এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৮

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৮
কায়ানাত আফরিন

প্রেমের স্নিগ্ধতায় আজ সকালটা বেশ ফুরফুরে। আমি পরম আবেশে বারান্দায় সকালের মৃদু হাওয়া অনুভব করতে ব্যস্ত। আজ সকালে উঠেই আমার ঠোঁটকোলে আপনাআপনি হাসি চলে এসেছে। কেননা আমি বারান্দায় টবে যেই গোলাপের চারা পুঁতেছিলাম আজ সেখানে ফুলের ছোট্ট অংশ গজিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ সম্মোহনের মতো তাকিয়ে রইলাম সেখানে। রোদ্দুরের প্রতিফলিত রশ্নি আমার চোখে পড়াতে অন্যরকম লাগছিলো আমার নিজের কাছেই।

হঠাৎ আনভীরের ডাক পড়তেই আমি ধ্যান কাটিয়ে রুমের ভেতরে চলে গেলাম। উনি হতদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটে সব গুছাচ্ছেন আর রেডি হচ্ছেন। আজ সকাল সকালই জরুরি প্রয়োজনের তাগিদে দ্রুত যাবেন ভার্সিটিতে। কিন্ত আজ আমি যাবো না। শিউলি ভাবির শারীরিক অবস্থা একটু দুর্বল তাই আজরান ভাইয়া আর আনভীর দুজনেই বলেছেন ভাবির খেয়াল রাখতে। তাই আমি আর উনার সাথে গেলাম না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আনভীর দ্রুত চশমাটা পড়ে চুল আছড়িয়ে ল্যাপটপটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। ক্রমশ দ্রুততার সাথে টাই পড়তে গিয়ে বারবার নষ্ট করে ফেলছেন। আমি এসব কিছু ঠোঁট চেপে খাটে বসে দেখছিলাম। একপর্যায়ে উঠে এগিয়ে যাই উনার কাছে। উনার শক্তপোক্ত ঘাড় ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিতেই আনভীর হতভম্ব হয়ে যান।

উনার ব্যস্ততম মুখে এখন বোকাসুলভ রেশ। আমি অগোচরে একটা হাসি দিলাম। সেদিন রাতে নিজের ভালোবাসি হীনা অনুভূতি এক্সপ্রেস করার পর থেকে কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গিয়েছেন। আমি কথা না বাড়িয়ে উনার হাত থেকে টাই নিয়ে ধীরসুস্থে উনার গলায় বেধে দিতে মগ্ন হয়ে গেলাম। উনার বোকাসুলভ দৃষ্টি এবার রূপ নিয়েছে কৌতুহলভরা দৃষ্টিতে। ভ্রু জোড়া হালকা কুচকে দেখে যাচ্ছেন আমার কার্যকলাপ। তারপর মিহি গলায় বললেন,

-‘তুমি এখন আর আগের মতো পিচ্চি পিচ্চি নেই আহি? কেমন যেন বউ বউ লাগে তোমায় দেখতে।’
আমি সরু চোখে পরখ করে নিলাম উনাকে। রূঢ় কন্ঠে জিঙ্গেস করলাম,
-‘ওহ্ ! এখন তাহলে বউ বউ লাগে কেনো আমায়?’
-‘উমমম্ , সেটা তো বলতে পারছি না।’

উনি এমন একটা ভান ধরলেন যে এর উত্তর উনার অজানা। আমি দ্রুত টাইটা বেঁধে দিয়েই বলে ওঠলাম,
-‘এখন আপনার দেরি হচ্ছেনা মহাশয়? ফাজলামি বন্ধ করে এবার বেরোন।’
উনি চলেই যাচ্ছিলেন হঠাৎ আমার ডাকে পেছনে ফিরলেন। আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে আজ উনাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। আমি কাট কাট গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
-‘আপনায় আজ এত সুন্দর লাগছে কেনো? আমার সাথে যখন ভার্সিটি যান তখন তো এতটাও সুন্দর লাগে না , ব্যাপারটা কি?’

আনভীর বোকাসুলভ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার উদ্দেশ্যে। যেন আমার পুরোটা কথাই উনার মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে। আমি দু’কদম এগিয়ে উনার মুখোমুখি হলাম। নিজের পা জোড়া উচু করে ছোট ছোট হাত দিয়ে খানিকটা এলোমেলো করে দিলাম উনার মসৃন কালো চুল। আনভীর কৌতুহলতার সাথে দেখে যাচ্ছেন আমার উদ্ভট কার্যকলাপ। চোখে-মুখে চরম প্রকারের বিষ্ময়। অদ্ভুতভাবে উনার সিক্ত চুলগুলো এলোমেলো হওয়ার দরুন উনাকে আরও বেশি মোহনীয় মনে হলো আমার কাছে। আগের থেকেও বেশি সুন্দর। আমি হতাশায় হাসফাস করতে থাকলাম। কোথায় চেয়েছি উনার সৌন্দর্যের মাত্রাটা একটু কমিয়ে দিতে আর হলোটা কি। আনভীর এবার মিহি স্বরে বললেন,

-‘তোমার কাজ হয়েছে মহারাণী? এড এনি চান্স তুমি কি এটা চাচ্ছো যে আমি আজ সারাদিন ঘরে থাকি ; তোমার সাথে?’
চোখজোড়া বড় বড় হয়ে এলো আমার। আমি উনার থেকে সরে আসতে যাবো উনি আমার দু হাত চেপে নিজের খানিকটা কাছে টেনে নিলেন। উনি সম্মোহনী কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-‘পিচ্চি বউটার এই এক জ্বালা। নিজে থেকে কাছে এসে বুকে আগুন ধরিয়ে ফট করে চলে যায়। এখন যে আমার বুকে আগুন ধরেছে এটা নিভাবে কে?’

লজ্জায় ক্রমশ গাল-নাক লাল হয়ে এসেছে আমার। আমি মনে মনে এই বিলাইটাকে কয়েকশ’ গালাগাল দিলাম। কিন্ত দিলেই বা কি হবে? এই লোক যেই ঠোঁটকাটা মানুষ, কবে জানি আমার কানও এই লোকের ভয়ে নাউযুবিল্লাহ্ পড়া শুরু করবে। আনভীর দুষ্টু হাসি দিয়ে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসতেই ফট করে এসে পড়লেন শিউলি ভাবি। আমাদের দেখে উনি তো স্তব্ধ হয়েছেনই আনভীরও হুড়মুড়িয়ে ছেড়ে দিলেন আমায়। আমরা দুজনেই এবার অস্বস্তির চরম মাত্রায় চলে গিয়েছি। ভাবি এবার ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কি দেবরজী? বউকে ছাড়া যেতে ইচ্ছে করেনা আপনার?’

উনি তপ্তনিঃশ্বাস ফেললেন। দ্রুত হাতঘড়িটা পড়ে বেরিয়ে গেলেন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।আমি উনার অসহায় মুখখানা দেখে ফট করে হেসে দিলাম। আমি জানি ভাবির সামনে এভাবে পড়াতে উনি নিজেও প্রচন্ড বিব্রত বোধ করছেন। আমি তারপর ভাবিকে বসিয়ে দিলাম আমাদের খাটে। ভাবি আগের তুলনায় খানিকটা গুবলুবুবলু হয়েছে। বেশ কিউট লাগে দেখতে। গালগুলোও কেমন টসটসে রক্তিম লাল। আমি অতি আগ্রহের সাথে ভাবির পেটের কাছটিতে মাথা রাখলাম। আমি এ কাজ প্রায়শই করি। ভাবিও আমার এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলেন হঠাৎ হঠাৎ। আর বলতে থাকেন আজরান ভাইয়ার কীর্তিকলাপগুলো।

আজরান ভাইয়া আনভীরের তুলনায় একটু অন্যরকম। নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পছন্দ করেন যেদিকে আনভীর কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট টাইপ। আজ আমাদের বিয়ের এতসময় পেরিয়ে গেলো অথচ মহাশয়ের মুখ দিয়ে কখনোই আমার উদ্দেশ্যে ভালোবাসি কথাটা বেরোইনি। আর আজরান ভাইয়ার মুখ থেকে ভাবির উদ্দেশ্যে আমি ভালোবাসি শুনিনি এমন কোনো দিনও বাদ পড়েনি।

ভাবির প্রেগনেন্সির পুরোটা সময় উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন ভাবিকে সময় দেওয়ার জন্য। যদি না পারেন তাহলে আমায় খেয়াল রাখতে বলেন। উনাদের দুজনকে দেখলেই মাথায় একটি কথা আসে , ‘একটি সুন্দর-সুখী দম্পতি’। হয়তো সেই সোনামণাটা পৃথিবীর আলো দেখার মাধ্যমেই তা আরও পরিপূর্ণতা পাবে।আমার বুকের ভেতর হঠাৎই একটু খালি খালি ভাব অনুভূত হতে থাকলো। আনভীর নিঃসন্দেহে ভালোবাসেন আমায়। হয়তো তা প্রকাশ করাটা পছন্দ করেন না। তবুও আমার মনেও ভাবিকে দেখে একটি ছোট্ট পৃথিবী আনার জন্য হৃদয় কেমন যেনো আনচান করে ওঠে। আমি জানি আনভীর এখন মানবেন না। উনার কাছে আগে আমার পড়াশোনা , তারপর সব। আমি মেনে নিয়েছি বিয়য়টা। ক’জনই বা চায় যে তার স্ত্রী নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলুক?

একগাঁদা বিরক্তি নিয়ে ক্যাম্পাসের ক্যান্টিসে বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। আশপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে আমায় এমন কাজ করতে দেখে। উনাদের হা করাটাই আসলে স্বাভাবিক, বরংচ আমায় এভাবে ক্যান্টিনে বইয়ের পাতা উল্টানোর ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক। আসলে কিছুক্ষণ আগে আনভীরের সাথে রাগ করে এখানে এসে পড়েছিলাম। দু’দিন পর থেকেই আমার পরীক্ষা শুরু হবে সেই সুবাদে পড়ার প্রচুর চাপ। সেজন্য আমি ভার্সিটির লাইব্রেরিতে চলে গিয়েছিলাম কিছু বই নেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়েই আচমকা আমি আনভীরের মুখোমুখি হই। উনিও কিছু বইয়ের প্রয়োজনে এখানে এসেছেন। আমায় দেখে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘ক্লাস নেই তোমার?’
-‘ক্লাস শেষ। বই নেওয়ার জন্য এখানে এসেছিলাম।’
আনভীর ছোট্ট করে ওহ্ প্রতিউত্তর দিয়ে লাইব্রেরির একপ্রান্তে ল্যাপটপ আর কয়েকটা এসাইনমেন্ট এর কাগজপত্র নিয়ে বসে পড়লেন৷ আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম উনার দিকে। কই এখন অফটাইম আছে একটু নিজেকে রিলেক্স করবেন আর উনি এই সময়েও স্টুডেন্টদের কাজ চেক করতে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি এবার আমার ডিপার্টমেন্ট এর শেলফ খুঁজে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বইগুলো বের করতে মগ্ন হয়ে গেলাম। শেলফগুলো যেমন বড়ো, আমি ততটাই খাটো।

কয়েকটা বইতো আমার নাগালের বাইরে। আমি নিজের পা জোড়া উচু করে অনবরত চেষ্টা করতে থাকলাম বইটা হাতিয়ে নেয়ার জন্য। তবে এটা আমার জন্য একেবারেই অসম্ভব। একরাশ হতাশা নিয়ে আমি যখন পা জোড়া নিচে নামিয়ে হাত নামিয়ে দিতে যাবো তখন আমি দেখলাম একটি বলিষ্ঠ হাত আমার হাত থেকে অল্প কিছু দুরত্বে রেখে বইটা নামিয়ে নিলেন৷ আমি হতভম্ব হয়ে আগন্তুকটিকে দেখার জন্য পছনে ঘুরতেই দেখি আমি আনভীরের দু’বাহুর মাঝে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার পেছনে বুক শেলফ আর সামনে আনভীর। আনভীর এবার ভ্রু নাড়িয়ে বললেন,

-‘আমাদের মতো বরদের পিচ্চি বউ নিয়ে এই একটা জ্বালায় পড়তে হয়৷ কিছুই হাতের নাগালে পায় না।’
বলেই উনি বিদ্রুপ হেসে চলে গেলেন সেখান থেকে। আমি যেন রাগে টুইটুম্বুর। মিঃ আনভীর রেজওয়ান খান ওরফে আনভীর খান ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করেছেন আমায়। আমিও দেখবো বাড়িতে গেলে আপনি কোন বউয়ের সাথে এত আদর করে কথা বলেন। ব্যাটা চশমিশ বিলাই কোথাকার!

বই নিয়ে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম তখনই আমার হঠাৎ চোখ গেলো আনভীরের দিকে। উনি একটা মেয়ের সাথে কথা বলছেন, খুবই মিহি কন্ঠে যেহেতু এটা লাইব্রেরি।মেয়েটি আর কেউই না , আমাদেরই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের নতুন টিচার রোজলীন ম্যাম। আমি কাছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি এই শাকচুন্নি মেয়েটা সুযোগ পেলেই আনভীরের সাথে কথা বলে।

আমি বুঝিনা উনারা দু’জন দুই ডিপার্টমেন্টের টিচার , তবুও এত কথা কিসের? শুধু কথা না, একেবারের পুরো জমে ঘি হওয়া টাইপ কথাবার্তা। আমার বইয়ের পাতা থেকে বারবার চোখ সরে উনাদের দিকেই নজর যাচ্ছে। আনভীর আড়চোখে আচমকা দেখলেন আমায়। আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম , যত দ্রুত সম্ভব এই শাকচুন্নিরে বিদায় করেন। কিন্ত উনি এমন একটা খাপছাড়া ভাব করলেন যেনো বউ তো আমি না , ওই রোজলীন টিচার উনার বউ। একপর্যায়ে ধৈর্যহারা হয়ে আমি ব্যাগ নিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে প্রস্থান করলাম সেখান থেকে। একবারও নজর দিলামনা যে উনি কি করছেন বা উনার প্রতিক্রিয়াটা কি। থাকুক , উনি ওই ন্যাকামি টিচারকে নিয়ে সে সুযোগ পেলেই ‘মিঃ আনভীর-মিঃ আনভীর’ বলে ভ্যা ভ্যা করে ওঠে। আমি তাই নিজেকে শান্ত করার জন্য চুপচাপ এসে পড়ি ক্যান্টিনে।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৭

এখানে খাওয়া-দাওয়া হয় কম , আড্ডা মাস্তি হয় বেশি। দু’একজন পড়ুয়া স্টুডেন্ট খাওয়ার ফাঁকে ক্যান্টিনের এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়ে। এ নিয়ে ট্রলের যেনো শেষ নেই। কিন্ত আমায় দেখে কেউ এমন কিছু করার সাহস পেলো না যেহেতু সবাই জানে আমি এই ভার্সিটির ওয়ান অফ দ্য মোস্ট স্ট্রিক্ট টিচার আনভীর রেজওয়ান খান এর ওয়াইফ। এখন কেন জানি নিজের কপালে আমারর নিজেরই বারি মারতে ইচ্ছে করছে। উনার সামনা-সামনি থাকলে একটু বুঝতে পারতাম আনভীর কি করছেন আর আমি করলাম টা কি? হাদার মতো ব্যাগপত্র নিয়ে এখানে মুখ ফুলিয় বসে রইলাম। ধ্যুর !

এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা প্লেট আমার দিকে কেউ এগিয়ে দিতেই আমি হতভম্ব হয়ে যাই। প্লেটে মিনি সাইজের একটা স্যান্ডউইচ আর সাইডে সসের প্যাকেট আছে। মানুষটির দিকে তাকাতেই আমি আরও এক ধাপ অবাক হলাম।কেননা আমার বরাবরের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন আনভীর। চোখের সরু দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার হতভম্ব মুখশ্রীর দিকে। আমি কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই উনি নির্লিপ্তভাবে বললেন,

-‘তোমার তো আবার রাগ করলে বেশি ক্ষুধা লাগে, তাই এই স্যান্ডউইচটা আগে খেয়ে এনার্জি গেইন করো। তারপর নাহয় রাগের বশে চুল ছিড়ো অথবা রাগ কমানোর জন্য আমায় আদর করো, দ্যাটস ইউর চয়েস। আইডিয়াটা ভালো না আহি?’

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৯