এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪০

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪০
কায়ানাত আফরিন

পরপর কিছুদিন আনভীর ভার্সিটিতে মাস্ক পরে ছিলেন। এই ভ্যাপসা গরমে উনাকে বিন্দুমাত্র মাস্ক খুলতে দেখা গেলো না। এমনকি মাস্ক খোলার ভয়ে উনি ভার্সিটিতে দুপুরে লাঞ্চও করেন না। অন্যান্য স্যাররা উনায় প্রশ্ন করে রীতিমতো অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন যে এভাবে পুরোটা ক্লাসটাইম মাস্ক পরে থাকেন কেন? উনার একটাই কথা , ঠান্ডা লেগেছে-তাছাড়া উনি চাননা ভাইরাসটা অন্য কারও মধ্যে ছড়াক।

ভার্সিটিতে এক্সাম চলছিলো বিধায় অগতাই উনাকে নিয়মিত যেতে হচ্ছিলো , তাই কেউ আর কিছু বলেনি। এটা তো গেলো ভার্সিটির কথা , বাসায়ও উনি পারলে মাস্ক পড়ে থেকেছেন। উনায় এমন বিপদগ্রস্থ অবস্থায় দেখে রীতিমতো আনন্দে মনে লাড্ডু ফুটছে আমার। উনি পরপর বহুবার চোখ রাঙিয়ে তাকান আমার দিকে। মিহি কন্ঠে এটাও বললেন, পরে উনি নাকি সুদে-আসলে তা উসুল কলে নিবেন। আমি উনার কথায় পাত্তা দিলাম না।তবে এটা সত্যি যে উনার থুতনিতে আসলেই ভয়াবহ একটা কামড় দিয়েছি। এটা কি আর এতদিন মাস্ক দ্বারা লুকানো সম্ভব?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একদিন সত্যি সত্যি সেটা নজরে পড়ে গেলো একজনের। তাও আবার আজরান ভাইয়ার সামনে। সকালে একদিন হুট করে ভাইয়া এসে পড়েছিলেন। তখন আনভীরকে এ অবস্থায় দেখে রীতিমতো চমকে যান। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
-‘তোর থুতনির এ অবস্থা কেনো? বিলাই কামড় দিসে নাকি?’
-‘এর থেকেও ভয়ংকর একজন কামড়িয়ে লাল করে ফেলেছে। পেয়েছো তোমার এন্সার?’

শান্ত ভাবে প্রতিউত্তর দিলেন আনভীর। উনার চোখের দৃষ্টি শীতল। কিন্ত আমি হতাশায় কপালে হাত দিয়ে দিলাম। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি কিন্ত আল্লাহ ! এর মতো ভয়ংকর মানুষ আমি আমার এই জনমে দেখিনি। তবে আজরান ভাইয়াকে বিচলিত হতে দেখা গেলোনা। যদিও উনি বুঝে ফেলেছেন যে কামড়টা কে দিয়েছে। তবুও ছোট্ট করে ‘ওহ্’ প্রতিউত্তর দেওয়াতে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আজরান ভাইয়া এবার খাপছাড়া ভাব নিয়ে খাটে বসতে বসতে বললো,

-‘তো শুধুই কামড়া-কামড়ি করছিস না কি? সুসংবাদ কবে পাবো , একা একা আমারও বাপ হতে ইচ্ছে হচ্ছে না রে ভাই ! চল্ দুই ভাই মিলে একসাথে দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাই।’
আমার কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে। একজন্যই তো বলি শিউলি ভাবি শুধু শুধু কেনো আজরান ভাইয়াকে এত চুপ থাকতে বলে। আনভীর প্রথম প্রথম শান্ত ছিলেন। কিন্ত পরবর্তীতে আজরান ভাইয়ার কথা শুনে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। আজরান ভাইয়া তো থামছেনই না। শেষ পর্যন্ত আনভীর কাতর গলায় বলে ওঠলেন,

-‘ভাই,,,,,! থামবে প্লিজ !তুমি যেমন ভাবছো এমন কিছুই হয়নাই।’
আজরান ভাইয়া কথাটি শুনে বিমর্ষ হয়ে গেলেন শুরুতে।কিন্ত পরক্ষণেই হঠাৎ সরু চোখে তাকালেন আমার আর আনভীরের দিকে। বলে ওঠলেন,
-‘আসলেই তো ! তুই এখন বাচ্চার বাপ হতে যাবি কেনো? আমার প্রথম কাজ হলো তোদের জোরপূর্ক হানিমুনে পাঠানো।তারপর না হয় তোরাও প্ল্যানিং করবি। আস্তে আস্তেই কর। আমার ছেলে বেবি হলে তোরটার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়ে দেবো।’
-‘আর আমারও যদি ছেলে হয়?’

ভ্রু কুচকে বলে ওঠলেন আনভীর। আজরান ভাইয়া উনার মাথায় গাটি মেরে বললেন,
-‘নাউযুবিল্লামার্কা কথা কস কেনো? শুভ শুভ বলবি তাহলেই তো শুভ শুভ হবে। তারপর ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমরা দুই-ভাই বউ নিয়ে হানিমুনের সেকেন্ড রাউন্ড দিবো।’
আমি উনাদের কথা আর নিতে পারছিলাম না। এককথায় ভৌ দৌঁড় দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। আল্লাহ ! এমন ভাসুর আল্লাহ যদি সবার ঘরে ঘরে দেয় তবে আমার মতো মেয়েদের তো পালাই পালাই করে থাকতে হবে।
আজরান ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমি আবার রুমে গেলাম। আনভীর তখন রুমে মোবাইল চালাচ্ছিলেন। আমি ক্রুব্ধ স্বরে বলে ওঠলাম,

-‘আপনি ভাইয়াকে এটা বললেন কেনো যে আমি কামড় দিয়েছি?’
-‘আমি কখন বললাম এ কথা?’
-‘তাহলে কি বলেছেন আপনি?’
-‘আচ্ছা তুমিই বলোতো আমি কি একবারও তোমার নাম মেনশন করেছি?’
উনি ভ্রু নাচিয়ে আমায় প্রশ্ন করতেই আমি আমতা আমতা করে না বলে দিলাম। উনি এবার বলে ওঠলেন,

-‘তাহলে? আর তাছাড়া তুমি যেই কামড়টা দিয়েছো লোকে দেখলেই বুঝবে এটা কেমন কামড়। প্রবলেম কি আর তোমায় ফেস করতে হয়? ফেস করতে হয় আমার। মিস রোজনীল তো বারবার……’
মিস রোজনীল নাম শুনে আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই উনি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমি থমথমে গলায় বললাম,
-‘এই রোজনীলটার জন্যই কামড় দিয়েছি আপনারে বুঝেছেন? যাতে ওই মহিলা থেকে আপনি দূরে দূরে থাকেন।’

উনি কিছু একটা ভেবে মোবাইল রেখে এগিয়ে আসতে থাকলেন আমার দিকে। আমি স্বাভাবিক হলাম। আমতা আমতা করে সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কি হয়েছে আপনার?’
উনি নির্বিকার। ঠোঁটে স্মিত হাসি রেখে আমার দিয়ে এগোচ্ছেন। চোখে মুখে বিশদ কৌতুহলতা। আমার কাছাকাছি এসে পকেটে হাত গুজে ঠান্ডা গলায় বললেন,
-‘তো কি বলছিলে তুমি? আমায় বাইট দিয়ে তুমি ভালো করেছো?’
-আমিতো…..আমিতো..
-তুমি তো কি আহি?

আমি কিছু বলতে চেয়েও বললাম না। উনি খানিকটা ঝুকে প্রগাঢ় হয়ে বলে ওঠলেন,
-‘লাভ বাইট কিন্ত চাইলেও আমিও দিতে পারি। তাও আবার তোমার থেকেও ভয়ঙ্কর করে। আমি দিলে কিন্ত থুতনিতে , গালে দিবো না ; দিবো ডিরেক্ট ওই সফ্ট লিপস এ। এতদিন তো তুমিই নিজের ঠোঁট কামড়িয়েছো। এবার নাহয় আমিই কামড়ে দেই?’

আমার মস্তিষ্ক ফাকা হয়ে গিয়েছে। হাত পা জমে পাথর। উনার উষ্ণ নিঃশ্বাসে জমা নেশাক্ত কথাবার্তা রীতিমতো আমায় তাজ্জব বানিয়ে দিচ্ছে। উনি এবার আরও কিছুটা ঝুঁকতেই আমি খিচে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভাবলাম এই বোধহয় আমায় কামড়ে নিংড়ে ফেলবে। কিন্ত আমায় বোকা বানিয়ে উনি তৎক্ষণাৎ পাশ থেকে ঝাড়ু নিয়ে আমার হাতে ঝাড়ু দিয়ে দিলেন। আমি বিস্ময়ে। উনি ক্রুব্ধ গলায় বললেন,

-‘এটাই তোমার শাস্তি। এখন চুপচাপ ঝাড়ুটা নিয়ে লাইব্রেরির বুকশেলফগুলো সাফ করে এসো।আমি গোসল করে এসেই যাতে দেখি সব পরিষ্কার।’
বলেই উনি গটগটিয়ে ওয়ালরুমে চলে গেলেন। ব্যাটা খচ্চর কোথাকার! এটা শুরুতে বললেই তো পারতি। এাবে আমার হতবাক না করলে হতো না? ভেবেছিলাম কি আর হয়েছে টা কি?

খাটো মানুষদের প্রতি পদে পদে এই এক জ্বালা। সহজে কোনো কিছুরই নাগাল পায়না। শেলফগুলো সাফ করতে রীতিমতো আমায় কসরত করতে হচ্ছে। নিচেরগুলো সহজ হলেও উপরের দিকে সাফ করাটা বেশ কষ্টসাধ্য আমার জন্য।অগত্যাই আমাকে একটা উচু টুল নিয়ে উপরে উঠে সেগুলো পরিষ্কার করতে হলো৷ যা অবস্থা দেখলাম, মনপ হয়না এই কয়েকদিনে কেউ সাফ করেছে। নুড়ী আপাও দিন দিন ফাঁকিবাজি শুরু করেছেন কাজে৷ মা এজন্যই প্রায়শই আপাকে শাসানী দেন৷

তবে মায়ের নজর থেকে পার পেলেই আবার শুরু হয়ে যায় তার ফাঁকিবাজি। টুলটার নিচ দিয়ে যে আংশিক ভাঙ্গা ছিলো সেটা সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। তাই টুলে দাঁড়ানোর সময়ই আমি খেয়াল করি এটা একটু নড়ছে৷ আমি সেফটির জন্য যেই না এই টুল থেক নামতে যাবো দুর্ভাগ্যবশত ভাঙ্গা অংশটায় আমার পা রাখতেই আমি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললাম৷ ভয়ে ইতিমমধ্যে আমি নিজের চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলেছি। তবে কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আমার মনে হলো, আমি নিচে পড়ে যাই নি৷ আমি আসলে শূন্যে ভাসছি৷ আমি পিটপিট করে চোখজোড়া খুলতেই চোখাচোখি হলো আনভীরের সাথে।

ইসসস! গোসলের পর উনাকে দেখতে মারাত্নক লাগে৷ কি দুর্দান্ত লুক, তারওপর সিক্ত চুলের বিন্দু বিন্দু পানিতে আমার মতো হাজারো মেয়ে মোহে পড়ে যাবে। আর টসটসে ঠোঁটগুলো দেখলে তো ইচ্ছে করে,,,
পরন্তু আমার আর ভাবার সময় হলো না।
আনভীর তখনই ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘আজকাল শরীর মন কোথায় থাকে তোমার? আমি না ধরলে বুঝতে পারছো কি হতো?’
আমি তখনই নিজেকে পরখ করে দেখে নিলাম আমি আসলে উনার কোলে। উনার ধমক খেয়ে রীতিমতো চুপসে আছি এখন৷ আনভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে আমায় নিচে নামালেন। ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩৯

-‘কবে তুমি নিজের খেয়াল রাখবে বলোতো? ছোটো বাচ্চা তুমি?’
-‘তো কি করবো বলেন? আমার দ্বারা আদৌ এত উপরে পরিষ্কার করা সম্ভব?’
উনি এবার কিছু একটা ভেবে শান্ত হলেন। শীতল গলায় বলে ওঠলেন,
-‘রাখো এগুলো, আমিই করে নিচ্ছি।’
-‘আপনি তো মাত্র গোসল সেরে আসলেন।’
আমি একথা বলার পর কিছু একটা ভাবলেন উনি৷ তারপর বলে ওঠলেন,
-‘আচ্ছা আমিই তোমার ব্যবস্থা করছি।’

উনি আচমকা আমার কোমড় চেপে উঁচু করে ধরতেই আমি পাথর হয়ে গেলাম। আনভীর মিহি স্বরে বললেন,
-‘আমি ধরেছি। তুমি এখন জায়গাটি মুছো।’
আমি কোনোমতে কাপাকাপা হাতে উপরের অংশটুকু মুছলাম। উনার এভাবে ধরাতে আমি প্রচন্ড লজ্জায় পড়ে গেলেও ব্যাটায় যেন দিব্যি আছে। তারপর কৌতুকের ন্যায় বললেন,
-‘ইসসস! বউটা পিচ্চি হলেও কত্তো ভারি গোওওওও!’

আমি তড়িঘড়ি করে নিজকে উনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে যেই না চলে যাচ্ছিলাম উনি দুষ্টু হেসে বললেন,
-‘লাভ বাইটের কথা কিন্ত ভুলে যেও না।’
আমি তো ভয়ে কাঠ। এই লোকের মতো কথাবার্তাগুলোও ভয়ঙ্কর। এবার মনে হয় সত্যি সত্যিই আর ছাড় নেই।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪১