এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৫+৩৬

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৫+৩৬
লেখিকা মালিহা খান

“শরৎকাল”মানেই শুভ্রপ্রহরের বুকে লেপ্টে থাকা রুপময়ী প্রকৃতিকন্যা।নীলসাদা পরিবেশজুড়ে শুভ্রমিতার আদুরে হাতছানি।তার ডাকে যে সাড়া দিবে সেই সাদা কাশফুলের শুভ্রমায়ার জড়িয়ে যাবে আষ্টেপিষ্টে।
তোহারা ঢাকা ফিরে এসেছে দুদিন হয়েছে।গত শনিবারই তাদের ফেরার কথা ছিলো কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় এংগেজমেন্ট হওয়ার দরুন আর ফেরা হয়নি।তবে পরদিন দুপুরের দিকেই ফেরার পথে রওনা দিয়ে দিয়েছিলো তারা।তূর্যর ভার্সিটি আছে তাছাড়া তিহানের অফিসেও ছুটি নেই সেজন্যই তাড়াহুড়ো করে ফেরা।
ঢাকায় এসে আবার সেই ধরাবাঁধা গতানুগতিক রুটিনে আবদ্ধ হয়ে গেছে তোহা।নিয়মিত কলেজ যাওয়া,পড়াশোনার ব্যস্ততা।উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এগিয়ে আসছে।কলেজ থেকেও আবার পরীক্ষা শুরু হবে কয়েকদিন পর।

বিকেল থেকেই প্র্যাক্টিক্যাল লিখতে বসেছিলো তোহা।সেই লিখা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।এক ধাঁচে লিখতে লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।বুড়ো আঙ্গুলের চামড়া ডেবে লাল হয়ে আছে।খাতাপত্র গুছিয়ে বিছানায় সটান হয়ে সুয়ে পরলো তোহা।হাতে ফোন নিয়ে ডাটা অন করতেই টুংটাং শব্দে বিরক্তি এসে গেলো নিমিষেই।স্বর্ণালি কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে মেসেন্জারে।সাথে একদুটো মেসেজ।ভ্রু কুঁচকালো তোহা।
নিতান্তই কৌতূহলবশত নোটিফিকেশন বার থেকে ক্লিক করতেই বিস্ময়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো।দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
সেইদিন আংটি পরানোর মূহুর্তের কিছু ছবি।এগুলো কখন তোলা হয়ে ছিলো তোহা খেয়ালই করেনি।
একটার পর একটা ছবি সরাতে সরাতে হঠাৎই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো।দু”আঙ্গুলে একটু জুম করলো ছবিটা।তোহা মাথা নিচু করে আংটি পরাচ্ছে তিহানকে।আর তিহান মুখে হাসি নিয়ে চেয়ে রয়েছে তার মুখের দিকে।যদিও ছবিটা সামনে থেকে তোলার কারণে তোহার মুখ দেখা যাচ্ছেনা।শুধু ঘোমটার আড়াল থেকে কিছু চুল সামনে এসে পরেছে।সেদিকেই মনোমুগ্ধকর দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে স্বমহিমায় কি যেন দেখছে তিহান।
তোহা একা একাই হাসলো।ছবিটা সেভ করে নিয়ে স্বর্ণালির মেসেজ গুলায় চোখ বুলাল।স্বর্ণালী লিখেছে,”তোকে ছবিগুলো পাঠাতে বলেছিলেন তিহান ভাই।”,”উনাকে বলে দিস তুই পেয়েছিস ছবিগুলো..শুধু শুধু বকা খেয়েছি তোর জন্য।”
মুখ চেপে হাসলো তোহা।লিখলো,”আচ্ছা আপু বলে দিবো।”
শরতের স্নিগ্ধ শীতল রিমঝিম বৃষ্টি নেমেছে ঘন্টাখানেক আগে।বারান্দার বামসাইডের রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে সদ্য বৃষ্টির পানিতে ধুঁয়ে যাওয়া পিচঢালা কালো রাস্তার দিকে নির্বিকার চাহনী নিয়ে দাড়িয়ে আছে তোহা।লম্বা চুলে অগোছালো বেণি করা।গায়ের ওড়না বাতাসে উড়ছে।বৃষ্টির ছাঁট এসে পরছে চোখেমুখে।ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে।গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে।তোহা মাঝেমধ্য হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিচ্ছে ঠান্ডা জলকণা গুলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কোন কারণ ছাড়াই এখানে দাড়িয়ে থাকলেও তার অবচেতন মন অবশ্য রাস্তাভরে একটা মানুষকেই খুঁজে যাচ্ছে অনবরত।ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলো তোহা।তিহানের আসার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই।তবুও লোকটা ফিরছেনা কেনো?হঠাৎই মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করলো।এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে লোকটার আবার কোনো বিপদ হলোনাতো?পরক্ষনেই আবারো ভাবলো নাহ্,তিহান তো গাড়ি করেই আসবে।বৃষ্টি হওয়ার বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা না।
তবুও মাথা থেকে চিন্তাটা না যাওয়ায় খানিকবাদেই রুম থেকে ফোনটা এনে তিহানের নাম্বারে ডায়াল করলো সে। প্রথমবার রিং হতেই কল কেটে গেলো।হাসলো তোহা।সে জানে তিহান এখন নিজেই কল করবে।এমনটাই হয় সবসময়।সে ফোন দিলে তিহান কেটে নিজে ফোন দেয়।যেন তোহার ফোনের টাকা শেষ না হয়।
ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো।মুচকি হেসে রিসিভ করলো তোহা।ওপাশ থেকে তিহান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
—“হ্যাঁ বল,কি হয়েছে?”
—“আপনি এখনো ফিরছেন না যে?”
তিহান বোধহয় একটু হাসলো।তোহা ঠি ক বুঝতে পারলোনা।ঠোঁট উল্টিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলো,”হ্যালো?শুনছেন?”
এবার কন্ঠ শোনা গেলো তিহানের।গলা ঝেড়ে যথাসম্ভব পরিষ্কার স্বরে সে বললো,
—“এসেই পরেছি।”
—“আপনার গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
—“কেমন শোনাচ্ছে?”দুষ্টুমি মাখিয়ে বললো তিহান।
তোহা আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ।বললো,
—“না কিছুনা,রাখছি।”
তোহা কান থেকে ফোন নামিয়ে কাটতে গেলেই তিহান গলা বাড়িয়ে ডেকে উঠলো,”শোন”।ফোনটা কান থেকে দুরে থাকা সত্ত্বেও ডাকটা শুনতেই থেমে গেলো তোহা।আবারো কানে নিয়ে নিচু গলায় জবাব দিল,”বলেন।”
একটুখানি নিরব অনুভূতির আদান-প্রদান চললো।ফোনের ওপাশ থেকেও বৃষ্টির অবিশ্রাম শব্দ,যানবাহনের ক্রিন ক্রিন হর্ণ সবমিলিয়ে শহরের ব্যস্ততার সচ্ছ আভাস।নিরবতা কাটিয়ে তিহান নরম কন্ঠে বললো,
—“কিছু খাবা?নিয়ে আসবো?”
ফোনের এপাশেই খিঁচে চোখ বুজে ফেললো তোহা।একটা গা কাঁপানো শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাড়া বেয়ে।শরীরের লোমগুলো বোধহয় দাড়িয়ে গেছে।লোকটার এই কন্ঠটায় কি যেনো আছে।আর এই “তুমি” ডাকটায় তো কখনো পুরনো ভাবটা আসেনা।যখনই ডাকে মনে হয় প্রথমবার ডাকছে।

—“হ্যালো?”
তিহানের ডাকে ঘোর ভাঙে তোহার।একটু ঢোঁক গিলে গলা ভিজিয়ে চাপা স্বরে সে উওর দেয়,
—“কিছু লাগবেনা।আপনি আসেন।বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে।”বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো তোহা।ফোনটা হাতে মুঠোয় সজোরে চেপে ধরে রাস্তার দেখায় মনোযোগ স্হাপন করলো।
পনেরো মিনিট যেতে না যেতেই একটা রিকশা থামলো মেইন গেটের সামনে।দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসলো তোহার।রিকশা থেকে কাকভেজা হয়ে নেমেছে তিহান।গায়ের গাঢ় সবুজ শার্ট আর কালো প্যান্ট ভিজে চুপচুপে।চুল ভিজে কপালে পড়ে আছে।তিহান নেমেই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো।মানিব্যাগে পলিথিন পেঁচানো।দ্রুত ভাঁড়াটা মিটিয়ে গেট পেরিয়ে ঢুকলো তিহান।
তাকে দেখে দাড়োয়ান চাচা আগেই ভেতরের দরজাটা খুলে দিয়েছে।কয়েকসেকেন্ড দারোয়ানের সাথে কথা বলে দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো তিহানকে।এরমধ্যই একবার চোখাচোখি হয়েছে তাদের।
তোহাও আর দাড়ালোনা।ফটাফট পা চালিয়ে গেট খুলে বেরিয়ে এলো।
তাকে হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলো আতিয়া।তোহার পাশে দাড়িয়ে বললো,
—“কি হলো এভাবে বেরিয়ে আসলি কেনো?”
তিহান তখন মাত্র সিঁড়ির বেয়ে উপরে এসে দাড়িয়েছে।আতিয়ার প্রশ্নে তোহা তার দিকে চেয়ে রাগান্বিত কন্ঠে উওর দিলো,
—“উনি কিভাবে ভিজে এসেছে দেখেছো আম্মু?
আতিয়া তাকালো।তিহানকে চোখে পরতেই আৎকে উঠে বললো,
—“এমা!এই রাতের বেলা এভাবে ভিজেছিস কেনো বাবা?ঠান্ডা লেগে যাবেতো।গাড়ি নিয়ে যাসনি?”
তোহার হাতে অফিসের ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো তিহান।ভেজা চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলতে খুলতে বললো,

—“মা-বাবা বাসায় নেই খালামনি।গাড়ি নিয়ে বাবার কোন এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলো।ওদিকের রাস্তাঘাট ভালোনা।বৃষ্টিতে পানি জমে যাচ্ছেতাই অবস্থা।ফোন করেছিলো,কাল সকালে পানি নামার আগে ফেরা সম্ভব না।”বলে তালা খুলে চাবিটা পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে তোহার থেকে ব্যাগ নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো তিহান।তোহা ব্যাগ দিলোনা।
আতিয়া দ্বিগুন চিন্তিত কন্ঠে বললো,
—“সেকি!তুই তাহলে কিভাবে কি করবি?আপা তো মনে হয় কিছু করে রেখে যায়নি।ভিজেও গিয়েছিস।”
—“ফ্রিজে খাবার আছে খালামনি।সমস্যা হবেনা।”মুচকি হেসে উওর দিলো তিহান।
—“তোহা,তুই যাতো ছেলেটাকে গরম পানি করে দে।এই বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।সেবারও তো গা কাপিয়ে জ্বর এসেছিলো।”কন্ঠে ভয় নিয়ে বললো আতিয়া।
তোহা সাঁয় দিয়ে মাথা নাড়ালো।বিনাবাক্য তিহানের কাছাকাছি যেয়ে দাড়াতেই দূর্বোধ্য হাসলো তিহান।আতিয়া উদ্দেশ্য করে বললো,”একটুপরেই ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি খালামনি।”আতিয়া চলে গেলো।সে চলে যেতেই ফুঁসে উঠলো তোহা।তিহান তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে জুতা খুলতেই নিলেই তোহা তেজী গলায় বললো,
—“আপনাকে তো দেখলাম রিকশায় আসতে।ভিজলেন কি করে?”

আড়চোখে তাকালো তিহান।উওর না দিয়ে ধীরেসুস্থে জুতো আর মোজা খুলে গেটের পাশে রাখলো।কাঁদাপানি লেগে আছে সেগুলোতো।
তিহান বেসিনে হাত ধুয়ে নিলো।তোহার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে রুমের দিকে পা বাড়ালো।দাঁতে দাত চেপে সেদিকে তাকালো তোহা।মূহুর্তেই একটা দীর্ঘ:শ্বাস ছেড়ে রান্নাঘরে যেয়ে চুলোয় গরম পানি চড়ালো।তিহান শাওয়ার নিবে এখনই।আগুনের আঁচ বাড়িয়ে দিলো সে।মাঝেই তিহান গলা উচিয়ে হাঁক ছাড়লো।দেরি করলোনা তোহা।দ্রুতপায়ে হেঁটে তিহানের রুমে ঢুকতেই একটু চুপসে গেলো সে।তিহানের গায়ে জামা নেই।উন্মুক্ত হয়ে আছে শক্ত পেটানো শরীর।ভেজা শার্ট পরে আছে বিছানায়।চাদর ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নাই তার।পকেট থেকে ফোন বের করে শুকনো কাপড় দিয়ে মনোযোগ দিয়ে সেটা মুছতে ব্যস্ত সে।
তোহা বেহায়ার মতো কিছুক্ষন চেয়ে থেকে দৃষ্টি নামালো।গুটিগুটি পায়ে দ্রুত এগিয়ে যেয়ে শার্টটা হাতে তুলে নিয়ে মিনমিন করে বললো,
—“ভেজা জামাটা এখানে রেখেছেন কেনো?চাদর ভিজে যাচ্ছে পুরো।”বলে শার্টটা লন্ড্রিবিনে রাখলো সে।
তিহান একপলক তাকালো।ফোনটা বিছানায় রেখে অফিসের ব্যাগটা থেকে একটা পলিথিন বের করে তোহার হাতে ধরিয়ে দিলো।ভ্রুকুটি করে তাকালো তোহা।তিহান মুচকি হেসে বললো,
—“ফুচকা আছে।খেয়ে নিস।আমি শাওয়ারে যাচ্ছি।
বলেই হাতে টাওয়াল আর জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো তিহান।দরজা লাগানোর আগমূহুর্তে তোহা একহাতে দরজায় ঠেস দিয়ে তাকে আটকে দিয়ে নিশ্চিত স্বরে বললো,
—“আপনি এটা আনতে গিয়েই ভিজেছেন তাইনা?”
তিহান অমায়িক হাসলো।সেই হাসির মানে মূহুর্তেই বুঝে গেল তোহা।তিহান ভেতর থেকে দরজা আটকে দিতেই সে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো দরজার দিকে।

[বি:দ্র:গতপর্বে আমি দুটো ভুল করেছিলাম।এক হলো আমি লেখেছিলাম তোহার মাধ্যমিকের পর তাদের বিয়ে হবে।ওটা মাধ্যমিক না উচ্চ মাধ্যমিক হবে।আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে একটা জায়গায় আমি লিখেছিলাম ওদের “আকদ” হয়ে গিয়েছে।ওটা “আকদ” হবেনা ওটা “বাগদান” হবে।আকদ মানে পুরো বিয়ে হয়ে যাওয়া।আমি এত বিস্তারিত জানতাম না।তাই বুঝিনি।যারা ভুল গুলো ধরিয়ে দিয়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।আগামীতে এমন ভুল না করার চেষ্টা করবো।ধন্যবাদ❤️]

চুলায় ফুটন্ত পানি টগবগ করছে।আগুনের ভয়াবহ আঁচে রান্নাঘর ভ্যাপসা গরমে ছেঁয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।ফুচকাগুলো প্লেটে সাজিয়ে রেখে চুলোটা নিভিয়ে দিলো তোহা।দুটো কাপড়ের ছাপি দিয়ে ধরে পাতিলাটা তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
—“দরজা খুলুন।গরম পানি দিব।”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষন চুপ থেকে তিহান কাঁটা কাঁটা কন্ঠে উওর দিলো,
—“এখন খোলা যাবেনা।পানি লাগবেনা,যা।”
তোহা আবারো চেঁচিয়ে উঠলো।দাঁত কামড়ে বললো,”আমার হাতে কিন্তু গরম আঁচ লাগছে।খুলুন তাড়াতাড়ি।”
কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো তোহা।তার অপেক্ষার প্রহর আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই ছিটকিনি খুলে গেলো।অর্ধেক দরজা খুলে তিহান অস্থিরতা নিয়ে বললো,
—“আঁচ লাগবে কেনো?কাপড় দিয়ে ধরিসনি?”বলেই তোহার হাতের দিকে তাকালো তিহান।হাতের ছাপি দেখে তোহার চালাকিটা নিমিষেই বুঝে গেলো সে।চোখের মনি সরু হয়ে এলো।তোহা এগিয়ে এসেছে ততক্ষনে।তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।তিহানের পরণে শুধু কোমড় থেকে হাঁটু অবধি সাদা টাওয়াল।গা ভেজা।
টুপটুপ করে পানি গড়াচ্ছে।সেদিকে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই তোহার।মাথা নিচু করেই সে তাঁড়া দিয়ে বললো,
—“সরুন।”

তিহান সরে দাড়ালো।তোহা দু’কদম ওয়াশরুমের ভিতর বাড়িয়ে পানিটা ঢেলে দিলো বালতির মধ্য।বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই ধুম করে দরজাটা আটকে দিলো তিহান।চোখ বড় বড় করে তাকালো তোহা।তার চোখে বিস্ময়,কৌতুহলের অদ্ভুত সংমিশ্রণ।তিহানের হঠাৎ এই আচরণের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা বুঝতে না পেরে সে একবার দরজা আর একবার তিহানের মুখের দিকে চেয়ে অস্ফুস্ট স্বরে বললো,
—“দরজা আটকালেন কেনো?”
তিহান আগালো।একটু একটু করে প্রায় অনেকটা কাছে গেলো।তবে অবশ্যই অনেকটার বেশি নয়।তোহার ডানহাতটা আলতো করে টেনে ধরে তালুর দিকে তাকিয়ে কিন্চিৎ ঠোঁট নাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
—“হাতে আঁচ লাগছে তাইনা?
তোহার নির্বাক।তার স্হিরদৃষ্টি তিহানের লোমশ বুকে।তিহানের চুলের পানি চুইয়ে চুইয়ে তার কপাল গড়িয়ে গোলাপি ঠোঁট স্পর্শ করছে।তোহার কাঁপছে।তার ঠোট কাঁপছে।চোখের পাপড়ি কাঁপছে।মন কাঁপছে।ভেতরে ভেতরে সে মানুষটাই ভীষণভাবে কাঁপছে।এই লোক তার মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।তার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে।এত ক্ষমতা কেন লোকটার?তাকে কোনোদিন ঘনিষ্ঠভাবে না ছুঁয়েও লোকটা কিভাবে এত আবেগ,অনুভূতি,গভীরতম প্রণয় সৃষ্টি করতে পারে?কিভাবে?ভাবতে ভাবতেই তিহানের বুক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তোহা।
তিহান চোখ থেমে গেছে অনেক আগেই।দৃষ্টিজোড়া তোহার মুখের প্রতিটা ভাঁজ লক্ষ্য করছে মোহাচ্ছন্ন ঘোরে।অজান্তেই তার হাত চলে গেলো তোহার চিবুকে।হাতের তর্জনী দিয়ে তোহার চিবুক উচিয়ে তিহান আবিষ্টভাবে বললো,
—“অপরূপ।”

এই একবাক্যর ছোট্ট প্রশংসাটাই যেন তোহার কানে ঝংকার তুললো।লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার যোগার হলো তার।কয়েকবার ঢোক দিলেও শুকনো গলাটা ভিজলোনা।একবিন্দু পানির অবশিষ্ট নেই ভেতরে।প্রেমিকের প্রশংসার তেজে সব শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে।
তোহা গলা খাদে নামিয়ে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে অনুরোধ করলো,
—“যেতে দিন।”
তোহার কথাটা স্পষ্টই কানে গেলো তিহানের।তবে তোহাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছেনা একটুও।গরম পানির বাষ্পে বদ্ধ বাথরুম জুড়ে আবছা ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছে।উষ্মতার ছড়াছড়ি সর্বাঙ্গে।তোহার ঠোঁটের উপর ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু।ঠোঁট গুলো বোধহয় এখনো কম্পমান।তিহান দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো।অল্প কিছুক্ষনের ব্যবধানে তোহার হাত ছেড়ে দুরে সরে দরজাটা খুলে দিলো।তিহানের ইশারা বা কোন কিছু বলার আগেই একছুটে বেরিয়ে গেলো তোহা।
মুখে একটা ফুচকা পুরে নিয়ে ফ্রিজ খুলে চোখ ঘুরাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তোহার।ফ্রিজে শুধু ডালের বাটি আর ঠান্ডা ভাত।কোন তরকারি নেই।আর তিহান তখন কি বললো,”ফ্রিজে খাবার রাখা আছে খালামনি,সমস্যা হবেনা।”তিহানের কথাটা ব্যঙ্গ করে বললো তোহা।এই সারাদিন খাটাখাটনির বাড়ি ফিরে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেলে তৃপ্তি মিলে?মোটেও না।একা একা বিরবির করতে করতেই সেগুলো বের করলো তোহা।গরম করার জন্য চুলোয় চড়িয়ে দিয়ে আবারো ফ্রিজ খুললো।দেখেশুনে একটা বেগুন আর দুটো ডিম বের করে নিলো।তিহানদের চার স্টোভের চুলা বিধায় এখনো দুটো খালি আছে।পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ভেঁজে বাটিতে তুলে রেখে গোল গোল করে বেগুন কাটলো সে।মশলা মাখিয়ে ছেড়ে দিলো গরম তেলের উপর।ভাঁজা হয়ে গেলে প্লেটে তুলে ভাত ডাল সহ সব সাজিয়ে রাখলো টেবিলে।কাজের মাঝেই সে ফুচকার প্লেট খালি করেছে।

কাজ শেষে সে গেলো তিহানের রুমে।লোকটা এখনো বের হয়নি।পানি ঢালার শব্দ ঝাঁপটে আসছে কানে।তিহানের রুমের অবস্থা একেবারেই অগোছালো।সেন্টার টেবিলে কাগজের ছড়াছড়ি।সকালে ঘুম থেকে উঠার পর হয়তো বিছানা ঝাঁড়া হয়নি।চাদর কুঁচকে আছে।যদিও সবসময় এই ঘরটা শৌখিনভাবে সাজানো থাকে তবে আজকের এই বিধস্ত অবস্থার কারণ অজানা নয় তোহার।অফিসে প্রেজেন্টেশন ছিলো তিহানের।সকালে কলেজ যাওয়ার সময় বলেছিলো তাকে।সেজন্যই হয়তো টেবিলভর্তি কাজপত্রের আলুথালু অবস্থা।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো তোহা।সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই বেরিয়ে এলো তিহান।
তোহাকে দেখে মনে মনে চরম খুশি হলেও মুখে বললো,
—“এখনও যাসনি কেনো?খালামনি চিন্তা করবেতো।”
বালিশদুটো পাশাপাশি রেখে ঝাড়ুটা খাটের চিপায় ঢুকিয়ে দিলো তোহা।মাথার এলোমেলো ওড়না টেনে নিতে নিতে বললো,
—“চিন্তা করবে কেনো?আম্মুতো জানে আমি আপনার সাথে আছি।”
তিহান হাসলো।টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো,
—“আমার সাথে থাকলে কি চিন্তা করা মানা?”
—“হ্যাঁ।”
তোহার সোজাসাপটা উওরে আবারো হাসলো তিহান।চুল মোছা শেষে টাওয়ালটা সোফার পিঠ ঠেকানোর জায়গাটায় মেলে দিতেই তোহা বললো,
—“রাতের খাবার খাবেন না?”

—“হু খাবো,গরম করতে হবে।তুই যাবি আমার সাথে?কথা শেষ করে কিছু একটা ভাবলো তিহান।তারপর বললো,না থাক,রান্নাঘরে গরম।তুই এখানেই বস।”
তোহা তাকালোনা।তিহানের কাছাকাছি যেয়ে দাড়িয়ে মিনমিন করে বললো,
—“আমি গরম করে রেখেছি।চলুন খাবেন।”
তিহান থতমত খেয়ে দাড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে।খাবার গরম করা পর্যন্ত ঠি ক ছিলো।কিন্তু মেয়েটা যে কষ্ট করে আবার বেগুন আর ডিমও ভেঁজে রেখেছে।
তোহার ডাকে আর চেয়ার সরানোর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে তার।চুপচাপ যেয়ে চেয়ারে বসে সে।তোহা প্লেটে ভাত বেরে দেয়।ডাল দিয়ে ডিমভাজাটা এককোঁণে উঠিয়ে রাখে।
তিহানের চোখ যায় একপাশে কেটে রাখা লেবুর দিকে।আৎকে উঠে সে বলে,
—“লেবুতো কাঁটা ছিলোনা ফ্রিজে।”
—“আমি কেটেছি।আপনিতো লেবু ছাড়া খেতে পারেননা।”
তিহান চোখ গরম করে তাকায়।কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
—“হাত দেখি।”
তোহা ঠোঁট উল্টায়।মুখ লটকিয়ে হাত মেলে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখিয়ে বলে,”কাটেনি।”স্বস্তির শ্বাস ফেলে তিহান।তারপর ভাত মাখিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।তোহা তার পাশের চেয়ার টেনে বসে।তিহান চুপচাপ খাচ্ছে।তোহা তার প্লেটে বেগুন ভাঁজা উঠিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“আচ্ছা,আমাদের ব্যাপারটা সবাই জানলো কি করে?”

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৩+৩৪

—“কোন ব্যাপার?”যথেষ্ট সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে তিহান।তবে তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে বিস্তর রসিকতা।
তোহা ধরতে পারে সহজেই।দাতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে তাকাতেই তিহান হেসে ফেলে।উওর দেয়,
—“নানা শুধু খালুকে বলেছিলো।প্রথমে অবশ্য খালু কোন মতামত দেয়নি।বলেছে তার মেয়ে যা বলবে তাই হবে।তারপর তোমার থেকে মতামত জানার পর পরেরদিন সকালে আমরা যখন ঘুরতে বের হই তখন সবাইকে জানানো হয়।খালুর সম্মতিতেই জানানো হয়।সবাই যখন কোন দ্বিমত করেনি তখন খালু নিজেই আমাকে ফোন দেয়।মানে আমার ফোনতো নষ্ট ছিলো তখন।তাই তূর্যর ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলেন তিনি।হুট করেই দেয় সেদিনই আংটি পড়ানোর প্রস্তাবটা।প্রথমে মানা করতে চেয়েও পরে আর তোমার উপর একটু অধিকার পাওয়ার লোভ টা সামলাতে পারিনি আমি।”হ্যাঁ”বলে দিয়েছিলাম।তারপর আংটির ব্যাবস্থা উনারাই সব করেন।বুঝলে?
তোহা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো পুরোটা।তিহানের কথা শেষ হতেই সে ফটাফট প্রশ্ন করে,
—“আমাকে জানানো হয়নি কেনো?”
—“কারণ আমি মানা করেছিলাম।আসলে তোমার হঠাৎ খুশি হওয়াটা দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব।”
তোহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আচমকাই তিহানের বাহুর নিচ দিয়ে ঢুকে বুকে মাথা রাখে।দুহাতে তিহানকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাসূলভ কন্ঠে বলে,
—“আমি একটু থাকি এখানটায়?”
—“থাকো।”

তিহানের খাওয়া শেষ হয়েছে একটু আগে।টেবিলের সব গুছিয়ে প্লেটটা ধুয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে রুমে উঁকি দেয় তোহা।তিহান পায়ের উপর পা তুলে ফোনে কি যেনো দেখছে।তোহা আস্তে করে বলে,
—“দরজাটা আটকে দিয়ে যান।আমি যাচ্ছি।”
তিহান একপলক তাকিয়ে উঠে দাড়ায়।ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে আসে।তোহা দরজার সামনে দাড়িয়ে পায়ে জুতো পরছে।তিহান পাশে যেয়ে দাড়ায়।জুতো পরা শেষে দরজার লক ঘুরাতে নিলেই তিহান তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।একমূহুর্ত বিলম্ব না করে তোহার দু’হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগে ধরে চোখের সামনে তালু মেলে একে একে দুই হাতের তালুর মাঝখানটায় নম্রভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে মোহবিষ্ট কন্ঠে বলে,
—“এই নরম কোমল আদুরে হাতদুটোকে এত কষ্ট করানোর জন্য ঠোঁট ছুঁইয়ে ক্ষমা চাচ্ছে প্রেমিক।প্রেমিকা যেন তা গ্রহণ করে নেয়।”

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৩৭+৩৮