এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৭+৩৮

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৭+৩৮
লেখিকা মালিহা খান

শরতের কাশফুল মলিন হয়ে পরতেই হেমন্তের আবির্ভাব শুরু হয়।শিশিরভেজা গাছের পাতা,আবছা কুয়াশায় ঢেকে থাকা ধোঁয়াটে সকাল,মেঘমুক্ত রাতের আকাশ,মৃদু মৃদু শীতল হাওয়া সব মিলিয়ে শীতের পূর্বাভাস হিসেবে হেমন্তের আগমন ঘটে।
তোহার পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে আজ।কলেজে যেতে হবে বেলা বারোটার দিকে।এখন বাজে এগারোটা পন্চাশ।ড্রইংরুমের সোফায় কলেজ ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে বসে আছে সে।মাঝে সিঁথি করে দু’পাশে দুই বেণি।সামনের কাঁটা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।চোখেমুখে বিরক্তি ভর করছে ক্রমান্বয়ে।তিহানের তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সে এখনো আসছেনা।ঘড়ির কাঁটা ঘুরে আরো তিন চারমিনিট গড়িয়ে যেতেই চরম অস্থিরতা নিয়ে সোফা ছাড়লো তোহা।নিজের রুমে যেয়ে ফোন হাতে নেয়ার আগেই আতিয়া জোর গলায় ডেকে উঠলো,

—“তোহা,তিহান ফোন করেছিলো।তোকে নিচে নামতে বলেছে।ও অপেক্ষা করছে।”
ফোনটা আর হাতে নেয়া হলোনা তোহার।সাত পাঁচ না ভেবে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুতপায়ে নিচে নামতে লাগলো সে।আজকে ব্যাগের ঝামেলা নেই।শুধু রেজাল্ট শিটটা নিয়ে আসবে যেয়ে।
তিহান বসে আছে ড্রাইভিং সিটে।চোখের মনি লাল হয়ে আছে।রাতে ঘুম হয়নি।চুল উস্কখুষ্ক।অফিসের একটা ঝামেলা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সে।তার আন্ডারে যেহেতু অনেকেই কাজ করে তাই সব দায়ভার তারই।নি:শ্বাস ফেলার সময় টুকুও পাচ্ছেনা।খালি এই মিটিং ওই আলোচনার মধ্যই আছে।
তোহাকে কলেজে নেয়ার জন্য এখনো একটা মিটিং পোস্টপন্ড করে এসেছে।আর এই মেয়ের নামার নামই নেই।কতক্ষণ যাবত ফোন দিচ্ছে ফোনও ধরছে না।
তোহাকে বকা দেয়ার পরিকল্পনা করে থাকলেও তোহা যখন লম্বা বেণি দুলিয়ে পাশের সিটে বসে মিষ্টি কন্ঠে বললো,”আপনি ব্যস্ত ছিলেন?দেরি করলেন কেনো?”তখন আর তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার অবকাশ রইলোনা তিহানের।এতক্ষনের চাপা রাগটা শুন্যে নেমে গেলো মুহূর্তেই।
চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো সে।ঠোঁট কোণ টা একটু প্রসারিত করে তোহার সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে এসি ছেড়ে দিলো।অত:পর গাড়ি স্টার্ট দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার।একহাতে ড্রাইভ করতে করতেই ফোন রিসিভ করে ঘাড় কাত করে ধরেই সে ব্যস্তভাবে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“হ্যাঁ,আমি আসছি।বেশিক্ষণ লাগবেনা।..না না মিটিং ক্যান্সেল করা লাগবেনা।আমার জাস্ট বিশ পঁচিশ মিনিট লাগবে।আই’ল বি ব্যাক।”বলে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে গাড়ির সামনের জায়গাটায় রাখলো সে।চুলগুলোতে দুবার হাত চালিয়ে বললো,”তোর কতক্ষণ লাগবে কলেজে?”
তোহা এতক্ষণ সবই শুনছিলো।তিহানের ব্যস্ততা যে খুবই বেশি সেটাও বুঝতে পেরেছে সে।
—“শুধু রেজাল্ট শিটটা নিয়েই চলে আসবো।..আপনার দেরি হয়ে গেলে সমস্যা নেই আমি রিকশা করেই ফিরতে পারবো।”
তিহান উওর দিলোনা।গাড়ির স্পিড বারিয়ে তুলনামূলক জলদি ড্রাইভ করতে লাগলো।মেয়েটার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।হয়তো রেজাল্টের ভয়ে।যদিও মুখে কিছু বলছেনা তবুও সে বুঝতে পারছে।রেজাল্ট যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায় তবে আর নিজেকে সামলাতে পারবেনা তোহা।দেখা যাবে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।সেজন্যই ড্রাইভার আঙ্কেলকে না পাঠিয়ে সে নিজেই এসেছে।

গাড়ি থামে কলেজের সামনে।তিহান নেমে তোহার পাশের দরজা খুলে দেয়।তাকে নামিয়ে ঘড়ি দেখে বলে ,”যা আমি অপেক্ষা করছি।ভয়ের কিছু নেই।”তোহা মলিনভাবে হাসলো।বললো,”আপনি থাকতে ভয় কিসের?”বলে আর অপেক্ষা করলোনা সে।গেট পেরিয়ে স্টুডেন্টদের ভিড়ের মাঝে আড়াল হয়ে গেলো।
পুরো ক্লাসের মধ্য অষ্টম পজিশনে আছে তোহা।রেজাল্টটা তাকে হাতে দিয়েই হাসলো শিরিন ম্যাম।তোহাও উওরে মুচকি হাসলো।ভেতরের খুশিটা ভেতরেই চেপে রেখে ম্যামকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই উনি বলে উঠলেন,
—“সে কি,তুমি এখনই চলে যাবে?প্রিন্সিপাল স্যার এসেতো টপ টেনের ছাত্রীদেরই দেখতে চাইবেন।তোমাকে তো থাকতে হবে।”
—“ম্যাম,আমার একটু সমস্যা আছে।যেতেই হবে।প্লিজ।”করুণ স্বরে অনুনয় করে বললো তোহা।শিরিন ম্যাম একটু ধাতস্থ হলেন।মেয়েটার কিসের এতো তাঁড়া?উপরন্ত তোহার করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলেন না।নরম কন্ঠে বললেন,
—“আচ্ছা ঠি কাছে।যাও।”

তিহান ফোনে কথা বলছিলো।তোহাকে বেরোতে দেখে দ্রুত কথা শেষ করে ফোনটা কাটলো সে।তোহার চেহারা এতোটাও থমথমে না।তার মানে রেজাল্ট ভালোই হয়েছে।তোহা কাছে এসে দাড়ালো।তিহান হাত বারাতেই রেজাল্ট শিটটা তার হাতে ধরিয়ে দিলোতিহান একবার চোখ বুলালো।মেরিট নাম্বারটা দেখে নিয়ে মুচকি হেসে
তোহার মাথার দুবার হাত বুলিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,”বস,আমার সাথে যেতে হবে একটু।এখন আবার গাড়ি ঘুরালে দেরি হয়ে যাবে অনেক।”
তোহা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো।তিহান আবারো ব্যস্তহাতে স্টার্ট দিলো গাড়ি।উদ্দেশ্য অফিস যাওয়া।
পনেরো মিনিট যেতে না যেতেই গাড়ি পৌছালো অফিসের সামনে।তোহাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে তিহান ছুটলো উপরে।বিরস মুখে চেয়ে রইলো তোহা।লোকটার এত ব্যস্ততা কেনো?সব ঝামেলা আজকের দিনেই হতে হলো?তার রেজাল্টের দিনে?
সেইবার মাধ্যমিকের সময় সে যখন এ প্লাস পেলো সেইদিন তাকে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিলো তিহান।সেই থেকে আজপর্যন্ত যত পরীক্ষা হয়েছে কখনো তোহার হাত খালি ছিলোনা।ওই বিশেষ মানুষের দেয়া বিশেষ ঘড়িটা সবসময় তার হাতে ছিলো।কলম পেন্সিল নিতে ভুলে গেলেও ওই ঘড়ি পরতে ভুল হতোনা তার।

তিহান ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক পরই।তোহা তখন গাড়িতে একচোট ঘুমিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
তবে তার আগেই তিহান সেখানে উপস্থিত হয়।তোহাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দরজা লক করতে করতে বলে,”আমার দেরি হবে।এতক্ষণ গাড়িতে বসতে পারবিনা।কষ্ট হবে তোর।উপরে চল।”বলে তোহার হাত ধরে উপরে উঠলো তিহান।কলেজড্রেস পরা তোহাকে দেখে অনেকে বাঁকা চোখে তাকালেও তিহানকে তার পাশে দেখে কিছু বলার সাহস পেলোনা কেউই।
তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে বড় সোফাটায় বসালো তিহান।নিজের ফোনটা বের করে হাতে ধরিয়ে বললো,”আমি পাশের মিটিং রুমেই আছি।ভয় পাস না।আর কেউ আসবেনা এখানে।নিশ্চিন্তে থাক।”বলে আর দেরি করলোনা তিহান।বেরিয়ে যেতে যেতে গেটের পাশে দাড়ানো মেয়েটাকে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,”আমার কেবিনে যেনো কেউ না ঢুকে।জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি মানা করেছি।মেয়েটা”আচ্ছা স্যার”বলে মাথা নাড়ায়।এই তলার ত্বত্তাবধানে সে আছে।তিহানের কেবিনে কে ঢুকবে না ঢুকবে বা কখন কোন ফাইল দিতে হবে সব সে-ই দেখে।

মিটিং শেষ হতেই হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢোকে তিহান।তোহা তখন কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে।একপাশের বেণি সোফা ছাড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।একটা হাত বেরিয়ে আছে সোফার বাইরে।সেই হাতে ফোন ধরা।ইউটিউবের ভিডিও চলছে স্বশব্দে।প্রায় দেড় দু ঘন্টা যাবত মেয়েটাকে একা রেখে মিটিংয়েও ভালোমতো মনোযোগ দিতে পারছিলোনা তিহান।তবুও এখন বেশ দায়মুক্ত লাগছে।এই একটা মিটিংয়েই যে একয়দিনের গোটা সমস্যার পাট চুকে যাবে একেবারেই ভাবেনি সে।এই মেয়েটা তার জন্য শুভ্রতা নিয়ে আসে সবসময়।সে পাশে থাকলেই সবকিছু শুভ্রতার আস্বাদনে ঢেঁকে যায়।
তিহান নি:শব্দে পা ফেলে এগিয়ে যায়।হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভিডিও অফ করে দেয়।কেবিনের একপাশের কাঁচের গ্লাস ভেদ করে দুপুরের রোদরশ্নি তেরছাভাবে তোহার চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে।মনে হচ্ছে সূর্য নিজে তাকে আদুরে চুম্বন করে যাচ্ছে চোখেমুখে।সূর্যের রাগী তেজও এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের কাছে হার মেনে নিজেকে মোলায়েম করে দিয়েছে।সুর্যটাও বোধহয় তার রাজকন্যাটাকে নিজের রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানাতে ইচ্ছুক।তিহান কপাল কুঁচকে তাকাল।কাঁচের সামনের মোটা পর্দাটা টেনে দিতেই সূর্যের আলো আর প্রবেশ করতে পারলোনা।
এবার যেনো তৃপ্তির হাসি হাসলো তিহান।পরক্ষনেই হাসি থামিয়ে তোহার মাথার কাছে বসে মাথাটা সযত্নে নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে অসন্তুষ্টি নিয়ে বললো,

—“—“এই চরিত্রহীন সূর্যের সাহস কি করে হয় তোমার গাল ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার?তুমিতো শুধু আমার।আমার প্রেমিকাকে ছোঁয়ায় আগে ও আমার অনুমতি নিলোনা কোন স্পর্ধায়!”
এয়ার কন্ডিশনারের হিমহিমে শীতল বাতাস ছড়িয়ে আছে আনাচে কানাচে।রুমজুড়ে কৃত্রিম সুগন্ধির মনমাতানো সুঘ্রাণ।তোহার ছোট্ট নাকের ডগায় একটু একটু লালাভ আভা।বোধহয় অতিরিক্ত ঠান্ডার প্রভাবে।গোলাপী ঠোঁটজোড়া গ্রীষ্মের মরুর মতো রুক্ষ।দু ঠোঁটের মাঝখানে কিন্চিৎ ফাঁক।মাথাটা সযত্নে পরে রয়েছে তিহানের কোলের উপর।
তিহান তাকিয়ে আছে।সম্মোহনী অবিচল দৃষ্টি।নিদ্রাপরীর ঘুমন্ত মুখশ্রীর বর্ননাতীত সৌন্দর্য্য গলে গলে পরছে তার সমস্ত কোলজুড়ে।মেয়েটাকে মানাচ্ছে এখানটায়।খুব বেশিই মানাচ্ছে।মনে হচ্ছে,এই কোলটাই তার নিত্য প্রয়োজনীয় ঘুমানোর বালিশ।
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভেজালো তিহান।বৃদ্ধাঙ্গুল তোহার ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিলো নরমভাবে।তারপর এদিক ওদিক তাকালো।পাশের ছোট্ট ফুলদানি রাখা টেবিলটায় একটা পানির গ্লাস রাখা।লম্বা হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে হাতের তর্জনীর এক ইন্চি পরিমাণ অংশ ডুবিয়ে দিলো।একফোঁটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিলো তোহার শুষ্ক ঠোঁট।গোলাপী ঠোঁটের রংটা যেন আরো একটু গাঢ় হয়ে উঠলো।সেদিকটায় তাকিয়ে ঢোঁক গিললো তিহান।নিজের পায়ে নিজে কুঁড়াল মারাটা কি তার উচিত হলো?
ধূসর মনির দৃষ্টি সরে গেলো তৎক্ষণাৎ।তোহা নড়ছে।হাতের আঙ্গুল কাঁপছে পুন:পুন:।মিনিট না পেরোতেই সে চোখ মেললো।নিভু নিভু পাপড়ি।বারবার বুজে আসছে।পা দুটো প্রলম্বিত করে চোখ কুঁচকে শরীরে টানা দিলো তোহা।ঘুমন্ত ভাবটা একটু কমতেই সে ঘুরে গেলো।দুহাত তিহানের পেট জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললো,

—“পানি খাবো।”
পানির গ্লাস তিহানের হাতেই ছিলো।সে বললো,
—“উঠতে হবেতো।”
মুখটা পেটের আরো একটু গভীরে গুঁজে দিলো তোহা।হাতের বাঁধনটা আরো একটু দৃঢ় করে ঘুমের শ্লেষ মাখানো কন্ঠে বললো,
—“না উঠে খাওয়া যায় না?”
—“গলায় ঠেকবে যে।”কন্ঠে আদুরে ধ্বনির রেশ টেনে বললো তিহান।তোহা অনাগ্রহ দেখালো।মুখ গুঁজে পরে রইলো নির্বিকার চিত্তে।তার নিরুদ্দেশ অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে,”পিপাসায় কাতর হয়ে থাকাও যেন প্রেমিকের কোল ত্যাগের চেয়ে অতি উত্তম।”
খানিকক্ষণ পর কোলে মাথা রেখেই সোজা হলো তোহা।তিহান আগে থেকেই মাখা ঝুঁকিয়ে তার দিকে চেয়ে ছিলো ফলস্বরূপ চারচোখ মিলে গেলো মূহুর্তেই।ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো তিহান।তোহাকে টেনে তুলে পানির গ্লাস চেপে ধরলো ঠোঁটে।ঢকঢক করে গিললো তোহা।দ্রুত খাওয়ার ফলে কয়েকফোঁটা পানি সরলপথে গড়িয়ে গেলো তার চিবুক ধরে।আরো গভীরে যাওয়ার আগেই তিহান ব্যস্ত ভঙ্গিতে তা মুছে দিতে হাত বাড়ালো।ঠান্ডা হাতের কনকনে হৃদয়কাঁনপানো স্পর্শ গলার কাছটায় পেতেই চমকে উঠলো তোহা।তার গলাটা আবার শুকনো শুকনো লাগছে কেনো?এতক্ষন যে পানিগুলো পান করলো তা কি পাকস্থলীর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ধুলিস্সাৎ হয়ে গেলো?তিহান হাত সরানোর পূর্বেই সে তিহানের চোখে চোখ রেখে বললো,
—“আপনি আমার পিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছেন।আরো পানি লাগবে বোধহয়।”
কথাটা তিহানের বোধগম্য হলোনা হলো আবার হলোনা।বাম ভ্রু উঁচালো সে।তীর্যক কন্ঠে বললো,
—“কোন পিপাসা?”
তোহা আলতো করে মাথা ঠেকালো তিহানের বাহুতে।চোখ বুজে অকপটে উওর দিলো,
—“প্রেমপিপাসা।”
—“পানিতে মিটবে?”
—“জানিনা।”তোহার কন্ঠে মেদুর ছাঁয়া।
তিহান হাসলো।উঠে যেয়ে জগ থেকে আরো একগ্লাস পানি এনে তোহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
—“তোমার প্রেমিক সীমা অতিক্রম করতে অক্ষম।আর ক’টা দিন নাহয় পানিতেই পিপাসা মিটুক।”

নীলরঙা আকাশে সাদা তুলির এলোপাথারি আঁচর।মেঘগুলো আজ বড্ড আকৃতিহীন।সাদা নীলে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে হেমন্তের গগন।মিঠা আলোয় আলোকিত বিকেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।তিহান বসে আছে চেয়ারে।তার সামনে ল্যাপটপ।তোহা পর্দা সরিয়ে দিয়েছে।দুহাত কাঁচের উপর রেখে একাধারে চেয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে।সূর্যের আলো পরছে না এদিকটায়।পরলে হয়তো তিহান আর তাকে দাড়িয়ে থাকতে দিতো না।
গেটে ঠকঠক শব্দ।তিহান সময় না নিয়ে উওর দিলো,
—“কাম ইন।”
তোহা ফিরে তাকালো।একজন যুবক ঢুকেছে দরজা খুলে।হাতের ফাইল আর পোশাক আশাক দেখে বোঝাই যাচ্ছে লোকটা অফিসেরই কেউ।দরজা ভিজিয়ে তোহার দিকে একপলক চোখ পরতেই মাথা নামালো সে।
মৃদু কন্ঠে বললো,
—“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”
তোহা অপ্রস্তুত হলো।তার থেকে বয়সে এত বড় লোকটা তাকে “ম্যাম” বলে সম্মোধন করছে আবার মাথা নিচু করে সালাম দিচ্ছে ব্যাপারটা একেবারেই দৃষ্টিকটু দেখালো।তবুও নিজেকে সামলে সালামের উওর দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো সে।
তিহান আড়চোখে তোহাকে দেখে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,
—“দাও নিরব।আমি দেখে দিচ্ছি।”
নিরব মুচকি হেসে ফাইলটা তিহানের হাতে দিয়ে নতমুখে চেয়ে রইলো মেঝের দিকে।পাশে দাড়ানো মেয়েটাই যে তার স্যারের হবু বউ সে জানে।
তিহান মনোযোগ দিয়ে পাতা উল্টালো।দেখা শেষে অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে কলমদানি থেকে একটা কলম তুলে কোথাও একটা সাইন করে দিয়ে ঘড়িতে সময়টা পরখ করে বললো,”তুমি তো আজকে হাফ ডে ছুটি নিয়েছে।সময় তো হয়ে গিয়েছে।এখনই বেরোবে?”

—“জি স্যার।”
—“তোমার স্ত্রী আর মানহা কেমন আছে?”
—“ভালো আছে স্যার।”লাজুক হেসে উওর দিলো নিরব।তিহানও হাসলো।তোহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“ও হচ্ছে নিরব।তোমাকে একবার বলেছিলাম না আমার এক কলিগের বাচ্চা হয়েছে।মনে আছে?”
তোহা যেন একটু লজ্জা পেলো।সেবার তিহানকে হেসে হেসে ফোনে কথা বলতে দেখে কি একটা কান্ডই না করেছিলো সে।মনে পরতেই সে যথাসম্ভব নিচু গলায় বললো,”মনে আছে।”
—“ম্যাম কে নিয়ে একদিন বাসায় আসবেন স্যার।একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন না?তারপর থেকে পুষ্পিতা প্রায়ই বলে আপনার কথা।”
তিহান মাথা নাড়িয়ে হা হুতাশ করে বললো,
—“আসবো নিরব।অবশ্যই আসব।ব্যস্ততাটাই তো কাটছে না।”
নিরব বেরিয়ে যেতেই গটগট করে এগিয়ে আসলো তোহা।তিহানের হাতের কব্জি টেনে ঘড়ি দেখে চোখ কপালে তুলে বললো,কত বেজে গেছে..আপনি আম্মুকে ফোন করেছিলেন?”
—“করেছিলাম।বলেছি তুই আমার সাথে আছিস।অফিস শেষ হলে একসাথে ফিরবো।”
—“রেজাল্টের কথা বলেছেন?”
—“বলেছি।”
—“খুশি হয়েছে আম্মু?”
—“হয়েছে।”
—“আপনি খুশি হননি?”মুখ ফসকে কথাটা বলে দিলো তোহা।বলে নিজেই কেমন যেনো বুঁদ হয়ে রইলো।
তিহান প্রত্যুওর করলোনা।ল্যাপটপের কি-বোর্ডে হাত চালাতে চালাতে ফোন কানে তুলে নিলো।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৫+৩৬

কমলা রঙা মেঘের আড়ালে দীপ্তিমান গোধুলীবেলা।সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের কোল ঘেঁষে।মনোহরী দৃশ্য।কাঁচের দেয়ালের এপাশ থেকে মুগ্ধনয়নে তা উপভোগ করছে তোহা।সে যখন প্রায় একটা ঘোরের মধ্য আবিষ্ট হয়ে গেছে তখনই পেছন থেকে কাঁচের উপর একটা সচ্ছ ছায়া ঘিরে ফেললো তার ছোট্ট দেহটাকে।তোহার ঘোর ভাঙলো,ধ্যান কাটলো।পেছন ফিরতেই শক্ত বুকটার সাথে ধাক্কা লাগলো।তড়িঘড়ি করে একটু পিছাতেই কাঁচের দেয়ালে পিঠ ঠেকলো।
সোনালি রুপালি আলোর মিশেল রংটা তিহানের মুখের উপর।চোখের ভাষাটা একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে।
ঠোঁটে হয়তো একটু হাসি আছে তবে বোঝা মুশকিল।দু’তিনদিনের শেভ না করা খোঁচা খোঁচা চাপচাড়ি।
গায়ের কফি কালারের শার্টের উপরের একটা বোতাম খোলা।
তোহা আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
—“কি হয়েছে?”

তোহার বেণির বেশিরভাগ চুল জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।ঠোঁটটা এখন আবারো শুকনো।মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে।লজ্জা পেলে ওর চোখের পাপড়ি কাঁপে।চোখের নিচে কোলজুড়ে সেই কম্পমান পাপড়ির ঘনছায়া পরে।কি অপূর্বই না দেখায়!
তিহান ঝুঁকে গেলো।তোহার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মুঁচরে গেলো তোহা।তিহানের শরীরের উষ্মতা এই শীতল রুমটাকেও তপ্ত বানিয়ে ফেলছে।ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দগুলো নৈ:শব্দের মতো কানে বাজছে।
মধ্যকার দূরত্বটা আরো একটু ঘুঁচলো।তিহান তোহার গলার দুইপাশ দিয়ে হাত গলিয়ে একটা গাঢ় নীল পাথরের লকেট সমেত চেনের হুক লাগাতে লাগাতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,”তোমার উপহার।”

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৯+৪০