হৃদয়হরণী পর্ব ৪৬

হৃদয়হরণী পর্ব ৪৬
তানিশা সুলতানা

ছোঁয়ার জন্মদিন আগামীকাল। আর সাদি বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিলো ঠিকঠিক বারোটায় তার বর তাকে বার্থডে উইস করবে। হ্যাপি বার্থডে বলবে। ছোট একটা কেক কাটবে।
কিন্তু তার বরটাই লাপাত্তা। সকালে বলেও গেলো না যে বাসায় ফিরতে পারবো না। দিব্যি কলেজে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো।

কলেজ শেষ করে ছোঁয়া বাসায় ফেরার পরে জানতে পারলো সাদমান চৌধুরী ওরফে ছোঁয়ার করলা বর বাসায় ফিরবে না আজকে।
মনটা তার ভীষণ খারাপ। প্রতি বছর ছোঁয়া অপেক্ষায় থাকতো সাদির থেকে একটু শুভ জন্মদিন শুনবে বলে। কিন্তু কোনোদিনও সেই সুভাগ্য হয় নি। আজকে তো সে ছোঁয়ার বর। তো আজকে তো একটু উইস পেতেই পারতো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কলেজ থেকে ফিরে ছোঁয়া কিচ্ছু মুখে তুলে নি। মন খারাপ করে বসে আছে তার রুমের বেলকনিতে। নাজমা বেগম অনেকখন টানা টানি করে গিয়েছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু ছোঁয়া যায় নি। বলেছে পরে খাবে। নাজমা বেগমও ভেবে নিয়েছে হয়ত খেয়ে এসেছে। তাই জোর করে নি।

সিমিও এসেছিলো। তবে খাওয়ার জন্য জোর করে নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো জন্মদিনে কি উপহার নিবে। প্রতি বছরই ছোঁয়া এটা ওটা আনতে বলে। কিন্তু এই বছর কিছুই আনতে বলে নি।
বলেছে “গিফট কি বলে দিতে হয়? তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই এনো”
সিমি প্রথমে অবাক হয়েছিলো। পরে চিন্তা করলো বয়স বাড়ছে। তার সাথে বুদ্ধি। চিন্তা ভাবনা বদলেছে।
বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসে। ছোঁয়ার মন ঠিকই হচ্ছে না। সে এখনো বেলকনি থেকে নরে নি।

তখনই ছোঁয়ার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা পায়ের কাছে ফ্লোরে পড়ে ছিলো। ছোঁয়া কালো আসমান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে। রিসিভ করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সাদি নামটা দেখে রিসিভ না করে পারলো না।
ভালোবাসার মানুষ তো। তার ডাকে সারা না দিয়ে পারা যায়?
ফোনটা কানে রাখতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ
“ভাইয়ার সাথে চলে এসো জান।
তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।

বলেই কল কেটে দেয়। চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় ছোঁয়ার। তার গোমড়ামুখো করলা বর তার জন্য সারপ্রাইজ রেখেছে?
এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। অগোছালো চুল গুলো হাত খোঁপা করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। কাউকে না জানিয়ে চলে আসে বাইরে। সেখানে সিফাত গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছোঁয়াকে ঝড়ের বেগে আসতে দেখে মুচকি হাসে। পাগল একটা।
ছোঁয়া সিফাতের সামনে এসে দুই হাতে পেট চেপে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে

” ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলো।
আমার জামাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সিফাত শব্দ করে হেসে ওঠে।
“চলো

বাসর ঘর সাজানোর দায়িত্ব চেপেছে সামির আশিক শিপন রিমি এবং ইরার কাঁধে। সকলেই কাজে লেগে পড়েছে। আর সামির ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে গাঁদা ফুলের একখানা মালা গলায় পড়ে উচ্চস্বরে গান ধরেছে

“আকাশে লক্ষ তারা চাঁদের মতো আলো দেয় না
আমার মন মানে না যৌবন জ্বালা সহে না।
আমার বাপ বুঝে না
বিয়ে আমার দেয় না
দুঃখ আমি রাখবো কোথায়?
ঐশি তো পাত্তা দেয় না
বুইড়া তো হইয়া গেলাম
বিড়াল মারতে পারলাম না”
সামিরের উদ্ভট গান শুনে সকলেই হেসে ফেলে।
সামির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে

“সাদি চাচা
যার মেশিন নিয়ে কাল ওবদি চিন্তিত ছিলাম আমি। সেও বাসর করতে যাচ্ছে। আর আমি?
তরতাজা জোয়ান রোমান্টিক বেডা আমার কপালে বাসর জুটছে না?
দুঃখের কথা কমু কার কাছে?
সামিরের আহাজারিতে কেউ দুঃখ পায় না। বরং সকলেই মজা নেয়।
আশিক বলে ওঠে

“তোর কপালে বিয়া নাই।
সামির এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। আশিকের পা দুটো চেপে ধরে
” এমন কথা কইস না। বিয়া ছাড়া আমি বাঁচতে পারমু না।
রিমি চুল টেনে সরিয়ে দেয় সামিরকে।
“ডিস্টার্ব করিস না সর এখান থেকে।
শিপন বলে ওঠে

” তোরা দুজন সর। ছোঁয়া চলে আসছে প্রায়। তোরা গিয়ে তাকে সাজিয়ে দে। বাকিটা আমরা সামনে নিবো।
রিমি এবং ইরা মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়।
এখনে সামিরের মাথায় একখানা বুদ্ধি চলে আসে।
“সাদি চাচার খাট ভাঙলে কেমন হয়?
আশিক এবং শিপন ভ্রু কুচকে তাকায়।
সামির ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলে। এবং ওরাও সঙ্গ দেয় সামিরকে। প্ল্যানিং করে ফেলে সাদি চাচাকে জব্দ করার।

বাসর খাট সাজানো শেষ। সাদিও চলে এসেছে। সামির সাদিকে পানজাবি পড়িয়ে দিয়েছে। সাদির পড়ার একদম ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আজকে কেনো জানি বাঁধা দিতে ইচ্ছে হলো না।
ওইদিকে ছোঁয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছে ইরা এবং রিমি। সব জিনিস সাদি পছন্দ করে কিনে এনেছে৷ এটা রিমির থেকে শুনেছে ছোঁয়া। আর শুনতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠেছে। বরের থেকে প্রথমবার কিছু পেলো। মনটা খুশি হয়ে যাবে না?

লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ। হালকা মেকাপ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। গায়ে হালকা গোল্ডের গহনা। সব মিলিয়ে পারফেক্ট লাগছে ছোঁয়াকে। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে ছোঁয়া।
রিমি ছোঁয়ার গালে হাত দিয়ে বলে
” মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ
বন্ধু আমার আজকে পাগল হয়ে যাবে।
ছোঁয়া লাজুক হাসে।

“আপু লজ্জা দিও না প্লিজ। আমার গা শিওরে উঠছে।
হেসে ফেলে রিমি।
আরও একটু লজ্জা দিতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ে। তাকে আর কতো লজ্জা দিবে?
ছোঁয়াকে ফুলসাজানো খাটে বসিয়ে দেয় রিমি। বসিয়েছে সামিরের নির্দেশনা মতে। কারণ সামির ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়াকে বার বার বলছে

” ছোঁয়া বউদের ডান পাশে বসতে হয়। বা পাশে বররা বসে। তুমি জানোই তো স্বামীর বা পাজরের হার দিয়ে বউদের তৈরি করা হয়?
সামিরের ছলে গলে গিয়েছে ছোঁয়া। সে আর বাম পাশে বসবেই না।
ছোঁয়াকে বসিয়ে সকলে দরজার কাছে চলে যায়। সাদি কোনো কথা না বলে দশ হাজার টাকার একটা ব্যান্ডিল সামিরের হাতে দেয়। সামির খুশি হতে পারে না। ভেবেছিলো বন্ধুর সাথে একটু মশকরা করবে। কিন্তু তা আর হতে দিলো কই?

“শালা বাসর করার জন্য একদম পাগল হয়ে গিয়েছে। একটু মশকরা করতেও দিলো না।
সাদি সামিরের কান ধরে তাকে দরজা থেকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এবং ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। সামির বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।

” তোরা দাঁড়া এখানে। এখুনি একটা ম্যাজিক দেখাবো।
শিপন আশিক ওরা বুঝতে পারলেও ইরা এবং রিমি বুঝতে পারে না। ওরা সামিরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর সামির আশিক শিপন দরজায় কান পাতে।
সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হাসে। ছোঁয়া লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে রেখেছে। পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেনো আজকে তার ওপরে ভর করেছে। এতো লজ্জা এতোদিন কোথায় ছিলো?

এই যে মাথা তুলে সাদির দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না।
সাদি খাটে বসতে যায়। নিজের ভরটা খাটের ওপর দিতেই ঠাসসস করে শব্দ হয়ে খাটটা ভেঙে যায়। ছোঁয়া লাফিয়ে ওঠে। সাদিও হতদম্ভ। খাট কি করে ভাঙলো?
সামির চেঁচিয়ে ওঠে
“কি হলো? কি হলো?
কিসের শব্দ?

ছোঁয়া এক দৌড়ে দরজা খুলে দেয়। ভয় পেয়েছে সে ভীষণ।
হুরমুরিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে সকলে। ইরা ছোঁয়াকে জড়িয়ে নেয়।
সাদি শুকনো ঢোক গিলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
“সামির বিশ্বাস কর ভাই। খাটটা আগেই ভাঙা ছিলো।
সাদির চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। এরকম বেকায়দায়র সম্মুখীন সে আগে হয় নি। বন্ধু বান্ধবরা কি ভাববে? বাসর রাতে খাট ভাঙলো?

সামির দাঁত কেলিয়ে খাটটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আহহহা বাসর ঘরে বন্ধু খাট ভেঙেছে? ইতিহাসের পাতায় কি লিখে রাখা উচিত নয়?
রিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে

” একটু প্রাইভেসি দিলাম কি না দিলাম তাতেই খাট ভেঙে ফেললি?
সামির রাজকীয় ভঙ্গিমায় ভাঙা খাটের এক কোণায় বসে পড়ে
“আহহ রিমি আমাদের সাদু বেবি স্পেশাল না?
তার বাসর স্পেশাল হবে না?
আশিকও তাল মেলায়

হৃদয়হরণী পর্ব ৪৫

“সাদির থেকে আমাদের শেখা উচিত। বাসর ঘরে খাট ভাঙা বাদ্ধতামূলক।
সামির হাই তুলে বলে
” বাসর ঘরে খাট ভাঙতে না পারলে বউকে ছুঁয়েও দেখবো না। এই যে সাদির ভাঙা খাটের কসম।

হৃদয়হরণী পর্ব ৪৭