এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২২+২৩

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২২+২৩
কায়ানাত আফরিন

-‘কার সাথে কথা বলছো আহি?’
আমার শিরদাড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো এবার।উনার উত্যপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার ঘাড়ে। অজানা আতঙ্ক আমায় ঘিরে ধরলো এতে।মানুষটা আনভীর ছাড়া আর কেউই না। এর আগে বাবার সাথে কথা বলেছি বিধায় আমার সাথে কি জঘণ্য আচরণটাই না করেছিলো। এবার যদি জানে যে চাচি ফোন দিয়েছে, তাহলে কি করবেন উনি?

আমি হালকা ঘাড় ঘুরালাম উনার দিকে। ফোনটা ইতিমধ্যে কান থেকে নামিয়ে কেটে দিয়েছি। উনি শান্তভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আমার কাজগুলো। চোখে সন্দেহের আভাস। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-‘ক-কোচিংয়ের এ-এক ফ্রেন্ড কল দিয়েছে পড়ার জন্য।’
-‘ওহ্ !’
উনি ছোট করে এই প্রতিউত্তরটি দিলেও কেনো যেন আমায় পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না। চোখে এখনও সন্দেহের আভাস রয়ে গিয়েছে।তবুও কিছু না বলে উনি চলে গেলেন রুমের ভেতরে। কাবার্ড থেকে ট্রাউজার আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘আমার জন্য চা বানিয়ে লাইব্রেরি রুমে নিয়ে আসো।’
আমি মাথা নাড়াতেই উনি ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবার।এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো যে আমার বুকে কেউ চাপা পাথর দিয়ে রেখেছে। বুকের হার্টবিট আমার অনেক বেড়ে গিয়েছে উনার ভয়ে। কেননা আনভীরের ভয়ংকর রাগ সম্পর্কে আমি অবগত। উনি রেগে গেলে কি থেকে কি করে ফেলবেন তা উনি নিজেও জানেন না। আমি স্ক্রিনে দেখতে পারছি যে চাচি বারবার কল দিচ্ছে আমায়। আমি এবার তপ্তশ্বাস ফেলে মোবাইলটা সুইচড অফ করে ফেললাম। অপূর্ব ভাইয়ার নামটাও শুনতে ইচ্ছে করছেনা। এবারের মতো আল্লাহ বাচিয়ে দিয়েছে আমায় আনভীর থেকে !!তবে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকতে হবে।

চায়ের কাপ নিয়ে আস্তে করে লাইব্রেরির দরজা খুললাম।দেখি আনভীর স্টাডি টেবিলে বেশ কয়েকটি থিওরিটিক্যাল কাগজপত্র নিয়ে বসেছেন। চোখে বরাবরের মতোই খয়েরি রঙের চিকন ফেমের চশমা। গম্ভীর দৃষ্টিতে একবার ল্যাপটপ দেখছেন তো একবার কাগজপত্রে কিসব যেন লিখছেন। আমি চায়ের কাপ কাগজগুলো থেকে এক নিরাপদ দুরত্বে রেখে বললাম,
-‘এই নিন আপনার চা।’
-‘থ্যাংক ইউ।এবার রুমে গিয়ে পড়তে বসো।’

উনি আমার দিকে না তাকিয়েই কথাটি বললেন। আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো এতে। সারাদিন মুখে পড়া কথাটি যেন ব্যাটায় ক্লুপ দিয়ে আটকে রেখেছে। ডানে গেলেও পড়া , বামে গেলেও পড়া।আমি মুখ ফুলিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখনই উনার স্টাডি টেবিলের এক প্রান্তে কয়েকটা বইয়ে চোখ গেলো আমার। আমি চোখ কুচকে দেখলাম সেদিকে। আমার সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনভীর মাথা উঠিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,

-‘কি ব্যাপার আহি? যাচ্ছো না কেনো?’
আমি উনার কথায় পরোয়া না করে উনার একপাশ থেকে একটি বই হাতিয়ে নিলাম তৎক্ষণাৎ। অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘আপনি প্রেমের উপন্যাস পড়েন কবে থেকে?’

বিব্রত হয়ে পড়লেন আনভীর। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এইতো একটা সুযোগ পেলাম উনাকে টাইট দেওয়ার। সবসময় নিজের আজগুবি কথা দিয়ে আমায় পাগল করা ; তাইনা? আজ দেখবেন আহি কি জিনিস। আমি বুকশেলফে হেলান দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে। বিদ্রুপ স্বরে বললাম,
-‘আমি তো ভাবতাম আপনার মাথায় ম্যাথ ছাড়া কিছুই ঢুকেনা, এদিকে সবার অগোচরে প্রেমের উপন্যাস পড়া হয় তাই না? তলে তলে এত কিছু?’

-‘আজব তো ! আমি কি লুকিয়ে প্রেম করছি? এটা জাস্ট উপন্যাস। আর এগুলো আমি ভার্সিটি লাইফে কিনেছিলাম। এখন পড়াও হয়না।’
-‘তাহলে টেবিলে রেখেছেন কেনো?’
আমার সন্দিহান কন্ঠ। উনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আমি বললাম,

-‘থাক্ থাক্, আপনি তো আবার সবার কাছে এক্সপ্লেইন করেননা। তাহলে পড়বেন উপন্যাসগুলো কেমন? নিজের জন্য না হলেও আমি চলে গেলে ভবিষ্যত বউয়ের জন্য পড়বেন। আমারে তো পড়াতে পড়াতে ঝালাপালা করে ফেলেছেন। এখন আগামী বউ যদি দেখে বর এতো আনরোম্যান্টিক তাহলে তো আর কথাই নেই।’
আমার মুখে ভবিষ্যত বউয়ের কথাটি শুনে উনার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এবার।

আমি সেসব দেখে একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে যেতেই উনি হাত টান দিয়ে আচমকা নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন আমাকে। আমার শরীর নিমিষেই গরম হয়ে গেলো উনার উষ্ণ শরীরের স্পর্শ পেয়ে। উত্তেজনায় রীতিমতো আমি বাকরুদ্ধ । আমার হার্টবিট এত দ্রুতই ফাস্ট হচ্ছে যে আমি নিশ্চিত , আনভীর শুনতে পারবেন। আনভীর প্রখর চাহিনী নিবদ্ধ করেছেন আমার তটস্থ মুখে।

এতদিন আমায় ঠোঁট কামড়ানোর ব্যাপারে শত থ্রেড দিলেও আজ অসভ্য লোকটা নিজেই ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। উনার এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ আমার মনে সুপ্ত বাসনা জেগে উঠলো। কেমন যেন ঠোঁট খাওয়া ফিলিং টাইপ ব্যাপারটা কাজ কযছে। আচ্ছা উনি কি তাহলে এজন্যই বলতেই এই অভ্যাসটা ত্যাগ করার জন্য? আমি এসব ভাবছিলাম এর মধ্যে উনি আমার কানের কাছে গম্ভীর ফিসফিসালো কন্ঠে বললেন,
-‘বারবার ভবিষ্যত বউয়ের কথা বলছো কেনো আহি? আই ডোন্ট লাইক দিস।’
আমি শুকনো ঢোক গিললাম। বললাম,

-‘আমি চলে গেলে একদিন না একদিন আপনাকে তো বিয়ে করতেই হবে। তাই তো ওসব বলছিলাম।’
উনি স্মিত হাসলেন। আমার কানে আরও মিহি কন্ঠে বললেন,
-‘ফাইন। আমি যেহেতু আনরোম্যান্টিক তাই ভবিষ্যত বউয়ের প্রবলেম হতে পারে এটাইতো বললে তুমি তাইনা? সুতরাং আমার উচিত প্রেজেন্ট বউটার সাথে একটু রোম্যান্সের প্র্যাকটিস করা যাতে পরে প্রবলেম না হয়। তাহলে রেডি তো মিসেস প্রেজেন্ট ওয়াইফ?

আমি বিস্ফোরিত নয়নে স্থির হয়ে রইলাম উনার কথা শুনে ৷ শরীরের নড়াচড়া কেমন যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনভীর এখনও আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে রাখাতে আমি মোটেও নড়াচড়া করতে পারছি না। আমি আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবো তখন হঠাৎ দরজা খুলে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়লো শিউলি ভাবি। আনভীর তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলেন আমায় যার জন্য আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম । শিউলি ভাবি চোখ বন্ধ করে বললেন,
-‘উপসস! রোম্যান্স করার জন্য আর জায়গা পাওনি তোমরা? আমি জানলে তো আসতামই না। আমি গেলাম, তোমরা চাইলে কন্টিনিউ করতে পারো।’

আমি আর আনভীর চরম অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছি এখন। ভাবি চলে যাওয়ার পর আনভীর ধমকের সুরে বললেন,
-‘তোমার জন্য হয়েছে সব। আমায় না রাগালেই তো পারতে।সবসময় মাথায় আমায় নিয়ে আজগুবি চিন্তা ঘুরে তাইনা? এখন পড়তে যাও!’
শেষ কথাটা উনি একটু জোরে বলাতে মুখ ফুলিয়ে চলে গেলাম আমি। লাইব্রেরির দরজাটাও লাগালাম সজোরে। ব্যাটা অসভ্য কোথাকার! নিজে তো আমার সাথে উল্টাপাল্টা কাজ করে আর এখন আমায় ধমকাচ্ছে। এর মধ্যে আবার শিউলি ভাবিও দেখে ফেললো এমন দৃশ্য। ধ্যুর! ভাল্লাগে না!

সকালটা পড়াশোনা দিয়েই কাটানোর চেষ্টা করছি। আগামীকাল মেডিক্যাল এডমিশন এক্সাম। দিনগুলো কেমন যেন চরকার মতো ঘুরে গেলো। সেই সমপরিমাণে চিন্তাটাও বেড়ে গেলো আমার। কিন্ত পরীক্ষার চিন্তা থেকে আনভীরের বর্তমানের ব্যবহারগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। আমার কেয়ার করা , চিন্তা করা, সবকিছুতে দৃষ্টি রাখা, ওভার পজেসিভ ফীল করা এগুলো অন্য সবার কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও আভার কাছে স্বাভাবিক নয়।

একে তো উনার সাথে আমি চুক্তিতে আবদ্ধ। যতই হোক, ছয় মাস পর আমি উনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। তবে কেনো এভাবে আমার প্রতি এরূপ আচরণ কযছেন উনি? আমি ভেবেছিলাম পরীক্ষাটি দেওয়ার কিছুদিন পরই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো কিন্ত তা কি সম্ভব আদৌ?
পড়ার সময় আমার ধ্যান অন্যদিকে থাকায় টেবিলে হাত দিয়ে একটা শব্দ করলেন আনভীর। আমি চমকে উনার দিকে তাকালাম এর জন্য। আনভীর শার্ট প্যান্ট পড়ে পুরো অফিসিয়াল লুকে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্ভবত উনার ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আমার দিকে তেজি গলায় বললেন,

-‘পড়ার সময় ধ্যান কোথায় থাকে তোমার?’
-‘আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। সেটার উত্তর পেলেই আমি আর ধ্যানমগ্ন হবো না।’
আমি তৎক্ষণাৎ বলে ফেললাম। আনভীর সরু চোখে তাকালেন এতে। বললেন,
-‘কি প্রশ্ন?’
-‘আমি কি আপনার কাছে শুধুই একটা দায়িত্ববোধ আনভীর?’
আনভীর ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বলে ওঠলেন,
-‘সবসময় মাথায় এমন আজগুবি জিনিস ঘুরে তোমার তাইনা? আজ বাদে কাল পরীক্ষা আর তুমি এসব কি ব্লাডি ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছো?’

-‘আমি জানতে চাই আনভীর?’
আমি জোড় গলায় বললাম। আনভীর এবার প্রতিউত্তর দিলেন,
-‘এসব এসব কথা বাদ দাও আহি। কাল পরীক্ষা। সেটাতে কনসানট্রেট করো।এ ব্যাপারে তোমার না জানলেও চলবে……….’
-‘আমি কি শুধুই আপনার দায়িত্ববোধ নাকি অন্যকিছু?’
উনাকে কথা বলতে না দিয়ে আমি আবারও প্রখর কন্ঠে বললাম।আনভীর বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘তুমি আমার জাস্ট দায়িত্ববোধ , ওকে? পেয়েছো তোমার উত্তর?’
আমি ঠোঁট চেপে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। আনভীর বইটা আমার আরও কাছে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘এখন এসব হাবিজাবি বাদ দিয়ে আবারও বলছি পড়াশোনায় মন দাও। আমার ভাবনা দিয়ে তোমার লাইফ দাঁড়াবে না, বরং তোমার চেষ্টা দিয়েই তোমার লাইফ উজ্জল হবে।’
বলেই হনহন করে চলে গেলেন উনি। আমি তপ্তশ্বাস ফেলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উনার কোনোরূপ কোনো অনুভূতির দরকার নেই আমার, না দরকার সিমপ্যাথির। আমি এখন আমার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছি, হ্যা চলে যাবো আমি মামুর কাছে।

দুপুরে ডায়নিং টেবিলে নুড়ী আপার সাথে আমি গল্প করছি। আসলে সকালে অনেকক্ষণ পড়া রিভাইস করার পর মাথাটা একটু ধরে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে আমি রান্নাঘরে কাজ করতে গেলে মা সাফ মানা করে দেয় আমায়। বলে এখন এসব কাজ করতে হবে না। উনার ব্যবহারে প্রতিবারই মায়ের এক মমতাময়ী স্বাদ অনুভব করাতে আমার ভালোলাগছে। কথার একপর্যায়ে হঠাৎ মা এসে বললো,

-‘আহি, আনভীরের কাবার্ডে তোমার বাবার একটা স্যুট আছে ওটা একটু কষ্ট করে আমার রুমে নিয়ে আসো তো?’
-‘কি রঙের?’
-‘নীল।’
আমি মাথা চুলকে বললাম,
-‘মা ! কাবার্ডে তো তিনটা স্যুট দেখেছিলাম ।এখন বাবার কোনটা তা তো আমি জানিনা।’
মা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
-‘আচ্ছা আমিও আসছি।’

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২১

বলেই আমার পিছু পিছু মা এসে পড়লেন। ভ্যাপসা দুপুর। পশ্চিমা রোদ থাই গ্লাস দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে ঘর উত্যপ্ত করে তুলেছে। আমি কাবার্ড খুলে মাকে দেখালাম যে কোনটা বাবার স্যুট। উনি স্যুটটা নির্বাচন করতেই আমি হ্যাঙ্গার থেকে সেটা নামিয়ে ফেলি। সেই সময়ে কাবার্ডের একপাশ থেকে একটা পেপার পড়ে গেলো মেঝেতে। আমি সেদিকে তাকাতেই শরীরে ভয় ঢুকে গেলো আমার।

কেননা আমাদের এগ্রিমেন্ট পেপার ছিলো এটি। যা এতদিন আমার কাছে থাকলেও এক সপ্তাহ আগে আনভীর নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। মা এগ্রিমেন্ট পেপারটা উঠিয়ে শীতল দৃষ্টিতে পড়তে থাকলেন সেটি। সবটুকু পড়ে উনি হতভম্ব। নিজের ভারসাম্য ভেঙে খাটে বসে পড়লেন। আমি ধরতে গেলেও উনি ধরতে দিলেন না আমায়। আমি বুঝে গিয়েছি যেই এগ্রিমেন্টের ব্যাপারটা শুধু আমার আর আনভীরের মধ্যে ছিলো তা পুরোটাই উনার নখদর্পনে এখন। ভয় লাগছে আমার। এমনিতেও উনি অসুস্থ মানুষ। তারওপর এতসব জেনে কি প্রতিক্রিয়া করবেন এখন?

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৪