এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২৩+২৪

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২৩+২৪
লেখিকা মালিহা খান

গোটা শহরজুড়ে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে।রজনীর গভীরতম প্রহর বিদ্যমান।আশেপাশের কোন বাড়িতেই আলো জ্বলছেনা।রাস্তার হেডলাইটের বাতিগুলোই অন্ধকার কাটানোর একমাত্র উৎস্য।
মাঝেমধ্য দু একটা কুকুরের আগ্রাসি বাঁকবিতন্ডতা।তারপর আবারো সব নিশ্চুপ।
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে মৃদু ক্যাঁড় ক্যাঁড় আওয়াজ তুলে আলমাড়ি খুললো তোহা।তার আলমারি জুড়েই তিহানের দেয়া শাড়ি ঝুলছে।ড্রয়ারের ভেতর ঠেসে রাখা তিহানের দেয়া রাশি রাশি কাঁচের চুড়ি,কানের দুল।এই লোকটা তাকে নিয়ে মার্কেটে গেলেই পাগলামি করে।এসব কিনে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।এই ভয়ংকর প্রেমিক পুরুষকে মানা করারও স্বাধ্যি নেই তোহার।ফলস্বরূপ আলমারিতে কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই আর।
আর আতিয়া যদি বলে,”এতকিছু কেনো কিনেছে?”তবে তিহানের সহজ সরল উওর হয়,”তিহু জেদ করেছে তাই কিনে দিয়েছে।”এ নিয়ে এপর্যন্ত মায়ের কম বকা শোনেনি তোহা।

বেশ অনেকক্ষণ যাবত একটা একটা করে শাড়ি দেখে সাদা রংয়ের একটা সুতির শাড়ি হাতে নিলো তোহা।
সাদার মধ্য সাদা সুতার কাজ করা।স্নিগ্ধশীতল মনকাড়া একটা শাড়ি।একটু হাসলো তোহা।শাড়িটায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে পাশের ড্রয়ের খুললো।লাল রংয়ের ব্লাউজের সাথে মিলিয়ে দুমুঠো লাল রেশমী চুড়ি বের করে বিছানার উপর রেখে আলমারিটা খুব আস্তে করে আটকে দিলো।এই মধ্যরাতে শাড়ি পরাটা নিছক ছেলেমানুষি হলেও এটাকেই এই মূহুর্তে মন ভালো করার ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে তোহা।বলা বাহুল্য,আজও সারাদিন তিহানের খবর পায়নি সে।
কুঁচিগুলো গুঁজে নিয়ে শাড়ির আচঁলটা আলগা করেই গায়ে জড়ালো তোহা।কোন সেফটিপিনের ঝামেলা নেই।চুলগুলো আঁচরে নিয়ে খোঁপা করে মাঝখানে একটা খোঁপার কাঁটা ঢুকিয়ে নিলো।হাতে মাত্র দুটো চুড়ি পরেছে তখনই চিরচেনা একটা গুনগুন করা কন্ঠ কানে এসে অতি আকাঙ্ক্ষিত কিছুর জানান দিলো তাকে।একপলক থমকালো তোহা।ষষ্ট-ইন্দ্রিয়র বদৌলতে ঘটনার অর্থোদ্ধার হতেই চমকে উঠলো সে।ঠোঁটেজুড়ে খেলে গেলো অবিস্বরণীয় হাসির ঝলক।ছলছলে কাঁপা পায়ে বারান্দায় যেয়ে পাশের বারান্দায় চোখ পরতেই একটা কালো সুঠামদেহী অবয়ব দেখামাত্র চোখজোড়া পানিতে টলমল করে উঠলো তোহার।
আর একমূহুর্ত দেরি করলোনা সে।উদ্ভ্রান্তের মতো ড্রয়ের হাতরে তিহানদের ফ্ল্যাটের চাবি খুঁজে নিয়ে বিনাশব্দে বেরিয়ে পরলো।বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রইলো লাল রেশমী চুড়িগুলো।তৃষ্ণার্থ প্রেমিকার প্রণয়পিপাসা দেখে যেনো তারাও বিদ্রুপ করে হাসছে।প্রেমিকের অপেক্ষা বুঝি এতোটাই পীড়াদায়ক?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মৃদুমন্দ হাওয়ায় মন ভাসাতে না পেরে ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হচ্ছিলো তিহান।পেছনে ঘুরতেই তার পাগলপ্রায় প্রাণপ্রেয়সীর হামলে পরা ধাক্কায় আচমকাই বেসামাল হয়ে পরলো সে।দু’কদম পিছিয়ে রেলিংয়ের সাথে শরীর ঠেকে যেতেই নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করলো।
দুহাতে আষ্টেপিষ্টে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে তোহা।যেন ছেড়ে দিলেই সে আবার পালিয়ে যাবে।
পায়ের পাতা সর্বোচ্চ উঁচু করে দাড়ানো সত্ত্বেও তোহার মাথা তিহানের গলা অবধি পৌছায়নি।বুকের উপরিভাগের সাথে জড়িয়ে আছে।প্রবল কান্নার দমকে গায়ের পাতলা টি-শার্ট ভিজে যাচ্ছে তিহানের।
গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা প্রেয়সীর মেয়েলি উষ্মতায় বুকের ভেতরের নিদারুণ ঝড়ো হাওয়া ইতিমধ্য বইতে শুরু করে দিয়েছে।
কয়েকবার ঢোঁক গিললো তিহান।নিজের পুরুষালি মনোভাবটাকে সংযত করে আলতো করে তোহার মাথায় হাত রাখলো।ছোট্ট করে বললো,

—“শান্ত হও।”
তোহা শান্ত হলোনা।উপরন্তু গুনে গুনে দুদিন পর তিহানের কন্ঠ শুনে কান্নার মাত্রাটা হু হু করে বেড়ে গেলো তার।কাঁদতে কাঁদতেই সে থেমে থেমে বললো,
—“আপনি..আপনি কোথায় ছিলেন?আমি..আমিতো”বলতে বলতেই হেঁচকি উঠে গেলো তার।
মাথায় রাখা হাতটা চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিয়ে তাকে থামালো তিহান।নিচু কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,এখনতো এসে পরেছি।”তার কথাবার্তা কোনোকিছুই কাজে দিলোনা।তোহার চোখের জলগুলো আজ বাঁধ মানার নয়।
ছোট করে একটা অস্থিরতম শ্বাস ছাড়লো তিহান।কান্নারত মেয়েটার কান্না থামাতে না পেরে নিজেকে চরম অধম মনে হচ্ছে।কিছুক্ষন চুপ থাকলো সে।অত:পর কোমল মোলায়েম কন্ঠে আঁকুতি নিয়ে বললো,
—“আর কেঁদোনা।থামো।”তিহানের শান্তশিষ্ট মোহময় কন্ঠে আরো কয়েকবার ফুঁপিয়ে উঠে কোনরকম থামলো তোহা।তবে তিহানকে ছাড়লোনা।
একটু হাসলো তিহান।তোহার শাড়ি অগোছালো।হাত উঁচিয়ে গলা ধরে রয়েছে বিধায় কোমড়-পিঠের অনেক অংশই চোখের সামনে দৃশ্যমান।মুহুর্তেই দৃষ্টি সরালো তিহান।ধীর কন্ঠে বললো,
—“এরকম আদুরে খোলামেলা আবেশে আমার সাথে লেপ্টে থাকলে যেকোনো সময় অনর্থ হয়ে যাবে।তুমি কি চাও আমার দ্বারা কোন অনর্থ হোক?”

কথার মানেটা সহজেই বুঝলো তোহা।লজ্জিত ভঙ্গিতে নতজানু হয়ে তিহানকে ছেড়ে দাড়ালো সে।শাড়ির আচঁল টেনে সামলে নিতেই তিহান হাত বাড়িয়ে তার খোঁপার কাঁটাটা খুলে নিলো।ঘনকালো চুলগুলো পুরো পিঠে ছড়িয়ে দৃশ্যমান অংশগুলো আবৃত করে নিতেই তিহান কাঁটাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
—“খোলাই থাক,বেঁধোনা।”
একপলক তাকালো তোহা।রক্তলাল হয়ে আছে তার ক্রন্দনরত নয়নজোড়া।চোখেমুখে ভেজাভাব।মুখের সামনের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে নিয়ে সে অভিমানি কন্ঠে বললো,
—“আপনি কোথায় ছিলেন এই দু’দিন?”
উওরে তোহার বাহু ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো তিহান।হাত দিয়ে গাল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
—“অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম।জরুরি কাজ ছিলো।”
—“আমার ফোন ধরেননি কেনো?কতবার ফোন করেছি আপনাকে।”বলতে বলতেই গলা ধরে এলো তোহার।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে।চোখের কোন বেয়ে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়েই পড়লো।
—“ফোন ধরিনি কারণ আমি তখন প্রচন্ড রেগে ছিলাম তোমার উপর।তুমি তো জানোই রাগলে মাথা
ঠি ক থাকেনা আমার।রাগের বশে আরো উল্টাপাল্টা কিছু বলতে চাচ্ছিলামনা তোমাকে।বুঝতে পেরেছো?”স্বাভাবিকভাবেই উওর দিলো তিহান।

চোখেমুখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালো তোহা।মাথাটা কাত করে তিহানের বুকে রেখে বললো,
—“আপনি এখনো রেগে আছেন?”
তিহান দুষ্টু হেসে বললো,
—“এমন রূপময়ী হয়ে এতো কাছে এসে এভাবে কান্না করলে রেগে থাকা যায়?অন্তত আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়।”
মুচকি হাসলো তোহা।তবে মুখে কিছু বললোনা।চোখ বন্ধ করে ফেলতেই তিহান আবারো তার চুলের ভাঁজে হাত ডুবালো।উপর থেকে নিচে আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে দিতে দিতে বললো,
—“এই রাতের বেলা শাড়ি পরে আছো যে?এতরাত অবধি জেগেই বা আছো কেনো?আমাকে দেখলে কি করে?বারান্দায় ছিলে?ঘুমোওনি?”
—“আমি দু’রাত যাবত ঘুমোইনি।”
তোহার এই ছোট্ট কথাটাতেই মনটা বিষিয়ে গেলো তিহানের।চুলে আঁচরাতে থাকা হাতটা থেমে গেলো অজান্তেই।কন্ঠে অদ্ভুত একটা ব্যাথা নিয়ে সে বলল,
—“খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”
—“খুব বেশি শান্তি দিচ্ছেন এখন।আপনার এই বুকটায় অনেক শান্তি জানেন?মনে হয় সারাক্ষণ এখানেই ঘুমিয়ে থাকি।”
—“ওটা তোমারই।ওখানটায় মাথা রাখার অধিকারো শুধু তোমার।”
একটু লজ্জা পেলো তোহা।খানিকবাদে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,

—“আপনি জানেন অনন্তকে..”
—“জানি,সব জানি আমি।এখন আর ওসব বলতে হবেনা।মার থেকে সবটাই শুনেছি আমি।আর যথেষ্ট খুশিও হয়েছি তোমার উপর।”
মাথা তুলে তাকালো তোহা।ঠোঁট এলিয়ে হাসতেই তিহানও হাসলো।হঠাৎ তোহার হাতের দিকে চোখ পরতেই তা আঁকড়ে ধরলো তিহান।কব্জি ধরে তুলে চোখের সামনে এনে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
—“দুটো চুড়ি?শাড়ি পরেছো অথচ চুড়ি পরোনি কেনো?লাল চুড়ি নেই আর?”
—“আছেতো,আপনাকে দেখে আর চুড়ি পরায় সময় নষ্ট করিনি।না পরেই চলে এসেছি।”
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো তিহান।তোহাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে পাশের মোড়ায় বসিয়ে বললো,
—“একটু বসো,তোমার জিনিসগুলো ব্যাগ থেকে বের করা হয়নি।নিয়ে আসি সেগুলো।”
কথার পিঠে তোহাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই রুমে চলে গেলো তিহান।হতাশ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো তোহা।লোকটা না জানি আবার কোন পাগলামি করেছে!

তিহান ফিরে এলো হাতে বড় একটা ব্যাগ নিয়ে।আরেকটা মোড়া টেনে মুখোমুখি বসে ব্যাগটা তোহার কোলের উপর রেখে বললো,
—“সেদিন তোমার দুটো চুড়ি চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলাম।বহু খুঁজেও ওই সেম ডিজাইনের পাইনি তবে এখানে নতুন বিশটা ডিজাইনের চুড়ি আছে।সুন্দর লেগেছে তাই নিয়ে এসেছি।তোমার পছন্দ না হলে বলো,বদলে আনবোনে।আর একটা শাড়ি আছে।ভালো লাগলো তাই নিয়ে আসলাম।”
—“আপনি কি পাগল নাকি?এতকিছু কোথায় রাখব আমি?”চিন্তিত বিস্মিত কন্ঠ তোহার।
তিহান হেসে ফেললো।বললো,
—“সেটা তোমার ব্যাপার।আচ্ছা,দেখি দাওতো এখানে লাল চুড়ি ছিলো।তোমার হাতদুটো খালি খালি লাগছে।”বলে তোহার হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিলো তিহান।অনেকক্ষণ হাতরে হাতরে পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে লাল চুড়ির প্যাকেটটা হাতে এলো তার।ব্যাগটা নামিয়ে রেখে চুড়ির কাগজটা খুললো সে।তোহার হাতের জন্য নিজের হাতটা মেলে ধরতেই আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখলো তোহা।তিহান যত্ন করে খুব সাবধানে তার হাতে চুড়ি গুলো পড়িয়ে দিলো।হাল্কা ঝাঁকিয়ে নিতেই রিনঝিন শব্দতরঙ্গে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো তিহানের।

—“আপনার গালে কি হয়েছে?”হঠাৎই তিহানের গালের মধ্যভাগটায় হাত ছুঁইয়ে বললো তোহা।
—“সেভ করতে যেয়ে কেটে গেছে।”তোহার অপরহাতে পড়ানো চুড়ি গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উওর দিলো তিহান।
তোহা ঝুঁকে গেলো অনেকটা।কাঁটা জায়গাটায় বৃদ্ধাআঙ্গুল বুলিয়ে নিজেই আর্তনাদ করে বললো,”ইশ!কতখানি কেটেছে।”
বলে আরো একটু সামনে ঝুঁকতেই তিহান তার গালে হাত রেখে আটকে দিয়ে খানিকটা আহাজারি করে ধরা গলায় বললো,
—“আর কাছে এসোনা ‘প্রেমনন্দিনী’।তোমার এই মেয়েলি ঘ্রাণটায় কবে যেনো আমি উন্মাদ হয়ে যাই।”
কথাটা শোনামাত্র যারপরনাই তুমুল লজ্জা ঘিরে ধরলো তোহাকে।একপ্রকার ছিঁটকে সরে অন্যদিকে তাকিয়ে বসলো সে।চোখেমুখে কেমন অস্বচ্ছলতা।তিহানের দিকে তাকানোর সাহস নেই।
তিহান মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো।তার লজ্জায় বুঁদ হওয়া প্রানভোমরাটার চেহারার দিকে তাকালেই মনটা ক্ষনে ক্ষনে ভালো লাগার উচ্চপর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে।
হুট করেই তোহার দুগালে দুহাত রাখলো তিহান।নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে চোখ রাখলো।ভড়কে গেলে তোহা।তাকে আরো একটু জ্বালানোর জন্য তিহান খালি গলায় মৃদু স্বরে গাইলো,

হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই।
যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমায় জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই।
~~
আমি যে নিজেই মত্ব
জানি না তোমার শর্ত
যদি বা ঘটে অনর্থ
তবুও তোমায় চাই।
হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই…।

ভোরের আলো ফুটতে আরো ঘন্টাখানেকের মতো বাকি।আকাশটা কেমন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।তাঁরা গুলোকে মনে হচ্ছে এক একটা মুক্তকণা।বিশাল আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানো মুক্তোর টুকরো।এখনি বোধহয় একটা দুটো খসে পরবে গায়ের উপর।
গান শেষ হওয়া মাত্রই তিহানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছে তোহা।তিহান বারণ করেনি।সরিয়েও দেয়নি বরং নিজের মোড়া ঘুরিয়ে পাশাপাশি বসে তোহাকে আরাম করে মাথা রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তোহার হাতদুটো তার হাতের মুঠোয় বন্দি।নরম ছোট্ট হাতদুটো অনবরত নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে তিহান।
তোহার চোখ বন্ধ।তিহান অনেকক্ষণ যাবতই তার চোখেমুখে তন্দ্রা ভাব লক্ষ্য করছে।কিন্তু নিজের কাছ থেকে সরাতেও ইচ্ছে করছে না মেয়েটাকে।শেষমেষ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়েই সে বললো,
—“ঘুম পাচ্ছে?ঘরে যাবা না?রাত শেষ হতে চললো।”
তোহার সারাশব্দ পাওয়া গেলোনা।ভ্রু কুঁচকালো তিহান।মেয়েটাকি ঘুমিয়ে গেলো তবে?তোহার হাতদুটো ছেড়ে মুখের উপর আসা চুলগুলোকে কানের পিছে গুঁজে দিলো সে।হাল্কা গলায় ডাকলো,
—“তিহু”।

ঘুমের মাঝেই দুবার ঠোঁট কাঁমড়ালো তোহা।অত:পর তিহানের সাথে আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আবারো ঘুমে বিভোর হয়ে গেলো।কপালে চিন্তার ছাপসহই মৃদু হাসলো তিহান।তবুও নিজেকে প্রশয় দিলোনা।তোহাকে নিয়েই একটু নড়েচড়ে বসে তোহার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে বললো,
—“উঠো।তোমার ঘরে যাও।তারপর ঘুমিও।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে পিটপিট করলো তোহা।ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
—“এতো নড়ছেন কেনো?ঘুমোতে দেন না।”
ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো তিহান।বাসায় কেউ উঠে গেলে সমস্যা হবে।তোহাকে এখন পাঠিয়ে দেয়াটাই উওম।
অনেকক্ষন যাবত এখানে আছে।
তোহার হাতদুটো ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো তিহান।তোহা ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছে।আচমকাই তাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তিহান।তখন আর নিজের হুঁশে নেই তোহা।ঘুমে বেহুঁশ।বুঝতে পারলে এতোক্ষনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিতো।তোহাকে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলো তিহান।হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে ব্যাগের ভিতর রেখে বাইরে যেয়ে ফ্ল্যাটের দরজাদুটো খুলে ফিরে এলো।তারপর তোহাকে আবারো কোলে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো তোহার রুমের উদ্দেশ্য।

তোহাকে বিছানার মাঝখানটায় শুইয়ে দিয়েছে তিহান।তারপর আবার যেয়ে শাড়ি আর চুড়ির ব্যাগ টা নিয়ে এসেছে।এই ভোরবেলা এই ফ্ল্যাট ওই ফ্ল্যাট করতে করতে রীতিমত ঘাম ছুটে গেছে তিহানের।তবুও মেয়েটার ঘুম যে ভাঙেনি এতেই শান্তি।
আশেপাশে নজর ঘুরালো তিহান।বিছানার এলোমেলো চুড়িগুলো নিজেই গুছিয়ে দিলো।আলমারি খুলে সব যথাস্হানে রেখে ঘরের পর্দা টেনে দিলো।কাঁক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে।ভোর হয়ে গেছে প্রায়।বামকাত হয়ে ফিরে ঘুমালো তোহা।গায়ের উপর দেয়া কাঁথাটা ইতিমধ্যেই সরে গেছে।বের হতে যেয়েও আবার ফিরে এলো তিহান।গায়ের কাঁথাটা ঠি ক করে দিয়ে তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বললো,
—“ঘুমাও নিদ্রাপরী।তোমার ঘুমন্ত স্বপ্নগুলো শুধু আমিময় হোক।”

তিহানের কোলে ছোট্ট মৌরি।বয়স তিনবছর।দুহাতে তিহানের গলা জড়িয়ে রেখেছে সে।হাতে দুটো চকলেট।ভাঙা ভাঙা শব্দে কথা বলতে পারে।তাকে কোলে নিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে তিহান।মোরির হাতের চকলেট দুটো কিনতে দোকানে গিয়েছিলো।ছুটির দিন তাই বাসায়ই আছে সে।
মোরি থাকে তাদের নিচের ফ্ল্যাটটায়।এই পুরো বাড়ির সবারই বেশ আদুরে বাচ্চাটা।আর তিহানের একটু বেশিই আদুরে।কারণ বাচ্চাকাচ্চা একটু বেশিই পছন্দ করে তিহান।
মৌরির মা তাদের ফ্ল্যাটে আছে।আফিয়ার সাথে কথা বলছে।মৌরিকে সাথে নিয়ে এসেছিলো সেজন্যই তাকে নিয়ে দোকানে চকলেট কিনতে গিয়েছিলো তিহান।

দুহাতে দুটো বালতি নিয়ে বেরিয়েছে তোহা।বালতি ভর্তি ধোঁয়া কাপড়।কপাল গলায় ঘাম।ছুটির দিনেও বাসার কাজে সাহায্য করার মেয়েটা আসেনি।প্রায় একসপ্তাহের কাপড় জমে আছে।আতিয়া ভেবেছে আজ সব ধোঁয়াবে কিন্তু না সকালেই মেয়েটা ফোন করে বলেছে আজসহ আগামী একসপ্তাহ সে আসতে পারবেনা।সে গ্রামে যাচ্ছে।ফিরলে তবেই আসবে।
মায়ের চেঁচামেচিতে একপর্যায়ে টি কতে না পেরে নিজেই কাপড়গুলো নিয়ে বাথরুমের ঢুকেছিলো তোহা।প্রায় দুঘন্টা লাগিয়ে কাপড়গুলো ধুয়ে এখন ছাদে যাবে শুকাতে দিতে।
ফ্ল্যাটের দরজা আটকে ঘুরে দাড়াতেই তিহানকে চোখে পড়লো তার।গটগট পায়ের শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছে তিহান।মৌরির দিকে তাকিয়ে মলিন মুখেই মিষ্টি করে হাসলো তোহা।জবাবে মৌরিও হাসলো।
—“কি হয়েছে তোর?চেহারার এমন বিধস্ত অবস্থা বানিয়ে রেখেছিস কেনো?খালামনির সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?”ভ্রু কুচকে বললো তিহান।
উওরে ক্ষেপে গেলো তোহা।ক্ষ্যাপাকন্ঠে বললো,
—“আপনি সবসময় এতো বেশি বুঝেন কোনো তিহান ভাই?এই সবগুলো কাপড় আমি ধুয়েছি।সেজন্যই ক্লান্ত লাগছে।আপনি জানেন কাপড় ধুতে কতো কষ্ট?”

—“তুমি বাইয়ার তাতে তিল্লাত্তো কেনো তোয়াপু?”
মৌরির কথায় ভ্রু উচিয়ে তাকালো তোহা।অবাক হওয়া কন্ঠে বললো,
—“আপনি এই বাচ্চাটাকেও হাত করে ফেলেছেন তিহান ভাই?”
সরু চোখে তাকালো তিহান।মৌরিকে একটা চকলেটের প্যাকেট খুলে হাতে দিয়ে বললো,”আমার কাওকে হাত করা লাগেনা।সবাই এমনেই হাত হয়ে যায়।”
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকালো তোহা।দুহাতে দুটো বালতি উঠিয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
—“সরুনতো সামনে থেকে।আপনার জন্য আমার কতো দেরি হয়ে গেলো।”
সরে দাড়ালো তিহান।তোহা একসিঁড়ি উঠতেই মৌরিকে একহাতে আগলে ধরে অপরহাতে তোহার হাত থেকে একটা বালতি নিয়ে ঠাট্টার সুরে বললো,”এতটুকু শরীর নিয়ে দুটো বালতি নিয়েছিস।কখন যেনো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পরে যাস।”
এবারো ফুঁসে উঠলো তোহা।তিহানের হাত থেকে বালতি নেয়ার চেষ্টা করে বললো,
—“ছাড়ুন।লাগবেনা আপনার সাহায্য করা।আমি একাই পারব।”
একটানে তোহার হাত থেকে বালতিটা ছিনিয়ে নিলো তিহান।তাকে পাশ কাটিয়ে কয়েকধাপ উপরে উঠে গিয়ে বললো,
—“বেশি কথা না বলে আয়তো।তোর এই বেশি কথার চাপে কোনদিন যেনো নিজেই চাপা পরে যাবি।”
আর কথা বাড়ালোনা তোহা।একাহাত দিয়ে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে তিহানের পিছে পিছে উপরে উঠতে লাগলো।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২১+২২

সবগুলো কাপড় প্রায় রোদে দেয়া শেষ।মৌরি কে কোলে নিয়ে ছায়ার দাড়িয়ে আছে তিহান।মৌরি কোলে না থাকলে সে নিজেই দিয়ে দিতো কাপড়গুলো।তোহার কাপড় দেয়া শেষ হতেই এগিয়ে গেলো তিহান।একহাতেই খালি বালতিদুটো তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই মৌরি দুহাত বারিয়ে বললো,
—“তোয়াপু যাবো।” অর্থ্যাৎ সে তোহার কোলে যেতে চাচ্ছে।
আড়চোখে তাকালো তিহান।তোহা তখন ব্যস্ত ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিতে।
—“নিতে পারবি ওকে?”গলা ঝেড়ে বললো তিহান।
—“দিন।”বলে হাত বারিয়ে দিলো তোহা।তৎক্ষনাত তার কোলে লাফিয়ে এলো মৌরি।তোহা হাসলো।মৌরির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—“তিহান ভাই পঁচা বুঝলে?তিহান ভাইয়ের কোলে যাবানা।”

—“তোমাকে কে বলেতে তোয়াপু?বাইয়াতো আমাকে খুব আদল কলে।তোমাকে কলেনা?”প্রতিবাদ করে বললো মৌরি।
শব্দ করে হেসে ফেললো তিহান।তোহা বোকা বোকা চাহনী দিয়ে চেয়ে আছে।তিহান দুষ্টু কন্ঠে বললো,
—“কলে আপু।বাইয়া চবাইকেই আদল করে।তোমার তোয়াপু কেন বাদ যাবে?”
মুখ বিকৃতি করে তাকালো তোহা।মুখ দিয়ে অষ্পষ্ট স্বরে “অসহ্যকর” শব্দটা বের করে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে গেলো।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২৫+২৬