শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩০

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩০
লাবণ্য ইয়াসমিন

ফারজানা হকের সামনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বসে আছে আবির। ফারজানা হকের চোখে মুখে আতঙ্ক। উনি হয়তো মৃদু মৃদু কাঁপছেন। এতো সুন্দর স্ত্রীর অভিনয় সে কিভাবে করতে পারে আবিরের বিশ্বাস হচ্ছে না। এই মহিলা ওর প্রিয় বাবার খুনি কিভাবে সম্ভব মানতে কষ্ট হচ্ছে। আবির শান্ত হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

বাবার অপরাধ টা কি ছিল বলবে? কেনো করলে এমন?
ফারজানা হক চমকে উঠলেন। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে তুতলিয়ে বললেন,
> কি বলতে চাইছো? কি করেছি আমি?
> কি বলেছি তুমি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছো। তুমি কিভাবে পারলে আমার বাবাকে মারতে? তোমার হাত দুটো কাঁপলো না? ছিঃ আম্মা আমাদের দুভাই বোনকে এতিম বানিয়ে দিলে?
আবিরের চোখে পানি তবে মুখটা বেশ শক্ত। কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনার জন্য শরীর কাঁপছে। ফারজানা হক ছেলের মুখের দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

> যা করেছি ঠিক করেছি। উনি আমার ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে শুরু করেছিল। তুমি বাবার কথায় উঠেছো আর বসেছো। নিজের ভালোবাসাকে গোপন করে বাবার কথামতো তার ক্ষতি করতে চেয়েছো। মানুষ মরার ফরমুলা তৈরী করেছো। ক্রাইম করেছো আমি চাইনা আমার বাচ্চাদের ক্ষতি হোক। ওই লোকটা আমার জীবন তো শেষ করেই ফেলেছে এখন তোমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছিল। আবির আমি চাইনি তুমি এরকম কিছু করো।
আবির মায়ের কথায় আক্রশে ফেটে পড়ছে। বাবা যেমনি হোক সে ওর বাবা ছিল। কতটা ভালোবাসা পেয়েছে ওই লোকটার কাছ থেকে তার ঋণ ও কিভাবে শোধ করবে। আবির চোখের পানি মুছে বলল,

> উনি আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছেন তার কাছে এসব কিছুই না। লোকটা আমাকে ভালোবাসতো আম্মা। তুমি অপরাধ করেছো। আমার থেকে আমার প্রিয় মানুষকে কেঁড়ে নিয়েছো ঠিক করোনি। তোমাকে আমি কখনও ক্ষমা করবো না।
> করতে হবে না আমি জেল বা ফাঁসি যাইহোক মানতে রাজি আছি। তুমি ভূলে যাচ্ছ কেনো লোকটা তোমার নিজের বাবা ছিলেন না। তোমাকে আমি দত্তক নিয়েছিলাম। উনি পারতেন তোমার পরিচয় লুকিয়ে রেখে আমাদের সন্তান হিসেবে পালন করতে কিন্তু উনি কি করেছেন? উঠতে বসতে তোমাকে আদর যত্ন করে বুঝিয়ে এসেছে তুমি আমাদের ছেলে না।

আমরা নিজেদের ছেলে না হওয়া শর্তও তোমাকে এতোটা ভালোবাসা দিয়েছি তোমার উচিৎ তার প্রতিদান দেওয়া। সন্তানের কাছে বাবা মা কখনও কি প্রতিদান চেয়েছে?।তুমি বোকার মতো নিজের জীবন উনার কথায় পরিচালনা করেছো। একবারও ভাবোনি তোমার নিজের মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে আগলে রাখবো। তুমি যাকে বাবা বাবা করে পাগল হয়ে যাচ্ছ সে সুযোগ বুঝে ঠিকই তোমাকে ফাসিয়ে দিতো। উনি লোভী। কতটা লোভী তুমি কল্পণাও করতে পারোনি। আবির আমি চাইনি ওই লোকটার জন্য আমার সন্তানের ক্ষতি হোক। একজন স্ত্রী হওয়ার পরে আমি একজন মা। তোমার মা অরিনের মা। তুমি বুঝবে না মায়ের কষ্ট। তুমি যে মেয়েটার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছো তার থেকে ডকুমেন্ট নিতে, ভেবে দেখো তার কি হাল তুমি করেছো।

ফারজানা হক একদমে কথাগুলো বলে থামলেন। লোকটার সঙ্গে থাকলে আবির সারাজীবনেও সুধরাতো না। উনি নিজের স্বামীকে ভালো করে চিনেন। আবিরকে দিয়ে উনি যা ইচ্ছা তাই করিয়ে নিতেন তাই বাধ্য হয়ে স্বামীকে বিষ দিয়েছেন। মানুষ শুধু উপরের খোলসটাই দেখতে পারে ভেতরটা দেখতে গভীর চোখ লাগে। বাইরে থেকে ভালো মনে হলেই কি সে ভালো? ফারহানা হক স্বামীকে প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। করবেন না কেনো এই বাড়িটা উনার বাবার। নিজের বাবা মায়ের অর্জিত সম্পত্তি উনার স্বামী ভোগ করে আসছে। কি ছিল লোকটার যখন ফারজানা হক লোকটাকে বিয়ে করে। কিছুই ছিল না।

বাবাকে হাত করে একমাত্র ভাইকে ঠকিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করে এই বিশাল সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়েছে। বাবা পরে ভূল বুঝলেও কিছু করার ছিল না। উল্টাপাল্টা ওষুধ দিয়ে দুজনকেই মেরে ফেলেছে। ফারজানা হক বুঝতেই পারেননি। যখন সবটা জানতে পেরেছেন তখন থেকেই ভেবেছিলেন এই লোকটা জীবিত থাকা অবস্থায় আমার ছেলেমেয়েরা ভালো থাকবে না। আবিরকে দত্তক নিয়েছিলেন তখন উনি খুশী ছিলেন না কিন্তু পরবর্তীকালে যখন অরিন জন্মগ্রহণ করে আর ডাক্তার বলে উনার কোনো সন্তান হবে না তখন থেকেই ছেলেটার উপরে লোকটা আলগা দরদ দেখাতে শুরু করে। ফারজানা হক একমনে কথাগুলো ভাবছে। হঠাৎ আবিরের কথায় উনার ধ‍্যান ভাঙলো,

> মেয়েটার চিন্তা পরে করবে আগে নিজের চিন্তা করো। আমি ওকে ভালোবাসি কে বলেছে তোমাকে? আমার দিকে তাকিয়ে দেখো? বাবার প্লান ছিল ভালোবাসার নাটক করা আমার ছিল না। আমি বিরক্ত হয়ে গেছিলাম।
> সত্যিই বিরক্ত হয়েছো? ভালোবাসা না থাকলে ওকে মেরে ফেলতে পারতে। না হলে জান্নাতকে কিডন‍্যাপ করে বাধ্য করতে ডকুমেন্ট দিতে এমন কিছু করেছো কখনও? আবির আমাকে বোঝাতে এসো না। এসব আজেবাজে কাজকর্ম ছেড়ে দাও। লোকটা মারা গেছে এখন তুমি স্বাধীন।

> ওই ফরমুলাটা আমার দরকার। তাছাড়া ওখানে বেশ কিছু তথ্য আছে। ওই মেয়েটাকে আমি ছাড়তেই পারবো না। বাবা যখন বলল ওকে বিয়ে করে নিতে আমার মানতে কষ্ট হয়েছিল। তবুও করেছি এমনি এমনিই না।
> বাবার সাথে থেকে বাবার মতো অমানুষ তৈরী হয়েছো। মেয়েটার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করতে বিবেকে বাধলো না? মেয়েটা জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। তোমার মুখ দর্শন করবে না। ভালোবাসার উপর থেকেই বিশ্বাস উঠে যাবে।
আবির তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

> তোমাকে দেখলেও স্বামীদের বিশ্বাস উঠে যাবে স্ত্রীদের উপর থেকে। তুমি নিজে কি করেছো? আর হৈমীর কথা বলছো? মেয়েটা দুর্বল না। ও আশা করে কিভাবে নিজে ডিভোর্সী এক সন্তানের মা হয়ে আমার মতো একটা ছেলের ভালোবাসা পাবে। জীবন এতো সহজ না। প্রথম দেখাতে আর যায় বলো ভালোবাসা হয় বলো না। হাস‍্যকর লাগে।
আবির কথাগুলো খুব তোড়ের সঙ্গে জোর গলাই বললো কিন্তু তৃপ্তি পেলো না। হৈমন্তীকে মারার কথা ও কল্পণাও করতে পারে না। তাছাড়া ওতো খুনী না। বাবার আদেশ মতোই কাজ করেছে। বিয়ে একটা অদৃশ্য বন্ধন। মেয়েটার উপরে ওর মায়া জন্মেছিল। নয়তো ওর ক্ষতি করে ফেলতো। বাবাকে বারবার এটা ওটা দিয়ে বুঝিয়েছে।

জান্নাতের প্লানটাও ওর বাবার ছিল। জান্নাতের মায়ের এতো সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা পরের কাছে মানুষ হয়েছে। ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে খুব সুখেই আছে। আবির লোকজন দিয়ে সেসব দলিল পত্র উদ্ধার করেছে। মেয়েটাকে ও ভালোবাসে। শিশুর প্রতি ওর ক্ষোভ নেই। কিন্তু ফারজানা হকের সঙ্গে এখন কি করা উচিৎ? পুলিশকে বলে দিবে নাকি অন‍্য কিছু। মাকে ও কম ভালোবাসে এমন না। চারদিক থেকে ফেঁসে গেছে। মায়া জিনিসটাই বিরক্তিকর বলে ওর মনে হচ্ছে। ফারজানা হক ওর নিরবতা দেখে বলল,

> বাবা নেই তাই নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নেওয়ার চেষ্টা করো। স্বামীর খুনি হিসেবে আমি একটুও লজ্জা পাচ্ছি না। আমার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণও পাবে না। যেটা ধরে বাবার খুনিকে শাস্তি দিবে। নিজেকে একটু ঠিকঠাক করো। এভাবে জীবন চলে না।
ফারজানা হক কথাটা বলে উঠে গেলো। আবির সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ফাইলটা পেয়ে গেলে হৈমন্তী কখনও জানতেও পারতো না আবিরের এই কঠিন সত্যিটা। মেয়েটা যেমন থাকতে পছন্দ করতো আবির ওকে তেমনই রাখতো। কাছে আসতে চাইলে নিয়ে আসতো দূরে যেতে চাইলে পাঠিয়ে দিতো। এমন পরিস্থিতির স্বীকার হবে কখনও ‍ভাবেনি। বাবা থাকলে ঠিক একটা বুদ্ধি দিয়ে দিতো। নিজের উপরে রাগ হচ্ছে। ফাইলটা যদি না রাখতো এমন কিছুই হতো না।

আরশী ফারজানা হকের কাছে বসে আছে। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। ফারজানা হকের মন ভালো নেই। আবির উনার সঙ্গে কথা বলছে না। তখন বের হয়েছে আর আসেনি। ছেলেটা আজ থেকে বাড়িতে ফিরবে না এটা উনার অজানা নেই। তবুও উনার কিছু করার নেই। স্বামীকে একবারে মারতে চাইছিলেন না। ভেবেছিলেন বিছানায় থাকবে কিন্তু হঠাৎ সুস্থ হয়ে উঠছিল তাই বাধ্য হয়েছে। না মারলে লোকটা উনাকে মেরে ফেলতো। তারপর আবিরকে দিয়ে আরও আজেবাজে কাজ করিয়ে নিতো। নিরবতা ভেঙে আরশী বলল,
> খালামনি বাবা মা আসতে চাইছে আমার আর আবিরের বিয়ের কথাবার্তা বলতে। তোমাকে কথা বলতে বলেছে।
ফরহাদ হক চমকে উঠে বললেন,

> আমি এই বিয়েটা মানতে পারছি না। তুমি সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে তোমার জন্য ছেলের অভাব পড়বে না। বাবা মাকে বলো ভালো ছেলে দেখতে। আজকের পরে তোমার মুখে এধরনের কথা যেনো আর না শুনি যাও।
ফারজানা হকের ঠান্ডা হুমকিতে আরশী কেঁপে উঠলো। লজ্জা আর অপমানবোধ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আবিরকে ওর পছন্দ হয়েছে তাছাড়া ওর মা বলেছে আবিরকে বিয়ে করলে সারাজীবন সুখের থাকতে পারবে। তাই বলে এমন অপমান সহ‍্য করবে কখনও না। আজকেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে কখনও ফিরবে না। ওকি ফেলনা নাকি।

মেয়েকে নিয়ে বসে আছে হৈমন্তী। সামনে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটা ওর বাবার বন্ধু রহমান হোসেন। লোকটার একটা মেয়ে আছে দেশের বাইরে থাকে। ভদ্রলোক স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামেই থাকে। গ্রামের উনার বেশ নাম প্রতিপত্তি আছে। এখনকার গ্রাম বাংলা আগেকার মতো নেই। সব পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ সব আছে। গ্রামের সঙ্গে লাগোয়া বাজার আছে। ভদ্রলোক হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন

> মা জীবনটা তোমার,তুমি নিজের জীবন কিভাবে পরিচালনা করবে সেটা তোমার উপরেই নির্ভর করে। জানো তো মানুষ কর্ম দ্বারা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?কারো উপরে নির্ভর না করে নিজেই পথ চলতে শুরু করো আমরা আছি তোমার পাশে। আজ থেকে আমার দুটো মেয়ে। এখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি তোমার একটা কাজের ব‍্যবস্থা করে দিবো। মেয়েকে মানুষ করো। বিয়ে স্বামী সংসার ছাড়াও মেয়েরা বাঁচতে পারে মানুষকে প্রমাণ করে দাও। অবলার মতো চোখের পানি ফেলো না। তুমি যে দুর্বল কাউকে বুঝতে দিও না। একবার যদি কেউ তোমার দুর্বলতার খোঁজ জেনে যায় দেখবে সেখানেই বারবার আঘাত করছে। পারবে না একা মেয়েকে মানুষ করতে?
হৈমন্তী মলিন হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,

> পারবো আঙ্কেল। আমি তো কারো থেকে কিছু আশা করিনি। সবাই নিজ থেকেই আমার কাছে এসেছে আর আশা দিয়ে প্রতারণা করেছে। আমার দোষটা কোথায় বলতে পারেন?তবে এখন থেকে এই ভূলটা আর জীবনেও করবো না। মেয়েকে নিজের মতো করে মানুষ করবো। এইটুকু জীবনে কতকিছু সহ‍্য করলাম হাপিয়ে উঠেছি আর পারছী না।

> রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো। তুমি এখানে আছো কেউ জানতে পারবে না। আমি কাউকে জানতেও দিবো না। ভয় নেই।
মেয়েকে নিয়ে উঠে গেলো হৈমন্তী। গতকাল রাতে আরাফাত ওকে এখানে রেখে গেছে। নিজের ফোন থেকে ফোন করতে পারবে না। বাইরে থেকে রহমান আঙ্কেলের কাছে ফোন দিয়ে কথা বলে নিবে। বাড়ির পরিস্থিতি আরাফাত সামলে নিবে। বোনের ধারে আছেও কাউকে আসতে দিবে না হৈমন্তীর জানা আছে। হৈমন্তীর বারবার আবিরের করা অভিনয় গুলো চোখে ভাসছে। লোকটা কিভাবে পারলো এমন করছে ওর মাথায় ঢুকছে না। কখনও সন্দেহ হয়নি। ফাইলগুলো লোকটার হাতে ও কখনও তুলে দিবে না। মানুষ মারার ফাঁদ তৈরি করেছে সেটা।ও এটা নিজের সঙ্গে লুকিয়ে রাখবে। কথাটা ভেবে হৈমন্তী মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। যদি কখনও দেখা হয় ও বলবে এতোটা করার কোনো মানে ছিল না।

ক্লন্ত শরীরে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো আরাফাত। অরিন কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরিণকে দেখে ওর রাগ হচ্ছে। বারবার হৈমন্তীর কথাগুলো মনে পড়ছে। এই মেয়েটার ভাইয়ের জন্য নিজের বোনকে বারবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এখন পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। কাউকে ক্ষমা করবে না। সব কিছুর হিসেবে নিয়ে ছাড়বে। হৈমী আসার সময় বারবার বলে দিয়েছে অরিনের সঙ্গে খারাপ ব‍্যবহার না করতে।

কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে। হৈমন্তী চলে গিয়েছে বাড়িতে কথাটা বলার পরে রাজীব রাগ করেছে। মেয়েটার মাথায় সত্যি সত্যিই সমস্যা আছে বলে রাজীবের মনে হচ্ছে। চয়নিকা ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে ছিল হয়তো ওর হজম হচ্ছে না বিষয়টা। মনে সন্দেহ হয়েছে। একমাত্র মাসুদ বিষয়টা নরমাল ভাবে নিয়েছে। মেয়েটা কাজকর্মমের বিষয়ে খুব সিরিয়াস। এখন গেছে পরে চলে আসবে এতে ঝামেলা করা কিছু নেই। বোন ভালো আছে এটাই অনেক। বাড়িতে আরেকটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সেটা হচ্ছে আমেনা বেগমের মন। উনি আগে হৈমন্তীকে সহ‍্য করতেই পারতো না এখন তার জন্য কেঁদে কেটে অস্থির হচ্ছে। মেয়েটেকে এক নজর দেখে ক্ষমা চাইবে। দুটো মেয়ের কাছেই চাইবে।

উনি ভেবেছিলেন মেয়ের বিয়ে হলেই মেয়েরা সুখে থাকে, ভালো থাকে। নারীর জীবনে পুরুষের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের জন্ম হয়েছেই স্বামী সংসার করার জন্য। বাচ্চা জন্মদান আর স্বামীর খেদমতেই মেয়েদের সুখ। নিজেও খুব ছোট থাকতে শশুর বাড়িতে এসেছিলেন। শাশুড়ির কথামতো চলতেন। স্বামী উনার বেশ ভালো ছিল। ভয়ে ভয়ে চলতে গিয়ে সেসব তিনি রপ্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু যুগ বদলে গেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা স্বামীর পায়ের নিচে পড়ে থাকতে চাইনা। ওরা স্বামীকে নিজের অর্ধাঙ্গ ভাবে। মেয়েদেরও মন আছে। ওদের কাঠ বা লোহার শরীর না। রক্ত মাংসের শরীর। ব‍্যাথা যন্ত্রণা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। বুঝতে উনার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কিছু ভূল সময় থাকতে সুধরে নেওয়া উচিৎ। আরাফাতের ধ‍্যান ভাঙলো অরিনের কথা শুনে। মেয়েটা ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আপনার পানি। কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? অপেক্ষা করছি।
আরাফাত ভ্রু কুচকে উত্তর দিল,
> কি দরকার?
> এমনিই আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। আপনি বুঝবেন না। আপনার দিকে তাঁকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে। আমি মনে হচ্ছে আপনার প্রেমে পড়েছি।
আরাফাত পানি মুখে নিয়েছিল অরিনের এলোমেলো কথা শুনে কাশি এসে গেলো। ফলাফল হিসেবে মুখের পানির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অরিনের মুখে গায়ে ছড়িয়ে গেলো। মেয়েটা কাঁদ কাঁদ হয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> ভিজিয়ে দিলেন? একটু সাবধানে পানি খাবেন না?
আরাফাত খুকখুক করে কেশে বলল,

> কথাবার্তার কি বেহাল অবস্থা। এসব শুনলে এমনিই কাশি আসে। পাগলামি বন্ধ করে সামনে থেকে যাও ভালো লাগছে না। বিরক্ত করবে না ঘুমাবো আমি।
অরিন ঠোঁট উল্টে ফেলল। লোকটা এরকম কেনো বুঝতে পারে না। প্রথমে এমন ছিল, মাঝখানে বেশ স্বাভাবিক তারপর আবারও আগের ফর্মে ফিরে এসেছে। অরিনের মন খারাপ হচ্ছে লোকটা যদি সব সময় এমন হম্বিতম্বি করে তবে সংসার হবে কবে? যতদিন বিয়ে হয়েছে এতদিনে ঘর আলো করে নতুন সদস্য হাজির হতো। অরিণের আফসোস হচ্ছে।।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আবির। জীবনের প্রতি বিরক্ত ধরে গেছে। প্রাণের থেকেও অধিক প্রিয় বাবার মৃত্যু সেই সঙ্গে হৈমন্তীর গায়েব হয়ে যাওয়া আবিরকে একেবারে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। পরের জন্য কুপ খুঁড়তে গিয়ে নিজেই সেই কুপে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা । কখনও ভাবেনি বাবা ওকে ছেড়ে চলে যাবে। হৈমন্তীর উপরে আবির দুর্বল। একটু খানি না অনেকটাই দুর্বল যেটা প্রকাশ করতে পারেনি। চারদিক থেকে হারিয়ে ফেলল। মেয়েটা ওকে কখনও ক্ষমা করবে না আবির এটা ভালো করেই জানে। কিন্তু ওতো মেয়েটার ক্ষতি করত না। শুধু ফাইলগুলো নিয়ে নিতো। এলোমেলো ভেবে চলেছে আবির। সামনে বসে আছে জাবেদ। জাবেদের চোখেমুখে বিস্ময়। আবির নীরবতা ভেঙে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> আমার সঙ্গেই কেনো এমন হলো বলতে পারো জাবেদ? আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি কিন্তু কেনো করেছি এটাতো কেউ ভাববে না। তুমি বলো বাবার ছায়া ছাড়া আমি কি এখানে এসে পৌঁছাতে পারতাম? এই আবির এহসান কোনো বস্তিতে নয়তো রাস্তার ছেলে হয়ে ঘুরতো। নিজের বাবা মা তো জন্ম দিয়েই পৃথিবী ছেড়েছে। আমাকে যে লালন পালন করেছে তার উপরে আমার কৃতজ্ঞতা থাকা উচিৎ ছিল না?
জাবেদ মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
> ম‍্যাডাম আপনাকে ভূল বুঝেছে আপনি কষ্ট পাবেন না। উনাকে আমি খুজেঁ বের করবো। উনি বুঝবেন আপনার কষ্ট।
আবির তাচ্ছিল্যের করে বলল,

> লাগবে তাকে। সে ভালো থাক। তুমি আর ওকে খুজোঁ না। আমার কোনো ডকুমেন্ট লাগছে না। যার জন্য এতোকিছু করলাম সেইতো আর বেঁচে নেই। তাছাড়া আমি চাইনি ওটা কোনো বিদেশির হাতে পড়ুক। ওই ফরমুলাটা বাবা সংগ্রহ করেছিল উনার বন্ধুর থেকে। আমাকে আনতে বলেছিল আমি ভূলে রেস্টুরেন্টে ফেলে চলে এসেছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ঘুরাঘুরি করতে তখন পছন্দ করতাম। এসব ফাইল টাইলে আমার মন ছিল না। তারপর যখন ওটা হারিয়ে গেলো তখন বাবাকে কেমন উন্মাদ হয়ে যেতে দেখলাম। উনি আমাকে থাপ্পড় দিয়ে বললেন, তোমাকে মানুষ করছি এই তাঁর প্রতিদান দিলে। তুমি বড্ড বেইমান।

পর কখনও আপন হয়না। জাবেদ কথাটা আমাকে কতটা যন্ত্রণা দিয়েছিল তোমাকে বোঝাতে পারবো না। সেদিন থেকেই ভেবেছিলাম বাবার সব কথা শুনবো। যা বলবেন তাই। তখন থেকে মেয়েটার পিছু নিয়েছি। আচ্ছা জাবেদ তোমার মনে হয়না একজন পুরুষ মানুষ সব সময় একটা মেয়ের পেছনে লাড্ডুর মতো ঘুরছে। শুধু নিজের স্বার্থের জন‍্যই আর কোনো উদ্দেশ্যে নেই?। শুনেছি প্রথম দেখাতেই প্রেম হয়ে যায় সেখানে আমি ওকে অসংখ্যবার দেখেছি তোমার মনে হয়না আমার দুর্বল হওয়াটা স্বাভাবিক কিছু?।আমার বয়সটা ছিল ভালোলাগার ভালোবাসার। মেয়েটার দুঃখ কষ্ট দেখে মনে হতো এক নিমিষেই ওর সব কষ্টগুলো উড়িয়ে দেই কিন্তু হতোই না। আমার নিয়তিই খারাপ। ছেড়ে দাও জাবেদ। আমার ভিসার ব‍্যবস্থা করো। আমেরিকা না অন‍্য কোথাও যেতে চাই। একা থাকতে চাই। এটাই আমার শাস্তি। আমার ছায়া অনেক ভয়ংকর।

জাবেদ অবাক হচ্ছে আবিরের কথাবার্তা শুনে। ছেলেটা আগে থেকেই ইমোশনাল ছিল বড় স‍্যারের জন্য শক্ত হয়ে কাজকর্ম করেছে। লোকটার অবর্তমানে আবার আগের মতো হয়ে গেছে। বড় ম‍্যাডাম হয়তো জানতো এমন কিছুই হবে তাই কৌশলে স‍্যারকে সরিয়ে দিলেন। পৃথিবীর সবাই কি স্বার্থপর? যে যাকে পারছে টপকিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ফারজানা হক স্বামীর অবর্তমানে সব কিছুর মালকিন। কিন্তু আবিরের কি? ওর তো কিছুই নেই। না আছে বাবা মা না আছে বাবা মায়ের সম্পত্তি। ফারজানা হক চাইলেই ওকে বাড়ি থেকে তাঁড়িয়ে দিতে পারে। ও তো একদম একা। একজন মানুষের এর চাইতে ভালো শাস্তি আর কি হতে পারে। আবির মলিন হেসে বলল,

> জাবেদ ওসব ফাইল বা ডকুমেন্টের বিষয়ে কাউকে বলো না। তাহলে হৈমীর ক্ষতি হবে। সবাই জানে ওটা আমার কাছেই আছে। যদি ফ‍াঁস হয়ে যায় তখন ঝামেলা আছে। আমি আর কারো ক্ষতি করতে চাইনা। তুমি আজকের মধ্যেই আমার যাওয়ার ব‍্যবস্থা শুরু করো। কার জন্য থাকবো। আমি তো এতিম।
> স‍্যার এসব বলবেন না। আপনি কেমন সেটা আমি জানি। আপনার যাওয়ার ব‍্যবস্থা আমি খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলবো। আপনি চিন্তা করবেন না।
> আম্মুকে দেখেশুনে রেখো। সে যা করেছে ক্ষমা হয়না তবুও সে আমার মা। তার স্বামীকে সে খুন করেছে আমি কি বলবো। তাঁর স্বামীর উপরে আমার কোন অধিকার নেই। তুমি কেস টা বন্ধ করে দিতে বলে দিও।
> স্বী স‍্যার।

আবির কথাটা শেষ করে পূর্বের মতো চোখ বন্ধ করলো। কারো ক্ষতি চাইলে নিজেরও ক্ষতি হয় কথাটা আজ বিশ্বাস হচ্ছে। জাবেদ চুপচাপ ফাইল হাতে বেরিয়ে গেলো। অফিসে কাজকর্ম চলছে তবে আবিরের সেদিকে খেয়াল নেই। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। মনে হচ্ছে সুইসাইড করে নিতে। ভাবলো সুইসাইড করলে কি সব দুঃখ চলে যাবে? আবির একবার ভাবলো সুইসাইড করবে। বিদেশে গিয়েও কি শান্তি আসবে? আসবে না তখন আরেকট যন্ত্রণা ওকে খাবলে ধরবে। মৃত্যুতেই মিলবে মুক্তি। হৃদয়ের সঙ্গে বিলীন হবে হৃদয়ের যত চাওয়া পাওয়া। লাইট দুটো বারবার বিড়বিড় করলো হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। ঝট করে চোখ খুঁলে দেখলো রোহান হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আবির ভ্রু কুচকে বলল,

> তুই?
রোহান এগিয়ে এসে বলল,
> তোর পরিণতি দেখতে আসলাম। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। তোর অবস্থাও তেমন। না হৈমন্তীকে পেলি না নিজের বাবাকে বাঁচাতে পারলি। আর না পারলি সেই মহামূল্যবান ডকুমেন্ট।
আবির বিস্মিত হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> তুই এসব কিভাবে জানলি,তোকে কে বলেছে? কে বলছে তোকে?
আবিরের অস্থিরতা দেখে রোহান তাচ্ছিল্যেরের হাসি দিয়ে বলল,

> অনেক কিছুই জানি। যাইহোক যেটা তুই পারিসনি আমি সেটাই করে দেখিয়ে দিব। আন্টি আমাকে ডেকেছেন তোঁর কাছে আসার ইচ্ছে আমার ছিল না। তুই যা করেছিস আমার সঙ্গে, জীবনে ভুলবো না।
আবির বিস্মিত হয়ে তাঁকিয়ে আছে। রোহানের সঙ্গে ওর মায়ের কি কথাবার্তা থাকতে পারে? তাছাড়া ফারজানা হক অফিসে তেমন আসেনা। হঠাৎ এখানে কি জন্য আসবে। আবিরের ধ‍্যান ভাঙলো রোহানের কথা শুনে। রোহান ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে চলে গেলো। ছেলেটা মেহুলের নাম ধরে কথা বলছিল। আবির ভ্রু কুচকে থাকলো। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না। কি করতে চাইছে এরা? নিজের উপরে বিরক্ত হচ্ছে। কয়েকদিনের ব‍্যবধানে কতটা অসহায় হয়ে উঠেছে। ফারজানা হক স্বামীর মৃত্যুর পরে সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে কিন্তু কেনো? আবির মায়ের উপরে ভরসা করতে পারছে না। শুধু ওর জন‍্যই কেনো উনি নিজের স্বামীকে খুন করতে চাইবে? মানুষ এতোটা ভালো হয়? কতকি জানার আছে।

রহমান সাহেবের সাহায্যে একটা বেসরকারি কলেজের শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করেছে হৈমন্তী। আজকে তাঁর প্রথমদিন ছিল। মেয়েটাকে সঙ্গে আনা হয়নি। দুটো ক্লাস নিতে হবে। পরপর দুটো ক্লাস নিলেই ঝামেলা শেষ। বাংলা পড়াতে হবে। এখানে শিক্ষকের দরকার ছিল সৌভাগ্যবশত হৈমন্তীকে সিলেক্ট করা হলো। হৈমন্তী এতেই খুশী তবে এর বাইরেও কিছু করবে। মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হলে টাকা পয়সার দরকার হবে। নিজের একাউন্টে যে টাকা আছে ওটা তুলতে পারবে না। পেছনে বিপদ হানা দিয়ে আছে। এই সুত্র ধরে ঠিক হাজির হবে। দরকার নেই সেসব হৈমন্তী রোজগার করতে জানে। প্রথমদিন থাকাই সকলের সঙ্গে পরিচিত হতে বেশ সময় লাগলো।

রহমান সাহেব ওর সঙ্গে এসেছে। হৈমন্তী নেকাব পড়ে আছে। ও চাইছে না কারো সামনে আসতে। আধুনিক যুগ কোন ছাত্রের টিকটক বা লাইভের ঝামেলায় ফেসে গিয়ে ভাইরাল হয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। সাবধানের মার নেই। মোটামুটি নিজের একটা শক্তপক্ত পরিচয় তৈরী করতে হবে। আর পালিয়ে বেড়ালে চলবে না। জীবন সুখের যদি সেটাকে উপভোগ করা যায়। হৈমন্তী মেয়েকে নিয়ে সুখে থাকবে। সেখানে কারো কালো ছায়া হানা দিতে পারবে না। না আবির না ফরহাদ কেউ না। হৈমন্তী অফিসের মধ্যে বসে ছিল পাশের ছিটে একটা ম‍্যাডাম বসে আছে। মেয়েটার কথায় হৈমন্তীর ধ‍্যান ভাঙলো।

> জানেন আপা আমিও আপনার মতোই স্লিম ছিলাম কিন্তু ভাগ্য গুণে একটা প্রেম করলাম। বয়ফ্রেন্ড ভালোবেসে সকাল বিকল চারবেল শুধু বলতো অনু তুমি না খেলে আমি কষ্ট পাবো। তুমি অনেক অনেক খাবে। আমিও কি বোকা। খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে গেলাম কিন্তু শেষপর্যন্ত উনি পাশে থাকলো না। বিয়ে করে নিলো। আমার ও বিয়ে হলো। মাঝখান থেকে আমি এখন মোটা।
হৈমন্তী ভদ্রমহিলার কথা শুনে মলিন হাসলো। অনুকা ম‍্যাম বিস্মিত হয়ে বলল,

> আপনি একটু চুপচাপ টাইপের তাইনা? আমি প্রচুর কথা বলি। আপনাকে হাসানোর জন্য কথাগুলো বললাম। সেই কখন দেকে দেখি মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে আছেন।
হৈমন্তী ছোট করে উত্তর দিলো,
> আমার মেয়েটা বাড়িতে আছে কি করছে খুব চিন্তা হচ্ছে।
> চিন্তা করবেন না। এরপর থেকে নিয়ে আসবেন।
> না না বাড়িতেই ভালো আছে। ভীষণ দুষ্টু।
মেয়েটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। হৈমন্তী ছুটির ঘন্টা পেয়ে মেয়েটার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো। রহমান সাহেব ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। এখন থেকে হৈমন্তী একা একাই যাওয়া আসা করবে। শুরুটা না হয় এভাবেই হলো।

মন খারাপ করে বসে আছে অরিন। মায়ের সঙ্গে প্রথমবার ঝামেলা হয়েছে। ছোট একটা বিষয় নিয়ে ভয়ানক তর্কাতর্কি হয়েছে। আরাফাতকে অফিসে যেতে মানা করা হয়েছে। উনি নাকি আজ থেকে অফিসে বসবে কি একটা ঝামেলা। আরাফাত তো ইচ্ছা করে অফিসে যেতো না। ওকে বাধ্য করা হয়েছিল। আবির আর ওর আব্বুর সিদ্ধান্ত ছিল সেখানে মা কেনো মানা করছে ওর জানা নেই। এখন আরাফাতকে কিভাবে মানা করবে? লোকটা যদি খারাপ কিছু মনে করে? অরিন সেসব নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করছে। আরাফাত বাথরুম থেকে বেরিয়ে অরিনকে কিছু ভাবতে দেখে বলল,

> আবারও কি হারপিকের চিন্তা মাথায় ঘুরছে? মুখটা পাতিলের মতো করে রেখেছো কেনো?
অরিন চমকে উঠে করুণ চোখে তাঁকিয়ে বলল,
> আজেবাজে চিন্তা আমি করিনা। আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?
আরাফাত কাধ থেকে টাওয়েল নামিয়ে চুলগুলোর নাড়তে নাড়াতে বিছানায় গিয়ে বসলো। অরিন উত্তরের আশায় মুখ উচু করে বসে আছে। আরাফাত ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> ভাইয়ার সঙ্গে যাচ্ছি। তোমার ভাইয়াকে বলে দাও আজ থেকে সেখানে আমি যাচ্ছি না। শশুর বাড়ির গোলামী খাটার চাইতে নিজে কিছু করা ভালো।
অরিন যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। লোকটা যে ওকে কি বাঁচানো বাঁচিয়ে দিলো আল্লাহ ভালো জানে। খুশীটা ও নিজের মধ্যে ধরে রাখতে না পেরে দাঁত বের করে হেসে বলল,

> এই জন‍্যই আপনাকে আমার এতটা ভালোলাগে। আপনি সেই কিউট। আপনাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পাই। আপনি….
আরাফাত অরিনের কথা বাড়তে দিলো না। মেয়েটার দিনদিন লজ্জা শরম কমে যাচ্ছে। কি ঠোঁট কাটা স্বভাব হয়েছে। আরাফাত ধমক দিয়ে বলল,
> থামবে? যাও চা নিয়ে এসো। আজ থেকে প্রতিদিন আমার জন্য একটা করে পদ রান্না করবে। রাতে এসে খাবো।
অরিন ওর কথায় বেজায় খুশী হলো। বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না। যদি একটা রান্না করা যায় সময় ভালো যাবে। লোকটার কতো বুদ্ধি। অরিনের এই খুশীতে আরও দুটো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু লোকটা এবার ধমক দিবে। অরিন তবুও খুশী হয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,

দারুণ একটা কাজ দিলেন। এই খুশীতে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে…
> চা খাবো।
অরিন চা খাবো কথাটা শুনে থেমে গেলো। মনে মনে ভাবলো লোকটা খাবিশ টাইপের। প্রেমের প ও বুঝে না। ছেলে মানুষ তো? সন্দেহ হচ্ছে কথাটা ভেবেই অরিন জিব কামড়ে ধরে মনে মনে বলল,
” ছিঃ ছিঃ আল্লাহ পাপ দিও না কি সব ভাবছি”

শেষ থেকে শুরু পর্ব ২৯

অরিন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। আরাফাত বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। অরিনের ফোনালাপের সবটাই ওর শোনা হয়ে গেছে। মেয়েটার পরিবারের সবগুলো মানুষকে ওর সন্দেহ হয়। শশুরের মৃত্যুর জন্য কাকে দোষী করবে ভাবনাতে আসে না। আবির যেভাবে লোকটার সেবাযত্ন করেছে ওর দ্বারা এসব করা সম্ভব না। অরিন বাবা ভক্ত মেয়ে। ওকেও সন্দেহ করা যায় না। শাশুড়িকে ওর একটু কেমন কেমন লাগে। সব কিছুতেই অতিরিক্ত মাথা ঘামায়। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। এদের ঝামেলায় পড়ে ওদের ভাই বোনের জীবনটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। ওদের থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল। যা ইচ্ছা করুক ওদের কি। হৈমন্তী ভালো আছে। এটাইতো অনেক। মেয়েটা নিজের মতো করে বাঁচুক।

শেষ থেকে শুরু শেষ পর্ব