এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৯+১০

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৯+১০
লেখিকা মালিহা খান

ইলিশমাছের গরম গরম তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছে তিহান।বেগুন আলু দিয়ে করা ইলিশমাছ টা আজকে একটু বেশিই স্বাদ হয়েছে।ছেলেকে তৃপ্তিভরে খেতে দেখে আফিয়া তার প্লেটে আরেকটু তরকারি তুলে দিয়ে বললেন,
—“”দুপুরে খাসনি তাইনা?”
তিহান অমায়িক হাসলো।আফিয়া নিমিষেই বুঝে গেলো তার হাসির মানে।গ্লাসে পানি ঢেলে তিহানের সামনে দিয়ে ক্ষুন্ন কন্ঠে বললো,
—“কেন এমন করিস?সবার খেয়াল রাখতে পারিস অথচ নিজের বেলায় যত অবহেলা।”
তিহান আবারো হেসে বললো,

—“এটা অবহেলা না মা।দেখো,আমি যদি আজ দুপুরে খেতাম তাহলে কি আর এমন রাম ক্ষুধা লাগতো বলো?আর এতো ক্ষুধা লেগেছে বলেই খাবারটার স্বাদ কয়েকরুন বেড়ে গিয়েছে।খাবারটা আরো বেশি মজার লাগছে।দুপুরে খেয়ে নিলে তো আর এতটা স্বাদ উপভোগ করতে পারতাম না।তাইনা?’Every action has an equal and opposite reaction.’বুঝলা?”
আফিয়া বিরক্তিকর কন্ঠে তেঁতে উঠে বললো,
—“হয়েছে,ওতো বোঝা লাগবে না আমার।তোর এই পটল তোলা কথাবার্তা তোর কাছেই রাখ।”
আফিয়ার কথা শুনে ভাত চিবানো বন্ধ করলো তিহান।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—“পটল তোলা কথাবার্তা মানে?”
ছেলের প্রশ্নে আফিয়া বোকা হেসে বললো,
—“জানিনা।মুখে আসলো তাই বলে দিলাম।”
হাস্যেজ্জ্বল কন্ঠে”তুমিও না মা।”বলে আবারো খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো তিহান।বাস্তবিকই প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে তার।পেটভরে খাওয়া শেষ করে পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিতেই আফিয়া টেবিল গোছাতে গোছাতে বললো,
—“আতিয়া কে বলে এসেছি।তোহা আজ আমাদের এখানেই থাকবে।”
—“কেনো?”
—“এমনিই ইচ্ছে হলো।তোর সমস্যা হবে?তাহলে থাক।”
ঢকঢক করে পানি গিলে নিয়ে আস্তে করে গ্লাসটা টেবিলে রাখলো তিহান।তারপর নিচু গলায় বললো,
—“নাহ্,ঠিকাছে।”
বলে আগের মতোই শান্ত স্বাভাবিকভাবে হাতটা ধুয়ে রুমে চলে গেলো।মনের চাঁপা খুশিটা নিজের প্রশস্ত বুকের মাঝেই খুব যত্নে চাঁপা পরে রইলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এখনো ঘুমে আছে তোহা।গভীর ঘুমে।শুধু শরীরের ভাবভঙ্গিটা পরিবর্তন হয়েছে।একটু আগে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছিলো।আর এখন আস্টেপিষ্ঠে তিহানের কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
এতক্ষণ ঘুমের কারণে তৈলাক্ত হয়ে গেছে মুখ।থুতনির আর ঠোঁটের উপরের জায়গাটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।আঙ্গুলের উল্টোপিঠ দিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘামটা মুছিয়ে দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কয়েকমিনিট চেয়ে থেকে তিহান।
ঠোঁটের কোঁণে ছোট্ট হাসির মলিন রেখা।
পাশের টেবিল থেকে ফোনটা নয়নে সোফায় যেয়ে সটান হয়ে শুয়ে পরলো সে।পিঠ ব্যাথা করছে।একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু সোফায় ঘুমানো আর না ঘুমানো তার কাছে সমান।আরাম করে সোয়া না গেলে আর কিসের ঘুম!একবার ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে কান্ত,পরিশ্রান্ত নয়নজোড়া বন্ধ করলো সে।
কিন্তু দেহ কি আর সেসব নিয়ম মানে।তার অবসন্ন দেহ সোফাতেই মানিয়ে নিল একচোঁট ঘুমিয়ে নেয়ার জন্য।মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে ঘুমে বিভোর হয়ে আসতেই মেয়েলি কন্ঠের মিষ্টি ডাকে আবারো ঘুমন্ত মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো তার।কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ খুলতেই আবছাভাবে তোহাকে দেখতে পেলো সে।তার দিকে ঝুঁকে গিয়ে
নিচু স্বরে ডাকছে তোহা,

—“তিহান ভাই,আপনি খাটে গিয়ে ঘুমান।আপনার কষ্ট হচ্ছে এখানে।”
কপালে ভাঁজ আরো খানিকটা গাঢ় হলো তিহানের।কন্ঠে ধমকের রেশ তুলে সে বললো,
—“তোকে কি আমার কষ্ট হিসেব করতে বলেছি?বেশি কথা না বলে যা তো।জ্বালাস না।”
বলে চোখ বুজতে নিলে তোহা আবারো বলে উঠলো,
—“আমাকে বকা দিচ্ছেন,দেন।তবুও খাটে যেয়ে ঘুমান।সত্যি খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।”
—“তিহু,সিরিয়াসলি আমি চড় বসিয়ে দিবো তোকে।মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু।”
তাদের কথোপকোথন আরো বাড়ার আগেই আফিয়ার কন্ঠ শোনা গেলো।তা শোনামাত্রই তোহা দ্রুত সরে গিয়ে তিহানের থেকে নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে দাড়ালো।সেকেন্ডের মাঝে গলা বাড়িয়ে তিহানকে ডাকতে ডাকতে সেখানে উপস্থিত হলো আফিয়া।ততক্ষনে উঠে বসেছে তিহান।তার চোখজোড়া ঘুমঘুম হলেও বার কয়েক পিটপিট করে পলক ফেলে সেটাকে লুকিয়ে ফেললো সে।গলা ঝেঁড়ে সাবলিল কন্ঠে বললো,
—“বলো মা।কোনো দরকার?”
আফিয়া কিন্চিৎ হেসে বললো,

—“আসলে বাবা,তোহার তো বেগুনে এ্যালার্জি।ইলিশের তরকারি তো ও খেতে পারবেনা।আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম।আর ফ্রিজেও মুরগি টুরগি কেনা নেই যে রেঁধে দিবো।তোর বাবাতো কাল সকালে বাজারে যাবে।
সাড়ে নয়টা বাজতে চললো।ওর ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়।তুই একটু কষ্ট করে ওর জন্য মোড়ের দোকান থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আয়।।”
তোহা এতক্ষন নিরব দর্শকের মতো সব শুনলেও এ পর্যায়ে এসে আপত্তি করে বললো,
—“না না খালামনি।দরকার নেই।আমি এখন এমনেও বাসায় যাবো।বাসায় যেয়েই খেয়ে নিবোনে।চিন্তার কিছু নেই।”
—“তোকে বাসায় যেতে দিলেতো যাবি।তোর মা কে বলে এসেছি আমি,আজকে এখানেই থাকবি।”
তোহা কাতর নয়নে তাকালো।এই ক্লান্ত শরীরে তিহান আবার মোড় পর্যন্ত যাবে বিরিয়ানি আনতে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার।মিনমিনে কন্ঠে আফিয়ার দিকে চেয়ে সে বললো,
—“তিহান ভাইতো খুব ক্লা…”
বলার আগেই তিহান জোরালো কন্ঠে ঝাঁড়ি দিলো,
—“তুই অনেক বেশি কথা বলিস তিহু।চুপ করে বসে থাকতে পারিস না?যওসব” বলে ড্রেসিং টেবিল থেকে মানিব্যাগটা পকেটে ভরে বেরিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললো,
—“আর কিছু খাবি?”
মৃদু গতিতে দু’পাশে মাথা নাড়ালো তোহা।তিহান আর কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে পরলো।তিহান বেরিয়ে যেতেই আফিয়া বসলো তিহানের বিছানায়।তোহাকে পাশে বসিয়ে মূহুর্তেই নানা আলাপে আড্ডা জুড়ে দিলো সে।

কোনোরকম ঠেসেঠুসে একপ্লেট বিরিয়ানি খেয়ে হাঁফিয়ে উঠেছে তোহা।হাত ধুয়ে যেয়ে তিহানের বিছানায় বসতেই তিহান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
—“আবার এখানে কেন?যা তোর জন্য বরাদ্দ রুমে যা।”
তোহা নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে হাই তুলে বললো,
—“খালামনিতো এখানেই আসতে বললো।”
তিহান ভ্রু কুচকে তাকালো।প্রশ্ন করার আগেই আফিয়া এসে বললো,
—“তুই ড্রইংরুমে ঘুমাতে পারবি না তিহান?গেস্টরুমটাতো পরিষ্কার করা হয়নি।ধুলোটুলো জমে আছে।তাছাড়া কাল দেখলাম ফ্যানটাও নষ্ট হয়েছে।”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো তিহান।মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো,
—“পারবো মা।তুমি নিশ্চিন্তে যেয়ে ঘুমাও।”
আফিয়া স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে প্রস্থান করতেই উঠে দাড়ালো তিহান।ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তোহার পাশ থেকে বালিশ নিতে গিয়ে অনেকটাই কাছাকাছি এসে পরলো দুজনে।তোহা থমকালো।শ্বাস আটকে তিহানের দিকে তাকাতেই তার জ্বলজ্বল ঘোর লাগা চাহনীর বিপরীতে দৃষ্টি নেমে গেলো তার।
তিহান আরো একটু কাছে এসে নেশাক্ত কন্ঠে বললো,

—“এমনেও এ ঘরে ঘুম হবেনা আমার।তোমার শরীরের তীব্র মেয়েলি ঘ্রাণটা একদম মস্তিষ্কের নিউরনে গিয়ে ঠেঁকছে।আজ তো নয়ই,বরং আগামী দুইদিনও এ ঘরে ঘুমানো অসম্ভব।একেবারেই অসম্ভব!”
ঘুমহীন চোখজোড়া মেলে রাতজাগা নিশাচর পাখির মতো তাকিয়ে আছে তোহা।সন্ধ্যাবেলা এত ঘুমিয়েছে যে এখন কেনোক্রমেই ঘুম আসছেনা।অনেকক্ষণ যাবত এপাশ ওপাশ করে শেষমেষ উঠে বসলো তোহা।চুলগুলো কোনোরকম পেঁচিয়ে হাতখোঁপা করে বিছানা থেকে নামলো।আসার সময় খোলাচুলে এসেছিলো।বিধায় চুলের কাঁটাটা সঙ্গে আনেনি।খোঁপা আলগা হয়ে আসছে বারবার।
অন্ধকারেই গুটি গুটি পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।ওয়াশরুমের আলো জ্বালিয়ে মুখে তিন চারবার পানির ঝাঁপটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো।মুখ মোছার জন্য কিছু নেই।গায়ের ওড়নাটাও খসখসে জরজেট কাপড়ের।এটা দিয়ে মুখ মুছলে চামড়ায় ঘষা লাগে খুব।ঘরের লাইট জ্বালায়নি,যদি দরজার ফাঁক দিয়ে আলো যেয়ে তিহানের ঘুম ভেঙে যায় এই ভয়ে।মুখ না মুছেই আস্তে করে শব্দহীন ভাবে রুমের দরজাটা খুললো সে।

ড্রইংরুম জুড়ে নীল আলোর ডিমলাইটের ছড়াছড়ি।কেমন ভুতুরে একটা পরিবেশ।বড় সোফাটায় সটান হয়ে শুয়ে আছে তিহান।মাথার পিছের বালিশটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।বালিশের জায়গাটা দখল করেছে তার বামহাত।মাথার নিচে বামহাত দিয়ে শুয়েছে সে।লম্বা দেহ জায়গা হয়নি সোফায়।পা জোড়া সোফা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অনেকটা।তোহা পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।
তিহানের ফর্সা চেহারায় নীলাভ আভাস যেন ক্ষণে ক্ষণে তার অতি আকর্ষনীয় চেহারা আরো বেশি আকৃষ্ট করে তুলছে।খাঁড়া নাক,গালের দাঁড়ি,বামগালের মাঝ বরাবর একটা বাদামী তিল আর তাকিয়ে থাকলে সেই গাঢ় ধুসর চোখের মণি সবমিলিয়ে এক অনন্য স্বপ্নপুরুষ।তোহা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।হাতের তর্জনী দিয়ে হাল্কা স্পর্শে গালের তিলটা ছুঁয়ে দিলো।মেঝের বালিশটা উঠিয়ে অনেকটা ঝুঁকে গিয়ে একহাত তিহানের ঘাড়ে ঢুকিয়ে আলতো করে মাথাটা উঠিয়ে বালিশটা নিচে দিতে নিলেই বাঁধলো বিশাল বিপত্তি।তার খোঁপা খুলে গিয়ে পুরো চুল বিছিয়ে পরলো তিহানের মুখের উপর।মুখ দিয়ে “আ” ধ্বনিটা বের করতে নিয়েও থেমে গেলো তোহা।ঠোঁট কামড়ে ধরে বালিশটা নিচে দিয়ে তিহানের মাথাটা রাখতেই তিহান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

—“চুলগুলো সরা তিহু।…তোকে কি আমি বলেছি বালিশ দিতে?”
তোহা আৎকে উঠলো।হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো কিছু সময়ের জন্য।ঠোঁটটা আরো জোরে কামড়ে ধরে আস্তে করে চুলগুলো সরিয়ে উঠে যেতে নিলেই তিহান তার হাত ধরে আটকে দিয়ে চোখ মেলে বললো,
—“জাস্ট চুলগুলো সরাতে বলেছি।তোকে সরতে বলিনি।”
তোহা হতবিহ্বল বিচলিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।হঠাৎ ভেজা মুখের পানি চুঁইয়ে টুপ করে তিহানের চোখের পাতার উপর পড়তেই ধ্যান ভাঙে তার।চাঁপা গলায় সে বলে,
—“ছাড়ুন।”
তিহান ছাড়ালোনা।বরং পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তোহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চোখের দৃষ্টি আরো খানিকটা গম্ভীর করে বললো,
—“আলমারির বাম দিকের দুই নাম্বার ড্রয়েরে তোর চুলের কাঁটা রাখা আছে।রুমে যেয়েই চুল বেঁধে নিবি।খোলা চুলে ঘুমাবিনা।খবরদার!”বলে তোহার হাতটা ছেড়ে দিলো সে।মাথার বালিশটা ঠি ক করে নিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে বললো,
—“শোন?”
—“বলেন।”
—“চুলে কি শ্যাম্পু দিস,নাকি আ্যালকোহল?”ঘোর লাগা জড়ানো কন্ঠে কৌতুহল নিয়ে বলে তিহান।
তোহা উওর দেয়না।নিরুত্তর ভঙ্গিতে তিহানের বাহুর নিচ থেকে ওড়নার আটকে পরা অংশটা টেনে নিয়ে দ্রুতপায়ে ঘরে যেয়ে দরজা আটকে দেয়।

ঘরে যেয়েই লাইট জ্বালালো তোহা।হাতের মুঠোয় থাকা চাবিটা দিয়ে আলমারি খুলে বামদিকের ড্রয়ারটা খুলতেই নজরে এলো তিহানের বেশ দামি ব্র্যান্ডের কিছু হাতঘড়ির বক্সের ভিঁড়ে খুব যত্নের সহিত একটা চুলের কাঁটা সাইড করে রাখা আছে।কপাল কুঁচকে সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেই মনে পরলো এটা সে হারিয়েছে প্রায় বছরখানেক হবে।তবে কবে হারিয়েছে সেটা মনে নেই।আরো কয়েকবার কাঁটাটা নেড়েচেড়ে দেখে নিয়ে মুচকি হেসে সেটা আগের জায়গায় রেখে দিলো তোহা।এতো যত্নের সাথে রাখা জিনিসটা আবারো নিজের অযত্নের মাঝে হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিটা নিলোনা আর।
আলমারিটা আটকে দিয়ে আশেপাশে তাকায় তোহা।তিহান তাকে বলেছে চুল বেঁধে ঘুমাতে।বলেনি যে এই কাঁটা দিয়েই চুল বাঁধতে হবে।শুধু চুল বাঁধলেই হবে তা সে যাই দিয়েই বাঁধুক না কেনো।চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করে টেবিলে রাখা কলমদানি থেকে দুটো কলম ঢুকিয়ে শক্ত করে তা আটকে ফেলে তোহা।এ কাজে একেবারে পাঁকা হাত তার।সারারাত বালিশের সাথে যুদ্ধ করলেও এ খোঁপা খুলবেনা।”

খিঁচুরির গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো ফ্ল্যাট।সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বা মাঝারি বেগে বৃষ্টি হচ্ছে।সরকারি ছুটিতে কলেজ বন্ধ আজকে।কি দিবস জানি আছে।সকাল সকাল এসে শাওয়ার নিয়ে চুল শুঁকানোর জন্য ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে ফোন নিয়ে বিছানায় বসেছে তোহা।
বাজে প্রায় সাড়ে দশটা।আতিয়ার ভুনাখিঁচুরি বানানো শেষ প্রায়।এখন সে ব্যস্ত ইলিশ মাছ ভাঁজতে।ভুনাখিঁচুরির সাথে ইলিশ ভাঁজা এ বাড়ির সকলেরই প্রিয় খাদ্য।বৃষ্টির দিন হলে প্রায়শই এটা রান্না করে সে।
গরম গরম ইলিশভাঁজা গুলো কড়াইয়ে তুলতে তুলতে সে হাঁক ছাড়লো,
—“তোহা,খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে সাজাতো।”
—“আসছি।”বলে উঠে দাঁড়ায় তোহা।চুল শুকিয়ে এসেছে প্রায়।ঘরের ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে।সবশেষে পিস করে কাঁটা লেবু নিয়ে এসে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠে।দ্রুতপায়ে যেয়ে দরজা খুলতেই দেখে তিহান দাড়িয়ে আছে।পরণে খয়েরি রংয়ের গেন্জি আর কালো ট্রাউজার।চুলগুলো ব্রাশ করা সুন্দরমতো।
—“সর সামনে থেকে।এমন সঙ সেজে দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

তোহা সরে দাড়ায়না।বরং এক একদম এগিয়ে এসে রাস্তা আটকে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠে,
—“আমাকে আপনার কোনদিক দিয়ে সঙ মনে হচ্ছে তিহান ভাই?”
তিহান জ্বালাময়ী হাসি হেসে বলে,
—“আপাতত সবদিক থেকেই।শুনেছিস?এবার সর।নয়তো দেবো এক থাপ্পর।”
—“আপনি কথায় কথায় আমাকে থাপ্পড় দিতে চান কেনো?আমার গালটা কি আপনার নিজস্ব সম্পদ?”
তিহান উওর দেবার আগেই আতিয়া চেঁচিয়ে বলেন,
—“তিহান এসেছে তোহা?ওকে তাড়াতাড়ি টেবিলে বসাতো।খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সেই কখন ডেকেছি”
একরাশ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে পথ ছেড়ে দাড়ায় তোহা।তিহান ধীরগতিতে জুতো খুলে পাশে রেখে এগিয়ে যাওয়ার আগে তোহার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“শুধু গাল নয়,গোটা তুমিটাই আমার নিজস্ব সম্পদ।”বলে আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে হনহন করে হেঁটে টেবিলে যেয়ে বসে সে।
আতিয়া নিজেই এসে তার প্লেটে খাবার তুলে দেয়।তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“তুইও বসে পর।আমার রান্না আছে।ছেলেটা একা বসে খাবে নাকি?”
আতিয়া কথাটা বলতেই তার দৃষ্টির অগোচরে নিজের পাশের চেয়ারটা টেনে দেয় তিহান।আদেশসূচক চোখের ইশারায় তোহাকে সেখানে বসতে বলতেই তোহা বিনা বাক্য ব্যায়ে চুপচাপ সেখানে বসে পরে।
—“তূর্য আর খালু কোথায় খালামনি?
—“তূর্য বোধহয় এখনো ঘুমাচ্ছে।রাত জেগে পড়াশোনা করেছেতো তাই আর ডাকিনি।যখন উঠবে তখন খাবে।আর তোর খালু গিয়েছে কোন কাজে।ছুটির দিনেও তার কাজের শেষ নেই।”
তিহান মৃদু হাসলো।তাদেরকে খাবার দাবার বেড়ে দিয়ে ব্যস্তভাবে আবারো রান্নাঘরে ছুটলো আতিয়া।
বাড়ির কাজে সেই মহিলাটা সাহায্য করে সে আজকে আসেনি।সেজন্যই কাজের ভারটা আজ একটু বেশি।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৭+৮

খুব মনোযোগ দিয়ে ইলিশের কাঁটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে তোহা।সবসময় আতিয়াই তার মাছের কাঁটা বেঁছে দেয়।কিন্তু আজ কাজের চাপে সে সেটা করতে পারছেনা।তোহাও আগ বাড়িয়ে ডাকেনি।অনেকক্ষন বাদে ব্যর্থ হয়ে সে যখন মাছের টুকরাটা সাইডে রেখে প্লেটে ডিম ভাঁজা তুলে নিতে যাচ্ছিলো ঠি ক তখনই অনেকগুলো কাঁটা বাঁছা মাছ তার প্লেটের কোঁণায় রাখে তিহান।তোহা বিস্মিত নয়নে তাকাতেই সে নিজে খাবার চিবাতে চিবাতে বলে,
—“চুপচাপ খাবি।বেশি কথা বলবিনা।”
—“এতগুলো লাগবেনাতো।আমি এত খাইনা।”দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে তোহা।
তিহান একপলক তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“তুই কতটুকু খাস আর না খাস আমার জানা আছে।তোর বলতে হবেনা।তবে এখন প্লেটে যতগুলো খাবার রাখা আছে সবগুলো না শেষ করলে…” এতটুকু বলেই চোখ রাঙায় তিহান।
তোহা কিছুক্ষণ বিরবির করে বাধ্য মেয়ের মতো পুরো খাওয়াটা শেষ করে।তিহান যে এতক্ষন নিজের খাওয়া শেষ করে তাকে পর্যবেক্ষন করছিলো ব্যাপারটা তার নজরেই আসেনি।খাবার শেষে পানির গ্লাস হাতে নিতেই তার মুখের সামনে ইলিশ মাছের বড় একটুকরো ডিম তুলে ধরে তিহান।নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,

—“হা কর।”
এই ডিমটা আফিয়া নিজে তিহানের প্লেটে তুলে দিয়েছিলো।ইলিশ মাছের ডিম তিহানের খুব বেশি পছন্দের তাই।আর এই এতটুকু ডিমই হয়েছে আজকের মাছটায়।তাই সেটা তিহানকেই দিয়ে গিয়েছে আফিয়া।
মুখটা একটু সরিয়ে নেয় তোহা।ইততস্ত কন্ঠে বলে,
—“না,এটা আপনি খান।”
তিহান তার ঠোঁটের সাথে টুকরাটা ঠেকিয়ে ধরে বললো,
—“আমি হা করতে বলেছি।”
—“কিন্তু..”
—“তিহু…”।নিচু কন্ঠেই গর্জে উঠলো তিহান।
এবার ছোট্ট করে মুখ খুললো তোহা।নিমিষেই পুরো ডিমটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো তিহান।অত:পর উঠে দাড়িয়ে হাত ধুঁয়ে এসে আতিয়াকে বলে চুপচাপ দরজার দিকে পা বাড়ালো।

এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ১১+১২