এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪+৫+৬

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪+৫+৬
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পরেরদিন সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে নতুন দিনের সূচনা করল। ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের আগমনে প্রকৃতি পুনরায় নিজের প্রকৃত রুপে ফিরে এসেছে। মৃদু বাতাস, বুনো পাখিদের কলবর, মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ, আর সবুজের সমারোহে অপরুপ এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে। কাক ডাকা ভোরে কয়েকজন পাহাড়ি তরুণী পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে। এই পথ দিয়ে তারা রোজ যাওয়া-আসা করে। এরা পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট দোকান গুলোতে হরেক রকম জিনিস বিক্রি করে। কত শত পর্যটকরা এসে তাদের পছন্দ মতো জিনিসপত্রও কিনে। সেখানে সারি সারি দোকান গুলোতে, তাঁতের শাড়ি, গামছা, থামি, আচার, ফলপাকড়, শামুকের তৈরী মালা দুলসহ আরো নানান জিনিস পাওয়া যায়। সুলভ মূল্যের কারণে ক্রয়-বিক্রয়ও ভালোই হয়।
একদল তরুণীর পেছনের সারিতে দু’জন গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। তাদের একজনের হঠাৎ চোখ গেল জঙ্গলের দিকে । তরুণী থমকে দাঁড়িয়ে ওর পাশে জনকে আঙ্গুলের খোঁচা মেরে বলল,

“বু ওতা কী লে? দেকে তো মানুচ মুনে ওচ্ছে?”
“কই?”
মুন নামের মেয়েটি ওর পাশের জনকে জঙ্গলে তাকাতে
ইশারা করল। মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে মুনকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল। ওরা সেখানে পৌঁছে দেখল, একটা ছেলে অজ্ঞান অবস্থায় উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ছেলেটার সাদা শার্ট রক্তে ভিজে চুপচপে হয়ে গেছে। মুন রক্ত দেখে নাক ছিঁচকে দুই পা পিছিয়ে গেল। ওর পাশের মেয়েটি মৃদু স্বরে বেশ কয়েকবার ছেলেটাকে ডাকল। ছেলেটার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে একই অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবকে পড়ে আছে। মুন আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে সতর্কতার কন্ঠে বলল,
“বু চল আমলা পালাই। এতা মুনে হয় মলা মানুচ।”
“উফ! চুপ কর।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাটা বলে মেয়েটা বসে অনেক কষ্টে রোদকে চিৎ করল। রোদের মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মেয়েটি রোদের নাকে, বুকে, কান পেতে নিঃশ্বাসের গতি পরীক্ষা করল। তারপর মুনের থেকে পানি নিয়ে মেয়েটি রোদের মুখে পানির ছিঁটা দিলো। রোদের নিঃশ্বাস ধীর গতিতে চলছে। মেয়েটি ওর দুই হাত দিয়ে আস্তে আস্তে রোদের বুকে চাপ দিলো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। মেয়েটি উপায় না পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মুনের দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকাল। মুন না বোধক মাথা নাড়িয়ে মেয়েটিকে নিষেধ করছে। মুন বুঝতে পেরেছে ওর বু এর তাকানো মানে। মুনের নিষেধ অগ্রাহ্য করে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে রোদের নাক চেপে ধরে রোদের ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। মুন ওর বু এর কাজে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে একটা পা পিছিয়ে গেল। সে বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি রোদকে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সূর্যের তাপে মেয়েটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ঘামটুকুতে শিশির বিন্দুর মতো অদ্ভুত এক সৌন্দর্য লুকায়িত আছে। মেয়েটি পরপর দুই বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। হার না মেনে সে পুনরায় চেষ্টা করায় রোদ মৃদু ভাবে নড়ে উঠল। রোদকে নড়তে দেখে আবার শ্বাস দিয়ে নাক ছেড়ে দিলো। রোদ পরপর জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলো। মেয়েটি রোদের মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে বুকে হালকা ভাবে চাপ দিতে লাগল। রোদ হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রোদকে নিঃশ্বাস নিতে দেখে মেয়েটি মৃদু হেসে ধীর কন্ঠে ডাকল,

“শুনছেন! এই যে! কি হয়েছে আপনার?”
রোদ ধীরে ধীরে একবার চোখ খুলে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর শরীরে উঠে বসার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। পুরো শরীরের অসহ্য ব্যাথায় জর্জরিত সে। চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে বুজে আসছে।
কালকে মেঘের ওই অবস্থায় দেখে রোদের মস্তিষ্ক অচল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। পরে জঙ্গিরা এসে পানি ঢেলে ওকে সজাগ করেছিল। রোদ সজাগ হয়ে বার বার আঁকুতি করে মেঘের কথা জিজ্ঞাসা করছিল। ওরা কিছু বলছিল না শুধু উচ্চশব্দে হাসছিল। তখন আচানক একটা মেয়ে এসে বিশ্রী ভাবে রোদের পুরো শরীরে হাত বুলাতে লাগল। রোদ এসব সহ্য করতে না পেরে রেগে মেয়েটার মুখে একদলা থুথু ছুঁড়ে মারল। ওর এই কাজে বাকিরা রেগে রোদকে চামড়া জাতীয় কিছু দিয়ে খুব মারতে লাগল। সেটা দিয়ে মারার সঙ্গে সঙ্গে রোদের শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত গড়িয়ে গেল। তখন রোদের মুখ দিয়ে একটা কথায় বেরিয়ে ছিল,’ ম মা।’
ওদের মারের চোটে একপর্যায়ে রোদ পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপরে ওর আর কিছু মনে নেই।
মেঘের কথা স্মরণে আসতেই রোদ উঠতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মেয়েটি রোদের হাতের বাঁধন খুলে ওকে উঠে বসতে সাহায্য করল। রোদ আশে পাশে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে মেঘের নাম ধরে ডাকল। কিন্তু মেঘকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বলির জায়গায় রক্ত রোদ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুন ভয়ার্ত চোখে রোদের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,

“এ মানুচটা পাগল নাকি? এমন করচে কেন? আমাকে কাড়লে দিবে না তো?”
মুন দাঁত দিয়ে নক কেটে পেছাতে পেছাতে দৌড়ে পালালো। রোদ উঠে খুঁড়িয়ে হেঁটে সব জায়গায় মেঘকে খুঁজতে লাগল। মেয়েটাও রোদের পেছন পেছনে যাচ্ছে আর চিন্তিত স্বরে করছে,
“এই যে আপনি থামুন! আপনার পায়ে থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কি খুঁজছেন, আমাকে বলুন?”
“আ আমার ছোট্ট ভাই। ওরা আমার ভাইকে বলি… ।”

এতটুকু বলে রোদ আর কিছু বলতে পারল না। ওর চোখ দিয়ে অঝরে ঝড়ে গেল কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। রোদ পাগলের মতো মেঘকে ডাকছে আর এদিক-ওদিক খুঁজছে। ওর শরীরে অসহ্য ব্যাথা নিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেঘকে খোঁজার। অজানা একটা ভয়ে রোদের বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। সে মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে, ওর নিষ্ঠুর মন যেটা ভাবছে সেটা যেন না হয়।
মেয়েটাও রোদের সঙ্গে বলির স্থানে গিয়ে দেখল সেখানে কিছু নেই। তবে কারো রক্ত পড়ে আছে। আর রক্ত দেখে মনে হচ্ছে কাউকে জবেহ করা হয়েছে। রোদ থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটু দূরে একটা বস্তা দেখতে পেল। সে কিছু একটা ভেবে বস্তুা খুলে দেখল পঁচা শকূরের মাংস। পঁচা মাংসের গন্ধে সে পেট চেপে ধরে বমি করতে লাগল। সেই গন্ধে বমির সাথে ওর নাড়ি ভুড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম। খালি পেটে বমি করা যে কত কষ্টকর সে হারে হারে টের পাচ্ছে। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে রোদের দিকে পানি এগিয়ে দিলো। রোদ কুলি করে চোখে মুখে পানি দিয়ে ওখানে ধপ করে বসে পড়ল। ওর শরীরটা আর চলছে না। এখন নিজের শরীরের ভাড়টুকুও ওর অসহ্য লাগছে। সে খুব করে চাচ্ছে, এই মূহুর্তে
মৃত্যু এসে ওর দুয়ারে কড়া নাড়ুক। ওর প্রাণ পাখিটা উড়ে যাক অচেনা এক পথের বাঁকে। সে সাদরে গ্রহন করতে চাচ্ছে ওর মৃত্যুটাকে। কারণ মেঘকে ছাড়া ওর বাঁচার ইচ্ছেটুকু যে এখানেই শেষ।
রোদের দিক থেকে চোখ সরাতেই মেয়েটার চোখ পড়ল বস্তার পাশে থাকা রক্তের ফোঁটার দিকে। সে রক্তের ফোঁটা অনুসরণ করে জঙ্গলের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। তারপর কিছুদূর যেতেই দেখতে পেল, একটা ফুটফুটে বাচ্চার অর্ধ শরীর মাটিতে পুঁতে রাখা। বাচ্চাটার শুধু মাথাটুকু বেরিয়ে আছে আর বুক অবধি মাটি দিয়ে ঢাকা। মেয়েটা চিৎকার করে রোদকে বলল,

“এই যে শুনছেন এখানে আসুন। এখানে একটা বাচ্চাকে পেয়েছি।”
কথাটা শুনে রোদ দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখানে গেল। মেঘের এই অবস্থা দেখে রোদ পাগলের মতো হাত দিয়ে মাটি সরাতে লাগল। মেয়েটিও রোদের সাথে হাত লাগল। তারপর দু’জনে মিলে অনেক কষ্টে মেঘকে উদ্ধার করল। রোদ মেঘকে বুকে জড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভাই! এই ভাই! মেঘ আমার সোনাটা কথা বল। দাভাই ডাকছে তো কলিজাটা উঠ। এই মেঘ আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস! এই মেঘ! মেঘ!”
মেঘের সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটি পানি এনে মেঘের মুখে ছিঁটা দিয়ে বলল,
“ওর মুখে দ্রুত কৃত্রিম শ্বাস দেন। ধীর গতিতে এখনো ওর শ্বাস চলছে।”
মেঘের এই অবস্থা দেখে রোদের মাথা কাজ করছে না। মেয়েটি ওকে ধাক্কা দিয়ে পুনরায় একই কথা বলল। রোদ নিজেকে সামলে মেঘের নাক চেপে কৃত্রিম শ্বাস দিতে লাগল। আর মেয়েটি মেঘের বুকে ধীরে ধীরে চাপ দিতে লাগল। একপর্যায়ে মেঘের শরীর মৃদু ভাবে কেঁপে উঠল। মেয়েটি মেঘের মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে ডাকতে লাগল। মেঘ ধীরে ধীরে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। রোদকে দেখে মেঘ মৃদু স্বরে বলল,
“দা দা দাভাই ক কষ্ট হচ্ছে।”
“এই তো আমি সোনা। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।”

মেঘ আবার চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। রোদ মেঘের গালে হাত রেখে আদুরে সুরে ডেকে যাচ্ছে। মেঘের অসাড় শরীর মেঘের বুকে লেপ্টে আছে। মেয়েটি জানে এই জায়গাটা ওদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই সে রোদকে বলল,
“পাহাড়ের নিচে আমার বাড়ি। আপনারা আমার বাড়িতে চলুন, এই জায়গাটা কারোর জন্যই নিরাপদ নয়।”
কথাটা শুনে রোদ আর কিছু ভাবল না। সে রক্তাক্ত এবং ব্যাথাযুক্ত শরীরে মেঘকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটি ওর ব্যাগ নিয়ে ওদের সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। রোদ অনেক কষ্টে মেঘকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পাশের পাহাড়ের দিকে। মেয়েটির বাড়ি পাশের ছোট একটা পাহাড়ের নিচে। বাঁশ, টিন আর ছনের তৈরী ছোট একটা বাড়ি। মেয়েটি রুমে দরজা খুলে মেঘকে খাটে শুয়াতে বলে গেল পানি আনতে। রোদ অতি সাবধানে মেঘকে খাটে শুইয়ে দিলো। মেয়েটি বালতিতে পানি এনে মেঘের মাথায় পানি ঢেলে শরীর মুছিয়ে দিলো। রোদ অশ্রু ঝরিয়ে আদুরে সুরে মেঘকে ডাকছে আর হাত পা তেল দিয়ে মালিশ করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর, মেঘ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে,’ দাভাই!’ বলে চিৎকার করে উঠল। রোদকে ওর সামনে দেখে মেঘ ভয়ে রোদের বুকে হামলে পড়ল। দু’জন ভাই একে অপরের জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে লাগল। ওদের কান্না দেখে মেয়েটিও নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। মেঘ রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কেঁদে অস্পষ্ট স্বরে বলছে,

“দাভাই! দাভাই! ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে দাভাই। বাঁচাও আমাকে, বাঁচাও!”
“এই তো আমি সোনা। কিচ্ছু হবে না তোমার। এই তো আমি তাকাও, দেখো দাভাই তোমার সঙ্গে আছি।”
কথাটা বলে রোদ খেয়াল করল জ্বরে মেঘের শরীর থরথর করে কাঁপছে। রোদ মেঘকে বুক থেকে সরিয়ে মৃদু ভাবে ঝাঁকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে ডাকছে। কিন্তু মেঘ ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে রোদের বুকে লুটিয়ে পড়েছে। মেঘকে কাঁপতে দেখে মেয়েটি কাঁথা আনার জন্য পা বাড়াতেই, একজন বৃদ্ধ মহিলা এসে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আলো! তুই মরদ মানষ্যেরে ঘরে আনসোস ক্যান? লোকে জানলে আমাগোরে থুতু দিয়া খেদাইয়া দিবে। এক্ষুণি এগোরে বাইর কইরা দে কইতাছি। এক্ষুণি দে!”
-‘এলোকেশী কন্যা’-
[০৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
আলো ওর দাদীর কথা শুনে মুখ তুলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল।রোদের এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে উতলা হয়ে মেঘের জ্ঞান ফিরাতে ব্যস্ত। বৃদ্ধ মহিলা রেগে আলোকে পুনরায় ধমকে কর্কশ কন্ঠে বললেন,
“এই ছেমড়ি আমার কথা কানে হুনতাছোচ না?”

“দাদীমা উনারা খুব বিপদে পড়েছে। আর ছোট বাচ্চাটার অবস্থা খুব একটা ভালো না।”
কথাটা বলে আলো কাঁথাটা এনে মেঘের শরীরে জড়িয়ে দিলো। দাদীমা প্রচন্ড রেগে ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন। আলোর শেষ কথাটা রোদের কানে পৌঁছাতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ী সুরে বলল,”দাদীমা আমরা অতি শীঘ্রই চলে যাব। আমার ভাইটার অবস্থা খুব একটা ভালো না। দয়া করে একটু সময় দেন আমাদের।”
রোদের কথা শুনে দাদীমার নজর গেল খাটের উপরে মেঘের দিকে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা শরীরে জখম নিয়ে অবচেতন হয়ে শুয়ে আছে। উনি দৃষ্টি সরিয়ে রোদকেও ভালো মতো খেয়াল করলেন। রোদের শার্টে রক্ত দেখে বুঝলেন, ওরা সত্যিই বিপদে পড়ে আশ্রয় চাচ্ছে। কেন জানি, ওদের অবস্থা আর মায়াবী মুখ দেখে উনার মনটা একটু নরম হলো। উনি আলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আলো যা, দৌড় দিয়া হাকিম রে ডাইকা আন। সে নাড়ি দেইখা বুঝুক বাচ্চাডার কিরাম অবস্থা।”
দাদীর কথা শুনে আলো দৌড়ে গেল পাশের বাড়ির হাকিমকে ডাকতে। হাকিম হচ্ছেন, এখানকার হাতুড়িয়া একজন ডাক্তার। উনি রোগের প্রতিশোধক হিসেবে গাছগাছড়া দিয়ে থাকেন। কখনো সেই প্রতিশোধক সীমিত সময়ে দ্রুত অসুখ সারে। আবার কখনো মারাত্নক ভাবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। তবুও এখানকার বিদ্যাহীন মানুষ গুলো অগাধ বিশ্বাস নিয়ে উনার চিকিৎসা গ্রহন করেন। তাছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে সুচিকিৎসার কেনো উপায় নেই।

রোদ এ ব্যাপারে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। সে মেঘের হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে আর আদুরে সুরে ডাকছে। চঞ্চল বাচ্চাটা ভয়ে চুপসে গেছে। হঠাৎ মেঘের হাতের কাটা অংশ দেখে রোদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে মেঘে হাতে অসংখ্য আদর দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। মেঘ ওর বড্ড আদরের ভাই। সে ভুলেও কখনো ওর গায়ে হাত তুলেনি। অথচ আজ! মেঘের হাতের কাটা স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। দাদী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে ওদের দেখছে।
একটুপরে, আলোর সঙ্গে একজন মধ্য বয়সী পুরুষ রুমে প্রবেশ করলেন। উনি মেঘের নাড়ি দেখে সবুজ রঙ্গের তরল প্রতিশোধক দিলেন। এবং গাছগাছড়া বেটে ওর ক্ষত স্থানে লাগাতে বললেন। তখন দাদী চিন্তিত সুরে রোদকে দেখিয়ে বললেন,
“হাকিম এই পোলাডারেও ঔষধ পত্রর দাও। ওর অবস্থাও ভালা মনে হইতাছে না।”
“দিতাছি চাচি।”
হাকিম রোদকেও প্রতিশোধক দিয়ে বিদায় নিলেন। রোদ চুপ মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদী পানের পিক ফেলে ওদের বিশ্রাম নিতে বলে স্থান ত্যাগ করলেন। আলো খাবার এনে রোদের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“ওকে খাইয়ে তাড়াতাড়ি ঔষধ খাইয়ে দেন।”

“এগুলোতে কোনো সমস্যা হবে না তো? না মানে ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হয়ে গেলে?”
” আমরা এই চিকিৎসা নিয়েই এখনো বেঁচে আছি। এখানে বড় কোনো ডাক্তারের হদিস পাবেন না। পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়ে আমি, তাই প্রয়োজনে আমারও টুকটাক কিছু জানা আছে। আপনি চিন্তা করবেন না, আল্লাহ ভরসা।”
রোদ আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে আলোর কথায় মেনে নিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর, মেঘের জ্ঞান ফিরল। সে গুটিশুটি হয়ে রোদের বুকে হেলান দিয়ে বসে আলোকে দেখছে। আলো মেঘকে তাকাতে দেখে ওর মাথায় বুলিয়ে বলল,
“বাবু খুব কষ্ট হচ্ছে?”
মেঘ উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,”আ আমার নাম বাবু না। আমার নাম মেঘ মেহবুব।”
বাচ্চাটার কথা শুনে আলো মুচকি হেসে রোদের দিকে তাকাল। রোদ নিশ্চুপ হয়ে মেঘকে বুকে আগলে ধরে বসে আছে। মেঘ খুব চঞ্চল প্রকৃতির বাচ্চা বুঝে আলো মৃদু হেসে বলল,”আমি তোমাকে মেঘ বাবু ডাকি? এই নামে ডাকলে তুমি রাগ করবে?”
মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে রোদের দিকে একবার তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে রাগ করবে না। তারপর আলোর কথার ছলে রোদ মেঘকে খাবার খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিলো। আলো মেঘের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলে, মেঘ আলোকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেল। আলো ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বলল না। আজ অনেক দিন পর, মেঘ দাভাই ছাড়া ওর মাথায় অন্য কারো হাতের স্পর্শ পেল। আর এই স্পর্শে মা মা একটা আদুরে ব্যাপার আছে। রোদ মেঘের এভাবে তাকানোর মানে বুঝে চুপ ছিল। তবে আলোর সরল
ব্যবহারে মেঘ বেশ সন্তুষ্ট। তাই হয়তো ওর মনে খুব সহজে আলোর জন্য একটা টান সৃষ্টি হলো। মেঘকে ঘুমাতে দেখে রোদ আলোর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

“আমরা রিমঝিম রিসোর্টে উঠেছি। আমাকে ওই রিসোর্টের যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলে খুব উপকৃত হতাম।”
আলো মেঘের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে বলল,”আচ্ছা চলুন।”
দাদীকে বলে ওরা বের হতেই ঝমঝম করে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। যেতে না পেরে অগত্য ওই রুমে গিয়েই বসতে হলো। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ অনবদ্য এক সুর তুলেছে। টেউ টেউ টিন থেকে শব্দ করে গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ধারা। রোদ ঘুমন্ত মেঘকে আবার শুইয়ে দিয়ে রুমের ছোট জানালার পাশে বসল। দূর প্রান্তরে সবুজ গাছ গুলো দেখে মনে হচ্ছে কুশায়াতে ঢাকা। মৃদু বাতাসে বৃষ্টি কয়েকটা ফোঁটা ছিঁটকে এসে রোদের শরীরে পড়ল। রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূরে প্রান্তরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সে কল্পনাও করেনি। রোদকে চিন্তিত হয়ে বসে থাকতে দেখে আলো নিঃশব্দে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
ওকে দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। আর আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, আজ বৃষ্টি থামবে। দাদীমা উনার রুমের দরজার সামনে বসে সুপারি কাটছেন। আলো খুদের ভাত উনুনে বসিয়ে কলার মোচা কাটতে বসল। গতকাল বিকালে সে দু’টো কলার মোচা এনে, একটা রেঁধেছিল। আর একটা অবশিষ্ট ছিল। এখন সেটাই রান্না করবে। সেই সাথে করবে শুঁটকি মাছের ভর্তা আর হলুদ ভর্তা। তাছাড়া এই মুহূর্তে বাড়িতে রান্নার মতো কোনো আনাজ নেই। দাদীর পাশের রুমের দিকে একবার তাকিয়ে নিচু স্বরে আলোকে বললেন,

“শুনছিস? হেরা মনে হয় মেলা বড়লোক। আমাগোর গরীবের খাওন কি হেরা খাইতে পারব?”
“তাও ঠিক! ওরা এসব খায় কী না তাও তো জানি না।”
“মুনের মায়ের থেইকা তিনডা ডিম আইনা হেগোরে ভুনা কইরা দে।”
“আচ্ছা।”
কথাটা বলে আলো বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে বাইরের দিকে হাঁটা ধরল। শ্যাওলাযুক্ত সবুজ উঠানে পা টিপে টিপে হেঁটেও, হঠাৎ পা পিছলে স্বজোরে আছড়ে পড়ল। মৃদু স্বরে ‘ওহ মা গো’ বলে বসে থাকা অবস্থায় আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কোথায় কাউকে না দেখে মুখ কাচুমাচু করে একাই উঠে দাঁড়াল। আলোর পরনে থাকা কালো রংয়ের থামিতে কাঁদা লেপ্টে গেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে বার দু’য়েক রোদের বসে থাকার জানার দিকে তাকাল। রোদকে না দেখে মুচকি হেসে সে মুনদের বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ওই মানুষটা দেখলে সে খুব লজ্জা পেত। আলো যাওয়ার পর রোদ আড়াল থেকে বেরিয়ে আসল। সে আলোকে পড়তে দেখেই ওখান থেকে দ্রুত সরে গিয়েছিল। যাতে ওকে দেখে মেয়েটা লজ্জা না পায়। আর আচানক পড়ে গেলে সচরাচর সবাই আশে পাশে বুলিয়ে দেখে, কেউ দেখল নাকি? পড়ে ব্যাথা পাওয়ার থেকে মনে তখন লোক লজ্জার ভয়টাই এসে জেঁকে ধরে। মেয়েটা ওদের জন্য অনেক করেছে, শুধু শুধু তাকে লজ্জা দেওয়ারই বা কী দরকার? আলো মুনকে দেখে ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“তোর বিচার পরে হবে। দাঁড়া তোরে আগে একা হাতের কাছে পায়।
” উফ! এভাবে মারচো ক্যান আলোবু? আমি তো কিচু করি নি।”
আলো কটমট করে মুনের দিকে তাকিয়ে মুনের মায়ের কাছে গেল। উনার থেকে তিনটা মুরগীর ডিম নিয়ে সে বাসায় ফিরে এলো। বৃষ্টি থামার নাম নেই! এখনো অঝরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে।
রোদ মেঘের পাশে চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছে। প্রচন্ড ব্যাথায় ওর শরীরেও জ্বর চলে এসেছে। আলো ডিম ভেজে রুমে ঢুকে দেখল দুই ভাই শুয়ে আছে। আলো আমতা আমতা করে সামনে এগিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“শুনছেন! আপনিও ঔষধ লাগিয়ে নি.. ।”
কথাটা শেষ না হতেই রোদ চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকাল। রোদের লালবর্ণ চোখ দেখে আলোর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ওর থমকে যাওয়া মুখ দেখে রোদ মৃদু হেসে বলল,”সমস্যা নেই, আমি ঠিক আছি।”
“উঠুন, রান্না হয়ে গেছে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিন।”
রোদ উঠে দাঁড়াল, আলো নতুন গামছা আর পানি রোদকে এগিয়ে দিয়ে সেখান থেকে সরে আসল। সে খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে ধীর কন্ঠে মেঘকে ডাকছে। মেঘ ঘুমের ঘোরে আলোর হাতটা জড়িয়ে ধরে বিরবির করে বলল,” আম্মু তোমার শরীরের মা মা গন্ধটা আমি খুব মিস করি। আমাকে রেখে আর যেও না আম্মু, প্লিজ যেও না।”

মেঘ বিরবির করে কয়েকবার কথাটা বলে আবার ঘুমিয়ে গেল। আলো হতবাক হয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ শক্ত করে ওর বুকের সাথে আলোর হাতটা আঁকড়ে ধরে আছে। রোদ হাত মুখ ধুয়ে এসে আলোকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতের গামছাটা মেলে দিয়ে সাবধানে আলোর হাতটা মেঘের থেকে ছুটিয়ে দিলো। রোদ আদুরে সুরে মেঘকে ঘুম থেকে তুলে উঠে বসাল। আলো যত্ন করে খাবার দিলো। রোদ একটা প্লেটে খাবার নিয়ে দুই ভাই একসঙ্গে খাচ্ছে । রান্না মজার হলেও
জ্বরে ওদের খাওয়ার কোনো রুচি নেই। যে মেঘ পছন্দের খাবার না পেলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। সে মেঘ বিনাবাক্যে চুপ করে এগুলো খাচ্ছে। ওদের খেতে দিয়ে আলো গোসলে চলে গেছে। কিন্তু অজানা কারণে মেঘ উঁকিঝুঁকি মেরে আলোকে খুঁজছে। ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গেছে। আলো গোসল সেরে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে রুমে এসে দেখে ওদের খাওয়া হয়ে গেছে। আলো কিছু বলার আগে রোদের সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের তাকিয়ে দু’জনে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রোদের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আলোর দিকে তাকাচ্ছে। আলোর অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পেরে রোদ আগে বলল,

“বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা এখন গেলে কী অসুবিধা হবে?”
“জ্বি না! একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি।”
কথাটা বলে আলো এঁটো প্লেটে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। চুল মুছে দাদীর সাথে খেয়ে গেল মুনদের বাড়ি। সে যতক্ষণ না ফিরবে মুনকে এখানেই থাকতে বলল। তারপর হাতের কাজ সেরে চুলে খোঁপা করে মাথায় ওড়না টেনে ওদের নিয়ে বের হলো। রোদ বিনয়ী সুরে দাদীর উপকারের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোদ মেঘকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে। পাহাড়ের নিচে আলোর বাড়ি হওয়াতে আর পাহাড়ে উঠা লাগল না। তবে কাঁদা মধ্যে হেঁটে যেতে একটু কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে সন্ধ্যার পূর্বেই ওরা রিসোর্টে পৌঁছে গেল। তখন আবার অঝরে বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো। রোদ আলোকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বুকিং করা রুমে চলে গেল। আলো সোফায় বসে চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখছে। রোদ মেঘকে শুইয়ে দিয়ে শার্ট বদলে নিচে চলে গেল। রিসোর্টের ব্যবস্থাপকের সাহায্য নিয়ে ওর অফিসের ম্যানাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করল। উনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে রোদ কল কেটে বলল,

“এখানে জরুরী ভাবে কোনো ডাক্তার পাবে যাবে?”
”জ্বি স্যার আমি ব্যবস্থা করছি।”
কথাটা বলে উনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। আর রোদ মৃদু পায়ে হেঁটে ওদের রুমে গেল। ততক্ষণে আলো মেঘের ড্রেস বদলে ফ্রেশ করিয়ে দিয়েছে। আধা ঘন্টার মধ্যে একজন ডাক্তার এসে রুমে উপস্থিত হলেন। উনি মেঘের হাতে, পায়ে, কপালে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল মেঘকে ইনজেকশন দেওয়া নিয়ে। সে কোনোভাবেই ইনজেকশন দিবে না। বরং ইনজেকশন দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,
“দাভাই ইনজেকশন দিতে নিষেধ করো। নাহলে আমি কিন্তু উনাকে কামড়ে দিবো।”
রোদ মেঘকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডাক্তারে ইশারা করে মেঘকে বলল,
“আমি পিঠে খুব ব্যাথা পেয়েছি। তুমি নড়লে আমি আরো বেশি ব্যাথা পাবো।”
রোদের কথা শুনে মেঘ নড়াচড়া বন্ধ করে দিলো। ডাক্তার ইনজেকশনের সূচ ফুটাতেই মেঘ কেঁপে উঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। আলো রুমের এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। রোদ ব্যাথা পাবে শুনে মেঘ ভয় পেলেও আর নড়ল না। কী অদ্ভুত টান! রোদ মেঘকে শুইয়ে দিয়ে আড়চোখে একবার আলোর দিকে তাকাল। ডাক্তার উঠে দাঁড়াতেই আলো মুখ কাচুমাচু করে রোদকে দেখিয়ে বলল,

“উনিও খুব ব্যাথা পেয়েছে। উনারও চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন।”
আলোর কথা শুনে উপস্থিত সবাই ওর দিকে তাকাল। ডাক্তার রোদের সমস্যার কথা শুনে শার্ট খুলে শুয়ে পড়তে বলল। রোদ তাই করল। রোদের পিঠের দিকে তিনজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এত গভীর জখম নিয়ে রোদ এতক্ষণ অবধি স্বাভাবিক ছিল। আর এখনো আছে। ডাক্তার বসে রোদের পিঠে ড্রেসিং করে লাগল। মেঘ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রোদের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“খুব কষ্ট হচ্ছে দাভাই?”
রোদ মেঘের হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছলছল চোখ তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“না সোনা আমি ঠিক আছি।”
ওদের কথা শুনে আলোর চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

-‘এলোকেশী কন্যা-‘
[০৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদ আর মেঘ একই বৃন্তের প্রাণবন্ত দু’টো ফুল। আর ফুল দু’টো ভালোবাসা নামক শাখাকে আঁকড়ে ধরে একে অন্যের জন্য বেঁচে আছে। ওদের ভালোবাসা দেখেই বোঝা যায়, ওরা দুই ভাই একে অন্যের প্রাণ। এজন্যই হয়তো একজনের কষ্ট দেখলে আরেকজনও কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যায়।
ওদের ভালোবাসা দেখে অালোর কেন জানি চোখ দু’টো ভিজে গেল। সে অন্য দিকে ঘুরে সতর্কতার সাথে চোখ মুছে নিলো। ডাক্তার আলোকে চোখ মুছতে দেখে মুচকি হেসে বললেন,

“মিসেস চিন্তা করবেন না। আপনার স্বামী শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে। আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি, সেগুলো শুধু সময় মতো খাওয়াবেন।”
কথাটা বলে উনি পুনরায় ড্রেসিং করাতে মনযোগ দিলেন। আর আলো একথা শুনে বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। রোদ ওর স্বামী! এটা কেমন কথা? বলা নেই, কওয়া নেই! ডাক্তার অকস্মাৎ অচেনা একজনকে ওর স্বামী বলে দিলেন। তাছাড়া উনি ওদের ব্যাপারে কিছু জানেনও না। অথচ অনুচিত একটা কথা বলে বসে থাকলেন। তবে রোদের মধ্যে কোনো জড়তা বা সংকোচ দেখা গেল না। সে নিশ্চুপ হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ওর এখন অযথা কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। এত ধকল শরীরেরও আর কুলাচ্ছে না। অসহ্য ব্যাথায় ওর পুরো শরীর যেন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ডাক্তার বললেই তো আর হয়ে গেল না। তবে রোদের খুব ইচ্ছে করল, এখন পাশ ফিরে আলোর মুখভঙ্গিটা দেখতে। আচ্ছা! মেয়েটা কী এখন লজ্জা পাচ্ছে, নাকি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? একথা রোদের জানতে ইচ্ছে করলেও তাকাল না। বরং তাৎক্ষণিক ওর এই অযৌক্তিক ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিলো। কারণ সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে নেই। কিছু কিছু সময় ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলে সর্বনাশা কিছু ঘটার প্রবল আশঙ্কা থাকে।
এর মধ্যে মেঘ কী বুঝল কে জানে! সে আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। মেঘকে এভাবে হাসতে দেখে আলো করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। এখন এই বাচ্চাটাও ওকে দেখে মজা নিচ্ছে। হাসতে হাসতে মেঘের হঠাৎ চোখ পড়ল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তারের হাতে আরো দু’টো ইনজেকশন দেখে মেঘ একটু পেছনে সরে উচ্চশব্দে বলল,

“আবার?”
“তোমার ভাইয়াকে দিবো।”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভেবে অকপটে বলল,”আপনি কী ঔষধের নাম ভুলে গেছেন?”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে, আপনি ঔষধের নাম ভুলে শুধু শুধু আমাদের ইনজেকশন দিচ্ছেন। ইনজেকশনে মেলা ভয় পাচ্ছি, গোল গোল ঔষধ দিলেই তো হয়।”
মেঘের কথা শুনে ডাক্তার শব্দ করে হেসে রোদকে পরপর দু’টো ইনজেকশন দিলেন। তারপর ঔষধ লিখে কিছু পরামর্শ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রোদ শুয়ে থাকা অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে বলল,
“ওই ট্রলিতে ক্যাশ টাকা আছে, উনাকে দাও।”
“আ আ আমি?”
রোদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”হুম তুমি।”
আলো মুখ কাচুমাচু করে টাকা বের করে ডাক্তারকে দিলো। ডাক্তার টাকা নিয়ে হাসি মুখে বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলেন। রোদ রিসিপশনে ফোন করে একজন ওয়েটারকে ওদের রুমে পাঠাতে বলল। পুরো রুম জুড়ে এখন পিনপতন নিরাবতা।
তখন আলো গুটিগুটি পায়ে রোদের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,

“আপনারা বিশ্রাম নিন, আমার এখন ফিরতে হবে।”
“বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকারে তোমার যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
রোদের কথা শুনে আলো জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যিই, এখনো বৃষ্টি থামে নি। বরং বৃষ্টির সাথে ঝড়ো বাতাস বইছে। আলো উপায় না পেয়ে কাচুমাচু করে সোফায় গিয়ে বসল। মেঘ বালিশে হেলান দিয়ে মিটিমিটি হেসে আলোকে দেখছে। আলো যেতে না পারাতে ওর খুব খুশি লাগছে। তখন ওয়েটার এসে ওদের রুমের দরজা নক করল। আলো উঠে দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল। রোদ ওয়েটারকে দেখে উঠে বসে টাকা আর প্রেসক্রাইবশন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এই মেডিসিন গুলোর ব্যবস্থা করুন। যদিও আমি শুনেছি, আপনাদের কাছে মেডিসিনের ব্যবস্থা থাকে।”
“জ্বি স্যার! তবে এখন সব গুলো না পেলে?”

“যেগুলো পাবেন নিন আসুন। আর আমাদের রাতের খাবার রুমে পাঠিয়ে দিবেন।”
ওয়েটার আড়চোখে একবার আলোর দিকে তাকিয়ে, “জ্বি স্যার” বলে স্থান ত্যাগ করল।
রোদ মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে কিছু খাবার মেঘের সামনে রাখল। বাচ্চাদের খাবার আর কী! এই রিসোর্টে উঠার সময় রোদ এগুলো কিনে এনেছিল। কারণ মেঘ সারাদিনে টুকটাক এটা ওটা খেতেই থাকে। পছন্দের চিপ্সের প্যাকেট দেখে মেঘের মুখে হাসি ফুটল। সে খুশিতে গদগদ হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে রোদকে বলল,
“দাভাই, দোয়া করছি। আমি যেন মিষ্টি একটা বউমণি পাই।”
মেঘের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে রোদ আর কথা বাড়াল না। মেঘ দিন দিন খুব পাকা হয়েছে। সে ছোট হয়ে বড় ভাইকে কথার খোঁচা মারছে। সামনের সোফায় আলোকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে মেঘ মিষ্টি হেসে বলল,
“ওই মিষ্টি শুনছ? এখানে এসো।”

একথা শুনে রোদ মেঘের দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আলোর দিকে তাকাল। মেঘের এমন সম্বোধনে আলো অবাক হলেও কিছু বলল না। সে উঠে মেঘের পাশে গিয়ে চুপটি করে বসল। রোদ পানির বোতল মেঘের পাশে রেখে পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়ল। মেঘ খাবারের প্যাকেট আলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে খেতে বলল। আলো খাবে না বললে, মেঘ জোর করে ওর মুখে গুঁজে দিলো। এখন দু’জনে খাচ্ছে আর ফিসফিস করে গল্প করছে। মেঘের দুষ্টু মিষ্টি কথা শুনে আলো নিঃশব্দে হাসছে। রোদ ততক্ষণে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়াতে আলো চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন বাজে রাত দশটা একুশ। দাদীমা নিশ্চয়ই খু্ব টেনশন করছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। অজানা কারণে আলোর এখন খুব অস্থির লাগছে। সে এর আগে কখনো রাতের বেলায় বাইরে থাকে নি। আর এখন তো চাইলেও যেতে পারবে না। কারণ পাহাড়ি রাস্তায় না আছে লাইট, আর না আছে কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা। সারাটা দিন মেঘদের সঙ্গে থেকে ওদের খুব আপন হয়ে হচ্ছিল। এজন্য হয়তো কিছুক্ষণের জন্য টেনশন ভুলে গিয়েছিল।
আলোকে অস্থির হয়ে ঘামতে দেখে মেঘ চিপ্স খাওয়া থামিয়ে বলল,

“কি হয়েছে তোমার? পেটে ব্যাথা করছে, পানি খাবা?”
আলো জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে না বোধক মাথা নাড়াল।
তখন ওয়েটার এসে দরজা নক করে খাবার আর ঔষধ দিয়ে গেল। আলো সেগুলো নিয়ে নিঃশব্দে দরজা আঁটকে দিলো। রোদ এখনো ঘুমাচ্ছে। আলো ঘড়ি দেখে মেঘকে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে দিলো। রোদকে ডাকবে কী না সে ভেবে পাচ্ছে না। রোদের শরীরে অনেক ক্ষত তাই ঔষধ গুলো খাওয়াও জরুরী। আলো মেঘের মুখ মুছিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। মেঘ শুয়ে ওর ট্যাব নিয়ে গেম খেলতে লাগল। এই ট্যাবে সিম নেই, শুধু আছে মেঘের পছন্দের অসংখ্য গেম।
আলো মেঘের পাশে শুয়ে মেঘের গেম খেলা দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, আলো খেয়াল করল মেঘ ঘুমিয়ে গেছে। সে উঠে মেঘকে ভালো ভাবে শুইয়ে ট্যাব টা বালিশের পাশে রাখল। এখন বাজে রাত বারো টা তিন। রোদ এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। আলো উপায় না পেয়ে রোদের একটু কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল। কয়েকবার ডেকে রোদের সাড়াশব্দ না পেয়ে কম্পিত হাতে রোদকে স্পর্শ করল। রোদের শরীরে প্রচন্ড জ্বর। আলো হাত সরিয়ে কিছু করবে ভেবে পাচ্ছে না। ওর শরীরও কাঁপছে। একে তো সে একা মেয়ে। তার উপরে এই মানুষটার শরীরেও এত জ্বর। আলো ঢোক গিলে পানি এনে রোদের রুমাল ভিজিয়ে জলপট্রি দিতে লাগল। হঠাৎ রোদ আলোর হাত সরিয়ে স্বজোরে ওকে মেঝেতে ধাক্কা মেরে বলল,

“নোংরা মেয়ে আমাকে স্পর্শ করবে না। তোমার স্পর্শ আমার ঘৃণা লাগছে, খুব খুব ঘৃণা লাগছে।”
কথাটা বলে রোদ আবার চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলো। আলো প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে হতভম্ব হয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে নোংরা মেয়ে বলল। কিন্তু কেন? আলো ছলছল চোখে রোদের দিকে অভিমান নিয়ে তাকাল। অসুস্থ মানুষের কথা গ্রাহ্য না করে সে উঠে আবার রোদের কাছে গেল। ভেজা রুমাল রোদের কপালে দিতে রোদ আবার চোখ খুলে তাকাল। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় সে চোখ খুলতেও পারছে না। তবে আবছা ভাবে এবার আলোকে দেখে বলল,
“আমি ঠিক আছি, যাও শুয়ে পড়।”

“ধাক্কা মেরে ব্যাথা দিয়ে এখন বলছেন শুয়ে পড়ো। একদম কথা বলবেন না, নাহলে আপনার কপালে দুঃখ আছে।”
রোদ আলোর রাগান্বিত কন্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকাল। তখন জঙ্গি মেয়ে ভেবে সে আলোকে ধাক্কা দিয়েছিল। ওর পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে এখনো ওই ঘটনাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এজন্য হঠাৎ আলোর স্পর্শ পেয়ে ভুল বুঝেছে। আলো উঠে খাবার এনে রোদকে খেতে বলল। রোদ একবার চোখ খুলছে তো একবার বন্ধ করছে। আলো সমস্যাটা বুঝে মানবিককার খাতিরে একটু খাবার তুলে রোদের মুখের সামনে ধরল। রোদ খাচ্ছে না চুপ করে তাকিয়ে আছে। আলো রোদের নাক চেপে ধরে মুখে খাবার পুরে দিলো। রোদ চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালেও মুখে কিছু বলল না। রোদকে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে আলো জলপট্টি দিতে থাকল। ওদিকে মেঘ গুটিশুটি মেরে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, “দাভাই বাঁচাও! দাভাই বাঁচাও! করে বিরবির করছে। আলো দ্রুত উঠে মেঘের কাছে গিয়ে ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। মেঘ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে গেল।

বাইরে আবার বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের মধ্যে শিরশির করে উঠছে। আলো উঠে জানালার বন্ধ করে পর্দা টেনে দিলো। তারপর রোদের কপালে জলপট্টি দিয়ে আলতো করে রোদের চুল টেনে দিতে লাগল। রোদ একটু আরাম পেয়ে ঘুমে তলিয়ে গেছে। আলো উঠে বসল বিছানার ঠিক মাঝখানে। যাতে দু’জনের দিকে খেয়াল রাখতে পারে।
মেঘ ততক্ষণে আলোর এক হাত বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেছে। আর আলো অন্য হাতে রোদের চুল টেনে দিচ্ছে। আলো ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আলো মুচকি হাসল। অচেনা এই মানুষ দু’টোর প্রতি ওর মনে অদ্ভুত ভাবে মায়া জন্মেছে। মনে হচ্ছে, রোদ মেঘ ওর খুব কাছে কেউ।
পরেরদিন সঠিক সময়ে পূর্বাকাশে সূর্য তার উপস্থিতি জানান দিলো। সেই সাথে সূত্রপাত ঘটাল রৌদ্রজ্জ্বল নতুন একটা দিনের। ঝকঝকে স্বচ্ছ আকাশে ঝাঁক ঝাঁক সবুজ টিয়াপাখি দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। কালকে রাতের বৃষ্টিতে গাছগুলো সব গ্লানি ধুয়ে মুছে নব্য রূপে সজ্জিত হয়েছে। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ভেলা আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১+২+৩

কালকে রাতে রোদের ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছে। তাই খুব সকালে ওর ঘুমটা আগে ভেঙ্গেছে। বুনো পাখিরা এসে থাই গ্লাসে টোকা দিয়ে যাচ্ছে। রোদ আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরে দেখে আলো বসে বসে ঘুমাচ্ছে। ওর সামনের অবাধ্য কিছু চুল এসে কপাল ছুঁয়েছে। ফর্সা মায়াবী মুখশ্রীতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মনে হয় রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারে নি। রোদ ওর দৃষ্টি সরিয়ে মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ আলোর পা জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেঘের ঘুমের ভঙ্গি দেখে রোদ মৃদু হেসে উঠে ফ্রেশ হতে গেল। তারপর ওদের দু’জনকে ডেকে ফ্রেশ হতে বলে খাবার অর্ডার করল। তিনজনে একসঙ্গে খেয়ে উঠতেই আলো তাড়াহুড়ো করে বলল,
”আমার এখন বাড়ি যেতে হবে। আপনারা সাবধানে থাকবেন, আসছি।”
আলো চলে যাবে শুনে মেঘ মন খারাপের সুরে বলল,”চলো আমরা তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছি।”
আলো নিষেধ করলেও মেঘ ওর বারণ শুনল না। অগত্যা মেঘের জেদের জন্য রোদ ওদের নিয়ে বের হলো। মেঘ আর আলো গল্প করতে করতে সামনে হাঁটছে। আর রোদ ওদের থেকে একটু পিছিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে আলো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, সামনে লোক জনের ছোটাছুটি দেখে। সে একটা মাঝ বয়সী মহিলাকে দাঁড় করিয়ে বলল,

“কী হয়েছে, সবাই এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে কেন?”
ওই মহিলা জবাবে যা বলল। সেটা শোনার জন্য আলো এই মুহূর্তে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে হতভম্ব হয়ে এক পা পিছিয়ে যেতেই রোদের সাথে ধাক্কা খেলো। আলো করুণ দৃষ্টিতে রোদের দিকে একবার তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে দৌড় দিলো বাড়ির পথে। আলোকে এভাবে যেতে দেখে মেঘও ওর পেছনে ছুট লাগাল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৭+৮+৯