এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৪

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৪
কায়ানাত আফরিন

-‘তুমি আর আনভীর এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী একসাথে থাকছো?’
মা শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আমায় । আমার মুখ থেকে আতঙ্কে কোনোরূপ কোনো কথা বেরিয়ে আসছে না উনার এমন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখে। মা তাই আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আমি তোমায় প্রশ্ন করেছি আহি? উত্তর দাও?’

আমি তবুও কথাটি এড়ানোর প্রসঙ্গে বললাম,
-‘মা , এখন এসব কথা থাক না? উনি আসলেই নাহয়……….’
-‘আমি তোমায় যা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দাও।’
থমথমে গলায় বলে ওঠলেন মা। আমি এবার হাল ছেড়ে দিলাম কথাটি এড়ানোর জন্য। উনি সবটা জেনেই গিয়েছেন। শুধু আমার মুখে শুনতে চাচ্ছেন সেই কঠিন সত্যটা। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
-‘হ্যাঁ মা। আমরা এগ্রিমেন্টের মোতাবেকই একসঙ্গে থাকছি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মায়ের চোখ দিয়ে টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। সেই সাথে তোলপাড় করে ওঠলো আমার হৃদয়। কেননা এই শক্ত মানুষটিকে আজ প্রথম কাদতে দেখেছি। আমি হাটুগেড়ে বসলাম উনার কাছে। হাত ধরার চেষ্টা করতেই উনি বলে ওঠলেন,
-‘খবরদার ! আমায় ষ্পর্শ করবেনা। তোমরা দুজন প্রতারণা করেছো আমাদের সাথে, তোমার পরিবারের সাথে, এমনকি নিজেদের সাথেও।’
আমি নীরব। মা আবার বললেন,

-‘তোমরা দুজন যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো একবারও বড়দের জিজ্ঞেস করলে না যে এটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আমিতো ভেবেছিলাম তোমাদের বিয়ে দুর্ঘটনার জন্যে হলেও হয়তো ভাগ্যকে মেনে নিয়েছো। কিন্ত ভুলধারনা ছিলো এটা আমার। কিভাবে পারলে এত বড় একটা নাটক সাজাতে? আরে আমার কথা বাদ দাও। তোমরা একটাবার কি ভেবেছো যে তোমাদের বাবারা ঠিক কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে তোমাদের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো?

যেখানে তোমার পরিবারই তোমার আর আনভীরের ব্যাপারে বিশ্বাস করেনি সেখানে আনভীরের বাবা শুধুমাত্র তোমাদের মানসম্মান বাচানোর জন্য , তোমায় কটুক্তি থেকে বাচানোর জন্য বিয়ে করিয়েছিলো আনভীরের সাথে। শুরুতে উনার তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত আমার মেনে নিতে কষ্ট হলেও তোমাদের দুজনের ওপর পূরয়ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন উনি। আর তোমরা কি করলে? একটাবার যদি উনি জানেন যে তোমরা ছয় মাসের জন্য চুক্তিবদ্ধ স্বামী স্ত্রী তাহলে ভেঙে যাবেন। মেনে নিতে পারবেন না তোমাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা।’

মায়ের প্রতিটা কথাই আমার হৃদয়ে তীরের মতো বিধঁছে। কথাটি সত্য একজন মা যেন সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসতে পারে তেমনি নিজের ক্ষত প্রকাশের মাধ্যমেও কষ্ট দিতে পারে। আমাদের এই সিদ্ধান্তে মা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন নিজের। তাছাড়া উনার প্রতিটা কথাই তো সত্য। আমরা তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছি সবার সাথে।

পুরো ঘর জুরে পিনপন নীরবতা। মায়ের অশ্রুসিক্ত লালচে চোখ দেখে ভালো লাছে না আমার। তারওপর আনভীরের ব্যবহারগুলো স্মৃতিচারন হতেই আমার মন-মস্তিষ্ক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। বারবার কানের কাছে উনার বলা শেষ কথাটি বেজে উঠছে যে আমি শুধুমাত্র উনার দায়িত্ববোধ ! জাস্ট একটা দায়িট্ববোধ।
আমি নীরবতা কাটালাম এবার। বললাম,

-‘এগ্রিমেন্টের সিদ্ধান্ত আনভীরের ছিলো মা। আমার না আমিও শুরুতে চেয়েছিলাম উনার সাথে কো-অপ করতে তবে আমি পারিনি উনার ভয়ঙ্কর রাগের শিকার হয়ে।’
আমি তারপর একে একে সব খুলে বললাম মাকে।বলতে বাধ্য হলাম। কেননা আনভীরের করা একটি কঠিন সিদ্ধান্তের কাছে আমি নত থাকলেও মাকে আমি কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। আমাদের প্রথম দিনের এগ্রিমেন্টের ব্যাপার, উনার ভয়ঙ্কর রাগে বলা কথাগুলো, আমায় মানসিকভাবে চাপে রাখা সবকিছু। মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন আমার কথা শুনে। কেননা উনি ভাবতে পারেননি যে আনভীর আমার প্রতি এতটা নির্দয় হবেন। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,

-‘ আমি আনভীরের এসব ব্যবহার জাস্ট নিতে পারছি না মা। আমিও তো একটা মানুষ! অন্য চার-পাঁচজনের মতো রক্তমাংসে গড়া মানুষ। কিন্ত আমার সাথে কি হলো? আমার জন্মদাত্রী মা আমায় ছেড়ে চলে গেলো, বাবা আমিয় বোঝা মনে করে চাচার কাছে ফেলে রাখলো, চাচি আমায় কাজের বুয়ার প্রয়োজনে নিজের কাছে রাখলো,বরপক্ষরা নিজের মানসম্মান বাচানোর জন্য আমার সাথে বিয়ে ভেঙে দিলো, বাবা আপনার আর আপনাদের মানসম্মান বাচানোর জন্য আনভীরকে জোর করে আমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলো আর সবশেষে উনিও ছয় মাস আমার সাথে পরিবারের খাতিরে থাকবেন বলে মনোস্থির করলেন।

কেউ কি একটাবারও জিজ্ঞেস করেছে যে আমি কি চেয়েছি?আমার ইচ্ছেটা কি? কেউ একটাবারও জিজ্ঞেস করেনি, সবাই শুধু পুতুলের মতো আমায় ইউজ করে গিয়েছেন নিজ স্বার্থে।’
প্রত্যেকটা কথা বলার সময় আমি কেপে উঠছিলাম। গলা দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে আসছিলো না। মা স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। উনার দৃষ্টিতে একরাশ নির্মলতা। যেন আমার বহু বছরের আপন কেউ। আমি আবার বললাম,

-আমি কারও দায়িত্ব হতে চাই না মা। কারও ভালোবাসা হতে চাই। আফসোস! সেই সৌভাগ্য আমার নেই।কেননা আনভীর যা করছেন সব করছিলেন দায়িত্বের জন্য, ভালোবাসার জন্য নয়। আমি আর কারও সিমপ্যাথি চাচ্ছি না মা। আমি অনেক ট্রাই করেছি উনার মন বুঝার। যতবারই মনে হয়েছিলো যে উনি বোধহয় আমায় ভালোবাসেন ততবারই উনি আমার চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।তাই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এগ্রিমেন্টের আগেই আমি চলে যাবো আনভীরের কাছ থেকে।’

আমি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে এবার তাকালাম মায়ের দিকে। অজান্তে অনেক কথাই তো বলে ফেললাম মাকে, উনি এখন ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সেটাই আমার জানার বিষয়। মা এবার আড়ষ্ট কন্ঠে বললেন,
-‘চলে যাও তাহলে আহি!’

আমি চমকে গেলাম উনার কথা শুনে। কেননা আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো আটকাবেন আমায়। একজন এজ ইউজুয়াল গুরুজনদের মতো আমার এ সিদ্ধান্তকে বাচ্চামো মনে করবেন। কিন্ত উনার এই সম্মতিসূচক ব্যবহার অবাক করেছে আমাকে।উনি এবার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
-‘অবাক হয়েছো যে আমি তোমায় যেতে বললাম কেন?’
-‘একটু হয়েছি।’
উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

-‘শোনো আহি! তুমি একটু নরম ধরনের মেয়ে। কেউ কোনো কথা বললে তার সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে পারো না তুমি। আমি জানি মূলত পারিপার্শ্বিক কারনেই তুমি এতটা নরম। তবে তোমায় আরও শক্ত হতে হবে আহি। তুমি কি জানতে চাও যে তোমার প্রতি আনভীর ঠিক কেমন অনুভব করে?’
-‘শুরুতে কৌতুহল ছিলো, কিন্ত সেটা মিটে গিয়েছে।’
আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম। মা গম্ভীর হলেন এবার। বললেন,
-‘আমি যদি তোমায় একটা সুযোগ করে দেই?’
উনার কথার ধরনটি ঠিক বুঝতে পারিনি আমি।তবে মনে হচ্ছে খুব গভীর একটা বিষয় তিনি ভেবে রেখেছেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-‘মানে?’

-‘আনভীর তোমার প্রতি যা করেছে তার সাথে আমি মোটেও একমত নই। আর আমি চাইবোও না যে তোমরা আলাদা হয়ে যাও। তবে আনভীরকে অবশ্যই তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে৷ নিজের ইগোর জন্য কিভাবে সে পারলো বিয়ে নিয়ে ছেলেখেলা করতে? তাই বলবো, হ্যা্, চলে যাও তুমি আহি। আনভীর থেকে অনেক দূরে চলে যাও। ওর বুঝতে হবে যে ও কত্তো বড়ো ভুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তোমায় দূরে সরিয়ে।’
আমি মৌনতা বজায় রাখলাম। ভেবে নিয়েছিলাম নিজের ছেলের এ কাজের জন্য হয়তো তিনি চরম কষ্ট পেয়েছেন। সেই সাথে জন্মেছে আমার প্রতি অগাধ মায়াও। তাই হয়তো আমার এ সিদ্ধান্ত শুনে তিনি বিচলিত হননি। আমি গম্ভীর হয়ে এলাম এতে। এমন একজন মমতাময়ী মা পেতে পেতেও হারিয়ে ফেললাম যে!

দুপুরে মা চলে যাওয়ার পর একটা লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিলাম শরীরটা রিফ্রেশ করার জন্য। আমার ভুলে গেলে চলবে না আগামীকাল পরীক্ষা আমার। তাই খাওয়া দাওয়া সেরে একমনে টেবিলে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছি আমি। সচরাচর মেডিক্যাল এডমিশন এক্সামের অনেক বড় বড় গাইডবুক থাকে।সেগুলো রিভাইস করা আমার কাছে বেশ সময় সাপেক্ষ ছিলো।

সন্ধ্যার পর বাড়িতে আসলেন আনভীর। হালকা ফ্রেস ট্রেস হয়ে আমার টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে আমায় বই থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পড়া জিজ্ঞেস করলেন। আমি উনার সাথে পড়া ব্যতীত কোনো কথা বললাম না আর। এটাও বললাম না যে মা আমাদের ব্যাপারে সবটা জেনে গিয়েছেন। কেননা মা না করে দিয়েছেন এসব বলতে। আমায় এতটা মৌনতা বায় রাখার ব্যাপারটা আনভীর খেয়াল করেছেন , তবুও কিছু বললেন না। এককথায় এমন এক ভাব দেখালেন যে আমার এসব ব্যাপারে উনার কিচ্ছু আসে যায় না। একপর্যায়ে উনি বললেন,

-‘প্রিপারেশন মোটামোটি তোমার ভালোই আছে। এখন খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ো। কারন পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াটা কখনোই ভালো ফল আনেনা।’
আমি কাঠপুতুলেন ন্যায় বই বন্ধ করে চলে গেলাম খাটে। গম্ভীর স্বরে বললাম,
-‘আমি খাবোনা। এখন প্লিজ ডিস্ট্রাব করবেন না।’

আনভীর নীরব দর্শকের মতো আমার কাজকর্ম দেখলেন। কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। হয়তো অন্যসময় হলে আমায় ধমকে পাঠাতেন খাওয়ার জন্য । তবে আজ আমন কিছুই করলেননা। না করেই ভালো হয়েছে। উনার এসব ছোটোখাটে কেয়ারিং,,,,,,ওপস! ভুল বললাম , দায়িত্ব আমায় জর্জরিত করে ফেলছে। এখন আমার একটাই ইচ্ছা, দূরে চলে যাবো আমি এই মানুষটা থেকে । অনেক দূরে।

আনভীর লাইট বন্ধ করে খাটে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন এবার। বরাবরেই মতোই আমাদের মাঝখানে এক কোলবালিশ। আমার ঘুম আসছে না চিন্তায়, উদ্রেকে, উত্তেজনায়। হতাশা আর বিভ্রান্তি সবকিছু আমায় কেমন যেন ঘিরে ধরেছে। আমি মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে।উনি আমার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছেন। আমি ঠোঁট দিয়ে নিজের জিভ ভিজিয়ে উনার ডাকার চেষ্টা করলাম। বললাম,

-‘আনভীর?’
আমার দিকে না কাত হয়েই উনি বললেন,
-‘ঘুমাও এখন।’
-‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই আপনাকে?’
-‘বললাম না ঘুমাতে?’

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২২+২৩

এবার থমথমে গলায় বলে ওঠলেন উনি। আমার উনার এধরনের ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট লাগছে। এইতো গত দু’রাত আগে আমায় শাস্তিস্বরূপ নিজের কাছে টেনে ঘুমাতে বলেছিলেন আমাকে। আর আজ এত দুরত্ব? উনি যে ঠিক কি চান আি নিজেও জানিনা। সবসময় আমায় পড়ার মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন।বলেন নিজেকে স্বাবলম্বী হতে। কিন্ত এসব আর নিতে পারছি না আমি। তাই আবার বললাম,

-‘এটাই আমার শেষ প্রশ্ন আনভীর? প্রমিস কখনোই আর আপনাকে বিভ্রান্ত করবো না।’
উনি একটা লম্বা সময় নীরব ছিলেন। আমি কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
-‘আচ্ছা আমি কি আপনার কাজে শুধু দায়িত্বই রয়ে যাবো?’
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি রাজি নই। ঘুমাও তো ! পরীক্ষার কথা বাদ দিয়ে কিসব বলছো।’
-‘প্লিজ বলুননা উত্তরটা?’
-‘হ্যাঁ। আমার উত্তর হ্যাঁ। নাও হ্যাপি? লেট মি স্লিপ।’

বলেই উনি কম্বল দিয়ে আপাদমস্তক শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে নজর দেওয়ারইচ্ছেপোষণও করলেননা উনি। আমিও তাই অন্য কাত হয়ে পড়লাম। চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশু বেয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। যেদিকে একজন নরমাল মেডিক্যাল এক্স্যামিনার পরীক্ষার টেনশনে ক্লান্ত সেদিকে আমি ক্লানয়ত হতাশায়। অনেক হয়েছে, অনেক সুযোগ দিয়েছি উনাকে। তবে এবার আমি উনার সো কল্ড দায়িত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে দিবো।পরীক্ষা দেয়ার পর চলে যাবো এ বাড়ি থেকে। ভুলে যাবো আমার জীবনের আনভীর নামক অধ্যায়টিকে!!

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৫