এক মুঠো প্রণয় শেষ পর্ব (শেষ অংশ) 

এক মুঠো প্রণয় শেষ পর্ব (শেষ অংশ) 
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ অনেকটা রাত পর্যন্ত বেলকনিতেই কাঁটাল। বাবা মাকে হারানোর পর থেকেই মেহুকে নিজের হাতে মানুষ করেছে সে। সবসময়ের মতো আগলে রেখেছিল প্রিয় বোনটাকে। এভাবে হুট করেই বোনের বিয়ে নিয়ে এগোতে চায়নি সে। তবুও হুট করেই সম্পন্ন করতে হলো বিয়েটা। সেই ছোট মেহু আজ কারোর স্ত্রী, কারোর পুত্রবধূ!

মেহেরাজ লম্বা শ্বাস টানল। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় মেহুকে সবসময় দেখতে পাবে বলে মনে মনে স্বস্তিও মিলল৷ অবশেষে বেলকনি ছেড়ে রুমে পা ফেলতেই চোখে পড়ল রুমের মৃদু আলোতে ঘুমন্ত জ্যোতিকে। কি নিষ্পাপ চাহনী! অগোছাল চুল আলগোছে হয়ে পড়ে আছে চোখে মুখে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

মেহেরাজ আলতো হেসে এগিয়ে গেল। বিছানার কোণে বসেই হাত ছোঁয়াল জ্যোতির গালে। পরমুহুর্তেই ঝুঁকে গিয়ে উষ্ণ চুম্বন আঁকল ডান গালে। গতরাতের স্মৃতিচারণ করেই মেহেরাজের আলতো হাসিটা চওড়া হলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিছানায় জ্যোতির দিকে ফিরে শুঁয়ে পড়ল। পুরুষালি হাত দিয়ে জড়িয়ে নিল সম্মুখে থাকা ঘুমন্ত রমণীকে। গুঁছিয়ে দিল মধ্যকার দূরত্ব। আলতোভাবে পুরু ঠোঁটজোড়া ছোঁয়াল জ্যোতির কপালে।ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

” সারাদিন লজ্জ্বারাঙ্গায় লালাভ হয়ে মুখোমুখিই হোসনি তুই। আর এখন কিন্তু দিব্যি মুখোমুখি হয়ে ঘুমিয়ে আছিস জ্যোতি।এখন লজ্জ্বা হচ্ছে না?”
ঘুমন্ত জ্যোতি বোধহয় টের পেল এবারে।শুনলও বোধহয় পুরুষালি কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো। তবুও বুঝতে দিল না। অল্প নড়চড় করলেও চোখ মেলে চাইল না একবারও। চোখ মেলে চাইলেই বোধহয় সম্মুখ পুরুষের নেশাময় দৃষ্টি তাকে জব্দ করত। নুঁইয়ে পড়ত সে মোহনীয় নজরে এক মুহুর্তেই। জড়িয়ে পড়ত ভিন্ন আবেশে। তার থেকে চোখ বুঝে ঘুমিয়ে থাকার ভান করা ভালো নয়?

মেহুর ঘুম ভাঙ্গল মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ পেয়েই।সাঈদের কল। মেহুর নিঃশ্বাস আটকে আসল। মনে পড়ল সেদিনকার মেয়েটার সমস্ত কথা। সেই সাথে মনে পড়ল গতকালের সকল কথা, সকল ঘটনা। এখন থেকে সে অন্যের স্ত্রী৷ এখন থেকে সে বিবাহিত। সাঈদ এখন কেবলই অতীত। শুধু এবং শুধুই অতীত। মেহু কল তুলল না। স্বার্থপরের মতো মোবাইলটা একপাশে ঠেলে রেখে উঠে বসল। পা বাড়িয়ে জানালা মেলেই অপর পাশের জানালায় একনজর তাকাল। মুহুর্তেই চোখে পড়ল ছোট বাচ্চাটাকে। আলতো হেসে বলল,

” গুড মর্নিং সানশাইন। ভালো আছো? ”
বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে চাইল ঠিক তবে উত্তর দিল না৷ মেহু আবারও শুধাল,
” কথা বলবে না আমার সাথে?”
বাচ্চাটা শুধাল,

” আম্মু বলে অপরিচিতদের সাথে বেশি কথা না বলতে। ”
মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
” আমি অপরিচিত? এক মিনিট, তোমার আম্মুটা কে?”
এবারে পেঁছন থেকে মেঘ এগিয়ে আসল। ভ্রু বাঁকিয়ে শুধাল,
” ওর আম্মুকে নিয়ে তোমার একটু বেশিই আগ্রহ মেহু। কেন বলোতো? ”
মেহু থমথমে কন্ঠে বলল,

” কি আশ্চর্য!জানতে চাইব না? যাকে বিয়ে করলাম সে যদি আগে আরো দশ পাঁচটা বিয়ে করে বসে থাকে তাহলে? আমি এই দশ- পাঁচ বিষয়টা সহ্য করতে পারিনি বলেই আপনাকে বিয়ে করেছি। এখন আপনিও যদি আরো দশ- পাঁচজনের সাথে জড়িয়ে থাকেন তাহলে দ্বিতীয়বার পা বাড়াব না। ”
মেঘ বাঁকা হাসল। সানশাইন ততক্ষনে দৌঁড়ে রুম ছেড়ে গিয়েছে। মেঘ একনজর পিছুঁ ফিরে সানশাইনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার মেহুর দিকে ফিরল। বলল,

” পা বাড়াতে চাইছো তার মানে? ”
” না! ”
বাঁকা হেসে আবারও বলল,

” চাইলেও সমস্যা নেই। বাড়াতে পারো নিশ্চিন্ত মনে।সানশাইন হলো ভাইয়ার ছেলে। ভাইয়া ভাবিকে দেখেছো আশা করি বিয়ের দিন?তাই সানশাইনের আম্মুকে নিয়ে আতংকে থাকতে হবে না।আর শোনো,আমার জীবনে প্রথম নারীটিও তুমি, শেষ নারীটিও তুমিই হবে।এর মাঝে অন্য কোন নারী আসবে না।”
মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভারী গলায় বলে,

“শুনুন ডক্টরসাহেব, পৃথিবীতে সবকিছুই বদলায়। সবকিছুই! এই কথাটাও বদলে যেতে দুই সেকেন্ড সময় নিবে না। এতটা দৃঢ়ভাবে বলবেন না। পরে যদি বদলে যায় কথাটা?”
দৃঢ়গলায় উত্তর আসল,
” বদলাবে না। আমার নিজের প্রতি আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে। ”

” কিন্তু আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না।তবে আমি মনে প্রাণে চাইছি আপনার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। আচ্ছা মেঘ?কতোটা ভালোবেসেও ব্যর্থ হলে, কতোটা যন্ত্রনায় ছটফট করলে মানুষ দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসতে ভয় পায়?কতোটা আঘাতে জর্জরতি হলে মানুষ দ্বিতীয়বার কারোর সাথে নিজেকে ভাবতে গিয়ে ভয় পায়?কতোটা?”
মেঘ আলতো হাসে। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলে,

” জানো মেহু?একটা কথা আছে, এই পৃথিবীতে আমরা কাউকে যতোটা কষ্ট দিই ততোটাই কষ্ট আবার ঘুরেফিরে আমরা পাই।আমি জ্বলেছিলাম তোমার দহনে, তুমি জ্বলেছিলে অন্য কারো দহনে। আবার তোমাকে যে জ্বালিয়েছে?সেও জ্বলবে। কয়েক দিন, কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর পর হলেও জ্বলবে।এটাই বাস্তবতা।”
কিছুটা থেমে আবারও বলল,

“জানো মেহু? চারবছর আগে চোখের সামনে তোমার কপালে কাউকে চুম্বন আঁকতে দেখেছিলাম।লোকটা সাঈদ নামক ব্যাক্তিটাই, যাকে তুমি ভালোবাসতে। উহ!কি অসহনীয় যন্ত্রনায় আমি পুড়েছিলাম সেই ক্ষনে।এই সত্যটা জানার পর যেন বুকের ভেতর উত্তপ্ত আগুনে ছারখার করছিল সবকিছু।আমি মুখ ফিরিয়ে সরে আসলাম, যেভাবেই হোক না কেন নিজেকে গুঁছিয়ে নিলাম। তবুও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমি জ্বলেছি। শুধুই জ্বলেছি। ”
মেঘ আবারও বলল,

” আমি জানি, এখনো তুমি তাকে ভালোবাসো। হয়তো অনেকটা বেশিই ভালোবাসো। তাই না? তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে অনেকটা ভালোবাসা একদিন ফিকে হয়ে যাবে, আর আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা সেদিন গাঢ় হয়ে যাবে। ঐ যে, নারী ভালোবাসায় আটকায়?আমি তোমায় ভালোবাসাতেই আটকাব মেহু।এতোবেশি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করবে যে একদিন তুমি আমায় ভালোবাসবেই! বাসতেই হবে। ”

মেহু কিছু বলল না। শুধু নিস্তব্ধ চাহনীতে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে। আসলেই ভালোবাসতে পারবে সে?সেও তো চায় সবটা ভুলতে। সেও চায় নতুন করে জড়াতে কারোর সাথে। সেও চায় সাঈদকে শুধু এবং শুধুই অতীত হিসেবে মেনে নিতে।

সাঈদ মেহুর বিয়ের বিষয়টা জানতে পারে সকালেই। মেহেরাজের থেকে। তখন থেকেই এক নাগাড়ে কল দিয়েছে মেহুকে। মেয়েটা কল তুলেনি। অবশেষে ম্যাসেজ করে জানিয়েছে, অন্তত একবার হলেও দেখা করুক।শেষবারের মতো হলেও একবার সম্মুখীন হোক তার। মেহু রাজি হলো। রেস্টুরেন্টে চেয়ার টেনে বসতেই চোখে পড়ল এক অগোছাল সাঈদকে।চুল উষ্কুখুষ্কু অগোছাল।

চোখমুখে কেমন অদ্ভুত ভাব স্পষ্ট। পরনে একটা টিশার্ট আর টাউজার যা সাধারণত বাসায় তার পরনে থাকে। মেহু অনেকক্ষন যাবৎ পরখ করল সামনে বসে থাকা সাঈদকে।রক্তরাঙ্গা চোখ আর শক্ত চোয়ালে একইভাবে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।অবশেষে চোখ তুলে চাইল মেহুর দিকে। বলল,
” খুব বেশি অযোগ্য ছিলাম আমি মেহু? এমনটা কেন করলে? তুমি জানতে না আমি তোমায় ভালোবাসতাম?কি হলো?জানতে না তুমি?”

মেহু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। মৃদু স্বরে বলল,
” এটা কেমন ভালোবাসা?যে ভালোবাসায় অন্য নারীর দিকে ঝুঁকতে হয়?এটা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না।”
সাঈদ হাসল। ব্যর্থ হাসি। মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

” সেদিন যে মেয়েটাকে দেখেছিলে? সে আমার ভার্সিটিতে থাকাকালীন ফ্রেন্ড।ওর সাথে মাস তিনেকের পরিচয় ছিল। তারপরই ও ফেমিলিসহ অন্য দেশে শিফট করে।তবে এটা ঠিক যে আমার সাথে ফিজিক্যালি সম্পর্ক হয়েছিল ওর। একবার দেশের বাইরে ট্যুরে গিয়েই মাথায় ভুত চেপে গেল।দেখা হলো ওর সাথে৷ মেয়েটা কেমন জানি। নিজ থেকেই প্রস্তাব রাখল ফিজিক্যাল রিলেশনের।

আমি প্রথমবারে এমন প্রস্তাবে না করলেও পরেরবার আমিও মজা লুফে নিতে রাজি হয়ে গেলাম একপ্রকার। ঐ যে প্লে বয় ছিলাম? সেই সম্মোধনের জেরেই বোধ হয় এই বিষয়টা ঘটে গিয়েছিল তখন। তারপর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। কিছুদিন আগেই বিজন্যাসের একটা মিটিংয়ে দেশের বাইরে যেতে হলো।তারপর তারসাথে আমার আবারও দেখা।

এবারে আমি তার সাথে সহজভাবেই বন্ধুর ন্যায় কথা বললাম।গল্প করলাম। কিন্তু ভাবিনি সে উম্মাদের ন্যায় আচরণ করবে। ইভেন এখনও পিঁছু পিঁছু ঘুরে জ্বালাচ্ছে! এতে কি আমার দোষ আছে মেহু? ওর সাথে যা করেছি সবটা অনেক আগের ঘটনা!অনেক অনেক আগের। তোমায় ভালোবাসার পর আমি আর কারোর দিকে টান উপলব্ধি করিনি মেহু। না শরীরের দিক দিয়ে আর না তো মনের দিক দিয়ে। ”

সাঈদ থামল। একবার মেহুর দিকে তাকিয়েই আবারও ভরাট গলায় বলে উঠল,
” তোমায় ভালোবাসি এটা উপলব্ধি করার পর তো আর ঝুঁকিনি কারোর দিকে মেহু। কারোর দিকেই ঝুঁকিনি। চারবছর আগে একটা মেয়েকে কিস করেছিলাম। আর সে দৃশ্য দেখেই তুমি এড়িয়ে চলতে শুরু করলে আমায়। আমি জানতাম তুমি আমার প্রতি দুর্বল।

আমার প্রতি তোমার প্রচন্ড দুর্বলতা আছে। তবুও তুমি আমার কাছে আমার বন্ধুর বোন হিসেবেই ছিলে মেহু।এর আগে মুখে মজা করলেও কখনো অন্য নজরে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে? তাকাইনি। কিন্তু সেদিন মেয়েটাকে কিস করার পর যখন বুঝলাম তুমি দেখে নিয়েছিলে?তোমার মুখের অসহায়ত্ব যখন দেখেছিলাম?হুট করেই অপরাধ বোধ জাগল। অনুভব করলাম তোমার অসহায়ত্ব, চোখের পানি আমার দুর্বলতার একাংশ।

তবে হ্যাঁ, তখনও বুঝে উঠিনি আমি তোমায় ভালোবাসি। বুঝলাম তখন, যখন তুমি ক্রমশ এড়িয়ে চলতে শুরু করলে। ক্রমশ বুঝিয়ে দিতে লাগলে তুমি আমার থেকে সরে যাচ্ছো। অনেকটুকু দূরে সরে যাচ্ছো। তার মাস খানেক পরই তোমার টলমল চোখের জলের সম্মুখীন হলাম আবারও। সেদিন কেন জানি সে অশ্রু, সে কষ্ট আগলে নিয়ে মুঁছে নিতে মন চাইল। তাই তো তোমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।

আর তুমি ভাবলে আমি সুযোগ নিলাম।অথচ তুমি জানলে না, তোমার অশ্রু আমায় কতোটা যন্ত্রনা দেয়। আর সে কারণই তোমার অশ্রুসিক্ত নয়নে আমি দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখতাম না।বরাবরই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি তোমার কান্নামাখা মুখকে।”

মেহুর চোখ টলমল করল। আসলেই কি এই লোকটাকে আপন না করে সে ভুল করে ফেলেছে? মুহুর্তেই মস্তিষ্ক জানাল, সে বিবাহিত। সে এখন অন্য কারো। সাঈদের দিকে ঝুঁকলে এখন ঐ লোকটার প্রতি অন্যায় হবে।লম্বা শ্বাস ফেলল মেহু। সাঈদ আবারও ব্যাথাময় স্বরে শুধাল,
” মেহু?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু। একবার বলো না সবটা মিথ্যে। একবার বলো প্লিজ!আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাকে অন্য কারোর সাথে মেনে নিতে। ”

মেহু উঠে দাঁড়াল এবারে। এর চেয়ে বেশিক্ষন থাকলে হয়তো সে আর স্থির থাকতে পারবে না। সত্যিই পারবে না। শক্ত গলায় শুধাল,
” এসব সত্যি। আপনি ফিরে যান।ফিরে যান সাঈদ ভাইয়া। আমি আর কিছুই শুনতে চাই না। আপনার কষ্ট, কৈফিয়ত কিছুই জানতে চাই না। ”

কথাটুকু বলেই পা বাড়াল মেহু।সাঈদ তাকিয়ে থাকল কেবল সেদিক পানে। বুকের ভেতর বিষাক্ত দহনে জ্বলছে সমস্ত কিছু। অস্ফুট স্বরে বলল,
” আমার হৃদয়ে তোমার নামে এক মুঠো প্রণয় ছিল মেহু। আপসোস! আমি সেই প্রণয়ে তোমায় জড়িয়ে নিতে পারলাম না। জীবনে অসংখ্য নারীর সন্নিকটে থাকলেও প্রথম প্রণয়টা তুমিই মেহু। আমি সেই প্রণয়ে আর কাউকে জড়াব না। কাউকেই না। তুমি আমার না হয়েও আমারই রবে। আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকবে।আমার কল্পনায়।”

সপ্তাহখানেক পরই মেহু আর মেঘের বিয়ের অনুষ্ঠানটা আনুষ্ঠানিভাবে করা হলো। সেই সঙ্গে বড়দের নির্দেশ অনুযায়ী মেহেরাজ আর জ্যোতির বিয়েটাও আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন হলো। মেহেরাজদের গ্রামের বাড়িতেই সব করা হলো।জ্যোতি আনমনে ভাবল দাদীর কথা, ছোট্ট মিথির কথা।ভাবল মিনারের কথাও। সেই চিঠিটার পর থেকে মিনারের সাথে খুব কমই যোগাযোগ হয়েছে।

শুনেছে ঢাকায় কোথাও চাকরী করে এখন সে। আচ্ছা, সে মানুষটা এখন কেমন আছে?পরমুহুর্তেই ভাবল দাদীর কথা।এই দিনটাতে নিশ্চয় তার দাদী খুব খুশি হতো? নিশ্চয় নিজের প্রিয় নাতনির সুখে ভীষণ সুখী হতো?ভাবতেই চোখজোড়া টলমল করল। সেই টলমলে দৃষ্টিতে, ফুলে ফুলে সজ্জ্বিত ঘরে ফুলের সুভাসে হঠাৎই দেখা মিলল পুরুষালি মুখয়ব। মেহেরাজের উপস্থিতি। মুহুর্তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হলো।সপ্তাহখানেক আগের সেই রাত, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত গুলোর কথা আবারও স্মরনে এল। মুহুর্তেই অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল সে। মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। কাছাকাছি এসে ঝুঁকে গিয়ে বলল,

” এমন ছটফট করছিস কেন জ্যোতি?আচ্ছা, তুই কি মনেমনে বাসরটাসর নিয়ে ভেবে বসে আছিস জ্যোতি? ছিঃ!”
জ্যোতি বোকার মতো চাইল। স্বাভাবিক ভাবে ফুলশয্যার রাতে,ফুলে ফুলে সজ্জ্বিত এমন একটা ঘরে থাকলে যা ভাবার তাই ভেবেছে সে।ছিঃ এর কি আছে?মেহেরাজ আরেকটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে শুধাল,
” তুই যা ভাবছিস তা যদি আবারো সেদিনের মতো সত্যি হয়ে যায়?আমার কিন্তু দোষ নেই জ্যোতি। ”

জ্যোতির নিঃশ্বাস এবারে ঘন হলো। আর একবারও তাকাল না মেহেরাজের দিকে। লোকসম্মুখে ভদ্র, গম্ভীর মেহেরাজই সুযোগ ফেলে যে অভদ্র হয়ে যায় তা তার জানা হয়ে গেছে। তাই চুপ থাকল। অন্য দিকে ফিরে নিজের অস্বস্তি লুকানোর চেষ্টা চালাল। মেহেরাজ এবারে নেশাময় কন্ঠে শুধাল,

” আ’ম স্যরি জ্যোতি। তোর ভাবনাটাই দ্বিতীয়বার সত্যি হতে যাচ্ছে আজ রাতে। ”
মুহুর্তেই জ্যোতি চোখ বুঝল। কম্পমান মিহি ঠোঁটজোড়া ততক্ষনে পুরুষালি ঠোঁটজোড়ার দখলে। জ্যোতির হৃৎস্পন্দ ক্রমশ দ্রুত হলে।আঁকড়ে ধরল মেহেরাজের ঘন চুল।

মেহুর চেহারা মলিন।সে জানে অন্য সব বর বউয়ের মতো তাদের বিয়ের রাতটা স্বাভাবিক হবে না। তবুও মনে মনে কোথাও অপরাধবোধ হচ্ছে৷ সে কি মেঘকে আসলেই ঠকাচ্ছে?আসলেই মেঘকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে? সে তো মনেপ্রাণে চায় মেঘকে ভালোবাসতে।হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি কেবলই মেঘের নামে করে দিতে। তবুও কেন পারছে না? ভাবতেই লম্বা শ্বাস ফেলল। মেঘ কাছে এসে বসল। মেহুর একহাত নিজের হাতে নিয়েই শুধাল,

” মন খারাপ?”
উত্তর আসল না। মেঘ কিছুটা থেমেই মেহুকে নিজের মুখোমুখি করল।মেহুর কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল,

“আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা না জম্মানো অব্দি তোমার কাছে ভালোবাসার আবদার রাখব না মেহু।তোমায় স্ত্রীর ন্যায় গভীর ভাবে ছোঁব ও না। যেদিন তুমি ভালোবাসবে সেদিনই তোমায় পরিপূর্ণভাবে স্ত্রী হিসেবে কাছে টানব। ভয় নেই।আমার প্রতি এইটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো।”
মেহু মৃদু গলায় বলল,

” আমি আপনাকে বিশ্বাস করি মেঘ, ভয় পাচ্ছি না।”
মেঘ হাসল। বলল,
” বিশ্বাস ভালোবাসার গভীরতম ধাপ। যেখানে বিশ্বাস আছে সেখানে ভালোবাসা অবশ্যই জম্মাবে মেহু।”
মেহু শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” তাই যেন হয়। ”

এর মাঝে কেঁটে গেল প্রায় আঠারোটা মাস। এতগুলো দিনে মেহু বারংবার মুগ্ধ হয়েছে মেঘের ভালোবাসায়। খুব করে এই মানুষটার মায়ায় পরেছে। নারী সত্যিই ভালোবাসায় আটকায়। প্রিয় পুরুষের যত্নে আটকায়, আগলে রাখাতে আটকায়, অনুভূতিতে আটকায়।আজকাল সাঈদের প্রতি অনুভূতিটা যতোটা ফিকে হয়েছে মেঘের প্রতি অনুভূতিটা ততোটাই দৃঢ় হয়েছে। গভীর হয়েছে! সাঈদ আজ সত্যিই অতীত।হয়তো মাঝেমাঝে ওক আধটা দীর্ঘশ্বাসে মনে পড়ে সেই অতীতকে। এর থেকে বেশি না। মেহু মলিন হাসল।

মেঘ যখন ফিরল তখন রাত বারোটা। ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে রুমে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল মেহুকে। লাল টকটকে শাড়ি, সাথে মোহনীয় সাঁজ। মেঘ আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে শুধাল,
” হঠাৎ এই সাঁজ?”
” বরের জন্য বউয়ের সাঁজ নিষেধ নাকি?একটা গোপণ কথা শুনবেন? সাঁজটা আসলে আমার নয়, আপনার স্ত্রী মেহুর।শুধু এবং শুধুই আপনার স্ত্রী। স্ত্রী রূপে কাছে টেনে নিবেন? ”
মেঘ দ্বিধান্বিত চাহনীতে চাইল। বলল,

” কিসব বলছো মেহু?”
” যেটা বুঝেছেন সেটাই বলছি। বয়সতো কম নয় আমার। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আমি বুঝি মিঃ মেঘ।তাই জেনেশুনেই বলছি সমস্তটা।জ্যোতি বয়সে আমার চেয়ে ছোট হয়ে এক মেয়ের মা হয়ে যাচ্ছে। আমি মা হবো না? ”
মেঘ চোখ বড়বড় করল। জ্যোতি সাতমাসের প্র্যাগনেন্ট! আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট অনুযায়ী অনাগত সন্তান মেয়ে। কিন্তু এই নিয়ে মেহু এভাবে ফট করে একটা কথা বলে বসবে ভাবেনি সে।ধীরপায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেষ হয়ে আসতেই তার বিস্ময়ের মাত্রাকো দ্বিগুণ করে এবার মেহু জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল,

” ভালোবাসি আপনাকে মেঘ।অনেকটুকু! ”
মেঘ গম্ভীর গলায় শুধাল,
” আমার তবে অবশেষে এক মুঠো প্রণয়ের প্রাপ্তি হলো?আমি আমার জায়গাটা তবে করে নিতে পেরেছি মেহু?”
” পারতে তো হতোই।এতো ভালোবাসার বিনিময়ে আমি কি এতোটুকুও ভালোবাসা দিতাম না? ”
মেঘ কিছুই বলল না।শুধু নিঃশব্দে হাসল।মেহু আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

” এবার পুরোপুরি স্ত্রীরূপে ধরা দিলাম। আমায় পুরোপুরি স্ত্রীরূপে কাছে টানবেন না মেঘ?”
মেঘ হাসল ঠোঁট বাঁকিয়ে। ঝুঁকে গিয়ে প্রিয়তমা নারীর কপালে চুম্বন এঁকে পরপর নরম ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে নিল নিজের ঠোঁটজোড়া দিয়ে। পরমুহুর্তেই কোলে তুলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” উহ!স্ত্রী রূপে কাছে টানতে গিয়ে অসভ্য হয়ে গেলে দোষ দিবে না মেহু। ”
উত্তরে মেহু কিছুই বলল না। হাতজোড়া দিয়ে মেঘকে আঁকড়ে রাখল ঠিক আগের মতোই। মেঘ আরো গভীরে জড়িয়ে নিল মেহুকে। কিয়ৎক্ষন জড়িয়ে রেখে উষ্ণ চুম্বনে,উষ্ণ স্পর্শে উম্মাদনায় মত্ত করল তারই প্রিয়তমাকে।

জ্যোতি সাতমাসের ভরা পেট নিয়েই বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার আকাশে জ্বলমলে চাঁদটার দিকে তাকিয়েই ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। বাইরের মৃদু শীতল হাওয়াটা ভালোই বোধ হলো তার কাছে। এর মাঝেই নিঃশব্দে বেলকনিতে উপস্থিত হলো মেহেরাজ। পেঁছন থেকে জ্যোতিকে জড়িয়ে নিয়েই হাত রাখল জ্যোতির পেটে৷ ঘাড়ের কাছে চুমু দিয়ে বলল,

” আমার ঘুমের বারোটা বাঁজিয়ে ,একা আমায় রেখে এসে এখানে সময় কাঁটানোর মানে কি?”
জ্যোতি কিছু বলল না উত্তরে। মেহেরাজ ফের বলল,
” তুই এখানে থাকলে থাকতেই পারিস আমার থেকে দূরে দূরে।কিন্তু আমার প্রিন্সেস কেন থাকবে আমার থেকে দূরে? ”
জ্যোতি এবারে উত্তর দিল,

” উহ, ঘুম হচ্ছে না। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন, তাই ডাকিনি আর। ”
মেহেরাজ ত্যাড়া স্বরে শুধাল,
” তো লাভটা কি হলো?তুই আসামাত্রই তো ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিসব জাদুটাদু করে রেখেছিস আমার উপর বলতো?”
জ্যোতি অস্ফুট স্বরে শুধাল,

” আমি?”
মেহেরাজ সতর্ক করল।হুশিয়ারি দিয়ে বলে উঠল,
” হুশশশ!ও নড়াচড়া করছে।আমার আম্মুটা!”
জ্যোতি চুপ হয়ে গেল।যখনই মেহেরাজ থাকাকালীন বাচ্চাটা এভাবে নড়াচড়া করে তখনই মেহেরাজ এভাবে অনুভব করে। এটা নতুন নয়৷ কিয়ৎক্ষন পর বাচ্চার নড়াচড়া আবার থেমে গেল। জ্যোতি হাসল। বলল,

” জানেন?আমি চাই না ও আমার কিংবা আপনার মতো গম্ভীর হোক। আমি চাই ও মিথির মতো চঞ্চল হোক। মিথি যখন ছোটবেলায় হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেল? চলে গেল আমায় ছেড়ে?আমার সে মুহুর্তটা মনে পড়লে আজও কান্না আসে। আমি চাই ওর মাধ্যমেই মিথি ফিরে আসুক আমার কাছে৷ সেই ছোট্ট মিথি। আমার মিথি! ”
মেহেরাজ ঠোঁট চওড়া করে হাসল।ভরাট গলায় বলল,

” খুব শীঘ্রই আসবে। ”
জ্যোতিও এবারে হাসল। মেহেরাজের হাত আঁকড়ে ধরে বলতে লাগল,
” মেহেরাজ ভাই..”
বাকিটুকু বলা হলো না। মেহেরাজ দৃঢ় কন্ঠে রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,
” হুশশ!ভাই? কিসের ভাই?তোর ভাই হই আমি?তুই তো সাংঘাতিক মহিলা জ্যোতি। এসব ভাইটাই বলে আমাকে কি আমার বাচ্চারই মামা বানানোর প্ল্যান করে রেখেছিস?”
জ্যোতি হতাশ হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে মিনমিনিযে চোখে চাইতেই মেহেরাজ ফের বলল,

” এভাবে তাকাবি না৷ আমার বাচ্চার আম্মু হওয়ার দাবি করে আমার সরল মনে জায়গা করে কতকিছু করে ফেললি আমার সাথে৷ শেষমেষ আমার বাচ্চার আম্মুও হয়ে বসে আছিস৷ আর এখনও আমায় ভাই বলিস?খবরদ্দার!আমার বাচ্চার সামনে আমাকে ভাই-টাই ডাকলে সোজা আঁছাড় মারব দোতালা থেকে।”
কথাটা বলেই জ্যোতিকে নিজের দিকে ঘুরাল। ঝুঁকে গিয়ে জ্যোতির পেটে পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

এক মুঠো প্রণয় শেষ পর্ব (১ম অংশ) 

” শোনো প্রিন্সেস, তোমার আম্মুকে কখনো বলা হয়নি। তবে তোমায় বলছি, তোমার বাবা তোমায় অনেকটা ভালোবাসে।এতটুকু ভালোবাসা তোমার আম্মুকেও বাসে না। তোমার আম্মুর ভাগে কেবল এক মুঠো প্রণয়ই আছে। বাকিটুকু সব তোমার। ”

সমাপ্ত