এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৭

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৭
কায়ানাত আফরিন

অপূর্ব ভাইয়া কথাটা আর শেষ করতে পারলো না , মাঝপথে কেউ তাকে ঘুষি মারতেই ভাইয়া ছিটকে পড়ে গেলো নিচে।আমি কাদতে কাদতে হিচকী তুলে ফেলেছিলাম কিন্ত হঠাৎ আমার সামনে দাঁড়ানো অবয়বটিকে দেখে আমার হাত পা নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে। আনভীর দাঁড়িয়ে আছেন উদ্ভ্রান্ত অবস্থায়। অপূর্ব ভাইয়ার আমার সম্পর্কে সেই নোংরা কথাগুলো শুনে আনভীর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। উনি তাই এবার এগিয়ে পুনরায় এলোপাথারি মারতে থাকলেন ভাইয়াকে।আমি স্তব্ধ। মনে হচছে যে এসব কিছু স্বপ্ন। কেননা আনভীরকে এতটা হিংস্র আমি কখনোই হতে দেখিনি।

অপূর্ব ভাইয়ার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে আমি চিৎকার করে বলে ওঠলাম,
-‘আনভীর….প্লিজ থামুন !’
নিজের হিতাহিতজ্ঞান ফিরে পেয়ে আনভীর ধপ করে নিচে বসে পড়লেন আহত অপূর্ব ভাইয়ার কাছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলেন উনি। চোখে-মুখে এখনও সীমাহীন রাগের আভাস। শুধু পারছেননা এই সামনের মানুষটাকে মেরে হাত-পা গুটিয়ে ফেলতে। অপূর্ব ভাইয়াও যে কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি এমন কিন্ত না। সেও সমানতালে আঘাত করেছে উনাকে। কিন্ত উনার প্রথম আঘাতটি যেহেতু একটু জোরালো ছিলো তাই তেমন কিছু একটা করতে পারেনি। আনভীর এবার নিজের রুদ্ধশ্বাস আটকে বলে ওঠলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘কি বলেছিলে তুমি অপূর্ব? আহি নিচ মানুষ? এই কথাটা এবার বলে ফেলেছো তবে নেক্সট টাইম এটা মনেও আনবে না।নাহলে এর চেয়েও খারাপ অবস্থা করবো আমি তোমার।’
অপূর্ব ভাইয়াও ফ্লোরে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। নাকের কাছে রক্ত জমাট বেধে পড়ে আছে ভয়ংকরভাবে। আনভীর এবার ওর এই অবস্থা দেখে বিদ্রুপ হাসি হাসলেন। বললেন,

-‘সেদিন আমার সাথে দেখা করে কি বলেছিলে তুমি? তুমি ওর ভালোবাসার মানুষ? ভালোবাসার মানুষ হলে কিভাবে পেরেছিলে ওকে আঘাত করতে , কিভাবে এখন পারলে ওকে নষ্টা মেয়ে বলতে? হ্যাঁ , আমি মানছি সেদিন আমি বলেছিলাম তুমি চাইলে আহিকে নিয়ে যেতে পারো যদি ও তোমায় ভালোবাসে।ওয়ান্স এগেইন আই রিপিট , যদি ও তোমায় ভালোবাসে তাহলে। নাহলে ওকে জোর করার তোমার কোনো অধিকার নেই।

আর তুমিও ভালোমতো বুঝতে পেরেছো আহি তোমায় ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই করেনা। তাহলে এমন পাগলামির মানে কি? আমি যেখানে আমার ক্লাসমেটের সাথে ওকে দেখতে পারিনা সেখানে তুমি ভাবলে কিকরে তোমার পাগলামির জন্য ওকে আমি নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবো?আর তুমি আরও কি বললে? চেনা নাই জানা নেই হুট করে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো তাই তুমি মানতে পারছো না যে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক তাইতো?

লিসেন , আশপাশে ভালোমতো চোখ খুলে দেখো , সমাজে এমন অনেক বিয়ে আছে যেগুলো অপরিচিত দুজনের মধ্যে প্রেম ছাড়াই হয়েছে। তাহলে আমাদেরটা তুমি মানা বা না মানার তো কেউই আমার কাছে মনে হয় না।………….আমি আহিকে বিয়ে করেছি অপূর্ব , তিন কবুলের মাধ্যমে আমাদের বিয়ে হয়েছে। সুতরাং আহি আমার স্ত্রী আর আমি ওর স্বামী। আমি ওকে ভালোবাসি কি-না সেটা তোমার না জানলেও চলবে , শুধু এতটুকু জেনে রাখো ওকে আমার চাই-ই চাই , মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের সাথে আগলে রাখতে চাই। পেয়েছো তুমি তোমার উত্তর?’

অপূরব ভাইয়া কতটা অবাক হলো সেটা আমার অজানা কিন্ত উনার এমন কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে আমার সর্বাঙ্গে শীতল হাওয় প্রবাহিত হচ্ছে। উনার কথাগুলো নুপুরের ন্যায় বেজে উঠছে আমার মস্তিষ্কতরঙ্গে। আনভীর কি বললেন এটা? উনি,,,,,,,,,,,সত্যিই আমায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের কাছে আগলে রাখতে চান?

অপূর্ব এবার কিছু বলতে গিয়েও বললো না। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে অতীতে আমি অসহায় থাকলেও এখন আমার সাথে দাঁড়ানোর জন্য একজন আছে যে ছায়ার মতো আগলে রাখবে আমায়। আনভীর এবার উঠে দাঁড়ালেন। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। আমার কাছে হাটু গেড়ে ঝুঁকে সপ্রতিভ গলায় বলে ওঠলেন,
-‘ড্রাইভারের সাথে এসেছো বলেই সময়মতো এখানে এসেছি আমি। নেক্সট টাইম এক পাও আমায় ছাড়া নড়বে না। এক পাও না।’

বলেই উনি হুট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আমি যেন এখন এক নির্জীব বস্ত। সকল অনুভূতি আকাঙ্খা কেমন যেন মনের সুপ্তকূপে জমে আছে। আমি একঝাঁক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম আনভীরের দিকে। কেননা এই আনভীরের সঙ্গে আমি অবগত নই। উনার চোখে ঝড়ের ন্যায় বিস্ফোরিত হচ্ছে আমার জন্য সীমাহীন অনুভূতি। উনার হৃদয়ের প্রত্যেকটি কম্পনে আমি শুধু আমার নাম শুনতে পারছি। হঠাৎ নিজের মধ্যে আমি একটা প্রাপ্তি লক্ষ্য চরলাম। করলাম। অনুধাবন করলাম, এই মানুষটা এখন আমার। নিতান্তই আমার।

গাড়িতে আমার সাথে একটা কথাও বললেন না আনভীর। আমি বারবার উনার দিকে তাকাচ্ছিলাম কিন্ত উনি নির্বিকার। ঠোঁট চেপে এমন একটা ভাব করছেন যে পাশে কেউই বসে নেই। আমি বুঝতে পারলাম উনি রেগে আছেন আমার ওপর। যদিও আমিও রাগার মতোই একটা কাজ করেছিলাম। উনাকে না বলে একে তো এখানে এসেছি আবার আমার গালে অপৃর্ব ভাইয়ার আঘাত দেওয়াটা উনার মস্তিষ্কের রক্ত টগবগ করে তুলেছে। যেদিকে উনি কখনোই আমায় গায়ে হাত তোলেননি সেখানে ভাইয়ার মারাটা যেন উনার শরীর হিম করে দিয়েছে।বাসায় এসেও আনভীর নীরবে জামা পাল্টে বারান্দায় বসে রইলেন।

সময়টা এখন সন্ধ্যার মাঝামাঝি। কিছুক্ষণ পূর্বেই পশ্চিমাকাশের লালাভ আভা নিশ্চিহ্ন হয়ে এসে আধাঁর ভর করেছে সবজায়গায়। দূর দূর শুধু টিমটিমে আলোর সামাহারে উচ্ছ্বাসিত সবকিছু। আমি নিজেকে শান্ত করে রাখার জন্য একটু ভাবির কাছে উকিঁঝুকি দিয়ে এসেছিলাম। পরে রাতে যখন উনাকে সে অবস্থাতেই বারান্দায় বসে থাকতে দেখি আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। বড়ো বড়ো পা ফেলে দ্রুত বারান্দায় গিয়ে উনার কাছে বসে পড়লাম।

বাইরে বহমান ঠান্ডা হাওয়া। আনভীর ডিভানে বসে ঘাড় কিছুটা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। নিষ্প্রভ উনার ভাবভঙ্গি। আমার উপস্থিতি বুঝতে পারলেও কোনো পরোয়া করলেন না। বুঝলাম উনি ভালোমতোই রেগে আছেন। আমি এবার ঠোঁটজোড়া হালকা ভিজিয়ে নিলাম। মিহি কন্ঠে বলে ওঠলাম,
-‘আনভীর?’
উনি নিশ্চুপ। আমি আবারও ডাকলাম উনাকে। উনি শীতল কন্ঠে বললেন,
-‘আমি একা থাকতে চাচ্ছি আহি।’

আমার চোখে এবার ক্রমশ অশ্রুতে টুটুম্বুর হয়ে গেলো। উনার এমন শীতল ব্যবহার আমায় ছুঁড়ির মতো আঘাত করে দিচ্ছে। আমি এবার সিক্ত কন্ঠে বললাম,
-‘এভাবে আমার ওপর রেগে থাকবেন না প্লিজ। আমার ভালোলাগছে না।’
-‘আর আমার ভালোলাগাটা? সেটা কোথায়?’
আমি প্রশ্নবিদ্ধ চাহিনী নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি চোখে খুলে ঘাড়টা খানিক কাত করে আমার দিকে মুখ করলেন। বলে ওঠলেন,

-‘তোমার ওই সো কলড অপূর্ব ভাইয়া যখ তোমায় নষ্টা বলেছিলো ভেবেছো আমার কেমন লেগছে? তুমি আমার পার্মিশন ছাড়া কিভাবে যতে পারলে ওই জাহান্নামটিতে? ভেবেছিলে আমার কেমন লেগেছিলো যখন শুনলাম তুই ও বাড়িতে গিয়েছো যেখানে তোমায় জঘণ্য ট্রিট করা হতো?,,,,,,,,,,, আহি , তোমায় আমি বারবার বলেছিলাম ও বাড়িতে না যেতে । কি এমন হয়েছিলো যে তোমার ওখানে যেতে হলো?’
আমি এবার কেদে দিলাম সশব্দে।বলে ওঠলাম,

-‘মা…….মায়ের সব জিনিস নষ্ট কলে ফেলছিলো ভাইয়া। আমি কি করতাম বলেনতো? আপনি তো আমায় ও বাড়ি থেকে কিছুই আনতে দেননি। নাহলে কখনোই মায়ের জিনিসগুলো আমি ওখানে রাখতাম না। তাইতো হতদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। আপনি না বলবেন ভেবে আমি আর আপনাকে বলিনি।’
আমি এবর একটু থামলাম। চেষ্টা করলাম উনার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য।উনি নীরবেই ডিভানে খাপছাড়া হয়ে বসে আছেন। চোখদুটো বন্ধ। আমি এবার মিহি কন্ঠে বললাম,

-‘ভাইয়াকে আমি ভালোবাসি না এটা সত্যি তবে এটাও সত্যি আমি মা’হারা মেয়ে। পদে পদে সবার কাছে অপমানিত হয়েছি , লাঞ্ছিত হয়েছি। এমনকি বিয়ের দিন নিজের মুখ কালো তো করলামই , আপনারটাও করলাম। আপনি তো আমায়ে বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছিলেন তাই না?ভাইয়া ঠিকই বলেছে , সতিই আমি নিচ। বেহায়ার মতো আপনার জীবনে এতদিন পড়ে ছিলাম। আমার জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি আর কারও সর্বনাশের কারন হতে চাচ্ছিনা আনভীর , আমি ,,,,,,,,,,,,,,,,’

আমার আর কিছু বলতে না দিয়ে আনভীর হুট করে আমার ঘাড় চেপে নিজের কাছে টেনে ওষ্ঠ্যদ্বয়ে নিজের আগ্রাসী ওষ্ঠ্য মলিয়ে দিলেন । আমি বিস্ফোরিত। মস্তিষ্কের নিউরন কাজ করা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে । হাত পাও সমানতালে কেপে উঠছে এবার।ক্ষণিকের এই সময়টা আমার কাছে কেমন যেন থেমে গিয়েছে। উনি এবার আমায় নিজের কাতর স্পর্শ থেকে মুক্ত করে দিলেন। তবুও ছাড়লেন না আমায়। নিয়মতান্ত্রিকের মতো আমার ঘাড়ের পিছে নিজের হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে কপাল মিশিয়ে রাখলেন আমার কপালের সাথে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন উনি। সেই সাথে আমিও। উনার অস্থিরতা আমায় ক্রমশ গ্রাস করে ফেলেছে।তোলপাড় করে তুলেছে আমার ক্ষুদ্র হৃদয়। আনভীর নিজের অস্থিরতা দমিয়ে খুবই ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-‘তুমি কখনোই আমার সর্বনাশের কারন হতে পারো না আহি। না তুমি বেহায়া , নিচ। তুমি আমার কাছে ঠিক কি সেটা আমি তোমায় কখনও বলে বোঝাতে পারবো না। কেন জানো? আমি নিজেই আসলে জানিনা আমার কাছে তুমি কি? ভালোবাসা ,,,, ভালোবাসা,,,ভালোবাসা ! কি আছে এটার মধ্যে হ্যাঁ যে সবাই শুধু এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে? তুমি এর উত্তর জানতে চাও তো যে আমি তোমায় ভালোবাসি কি না?

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৬

তাহলে শুনে রাখো , তুমি আমার কাছে ভালোবাসার চাইতেও বিশেষ কিছু। আমার জীবন মরণ সব। আমার বাঁচতে হলেও তোমায় দরকার , মরতে হলেও তোমাকে দরকার। তুমি আমার শারীরিক প্রয়োজন না , তুমি হলে আমার অন্তরের প্রয়োজন। তুমি চাও বা না চাও , মানো বা না মনো , আমার জন্য হলেও তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে। হোক সেটা দায়বদ্ধতার জন্য , বা অন্য কিছুর জন্য। আমায় সেলফিস মনে হচ্ছে তাইনা? হ্যাৎ , আমি সেলফিস। নিজের জন্য যেমন সেলফিস , তোমার জন্য তার থেকেও দ্বিগুণ হতে পারি। ‘

এরকম আরও অজস্র কথা বলে চলছিলেন আনভীর। উনাকে অস্থির লাগছে। উনার এই অস্থিরতা আমার শরীরে অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার করলো। আমি জানি উনি কখনোই ভালোবাসি বলবেন না আমায় , আর আমার সেটার প্রয়োজনও এখন নেই। কেননা এর থেকেও বেশি কিছু পেয়ে গিয়েছি আমি। উনার ওভার প্রোটেকটিভ হওয়া , কেয়ারিং হওয়া , আমার জন্য সীমাহীন চিন্তা চরম ভাবে প্রমাণ করে দেয় উনার প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমায় প্রয়োজন। আমি এবার দ্বিতীয়বারের মতো উনার বুকে নিজের মুখ গুঁজে দিলাম। প্রথমবার ছিলাম আতঙ্কে , আর এবার নতুন কিছুর প্রাপ্তিতে। এই পাগলাটে আনভীরকে আমি উপভোগ করতে চাই এখন। খুব বেশি উপভোগ করতে চাই।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৮