এলোকেশী কন্যা গল্পের লিংক || লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১+২+৩
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

‘অ্যাডভেঞ্চার’ শব্দের উচ্চরণটা শুনতে বেশ কঠিন। তেমনি এর শব্দার্থ টাও। তবে হাস্যকর হলেও সত্যি এই শব্দটাতে অনেকে খুব সহজে আকৃষ্ট হয়। কেন? এর সঠিক উত্তরটা অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরাই বলতে পারবে।
আজ ক্লাস শিক্ষকের থেকে এই শব্দটা শুনেছে চতুর্থ শ্রেনীর মেঘ মেহবুব। ওর পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে এখন ‘অ্যাডভেঞ্চার’ শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে। টিচারের কাছে শব্দটার তাৎপর্য শুনেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারে নি। অথচ এই শব্দার্থটা ওর জানা চায় ই চায়। যতক্ষণ না সে এটা স্পষ্ট ভাবে বুঝবে, ততক্ষণ ওর স্বস্তি নেই।
মেঘ বাসায় ফিরে কাঁধের ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দৌড়ে রুমে চলে গেল। কোনোমতে ড্রেস বদলে ছুটল ওর দাভাই রোদ মেহবুবের রুমে। এত বড় বাসায় এই দু’টো প্রাণের বসবাস। তাছাড়া আছে বেতনভুক্ত কাজের লোক। রোদ আর মেঘ সম্পর্কে ভাই এবং বন্ধু দু’টোই। আজকে রোদ বিশেষ কারণে অফিসে যায়নি৷ মেঘকে স্কুলে রেখে সে এতক্ষণ বাসাতেই ছিল। ফোন আলাপের মাধ্যমে ওর জরুরী কাজগুলো সম্পূর্ণ করছিল। তখন মেঘ হন্তদন্ত হয়ে রোদের রুমে প্রবেশ করল। রোদকে ব্যস্ত দেখে মেঘ সোফায় বসে মৃদু স্বরে ডাকল,

”দাভাই! দাভাই আমি কিছু বলতে চাচ্ছি। এখন না বললে আমার পেট গুরগুর করছে।”
রোদ মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে কথা শেষ করে কল কাটল। মেঘ মিষ্টি হেসে ইশারায় রোদকে ওর পাশে বসতে বলল। রোদ মৃদু হেসে বসে বলল,
“বলো কি বলবে?”
“দাভাই, অ্যাডভেঞ্চার জিনিসটা আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
রোদ হাসি মিশ্রিত মুখে মেঘের চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে বলল,
“অ্যাডভেঞ্চার মানে দুঃসাহসিকতা অথবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কাজকে অ্যাডভেঞ্চার বলে।”
“অ্যাডভেঞ্চার কোথায় কোথায় হয়?”
“অ্যাডভেঞ্চার জিনিসটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সেটা
পাহাড়, সমুদ্রেও হয়। ”
রোদের কথা শুনে মেঘ বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে বুঝেছে। তারপর কিছু একটা ভেবে দাঁত বের করে হেসে বলল,”আমি পাহাড়ে যেতে চাই দাভাই, প্লিজ!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোদ জবাব না দিয়ে ফাইল গুলো গুছিয়ে মেঘকে নিয়ে নিচে গেল। মেঘ বার দু’য়ের একই কথা বলল। রোদ শুনেও নিরুত্তর থেকে মেঘকে খাওয়াতে লাগল। মেঘ রোদের এই নীরবতার মানে বুঝে। তাই সে অভিমান করে উঠে বাগানে চলে গেল। রোদ ডাকলেও শুনল না। অগত্যা রোদ উঠে খাবারের প্লেট নিয়ে মেঘের পাশে গিয়ে বসল। মেঘ অন্য দিকে ঘুরে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আজকে মেঘের জন্মদিন। তাই রোদ মেঘের আবদার উপেক্ষা না করে বলল, ”আচ্ছা যাব ঘুরতে।”
কথাটা শুনে মেঘ মিষ্টি হেসে মুখে খাবার নিলো। খেতে খেতে সে অনেক কথার ঝুলি খুলে বসল রোদের সামনে। ওর কথার সমাপ্ত পার্ট নেই। অনবরত একটার পর একটা বলেই যাচ্ছে। রোদ মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে আর হু হা করে উত্তর দিচ্ছে। কথার ঝুলি নিয়ে মেঘ খাবার খেয়ে রোদের সাথে রুমে গেল। তারপর দুই ভাই রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে গেল।

মেঘের জন্মদিনে রোদ বাসায় আয়োজন করে না। মেঘও চায় না। তবে এই দিনে রোদ চারটা কাজ অবশ্যই করে। প্রথমে মেঘকে নিয়ে যায়, ওদের বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করতে। তারপর যায় এতিম খানায়। সেখানে বাচ্চাদের নতুন পোশাক আর খাবারের আয়োজন সম্পূর্ণ করে। তারপর রাতে বাসায় ফিরে রোদ মেঘকে পায়েস খাইয়ে কপালে উষ্ণ স্পর্শ দেয়। এই কাজটা আগে ওদের আম্মু করতেন। এখন এই দায়িত্বটা রোদ পালন করে। অবশেষে রাতে ঘুমানোর সময় মেঘ রোদের কাছে একটা আবদার করে। আর রোদ হাসি মুখে সেই আবদারটা পূরণ করে। আজকে মেঘ সেই সুযোগটায় কাজে লাগিয়েছে। সে বুদ্ধি করেই আবদার করেছে পাহাড়ে যাওয়ার। ছোট হলেও ওর বুদ্ধি বেশ টনটনা। সে জানত, দাভাই আজ ওর আবদার ফেলবে না। তাই তার এত ছলাকলা। আর রোদও ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটাতে সহজেই রাজি হয়ে গেছে। কারণ ওর কাছে মেঘের খুশির থেকে বড় কিছু আর নেই।
প্রতিবারের মতো আজও ওরা সারাদিনের কার্যক্রম শেষ করে বাসায় ফিরেছে। এখন দুই ভাই শুয়ে গল্প করছে। মেঘ রোদের পেটের উপর পা তুলে চিন্তিত সুরে বলল,

“দাভাই, রাতে ঝড়ে আমার ছাদ উড়ে গেলে কি হবে?
“কি আর হবে! তুমি ছাদটা খুঁজে এনে আবার জোড়া লাগিয়ে দিবে।”
“উম আমি পারব না।”
কথাটা বলে মেঘ এক নাগাড়ে বকবক করতে লাগল। রোদ চুপ করে ওর কথাগুলো শুনছে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে মেঘ বকতে বকতে ঘুমিয়ে গেল। রোদ উঠে মেঘকে সুন্দর করে শুইয়ে নিজেও চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। তখন ওর চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আজকের দিনে ওরা বাবা মাকে হারিয়েছিল। উনারা একসঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরণে মারা গেছেন। আজকের দিনটা যেমন আনন্দের তেমনি কষ্টেরও। রোদের বর্তমানে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মেঘ। গত দুই বছর ধরে মেঘকে কিভাবে সামলেছে, শুধু সেই জানে। একদিকে ছোট্ট মেঘ, পড়াশোনা, অফিস, শত কষ্ট হলেও সে সবটা সামলে উঠতে পেরেছে। তবে এতকিছুর ভিড়ে ওর হাসিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। স্বপ্নটাও অনাদরে পথ হারিয়েছে। শখের গিটারটারও ঠায় হয়েছে ধূলো-ময়লাযুক্ত স্টোর রুমে। এখন প্রাণবন্ত ছেলেটার মাঝে গম্ভীরতা এসে ভর করেছে। সে শুধু মেঘের কাছে বেস্ট দাভাই! তাছাড়া সবার কাছে গম্ভীর, রাগী এবং কঠিন চরিত্রের মানুষ। বর্তমানে রোদ পড়াশোনা শেষ করে নিজেদের ব্যবসা দেখাশোনা করছে। ওর বাবার কষ্টে তৈরী ব্যবসার হাল ধরেছে। মেঘের সঙ্গে ওর দুষ্টুমি, খুনশুঁটি, আদর, শাষণ আর ব্যস্ততা নিয়ে ওর সময় গুলো অতিবাহিত হচ্ছে।

পরেরদিনের সকালটা মন ভালো করার মতো একটা সকাল।
অদ্ভুত সৌন্দর্যের অধিকারী পূর্বাকাশের সূর্যের কিরণের ঝলকানি। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। আর ব্যস্ত শহরে যানবাহনের হর্ণের শব্দ। তখন ওদের ঘড়িটাও ঠিক ঠিক শব্দ করে জানাল সকালের আগমনী বার্তা। এখন বাজে আট টা নয়। দুই ভাই উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে গেল বাস স্ট্যান্ডে। ওদেন গন্তব্য এখন রাঙ্গামাটি। আজকে ওরা রাঙ্গামাটিতে পৌঁছে একটা রিসোর্টে উঠবে। তারপর কালকে সেখান থেকে যাবে, রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক ইউনিয়নের কংলাক নামক পাহাড়ে। আজ ঘুরতে যেতে পেরে মেঘের তো খুশির অন্ত নেই। সে জানালার পাশে বসে পোজ দিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কখনো বা মুখ বাড়িয়ে হা করে বাতাস খাচ্ছে। তো কখনো সিটে পা তুলে বসছে আবার নামাচ্ছে। রাস্তায় কত শত জিনিস দেখে যে প্রশ্ন করছে, তার হিসেব নেই। মাঝে মাঝে অন্য বাসের মেয়েদের হাই করে খিলখিল করে হেসে উঠছে। কোনো মেয়ে দুষ্টুমি করে ওকে ফ্লায়িং কিসও ছুঁড়ে দিচ্ছে। এটা দেখে মেঘ খিলখিল হেসে রোদের গায়ে ঢলে পড়ছে। রোদ বিরক্ত হয়ে মেঘকে দুইবার নিষেধ করল, কিন্তু কে শুনে কার কথা। এখন বাসভর্তি লোকের মাঝে রোদ বকতে চাচ্ছে না। এজন্য চুপ করে ওর কান্ড দেখছে। অপর সিটের মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে ওদের লক্ষ্য করছে। মেয়েটা নিজে থেকে রোদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

“হাই! আমি মেহরীন।”
রোদ মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ‘ওহ আচ্ছা’ বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অপরিচিত কারো সঙ্গে সে খেজুরে আলাপে অভ্যস্ত নয়। বিশেষ করে কোনো মেয়ের সাথে। রোদের এমন বেমানান উত্তরে মেয়েটা বুঝল, সে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তাই ব্যাপারটা স্মার্টলি বুঝিয়েও দিলো। মেয়েটা সিটে হেলান দিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে রইল। ওর কেন জানি ওদের দেখতে খুব ভালো লাগছে।
তখন মেঘ রোদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি তুলে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“দাভাই বলো তো কে বেশি হ্যান্ডস্যাম?”
“অবশ্যই আমি।”
কথাটা শুনে মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ওই মেয়েটাকে প্রশ্নটা করল। মেয়েটা একবার মেঘের দিকে তো একবার রোদের দিকে তাকাচ্ছে। দুই ভাই সাদা কালো রংয়ের ড্রেস পরিহিত। দু’জনের চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস। দেখতেও ওরা বেশ সুদর্শন। মেয়েটা কাকে রেখে কাকে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তাই সে মুখ কাঁচুমাচু করে আমতা আমতা করতে লাগল। তখন মেঘ রেগে বলল,
“বলতেই তো পারলেন না। তাহলে ভুলেও আর আমাদের দিকে তাকাবেন না। নাহলে আমি চিৎকার করে সবাইকে বলব, আপনি আমাকে চোখ মেরেছেন।”

এতটুকুন বাচ্চার কথা শুনে মেয়েটা অবাক না হয়ে পারল না। বাস ভর্তি লোকের সামনে সে অপমানিত হতে চাচ্ছে না। তাই দ্রুত চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। আর মেঘ চিপস খেতে খেতে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে লাগল। রোদের একটু পর পর ফোনে কল আসছে। সে অফিসের দরকারী কল গুলো রিসিভ করে কথা বলছে। একসময় সে খেয়াল করল মেঘ ঘুমিয়ে গেছে। রোদ মেঘকে বুকে জড়িয়ে ওর কানের ইয়ারফোন খুলে নিলো। পানি নিয়ে হাত ভিজিয়ে মেঘের মুখটা মুছে মৃদু হেসে বলল,”দুষ্টু একটা।”
দুপুরে বাস থামিয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতে বলা হলো। রোদ মেঘকে ফ্রেশ করিয়ে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। তখন ওয়েটা এসে ওদের অর্ডার নিয়ে গেল। মেঘ টেবিলে দুই হাত রেখে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে। রোদ রুমাল দিয়ে মেঘের মুখ মুছিয়ে চুল গুলো ঠিক করে দিলো। মেঘ তখন সতর্কতার সাথে রোদকে মৃদু স্বরে বলল,
“দাভাই ওই মেয়েটাকে একটা চিমটি কেটে আসব? দেখো আমাদের দিকে কুটুর কুটুর করে তাকিয়ে আছে।”
” উহুম! তুমি ওইদিকে তাকিও না।”
“উখে।”

তারপর খাবার এলে দু’জনে খাওয়া শুরু করল। রোদ নিজে খাচ্ছে আর মেঘকেও খাইয়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে মেঘের চোখ গেল মেহরীনের দিকে। সে মেঘকে ফ্ল্যায়িং কিস ছুঁড়ে ইশারায় কাছে ডাকছে। মেঘ চিবানো থামিয়ে আড়চোখে একবার রোদের দিকে তাকাল। রোদ ওর সামনের গ্লাসে সব দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরেই এমন করছে। সে কিস গুলো ছুঁড়ছে মেঘকে নয় রোদকে। আর রোদ সব দেখেও চুপ করে আছে। কারণ সে বুঝেছে, মেহরীন গায়ে পড়া টাইপের মেয়ে। সে বাস থেকে নেমেই ইশারায় রোদের ফোন নাম্বার চেয়েছে। আর এসব মেয়েদের রোদের মোটেও সহ্য হয় না। তার ভাষ্যমতে, মেয়ে হবে ভদ্র, শান্ত, বিনয়ী, লাজুক, আর একটু ভীতু টাইপের। তা না মেয়েটা এসবের বিপরীত। এক কথায় লাজ লজ্জাহীন। আর এমন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে ওর রুচি আসে না। রোদ চুপ করে খাচ্ছে। তখন মেঘ কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,
“আপনি এত খারাপ কেন? আমার দাভাইকে চোখ মারতে আপনার লজ্জা করছে না? আপনাকে আর কতবার নিষেধ করব?”
মেঘের আঙ্গুল তুলে বলা কথাটা শুনে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। বাচ্চা মানুষ নিশ্চয়ই অযথা মিথ্যা বলবে না। তাই সবাই খাওয়া থামিয়ে মেহরীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরীন লজ্জায় মাথা নিচু করে উঠে চলে গেল। বিচ্ছু বাচ্চাটা যে ওকে এভাবে কুপোকাত করবে সে ভাবতেও পারে নি। মেহরীনের যাওয়া দেখে মেঘ বিশ্বজয় করা হাসি দিয়ে বসে পড়ল। রোদ মেঘের মুখে খাবার দিয়ে বলল,

“শান্তি হলো?”
“হুম খুব। জানো দাভাই মুগুরকে কুকুর দিতে হয়, নাহলে সে ভদ্র হয় না।”
মেঘের কথা শুনে রোদ মুচকি হেসে বলল,”মুগুরকে নয়। কথাটা হবে, ‘কুকুরকে মুগুর দিতে হয়।’
কথাটা ভুল বলেছে বুঝে মেঘ জিহবায় কামড় বসিয়ে হাসল। রোদও হেসে মেঘের মুখ মুছিয়ে উঠে দাঁড়াল।
রোদ মুচকি হেসে বলল,”মুগুরকে নয়। কথাটা হবে, ‘কুকুরকে মুগুর দিতে হয়।’
কথাটা ভুল বলেছে বুঝে মেঘ জিহ্বায় কামড় বসিয়ে হাসল। রোদও হেসে মেঘের মুখ মুছিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আরো কিছু শুকনো খাবার কিনে বিল মিটিয়ে বাসে উঠে বসল। মেহরীন বাসে নেই। হয়তো লজ্জায় চলে গেছে নয়তো এটাই তার গন্তব্যস্থল ছিল। সব যাত্রীরা আসলে পুনরায় বাস চলতে শুরু করল। ওদের নীল সাদা রং মিশ্রিত বাসটা দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে রাঙ্গামাটির পথে। মেঘ রোদের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছে। কিন্তু জানালার কাঁচ ভেদ করে প্রকৃতি দেখে তৃপ্তি পাচ্ছে না। তাই সে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে জানালা খুলে দিলো। তখন ভুরি ভুরি অবাধ্য বাতাস ঢুকে ওর চুল গুলোকে এলোমেলো করো দিলো। বাতাসের জন্য সে ঠিক মতো তাকাতে পারছে না। তাই বুদ্ধি করে চোখে সানগ্লাস পরে নিলো। এখন আর চোখে বাতাস লাগছে না দেখে মেঘ মুখ টিপে হাসল। অর্থাৎ বাতাসকে সে পরাজিত করেছে। রোদ সিটে মাথা ঠেকিয়ে মেঘের কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসল। তখন বাস কন্ডাক্টর এসে বললেন,

“বাবু জানালা আটকাও এসি চলছে।”
“আঙ্কেল আর এই একটু!”
মেঘ ওর শাহাদত আঙ্গুলের চিমটি পরিমাণ দেখিয়ে কথাটা বলল। ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে উনি হেসে চলে গেলেন। জোর দেখিয়ে আটকাতে বললে বাচ্চাটার মন খারাপ হয়ে যেতো। ব্যাপারটা উনার কাছেও খারাপ লাগত। মেঘ খুশি হয়ে উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল।
তখন পেছনের সিটের একজন যাত্রী বাসের মধ্যে হরহর করে বমি করে দিলেন। উনার এসি বাস সহ্য হয় না। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে বাধ্য হয়ে এসি বাসে যাচ্ছেন। তাছাড়া উনি কিছুক্ষণ আগে পেট পুরো মাছ ভাত খেয়েছেন। সাথে মিষ্টি, মালাই চা, এবং পানটাও বাদ রাখেন নি। ভরপেট খেয়ে বাসের ঝাঁকুনিতে অবশেষে যা হওয়ার তাই হলো। মেঘ সেদিকে ঘুরতে গেলে রোদ ওকে নিষেধ করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেঘ কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলল,
“জানো দাভাই? কুকুর রা খুব মজা করে বমি খায়। আমি পরশুদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে দেখেছি।”
“ঘুমাও।”

রোদ ছোট থেকেই কারো বমি দেখতে পারে না। কেউ বমি করলে সে দশ হাত দূরে থাকে। নয়তো কাল ক্ষণ ভুলে সেও বমি করে দেয়। কিন্তু মেঘ হয়েছে তার বিপরীত। কারো বমি দেখলে ওর কিচ্ছু হয় না। বরং সে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে, কেন বমি করছে? বমি করতে কষ্ট হচ্ছে নাকি? নিজের শরীরে বমি করছে, নাকি অন্যের শরীরে? এজন্য রোদ মেঘকে থামাতে ঘুমাতে বলল। নাহলে সে এখন বমি নিয়ে গবেষণা করা শুরু করত। ওই মহিলা বমি করে ঢকঢক করে পানি খেয়ে আবার বমি করলেন। বাসের কন্ডাক্টর বিরক্ত হয়ে সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। এখন এসব আবার পরিষ্কার করাতে হবে। সিটের সামনে পলিব্যাগ রাখা সত্ত্বেও বাসের মধ্যেই কাজটা সারলেন। কেউ আর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যে যার মতো বসে রইল।
তারপর ওরা যথাসময়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছে রোদের বুক করা রিসোর্টে উঠল। রিসোর্টের বাহ্যিক দিকটা বেশ সুন্দর। ভেতরটাতে হরেক রকম লাইটের ঝলকানিতে অন্য রকম এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। আর দেখতেও দারুণ লাগছে।
রোদ দো’তলার একটা রুমে প্রবেশ করে চারিদিকে চোখ বুলালো। রুমটা সুনিপুণ ভাবে সাজানো গুছানো। কাঠের মেঝে দেখে মেঘ লাফিয়ে পরখ করে দেখল, ভাঙ্গে নাকি? কিন্তু না কিছুই হলো না! তাই সে দৌড়ে গেল জানালার কাছে। একটু দূরে অন্ধকারে আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড় দেখে মেঘের আর তর সইছে না। রাত না হলে এখনই সে দৌড়ে গিয়ে পাহাড় ছুঁয়ে আসত। অনেক দিন পর আজ লং জার্নি করে দু’জনেই বেশ ক্লান্ত। তাই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দু’জনেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেল।

পরেরদিন সকালে ওরা রিসোর্ট ছেড়ে সাজেকের পথে রওনা দিলো। সেখানেও রোদ আরেকটা রিসোর্টের ব্যবস্থা করে রেখেছে। মেঘ পাহাড়, আকাশ, আর প্রকৃতির সৌন্দর্য ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এর আগে সে স্বচক্ষে পাহাড় দেখেনি। তাই ওর কাছে সবকিছু বিষ্ময়কর লাগছে। সাজেক পৌঁছাতে ওদের দেরী হয়ে গেছে। তাই রোদ দূরে কোথাও না গিয়ে মেঘকে আশ-পাশটা সব ঘুরে দেখাল। পাহাড়িদের দোকান থেকে মেঘের পছন্দে টুকিটাকি জিনিস কিনল। তারপর দুপুরে খেয়ে ওরা একটু ঘুমিয়ে বিকালে বের হলো। রোদ মেঘকে সূর্যাস্ত দেখা নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে চির সবুজের মাঝে লাল আভা ছড়ানো সূর্যের অপরুপ সৌন্দর্য্য। কিন্ত মেঘের বায়না সে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সূর্যাস্ত দেখবে। রোদ বোঝাল, সন্ধ্যার পর পাহাড়ির এলাকা খুব বিপদজনক। তাছাড়া এখন পাহাড়ে উঠলে নামার আগেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাবে। তবুও মেঘ শুনল না। সে জেদ করে মাটিতে বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল। রোদ বিরক্ত হয়ে একটা পাহাড়ে মেঘকে নিয়ে সাবধানে উঠল। ওদের উঠতে উঠতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। যারা আগে পাহাড়ে উঠেছিল, তারা একে একে সবাই নেমে যাচ্ছে। একজন যুবক রোদকে ডেকে বলল,”ভাই নেমে যান। সন্ধ্যার পর জায়গাটা খুব বিপদজনক। আর পাহাড়ে তো জন্তু জানোয়ারের অভাব নেই। ”

“জ্বি।”
কথাটা বলে রোদ ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ হাঁটু মুড়ে বসে দুই গালে হাত রেখে পাহাড় দেখছে। আহা! কি সুন্দর সবুজ সবুজ পাহাড়। যদিও পাহাড় সবুজ নয়।গাছগুলো দেখে এটা ওর অবুজ মনের ভাবনা আর কি। হঠাৎ মেঘ ভ্রু কুঁচকে রোদকে জিজ্ঞাসা করল,
“দাভাই, পাহাড় কী সিগারেট খায়?”
“হঠাৎ একথা কেন?”
মেঘ আঙ্গুল দিয়ে অদূরে পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়া দেখিয়ে সুর টেনে বলল,
“ওই যে পাহাড়ের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।”
“ওগুলো ধোঁয়া না কুয়াশা।”
“ওহ আচ্ছা।”
মেঘ এবার মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল। আকাশটা পরিষ্কার পানির মতো ঝকঝক করছে। ওর মনে প্রশ্ন জাগল,’আকাশ কি পরিষ্কার পানি খায়?’ পানি না খেলে আকাশটা এত ঝকঝক করছে কেন?’ মেঘ প্রশ্নটা করার আগে রোদ বলল, ”চলো এবার যেতে হবে।”

এত সুন্দর আকাশ! এত সুন্দর পাহাড় রেখে ওর যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে শক্ত হয়ে সেভাবেই বসে রইল। রোদ মেঘের হাত ধরে টানছে কিন্তু মেঘ কিছুতেই উঠছে না। তার একই কথা সে যাবে না। রোদ টানার ফলে মেঘ মাটিতে ছেঁচড়ে যাচ্ছে তবুও উঠতে চাচ্ছে না। এই জায়গাটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। ওর খুব করে ইচ্ছে করছে, এখানে একটা ঘর বানিয়ে সারাজীবন থেকে যেতে। তাহলে রোজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্কুল কোচিংয়ে যেতে হবে না। পড়াশোনার ঝামেলা পোহাতে হবে না। আহা! পড়াশোনা না থাকলে কতই না ভালো হতো। এদিকে সবাই একে একে পাহাড় থেকে নেমে গেছে। এখন শুধু ওরা দু’জনই আছে। রোদ আশে পাশে তাকিয়ে মেঘকে বোঝাতে আদর দিয়ে বলল,
“ভাই আমরা আবার কালকে আসব। সন্ধ্যার পর এখানে গরিলা আসে।”
“না, না, তুমি শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। আমি সব বুঝি দাভাই।”
“মেঘ আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। সব সময় জেদ ভালো লাগে না।”
রোদ বকছে দেখে মেঘ ছলছল করে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। ততক্ষণে ধীরে ধীরে চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ঘন জঙ্গলের কারণে পাহাড়ের বুকে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে। অদূরে বুনো বাদুড়ের দল চ্যা চ্যা শব্দ করে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলছে। পাশের জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। দিনের আলো বিদায় নিয়ে রাতের আঁধারের খেলা শুরু। পাহাড়ের সবুজ সবুজ গাছ গুলো ধীরে ধীরে ঘন আঁধারে ডুবে যাচ্ছে।

রোদ ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল! তবুও সে সাহস করে মেঘকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। অন্ধকার দেখে মেঘও গুটি গুটি পায়ে রোদের সাথে হাঁটতে লাগল। রোদকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ হাঁটতে হাঁটতে করুণ সুরে বলল,”সরি দাভাই, আমি আর জেদ করব না। তুমি আর রাগ করো না প্লিজ। তুমি কথা না বললে আমি কষ্ট পাচ্ছি।”
“আমি রাগ করিনি সোনা। চলো আর একটু দ্রুত পা চালাও।”
কথাটা বলে রোদ চিন্তিত হয়ে মেঘকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পাহাড়ের উঁচু নিচু রাস্তায় খুব দ্রুত হাঁটাও যাচ্ছে না।

ফোনের আলোয় পথ দেখে যতটুকু যাওয়া সম্ভব, ওরা যেভাবেই এগোচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে ওরা অজান্তেই পথ হারিয়ে ফেলল। অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। মেঘ আর পা চালাতে না পেরে মুখ থুবকে পড়ে গেল। শক্ত গাছের শেখরে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রোদ মেঘকে দ্রুত তুলে দেখল মেঘের হাঁটু ছিলে রক্ত বের হচ্ছে। রোদ মেঘের ক্ষত স্থানে রুমাল বেঁধে কোলে তুলে নিলো। মেঘ ভয়ে গুটিশুটি হয়ে রোদের বুকে মুখ লুকিয়েছে। অজানা ভয়ে রোদের বুকটাও দুরুদুরু কাঁপছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আচানক রোদের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। মেঘ আরো শক্ত করে রোদকে আঁকড়ে ধরল। রোদ অনেক চেষ্টা করেও ফোনটা আর অন করতে পারল না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর এক পা ফেলারও বুদ্ধি নেই। কালো মেঘের আড়ালে আকাশটাও মুখ লুকিয়েছে। ঘন অন্ধকার আর আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আজ ঘোর অমাবস্যা। অন্ধকার যেন চাঁদের সবটুকু আলো গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে। রোদ আর দিশা না পেয়ে মেঘকে নিয়ে ওখানেই বসে পড়ল। মেঘ রোদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আছে। ওর অন্ধকারে থাকার অভ্যাস নেই। রোদ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মেঘকে স্বাভাবিক রাখার। কিন্তু এই মূহুর্তে রোদ কথা খুঁজেও পাচ্ছে না। মেঘ তখন হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“দাভাই, আমরা কি এখন মরে যাব? আমি খুব ভয় পাচ্ছি দাভাই।”
“না সোনা, আল্লাহ ভরসা আমাদের কিচ্ছু হবে না। এই তো আমি আছি তোমার সাথে। তুমি ভয় পেও সোনাপাখিটা।”
কথাটা বলে রোদ আরো শক্ত করে মেঘকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেঘ ভয়ে মৃদু ভাবে কাঁপছে। এই পরিস্থিতিতে রোদের নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। এখন কিভাবে কী করবে? সেও ভেবে পাচ্ছে না।
তখন বেশ কয়েকজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। রোদ মৃদু স্বরে মেঘকে শব্দ করতে নিষেধ করে চুপ থাকল। কিন্তু
দূর্ভাগ্যবশত মশালের আলোয় কেউ একজন ওদের দেখে নিলো। সে মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে ওর অন্য সঙ্গীদের ডেকে নিলো। মেঘ রোদের র্শাট খামছে ধরে চোখ বন্ধ করে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। রোদ মেঘকে বার বার বলছে,”আমি আছি সোনা ভয় পেও না। দাভাই তোমার কিচ্ছু হতে দিবে না।”

রোদ কম্পতি কন্ঠে এসব বলছে ঠিকই। কিন্তু টেনশনে ওর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ততক্ষণে অনেকজন মিলে ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। ওদের দেখে পাহাড়ের বসবাসরত বন্য জঙ্গি মনে হচ্ছে। রোদ কিছু বলার আগে ওরা মেঘকে জোর করে কেড়ে নিলো। মেঘ ভয়ে রোদের দিকে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে দাভাই! দাভাই! করে কাঁদছে। রোদ ওদের অনুরোধের সুরে বলল,
“আ আমরা আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি। তবুও ওকে আমার কাছে দেন। বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে, প্লিজ!”
ওরা কেউ রোদের কথা শুনল না। বরং একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগল। একজন মেঘকে কোলে নিয়ে উপরে ছুঁড়ে আবার ক্যাচ ধরল। বেশ কয়েকবার এমন করাতে মেঘ ভয়ে উচ্চশব্দে কাঁদতে লাগল। আর ওর চিৎকারে জঙ্গিদের উল্লাসটা যেন দ্বিগুন হারে বেড়ে গেল।
মেঘ ভয়ে চিৎকার করে উচ্চশব্দে কাঁদছে। আর ওর চিৎকারে জঙ্গিদের উল্লাসটা যেন দ্বিগুন হারে বেড়ে যাচ্ছে। রোদ কম্পিত হাতে ওর ওয়ালেট আর ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনাদের যা লাগে নিয়ে যান। তাও আমাদের ছেড়ে দেন, প্লিজ! আই সোয়্যার আমরা আপনাদের কথা কাউকে বলব না।”
জঙ্গিরা রোদের কথা না বুঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রোদ আঁকুতি ভরা কন্ঠে বার বার বলছে ওদের ছেড়ে দিতে। মেঘ ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে নেতিয়ে পড়েছে। একজন জঙ্গি রোদের ওয়ালেট আর ফোন’টা থাবা দিয়ে কেড়ে নিলো। তারপর মুখে অদ্ভুত শব্দ করে দুই ভাইকে জোর করে ওদের অস্তানায় নিয়ে গেল। পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে তাদের আস্তানা। সেখানে কয়েকটা তাবু টানিয়ে দু’একটা মশাল জ্বালানো। ওরা পাহাড়ে বসবাস করলেও এক পাহাড়ে কখনো স্থায়ী ভাবে থাকে না। মশালের আবছা আলোতে দেখা গেল, জঙ্গিদের মুখে কালি দিয়ে আঁকিবুঁকি করা আর চামড়ার পোশাক। অদ্ভুত তাদের ভাষা!

কয়েকজন অর্ধ নগ্ন মেয়েকেও সেখানে দেখা গেল। যুবতী মেয়েদের উপরে অংশে চামড়ার পোশাক থাকলেও মধ্য বয়স্কদের কিছু নেই। অথচ তারা দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের মাঝে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি। ওরা এখনো আদিম যুগের সংস্কৃতিতেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া মানুষের মাংস খেয়েও ওরা অভ্যস্ত। আজ দু’টো মানুষ পেয়ে তাই তাদের এত উল্লাস। রোদের জানামতে এরা খুব হৃদয়হীন এবং ভয়ংকরও বটে। কয়েকজন মাঝ বয়সি মহিলা এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। উনাদের পোশাক দেখে রোদ মেঘ দু’জনেই দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। তখন আরো কয়েকজন জঙ্গি উপস্থিত হয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। রোদ নিজের প্রাণের ভয় পাচ্ছে না, কিন্তু মেঘ? রোদ ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘের দিকে তাকাল। সে এখনো গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রোদকে তাকাতে দেখে মেঘ আঁকুতি ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। এই দৃষ্টি যেন চিৎকার করে বলছে,”দাভাই আমি ভয় পাচ্ছি! আমাকে বাঁচাও!
রোদের হাতেও কিছু করার নেই। ওরা এখন এই পরিস্থিতির স্বীকার। মেঘকে দেখে কষ্টে রোদের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। তাই সে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকাতেই ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। তখন দুইজন এসে ওদের’কে দুরত্ব রেখে গাছের সাথে বাঁধল। শক্ত করে বাঁধার জন্য মেঘ ছটফট করে বলল,

“আমি খু্ব ব্যাথা পাচ্ছি আঙ্কেল। উফ! আমার হাতে খুব লাগছে। আঙ্কেল প্লিজ একটু আস্তে বাঁধুন।”
“ওর হাতটা খুলে দেন। আমাকে আরো কষ্ট দেন তবুও ছোট বাচ্চাটাকে আর কষ্ট দিয়েন না। এই যে শুনছেন? আমার অনুরোধ’টা প্লিজ রাখুন।”
মেঘ ব্যাথায় ছটফট করে কাঁদছে। জঙ্গি দু’টো ওদের কথা বুঝতে না পেরে শব্দহীন পায়ে চলে গেল। ব্যাথার চোটে মেঘের কান্নার বেগ বাড়তে লাগল। মেঘকে কাঁদতে দেখে একটা মেয়ে এসে স্বজোরে মেঘের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রোদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে কোনোদিন ভুলেও মেঘকে ফুলের টোকা দেয়নি। আর আজ ওর সামনে ওর কলিজা’টার গায়ে মেয়েটা হাত তুলল। রোদ আদুরে সুরে বার বার মেঘকে কাঁদতে নিষেধ করছে। শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড়ে মেঘের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। মনে হচ্ছে ফর্সা গাল থেকে এক্ষুণি রক্ত গড়িয়ে পড়বে। মেঘের কান্না থামছে না দেখে মেয়েটা মেঘের মুখে গাছের পাতা গুঁজে দিলো। মেঘ বমি করতে গেলে মেয়েটা আরো জোর করে মুখে পাতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মেঘ এবার ছটফট করলে মেয়েটা শক্ত করে মেঘের নাক চেপে ধরল। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মেঘ অস্থির হয়ে কাটা মুরগির মতো দাপাদাপি করতে লাগল।

রোদ মেয়েটাকে বার বার অনুরোধ করছে ওকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সে শুনছে না। রোদ একপর্যায়ে অসহায় হয়ে অঝরে কাঁদতে লাগল। ওর কলিজাটা’র কষ্ট সে আর দেখতে পাচ্ছে না। নিঃশ্বাস না পেয়ে মেঘের চোখ উল্টো প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মেয়েটা মেঘের নাক ছেড়ে গাল চেপে ধরে শাসিয়ে চলে গেল। মেঘ মুখে পাতা নিয়ে অস্পষ্ট সুরে কী যেন বলছে। ওর চোখ দু’টো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। মেঘের করুণ অবস্থা দেখে রোদ ছটফট করে অসহায় কন্ঠে বলল,
“মেঘ! মেঘ সোনা আমার কলিজা’টা। ভাই একটু তাকাও আমার দিকে। এই মেঘ! দাভাই তোমাকে ডাকছে শুনবে না তুমি? আমি কষ্ট পাব তাহলে, এই মেঘ!”
মেঘের শরীর ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসছে। ভয়ে ওর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমান কমে জ্ঞান হারানোর উপক্রম। রোদ ব্যাকুল হয়ে মেঘকে বার বার ডাকছে। কিন্তু মেঘের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
তখন একটা মেয়ে এসে রোদের পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে উঠতে উঠতে লাগল। মেয়েটা শ্বাস টেনে রোদের শরীরের গন্ধ নিচ্ছে। রোদ রাগ, ক্ষোভ, বিরক্ত আর অসহায়ত্ব নিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মেয়েটা ওর সাথে অদ্ভুত আচরণ করছে। শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কখনো বা শার্টের কলার টেনে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে। আবার কখনো বিশ্রী হেসে রোদের ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছে। আর এই মেয়েটার কান্ড দেখে বাকিরা নিকটে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। রোদ চোখ বন্ধ করে মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থণা করছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ওদের এই পরিস্থিতি থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এরা নোংরা মস্তিষ্কের বদ্ধ উন্মাদ জঙ্গি। এরা শরীর নিয়ে খেলতে বেশ পছন্দ করে। এদের পোশাক আর ব্যবহার দেখে সেটা স্পষ্ট। তাছাড়া এরা মুসলিম ধর্মের নয়, এটাও নিশ্চিত!

মেয়েটা রোদের শার্টের বোতাম খুলতে গেলে রোদ অনবরত নড়ে বাঁধা সৃষ্টি করল। মেয়েটা রেগে নাক ফুলিয়ে শক্ত করে রোদের চুল খামচে ধরল। রোদ প্রচন্ড ব্যাথা পেলেও টু শব্দ করল না। রোদের জেদ দেখে মেয়েটা হেসে রোদের গালে ঠোঁট বুলালো। তারপর দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দিকে একবার তাকিয়ে শক্ত করে রোদের দুই চিবুক ধরে ঠোঁট স্পর্শ করল। তাৎক্ষণিক রোদ ওর ঘাড় ঘুরিয়ে বমি করতে লাগল। মেয়েটা দাঁতে আর ঠোঁটে কালো কী সব লেগে আছে। আর সেটা থেকে বিশ্রী একটা পঁচা গন্ধ আসছে। গন্ধটাতে রোদের পেটের নাড়ি-ভুঁড়িও মোচড় দিয়ে উঠছে।
জঙ্গি মেয়েরা কালো জিনিসটা লিপষ্টিক হিসেবে ব্যবহার করে। আর এটা বন্য শূকরের কলিজা বেটে রোদে শুকিয়ে তৈরী করা হয়। রোদে শুকানো পর কালো হয়ে গেলে ওরা ঠোঁটে লাগায়। এবং মনে করে এটা ঠোঁটে লাগালে পুরুষরা খুব সহজে ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কারণ ওদের জাতের পুরুষটা এটার জন্য পাগল।
কিন্তু রোদের বমি করা দেখে মেয়েটা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে চলে গেল। তখন আরেকজন এসে মেঘের প্যান্ট খুলতে লাগল। মেঘ ছটফট করে উম উম শব্দ করে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করছে। কিন্তু সে শুনল না। বরং পাত্র এগিয়ে ইশারায় মেঘকে প্রসাব করতে বলল। রোদ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। মেঘ প্রসাব করছে না দেখে মেয়েটা রেগে একটা থাপ্পড় মারল। পুনরায় থাপ্পড় খেয়ে মেঘ ভয়ে আরো কুঁকড়ে গেল।

রোদ অন্য দিকে তাকিয়ে সমানে অঝরে অশ্রু ঝরাচ্ছে।নিজেকে এতটা অসহায় ওর কখনো লাগে নি। মেঘ চোখ বন্ধ করে প্রসাব করলে সেটা নিয়ে মেয়েটা চলে গেল। ওরা মদের সঙ্গে বাচ্চাদের প্রসাব মিশিয়ে পান করে। ওদের ভাষ্যমতে, ‘বাচ্চা হচ্ছে ঈশ্বরের আরেকটা রুপ। তাই বাচ্চাদের প্রসাবও খুব পবিত্র।’
তাছাড়া বাচ্চাদের প্রসাব খেলে নাকি শরীরের উন্মাদনা বৃদ্ধি পায়। এবং দীর্ঘদিন ধরে কাম শক্তি ধরে রাখা যায়। ওদের প্রসাব খাওয়া দেখে দুই ভাই আবার বমি করতে লাগল। বমি করতে করতে ওদের কাহিল অবস্থা। রক্তে মাংসে গড়া মানুষ যে এতটা নোংরা হয় ওদের জানা ছিল না। জঙ্গিরা গোল হয়ে বসে মদ খাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করছে। ওদের দিকে তাকিয়ে রোদের ভয়টা ক্রমশ বৃদ্ধ পাচ্ছে। জঙ্গিরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা আগে মেঘকে বলি দিবে। তারপর মেঘের পবিত্র রক্ত দিয়ে ওদের কাম দেবতার আরাধনা করবে। এবং মেঘের মাংস দিয়ে তৃপ্তি করে ভুরিভোজ করবে। তারপর কথা উঠল রোদকে নিয়ে।
রোদকে নিয়ে কিছু বলার আগে কয়েকজন মেয়ে তাদের ইচ্ছের কথা জানাল। কথাটা শুনে জঙ্গি ছেলেরা উচ্চশব্দে হেসে উঠল। রোদের মতো টগবগে যুবক পেয়ে মেয়েরা হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। তাই তারা এই সুযোগের ফায়দা উঠাতে চাচ্ছে।
আলোচনায় বসে নোংরা মস্তিষ্কের মানুষ গুলো নোংরা পরিকল্পনা সমাপ্ত করল। তারপর ঠিক হলো রোদের সঙ্গে ওই মেয়েগুলো যথাশীঘ্রই ঘনিষ্ঠ হবে। তারপর তাকেও বলি দেওয়া হবে।

জঙ্গি প্রধান আঙ্গুলের ইশারায় অন্য জঙ্গিদের কিছু একটা বোঝাল। তখন দুইজন গিয়ে মেঘের হাতের বাঁধন খুলে দিলো। রোদ কিছু একটা আন্দাজ করে পেরে বার বার জিজ্ঞাসা করছে,
“ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কি হলো বলুন? মেঘ! মেঘ!”
ততক্ষণে মেঘের জ্ঞান হারানো শরীর মাটিতে লুটে পড়েছে। ওই দুইজন মেঘকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বলি কাঠে শুইয়ে দিলো। আর একজন এসে রোদের মুখটা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। রোদ শত চেষ্টা করেও আর কিছু বলতে পারছে না। শুধু পানি ছাড়া মাছের মতো দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে ছটফট করছে। তারপর স্বজোরে পানি ছুঁড়ে মেরে মেঘের জ্ঞান ফেরানো হলো। মেঘ ওর সামনের জনের হাতে ধারালো রামদা দেখে ভয় থরথর করে কাঁপছে। রামদা ধরা ব্যাক্তি বাঁকা হেসে মেঘের আঙ্গুলে পোজ দিলো। আর সেই পোজে মেঘের আঙুল কেটে গলগল করে রক্ত গাড়িয়ে গেল। মেঘ ব্যাথায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এতটুকু দেখে রোদের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪+৫+৬