এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৪১+৪২

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৪১+৪২
লেখিকা মালিহা খান

আকাশ কাঁপিয়ে জলধারা নামে আজকাল।মেঘে মেঘে বিস্তর রেশারেশি করে পরিশেষে অভিমানগুলো বৃষ্টিরূপে ঝরে পরে যায় ধরণীর গায়ে।ধরিত্রীমাতা তা সাদরে বরণ করে নেয় দুহাত মেলে।প্রকৃতি ভিজে উঠে।কাঁটা মাটির গন্ধ,পিচঢালা রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা জলরাশি,চকচক করে উঠা সবুজ গাছটার মগডালে সরু সোনালী রোদরশ্মি,সবটা যেনো এই চিরচেনা প্রকৃতিটাকে নতুন করে একেবারে শুদ্ধতম রূপে ভালবাসতে শেখায়।শ্রাবণ মানেই তো বৃষ্টি আর বৃষ্টি মানে প্রেম।সুতরাং এই শ্রাবণের সব বর্ষণের অপরিবর্তিত এক নাম “প্রেমবর্ষণ”।

মায়ের ঘরের বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে তোহা।তাকে বসিয়ে রেখে কাঠের আলমারি হা করে খুলে আধঘন্টা যাবত খোজাখুজি করছে আতিয়া।মাঝেমধ্য দু একবার বিরবির করে “রাখলাম কোথায়?”,”পাচ্ছিনা কেনো?” এই ধরণের স্বগতোক্তি আওড়াচ্ছে।তোহা চোখমুখ পুতুলের ন্যায় শান্ত,নিশ্চল।কিছু বলতে গেলেই তাকে মৃদু ধমকের স্বরে চুপ করিয়ে দিচ্ছে আতিয়া।
ড্রইংরুম থেকে ছেলেদের হাসি ঠাট্টার শব্দ কানে আসছে।তার খালুরা,ভাইরা সবাই বসেছে ড্রইংরুমে।কাবিন হবে আগামীকাল মানে শুক্রবারে।আগে বিয়েটা পরিয়ে রেখে তারপর বাদবাকি হলুদ বিয়ের আনুষ্ঠানিক জমকালো আয়োজন শুরু হবে পরের সপ্তাহে।আদরের ছোট মেয়ের বিয়ে বলে কথা।আরমান সাহেব পারলে মাসখানেক আগে থেকেই বাড়িঘর সাজিয়ে ফেলেন।কিন্তু তা করলে লোকে তাকে পাগল বই কিছু বলবেনা।
আতিয়ার হাতে তার বিয়ের ওড়নাটা।সিঁদুর রঙা ওড়নায় সোনালী কাজ করা পাড়।সেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের যুগেও আরমান সাহেব বেশ রুচিশীল ছিলেন।বিয়ের শাড়ি-গহনার সাথে এই ওড়নাটাও দিয়েছিলেন।দামি দামি শাড়ি গহনার ভিড়ে এই ওড়নাটাই বেশি মনকেড়ে ছিলো যুবতী আতিয়ার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওড়নাটা এতকাল বেশ সযত্নে তুলে রাখা ছিলো আলমারির নিরাপদ এককোঁণে।নিশার বিয়ের সময় অবশ্য বের করেছিলো আতিয়া।কিন্তু নিশা সাফ মানা করে দিয়েছিলো যে সে এসব পুরনো যুগের ওড়না পরবেনা।কষ্ট পেলেও আতিয়া জোর করেনি।হাতের পাঁচআঙ্গুল তো আর সমান হয়না।তখন এটা আবার তোহার জন্য যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন উনি।তোহা যেন বিয়ের দিন তার মায়ের ওড়না মাথায় দেয় এমন একটা সুপ্ত ইচ্ছা তার আছে।যদিও সে জোর করবেনা তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছোট মেয়ে মায়ের ইচ্ছার মান রাখবে।
আতিয়া এগোলো।মিষ্টি হেসে পেছন দিয়ে দুহাতে ওড়নাটা মেলে ধরে তোহার মুখের দিকে চেয়ে অদ্ভুত একটা মোলায়েম আবদার করে বললো,
—“পরাই?”
কিছুক্ষণের জন্য একরকম মোহে চলে গেলো তোহা।মায়ের এমন কন্ঠ সে আগে শোনেনি।খানিকবাদে নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে টানা ঘোমটা টা নামিয়ে মাথা নুয়ালো সে।মেয়ের সম্মতি বুঝতেই ঠোঁটে প্রগাঢ় হাসির ঝলক খেলে উঠলো আতিয়ার।চোখের কোঁণায় চিকচিকে অশ্রুকণা নিয়ে ধীর গতিতে ওড়নাটা তোহাকে পরিয়ে দিলো আতিয়া।মুখ নামিয়ে মনভরে তোহাকে দেখে নিয়ে কপালে স্নেহের চুমু খেয়ে বললো,”মাশাআল্লাহ্”।
তোহা হাসলো।এ হাসিতে যেনো মুক্ত ঝরে।মা মেয়ের এহেন মূহুর্তে বাঁধা হয়ে স্বশব্দে দরজা খুলে ভেতরে আসলো স্বর্ণালী।বললো,”খালুর চশমা কোথায় খালামনি?খালু চাচ্ছে”।আতিয়া উঠে দাড়ালো।খুব সন্তর্পনে চোখের জলটা মুছে নিয়ে গলা ঝেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে উওর দিলো,”কোথায় যে রেখেছে?আচ্ছা,তুই যা,আমি খুঁজে আনছি।”স্বর্ণালী চলে গেলো।তবে দরজাটা অর্ধেক না ভিড়িয়েই।
এখান থেকে ড্রইংরুমের সব স্পষ্ট দেখা যায়।তোহার দৃষ্টি মুখ বরাবর রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে।নিজেকে কেমন নতুন নতুন লাগছে।একদম অচেনা,স্নিগ্ধ একটা শোভা।
ড্রইংরুমের কোঁণার সোফায় বসে কথাবার্তায় নিবিষ্ট ছিলো তিহান।নিতান্তই বেখেয়ালিতে হঠাৎ পাশের রুমের দিকে চোখ পড়লেও পরমূহুর্তেই তার সকল খেয়াল যেয়ে স্তূপআকারে জমা হলো সেখানে।
তিহান বশীভূত হলো।বিয়ের লাল ওড়না মাথায় দেয়া মেয়েটার এই আশ্চর্য অপার সৌন্দর্য তার তুচ্ছ চোখজোড়া ধারণ করতে পারছেনা।তবুও সে তা চেষ্টা করলো তা সহ্য করে নেয়ার।।চেয়ে রইলো মুগ্ধ,নিষ্পলক নয়নে।
মিনিট পার না হতেই চারচোখ এক হলো।চট করে দৃষ্টি নামালো তোহা।সেই গালের রক্তিম আভাযুক্ত অপার্থিব সৌন্দর্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিলো তিহানের ধূসর মনি।ধীরগতিতে সেও চোখ ফিরিয়ে নিলো।

সন্ধ্যা সাতটা।
তিহানের মুখশ্রী থমথমে।ক্রোধে ফেটে পরছে লালাভ চোখদুটো।ফর্সা চেহারায় ফুটে উঠা ঝাঁঝালো রাগটা লুকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলোনা সে।শুধুমাত্র বিয়ের ভরা বাড়িতে উচ্চবাক্য আগ্রাসি আচরণ করা দৃষ্টিকটু দেখা যাবে ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে।খানিকবাদে রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই তা সহ্য করতে না পেরে আরমান সাহেবকে ড্রইংরুম থেকে ডেকে রুমে নিয়ে গেলো তিহান।দরজা ভিড়িয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,
—“অনন্ত এখানে কেনো এসেছে খালু?আপনি মানা করেননি কেনো?”
আরমান সাহেব টের পেলেন তার সামনে দাড়ানো যুবকটি আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলজ্বল করছে।যদিও ভদ্রতার খাতিরে দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে তবুও বোঝা যাচ্ছে সেই চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝড়ছে।সেই আগুনের তাপে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
আরমান সাহেব হাল্কা কাঁশলেন।বললেন,
—“নিশা তো তোহার বড় বোন।ওকে তো আমি বিয়েতে আসতে মানা করতে পারিনা।তাইনা?”
—“আমি নিশার কথা বলিনি খালু।অনন্তের কথা বলেছি।আর আপনি অবশ্যই অবগত আছেন আমি কেনো বলছি কথাটা।”তিহানের নামানো কন্ঠেও প্রগাঢ়তার তীব্র ছাঁপ।

আরমান সাহেব এগোলেন।তিহানের কাঁধে একহাত রেখে বললেন,”শান্ত হও বাবা,আমি শুধু নিশা আর সৌহার্দকেই আসতে বলেছিলাম।অনন্ত কেনো এলো আমার জানা নেই।আর এতক্ষণ ছেলেটার আচার-আচরণ দেখে মনে হয়না সে পূর্বের মতো কাজ আবারো করার সাহস করবে।সৌহার্দ্য বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ।অবশ্যই নিজের এমন ভাইকে সে এমনি এমনি নিয়ে আসবেনা।এখন বাসায় আশেপাশের ফ্ল্যাটের মহিলা মানুষ আছে।আমার মনে হয় এ বিষয়ে রাতের বেলা খোলাখুলিভাবে কথা বলা যাবে।”
তিহান মৌনমুখে মাথা নাড়ালো শুধু।এমুহূর্তে কথা বাড়িয়ে শুধু শুধু খালুর সামনে বেয়াদবি করতে চাচ্ছেনা সে।
রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলোনা।সন্ধ্যার একটু পরে অন্য ফ্ল্যাটের মহিলারা চলে গেলে সৌহার্দ্য সময় সুযোগ বুঝে নিজ থেকেই বললো,”বাবা,আপনি হয়তো ভাবছেন আমি ওই ঘটনার পরও কেনো নির্বোধের মতো অনন্তকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।তাইতো?”
বসার ঘরে তখন পরিবারের বড়রা উপস্থিত।তিহানও আছে অবশ্য।অনন্ত নতমুখে বসে আছে।চোখেমুখে হয়তো অনুশোচনার রেখা।আরমান সাহেব বিচলিত হলেন না,ঠান্ডা স্বরে উওর দিলেন,

—“সেরকম ভাবাটাই তো স্বাভাবিক।”
—“অনন্ত তোহার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে বাবা।সেই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য সে অনুশোচিত।”
তিহান তেজস্বী গম্ভীর গলায় ফোঁড়ন কাটলো,
—“তাই নাকি?হঠাৎ আজকে কেনো তার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হলো দুলাভাই?সেই ঘটনার তো অনেক অনেকদিন হয়ে গেছে।এতদিন পর আজ তার অনুশোচনা হলো?”
তাকে থামিয়ে দিলেন আরমান সাহেব।স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন,”তোহাকে ডেকে আনো।সে যেহেতু ক্ষমা চাচ্ছে তাকে তা করার সুযোগ দেয়া হোক।”
তোহা এলো।অনন্ত ক্ষমা চাইলো।সে পায়ে পরতেও রাজি।তবে পায়ে পরতে হলোনা তাকে তার আগেই তোহা মিনমিনে কন্ঠে তাকে ক্ষমা করে দিলো।পরিস্থিতি তখন শিথিল হয়েছে।তোহা বসার ঘর থেকে সরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তিহান সকলের অগোচরে তার কব্জি ধরে আটকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
—“রাতে একটু সাবধানে থাকবে।”

আজকের সকাল টা ভিন্ন।বছরের পর বছর অপেক্ষার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।তোহার হাতভর্তি লালরঙা মেহেদি উঁকি দিচ্ছে।গতকাল রাতে সে মেহেদী পরেছে।কোনো অনুষ্ঠান করেনি ইচ্ছে করেই।সারা বাড়িতে ব্যস্ততারা ছুটে বেরাচ্ছে হইহই করে।শুধু কাবিনের অনুষ্ঠানেও আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাইকে দাওয়াত করেছে আরমান সাহেব।ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়রা তো আছেনই।
তোহা অবশ্য কাবিনটা ছোটখাটো করে করার কথা বলেছিলো কারণ আবার পরশুদিনই বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে।এত খরচা করে কি লাভ?কিন্তু আরমান সাহেব তার প্রস্তাবটা মুখের উপর নাকচ করে দিয়েছেন।
জুম্মার পর কাজি আসবে।বিয়ে পড়ানো হবে তাদের।’কবুল’ ‘কবুল’ ‘কবুল’ এরপর কেবলই পবিত্রতা।
তোহার পরণে তিহানের দেয়া লাল বেনারসি।মুখে অল্পবিস্তর সাঁজ।রেশমকালো চুলগুলো পিঠের উপর লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে।নিশা আর আতিয়া স্বর্ণের গহনাগুলো পরিয়ে দিলো তাকে।চুল বাঁধার আগেই বাইরে থেকে ডাক পরলো।বিয়ে বাড়ি।হাঁকডাক হওয়া স্বাভাবিক।আতিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো।খানিকবাদে আবারো সৌহার্দ্যর ডাকে”তুই বস,আমি একটু শুনে আসি”বলে নিশাও বেরিয়ে গেলো।একা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রইলো তোহা।আনমনে আতিয়ার বিয়ের ওড়নাটা মাথায় দিলো একবার।নাহ,এবার সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।

গেট খোলার শব্দ।তোহা না তাকিয়েই বললো,”আপু,চুলটা বেঁধে দাও তাড়াতাড়ি।আজান তো দিয়ে দিবে একটু পর।বাইরে এতো শোরগোল কেনো?কাজি কি আগেই এসে পরেছে?”বলে মাথার ওড়নাটা নামিয়ে রাখলো সে।উঠে দাড়িয়ে খোলা চুল সামলাতে সামলাতে পেছনে ফিরতেই ‘ধক’ করে একটা ধাক্কা লাগে বুকের মধ্যিখানটায়।আপনাআপনিই দু’পা পিছিয়ে যায় সে।ড্রেসিং টেবিলের সাথে পা ঠেঁকে যেতেই থেমে থেমে ভীত গলায় বলে,
—“আপনি এখানে কেনো এসেছেন?বের হন।আমি তৈরী হচ্ছি।”
অনন্ত হাসলো।সেই পুরনো বিশ্রি হাসিটা।গা রি রি করে উঠলো তোহার।শরীর কাঁটা দিলো।মনের গহীণ কোঁণে উঁকি দিলো আগাম কিছু দু:সংবাদ।অনন্ত সময় নষ্ট করলোনা।যেকোনো সময় যে কেউ এসে পরতে পারে।এই সুযোগটাই বেশ কষ্টে হাতে এসেছে।সে দ্রত কদমে এগিয়ে গেলো।তোহার নরম হাতের প্রতিরোধ নিমিষেই উঁপড়ে দিয়ে বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরলো তোহাকে নিজের সাথে।আপত্তিকর স্হানগুলো তার বাজে হাতের কলোষিত ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে থাকলো অবিলম্বে।তোহা চিৎকার করলো।বাইরে বোধহয় কিছু নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে।বাবার,খালুদের তুমুল উচ্চবাক্য শোনা যাচ্ছে।

পুনরায় চিৎকার করার আগেই অনন্ত তার মুখ চেপে ধরলো।স্পর্শকাতর স্থানে অধরের আগ্রাসী আক্রমণগুলো ক্ষত বানিয়ে ফেলছে।ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তোহার মন।এই শ্রাবণ কি তবে কেবলই তার হৃদয়ের রক্তপাত ঘটানোর জন্য এসেছে?চোখ বেয়ে অঝর ধারায় গড়াচ্ছে পানি।মুখ দিয়ে গোঙ্গানি।তার নিজের মানুষটা তাকে স্পর্শ করার আগেই সে অন্যর ছোঁয়ায় রক্তাক্ত হয়ে গেলো কেনো?
কেউ বোধহয় আসছে।হ্যাঁ তাইতো,এদিকেই আসছে।খুব দ্রুতপায়ে।পায়ের হিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।খট খট খট।অনন্ত সরে দাড়ালো।সেদিনের চড়ের ঝালটা পুরোপুরি মিটেনি তবে যা পেরেছে এই ঢের।তোহাকে ছেড়ে দিয়ে পৈশাচিক হাসি হাসলো সে।ডানহাতের কুনুইয়ের কাছটা খামছিয়ে ধরে আরেকহাতে খুব দ্রুত গাঢ় লিপস্টিক ঢলে ছড়িয়ে দিলো,মাথায় চুল এলোমেলো করে বাইরের মানুষটা দরজা খোলার আগেই ভেতর থেকে দরজা টেনে সজোরে তোহাকে একধাক্কায় ছুঁড়ে মারলো বাইরে।
বাবুর্চিদের সাথে খাবার দাবারের বিষয় নিয়েই এক কথা দু কথায় বিস্তর কথা কাটাকাটি লেগে গিয়েছে ড্রইংরুমে।আরমান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পরেছেন।আতিয়া আর নিশা সেখানে ব্যস্ত থাকায় স্বর্ণালী আসছিলো তোহার চুল বাঁধায় সাহায্য করতে।তবে রুমে প্রবেশ করার আগেই এই আকস্মিক ধাক্কাটা সে সামলে উঠতে পারলোনা।ড্রইংরুমে উপস্থিত প্রত্যেকটা চোখ তখন সেদিকে।ঝগড়া থেমে গেছে।সব শান্ত,শীতল।বিয়ে বাড়িতে বউয়ের এহেন বিধস্ত অবস্থা আর পরক্ষণেই রুমের ভেতর থেকে অনন্তের বের হওয়া দেখে মেহমানদের প্রায় সবাই-ই ঘটনা সম্পর্কে উৎসুক হয়ে উঠলো।তূর্য এগিয়ে এলো সর্বপ্রথম।বাকি কারো না চলছে পা না চলছে মুখ।তূর্য এসে স্বর্ণালির কাছ থেকে তোহাকে টেনে বুকের সাথে চেপে ধরলো দ্রুত।এলো স্নেহের চুলগুলোতে হাত ডুবিয়ে দিতেই ক্ষীণ স্বরে ডাকলো তোহা,”ভাইয়া।”সেই করুন ডাকটায় ভেতরটা যেন জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলো তূর্যর।বোনের এ অবস্থা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি নেই তার।সে জাপটে ধরলো তোহাকে।যেন বুকের ভিতর লুকিয়ে ফেলবে আদরের বোনটাকে।তোহা চোখ বোজল।নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো,”উনি কোথায়?”

অনন্ত দাড়িয়ে আছে উদ্ভ্রান্তের মতো।তার চোখে,ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে যেন প্রকাশ পাচ্ছে নরপিশাচের তৃপ্তিকর ঢেঁকুর।আরমান সাহেব এগোলেন।রক্তচক্ষু নিয়ে সজোরে চড় মারলেন অনন্তর বামগালে।তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।হাত কাঁপছে।মাথা ঘোরাচ্ছে।অনন্ত ছিঁটকে পরে গেলেও মূহুর্তেই তাচ্ছিল্যর স্বরে হেসে বললো,”এখন যত ইচ্ছা মারেন আঙ্কেল।আপনার মেয়ের ক্ষতি তো করেই ফেলেছি।”
তিহান বেরিয়েছিলো একটু।একটা জিনিস কিনতে।ধৈর্যশীল প্রেমিক মনটা আজ খুব বেশি তাড়া দিচ্ছে।তোহাকে বিয়ের শাড়িতে-সাজে,বধুবেশে দেখার জন্য তৃষ্ণার্থ মনটা হাহাকার করছে।এত তাড়া তো তার কোনোকালেই ছিলোনা?তবে?আজ এতো তাড়াহুড়ো কেনো?হাতের ছোট্ট জিনিসটা পরণের ধবধবে সাদা পান্জাবির পকেটে ঢোকালো সে।প্রায় সিঁড়ির মাথায় উঠে গেছে।কোনো কলরব নেই।বেরোনোর আগেই তো দেখলো সব সরব।এখন সব এতো নিরব কেনো?কিছু হলো না তো?
তোহাদের ফ্ল্যাটের দরজাটা আস্তে করে খুললো সে।সবার মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে থাকা আর অনন্তর ফ্লোরে বসা দেখেই বুঝলো খুব বাজে কিছু ঘটে গেছে।সে দেরি করে ফেলেছে।খুব দেরি।
কয়েককদম এগিয়ে যেতেই তোহার দেখা মিললো।তূর্যর বুকে গুটিশুটি হয়ে লুকিয়ে আছে।ভয় পাচ্ছে বোধহয়।
তিহান সবট বুঝেও যেনো বুঝলো না।বুঝতে চাইলো না।তূর্যর চোখ সিক্ত।তিহান নির্বোধের মতো বললো,

—“কি হয়েছে এখানে?”
তিহানের কন্ঠ কানে যাওয়া মাত্রই মুখ তুললো তোহা।রং ছড়ানো ঠোঁট,এলোকেশ,চুলের ফাঁক গলিয়ে ঘাড় গলার দৃশ্যমান ক্ষতগুলো যেন মূহুর্তেই দাবানল সৃষ্টি করে দিলো তিহানের শান্ত স্নিগ্ধ চোখদুটিতে।বজ্রহতের ন্যায় প্রাণপ্রেয়সীর বিক্ষিপ্ত আবেশ দেখে নিতেই ফুঁপিয়ে উঠে আবারো তূর্যর বুকে মুখ লুকালো তোহা।তূর্য আগলে ধরলো তাকে।খুব আদরে,চরম মমতায়।তিহান মুখ ফেরালো।বিধংস্বী,হিংস্র হয়ে উঠলো নিমিষেই।
লাথি লাগালো অনন্তর বুক বরাবর।আর্তনাদ করে উঠলো অনন্ত।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“তোর হবু বউকে তো কলঙ্কিত করেই ফেলেছি।পুরো বাড়িভর্তি সবাই সাক্ষী আছে।খুব তেজ না চড় মারার?আমা..”বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা অনন্ত।তার আগেই আরেকটা ভারী লাথি পড়লো তার মুখের উপর।একপর্যায়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরতেই থাকলো।এলোপাথারি।কেউ আটকাচ্ছেনা।সাহস পাচ্ছেনা।সৌহার্দ্যও চুপচাপ।তার ছোট ভাই যে এত নিকৃষ্ট তার জানা ছিলোনা।থাকলে হয়তো এতদিন অনন্তের মিথ্যা ভদ্র আবেশটা সে ধরে ফেলতে পারতো।সে ব্যর্থ।ভাই হিসেবে ব্যর্থ,এবাড়ির জামাই হিসেবে ব্যর্থ।
তিহানের চোখেমুখে যেনো আগুনের রক্তিম লাভা গলে গলে পরছে।তোহার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দগুলো যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে তাকে আরও দাহ্য করে তুলছে।অনন্তর অবস্থা যায় যায়।রক্তের ফোটায় সাদা ফ্লোর রন্জিত।তূর্য বোনকে ছাড়তে পারছেনা নয়তো তার হাত থেকেও অনন্ত রক্ষা পেতো না আজ।আরমান সাহেব চোখ বোজে সোফায় বসেছিলো।অনন্তের আহাজারি গোঙ্গানিতে চোখ মেললো সে।তখন যদি ড্রইংরুমের তুমুল ঝগড়াটা না লাগতো তবে অবশ্যই তোহার চিৎকার কারো না কারো কানে তো আসতো।কিন্তু তা আসেনি।কোনোভাবে তো সে-ই দায়ী।একবার মেয়ের দিকে তাকালো।তূর্য আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ভয়ার্ত বোনকে।ড্রইংরুমের এককোঁণে বোনের প্রতি ভাইয়ের নিরব ভালবাসার বহি:প্রকাশ হচ্ছে।তপ্ত দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়লো সে।তিহানের দিকে চেয়ে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,,”থামো তিহান,মারা যাবে।আমি দেখছি কি করতে হবে।”

সাথেসাথেই থামলোনা তিহান।আরো কয়েকটা লাথি লাগিয়েও ক্ষান্ত হলোনা তার ক্ষ্যাপা মন।জোরে কয়েকটা হাঁফ ছেড়ে একটু দুরে সরলো সে।বললো,
—“আপনাকে আমি কালই সাবধান করেছিলাম খালু।আপনি শোনেননি।আজকে..”জড়িয়ে আসে তিহানের কন্ঠ।আরমান সাহেব চোখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকায়।তিহান শ্বাস ছাড়ে।ঢোঁক গিলে তোহার কাছে এগোয়।তূর্য কাছ থেকে ছাড়িয়ে সবার সামনেই নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়।সবাই চুপ।কারো স্বাধ্যি নেই কিছু বলার।মানুষটার চিরচেনা বুকের গন্ধটা নাকের কাছে পেতেই ডুঁকরে উঠে তোহা।কাঁটা জায়গাগুলোতে জ্বলছে।অনেক জ্বলছে।তার চেয়ে বেশি জ্বলছে ভেতরটা।এই ছিলো তবে এত অপেক্ষার পরিসমাপ্তি?
উপস্থিত একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ফোঁড়ন কাটলো,
—“বিয়ের আগে বরের সাথে এতো জড়াজড়ি কিসের?মেয়ের তো মনে হয় চরিত্রে সমস্যা।শুধু ছেলের দোষ কেন হইবো?”

—“চুপ।”বলে গর্জন করে উঠে তিহান।তার এক চিৎকারে মহিলা চুপসে যায়।বড়দের সাথে এভাবে সে কখনোই কথা বলেনা।তবে আজ..আজ কেনো যেনো পারছেনা।এলোমেলো,অগোছালো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।কানাঘুষা চলছে তখনো।আতিয়া মূর্ছা গেছে।স্বর্ণালী-নিশা সামলাচ্ছে তাকে।পরিবেশ খুব ভারি।তোহার শরীর নিস্তেজ,নির্জীব,অসাঢ় হয়ে আসছে।এত চাপ তার ছোট্ট মস্তিষ্ক নিতে পারছেনা।তিহান দাড়ালোনা।তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে নিয়ে আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,”নিয়ে যাচ্ছি ওকে।এখানে ও নিরাপদ না।শুধু কাজি আসলে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবেন।ওখানেই বিয়ে পড়ানো হবে।আর হ্যাঁ,পরিবারের মানুষ ছাড়া একজনকেও যাতে না দেখি।”শেষের কথাটা উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বলে স্হান ত্যাগ করলো তিহান।আরমান সাহেব তার ঠান্ডা কন্ঠ শুনেই বেশ বুঝতে পারছেন তিহানের বলা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন না হলে আজ ঘোর অনর্থ ঘটে যাবে।আফিয়া আর তূর্য ছুটলো তিহানের পিছু পিছু।তোহাকে নিজের রুমে এনে শুইয়ে দিলো তিহান।মেয়েটা বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে।নাহ্,জ্ঞান হারায়নি।ওইতো চোখ খুলছে একটু আধটু।দূর্বল হয়ে পরেছে হয়তো।আফিয়া পানি এনে দিলো।তিহান ফাস্ট এইড বক্স এনে রাখলো টেবিলে।নিজেকে যথাসম্ভব সামলে তোহাকে ঠেস দিয়ে বসালো বুকের সাথে।আফিয়া পানি খাইয়ে দিয়ে বাইরে গেলো।তূর্য নিজের রুমাল বের করে মুখের লিপস্টিক,ছড়িয়ে যাওয়া সাঁজগোজ মুছে দিচ্ছে।

মোছানো হয়ে যেতেই রুমালটা পুনরায় পকেটে ঢোকালো সে।বোনের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো অনেকক্ষণ।।তিহান ফাস্ট এইড বক্স খুললো।গলার কামড়ে ক্ষত করা জায়গাটায় স্যাভলনের ছোঁয়া দিতেই শিঁউরে উঠলো তোহা।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে শাড়ি খামছে ধরে করুন স্বরে বললো,”লাগছে।”
বুকের কোথায় যেনো একটা কাঁটা বিধলো।বড় একটা কাঁটা।খুব ধারালো।একদম রক্তাভ করে দিলো সব।তখনই দরজার সামনে আসলো সাইফ।তূর্যকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বললো,”খালু তোমাকে ডাকছে একটু।”বলেই জায়গাটা থেকে সরে গেলো সে।তূর্য আরেকবার বোনের দিকে তাকালো।অত:পর তাকালো তার পিছে বসা শক্তপোক্ত মানুষটার দিকে।প্রবল শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে।
তিহান তোহার গলার কাছটায় সযত্নে ব্যান্ড-এইড লাগাতে লাগাতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
—“যা তুই,আমি একাই পারবো।আর এখানে কাউকে আসতে মানা করবি।হট্টগোল চাচ্ছিনা,তিহুর রেস্ট প্রয়োজন।”
ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে।বাইরে বোধহয় শীতল হাওয়া বইছে।শ্রাবণঝরা বৃষ্টি নামতে পারে।পর্দা উড়ছে।একটু পরপর একফালি আলো ঝলকে পরছে ঘরের সাদা মেঝেতে।বাতি নিভানো।তবে আলোকশূন্য নয় কোনোকিছুই।পাতলা পর্দা ভেদ করে আসা কিরণে সব দৃশ্যমান।তোহার ঘাড়ে গলায় ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিয়ে তিহান কোমল স্পর্শে তার বামগালে হাত ছোঁয়ালো।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বললো,”আর কোথাও লেগেছে?”

এতক্ষণ তেজশূন্য ভঙ্গিতে তিহানের বুকে লেপ্টে থাকলেও এই নরম কন্ঠটায় ভেতরের কান্নাটা ফুলে ফেঁপে
উপচে পড়লো তোহার।গালে রাখা হাতটা নামিয়ে নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে অদ্ভুত আর্তনাদ করে গুঙ্গিয়ে উঠলো সে।সেই সাথে গড়িয়ে পরলো অবিরাম অশ্রুপাত।পান্জাবি ভিজে উঠলো।বুকের উপরের সেই ভেজা জলের অস্তিত্বে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তিহান।সব কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।তার এই নিষ্পাপ ফুলটাকেই কেনো এতো বেদনা সহ্য করতে হলো?কেনো সে আগে এলোনা?কেনো মেয়েটাকে ওই নরপশুটা ছুঁয়ে দিলো?
তোহার কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে।পাহাড়সমান কষ্টে দিশেহারা তিহান উপায় না পেয়ে তোহার মাথাটা বুকের সাথে আরো একটু জোরে চেপে ধরলো।হাত দিয়ে গাল-চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
—“কাঁদেনা,আমি আছিতো।”

তোহার কান্না হুহু করে বেড়ে গেলো।কেমন উন্মাদ হয়ে উঠলো সে।তিহানের বাহু খামছে ধরলো।খুব জোরে।নখগুলো যেনো ভেদ করে গেঁথে যাচ্ছে।তোহা আঁচরে দিচ্ছে।এবড়োথেবড়ো করে।হুঁশ নেই।তিহান বললোনা কিছু।তার বাহু রক্তাক্ত করে যদি মেয়েটার কষ্ট কমে তবে কমুক না।ক্ষতি কি?তোহার হাত থামলো।তিহানের বুকে কপাল ঠেকিয়ে সে আহাজারি করে চিৎকার করলো,
—“আপনি ছিলেননা।আপনি আমার কাছে ছিলেননা।কেউ ছিলোনা।আমি একা ছিলাম”।এটুকু বলতেই বিধ্বংসী রুপটা শান্ত হয়ে এলো।মুখ তুলে একবার তিহানের বাহুতে নজর দিলো।সাদা পান্জাবির উপর দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্তের ছাপ।হাতটা নামালো সে।ধীর গতিতে তিহানের পিঠ জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিলো।চোখ বুজে মৃত গলায় বললো,”তারপর লোকটা এলো।চেপে ধরলো।গায়ে হাত দিলো।ঠোঁট ছোঁয়ালো।কাঁমড়ে দিলো।জানেন,আমি চেষ্টা করেছিলাম।অনেক চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু পারিনি।লোকটা ছাড়লোই না।চিৎকার করলাম,কেউ শুনলোই না।ওই স্পর্শগুলো না আমার সহ্য হচ্ছিলো না।কোমড়ে,পিঠে,বুকে,গলায় সব জায়গায়।কেমন দুর্গন্ধ!এরপর..এরপর হঠাৎই আমাকে ছেড়ে দিলো।লিপস্টিক ডলে চুল এলোমেলো করে দিলো।আমি কিছুই করতে পারলাম না।অথচ লোকটা কিছু না করতে পেরেও যেনো সব করে ফেললো।”থামলো তোহা।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে ক্রন্দনরত কন্ঠে অভিমান করে বললো,”স্বর্ণা আপু কেনো আরো একটু আগে আসলোনা?আপনি কেনো আসলেননা?আমিতো অপেক্ষা করে ছিলাম।আপনি আসবেন।ছাড়িয়ে নিবেন আমায়।”বলে আবারো দুমরে মুচরে উঠলো আরক্তিম মুখটা।চোখের পানির বাঁধটা ভেঙে গেলো।গড়গড় করে গড়িয়ে পরতে থাকলো তিহানের বুক ভিজিয়ে।
তিহান বুঝলো,জানলো।তোহার সাথে অতিমাত্রায় খারাপ কিছু হয়নি।তবে যেটুকু হয়েছে সেটুকুই বা কম কি?
এই অতিশয় পবিত্র মেয়েটার মনে গভীর কালো দাগ বসিয়ে দেয়ার জন্য এটুকুই খুব যথেষ্ট।আসলেইতো,সে কেনো এলোনা?তার তো দায়িত্ব ছিলো মেয়েটাকে আগলে রাখার।কেনো পারলোনা?পরিপূর্ণতা পাওয়ার শেষ সময়েই কেনো ব্যর্থ হতে হলো তাকে?
“আচ্ছা,আমি কি কলঙ্কিত হয়ে গেছি?”বলেই নির্বোধ শিশুর মতো তিহানের মুখপানে চাইলো তোহা।
তিহানের কঠিন পুরুষচোখেও জলের আনাগোনা।তার একফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়লো।তোহার কপালের উপর।চোখের কার্নিশ বেয়ে তা নিচে পরে গেলো নিমিষেই।তিহান সামলালো।তোহার গালে হাত রেখে গাঢ় কন্ঠে বললো,
—“তুমি সবচেয়ে পবিত্র,কলঙ্ক তোমাকে ছুঁয়ে দিতে অপারগ।”
চোখ নামালো তোহা।নিরবে একফোঁটা জল বিসর্জন দিলো।এই লোকটা তাকে পবিত্র মনে করলেও অন্যরাতো তাকে কলঙ্কিতোই মনে করছে।তাদের চোখেতো সে নিকৃষ্ট,অপবিত্র।এই যন্ত্রনা থেকে সে কি করে মুক্তি পাবে?
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটলো।তোহা বললো,

—“একটা কথা বলি?”
—“বলো।”
—“আপনি আমাকে বিয়ে করেননা।লোকে খারাপ বলবে।”
মূহুর্তেই কানে ঝাঁ ঝাঁ লেগে গেলো তিহানের।ক্রোধানলে হৃদয় পুড়ে ছারখার।তার ভালবাসাটাকে এতোই সস্তা ভাবে মেয়েটা।এর ভিত্তি কি এতটাই নড়বড়ে?এত অকপটে,নির্দ্বিধায় এই কথাটা বলে ফেললো মেয়েটা?এত সহজে?হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করলো তিহান।ক্রোধে শক্ত হয়ে এলো মুখের চোয়াল।কন্ঠে কাঠিন্য নিয়ে সে কোনরকমে উচ্চারণ করলো,”কি বললে তুমি?”
তোহা তাকালো।এক মূহুর্তের জন্য।পরক্ষণেই তিহানের অগ্নিদৃষ্টির সামনে মাথা ঝুঁকে গেলো।দিরুক্তি করলোনা।
তিহান গরম শ্বাস ছাড়লো।পিঠের পিছে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে তোহাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,”চোখটা বন্ধ করে রাখো।ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
তোহা চোখ বন্ধ করলো।কিন্তু ঘুম আসলোনা।সেই ভয়ংকর মূহুর্তটা মনে পরে গেলো।চকিতে চোখ মেললো। বুকের ধুকপুকানি আবার বাড়ছে।অস্থির লাগছে।হুট করে তিহানের বুক থেকে সরে গেলো সে।তিহান চোখ বুজে ছিলো।তোহার সরে যাওয়ায় চট করে তাকালো।আধশোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়ে..”পুরো কথা শেষ হলোনা।তার আগেই তোহা হামলে পড়লো।দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ খুঁজে পাগলের তো কাঁদতে কাঁদতে তুলনাহীন বিষাদ নিয়ে বললো,”আপনি ছোঁয়ায় আগে আমাকে ওই লোকটা ছুঁয়ে দিলো কেনো?”

বেকায়দায় পরে গেলো তিহান।তোহা কস্মিককালেও তার এত কাছাকাছি আসেনি।না এসেছে সে নিজে থেকে।
আমতা আমতা করলো তিহান।তোহার প্রশ্নের উওরটা তার কাছে নেই।মেয়েটাকে শান্ত করার উপায় কি তবে?মস্তিষ্ক শূন্য।সব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে এখন সে নিজেই বেসামাল হয়ে পরেছে।
তোহা কাঁদছে।হাউমাউ করে।সব কষ্ট যেন ধুয়ে যাচ্ছে সেই পানির সাথে।হৃদয়বিদারক যন্ত্রনা গুলো কান্নারূপে ঝরে পরছে বৃষ্টির মতো।তিহানে কাঁধ ভিজে চুপচুপে।তোহার গায়ের ভারি শাড়ির যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে আছে।
তিহান দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে আলতো করে হাত রাখলো তোহার বাহুতে।খানিকক্ষণ ইততস্ত করে বললো,
—“তুমি..”
তোহা বাক্য সমাপ্ত করতে দিলোনা।তার আগেই অনুনয়ের স্বরে বললো,
—“আমাকে সরতে বলবেন না।আমি সরবোনা।এভাবেই থাকবো।”
উওরে কিছু বললোনা তিহান।নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে মৌনমুখে ঠায় বসে রইলো।
তোহার কান্না থামছে।সে হাল্কা হচ্ছে আস্তে আস্তে।চোখ বন্ধ।ক্লান্ত শরীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে।
দরজায় শব্দ।ঠক ঠক ঠক।সাথে আমজাদ সাহেবের ডাক,”তিহান,একটু কথা ছিলো।আসবো?”
তোহা ঘুমিয়ে পরেছে কাঁধে মাথা রেখে।তিহান আলতো করে ধরে সরালো তাকে।বালিশে শুইয়ে দিয়ে শাড়ির আচঁল গুছিয়ে দুরত্ব নিয়ে সোজা হয়ে বসলো।নম্র স্বরে উওর দিলো,”আসো বাবা।”
আমজাদ সাহেব প্রবেশ করলেন।তোহাকে শান্তিতে ঘুমোতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন।ধীরগতিতে বিছানার অপরপাশে বসে ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি টেনে বললেন,”ঘুমিয়েছে তাহলে?”

—“মাত্রই শুয়েছে।”কন্ঠে জোর নেই তিহানের।
আমজাদ সাহেব সময় নষ্ট করলেন না।সোজাসাপটা ভাবে বললেন,
—“অনন্তকে কি করবে?অবস্থা ভালোনা।ওর বাবা মা কে ফোন করা হয়েছে।তোমার খালু দুশ্চিন্তা করছে।মেহমানরা এখনো যায়নি বাসা থেকে।বাজে বকছে।বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?”
—“পারছি।”
আমজাদ সাহেব অপেক্ষা করলেন।ছেলে নিশ্চয়ই কিছু বলবে।তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
তিহান ভাবলো কিছুক্ষন।কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে তোহার মুখের দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বললো,
—“সবাই যা ভাবছে তেমন কিছু হয়নি বাবা।অনন্ত চেষ্টা করেছে তবে সময় ছিলোনা।স্বর্না তার আগেই এসে পরেছিলো।তিহুকে দেখে যা মনে হয়েছে তা আসলে ঘটেনি।সবাই ভুল ভাবছে।”
আমজাদ সাহেব মৃদু হাসলেন।ঘুমন্ত তোহার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে তিহানের দিকে চেয়ে বললেন,”তোমার অতিযত্নে আগলে রাখা মানুষটাকে লোকে বাজে বলছে।তাদের ভুল ধারণা কাটানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমারই।”

আমজাদ সাহেব কথাটা শেষ করতেই নড়ে উঠলো তোহা।ঘুমের মাঝেই তিহানের দিকে কাত হয়ে শুয়ে একহাত হাঁতরে তিহানের হাত খুঁজলো।তিহান দুরত্ব নিয়ে বসেছে বিধায় নাগাল পেলোনা।তিহান হাসলো, নিজেই হাত এগিয়ে তোহার হাতের উপর রাখলো।তোহা অবিলম্বে তা আকড়ে ধরে গালের নিচে নিয়ে আবারো ঘুমে তলিয়ে গেলো।তিহানকে বিচলিত দেখালোনা।বাবার দিকে চেয়ে সে নরম তবে একরোখা কন্ঠে বললো,”ওকে ছাড়া আমার কোনোভাবেই সম্ভব না বাবা।”
অনন্ত বসে আছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে।চেহারার অবস্থা ঢুলুঢুলু।রক্তপাত হচ্ছে এখনো।তূর্য এসে আরো কয়েক ঘা লাগিয়েছে তাকে।আরমান সাহেব,আতিয়াসহ সবাই আছে ড্রইংরুমে।তবে অনন্তকে কেউ ধরছেনা পর্যন্ত।
আতিয়া তোহার কাছে যেতে চাইলেও আরমান সাহেব যেতে দেয়নি।তোহার কাঁটা ক্ষত দেখলে কান্নাকাটি করবে আতিয়া তা দেখে আরো ভেঙে পরবে বাচ্চাটা।তিহান যেহেতু নিয়ে গেছে তারমানে নিরাপদেই আছে তাদের মেয়ে।একটু একান্তে থাকুন দুজন।মেয়েটার মন হাল্কা হবে।তিহানের চোখে যে প্রগাঢ়তা সে আজ দেখেছে তাতে আর কোনকিছু ভাবার অবকাশ নেই।তিহান বলেছিলো কাজি আসলে যেনো তাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি বিয়ে পড়ানো আদৌ সম্ভব?
বিকেল চারটা…

অনন্তর মা-বাবা এসেছে।বসেছে বসার ঘরে।এই বিকেলে বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।তা আর হলোনা।একটা আকস্মিক ঝড় সব ওলোট পালট করে দিলো।তিহান থমথমে চেহারায় বসে আছে।রক্তলাল চোখজোড়া অনন্তর দিকে নিবদ্ধ।অনন্তর মা কান্নাকাটি করছেন।ছেলের হয়ে ক্ষমা চাচ্ছেন বারবার।
সেই আঁকুতি কারোর মনই গলাতে পারেনি।এমনকি সোহার্দ্যও বসে আছে চোখেমুখে কাঠিন্য নিয়ে।মায়ের কান্নাটাও তার কাছে তেঁতো ঠেকছে।কিভাবে পারছে মা সব জেনেও এই ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে?
—“আপনারা যা দেখেছেন তা আসলে ঘটেনি।অনন্ত একটা নিকৃষ্ট কাজ করতে যেয়েও করতে পারেনি।আপনারা যা ধারণা করছেন তা ভুল।সে তিহু..মানে তোহাকে কলঙ্কিত করে ফেলেছে,তোহার ক্ষতি করে ফেলেছে এ ধরণের যা কিছু বলেছে সবই মিথ্যা।এমন কিছুই হয়নি।”রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো তিহান।
তৃতীয় তলার একজন প্রতিবেশি মহিলা তেঁতে উঠলো।গা জ্বালানো কন্ঠে ফোঁড়ন কাটলো,”আমরা সবাই স্পষ্ট দেখেছি মেয়েটার অবস্থা।দেখেই তো বোঝা যায় সব শেষ করে তবেই ছেড়েছে।তুমি বললেই হবে নাকি?”

তিহান আটকে রাখলো নিজেকে।শান্ত শীতল গা হিম করা চাহনী নি:ক্ষেপ করে উঠে দাড়ালো।অনন্তর সামনে যেয়ে একহাঁটু মুড়ে বললো,”তুই কি সত্যিটা বলবি?”অনন্ত তাকালো।নিভু নিভু দৃষ্টি।ভাবলো,তার এই বোকামিটা করা উচিত হয়নি।মেয়েটার ক্ষতি যতটুকু পেরেছিলো করেছিলো তারপর উচিত ছিলো লুকিয়ে বের হয়ে যাওয়া।এভাবে সবার সামনে ধরা দেয়াটা এখন মনে হচ্ছে একদম ঠি ক হয়নি।তিহানের চেহারা,আগুন ধরানো দৃষ্টিতে ভয়ের দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে সে।এই লোক যে এত ভয়ঙ্কর সে ভাবেনি।এর আগের বার তো কিছু করেনি।তাই ভেবেছিলো এবারো বৌয়ের শোকে কাতর হয়ে যাবে।
সে উওর দিলোনা।সে যে তোহাকে ছোঁয়া ছাড়া কিছু করতে পারেনি কথাটা স্বীকার করলেতো তার সব কষ্ট পানিতে যাবে।এত মার খেলো।এত অপমান।নাহ্,কিছুতেই স্বীকার করা যাবেনা।
তিহানের মুখের অবস্থা ভয়ংকর।আচমকা দুহাতে অনন্তর দুহাতের কব্জি ধরে মুঁচরে ধরলো সে।আর্তনাদ করে উঠলো অনন্ত।তিহান আরো একটু ঘুরিয়ে মুচরে ধরলো হাতজোড়া।রুগ্ন উত্তেজিত হয়ে বললো,”বল।”

হাল ছেড়ে দিলো অনন্ত।এ ব্যাথা সহ্য করার নয়।মনে হচ্ছে হাড্ডি ভেঙে যাচ্ছে।কোনরকমে বললো সে,”আমি স্বীকার করছি।তোহাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি।মিথ্যা বলেছি তখন।চুল,লিপস্টিক আমি ইচ্ছে করেই লেপ্টে দিয়েছিলাম।আমাকে..”আরো কিছু বলার আগেই একটা হৃদয় কাঁপানো বিভৎস্য জিনিস ঘটে গেলো।অনন্তর দুহাত মচকিয়ে কনুই থেকে ভেঙে ফেলেছে তিহান।গগনবিদারী চিৎকার করলো অনন্ত।কানে তালা লেগে গেলো সবার।তিহানের রাগের বহি:প্রকাশ দেখে থমকে গেলো পরিবেশ।
অনন্তর মা কাঁদছে।মরা কান্না।তিহান উঠে দাড়ালো।আরমান সাহেবের দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,”ওসব পুলিশে আমি বিশ্বাস করিনা খালু।এদের যে টাকা।দু দিনেই বেরিয়ে যাবে।যে হাত দিয়ে ও তিহুর সর্বত্র ধরেছিলো।সেই হাতটা আমার পক্ষে অক্ষত রাখা সম্ভব হলোনা।”
আরমান সাহেব হতভম্ব।মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে প্রতিটি সদস্য।কেউ কেউ ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।অনন্ত অজ্ঞান।তিহান ডাইনিং টেবিল থেকে পানি নিলো।অনন্তের মুখে ছিঁটা দিতে দিতে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আপনাদের মধ্য কেউ আর কখনো তোহাকে খারাপ কিছু বলার আগে দু’বার ভাববেন।ও শুধু বাজে পরিস্থিতির শিকার।আর কিছুইনা।”

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৯+৪০

আসরের আযান দিয়ে দিয়েছে।বাইরে ঝড় নামছে।গুমোট কালো মেঘের আঁধারে ছেঁয়ে গেছে শহর।তোহা ঘুমোচ্ছে তখনো।নিশ্চিন্তে,নিরবে।মাথার কাছে বসে আছে আতিয়া।তাকে ডেকে এনে তোহার কাছে বসিয়ে রেখে তিহান গেছে ওই ফ্ল্যাটে।অনন্তর মা-বাবা এসেছে।কিছু একটা হয়তো হচ্ছে সেখানে।
তার মেয়েটার মুখটা পানসে,ফ্যাকাশে।দু গালে শুকিয়ে হাল্কা দাগে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কান্নার সরল রেখা গুলো।আতিয়ার চোখ দিয়ে টুপ করে একটা পানির ফোঁটা পরলো।মেয়েকে খুব করে বধুবেশে দেখার শখ হয়েছিলো তার,এভাবে বিধস্ত অবস্থায় নয়।ধুমধাম শব্দ।সাথে অনেকগুলো পদচারণ।আতিয়া চকিতে সোজা হয়ে বসলো।বিকট শব্দে ঘরের দরজা খুলে যেতেই ঘুম ভাঙলো তোহার।অনন্ত সামনের ফ্লোরে ছিঁটকে পরেছে।পিছে তিহান,তূর্য,বাবা,খালুরা।
আলুথালু অগোছালো আবেশেই ধরফরিয়ে উঠে বসলো তোহা।মুখ চুপসে গেছে।অনন্তকে দেখে ভয়ে কাঁপছে হাত-পা।খুব দ্রুত ঘেমে যাচ্ছে শরীর।পাশে তাকিয়ে একবার মাকে দেখলো তোহা।ভরসা পেলো।আঁকড়ে ধরলো মায়ের হাত।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো।কেনো যেন মনে হচ্ছে অনন্ত আবারো হামলে পরবে, আবারো তাকে ছুঁয়ে দিবে সেই নোংরা হাতে।কেউ বাঁচাতে পারবেনা।সে আবারো বাজে স্পর্শের দংশনে দংশিত হয়ে যাবে।

তিহান কাছে আসলো।তোহার পাশে বসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে ধীর গলায় বললো,”এখনতো আমি আছি।ভয় নেই।চোখ খুলো।”
তোহা চোখ খুললো।অনন্তর দিকে না তাকিয়েই ভয়ার্ত গলায় থেমে থেমে বললো,”উনাকে নিয়ে যান প্লিজ।উনি আবারো..আমি..নিয়ে যাননা।আমার ভয় করছে।”
তিহান শক্ত করে ধরলো তাকে।ভয় এখন না কাটলে মেয়েটা সারাজীবন এটা বয়ে বেড়াবে।যা সে হতে দিবেনা।তোহার উৎকন্ঠা,ভয়ার্ত চেহারা দেখে ভিজে উঠলো উপস্থিত সবার চোখ।তিহান গলার স্বর তীব্র করলো।বললো,
—“তুমি তাকাবে নাকি না?”
তোহা তাকালো এবার।একেবারে অনন্তর দিকে।তার রক্তাত্ব চেহারা,বিভৎস্য ভাবে ঝুলে থাকা হাত দেখে মূহুর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো তার।তিহান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে তৃপ্তিভরা কন্ঠে বললো,
—“এই হাত দিয়ে ও আর কখনো বাজে ছোঁয়া দিতে পারবেনা।”
তোহা চিৎকার দিলো।হাঁসফাঁস করলো।অনন্তর হাতটা কেমন দুলছে।অনন্ত ক্ষমা চাচ্ছে।জড়ানো কন্ঠে বলছে,”ক্ষমা চাচ্ছি,আমাকে ছেড়ে দেন।”
যদিও মনে মনে একটা প্রচন্ড রকমের শান্তি হচ্ছে তবুও এই বিভৎস্য হাতের দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলোনা তোহা।জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো তিহানের বুকের উপর।

এক রক্তিম শ্রাবণে শেষ পর্ব