এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ২৩

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ২৩
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

পরেরদিন সকালে ক্লাস শেষে তিতির যখন একা করিডোরে হাঁটছিল তখন শুভর সাথে দেখা হয়। হাঁটছিল বললে ভুল হবে, সে রাফি, শুভদেরই খুঁজছিল। তিতির শুভকে ডাক দেয়,
“ভাইয়া একটু শুনবেন?”
শুভ এসেছিল এক স্যারের সাথে কথা বলতে। তিতিরের ডাকে দাঁড়ায়। এগিয়ে এসে বলে,

“আরে তিতির, কী অবস্থা?”
“জি ভাইয়া ভালো। আপনাকে কিছু দেওয়ার আছে?”
শুভ অবাক হয়ে শুধায়,
“আমাকে? কী?”
তিতির এবার ব্যাগ থেকে হিজাব ও চুড়ির বক্সটা বের করে শুভর হাতে দিয়ে বলে,
“এসব দয়া করে আপনার বন্ধুকে দিয়ে দিবেন আর তাকে বলে দিবেন, পরের স্ত্রীকে নিয়ে অনাধিকারচর্চার না করতে।”
শুভর কাছে কথাটা রূঢ় শোনাল। সে কিয়ৎ মৌন রইল। তারপর বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুমি সময় নাও। ভাবো। তাড়া কিসের!”
“ভাবাভাবি শেষ। আমি শান্তি চাই প্লিজ। আপনার বন্ধু নিজের যেমন অশান্তি বাড়াচ্ছে তেমনি আমারও।”
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এগুলো আমি নিতে পারলাম না। দুঃখিত। তবে যার উপহার তাকেই ফিরিয়ে দিয়ো। যদিও সে আজ আসত না তবুও তাকে আসতে বলছি।”
এই বলে শুভ চলে গেল। শুভর খারাপ লাগছে তার বন্ধুর জন্য। কিন্তু এখানে তার তো কিছু করার নেই। যা বোঝার ও বলার তার বন্ধু নিজেই নাহয় বলুক! চলতে চলতে শুভ ব্যাপারটা মাশরিফকে মেসেজে বলে দিল।

মেসেজটা পাওয়া মাত্রই মাশরিফ বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। দুপুর বারোটা নাগাদ এসে ক্যাম্পাসে পৌঁছাল। ময়মনসিং মেডিকেল কলেজের লেক পাড়ে অপেক্ষা করছে মাশরিফ। তিতিরকে ইতিমধ্যে খবর পাঠানো হয়েছে। তিতির এই এলো বলে। মধ্যাহ্নের তপ্ত রোদে ঘেমে একাকার অবস্থা হলেও মৃদু সুনীলে শরীরে শিথিলতা আসছে কিন্তু মন! সে তো বড্ড বিষণ্ণতায় কাতর! জ্বলজ্বলে সূর্য রশ্নির দিকে গুটি কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে কারও ডাকে দৃষ্টি হটালো। চোখে হাসল মাশরিফ। সেই হাসির খবর বিপরীত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাল না।

তিতির এসে মাশরিফের পাশে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অতঃপর ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আপনার উপহার সামগ্রী আপনি নিজের কাছেই রাখুন। কারো অনুমতি ব্যতীত তাকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ”
তিতির দিকে বক্সখানা মাশরিফের দিকে এগিয়ে দিল। সেটা দেখে মাশরিফ মুচকি হাসল। তারপর চোখ নামিয়েই বলল,
“উপহার বুঝি অনুমতি নিয়ে দিতে হয়? জানা ছিল না।”

“হ্যাঁ অনুমতি নিয়ে দিতে হয়। অনুমতি ছাড়া উপহার শুধু পরিচিত ও প্রিয়জনদের থেকে গ্রাহ্য করা হয়। আপনার জ্ঞাতার্থে বলি, আপনি আমার প্রিয়জন বা প্রয়োজন কোনোটাই না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।”
মাশরিফ এবার চোখে হেসে তিতিরের নয়নজোড়ায় দৃষ্টিপাত করল। অতঃপর বলল,
“যদি বলি আপনি ভুল!”

তিতিরের ভ্রুঁ প্রশ্নাত্মক সংকুচিত হলো। সে শুধাল,
“তাই? কী করে?”
“আপনার জানার বাহিরেও এমন কিছু আছে যা আপনি আজ জানবেন। তবে আমার ইচ্ছে ছিল না আজ জানানোর। কিন্তু আপনি যেহেতু আমার ব্যাপারে জেনেই গেলেন তাহলে এইটুকুও জেনে রাখুন।”
এই বলে মাশরিফ তার পকেট থেকে একটা খাম বের করল। সেটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” নিন। এটা পড়ুন।”

তিতির এক পলক মাশরিফের দিকে ভ্রুঁকুঞ্চন করে তাকিয়ে খামটা হাতে নিল। খামটার দিকে তাকিয়ে দেখল তাতে ঢাকা সিএমএইচ এর নাম লেখা আছে। কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খামটির দিকে। তিতিরকে এভাবে দেখতে দেখে মাশরিফ বলল,
“এটা আপনার শ্রদ্ধেয় পরলোকগত শ্বশুরবাবা মোঃ ওসমান আলী এক নার্স বা ওয়ার্ড বয়ের হাতে লিখিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর দুই-তিন দিন আগে আমি এটা পেয়েছিলাম। সম্ভবতো তখন তিনি প্রায় সুস্থ ছিলেন।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,

“হ্যাঁ বাবা প্রায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু এক পাশ প্যারালাইজড ছিল। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়াতে তিনি বাসায় আসার জেদ করলে আমার দেবর তাকে নিয়ে এসেছিলেন। বাসায় আসার দুই দিনের দিন হুট করে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। এরপর ফরিদপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”
“তাই হবে হয়তো। উনি আমাকে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন। আর উনি যখন অসুস্থ হয়েছিলেন মানে তার মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস আগে উনাকে আমি বাড়িতেই দেখতে গিয়েছিলাম। তখনি আপনাকে..!”

মাশরিফ হঠাৎ থেমে যাওয়াতে তিতির বলল,
“কী? আমাকে প্রথম দেখেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“তবে সেটা আপনি ছিলেন? আমি সহসা কারও সামনে যাই না। মেডিকেলে ছাড়া বাড়িতে পুরুষ কেউ আসলে দরকার ছাড়া সামনে যাই না।”
তিতিরের প্রত্যুত্তরে মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“চিঠিটা পড়ুন।”
তিতির এবার চিঠিটা খুলে পড়া ধরল,
“মেজর মাশরিফ ইকবাল,

চিঠিটা আমি কাউকে দিয়ে লিখাচ্ছি। তুমি আমার ছেলের মতোই। আমার মন বারবার বলছে আমার ছেলে, আমার রাহান আর জীবিত নাই। যেদিন থেকে এটা মনে হচ্ছে সেদিন থেকে আমার বাঁচার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। আমার স্ত্রী, ছোটো ছেলে ও মেয়ের জন্য কোনো চিন্তা নাই। কারণ আমার ছোটো ছেলে তার মাকে ফেলবে না। আর মেয়ে তো বিয়ে দিয়েই দিয়েছি। চিন্তা কেবল তিতিরের জন্য। মেয়েটা আমার পুত্রবধূ হলেও তাকে আমি মেয়ের নজরেই দেখি। ওর বাবা-ভাইও জীবিত নাই। আমার মৃত্যুর পর যে ও আমাদের বাসায় থাকবে না তাও বুঝি।

ওর জন্য চিন্তায় আমার মাঝেমাঝে নিজের উপর রাগ হয়। বিয়েটা যদি আর কিছুদিন পর হতো তবে হয়তো মেয়েটার ভাগ্যে অন্যকিছু থাকত। সেদিন তোমার দৃষ্টিতে আমি ওর প্রতি মুগ্ধতা দেখেছি। লালসা দেখিনি। বাবার চোখ কিছুটা তো আন্দাজ হয়। তুমি ওকে দেখার পরপরই যখন জানতে পারলে ও রাহানের স্ত্রী তখন সাথে সাথেই দৃষ্টি সংযত করে নিয়েছিলে। তোমাকে আমি চিনি। রাহানের সুবাদে দুই-তিন বার সেনানিবাসেও গিয়েছিলাম। তুমি একজন ভালো ছেলে। আমার মেয়েটা খুব চাপা স্বভাবের। যদি আমার এই মেয়েটা বিধবা হয়ে থাকে তাহলে তুমি যদি মেয়েটাকে আপন করতে পারো তবে এই বাবা তোমার উপর ঋণী হয়ে থাকব।

ইতি এক সন্তানহারা বাবা।”
লেখাটা পড়তে পড়তে তিতির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। জলের ধারা গড়িয়ে পরলো। চিঠিটার উপরেও দুয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু নিজেদের স্থান দখন করে নিয়েছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। আশেপাশের সবকিছু কেমন ভারী ভারী লাগছে। তিতির বড়ো একটা ঢোক গিলে আকাশপানে তাকলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল। তারপর সেটাকে বুকে চেপে রাখল কয়েক মূহুর্ত।
মাশরিফ মলিন হেসে বলল,

“এটা ঠিক আপনার প্রতি আমার ফিলিংস প্রথমদিন থেকেই কিন্তু অনেস্টলি, আপনাদের বাড়িতে যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনের পর আপনার শ্বশুরবাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার কোনো খোঁজ আমি নেইনি। ফরিদপুরেও আসিনি। অন্যের স্ত্রী মনে করে একপ্রকার নিজের অনুভূতি দাবিয়ে রেখেছিলাম। তারপর চিঠিটা পড়ার পরই আমি ফরিদপুরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কিছু কাজ পরাতে দেরি হচ্ছিল কিন্তু তখনি ওসমান আঙ্কেলের মৃত্যুর খবর আসে। আমি হয়তো একটু বেশিই আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম যা আমার পেশার সাথে যায় না। আপনার চোখে হয়তো এখন আমি এক ছ্যাঁ*চড়া লোক! হয়তো কেনো বলছি! সত্যিই তাই। তার জন্য দুঃখীত। আপনি না চাইলে আমি আপনার সামনে আমার অনুভূতি ব্যাক্ত করব না।”

তিতির চুপ করে আছে। তার আঁখিদ্বয় দ্বারা অশ্রুধারা এখনও ধীর গতিতে গড়াচ্ছে। মাশরিফ এবার নিজের পকেট থেকে আরেকটা খাম বের করে। সেটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা আপনার মাকে দিবেন। আপনি খুলবেন না। আর ভয় পাওয়ার কারণ নাই। আপনার মায়ের সামনে আমার নিচ মা*নসিকতা প্রকাশ করার ভুল করিনি। খামে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে যা আপনিও জানতে পারবেন তবে আপনার মা আগে জানুক আমি চাই। এই রিকুয়েস্টটা রাখবেন। আমি আজ এসেছিই এই দুটো জিনিস দিতে। চিঠিটাও আপনি আপনার কাছে রাখুন। সকল আমানত ফেরত শেষ। এবার তো এই উপহার সামগ্রীও আমায় ফেরত নিয়ে যেতে হবে!”

তিতির মাশরিফের দিকে তাকাল। নিষ্প্রাণ চাহনি তার। মাশরিফ হতাশ হলো। বলল,
“এই মেজর আপনার সামনে আপনার অনুমতি ছাড়া আসবে না।”
এই বলে মাশরিফ বক্সটা নিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয়। তিতির মাশরিফকে ডাক দেয়। তিতিরের ভাঙা কন্ঠস্বরে মাশরিফ থমকে দাঁড়ায়। তিতির এগিয়ে গিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ আমাকে ফরিদপুর ছাড়ার জন্য প্ররোচিত করার জন্য। আপনি আমাদের অনেক হেল্প করেছেন। কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।”

“আপনার গন্তব্য এখানেই ছিল। যদি কোনো সময় দেখা হয় সেই অপেক্ষায় রইলাম। তবে আমার মন বলছে সময়টা বেশি দীর্ঘ হবে না। ভালো থাকবেন।”
মাশরিফ চলে গেল। তিতির চিঠিটা ও খামটা নিয়ে ধীর পায়ে ক্যাম্পাসের দিকে যায়। বিকেলে নাজমা বেগম ও হিয়া, হায়াতকে নিয়ে আসবে। তখনই খামটা দেখা হবে।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ২২

এই পাঠকমহল, ব*কা দিয়েন না প্লিজ। বিচ্ছেদ দীর্ঘসূত্রী না। গতকাল দিবো বলেছিলাম কিন্তু গতকাল সকাল দশটাঢ একটা ক্যান্সেল হওয়া ক্লাসের মেকআপ ক্লাস হুট করে দেয় তারপর বইমেলাতেও যাওয়ার প্ল্যান ছিল।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ২৪