এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ১৯+২০

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ১৯+২০
লেখিকা মালিহা খান

ফ্যানের বাতাসে গা শিরশির করছে তোহার।তারউপর বৃষ্টি হয়েছে বলে পরিবেশও আজ অনেকটাই শীতল।ঘরের জানালাটাও বোকার মতো খুলে রেখেছে বিধায় ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় রুমে থাকাটাই মুশকিল হয়ে উঠছে।সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে শাওয়ার নিয়েছিলো তাই বোধহয় শীত শীত ভাবটাও তার বেশি অনুভব হচ্ছে।
গায়ে পাতলা কাঁথা নিয়ে অবিরাম মুচরামুচরি করছে তোহা।গভীর ঘুমের মাঝে কষ্ট করে উঠে ফ্যান আর জানলাটা বন্ধ করার ইচ্ছাটা থাকলেও তা করার শক্তিটা নেই তার।হাড়ের মধ্যেও একটা নিস্তেজ নিস্তেজ রেশ চলে এসেছে।সারাবছরের ঘুম যেনো ভর করেছে চোখে কিন্তু বাঁধ সাধছে এই অতি ঠান্ডাভাবটা।

রাত প্রায় গভীর।ঘড়ি দেখা হয়নি।তবুও নি:সন্দেহে বলা যায় একটা অথবা দেড়টা তো বেজেই গেছে।
গায়ের কাঁথাটা ভালো করে ছড়িয়ে তার ভিতর মাথা ঢুকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো তোহা।কাজও হলো এতে।ঠান্ডাটা অতটা গায়ে লাগছেনা।খানিকবাদে হরিণীর ন্যায় চোখদুটোতে তন্দ্রাভাব এসে জাপটে ধরতেই দরজার লক ঘুরানোর আওয়াজে বাজে ভাবে একটা ব্যাঘাত ঘটে গেলো ঘুমের মাঝে।মেজাজ চটে গেলো তোহার।চটা মেজাজটা আরো বেশি চড়াও করার জন্য ঘরের লাইটটাও জ্বলে উঠলো।রাগে দু:খে কান্না পেয়ে গেলো তোহার।হাল্কা করে মাথা বের করে উচ্চস্বরে চিল্লানোর পূর্বেই তূর্যকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো সে।পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ভাইয়া তুমি এতরাতে?কিছু হয়েছে?আব্বু ঠিক আছে?”
বোনের ভীত কন্ঠের মানে বুঝতে পারে তূর্য।মাঝেমাঝে তাদের আব্বু রাতের বেলা অসুস্থ হয়ে যায়।তীব্র বুকে ব্যাথা উঠে আবার কখনো প্রেসার লো হয়ে যায়।তবে আজ তার আব্বু সুস্থ।সে এসেছে অন্য কারণে।
বোনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্তভরা কন্ঠে সে বলে,
—“আব্বু ঠি ক আছে,শান্ত হ।”
—“তবে?”সন্দিহান কন্ঠে বলে তোহা।
—“তিহান ভাই অসুস্থ।১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠে গেছে উনার।কোনোমতেই জ্বর নামানো যাচ্ছেনা।খালামনি কান্নাকাটি করছে।আব্বু আম্মু ওখানেই,তোকেও যেতে বলেছে।”
মাথা ঘুড়ে যায় তোহার।সম্ভিৎ হারিয়ে কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সে।তূর্য তাঁড়া দিয়ে বলে,
—“জলদি উঠ বোন।তোকে ওই ফ্ল্যাটে দিয়ে আমি বাসা তালা দিয়ে ফার্মেসীতে যাবো।এতরাতে ফার্মেসিও খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ।”
কোনরকমে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ায় তোহা।মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে বলে,
—“চলো।”

খালু আর তোহার বাবা ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে।দুজনের কানেই ফোন।হয়তো ডাক্তারদের ফোন করছে তারা।খুব সন্তর্পণে তাদের কে পাশ কাটিয়ে তিহানের রুমে ঢোকে তোহা।
তিহানের একপাশে খালামনি আরেকপাশে ওর মা।
তোহা কাছে এগিয়ে যেতেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো আফিয়া।তোহাকে তিহানের মাথার পাশে বসার জায়গা করে দিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
—“তোর কথা অনেকবার করে বলছিলো মা।তুই একটু পাশে বসে থাক।ওর ভালো লাগবে।”
মায়ের সামনে খানিকটা ইততস্ত নিয়েই তিহানের মাথার কাছটায় বসলো তোহা।আফিয়ার হাত থেকে পানির বাটিটা নিয়ে বললো,
—“কান্না করোনা খালামনি,শান্ত হয়ে বসো।আমি পট্টি দিয়ে দিচ্ছি।”বলে তিহানের কপাল থেকে গরম হয়ে যাওয়া রুমালটা সরিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভেঁজালো তোহা।খানিকবাদে তা দুহাতে চিপড়িয়ে আবারো তিহানের কপালে দেয়ার সময় লক্ষ্য করলো,চেহারা পুরো লাল হয়ে গেছে তিহানের।ঠোঁটগুলো মনে হচ্ছে ঠোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পরবে।হাল্কা গোঙ্গাচ্ছে তিহান।মাকে মাথা নিচু করে কোন একটা দোয়া পরতে দেখে আলতো করে তিহানের গালে হাত রাখলো তোহা।জ্বরে শরীর রীতিমত পুড়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো তোহা।কাঁথার নিচ দিয়ে তিহানের হাত আঁকড়ে ধরে মাথা নামিয়ে ভীত কন্ঠে ডাকলো,

—“তিহান ভাই?”
তার একডাকেই আবছাভাবে চোখ মেললো তিহান।তার ধূসর মনিজোড়াও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তোহার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে সে বললো,
—“ভালো লাগছেনা তিহু।কিছু ভালো লাগছেনা।”
—“আচ্ছা আচ্ছা,আপনি চোখ বন্ধ করে রাখেন।ভালো লাগবে।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো তিহান।তোহা হাতটা ছাড়াতে নিলেই চাপা স্বরে ছেলেমানুষি কন্ঠে বললো,
—“ধরে রাখ প্লিজ।”
তোহা আর ছাড়ালোনা হাতটা।শক্ত করে ধরে আরেকহাতে ধীরে ধীরে তিহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“খালামনি,আরেকটা কাঁথা বের করে উনার গায়ে দিয়ে দাও।শীত কম লাগবে কিছুটা।”
আফিয়া তাই করলো।যদিও দুটো কাঁথা জড়ানো তিহানের গায়ে।তারপরও আরো একটা মোটা কাঁথা এনে তিহানের গায়ে দিয়ে বাচ্চাসূলভ কন্ঠে বললো,

—“তিহান?এখন একটু ভালো লাগছে বাবা?”
তিহান শব্দ করলোনা।সে ঘুমিয়ে পরেছে।আফিয়া ডাকলোনা আর।তোহা আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো।তিহানের অপরপাশের হাত মুঠোয় নিয়ে একমনে দোয়া পরছে তার মা।চোখ যদিও বন্ধ তবুও কপালের চিন্তার ভাঁজ গুলোই বলে দিচ্ছে কতোটা টেনশনে আছে সে।
—“খাবার খেয়েছেন উনি?”গলা নামিয়ে প্রশ্ন করলো তোহা।তার হাত তখনো অনবরত তিহানের চুলের ভাঁজে বিলি কেটে যাচ্ছে।
—“না রে মা।শতবার বলেও রাজি করাতে পারিনি।কিছুতেই খাবেনা।”হতাশ কন্ঠ আফিয়ার।
—“ভাইয়া ফার্মেসীতে গেলো কেনো?ঘরে প্যারাসিটামল নেই?উনাকে ওষুধ খাওয়াওনি?”
—“খাইয়েছি।দুটো নাপা ছিলো।দুটোই খাইয়েছি।রাতে যদি জ্বর না কমে সেজন্যই তূর্য নতুন আনতে গেলো।”
“ওহ” বলে আবেগভরা দৃষ্টিতে তিহানের মুখের দিকে তাকায় তোহা।কপালের রুমালটা আবারো ভিজিয়ে পুনরায় কপালে দিতেই তূর্য হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে।আফিয়ার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলে,
—“তিন মোড় ঘুরে একটা ফার্মেসী খোলা ছিলো খালামনি।সেজন্যই আনতে দেরি হলো।জ্বর কমেছে একটু?”
তোহা তৎক্ষনাত গালে গলায় হাত ছোঁয়ালো তিহানের।জ্বর মেপে বললো,

—“কমেনি ভাইয়া।”
—“খাবার খাইয়ে,আরেকটা নাপা খাইয়ে দেয়া দরকার তাইলে।খালি পেটে এতো ওষুধ খেলে আবার হিতে বিপরীত হতে পারে।”
হতাশ শ্বাস ছাড়লো তোহা।খালামনিকে বললো,
—“তুমি ভাত নিয়ে আসো খালামনি।আমি দেখি কিভাবে উনাকে খাওয়ানো যায়।”
তার কথাটা শেষ হতে না হতেই তিহান জ্বরের মাঝেই তেঁতো স্বরে বলে উঠলো,
—“আমি কিছু খাবোনা।শুধু শুধু ভাত এনে লাভ নেই।”
আফিয়া থেমে গেলো।কাতর নয়নে তাকাতেই তোহা তাকে বিশ্বাস দিয়ে বললো,
—“তুমি নিয়ে আসোতো খালামনি।”
—“তিহু আমি খাবোনা কিন্তু।….”জ্বরের ঘোরেও ধমকে উঠলো তিহান।
ভয় পেলোনা তোহা।বাবার ডাকে তূর্য রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই হাল্কা ঝুঁকে তিহানের গালে হাত রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
—“আমি খাইয়ে দিলেও খাবেননা আপনি?ভেবে বলছেন তো?”
চুপ করে রইলো তিহান।নিরবতা সম্মতির লক্ষন ভেবে মুচকি হাসলো তোহা।

ভাতের শেষ লোকমাটা তিহানের মুখে তুলে দিয়ে স্বতিদায়ক হাফ ছাড়লো তোহা।আফিয়ার ঠোঁটের কোঁণে মুচকি হাসি।তোহা নির্বিকার।আতিয়া তখনো যায়নি।তবে ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে তার মুখে।তোহা উঠে ভাতের প্লেটটা পাশে রেখে তিহানের মুখে একটা ওষুধ দিয়ে পানি খাইয়ে দিয়ে বললো,
—“এখন শুয়ে থাকেন।জ্বর নেমে যাবে একটুপর।আমি হাতটা ধুয়ে আসি।”
বলে সে বাইরে যেতেই তিহান আতিয়াকে বললো,
—“খালামনি,তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।তুমি যেয়ে ঘুমিয়ে পরো।তিহু আর মা আমার কাছে থাকুক।তাতেই হবে।চিন্তা করোনা।”

হাত ধুয়ে রুমে ঢুকলো তোহা।তিহান মাঝখানটায় ঘুমিয়ে আছে।পাশে আফিয়া খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসা।আতিয়াকে না দেখে বিশেষ অবাক হলোনা সে।এসব তিহানের কারসাজি,জানে সে।
তিহানের ডানপাশে যেয়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে তুলে বসলো তোহা।আফিয়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে।হয়তো ঘুম পাচ্ছে তার।
জ্বর দেখার উদ্দেশ্য হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তিহানের গাল ছুঁয়ে দিতেই তিহান চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললো,
—“মাথাটা টিপে দে তো তিহু।ব্যাথা করছে।”
সাথেসাথেই বিনাবাক্য ব্যায়ে একহাতে তার মাথা টিপে দিতে লাগলো তোহা।আরেকহাত তিহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“ঘুমানোর চেষ্টা করুন।এখন ভালো লাগছে একটু?”
ক্ষীণ হাসলো তিহান।উওর দিলো,
—“তুমি কাছে থাকলে আমার কখনো খারাপ লাগেনা’জানপরী’।”

ছোট্ট নরম কোমল মেয়েলি একটা হাতের অবাধ বিচরণ তিহানের চোখের উপর।আধো আধো জাগরণে চোখ মেললে চোখের উপর হাতের তালুর আবরণটিই সর্বপ্রথম নজরে আসলো তিহানের।ঠোঁটের কোঁণ আপনাআপনিই প্রসারিত হয়ে এলো তার।বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা হাতটা মোটা কয়েকটা কাঁথার তলদেশ থেকে উদ্ধার করে চোখের উপর থেকে হাতটা সরালো সে।কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকালো।নিবিড় পর্যবেক্ষণে হাতের মালিক যে ঘুমে বিভোর ব্যাপারটা নিশ্চিত হতেই হাতের নরম তালুতে শুভ্র স্পর্শে ঠোঁট ছোয়াঁলো সে।
—“কাল তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি বাবা।”
হঠাৎ মায়ের কন্ঠে বেশ খানিকটা লজ্জা পেলো তিহান।ভেবেছে মা ঘুমিয়ে আছে।কিন্তু না,আফিয়ার দৃষ্টি যে তার দিকেই তা স্পষ্ট হতেই লজ্জার মাত্রাটা বাড়লেও কোনরকম তাড়াহুড়ো করলোনা সে।ধীরগতিতে তোহার হাতটা নামিয়ে রেখে একটু কাত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বললো,

—“কালরাতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে।তাইনা মা?”
—“আরে না রে পাগল।আমারতো তোর কষ্টটা সহ্য হচ্ছিলো না।”
তিহান হাসলো।গায়ের কাঁথাগুলো সরিয়ে মাথার চুলে হাত চালাতে নিলেই আবারো বাঁধ সাধলো তোহার হাত।তার চুলের ভাঁজেও মেয়েটা হাত ডুবিয়ে রেখেছে।একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলেও এবারো আলতো ভাবেই হাতটা সরালো তিহান।তোহার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটুক তা সে চাচ্ছেনা।
আফিয়া একটু হেসে বললো,
—“একটু আগে দেখলাম ঘুমাচ্ছে অথচ গভীর ঘুমের মাঝেও তোর মাথা টিপে যাচ্ছে তো টিপে যাচ্ছেই।”
—“তোমার বেপরোয়া ছেলের বউ বলে কথা।ছেলের একটু পরোয়া তো করতেই হবে।”দুষ্টু হেসে বললো তিহান।
—“ছেলের বউ আর হলো কই?আচ্ছা তুই কি বুড়ো হয়ে বিয়ে করবি তিহান?মেয়েটাকে এভাবে ঘুরানো কি তোর ঠি ক হচ্ছে?”
—“তুমিতো সব জানোই মা।তিহু এখনো কলেজও পেরোয়নি।এ বয়সে মেয়েরা আবেগপ্রবণ হয় বেশি।বিয়ের কথা আসলে পড়াশোনা মাথায় উঠবে।ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাবে ওর।তাছাড়া আমাদের পরিবারে এতো ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়না।নিশাকেও তো পড়াশোনা কম্প্লিট করে তবেই বিয়ে দিয়েছে খালু।তিহুও আর একটু বড় হোক।পড়াশোনাটা অন্তত শেষ করুক।তারপর নাহয়…”

—“তোহা তো বুঝে তোর মনের কথা।তোর কি ওকে এতোটাই বাচ্চা মনে হয়?”
—“আমি জানি ও বুঝে।”নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো তিহান।তারপর আবার বললো,”আমি যতটুকু বুঝতে দেই ও ততটুকুই বুঝে মা।এর বেশি নয়।আর আমি ঠি ক ততোটাই প্রকাশ করি যতটা ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক নিতে পারবে।”
আফিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তার ছেলেটা বোধহয় শ্বাস নেয়ার আগেও একশবার চিন্তা করে।সবকিছু একদম সুক্ষ্ণ ভাবে চিন্তা করে তবেই কোন সিদ্ধান্ত নেয়।
গায়ের কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে তিহান।আফিয়া উঠে দাঁড়ায়।ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
—“ফ্রেশ হয়ে আয়।আমি নাস্তা করে আনি।ওর হাতেই খাবি?”
মায়ের কথায় দাঁত বের করে হেসে ফেললো তিহান।একআঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষে বললো,
—“ওর হাতের অভ্যাস হয়ে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে মা।আমি নিজেই খেতে পারবো।আচ্ছা,খালু কি চলে গেছে রাতে?”
—“খালু তোর বাবার সাথে ঘুমোচ্ছে।কোনো ডাক্তারকে ফোন করা আর বাদ দেয়নি কাল।শেষমেষ অতোরাতে কাউকেই পায়নি।”
বলে আফিয়া চলে যেতেই উঠে দাড়ায় তিহান।খাটের হাল্কা শব্দে একটু নড়েচড়ে যায় তোহা।একটু একটু করে তাকাতেই চোখের সামনে তিহানকে না পেয়ে ভ্রুতে ভাঁজ পরে তার।মুখ বাকিয়ে আলমারির সামনে তিহানকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে তোহা।দুহাতে চোখ কঁচলে বলে,

—“আপনি উঠলেন কখন?জ্বর কমেছে?”
আলমারি থেকে টি-শার্ট বের করলো তিহান।অত:পর আলমারি আটকে দিয়ে টি-শার্টটা এনে বিছানার উপর রেখে বললো,
—“কমেছে।তুই ঘুমোসনি সারারাত?শরীর খারাপ লাগছে?”
আবারো চোখ কঁচলালো তোহা।বড় একটা হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে তিহানের বালিশটা মাথার নিচে টেনে নিয়ে বিছানায় ডানকাত হয়ে গা এলিয়ে দুহাত জোড়া করে গালের নিচে দিয়ে বললো,
—“আপনি ঘুমোতে দেননি রাতে।এখন ডাকবেননা।আধঘন্টা পর আমি নিজেই উঠে যাবো।”
তিহান হাসলো।উবু হয়ে বিছানা ছাড়িয়ে পরে যাওয়া তোহার ওড়নার আঁচলের অংশবিশেষ তুলে দিয়ে বললো,
—“ঘুমা।কেউ ডাকবেনা।”
তিহানের কন্ঠটা আবছাভাবে শুনতে পেলো তোহা।তবে ঘুমিয়ে তলিয়ে যাওয়ার পরপরই আবারো স্পষ্ট হয়ে এলো তিহানের মুখশ্রী।তার সপ্নরাজ্য যে কেবল তিহান এবং তিহানই।তিহান ছাড়া সেখানে দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্হান নেই।

আজ আর কলেজ যাওয়া হয়নি।সবে গোসল করে বারান্দায় চুল ঝাড়ছে তোহা।মধ্যদুপুরের সরু চিকন রোদরশ্নি অদ্ভুত আল্পনায় বারান্দায় ছড়িয়ে পরেছে।রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে মাথা কাঁত করে চুল মুছতে মুছতে উৎসুক দৃষ্টিতে রাস্তার মানুষ জনদের দেখে যাচ্ছে সে।চোখেমুখে সৌন্দর্যের বিস্তর ছেলেখেলা।চুলের নিচের অংশের পানিতে কোমড়ের জামা ভিজে একাকার।তার সেদিকে খেয়াল নেই।সে ব্যস্ত রঙিন শহরের ব্যস্ততা দেখতে।গায়ের মসৃণ মেরুন ওড়না কাঁধ গলিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অথচ তরুনীর কোন মাথাব্যাথাই নেই।
এদিকে সদ্য স্নানকরা প্রেয়সীর হৃদয়হরণ করা জ্বালাময়ী রুপে চোখ রীতিমত ঝলসে যাচ্ছে তিহানের।বারান্দায় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলো একটু খোলা বাতাসে কাজ করার উদ্দেশ্য কিন্তু এই মেয়েতো তা করার অবকাশ টুকুও দিচ্ছেনা।দিনকে দিন মন মস্তিষ্কে এমনভাবে জেঁকে বসছে যে অন্যকিছুকে সেখানে ঠাঁই দেয়াটাই মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে।
ল্যাপটপ টা অর্ধেক বন্ধ করলো তিহান।গলা উঁচুতে চড়িয়ে ডাকলো,

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ১৭+১৮

—“তিহু…”
তার হঠাৎ গাম্ভীর্য কন্ঠের ডাকে চমকে উঠলো তোহা।শরীরের মৃদু কম্পনে হাতের তোয়ালেটা পরতে যেয়েও পরলোনা।ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সে।খানিকটা ভীত কন্ঠে বললো,
—“এভাবে ডাকছেন কেনো?কি হয়েছে?”
কোনরকম ভূমিকা উপসংহার করলোনা তিহান।আদেশসূচক গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বললো,
—“ঘরে যা।”
—“কেনো?”কৌতুহলী অবাক কন্ঠ তোহার।
তিহান একপলক তাকালো।ভেজা চুল গড়িয়ে টুপটাপ পানিগুলোকে মুক্তকোণা মনে হচ্ছে তার চোখে।আবারো ঘোর লেগে যাচ্ছে।তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে বেহায়া প্রেমিকের মত।কিন্তু তা সম্ভব নয়।মনে মনেই একটা শ্বাস ফেললো তিহান।পুনরায় ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

—“আমি একটা জরুরি কাজ করছি তিহু।তুই প্রচন্ড ডিস্টার্ব করছিস।”
—“আমি কিছু বলেছি আপনাকে?আমিতো শুধু…”
—“তুই যাবি নাকি না?”
—“আপনি একটা অসহ্যকর,তিহান ভাই।”ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাটা বলে তোয়ালেটা শুকাতে দিলো তোহা।গটগট করে রুমে যাওয়ার আগেই তিহান দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বললো,
—“তুমিতো এই অসহ্যকর লোকটার চিন্তায়ই সারাক্ষন ধ্যানমগ্ন থাকো প্রাণপ্রেয়সী”।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২১+২২