এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৩

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৩
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ জ্যোতির প্রতি ভালোবাসাটা অনুভব করেছিল জ্যোতি চলে যাওয়ার পর। সুদূর চট্টগ্রামে পাড়ি জমানোর পর জ্যোতির সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে খুবই কম।বলা যায় বরাবর জ্যোতিই স্বল্প কথায় কিংবা ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে।

আর সরাসরি দেখাসাক্ষাৎ বলতে দুইবার জ্যোতির হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্বল্প আলাপ আর মেহুর জম্মদিনে একবার জ্যোতির আগমন এই বাসায়। ব্যস!এই তিনবছরে এইটুকুই যোগাযোগ হয়েছে।এই স্বল্প যোগাযোগে কিংবা ক্ষনিকের কথোপকোতনে কখনোই জ্যোতিকে বিশেষ করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

অন্তর্মুখী মানুষরা বোধ হয় নিজের অনুভূতি এভাবে মুখে ভালোবাসি বলে স্বীকার করতে পারেও না।তাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাদের যত্নে, তাদের সঙ্গে, তাদের আগলে রাখা মুহুর্তগুলোতে।এই কারণেই বোধহয় অন্তর্মুখী মানুষদের ভালোবাসা ব্যাতিক্রমী সুন্দর!মেহেরাজ উঠে বেলকনিতে যায়।বছর দুয়েক আগেই চাকরীতে জয়েন করেছিল সে।

তবুও মাথায় ছিল চট্টগ্রাম শিফট করার৷ এই বাসায় সামান্তার উপস্থিতিতে হয়তো বা জ্যোতি সবসময়ই কষ্ট পুষবে মনে মনে।যন্ত্রনা পাবে কখনো সখনো দুইজনকে একসাথে দেখলে।অন্যদিকে সুদূর চট্টগ্রামে জ্যোতি একা।যাকে একা থাকতে দিবে না বলেই প্রথম অস্থিরতা টের পেয়েছিল তাকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়াটা অযৌক্তিক!তবুও বাস্তবতার কাছে হার মেনে, জ্যোতির পড়ালেখা-ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে একা ছেড়েছে।

এতগুলো দিন অপেক্ষায় ছিল একটা সুযোগের। অবশেষে সুযোগটা মিলেও গেল। চট্টগ্রামে একটা কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি পেল। জয়েনিং ডেইট পরের মাসে।মেহেরাজ ততদিন অপেক্ষা করতে পারল না।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল পরশুই যাবে একবার।জ্যোতির সাথে দেখা করে বাসা দেখে আসবে।তারপর পছন্দ মতো একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সুন্দর সংসার গোঁছাবে। আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো ঘর বাঁধবে।

মেহেরাজ হাসে আনমনে এসব ভেবে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে জ্যোতির নাম্বারটা খুঁজে কল দিল মুহুর্তেই।জ্যোতিকে সে শেষ কল দিয়েছিল দিন পনেরো আগে।এর মাঝে না তো জ্যোতি কল দিয়েছে আর না তো মেহেরাজ।জ্যোতি অবশ্য তাকে নিজ থেকে কল দেয় খুবই কম। অথচ মেহুর সাথে জ্যোতির প্রত্যেকটা দিন কথা হয়। প্রত্যেকটা দিন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প জুড়ে। যখন মেহুকে পায়না কলে, কিংবা কোন বিশেষ প্রয়োজন হয় তখনই মেহেরাজকে কল দেয় জ্যোতি।মেহেরাজ মনে মনে এসব ভেবে অভিযোগ পুষে।ঠিক তখনই ওপাশ থেকে কল রিসিভড করে এক মেয়েলি স্বর বলে উঠল,

” আসসালামুআলাইকুম মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতল অনুভূতি হলো মেয়েটার কন্ঠ শুনে৷ বুকের বা পাশটা চেপে ধরে কিয়ৎক্ষন থম মেরে চুপ করে থাকল। তারপর গলা ঝেড়ে সালামের উত্তর দিল গম্ভীর কন্ঠে। বলল,
” কেমন আছিস?”
জ্যোতি উত্তরে মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,

” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
মেহেরাজ শুনল।দৃঢ় গলায় সরাসরি বলে উঠল,
” ভালো আছি, পরশু ফ্রি থাকবি?”
প্রশ্নটা শোনা মাত্রই উত্তর দিল না জ্যোতি।কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” কেন?”

মেহেরাজের মুখভঙ্গি বদলাল না।গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
” দেখা করব তোর সাথে।”
আচমকা এমন এক প্রশ্নে চুপ থাকল জ্যোতি।শেষ তাদের দেখা হয়েছিল এগারো মাস আগে। বলা যায়, প্রায় এক বছর আগে তাও মেহুর জম্মদিন উপলক্ষ্যে সেই গিয়েছিল। এতগুলো দিন পর দেখা করার জন্য মেহেরাজের তরফ থেকে এই বাক্যটা শুনেই শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরন হলো।অনুভব করল বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতা৷ জবাবে বলল,

” কখন? ”
মেহেরাজের মুখ টানটান হলো হঠাৎ। দাঁতে দাঁতে চেপে ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিয়ে বলল,
” সারাদিন। কেন তুই কি ব্যস্ত থাকবি? ”
জ্যোতি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিল,

” আমার টিউশনি আছে, ক্লাস আছে মেহেরাজ ভাই। আপনি নির্দিষ্ট একটা সময় বললে সুবিধা হবে আমার।”
মেহেরাজ দমে গেল না জ্যোতির স্পষ্ট উত্তরে। ফের ভরাট কন্ঠে ত্যাড়াভাবেই উত্তর দিল,
” নির্দিষ্ট সময় না, অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকব।সমস্যা আছে?আর ক্লাস, টিউশন পরশুদিনের জন্য বাদ। একদিন মিস দিলে তো সমস্যা হবে না। তাই না?”
ওপাশে জ্যোতি কথা গুলো শুনে থম মেরে চুপ হয়ে গেল। নির্দ্বিধায়, স্পষ্টভাবে মেহেরাজের এমন আদেশে তার ভালো লাগল কি খারাপ লাগল বুঝে উঠল না সে।তবে বুকের ভেতর কেমন কম্পন অনুভব হলো সেই মুহুর্তে। তবুও স্পষ্ট ভাবে বলল,

” না,সমস্যা হবে না। ”
মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠল,
” গুড!তাহলে পরশুদিনের জন্য তোর ক্লাস, টিউশন সব ক্যান্সেল। দেখা করছি পরশু। মনে থাকবে?”
” হ্যাঁ, থাকবে।”
মেহেরাজ আবারও হাসল।বলল,

” ওখানে গিয়ে কল করব তাহলে। ”
জ্যোতি বিনিময়ে উত্তর দিল না।চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর কি বুঝেই প্রশ্ন ছুড়ল,
” কোন দরকারে আসছেন এখানে? ”
মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। হাত দিয়ে কপালে আসা চুল পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, দরকার তো আছেই।তাই ভাবলাম তোর সাথেও দেখা করে আসি।কেন?”
জ্যোতি উত্তরে বলল,

” মেহু আপু বলেছিল আপনি নাকি কয়েকদিন আগেও এসেছিলেন এখানে কি প্রয়োজনে৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
” তুই কি মেহুর থেকে আমার খোঁজখবর নিস জ্যোতি?”
জ্যোতির স্পষ্ট উত্তর,

” নাহ তো।আমি আপনার সম্বন্ধে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।মেহু আপু নিজের থেকেই বলেছিল কথাটা।”
মেহেরাজ মুখ ভার করল এবার৷ চোখজোড়া বুঝে ভারী বুক হালকা করতে ছাড়ল দীর্ঘশ্বাস।শান্তস্বরে বলল,
” মেহুর সাথে এত কি কথা বলিস তাহলে প্রতিদিন ?”
জ্যোতি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

” আমার আর মেহু আপুর কথার বিষয়বস্তু কেবল আপনিই হবেন এমন কোথাও লিখা আছে নাকি মেহেরাজ ভাই?”
” নেই বলছিস?”
” না, নেই। সামান্তা আপু কেমন আছে? ”

মেহেরাজ চুপ থাকল। প্রত্যেকবার কল করলেই জ্যোতি আগ্রহ নিয়ে সামান্তাকে নিয়ে এই প্রশ্নটা করে তাকে।প্রশ্নটা করে যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার আর সামান্তার সম্পর্কটাকেই জ্যোতি তুলে আনতে চায় তাও বুঝে মেহেরাজ। তবুও উত্তর দেয় না৷ এবারও ব্যাতিক্রম হলো না৷ গম্ভীর স্বরে উত্তর না দিয়েই বলল,
” রাখলাম। পরশু আসছি।”
কথাটুকু বলেই মেহেরাজ কল কাঁটল।মুখটা টানটান করে তাকিয়ে থাকল বেলকনির অপর প্রান্তে।
.
সন্ধ্যায় সাঈদ অফিস থেকে ফিরছিল রিক্সায় করে।কিছুটা দূরে রাস্তার একপাশে শুভ্রময়ী মেহু নামক মেয়েটিকে দেখেই হৃদয়ের ভেতর কম্পন অনুভূত হলো। রাতের আঁধার আর ল্যাম্পপোস্টের আলোতে গোলাপি রাঙ্গা জামা পরনে অদ্ভুত সুন্দর বোধ হচ্ছিল মেয়েটাকে।সাঈদ নিজেকে আর রিক্সায় বসিয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত রিক্সা থামাতে বলে ভাড়া মিটিয়ে নিজেকে হাজির করল মেহুর সামনে।মেহু ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে৷ চোখমুখে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া আপনি?”
সাঈদ হাসল ঠোঁট চওড়া করে৷ ফিচেল গলায় বলল,
” তোমার আমার প্রেমের কতোটা টান দেখেছো? প্রেমের টানেই দুইজনের দেখা হয়ে গেল প্রিয়।তবুও তুমি এই প্রেমটা স্বীকার করতে নারাজ৷ কি এক যন্ত্রনা!”
শেষের কথাটা সাঈদ বুকের বা পাশে হাত রেখেই বলল।মেহু কপাল কুঁচকাল। বিরক্তি সমেত গলায় বলল,

” আপনাকে একবার বলেছি এসব ফ্লার্ট আমার সাথে করবেন না সাঈদ ভাইয়া৷ ”
সাঈদ থামল না। ফের ফিচেল গলায় বলে উঠল,
“ফ্লার্ট করব কেন? প্রেমিকার সাথে কেউ ফ্লার্ট করে নাকি? আমি একদমই ফ্লার্ট করছি না বিশ্বাস করো। ”
মেহু থমথমে গলায় উত্তর দিল,
” আমি আপনার প্রেমিকা নই। ”

” প্রেমিকা না? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রেমিকা নাই হতে পারো, হবু বউ তো অবশ্যই। বলো?”
শেষ শব্দটা সাঈদ চোখ টিপেই বলল। মেহুর মুখভঙ্গি তাতে একটুও বদলাল না। আগের ন্যায় কপাল কুঁচকে বলল,
” আবোল তাবোল বকবেন না সাঈদ ভাইয়া।”
সাঈদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” আবোল তাবোল বকবো কেন? এই এক বছর আগে এত কষ্ট করে চাকরী জোগাড় করলাম। কেন করলাম?বিয়ে করার জন্যই তো। ”
” তো বিয়ে করতে নিষেধ করেছে কেউ আপনাকে?”
সাঈদ আপসোসের সুরে বলল,

” উহ, পাত্রী হিসেবে তো আমি তোমায় পছন্দ করেছি। কিন্তু তুমি তো নাকি পড়ালেখা শেষ না হওয়া অব্দি বিয়ে করবে না বলেছো।এখন তো পড়ালেখা কম্প্লিট?বিয়ে করবো চলো।দুদিন পর আবার তোমার ভাই তোমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে চলে যাবে।তখন আমার কি হবে?”
মেহু এবার কিছুটা জোরেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া, আমি এসব মজা উপহাস পছন্দ করি না৷ আপনি আর যার সাথেই মজা করুন না কেন, আমার সাথে করবেন না।”
সাঈদ চুপ করল না।ঠোঁট বাকিয়ো হেসে বলল,
” আগে কিন্তু দিব্যি পছন্দ করতে এসব। চারবছর আগে একটা চুমুই সব পছন্দ অপছন্দ বদলে দিল? জাস্ট একটাই তো চুমু! ”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২২

মেহু থমকাল।মনে পড়ে গেল সেই অনাকাঙ্খিত ঠোঁটের ছোঁয়া। অপ্রত্যাশিত মুহুর্ত!অপ্রত্যাশিত চুমু।মুহুর্তেই মুখচোখের ভঙ্গি পাল্টে গেল তার। চোখজোড়ায় ভর করল ঘৃণা আর টলমলে পানি। সেই টলমলের চোখের চাহনীতে একনজর তাকিয়েই সাঈদ আর দাঁড়াল না।বুক টানটান করে দ্রুত হেঁটে চলে গেল সেই স্থান ছেড়ে।

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২৪