হতে পারে কোনো প্রমাণ নেই। শোন তুই সুদর্শন পুরুষ বাপের অঢেল টাকা পয়সা আছে তোর জন্য ও বেটার না। আরও ভালো কিছুই পাবি।
আবির হাসি হাসি মুখ করে বলল,

> দূর তুই ব‍্যাটা বুঝবি না। মেয়েটাকে দেখেই আমার চোখ আটকে গেছে। প্রেম ভালোবাসা ওসব বিয়ের পরে হবে আগে ওকে আমার করে ফেলবো। শোন তুই কিন্তু আমাদের মধ্যে ভিলেন হবি না। আমাকে চিনিস তো? পছন্দের জিনিস আমি নিজের করতে পিছপা হয়না। ডিভোর্স হয়েছে তো কি হয়েছে? আমি মানিয়ে নিবো।
রোহান ওর কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এই ছেলেকে বোঝানো কারো কর্ম না। যা বলেছে তাই করে ছাড়বে। কিভাবে আটকাবে একে সেই চিন্তাই ও ঘামতে শুরু করলো। একে না আনলেই বুঝি ভালো হতো। আবির ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল,
> তাছাড়া তোকে আরেকটা সত্যি জানানোর ছিল। হৈমন্তীকে আমি প্রথমবার না। অসংখ্যবার দেখেছি। আমি ওকে যতবার দেখেছি হয়তো তুই তার এক ভাগ ও দেখিসনি। এই ও বাংলাদেশের এসেছে এটাও বলতে পারিস আমার ইচ্ছেতে।
রোহান অবাক চোখে আবিরের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ও মিথ্যা বলার ছেলে না। কিন্তু কিভাবে সম্ভব মাথায় ঢুকছে না তাই কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে বলল,

> কিভাবে?
> এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। চল খেয়ে আসি। শাশুড়ি বাড়িতে প্রথমবার এসেছি জমিয়ে খেতে হবে। টেনশনে দুদিন খাওয়া হয়নি।
আবির কথাগুলো বলে উঠে চলে গেলো। রোহান সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। এরপর কি হবে ভেবেই ভয় করছে। তাছাড়া আবির এতগুলো রহস্য রেখে চলে গেলো। শেষপর্যন্ত হৈমন্তীর দিকে ওর নজর পড়লো। হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। চারদিকে ঝামেলায় ভরপুর। শান্তি নেই। মনে প্রশ্ন আসলো হৈমন্তী কি রাজি হবে?

ভোর রাতে বাজে একটা স্বপ্ন দেখে হৈমন্তীর ঘুম ভাঙলো। গতকাল অনুষ্ঠান শেষের আগেই রুমে এসে ঘুমিয়েছিল।আর বাইরে যাওয়া হয়নি। এতো লোকজন হৈচৈ ওর সহ‍্য হয়না মাথায় যন্ত্রণা করছে। অনিচ্ছা শর্তও কিছু কাজ ওকে করতে হচ্ছে।মায়ের মুখটা কতকাল দেখা হয়নি। গ্রামে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সেখানে গেলেই তো আবার শুরু হবে হৈমন্তী অপয়া। হৈমন্তী আগে ঘটনাগুলোকে স্মরণ করার চেষ্টা করলো। মায়ের ইচ্ছেতে বিয়ে হয়েছিল। হৈমন্তী তুলনামূলকভাবে তখন ছোট ছিল তাই বড় ভাইয়া শর্ত দিয়েছি হৈমন্তী বড় হলে শশুর বাড়িতে ফিরবে কিন্তু নিয়তি সেদিনই তাকে মরতে হলো। বিয়ে করতেই তো লোকটা সেদিন এসেছি নয়তো বাড়িতে থাকতো।

মরতে হতো না। হৈমন্তীর সেই পযর্ন্ত মনে আছে। তারপর যে ছোট ভাইয়ার কাছে কিভাবে পৌঁছালো মনে পড়ছে না। বড় ধরণের কোনো অসুস্থতার কথাও মনে আসছে না। ভাইয়াকে জিঞ্জাসা করেছিল সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। হৈমন্তী ভাবলো বড় ভাবির থেকে জেনে নেওয়া যাবে। জীবনের বড় একটা অধ‍্যায়কে ভূলে গিয়ে বসে আছে কি অদ্ভুত। নিজের উপরে বিরক্ত লাগলো। হৈমন্তী ফরজের নামাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমটা অচেনা লাগছে। অগোছালো হয়ে আছে। গতকাল হয়তো সবাই অনেক রাত পযর্ন্ত আড্ডা দিয়ে রুমে গেছে। আজ সকালে কেউ সহজে উঠছে না। হৈমন্তী রান্নাঘরে গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ চা তৈরী করে সোফায় গিয়ে বসলো। চা শেষ করতে না করতে ওকে অবাক করে বড় ভাবি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সেখানে হাজির। হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল,

> এতো তাড়াতাড়ি ঘুম কাটলো তোমার? আমি তো ভেবেছিলাম আজকে দুপুরে ছাড়া কাউকে পাওয়া যাবে না।
> আমার অভ‍্যাস আছে। বাচ্চা পালতে হলে ঘুমটুম নিয়ে ভাবলে চলে না।
> রনি খুব বিরক্ত করে তোমাকে তাইনা?
> আরে দূর মা হয়েছি এইটুকু তো করতেই হয়। হৈমি আমার সঙ্গে শপিং করতে যাবে? রনির জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
হৈমন্তী কিছু ভেবে নিয়ে বলল,
> মন্দ না যাওয়া যায়। আমারও কিছু কেনার আছে। তোমাকে আমার বন্ধু অরিনের কথা বলেছিলাম মনে আছে?
> হুম।
> ওর বিয়ে পনেরো তারিখে। হয়তো দশ তারিখের মধ্যে ওর সঙ্গে থাকতে হবে। গতকাল কথা হয়েছে আমাকে যেতেই হবে। মেয়েটা পাগলামী করছে।
> বিয়ের বাড়ির হৈচৈ সহ‍্য করতে পারবে?
>কিছু করার নেই ভাবি। তাছাড়া ওর সঙ্গে থাকলে আমি খারাপ থাকি না।

চয়নিকা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে নিয়ে সকলের চিন্তা। হুটকরে কবে না জানি সেই কালো অতীত ওর সামনে চলে আসে। মেয়েটা যদি মনের দিক থেকে শক্ত হতো তাহলে এতো ঝামেলা ছিল না। জীবনে সমস্যা আসবে তাই বলে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কি আছে। হৈমন্তীর সেই রাতে বেরিয়ে না এসে প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে কি করলো পালিয়ে এলো। তার মনে হলো লোকজন শুনলে ওকে ছোট করবে অপমান করবে। তাছাড়া জোর করে অধিকার দাবি করে সংসার হয়না। ফরহাদ প্রথম থেকেই ওর প্রতি উদাসীন। চয়নিকা ভাবতে পারলো না। একবার মনে হলো হৈমন্তী ঠিক ছিল আবার মনে হলো ফরহাদকে এমনি ছেড়ে দাওয়া ঠিক হয়নি। যাইহোক মেয়েটা ওখানে থাকলে সারাজীবন কষ্ট পেতো সেই হিসেবে ভালো হয়েছে। আপাতত যেমন আছে থাক। কথাটা ভেবে ও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

কাজের লোকজনকে আজ পাওয়া যাবে না। গতকালের থালাবাসন ঘরবাড়ি পরিস্কার করতে তারা ব‍্যস্ত। নিজেদের কাজগুলো নিজেরাই করে নিতে হবে। চয়নিকা সকলের জন্য নাস্তা তৈরী করে ফেলল। হৈমন্তী ভাবিকে সাহায্য করতে করতে সকাল আটটার বেশি বেজে গেলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুজনের শপিং করতে বেরিয়ে পড়লো। বাড়ির বাকি সদস্যরা কুম্ভকর্ণের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বারোটার আগে কেউ উঠবে না তাই কাউকে জানাতে পারলো না। চয়নিকা রনিকে সঙ্গে এনেছে। এর মধ্যে হৈমন্তীর সঙ্গে রনির মোটামুটি একটু ভাব জমেছে। ছেলেটা এখন আর ওকে ভয় পাচ্ছে না। ওরা শপিংমলের সামনে নেমে পড়লো। হৈমন্তী রনিকে নিজের কোলে তুলে নিলো।

চয়নিকা কেনাকাটা করবে রনি থাকলে অসুবিধা হতে পারে তাই। হৈমন্তী এক মাস ঢাকায় ছিল তার কিছুই মনে নেই। ঢাকা শহর ওর কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। চয়নিকা ওকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে হাটছে। সকাল টাইমে লোকজনের ভিড় তেমন নেই তবুও সাবধানতা অবলম্বন করছে। চয়নিকা ওদেরকে একটা দোকানে রেখে সামনে একটু এগিয়ে গেলো। হৈমন্তী রনিকে নিয়ে এটা সেটা দেখছে। ছেলেটাও বেশ খুশী। হৈমন্তীর বাচ্চাদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা হয়নি। রনিকে ওর বেশ ভালোলাগছে। কিন্তু হৈমন্তীর এই খুশীটা বেশিক্ষণ টিকলো না। একটা শক্ত হাত পেছনে ওরে হাতের কব্জি টেনে ধরলো। হৈমন্তী ভয়ে চমকে উঠে পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো অচেনা একটা লোক ওর হাত ধরে আছে। হৈমন্তী হাত ছাড়ানো চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হৈমন্তীর মনে হলো এই লোকটা ওকে মারতে চাইছে। ও চোখ মুখ বন্ধ করে চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু পারলো না তার আগেই লোকটা বললো,

> হৈমন্তীর আমি ফরহাদ। আমাকে চিনতে পারছো না? খুব ভূল করেছিলাম তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে। বিশ্বাস করো তোমাকে আমি অনেক খুজেঁছি কিন্তু পাইনি। এতোদিন পরে তোমাকে দেখছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সঙ্গে চলো আমি তোমাকে আর কখনও কষ্ট দিবো না।
ফরহাদ একদমে কথাগুলো বলে থামলো। ওর কথা শুনে হৈমন্তী বুঝতে পারলো ও একটা পাগলের খপ্পরে পড়ছে। ভয়টা ওর আরও জেগে বসলো। তাই কোনো কিছু না ভেবে চিৎকার দিতে উঠলো। ওর চিৎকারে রনিও ভ‍্যা ভ‍্যা করে কান্না শুরু করলো। মোটামুটি দুজন মিলে দোকান উড়িয়ে দেবার মতো অবস্থা। চয়নিকা পাশের দোকানে ছিল ওদের দুজনের এমন চিৎকার দিতে শুনে দৌড়ে এসে দেখলো ফরহাদ এখনো হৈমন্তীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ও আর অপেক্ষা করলো না দৌড়ে গিয়ে হৈমন্তীকে ওর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। চয়নিকাকে দেখে হৈমন্তীর চিৎকার তো বন্ধ হলো কিন্তু ভয় কমলো না। ফরহাদ ছেলে মানুষ ওর সঙ্গে পারা দুজনের সম্ভবও না। ফরহাদ চয়নিকাকে দেখে যেনো আশার আলো পেলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

>ভাবি আমি ওদেরকে ফিরিয়ে নিতে চাই। এই বাচ্চাটা আমার ছেলে তাই না?
ফরহাদের কথা শুনে চয়নিকা তাড়াতাড়ি হৈমন্তীকে ছেড়ে রনিকে কোলে তুলে নিলো। এভাবে একা আসা ঠিক হয়নি। কি করবে মাথায় ঢুকছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে সঙ্গে ভয়। চয়নিকা নিজেকে শক্ত করে বলল,
> পাগল নাকি আপনি? আপনাকে আমরা চিনি না। দয়াকরে ছেড়ে দিয়ে বিদায় হোন। দেখুন খুব খারাপ হবে।
ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল,
> কিসের খারাপ?আমার বউ বাচ্চা আমি ফিরিয়ে নিতে চাইছি। এতোদিন ভুল করেছিলাম মানছি। ক্ষমা চাইলে আল্লাহও ক্ষমা করে আর মানুষ হয়ে আপনারা পারবেন না।
হৈমন্তীর ধৈর্যের বাধ বেঙে গেলো। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ও হালকা চেচিয়ে বলল,
> রাখ তোর বউ বাচ্চা। এখুনি আমার হাত ছাড়। মেয়ে দেখলেই বউ মনে হয় তাইনা?

ফরহাদ হৈমন্তীর কথায় অবাক হলো। মেয়েটা ওকে চিনেও না চেনার ভান করছে কিন্তু কেনো? মেয়েটার তো খুশী হওয়া উচিৎ। ফরহাদ নিজের বাচ্চাকে মেনে নিতে চাইছে এটা ওর জন্য কম কিসের। ওদের চিৎকার চেচামেচিতে বেশ কিছু লোক জুটে গেলো। আবির সকালবেলায় এদিকে একটা কাজে এসেছি। মায়ের জন্য একটা জিনিস কিনতে শপিংমলে ঢুকতে হলো। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার চেচামেচি শুনে ভেতরে এসে দেখলো একটা ছেলে হৈমন্তীর হাত ধরে টানাটানি করছে। দৃশ্যটা ওর কাছে সবথেকে খারাপ আর জঘণ্য বলে মনে হলো। ও কোনো কিছু না শুনে না দেখে হাতের মুঠো শক্ত করে ফরহাদের মুখের উপরে কয়েকটা পরপর ঘুসি মেরে বসলো। ফরহাদ হঠাৎ আক্রমণে নিজেকে সামনে নিতে না পেরে হৈমন্তীকে ছেড়ে ছিটকে পড়ে গেলো। আবির ফুল ফর্মে রয়েছে। মেজাজ চরম খারাপ। চয়নিকা কে শুধু ইশারা করলো হৈমন্তীকে নিয়ে চলে যেতে। চয়নিকা সময় নষ্ট করলো না। হৈমন্তীকে নিয়ে সরে গেলো। আবির ফরহাদের কলার চেপে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলো। ডান হাতে কাকে একটা ফোন করলো। চয়নিকা হৈমন্তীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। হৈমন্তী ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। রনী এখনো ফুপিয়ে যাচ্ছে। কি থেকে কি হলো এখনো সবাই ঘোরের মধ্যে আছে। চয়নিকা দ্রুত ওদেরকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলো। হৈমন্তী রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। চয়নিকা রাজীব আর আরাফাতকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। দুজনই রাগে ফুলছে। এতো বছর পরে বউ বাচ্চা ফিরিয়ে নিতে এসেছে। রাজীব ইচ্ছে মতো গালিগালাজ করছে।

সিটি হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছে ফরহাদ। হাত ভেঙেছে পা মচকে গেছে। ঠোঁট মুখে বেশ জখম। দুপুরে সেই অচেনা ছেলেটা ওকে আচ্ছা করে ধোলাই করে হাসপাতালে রেখে খেছে। পাশে ফরহাদের মা শায়লা বানু গুনগুন করে সুর তুলে কান্নাকাটি করছে। দূরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লতা। সে এই মা ছেলের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হচ্ছে। ফরহাদ অচেতন আছে। ডাক্তার বলেছে কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। শায়লা বানুর প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। এই ছেলেটাই উনার শেষ সম্বল। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেটা না থাকলে কোথায় যাবেন কি করবেন ভেবেই কান্না দ্বিগুণ হচ্ছে। লতা বিরক্ত হয়ে ছুটে এসে শাশুড়িকে বলল,

> মরা কান্না জুড়েছেন কেনো? মাথা ধরে যাচ্ছে। চুপচাপ থাকবেন নাকি চলে যাবো? আমি গেলে কিন্তু আর আসবো না। তখন ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়িয়েন ভালো লাগবে।
শায়লা বানু ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। লতা চলে গেলে সত্যিই ঝামেলা হবে। ওষুধপত্র কিনতে হলেও বারবার নিচে যেতে হবে। উনার হাটুতে ব‍্যথা হয়েছে যাওয়া আসা করলে বেশি হবে। এর মধ্যেই ডাক্তার এসে বলে গেলো ইনজেকশন ফুরিয়ে গেলো হাসপাতালের সামনের দোকান থেকে আনতে হবে। লতা গটগট করে চলে গেলো। মেয়েটা বাইরে যেতেই শায়লা বানু আবারও শুরু করলেন। যেনো সুযোগ খুজতেছিলেন।
কয়েক মিনিটের ব‍্যবধানে ফরহাদের জ্ঞান ফিরলো। মাথার উপরে ফ‍্যান ঘুরছে তবুও কেমন গরম লাগছে। নড়াচড়া করতে গেলো কিন্তু পারলো না। হাত পা ভীষণ ব‍্যাথা। ঠোঁট কেটে গিয়েছিল সেখানে ফুলে বালিশ হয়েছে। পাশে মাকে দেখে ফরহাদ যেনো নিমিষেই ব‍্যথা ভুলে গেলো। ফিসফিস করে বলল,

> আম্মা তুমি জানো ওকে পেয়েছি আমি?
শায়লা বানু এতক্ষণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারলেন না। ছেলের এমন অবস্থা কে করছে আসল ঘটনা শোনার জন্য এতক্ষণ উতলা ছিলেন। উনাকে চুপচাপ থাকতে দেখে ফরহাদ বলল,
> আম্মা হৈমন্তীকে দেখেছি। তুমি জানো ও দেখতে কতো সুন্দর হয়ে গেছে? আমাদের বাচ্চাটাও সুন্দর হয়েছে। একদম আমার মতো। আমি সুস্থ হয়ে তোমাকে নিয়ে ওকে আনতে যাবো।
শায়লা বানু ছেলের এমন কথায় চমকে উঠলেন। হৈমন্তীর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা উনার নেই। উনি নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

> হৈমন্তীর সঙ্গে তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে ভুলে গেলে তুমি?
> হয়েছে তো কি হয়েছে? আমার বউ বাচ্চা আমি ইচ্ছে করলেই ফিরিয়ে নিতে পারি। তাছাড়া বাচ্চাসহ ওকে আবার কে বিয়ে করবে? আমি গেলেই দেখবা ওর মা খুশী হয়ে যাবে। আবার বিয়ে করবো। লতার সঙ্গে আমি থাকবোনা।
শায়লা বানুর মনের মধ্যেও আশার আলো ফুটে উঠলো কিন্তু ভরসা করতে পারলো না। হৈমন্তীর বাপ ভাইদের সামনে গেলে যদি ঝামেলা হয় তখন? উনি বুদ্ধি করতে লাগলেন কিভাবে হৈমন্তীকে আবারও ফিরিয়ে আনা যায়।

রোহানের সামনে বসে আছে আবির। নির্জন পরিবেশ। রোহানের মেজাজ মোটামুটি শান্ত কিন্তু আবিরে রেগে আছে। ফোস ফোস করে নিশ্বাস নিচ্ছে। রাগ কন্ট্রোল করতে যথাযথ চেষ্টা করে চলেছে। কিছুক্ষণ আগে চয়নিকা রোহানকে বোন করে সবটা বলেছে। রোহান আর অপেক্ষা করেনি আবিরের অফিসে চলে এসেছে। শেষমেশ ছেলেটা খুনখারাপির সঙ্গে জড়িয়ে না যায় ভয় পাচ্ছে। রোহানকে এভাবে চুপচাপ দেখে আবির ভ্রু কুচকে বলল,
> কিছু বলার থাকলে বল নয়তো বিদায় নে। মেজাজ চরম খারাপ।
রোহান ভনিতা না করে শান্ত কন্ঠে বলল,
> ফরহাদ কোথায়? কি করেছিস ওর সঙ্গে?
> কিছুই করিনি শুধু কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিয়েছি। তোর দুলাভাইয়ের জায়গাই থাকলে না আমি ওকে এতক্ষণে মর্গে পাঠাতাম। বেহুদ্দা লোকজন। এতোকিছু হয়ে গেছে তবুও কোনো হেলদোল নেই।
> আবির ওদের বোন ওরা বুঝবে তুই কেনো ঝামেলা করছিস। আন্টি জানলে কি হবে জানিস? হৈমন্তীর সম্পর্কে কিছুই তো জানিস না।

আবির এবার রেগে খেলো। ও টেবিল চাপড়ে বলল,
> এইটুকু একটা মেয়ের সম্পর্কে জানতে আহামরি কিছু করতে হয়নি আমার। তাছাড়া আজ পাঁচ বছর ধরে মেয়েটাকে দেখছি কখনও কোনো খারাপ কিছু দেখিনি। আমার বোনের সঙ্গে মেলামেশা করে। অরিন আগে কতটা বেপরোয়া ছিল জানিস তো?এই মেয়েটার সঙ্গে মিশে একদম শান্ত হয়ে গেছে।
রোহান ভ্রু কুচকে বলল,
> হৈমন্তী ওর কোন বন্ধুর বিয়ের জন্য দেশে ফিরেছে ওটা কি অরিন ছিল?
> তো কি মনে হয়? আমি বলেছিলাম অরিণকে হৈমন্তীকে বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে। তাছাড়া দুবছর আমি ওখানেই ছিলাম। সেসব কথা পরে বলবো এখন বল এই ফরহাদকে তোর বোনেরা সহ‍্য করে কিভাবে?
আবিরের কথায় রোহান উত্তর করতে পারলো না। কিছুই ভালো লাগছে না। আবির নিরবতা ভেঙে বলল,
> আচ্ছা আমার সঙ্গে হৈমন্তীর বিয়ে নিয়ে তোর কি অসুবিধা বলবি? আমি তো কোনো সমস্যা দেখছি না।
> মেয়েটা ডিভোর্সী আন্টি মানবে না। আঙ্কেল ঝামেলা করবে।

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৪

আমার তো এখন আফসোস হচ্ছে আমিও কেনো ডিভোর্সী হলাম না। অপেক্ষা কর আম্মুকে বলছি আমার বিয়ে দিয়ে ডিভোর্সের ব‍্যবস্থা করতে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই।
রোহান মাথায় হাত দিয়ে নড়েচড়ে বসলো। আবির চোখমুখ কঠিন করে বসে আছে। এই ছেলের কাছে কোনো বিষয় কঠিন না। সব সহজ। হৈমন্তীকে ওর বেশ পছন্দ কিন্তু আবিরের মতো এভাবে কখনও ভাবেনি। ডিভোর্সী মেয়েদের সমাজ ভালো চোখে দেখেনা সে দোষটা যারই থাকুক না কেনো। ভেবেছিল যদি মেয়েটার বিয়ে না হতো তাহলে নিজের জন্য দুলাভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিতো। কিন্তু আবির তো লাগাম ছাড়া মানুষ। নিজের কাছে যা ঠিক মনে হবে ওটাই ঠিক। কাউকে পরোয়া করে না। রোহান ভাবলো আপার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৬