এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৯+৪০

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৯+৪০
লেখিকা মালিহা খান

সূর্য ডুবে গেছে প্রায় অনেকক্ষণ।চারিপাশে এখন আলোকশূন্য সন্ধ্যার বিষন্ন বাতাসের আনাগোনা।তবে সেই বাতাসের ছোঁয়া তোহার মন অবধি পৌছাতে পারেনি।কিশোরী মনটায় আজ খুশিখুশি আমেজ।গাড়ির মিরর গ্লাসে ফুটে ওঠা প্রতিচ্ছবিটার মধ্যে আটকে রয়েছে মুগ্ধ আঁখিযুগল।তিহানের পরিয়ে দেয়া গলার ছোট্ট লকেটটা গভীর নীলাভ রংয়ের।যে কারো দৃষ্টি আকর্ষন করতে পুরোপুরি সক্ষম।পাথরের আকৃতিটা একফোঁটা গড়িয়ে পরা পানির মতো।আধো তম্রসায় বুকের উপর এক টুকরো সমুদ্রের মতো জ্বলজ্বল করছে পাথরটা।তোহাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মুখ খুললো তিহান।বললো,

—“পছন্দ হয়েছে?”
তোহা দিরুক্তি করলোনা।আড়চোখে তাকিয়ে লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো।হাসলো তিহানও।খানিকবাদে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে আফসোস করে বললো,
—“এই জিনিসটা দেয়া উচিত হয়নি বুঝলে?”
তোহা ভ্রুকুটি করলো।কপালে ভাঁজ ফেলে অনুসন্ধিৎসু কন্ঠে বললো,
—“কেনো?”
তিহান এবার বাঁকা হাসলো।চট করে ঘাড় ফিরিয়ে লকেটটার উপর চোখ বুলিয়ে জ্বালাময়ী কন্ঠে বললো,
—“বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তুমি আমাকে নির্লজ্জ বলবে।”
কিছুক্ষণ বোকা বোকা চাহনী দিয়ে অত:পর কথাটা বুঝে যেতেই বিশ্রিভাবে মুখ কুঁচকে ফেললো তোহা।নড়েচড়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অষ্পষ্ট স্বরে বললো,”ছিহ্!”
বাসায় ফিরতেই আতিয়ার মুখোমুখি হয়েছে তারা।গেট খুলে তিহান আর তোহাকে দেখে সহাস্য মুখে “ভেতরে আয়”বললেও পরমূহুর্তেই চোখের কোঁণায় সুক্ষ ভাঁজ পরলো তার।দৃষ্টি তোহার লকেটটায়।হাত বাড়িয়ে তা দেখে নিলেন তিনি।অত:পর তিহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ভারি সুন্দর তো।এবারো জেদ করেছিলো নাকি?”
আতিয়ার কৌতুকপূর্ণ স্বর আর বলার ঢং দেখেই রসিকতাটা বুঝতে পারলো তিহান।আগে তোহাকে শাড়ি চুড়ি কিনে দিলে সবসময় সে বলতো”তিহু জেদ করে কিনেছে।”তার বলা কথাটা দিয়ে তাকেই জব্দ করার চেষ্টা করছে খালামনি।তিহান মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে সহজ গলায় বললো,
—“এবার আর জেদ করার সুযোগ দেইনি খালামনি।জেদ করার আগেই কিনে দিয়েছি।”
তোহা বিস্ফোরিত নয়নে তিহানের মুখপানে চেয়ে থাকলো।এই লোকের মুখে কিচ্ছু আটকায়না।নিজের খালামনির সামনেও একরত্তি লজ্জা নেই।হাহ্!

হুড়মুড় করে পার হয়ে গেছে আরো কয়েকটা মাস।ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ চলছে।তোহার টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে পাঁচদিন আগে।কলেজজীবনের সমাপ্তি হয়ে গেছে প্রায়।এখন শুধু বাসায় পড়াশোনা করবে আর তারপর তিনমাস পর উচ্চমাধ্যমিক।শীতকালের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে।আজকাল ভোরবেলায় কুয়াশায় আচ্ছাদনে ছেঁয়ে থাকে শহর।দিনের বেলায় সূর্যের রাজত্ব কম।স্তূপীকৃত মেঘের বেড়াজালে দিনের আলো তার ডালপালা ছড়িয়ে দিতে পারেনা।রাত্রিপ্রহরে মোটা শীতের কাপড় না পরলে কাঁপুনি ধরে যায়।
গুমোট বিকেলবেলায় গোসলে ঢুকেছে তোহা।সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি।দুপুর পর্যন্ত কম্বল গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছে।তাও ঘুমটা পুরোপুরি হয়নি।আরো কিছুক্ষন ঘুমোতে পারলে ষোলোকলা পূর্ণ হতো কিন্তু তার আগেই ফ্যানের আকস্মিক নষ্ট হয়ে যাওয়ার তা আর পূর্ণতা পায়নি।শীতকাল হলেও ফ্যান আর কম্বল ছাড়া ঘুম হয়না তোহার।
দুপুর থেকেই মেজাজ খারাপ থাকায় ভেবেছিলো আজ গোসলটা বাদ দিবে কিন্তু বিকেল হতেই নোংরা নোংরা বোধ করায় তা আর করতে পারেনি।
কলিংবেলের শব্দের তুমুল উপদ্রবে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো তূর্য।তোহা গোসলে যাওয়ার আগে তাকে বলে গিয়েছে কেউ বাসায় আসলে যেনো গেট খুলে দেয়।আতিয়া দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে আর আরমান সাহেব বাসায় নেই।তাই তূর্যকেই যেতে হবে।
দরজার বাইরে একটা অচেনা ছোকরা টাইপের ছেলের সাথে তিহানকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তূর্য।তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিহান বললো,

—“তিহুর ঘরের ফ্যান নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে?খালামনি মিস্ত্রি ডাকতে বলেছিলো।”
তূর্য ভদ্রতার সহিত সরে দাড়ালো।আজকে সকাল থেকে রুম থেকে বের হওয়া হয়নি।সে জানতোনা তোহার ফ্যান নষ্ট হয়েছে।জানলে আর তিহানকে কষ্ট করতে হতোনা সে নিজেই মিস্ত্রি নিয়ে আসতো।
তোহার রুমের সামনে যেয়ে একটু দাঁড়ালো তিহান।নক করার জন্য হাত বাড়াতেই তূর্য মুচকি হেসে বললো,
—“তোহা গোসলে গেছে।ভেতরে যান,সমস্যা নেই।”
আস্তে করে দরজা খুললো তিহান।রুমে কেউ নেই ব্যাপারটা শতভাগ নিশ্চিত হতেই তূর্য আর ছেলেটাকে ঢোকার জায়গা দিলো।বাথরুম থেকে পানি ঢালার শব্দ আসছে অনবরত।এই বিকেল বেলায় মেয়েটার কিসের গোসল?সর্দিজ্বর বাঁধাবে পরে।
বিছানার উপর একটা টুল বসিয়ে তার উপর উঠে ফ্যানে যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে ছেলেটা।তূর্য এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে নিচে রাখা যন্ত্রপাতির ব্যাগটার থেকে।তিহান দাড়িয়ে আছে বাথরুমের দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।তার কঠোর দৃষ্টি ছেলেটার দিকে।কিভাবে কি করছে তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে।
বাথরুমের ভেতরের পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো তার।ছিটকিনি খুলে দরজাটা ফাঁক হতেই সচকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো তিহান।কয়েকসেকেন্ড তোহার সদ্য স্নানকরা পবিত্র মুখখানা আর স্নিগ্ধ ভেজা চুলগুলো দেখে নিয়ে দরজার হাতল আঁকড়ে ধরে গলা নামিয়ে অবরুদ্ধ কন্ঠে বললো,
—“এখন না,একটু পরে বের হ।”
তোহা হতবিহ্বল কন্ঠে আশ্চর্য হয়ে বললো,
—“পরে মানে?আমি কি বাথরুমে দাড়িয়ে থাকবো?বের হতে দিন।”
চোয়াল শক্ত করে চোখ রাঙানো তিহান।বললো,
—“মানা করেছিনা?”

নিভে গেলো তোহা।বাধ্য মেয়ের মতো দরজাটা আবারো আটকে দিয়ে থম ধরে দাড়িয়ে রইলো বাথরুমের ভিতর।ঘরে মিস্ত্রি এসেছে তা সে বুঝতে পেরেছে।ওয়াশরুমের ভিতর থেকেও সবই শোনা যায়।কিন্তু তাই বলে তাকে বেরোতে দিবে না তিহান?অদ্ভুত!প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর ঘরের ভেতরের পুরুষালি কন্ঠস্বরগুলো থেমে গেলো।দরজায় কান পেতে সে বুঝলো মিস্ত্রি চলে গিয়েছে।কিছু বলার আগেই তিহান দরজায় নক করে বললো,
—“এখন বের হ।”
তোহা বের হলো।পরণে লালরঙা কামিজ।গায়ে ওড়না নেই।জামার লাল ওড়নাটা বালিশের পাশে রাখা।খুব সম্ভবত ভেতরে নিতে যেতে ভুলে গিয়েছিলো।চুলগুলো এখনো ভেজা।গলা ভেজা।পানিগুলো মুক্তোদানার মতো আকর্ষন করছে।তিহান বিছানায় বসেছে।চোখমুখ স্হির।”
—“আপনি কি পাগল নাকি?”বিরক্তির সুরে কথাটা বলে বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়ালো তোহা।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে তিহানের দিকে এগিয়ে আসতেই তিহান তাকে হাত টেনে পাশে বসিয়ে চুলে ডানহাতের পাঁচআঙ্গুল ডুবিয়ে দিয়ে বললো,
—“”তোমার ভেজা চুলে অন্য কারো নজর পরবে তা তো আমি কি করে হতে দেই?।”
—“ছেলেটা ফ্যান ঠি ক করতে এসেছিলো।আমার ভেজা চুল দেখতে নয়।”তেঁতো কন্ঠে বললো তোহা।
—“তা ঠি ক,কিন্তু তুমি ওর সামনে বের হলে ওর নজর তো তোমার উপর পরতোই।তাইনা?”বলতে বলতেই তিহানের চোখ গেলো তোহার গলার দিকে।তার দেয়া লকেটটা না দেখতে পেয়ে মূহুর্তেই দৃষ্টি সরু হয়ে এলো।শক্ত কন্ঠে সে বললো,
—“তোমার লকেট কোথায়?”
তিহানের হঠাৎ রাশভারি কন্ঠে চমকে উঠলো তোহা।চোখ নামিয়ে আমতা আমতা করে ড্রেসিং টেবিলের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,
—“ওইযে…,খুলে রেখেছিলাম।সাবান পানিতে যদি নষ্ট হয়ে যায়।”
তিহান সাথেসাথেই চুল থেকে হাত সরালো।আদেশসূচক কন্ঠে বললো,

—“নিয়ে আসো।”
তোহা চুপসে গেলো পুরোদমে।তিহান যে রেগে আছে বুঝতে বাকি নেই।ধীরপায়ে উঠে গেলো সে।লকেটটা এনে তিহানের হাতে না দিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
—“আমি পরে নিচ্ছি।ভাইয়া এসে পরলে কি ভাববে..”
কথাটা শেষ করার আগেই হাত থেকে লকেটটা নিয়ে একটানে তোহাকে বিছানায় বসালো তিহান।ভেজা চুলগুলো একপাশে এনে লকেটটা পরানোর জন্য কাছে ঝুঁকে গেলো।হুক না দেখে তো আর আটকাতে পারবেনা।মূহুর্তেই জমে গেলো তোহা।তিহানের গাল তার কানের পাতা স্পর্শ করছে।নি:শ্বাসগুলো ছড়িয়ে পরছে ঘাড়ের কাছটায়।তোহা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই তিহান তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রবল অধিকার নিয়ে বলে উঠলো,
—“আজ পরিয়ে দিচ্ছি।আর কখনো যেন খুলতে না দেখি।”
গোটা রাজধানী কুয়াশায় লেপ্টে আছে।ধোঁয়াটে সাদা পদার্থগুলো যেনো পুরো শহরটাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে শীতের ঠান্ডা আলিঙ্গনে।পাখিদেরও ঘুম ভাঙেনি।তন্দ্রাচ্ছন ঢাকাশহর।
ফোনের রিংটোনে গভীর আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তোহার।গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।গায়ের উপরের ভারি কম্বলটা সরিয়ে ওপাশ হতে শরীর সাঁয় দিচ্ছে না।ফোনের রিংটোন বেজেই চলেছে।অবিশ্রান্ত,বিরামহীন।তোহা ঘুরে সোজা হলো।দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শরীরের জড়তা কাটানোর নিষ্ফল চেষ্টা করলো।পিটপিট করে আধবোজা চোখে ফোনটা কানে তুললো।ওপাশ থেকে তিহানের ভারভার কন্ঠস্বরের ডাক ভেসে আসছে,
—“তিহু?”
তোহা ঘুমের ঘোরেই হাল্কা গোঙ্গালো।ঝাপসা স্বরে স্বাড়া দিলো,
—“হু।”

কিছুক্ষণ মৌনমুখে চোখ বোজে তোহার ঘুমন্ত কন্ঠটা অনুভব করার চেষ্টা করলো তিহান।এইতো আর মাত্র কয়েকটা মাস পরই সে রোজ সকালে এই কন্ঠটা শুনবে।এই কন্ঠের আদুরে বুলিতে তার ঘুম কাটবে।অতি সাদরে অপেক্ষা করা কিছু মূহুর্তে জর্জরিত হবে তার এতদিনের ধৈর্যশীল প্রেমিক মন।চোখ মেললো তিহান।নমনীয় কন্ঠে আবদার করে বললো,
—“একটু বাইরে আসবে?আমি অপেক্ষা করছি।”
তোহা উঠে বসলো।লোকটার কোনো কথা,আবদার অমান্য করার স্বাধ্যি নেই তার।আজপর্যন্ত কখনো তিহানের মুখের উপরে কোনো কথা বলেনি।
অগত্যা চোখ কঁচলে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করলো সে।দ্রুত বিছানা থেকে নেমে গায়ের শাল জড়িয়ে নিয়ে নিভু নিভু স্বরে উওর দিলো,
—“একটু দাড়ান,আসছি।”
এসময় নিরবতাটা বেশি থাকে।নি:শ্বাস প্রশ্বাসগুলোও যেনো উচ্চরব সৃষ্টি করে ফেলে।রুমের দরজাটা আস্তে করে খুললো তোহা।নি:শব্দে লক করে ঘুরে দাড়াতেই হৃদপিন্ডটা দড়াস করে লাফিয়ে উঠলো।
ঠি ক তার পেছনেই তূর্য দাড়িয়ে আছে।চোখমুখ ঢুলুঢুলু।তোহা বিব্রত,কিৎকর্তব্যবিমূঢ়।
লজ্জিত ভঙ্গিতে কিছু বলার আগেই তূর্য তাড়া দিয়ে বললে,
—“জলদি আয়,দরজা আটকে দিয়ে আমি ঘুমাবো বোন।”
তোহা বিস্মিত,বাক্যহীন।পরিস্থিতিটার আগামাথা তার মাথায় ঢুকছে না।তূর্য কিভাবে জানলো সে বাইরে যাবে?তিহান বলেছে নিশ্চয়ই।ভাইয়ের সামনে কি একটা লজ্জা।ও আল্লাহ!

কথা না বলে চুপচাপ দরজার কাছে গেলো তারা।বেরোতেই দেখলো তিহান দাড়িয়ে আছে।তোহা গুটিগুটি পায়ে চুপটি করে দাড়ালো।কলাপাতা রংয়ের একটা সাদামাটা থ্রিসিপের উপর কালো শাল জড়ানো।মাথায় জর্জেটের ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা।ঘুমের রেশ এখনো লেগে আছে চোখের কোলজুড়ে।তূর্য কন্ঠে হাসিমাখা তবে তীব্র দৃঢ়ভাব নিয়ে বললো,
—“আমার বোনকে নিয়ে যাচ্ছেন তিহান ভাই।সময়মতো আবার ফেরত দিয়ে যেয়েন কিন্তু।”
চাঁপা হেসে এলোমেলো চুলগুলোতে হাত চালানো তিহান।ফিচেল গলায় বললো,
—“একসময় তো একেবারেই নিয়ে যাবো,তখন কি করবি?”
হেসে ফেললো তূর্য।দরজা আটকে দিতেই তোহা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো,
—“আপনি এটা কি করলেন?”
—“কি করেছি?”
—“ভাইয়া কি ভাবছে!আমিতো আসছিলামই..আপনি ভাইয়াকে কেনো ডাকলেন?”
তিহান এগিয়ে গেলো।তোহার বামহাতটা নিজের হাতের মাঝে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিয়ে বললো,
—“তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরবো।সময় লাগবে।এভাবে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রেখে গেলে বিপদ হতে পারে।আর তূর্য কিছু ভাবেনি।আমার প্রেমিকা ওরফে হবু বউকে আমি নিয়ে যাচ্ছি কে কি ভাববে তা ভেবে আমার কি?”
—“আপনি পাগল।সত্যিই পাগল।”
তিহান হাসলো কেবল।তোহাকে কাছে টেনে সিঁড়ি ধরে নামতে নামতেই তোহা জিজ্ঞেস করলো,
—“এসময় কোথায় নিয়ে যাবেন?”
—“জানিনা।অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবো।তোমাকে অনুভব করবো।ব্যস এতটুকুই।”
—“হাঁটবেন?”
তিহান ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—“নাহ্,এবার রিকশা ঠি ক করে রেখেছি ।তোমার তো পা ব্যাথা হয়ে যায়।”

রিকশা চলছে ধীরগতিতে।কুয়াশায় আচ্ছাদন কাটিয়ে এগোনো মুশকিল।তবুও রিকশা ওয়ালা মামাটা পাক্কা চালক হওয়ায় বিশেষ ঝামেলা হচ্ছেনা।আশেপাশের কোনো দোকান এখন অবধি খুলেনি।ফোন বা ঘড়ি নেই সাথে বিধায় সময়টাও বোঝা যাচ্ছেনা।ছয়টা বোধহয় বাজেনি এখনো।
শীতে কুঁকড়ে তিহানের সাথে ঘেঁষে বসেছে তোহা।তিহানের পরণে পাতলা টি-শার্ট আর ট্রাউজার।চোখমুখ একেবারে স্বাভাবিক।নির্বিকার চিত্তে তোহার একহাত টেনে সেই হাতের দিকে তাকিয়ে তা নেড়েচেড়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে।যেন শীত তাকে ছুঁয়ে দিতে অক্ষম।তোহা চোখমুখ কুঁচকালো।বললো,
—“আপনি এটা কি গায়ে দিয়ে এসেছেন?শীত করছেনা?”
—“করছেনা তো।”
—“কেনো করবেনা?”
তিহান ঘাড় ফিরালো।তোহার মুখের দিকে কিছুক্ষন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে আবিষ্ট স্বরে বললো,
—“আমার উত্তাপ টা যে আমার সাথেই আছে।শীত আমায় ছুঁবে কি করে?”

শীতকালে রান্নাঘরে খুব আরাম বোধ হয়।আগুনের তাপে গরম গরম লাগে।সেই গরম গরম ভাবটা অনুভব করতেই রান্নাঘরে পদচারণ করলো তোহা।আতিয়া বিকেল থেকেই কিছু একটা করছে।সে এতক্ষণ ঘরে পড়ছিলো তাই জানেনা।
তোহা কাছাকাছি যেয়ে দাড়ালো।নাকে চিরপরিচিত কিছু একটার মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসতেই উৎসুক কন্ঠে বললো,
—“কি করছো আম্মু?”
আতিয়া মুচকি হাসলো।বললো,
—“খুন্তি টা দে তো।পাটিসাপটা করছি।”
চওড়া হাসলো তোহা।খুন্তিটা এগিয়ে দিয়ে আতিয়ার পাশে দাড়াতেই আতিয়া দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বললো,
—“তোর ও বানানো শিখা উচিত।তিহানটা খুব পছন্দ করে এসব।”
—“তো?”
—“বিয়ের পর করে খাওয়াবি।”
তোহা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।এই লোকটার লাগামহীন কথাবার্তার ছোঁয়া তার পুরো পরিবারে লেগে গেছে।
সবাই যেন তাকে লজ্জায় ফেলার ঘোর ষড়যন্ত্রে নেমেছে গাঁট বেঁধে।সে কি করবে?কোথায় মুখ লুকাবে?তিহানের বুকে?
ভাবনার সুঁতো ছিঁড়লো।আতিয়া তিনটে গরম পিঠা বাটিতে তুলে তোহার হাতে ধরিয়ে বললো,”ছেলেটাকে দিয়ে আয়।”

তিহানের রুমে ঢুকতেই একটা লোমশ তুলতুলে কিছু পা ছুঁয়ে যেতেই তুমুল গতিতে লাফিয়ে উঠে তোহা।চোখমুখ খিঁচে গগনবিদারী চিৎকার করতেই কেউ একজন পাশ থেকে তাকে বুকে টেনে নেয়।স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্তভরা কন্ঠে বলে,
—“বিড়াল ওটা,ভয় পায়না।”
তোহা স্হির হয়।ভয়টা হয়তো কমেছে কিছুটা।তিহান তাকে ছেড়ে দাড়ায় ।তোহা জোরে শ্বাস নেয়।বুকে থুতু দিয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ভীত কন্ঠে বলে,
—“কোথায় বিড়াল?”
তিহান আচমকাই হাসে।মেয়েটা এতো বেশি ভয় পায়।
তোহার হাত থেকে কাঁচের বাটিটা খুব সন্তর্পনে নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে।হাতের উচিয়ে ইশারা করে বলে,
—“ওইতো বিছানায় বসেছে।”
কালো সাদা রংয়ের একটা মাঝারি আকারের বিড়াল।সবুজ চোখ।বিছানার মাঝে বসে গা চাটছে।তোহা চিনে বিড়ালটাকে।সেই যে একবার তিহান পথ থেকে বাঁচিয়েছিলো এই বিড়ালটা।এরপর থেকে তাদের বাসার নিচতলার গ্যারেজেই থাকতো।দারোয়ান চাচা খেয়াল রাখতো।তিহান বোধহয় খাবার দাবারের টাকা দিয়ে আসতো।সে জানেনা ঠি ক।তখন অবশ্য বিড়ালটা ছোট ছিলো অনেক।এখন বড় হয়েছে।
তোহা সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৭+৩৮

—“আপনি ওকে ঘরে এনেছেন কেনো?”
—“শীত পরেছে তো।গ্যারেজে অনেক ঠান্ডা থাকে।ওর থাকতে কষ্ট হয়।তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।আমার সাথে ঘরে থাকুক।”বলতে বলতে বিছানায় যেয়ে বসলো তিহান।তোহাও গেলো কাছাকাছি।বিড়ালটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বিছানায় বসলো।বললো,
—“আপনাকে কামড়ে দিলে?”
—“অলরেডি খামছে দিয়েছে।রাতে সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।পিঠটা আঁচরে কিছু রাখেনি।”
—“আল্লাহ!দেখি।”আৎকে উঠলো তোহা।
তিহান হাসলো।একটানে গায়ের টি-শার্ট খুলে নিয়ে পিঠ দেখিয়ে বললো,
—“তোমার কাজটা তোমার আগে বিড়ালটা করে দিলো।দুষ্টু বিড়াল।”
রসিকতাটা গায়ে মাখলোনা তোহা।ব্যাথাতুর নয়নে চেয়ে থেকে তৎক্ষনাত উঠে গেলো।সেন্টার টেবিলের নিচের অংশ থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা বের করে মলম হাতে এগিয়ে আসলো।তারপর অবিলম্বে লাল হওয়া অংশগুলায় মলম লাগাতে লাগাতে কান্নামাখা কন্ঠে বললো,
—“বেশি জ্বলছে?”
তিহান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে বললো,
—“জলছেইনা।”
—“একদম মিথ্যা বলবেন না।আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে।অসহ্যকর।আপনি এমন কেনো?”
তিহান এবারো হাসলো।মেয়েটা একসময় সবসময় তাকে এভাবে শাসন করবে।তার পাশাপাশি থাকবে,কাছাকাছি থাকবে।অদ্ভুততো,তার হঠাৎ এতো লজ্জা লাগছে কেনো?

দিন গড়িয়ে গেছে।বছর ঘুরেছে।গত মে মাসে শেষ হয়েছে তোহার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।ব্যস্ততারা ছুটি নিয়েছে।তোহার এখন অফুরন্ত সময়।মনে মনে চলছে বিয়ের মৌসুম।এ মাসের শেষেই খুব সম্ভবত তাদের কাবিন হয়ে যাবে।
ঋতুর পালাবদল ঘটেছে।শীত থেকে গ্রীষ্ম,গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা।অত:পর প্রকৃতি সিক্ত করতে আবারো এসেছে শ্রাবণ মাস।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৪১+৪২