এলোকেশী কন্যা শেষ পর্ব

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

-“আলোবু!”-
ডাকটা শুনে, আলো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সাবেদ মিষ্টির প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চেনা; সাবেদ ভাই! এখানে? কীভাবে সম্ভব? আলো ছলছল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ‘আলোবু’ ডাকটা শুনে সে চমকে উঠেছে। ওর অবুজ মনটা ভেবেছিল, ছেলে কন্ঠে মকবুল ডাকছে। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়; ওরা অন্য জগতের অধিবাসী। শত ডাকলেও ফিরবে না! কারণ মৃত্যুপুরীতে যাওয়ার পথ থাকলেও, ফেরার পথ নেই। আর
সৃষ্টিকর্তা ফেরার পথের সন্ধানও দেন নি। দিলে হয়তো, সবাই সবার আপনজনকে ফিরিয়ে আনতো। মৃত্যুর শোক কাউকে অনুভব করতে হতো না। মুন’রা আলোর খুব কাছের বিধায় সে এখনো আশা করে, ওরা ফিরে আসুক। আদুরে সুরে ওকে ডাকুক! আফসোস, এটা হবার নয়!
তবে পূর্ণিদের দেখে আলো হতবাক। ওর মাথায় অনেক প্রশ্ন’রা কড়া নাড়ছে। সব শোনার জন্য ছটফট করছে। রোদ ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। এজন্য কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিলো। যা হওয়ার হয়ে গেছে, কিছু বলেও আর লাভ হবে না। রোহান বার বার রোদের দিকে তাকাচ্ছে।

কারণ, রোদের চোখ দু’টো লালবর্ণ হয়ে গেছে। রাগে? নাকি কষ্ট পাচ্ছে? কি আশ্চর্য! পা পুড়েছে আলোর আর কষ্ট পাচ্ছে রোদ! একেই কী বলে আত্মার টান? অটুট বন্ধন, নাকি ভালোবাসা নামক ব্যাধি?
এদিকে আলোর পা দেখে মেঘ কাঁদতে লাগল। ওর ফর্সা গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে যাচ্ছে, অঝর শ্রাবণ। ক্ষণিকেই চোখ, মুখ, নাক, লাল করে একাকার অবস্থা। সে দৌড়ে গিয়ে বসে ফুঁ দিতে দিতে হেঁচকি তুলে বলল,
“বউমনি, খুব কষ্ট হচ্ছে?”
কথাটা বলে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ব্যথা’টা যেন সে পাচ্ছে! মেঘকে কাঁদতে দেখে আলোর খেয়াল আসল এবং পায়ের জ্বালাপোড়া টের পেলো। এতক্ষণ সে পূর্ণিদের ভাবনায় বিভোর ছিল। আলো মেঘকে কাছে টেনে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“এভাবে কাঁদে না সোনাপাখিটা। আমি ঠিক আছি, তুমিই দেখো। আর কষ্ট পেলে কেউ হাসে, হুম?”
মেঘ ফুঁপাতে ফুঁপাতে চোখ ডলে নাক টেনে উত্তর দিলো,
“এটা তোমার ভালো হাসি না, বউমনি। আমি সব বুঝি।”
একথা শুনে আলো মেঘের চোখ মুছিয়ে আদর দিলো। ছোট্ট মেঘ কী ক্ষণিকেই বড় হয়ে গেল? সে বুঝল কীভাবে? পোড়া পা নিয়ে কারো মুখে তৃপ্তির হাসি আসে না। পায়ের জ্বালাপোড়ায় ওর কষ্ট হচ্ছে! খুব কাঁদতেও ইচ্ছে করছে। তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ এমনিতেই, একজন থম মেরে গেছে আরেকজন কেঁদে একশা! কিছু বললে এ দু’জনের পাগলামি বেড়ে যাবে। তারপর আলো কত কী বলে আদর দিয়ে মেঘকে থামাল। আর সবাই প্রাণ জুড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল। ওরা সম্পর্কে দেবর ভাবি হলেও, দেখে মনে হয়, মা ও ছেলে। নিদারুন এক মিষ্টি সম্পর্কের মেলবন্ধন! তখন পূর্ণি এগিয়ে এসে ধরা গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ওহ আলোবু, তুমি ছত্যিই একানে?”
“হুম, তোরা?”
“আমলা পালিয়ে এছেছি।”
আলো খুব অবাক হলো পূর্ণির কথা শুনে। মেয়ে বলে কী? কেন? একথা শুনে আলোর কৌতূহল দ্বিগুন বেড়ে গেল। সে কিছু বলার আগে, রোদ ওর হাতে চাপ দিয়ে থামিয়ে দিলো।আর ইশারায় বোঝাল; পরে জানতে।এটা সঠিক অবস্থান নয়!
তাছাড়া দূর্বলতা সবার কাছে প্রকাশ করতে নেই।
একজনের দূর্বলতা হতে পারে অন্যজনের হাসির খোরাক! আলো বুঝে এক পলক সাবেদের দিকে তাকাল। সাবেদ মৃদু মাথা নাড়িয়ে পূর্ণিকে তাড়া দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। পূর্ণি বোকা, সে বুঝত না! রোদ আলোকে ধরে গেস্ট রুমে নিয়ে গেল। এসব পরিষ্কার করা দরকার। মেঘ আলোর হাত শক্ত করে ধরে আছে। যেন ছাড়লেই বউমনি হারিয়ে যাবে! রোদ টাওয়াল ভিজিয়ে তরকারির ঝোল মুছতে থাকল। কামিজসহ সালোয়ারের অনেকটা ভিজেও গেলো; শুকালে পুরোপুরি ঠিক না হলেও, চলবে। তখন রোদ বলল,
“জ্বলছে খুব?”
“না।”

রোদ ওর চোখে চোখ রেখে বাকিটা বুঝে নিলো। আলোর ডান পায়ে ফোসকা বেশি পড়েছে। লাল হয়ে ফোসকার ভেতরে পানি টলটল করছে।রোদ বসে, আলোর সালোয়ার পা থেকে একটু উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে নিলো। গরম তরকারি চুলা থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই ঝোল ছিঁটকে পায়ের যেখানে পড়েছে, সেখানেই একই অবস্থা! তাতে ফর্সা পা! ফোসকাগুলো ভয়াল দেখাচ্ছে।
তখন মেঘ কান্নারত কন্ঠে বউমনি! বলে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। আলো হেসে মেঘের কাঁধে মাথা রাখল। মেঘ আলোকে আদর দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকল। আর রোদ ওর ঠোঁট কামড়ে এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছে। যেন সব দোষ ঠোঁটের! প্রিয় মানুষটার কষ্টের ভাগ নেওয়া যায় না কেন? নিতে পারলে, সবটাই সে শুষে নিতো। একবিন্দু কষ্টও অবশিষ্ট রাখত না। কষ্ট হচ্ছে; প্রচুর কষ্ট!
তখন রোহানকে আসতে দেখে আলো সালোয়ার ঠিক করে, মিষ্টি হাসল। ওকে হাসতে দেখে কেউ অবাক হলো না, মেয়েটা এমনই! রোহান বার্ণাল ক্রিম এনে রোদকে লাগিয়ে দিতে বলল, যাতে জ্বালাটা কমে। তবে ফোসকার জন্য ভুগতে হবে। রোহান ফেলে আসা আলোর নুপূর জোড়া দিয়ে চলে গেল, তখন তাড়াহুড়ো করে রোদ’ই নুপূর খুলেছিল। যাতে নুপূরের পাথরে লেগে ফোসা গলে না যায়। রোদ নুপূরজোড়া পকেটে রেখে আলতো করে ক্রিম লাগাতে থাকল। আর মেঘ উবু হয়ে ফুঁ দিতে থাকল।
এদিকে আলোর পূর্ব পরিচিত দেখে রোহানের বাবা-মা পূর্ণিকে কিছু বলতে পারলেন না। রোদ বার বার নিষেধ করেছে। দুর্ঘটনা, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। পূর্ণিও কেঁদে খুব আফসোস করছে। আসলে খুশিটা সে ধরে রাখতে পারে নি। তাই কোনোকিছু না ভেবে আলোকে জড়িয়ে ধরেছে। এমন কিছু হবে জানতে কখনো এমন করত না। বেশ কিছুক্ষণ পরে, সবাই খেতে বসল। আলো বারণ শুনল না, টেবিলে বসে মেঘকে খাওয়াচ্ছে নিজেও খাচ্ছে। তাছাড়া মেয়েদের অল্পতে ভেঙ্গে পড়তে নেই নয়তো বেঁচে থাকাও দুষ্কর হয়ে যায়। মুখ্য কথা, সে হাসলে ওর কলিজায় স্থান দেওয়া মানুষ দু’টোর মুখেও হাসি ফুটবে। একথা ওর অজানা নয়!
গল্পে গল্পে খাওয়া শেষে সবাই আড্ডায় বসল।

আর রোদ, আলোকে পূর্ণিদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলো। মেঘবাবুও এসেছে। কারণ বউমনিকে সে একা ছাড়বে না। আলো সাবেদের থেকে, মাতবরকে মেরে আসার পুরো ঘটনা শুনল।
পূর্ণিদের ঢাকায় আসার বাসে ছিল; রোহানের চাচাতো ভাই তুহিন! বাস থামার পরে, পূর্ণিরা নেমে তুহিনের কাছে আশ্রয় চাচ্ছিল। বড় বড় দালান আর যানজট দেখে ওরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। ওদের আঁকুতি দেখে তুহিন বাধ্য হয়ে রোহানকে ফোন করে সব বলে। রোহান গিয়ে কথা বলে ওর বাসায় নিয়ে আসে। কারণ ওর আম্মুর কাজে সাহায্যের লোক দরকার। আর এদের আশ্রয়! তখন থেকে ওরা এখানেই থাকে।
পূর্ণি রোহানের আম্মুর কাজে সাহায্য করে। আর সাবেদ বাজারসদাইয়ের দায়িত্বে আছে।রোহানের বাবা-মা ওদের বিয়েও দিয়েছেন। এখানে দু’জনে বেশ ভালো আছে। পূর্ণির সাহস দেখে আলো ওকে জড়িয়ে ধরল। ভালোবাসা রক্ষার্থে কত কী না করা লাগে! কেউ মরতে দ্বিধা করে না, কেউ মারতে দু’বার ভাবে না। ভালোবাসা এমন কেন, না গিলা যায়; না উগলানো! সুমিষ্ঠ হলেও, এর পূর্নতা না পেলে পরিণতি খুবই কষ্টদায়ক! এসব ভেবে, আলোর চোখ দিয়ে সমানে অশ্রু ঝরছে। সাহস দেখালে, মুনও হয়তো বেঁচে থাকত। তবে মুন নেই, পূর্ণি তো আছে! এরা প্রণয়ের লড়াইয়ে দু’জনেই বিজয়ী, কেউ মরে আর কেউ বেঁচে! কী অদ্ভুত! আলো পূর্ণির চোখ মুছিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“যখন যা দরকার আমাকে বলবি। মন খারাপ করবি না। বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার, দিয়ে যাবো। যখন ইচ্ছে হবে আমার কাছে চলে যাবি। শোন, তোকে এখন নিয়ে গেলে রোহান ভাইয়ারা কষ্ট পাবে। উনাদের তোদের দরকার। উপকারীর কৃতজ্ঞতার কখনো ভুলতে নেই। হোক, একদিন অথবা এক সেকেন্ডের উপকারী। মাঝে মাঝে আমি এসে দেখে যাবো, হুম! আর সাবেদ ভাই সবাইকে নিয়ে থাকবেন।”

”আলোবু, তুমি খুব ভালো।”
আলো হেঁচকি তুলে কেঁদে আবারও ওকে জড়িয়ে
ধরল। মুনের কথা খুব মনে পড়ছে। পূর্ণির ডাক শুনে; ক্ষতটা জেগে উঠেছে। তবে অচেনা শহরে চেনা কাউকে পেয়ে আলো খুব খুশি। তখন পূর্ণি চোখ মুছে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আলোবু, তোমাল বল(বর) খুব সুন্দল হইছে। তোমলা বিয়া কলেছো?”
“হুম।”
তখন যাবেদ মেঘের গাল টেনে বলল,
“এতা কে বু?”
“আমার কলিজা।”
পূর্ণি আর যাবেদ মেঘকে কাছে টেনে আদর করে দিলো। ওরা জানে, এই পুঁচকে আলোর দেবর।
এদিকে বন্ধুদের হইহল্লা শুনে আলোরাও বেরিয়ে আসল। সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। রিমির আজকাল খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। আলো খুঁড়িয়ে হেঁটে রিমির পাশে গিয়ে বলল,
“আপু, আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি? বাসাতে আসেন না, কথাও বলেন না।”
আলোর কথা শুনে রিমি একগাল হেসে উত্তর দিলো,
“না রে পাগলি, আমার খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।
খাওয়ার সময় অবধি পায় না, সামনে মাসে ফ্রি হবো। রোহানের জোড়াজুড়িতে আসতে হলো।
আর রোদের থেকে খোঁজ নিচ্ছি তো, জানায় না তোমাকে?”
আলো না বোধক মাথা নাড়াল। তারপর দু’জন অনেকক্ষণ গল্প করল। নিতু আড়চোখে তাকিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে না। রিমিকেও তার পছন্দ না, ভাব বেশি! যেন পুরো পৃথিবীতে সে একাই ফ্যাশান ডিজাইনার, যত্তসব।
তারপর সন্ধ্যার পূর্বে বিদায় নিয়ে যে যার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। পাছে রইল, রোদ’রা। রোদ কিছু কাজ সেরে বাসার পথে রওনা দিবে। তখন
রোহানের মা আলোকে জড়িয়ে ধরে আফসোস করে বললেন,

“প্রথমবার এসে অঘটন ঘটল, খুব খারাপ লাগছে।”
আলো উনার হাতে হাত রেখে হেসে আশ্বস্ত করে বলল,
“আপনার কাছে আমার কাছের জন’রা থাকছে। এবার থেকে আমি মাঝে মাঝে আসব, আন্টি।আপনি রাগ করলেও আসব।”
“অপেক্ষায় থাকব।”
কথাটা বলে উনি আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মেয়েটাকে উনার বেশ লেগেছে, খুবই মায়াবতী। তারপর রোদ উনাদের থেকে বিদায় নিয়ে আলোদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোহানকে বলল, সাবেদ আর পূর্ণিকে বাসায় নিয়ে যেতে। নাহলে সে এসে নিয়ে যাবে। পূর্নি সাবেদ ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল ওদের যাওয়ার দিকে। দামী পোশাক, খাবার, মস্ত দালান, টাকা, এসব কিচ্ছু
না। ব্যবহারেই মানুষ মানুষকে মনে রাখে। চরম সত্য এটা! পূর্নি’রা রোদের বিনয়ী ব্যবহারে খুব খুশি হয়েছে। ওরা আশায় করে নি, রোদ ওদের সঙ্গে কথা বলবে। আলো ছাড়া রোদকেও ওদের খুব আপন মনে হয়েছে।

রোদ এখন যাচ্ছে, হসপিটালে। তখনই আসত, আলো কিছুতেই রাজি হয় নি। রোহানের বাবা মায়ের জন্য কিছু বলতেও পারে নি। তবে এখন? পায়ে ব্যথা আর ফোসকার জন্য আলো খালি পায়ে আছে। মেঘ রোদের বুকের সাথে লেপ্টে বসে কাঁধে মাথা রেখেছে। রোদ মেঘকে ধরে, এক হাতে ড্রাইভ করছে। আলোর কোলে সে যায় নি, যদি বউমনি ব্যথা পায়। এই সময় রাস্তায় জ্যাম বাঁধে, অফিস আর গার্মেন্ট ছুটির কারণে। কখন ছুঁটবে তারও ঠিক নাই! রোদের গাড়িটাও জ্যামে আটকাল। তখন হিজড়াদের দল পাশের গাড়ির ড্রাইভারকে গালি দিয়ে টাকা চাচ্চিল। ড্রাইভার দিচ্ছে না দেখে রেগে গালি দিয়ে বলল,
“হারামজাদা ট্যাকা দে! এ্যাই, কাপড় তুললাম, শোন, মাঝ রাস্তায় তোরে বেইজ্জতি করুম কিন্তু, মা**।”
রোদ আলোর সঙ্গে কথা বলছে বিধায় খেয়াল করে নি। কিন্তু মেঘ চুপ করে দেখছে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় এদের দেখে। টাকা না দিলে বলে,’তুললাম! তুললাম!’ কিন্তু কিছুই তুলে না।
বরং টাকা দিলে হাসতে হাসতে চলে যায়। এই দাড়িওয়ালা মেয়েগুলো, কী তুললে চায়? সেও আজকে দেখতে চায়। তাই মেঘ সাহস নিয়ে চট করে বলে উঠল,
“তুলবেন! আচ্ছা, তুলেন তো দেখি।”
রোদ আর আলো মেঘের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে; হতভম্ব। রোদ ‘ওহ শিট’ বলে দ্রুত কাঁচ তুলে মেঘের কান চেপে ধরল। কারণ সে জানো, হিজড়াগুলো এখন খাঁটি বাংলার গালি প্রয়োগ করবে।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

বেশ কয়েকদিন পর,
সেদিন সন্ধ্যায় ওরা ডাক্তার দেখিয়ে রাতে বাসায় ফিরেছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ আর মলম ব্যবহারে আলোর পা অনেকটাই সেরে গেছে। তবে রাতে বেডশীটে ঘষা লেগে ফোসকা গলে গিয়েছিল। জ্বালাপোড়ার চোটে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে গিয়ে রোদের কাছে ধরাও পড়েছিল। পরে রোদ জ্বালা কমাতে বরফ, মলম আর ফুঁ দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেছিল। এছাড়া বা কী করবে? বেশ কিছুক্ষণ পর, জ্বালা কমলে আলো রোদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। রোদ ওকে স্বযত্নে বুকে আগলে খেয়াল রেখেছিল, পুনরায় যাতে ঘষা না লাগে। পরেরদিন সকালে,পাপোসে বেঁধেও ফোসা গলেছিল। সাবধানে থাকলেও ওর সেখানেই গিয়ে লাগছে। আলো কষ্টও পাচ্ছিল।ওষুধ আর মলম ব্যবহারে ক্ষতটা প্রায় শুকিয়ে গেছে, হাঁটলে তেমন ব্যথা লাগে না। তবে দাগ রয়ে গেছে! একয়েকদিনে আলোর চারটা পরীক্ষা হয়েছে; ভালোই হয়েছে। দেখা যাক, বাকিগুলো কেমন হয়!
আলো পরীক্ষা দিয়ে সারার সঙ্গে গেটের বাইরে আসল। সবাই হুড়োহুড়ি করে বের হচ্ছে। যেন আর এক মিনিট দেরী হলে ওখানেই মারা যাবে।
সাফি পরবর্তী পরিক্ষা নিয়ে কথা বলছে। আজ নোট কালেক্ট করে রাতে সবাইকে পাঠিয়ে দিবে। তাও বন্ধুরা যেন এক নাম্বার কম না পায়।আলো
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে ডানে তাকিয়ে হাসল।অদূরে মেঘ গোলাপি আর সাদা হাওয়াই মিঠাই হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রবিও আছে! দুষ্টটাকেই সে খুঁজছিল! বউমনিকে তাকাতে দেখে মেঘ মিষ্টি করে হাসল। দাভাই অফিসে! তাই স্কুলে থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বউমনিকে নিতে এসেছে। রোজ আসে, বারণ শুনে না। কেন শুনবে? ওর দায়িত্ব আছে না! মেঘ দৌড়ে গিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে করে বলল,

“পরীক্ষা ভালো হয়েছে? তোমরা সব লিখেছো তো?”
ওরা একে অপরের মুখ তাকাতাকি করে নিঃশব্দে হাসল। দুষ্টুটার এত পাকা পাকা কথা। তখন সারা উত্তর দিলো,
” হ্যাঁ জান! আর শোনো, চলো আমি আর তুমি বিয়ে করে ফেলি?”
সারার শুনে মেঘ ভ্রু কুঁচকে নিলো। মেয়েটা খুব পঁচা দেখা হলেই, জান বলে। লজ্জা নেই! আর বউমনির সামনে এসব বলে? পঁচা মেয়ে! সে তো পুতুলের মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করবে। যাতে বউকে খুব মারতে পারে। বউ কথা শুনলেও মারবে আর না শুনলেও। মেরে আবার আদরও করবে, হুম। বউ কাঁদলে তাকে চকলেট দিয়ে বলবে,
”ইস,কাঁদে না! কাঁদে না বউ, নাও চকলেট খাও। এবার কাঁদলে, তোমাকে ডাস্টবিনে ফেলে আসব।”
কিন্তু বউ বড় হলে উল্টে ওকেই মারবে! কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়েও রাখবে। না, দরকার নেই বাবা। বিয়ে’ই করবে না, তবুও বড় বউ লাগবে না। মেঘ আর কিছু বলতে না দিয়ে আলোকে টেনে গাড়িতে বসাল। রবি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিদির্ষ্ট পথে চলতে শুরু করল। মেঘ তখন মিষ্টি হেসে একটা ডাব এগিয়ে দিয়ে বলল,

“খাও।”
আলো মুচকি হেসে অর্ধেক খেয়ে মেঘকে দিলো। তারপর দু’জনে কতশত গল্প জুড়ে দিলো। প্রায় দশ মিনিট পর, আলো খেয়াল করল বাসার রাস্তায় যাচ্ছে না। তাহলে? সে কিছু বলার আগে গাড়িটা একটা বড় গেট দিয়ে ঢুকে থেমে গেল। আলো কৌতূহলবশত বাইরে তাকালে ওর চোখে পড়ল, বড় বড় অক্ষরে লিখা -‘মেহবুব গ্রুপ এ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ’-
বাসায় না গিয়ে অফিসে? আলো মেঘের দিকে তাকালে, মেঘ দাঁত বের করে হাসল। অর্থাৎ এসব ওর বুদ্ধি! রোজ তো বাসাতেই যায় আজ অফিসে সময় কাটাবে। মেঘ লাফ দিয়ে নেমে আলোকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। কিছু বলার সুযোগও দিলো না। মেঘকে যে দেখছে সেই হেসে কথা বলেছে। কিন্তু ওকে কেউ চেনে না! তাছাড়া কলেজ ড্রেস পরিহিত। সবাই ওকে কী ভাবছে, কে জানে? রোদ ওকে দেখে রেগে গেলে? বকবে নাকি মারবে? এমনিতেই মানুষটার যা রাগ। না, এখানে আসা মোটেও ঠিক হয় নি। আলো চুপ করে এসব ভাবছিল। তখন রোদ আর আকাশ মিটিংরুমে থেকে বের হচ্ছিল। ওদের মিটিং কেবল শেষ হলো। হঠাৎ আকাশ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আরে ম্যাম, আসুন, আসুন! আসতে কষ্ট হয় নি তো?”
আলো চোখ বড় বড় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাম? আলো ওর পেছনে ঘুরে দেখে; না কেউ নেই! তাহলে? আকাশ ওকে ম্যাম ডাকছে? এবার রোদের সাথে আলোর দৃষ্টি বিনিময় হলো। তখন রোদ মুচকি হেসে বলল,
“ম্যাম, প্লিজ ভিতরে আসুন!”

আকাশ খুব রশিক মানুষ। সবাই ভেবেছে, মজা করছে। কিন্তু রোদকে বলতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। আলো হতভম্ব! ভেবেছিল কী, আর হচ্ছে কী! তারপর সে নিজেকে সামলে মৃদু স্বরে সালামের উত্তর দিলো। লজ্জা আর অস্বস্তি যেন জাপটে ধরেছে। তখন মেঘ চেঁচিয়ে বলল,
“দেখো! সবাই দেখো, এটা আমার বউমনি।অল্প করে সবাই দেখো।”
“বেশি দেখলে কী হবে?” (আকাশ)
“না, দেখছো না? বউমনি লজ্জায় লাল টুকটুক হয়ে গেছে।”
মেঘের কথা শুনে রোদ মুচকি হাসল। সবার দৃষ্টি তখন কলেজ ড্রেস পড়ুয়া মেয়েটার দিকে। অল্প বয়স! তবে মেয়েটা দেখতে পুতুলের মতো, খুব আদুরে! রোদ আলোকে পরিচয় করিয়ে কেবিনে নিয়ে গেল। তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“ম্যাম, কেমন আছেন?”
“ঢং।”
আলোর কথা শুনে রোদ শব্দ করে হেসে উঠল।

আলোকে দেখে রোদ খুব খুশি হয়েছে। এতদিন সে ইচ্ছে করে আলোকে অফিসে আনে নি। কেন আনবে? আলো নিজে আসবে না কেন? মেঘের মতো ওর’ও অধিকার আছে, তাহলে? সবকিছু মুখে বলে বোঝাতে হবে? রোদ ওর চেয়ারে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেঘ আকাশের সাথে কোথায় যেন গেছে। রোদ কিছু বলছে না দেখে, আলো উঠে পুরো কেবিনে চোখ বুলিয়ে নিলো। পরিপাটি করে সাজানো কেবিন।
রোদের আবার সবকিছুই পরিপাটি হওয়া চায়। বাসায় অথবা অফিসে। আলো কথা খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“ক্ষুধা লেগেছে।”
“খাবার কেনার টাকা নেই, আমাকে খাও।”
একথা শুনে আলো থম মেরে গেল। এটা কেমন কথা? কাউকে খাওয়া যায়? টাকা নেই, তাও ওর কাছে? পাগল নাকি মানুষটা? নয়তো প্রলাপ বকছে কেন? তখন রোদ উঠে আলোর খুব কাছে গিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
“আগে আমার ক্ষুধা মেটাও তারপর তোমারটা মেটাবো।”
”আমার কাছে খাবার নেই।”
“খাবারেই শুধু ক্ষুধা মিটে কে বলল, হুম?”
“তাহলে, আর কিসে মিটে?”
”আদরে!”
“আদরও নেই।”

“আছে তো! এই যে, তোমার কপালে, গালে, গোলাপি ঠোঁটে, থুতনীতে, গলার ভাঁজে। যতটুকু আদর লুকায়িত রেখেছো, এতটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট এলোকেশী।”
আলো লজ্জায় মাথা নিচু করে লাজুক হাসল।
এই মানুষটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ইস! কী বলছে এসব? লজ্জার ছিঁটেফোঁটাও কী নেই! রোদ মিটিমিটি হেসে ওর নাকের ঘাম মুছে দিলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে আলো এসি রুমেও ঘামছে। আলোকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে তখন মেঘের আগমন ঘটল। বউমনি! বউমনি! বলে ডাকতে ডাকতে কেবিনে প্রবেশ করল। ততক্ষণে রোদও দূরে সরে দাঁড়িয়েছে।মেঘ আর আকাশের হাত ভর্তি প্যাকেট। রোদ একটা প্যাকেট নিয়ে আলোকে ফ্রেশ হতে বলল। এখানে ড্রেস আছে! কতক্ষণ কলেজ ড্রেসে থাকবে? ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, খুব ক্লান্ত! এজন্য রোদ’ই রিমিকে মেসেজ করে বলেছে, আকাশের হাতে ড্রেস পাঠাতে।রিমির শোরুম এখান থেকে ছয় মিনিটের পথ।
আলো ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আকাশ আর রোদ খাবার সাজিয়ে ফেলল। তারপর চারজন খেতে বসে রিমিকে ভিডিও কল দিলো। রিমি ওদের খাবার দেখে বলল,

”আমাকে ছাড়া খাচ্ছিস? দেখিস, কোষ্ঠকাঠিন্য হবে।”
তখন আকাশ মুখটা বিকৃতি করে প্রায় চেঁচিয়েই বলল।
“টাকায় আমাকে কিড়িমিড়ি করছে? যা ভাগ, ফহিন্নি।”
রিমি প্রত্যুত্তর করার আগে ওর স্টার্ফ খাবার দিয়ে গেল। খাবারগুলো দেখে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এসব খাবার অর্ডার করে নি, তাহলে? স্টার্ফ ওর তাকানের মানে বুঝে উত্তর দিলো,
“আকাশ স্যার দিয়ে গেছে।”
“ওহ আচ্ছা।”
রিমি কিছুক্ষণ বিনাবাক্যে রোদ আর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সর্বদা এরা এভাবেই ওর খেয়াল রাখে। বন্ধুদের কাজ দেখেই, বন্ধুদের জন্য জান দিতে মন চায়। রোদ ওকে তাকাতে দেখে খাবার মুখে দিতে দিতে বলল,
“লোভ দিবি জেনেই দিয়েছে। এবার তুই’ও খা, আমাদেরও খেতে দে।”
তারপর গল্পের ছলে সবাই খাওয়া শেষ করল। রিমির কাস্টমার এসেছে তাই বিদায় নিয়ে কল কাটল। আর রোদের কথায় আকাশ আজকে
তাড়াতাড়ি অফিস ছুটির ঘোষণা দিলো। সবাই খুব খুশি! স্টার্ফরা চলে গেলে আকাশও বিদায় নিলো। রোদ আলোকে পুরো অফিসটা ঘুরিয়ে ছাদের নিয়ে এলো।
বিকেলের সূর্য তখন পশ্চিমা দিগন্তে অবতরণ করছে। তার রাজত্ব শেষ! কাল সকালে পুনরায় তেজ দেখিয়ে উদয় হবে। আর কাজেও বুঝিয়ে দিবে, সেই সেরা! ছাদে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত নগরী দেখা যাচ্ছে। রাস্তা, গাড়ি, দোকান, আর কত্ত মানুষের কোলাহল! সবাই কর্মচঞ্চল! ছাদটা খুব সুন্দর।

ফুরেফুরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আলোর লাল ওড়না উন্মুক্ত বাতাসে অবাধ্য হয়ে উড়ছে।
সে সিঁদুরে লাল রংয়ের ড্রেস পরে আছে। খোঁপা করে মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া। কিন্তু দুষ্টু বাতাস ওড়না রাখতে’ই দিচ্ছে না। আলো হাল ছেড়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“ছাদটা খুব সুন্দর।”
“আমার বাবাও খুব পছন্দ করতেন। আমি আর বাবা এখানে অনেক সময় কাটিয়েছি।”
“মনে পড়ছে, বাবার কথা?”
“সব সময়ই পড়ে।”
” উনাদের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নাকি..?”
”স্বাভাবিক। আম্মু জানত না, সিলিন্ডার লিক করেছিল। আব্বু- আম্মু দু’জনেই কথার ছলে চা বানাতে রান্নাঘরে গিয়েছিল। চুলা অন করতেই বিষ্ফোরণটা ঘটেছিল। তারপর….!”
আলো আর কিছু বলার সাহস করল না। মূখ্য কথা, বাড়তি কিছু বলে রোদের কষ্ট বাড়াতে চাচ্ছে না। থাক না, কিছু অজানা। মেঘ চুপ করে বসে রোদের ফোনে গেম খেলছে। মাঝে মাঝে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলছে। হয়তো বার বার চেষ্টা করেও হেরে যাচ্ছে। রোদ রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে সামনে দৃষ্টি রেখে বলল,
“তোমার বাবা-মাকে খুঁজতে ইচ্ছে করে না?”
“উহুম, না।”
“কেন?

“সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না। আমি আপনাদের নিয়ে বেশ আছি! তাছাড়া জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছি। এখন বাবা-মাকে খুঁজতে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলে হয়তো আমিই আর বাঁচব না।”
“নিরপেক্ষ কিছু ভাবো।”
আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছলছল চোখেও হাসি ফুটিয়ে বলল,
“যাকে আমি দাদীমা বলে জানতাম, উনি আমার রক্তের কেউ নন। আমার বাবা-মা কে? তাও জানিনা! হয়তো মেয়ে বলে বাবা-মা ফেলে গিয়েছিল। নয়তো দাদীমা কারো থেকে ছিনিয়ে এনেছে। নতুবা দাদীমাকে স্ব-ইচ্ছায় কেউ দিয়ে গেছেন। এমন কিছুই হবে। আমি বাবা-মাকে ছাড়া এতদিন বেঁচে ছিলাম; এখনোও আছি।
নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি তাই ভবিষ্যতেও সমস্যা হবে না। তাছাড়া পুরনো ক্ষতকে জাগ্রত করার, ইচ্ছে, ধৈর্য, সাহস, কোনোটাই আমার নেই।আমি সৃষ্টিকর্তার হুকুমে জন্ম নিয়েছি, ভাগ্যের জোরে দাদীমার কাছে, তারপর অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনায় এখন আপনার কাছে। আপনিও কী…?”
রোদ পকেটে হাত গুঁজে ওর কথাগুলো শুনছিল। ভীতু মেয়েটা গুছিয়ে কথা বলতেও শিখে গেছে।
কঠিন কঠিন কথা কত্ত সহজে বলে দিলো। তবে
শেষ প্রশ্নের জবাবটা রোদ ওর দিকে না তাকিয়ে বলল,
“উত্তরটা তোমার অজানা নয়। শুধু মস্তিষ্ক এবং মনে স্পষ্টভাবে গেঁথে নাও; তুমি মেঘের বউমনি আর আমার কেউ! নিতান্তই কেউ! তাই তুমি এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে না। আর আমি বেঁচে থাকতে তো নয়’ই!”
রোদের কথা শুনে আলো মনে মনে বেশ ক’বার আওড়াল; কেউ ! এই কেউ’টা কী? ওর প্রণয়ী, অর্ধাঙ্গিনী, ভরসাস্থল, নাকি হৃদমোহিনী? যদিও উত্তরটা সে , জানে, বুঝে, মানে এবং বিশ্বাসও করে। অস্পষ্টভাবে রোদ না বলা কথাটা জানিয়ে দিলো। যেখানে ওর চোখ গাঢ় অনুভূতির কথা জানান দেয়; সেখানে মুখে বলাটা বিলাসিতা!
বুদ্ধিমান মানুষরা একথায় কাজ সারে। হোক সেটা, পেঁচিয়ে বা স্পষ্টভাবে! রোদের মনোভাব বুঝে আলো মুচকি হেসে মনে মনে বলল,
‘-এটাই বুঝি এলোকেশীর প্রণয়ের পূর্ণতা। বেলাশেষে, তুমি নামক প্রাপ্তিটা আমি পেয়েই গেলাম, প্রিয়!-‘

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

(অন্তিম পার্ট)
দিন যায়! মাস যায়! দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে যুগও পেরিয়ে যায়। সময় বহমান! গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়াই তার কর্ম। এই দায়িত্বে সময়ও নিশ্চল; যেন তার সৃষ্টি এই কর্মে সম্ভূত!
মানব জীবনে সুখ-দুঃখের গন্ডি স্থির নয়। এটা পালা বদলের অনবদ্য খেলা। সুখ আসলে মনে হয়; উফ, পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন! সুখপূর্ণ রঙিন ভুবন! আর কষ্ট পেলে মনে হয়, এই বুঝি মরেই যাব। কষ্টের কড়াঘাত বড্ড নির্মম। এই কষ্ট প্রাণে সহে না।
অথচ প্রকৃতপক্ষে দিন পেরিয়ে সুখ-দুঃখের বদল ঘটে। পরিস্থিতি মোতাবেক জীবনও নিদির্ষ্ট পথে চলতে থাকে। শুধু স্মৃতির পাতায় এসে জমা হয়, অনাকাঙ্খিত মানুষদের আনাগোনা আর গুটি কয়েক অব্যক্ত গল্পকথা।
আর এই জীবনের সুখ -দুঃখের মধ্যস্থলে সৃষ্টি; পাপকর্ম। কেউ সুখে পাপে লিপ্ত, কেউ বা দুঃখে! তবে সময়, সুখ- দুঃখের কোনো ভেদাভেদ বুঝে না। চেনেও না, সুখ-দুঃখের মর্মজ্ঞ! শুধু জানে,
সঠিক সময়ের আগমনে সবার কর্মফল বুঝিয়ে দেওয়া।
যে জিনিস যত মূলবান তার চাহিদা তত বেশি।
কথাটা চরম সত্য! আর এই চাহিদা পূরণের পথ
কষ্টার্জিত! হাজারও বাঁধা বিঘ্ন! তবুও এটা সবার চাই-ই চাই! কেউ বুঝে; কেউ বা না বুঝে জড়িয়ে পড়ে, এই মায়াজালে। পূর্নতা অর্জনও কঠিন।
তবু! আর এই জিনিসটার যথার্থ উদাহরণ; প্রণয়!

তিন বছর পর,
পাহাড়ের সেই ছোট্ট গ্রামে গত তিন বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চিকিৎসালয়, স্কুল, মসজিদ, এবং বাজার তৈরী হয়েছে। চাকচিক্যময় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ না হলেও, চলার উপযুক্ত! পূর্বের মতো,
গ্রামবাসী ভয়ে আড়ষ্ট থাকে না! মেয়ে জন্মালে বাবা-মায়ের আফসোস হয় না। সুন্দর মেয়েরা আর লুকিয়েও থাকে না! কারন গ্রামের কুৎসিত রীতি বদলে নতুন রীতি তৈরী হয়েছে। এই গ্রামে অনাবিল সুখ’রা এসে হানা দিয়েছে। গুমোটপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে আনন্দমুখর এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
গত তিন বছর পর, আলো আবার এসেছে ওর গ্রামে। সব পরিবর্তন দেখে খুশিতে কেঁদেছে। তবে ওর চেনা অনেক মানুষ নেই। কেউ মারা গেছেন, কেউ বা চলে গেছেন! এখানে জোর করে থাকার রীতিও আর নেই! আর ওই জঙ্গিদের সাথে চুক্তি হয়েছে। ওরা গ্রামেও ঢুকতে পারবে না, মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। নয়তো ওদের তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হবে। জঙ্গিরা প্রথম প্রথম না মানলেও পরে রাজি হয়েছে। এখন সব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে।
বন্য পাখিরা যেমন দীর্ঘদিন খাঁচায় থেকে মুক্ত হলে, পাগলের মতো উড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। ডানা ঝাপটে সুখচর সাজে! আলোরও তেমন অবস্থা। চেনা স্বচ্ছ আকাশ, কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, বন্য পাখিদের গুনগুন, শুভ্র মেঘেদের ভেলা, বুনো ফুলের সুগন্ধ। এসব পেয়ে আলোর খুশি আর ধরে না। খুশিতে ওর অশ্রুপূর্ণ আঁখি ছলছল করলেও মুখে তৃপ্তির হাসি। এখানে না আসলে রোদের জানাই হতো না, আলোর মন ও প্রাণ এখানে পড়ে থাকত। সে প্রত্যাশা করত; এখানে আসার। যদিও নিজের গ্রামের প্রতি টান থাকাটা স্বাভাবিক! তবুও মেয়েটা বুঝতে দিতো না।

ওদের সাথে এবার রোহানরা এসেছে। ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোহিত হতে এসেছে।পূর্ণি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধায় আসে নি। সেও সময় বুঝে আসবে! শুভাননাগণ রোদদের গ্রামের থাকার সু-ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রোদ প্রথমে রাজি না হলেও আলোর জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে। যার খুশিতে এতকিছু, সে চায়লে আর কী করার! তবে আলোকে এতটা প্রানবন্ত দেখে ওরা খুব অবাকও হয়েছে। কারণ কর্মচঞ্চল শহরের এই আলোটা হারিয়ে বসেছিল। পুনরায় যেন মেয়েটা প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠল! ওরা উঠানযুক্ত টিনের চালা বিশিষ্ট তিনরুমের কক্ষে থাকছে। পাশে রান্নাঘর আর সাদামাটা বাথরুম। এটা অতিথিশালা! প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস দিয়ে সাজানো। বাড়িটা দেখতেও বেশ! রোদরা একরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আলো আর মেঘ নেই। সেই সকালে বেরিয়েছে, এখনো ফেরার নাম নেই। ওদের কাজ’ই টইটই করে বেড়ানো। রোদ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই আলো আর মেঘ রুমে প্রবেশ করল। দু’জনের মুখভর্তি হাসি! যেন বিশ্বজয় করে ফিরল।আলো হাতে ফলের ডালা, সেখানে পাহাড়ি হরেক রকম ফল রয়েছে!
রোহানরা সেদিকে তাকাতেই, ওদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সকলের নির্বাক চাহনি! আলো তখন মিষ্টি হেসে ফলের ডালা রেখে বলল,
” টাটকা ফল! ঢাকাতে এমন পাবেন না।”
“বইন, কে গো তুমি?”
আকাশের কথায় আলো খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রানবন্ত হাসি! সে বুঝেছে, আকাশের কথার মানে এজন্য অহেতুক কথা বাড়াল না।

তবে ওর হাসি দেখে সবাই মুগ্ধ হলো। রোদ খাটে হেলান দিয়ে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই পরিবেশে মেয়েটার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুন বেড়ে গেছে। তার উপরে, পোশাক বদলে গাঢ় লাল আর সবুজ রংয়ের সংমিশ্রণের থামিও পড়েছে। ফর্সা শরীরে রং দু’টো ফুটে উঠেছে। সাথে যুক্ত আছে; ভি স্টাইলে নেওয়া ওড়নাটা। চুল খোঁপা করে লাল রাবাব ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। সুযোগটা সে কাজে লাগিয়েছে, ঢাকাতে তো থামি চলবে না।
তাই যে কয়েকদিন আছে, থামি পরলে মন্দ হয় না।
সময়ের সাথে সাথে ওর শরীরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এজন্য এমন সাজে’ও ওকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। থামিতে দেখেই আকাশ কথাটা বলল। কারণ ওরা আলোকে এভাবে দেখি নি।
রোহান বার দু’য়ের তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কারণ, নিষিদ্ধ সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হতে নেই, মন পুড়ে! তখন মেঘ দাঁত বের করে হেসে রোদকে বলল,
“দাভাই বউমনি আগের মতো লাগছে তাই না?”
“হুম।”
রিমি রোদের কাঁধ চাপড়ে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এজন্যই বলি, বন্ধুটা আমার শহরের ফুল ছেড়ে বুনে ফুলে আসক্ত কেন।”
আলো ততক্ষণে ফলগুলো ধুতে কলপাড়ে চলে গিয়েছে। সে রিমির কথা শুনতে পায় নি। রোদ আলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“শহরের ফুলে রং ঢং মেশানো, কৃত্রিম। আর আমার বুনো ফুলের সৌন্দর্য প্রকৃতিগত।”
রোদের জবাবে রিমি সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে হাসল। আসলেই! আলো ফলগুলো ধুয়ে কেটে ওদের দিতে থাকল, ওরা খেতে থাকল। রোহান আনারস খেতে চাচ্ছিল না, মেঘের খাওয়া দেখে টেষ্ট করে লোভে পড়ে গেছে। তখন মেঘের সাথে ওর যুদ্ধ শুরু হলো। তারপর,আলো ওদের ফল খাইয়ে রোদকে নিয়ে একটু বের হলো। মেঘ ব্যস্ত থাকল, কুস্তিতে। বাইরের কড়া রোদ! সূর্য রেগে যেন রোদের তাপ বাড়াচ্ছে। বাতাস নেই! গাছের একটা পাতাও নড়ছে না! আলো মাথায় ওড়না টেনে মুখটা মুছে বলল,
“এখানে সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। তাই আমি’ই ভাইয়াদের রান্না করে খাওয়াব। শুভাননাদেরও বুঝিয়ে বলে এসেছি।”
“হুম, তা এখন কোথায় যাচ্ছি।”
“বাজারে।”
হঠাৎ রোদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে, আলোর থুতনীর নিচে কামড় বসিয়ে সরে গেল। এমন ভাব যেন কিচ্ছু জানে না। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল, আলোর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। আলো আশেপাশে তাকিয়ে সেখানে হাত বুলিয়ে বলল,
“উফ, এমন করলে কেন?”
রোদ দুই পকেটে হাত গুঁজে আলোকে বাহু দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“খুশিতে ঠ্যালায়।”
আলো আর এই নিয়ে কথা বাড়াল না। অভ্যস্ত
সে! এই মানুষটা আর শুধরাবে না। ফাজিল না এটা; মহাফাজিল! আলো এখন রোদকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। কারণ এই ব্যাপারেও রোদ ওকে চাপে ফেলেছিল। সেদিন আলোকে কাঁদিয়ে ‘তুমি’ বলিয়ে পরে মান ভাঙ্গাতে বলেছিল,
“ওরে আমার নাক, কান, গলা, কাঁদে না।”
আলো ওর কথা শুনে কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসাও করেছিল,
“আমি আপনার নাক, কান, গলা?”
রোদ তখন ফিচেল হেসে আলোর নাক’টা টেনে উত্তর দিয়েছিল,
“হুম! এখন কলিজা, জান, বাবু, হার্ট, কিডনী, এসব ডাক কমন হয়ে গেছে। আর আমি সর্বদা আনকমন জিনিস পছন্দ করি। তাই তোমাকে আদর করে ডাকলাম, আনকমন কিছু শব্দগুচ্ছ দিয়ে।”
এরপর আলো প্রত্যুত্তর করার শব্দ খুঁজে পায় নি। বোকার মতো তাকিয়ে সবটা মেনে নিয়েছে।
তাছাড়া সে জানে, রোদের দুষ্টুমিগুলো শুধু ওকে ঘিরে! আর এই ফাজিল মানুষটাও একান্ত ওর।যার পুরো হৃদয়জুড়ে সে বিরাজমান!

তারপর দু’জনে বাজার ঘুরে হাতভর্তি বাজার নিয়ে বাড়িতে ফিরল। রোদ আলোকে রান্নায় সাহায্য করতে, পাশে মোড়াতে বসল। একটুপরে, রোহানরা এসে যে যা পারে কাজে হাত লাগল। কেউ’ই আলোর বারণ শুনল না। বরং হাসির কথা বলে হাসাতে লাগল। গল্প হাসিঠাট্টায় মজে রান্না সম্পূর্ণ করল। তারপর একে একে গোসল সেরে, সবাই একসঙ্গে খেতে বসল। সবাই তৃপ্তি করে খেলেও, টাটকা জিনিসের স্বাদই আলাদা!
রান্নাটাও খুব মজার! দুপুরে রেস্ট নিয়ে বিকালে ওরা ঘুরতে বের হলো। কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ আকাশ বুনে একটা ফুল নিয়ে রিমির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমার বউ হবি?”
রিমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফুলটা নিলো। কারণ এরা দু’জন দু’জনকে বিগত সাত বছর ধরে ভালোবাসে। বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কেউ কাউকে বলে নি। কারণ ওদের বন্ধুত্বে শর্ত ছিল, প্রেমজনিত কারণে কেউ বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবে না। তবে রোদ আর রোহান সব জানত।
রোদ আকাশকে হুমকি না দিলে হয়তো আজও বলত না। রিমির লজ্জারাঙা মুখ দেখে সবার মুখে ফুটল। তবে কিছু বলে লজ্জায় ফেলল না। তখন মেঘ রোহানের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলল,
“আমার আর রোহান ভাইয়ার কেউ নেই।”
“হ্যারে ভাই।”
ওদের কথা শুনে বাকিরা উচ্চশব্দে হেসে উঠল।

তারপর পাশের পাহাড়িদের দোকানগুলো থেকে কেনাকাটা করল। আকাশ পছন্দ করে রিমিকে একটা নীল রংয়ের থামি, চুড়ি, দুল, আর হরেক রকমের আচার কিনে দিলো। মেঘ নাড়ু, বাদাম, আচারসহ শুকনো খাবার নিলো। রোহান আব্বু আম্মুর জন্য সুন্দর দেখে দু’টো শাল কিনল।
আলোকে কালো রেশমি চুড়ি নিতে দেখে রোদ হাসল। কারণ রোদের পছন্দ কালো! রোদ এসেই একটা সুন্দর চুলে কাঁটা আলোর খোঁপায় গুঁজে দিয়েছে। আলো না বুঝলেও, আকাশ’রা দেখে নিঃশব্দে হেসেছে। আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে ওরা
সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়ি ফিরে গেল। এবার আর মেঘ বায়না করে নি।

হালকা শীতের রেশ পড়েছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। এখন বাজে রাত বারো’টা। রাতের খেয়ে মেঘ আলোর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রিমি একরুমে, রোহান আর আকাশ পাশের রুমে। রোদরা তার পাশের রুমে।
কিছুক্ষণ আগে, মেঘ দৌড়ে আলোর কাছে যেতে গিয়ে পড়ে পায়ে নখ উল্টে ফেলেছে। গলগল করে রক্ত বের হতে দেখে মেঘ কিছু না বললেও, আলোর কেঁদে একাকার অবস্থা। মেঘ একটু বড় হয়েছে। বউমনির সামনে কাঁদতেও লজ্জা পায়।
তাই বাক্‌শূন্য! কিছুক্ষণ পর, আলোকে কাঁদতে দেখে মেঘ ধরা গলায় বলল,
“বউমনি ব্যথা কমে গেছে।”
“বাচ্চারা আগে কার কাছে ধরা পড়ে মেঘবাবু?”
“মায়ের কাছে।”
“আমি কে?”
“আমার আরেকটা মা!

কথাটা বলে মেঘ ছলছল চোখেও মিষ্টি হাসল। আলো মেঘের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দিন পেরিয়ে বছরে গড়ালেও ওদের সম্পর্কের ভিত নড়ে নি। বরং শক্তপোক্ত
হয়েছে! আলো সঠিক দায়িত্ব পালনে অটল। সে সত্যিই মেঘের বউমনিরুপি মা হয়েছে। সন্তানদের যেমন ব্যথা পেতে দেখলে মাযের কষ্ট হয়, বুকটা কেঁপে ওঠে! বার বার দোয়া করে যেন সন্তানের কষ্ট লাঘব হয়। তেমনি মেঘের সামান্য কিছুতেও আলো উতলা হয়ে পড়ে। একজন কাঙাল বুঝে, আরোকজন কাঙালের কষ্ট। এজন্যই বুঝি, ওদের সম্পর্কটা এতটা শক্তপোক্ত! তবে আলো সর্বদা চেষ্টা করে মেঘকে ভালো রাখার। আর মেঘেরও প্রাণ তার বউমনি! রোদ এতক্ষণ চুপ করে শুয়ে ওদের’ই দেখছে।
রোদ আর আলোর সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক! যতটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা, ঠিক ততটাই! সংসার, মেঘের দায়িত্ব, পড়াশোনা, বুটিকশপ, সব আলো নিজে সামলায়। বাচ্চা নিয়ে এখন
চিন্তা নেই! হবে, নিবে, তবে নিজেকে আর একটু গুছিয়ে। কারণ স্বামীর সব থাকলেও ওর নিজের কিছু নেই। আজ স্বামী কোটিপতি, কাল ফকির হলে? আজ গাড়ি-বাড়ি সব আছে, কাল না থাকলে? আজ স্বামী সবটুকু দিয়ে ভালোবাসছে, কাল না বাসলে? আজ সে প্রিয়, কাল অপ্রিয় হলে? জীবন এত সহজ হলে, বিচ্ছেদ আর কষ্ট নামক শব্দ পৃথিবীতে থাকত না। কোটিপতিরাও পথে নামত না, কারো সোনার সংসার ভাঙ্গত না। বর সোহাগী মেয়েদেরও বিবাহবিচ্ছেদ হতো না। স্বামী সংসারের কথা ভেবে পড়াশোনা ছেড়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তবে রোদও বাচ্চা নিয়ে না ভাবলেও পারিপার্শ্বিক অনেকে’ই উতলা হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ রোদকে এমনও বলেছে,

“রোদ বাচ্চা নিয়ে নাও। নয়তো তোমার সুন্দরী বউ উড়াল দিবে। বাচ্চা নিয়ে বাঁধনটা শক্ত করো।”
রোদ মুচকি হেসে খুব শান্তভাবে তাদের উত্তর’ও দিয়েছে,
“যে যাওয়ার তাকে সোনার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও সুযোগ বুঝে ঠিকই উড়াল দিবে। তাই বাঁধার প্রশ্নই আসে না।”
“পাখি উড়াল দিলে?”
“উড়াল দিলে বুঝব, পাখিটা কখনো আমার ছিল না।”
একথা শুনে কেউ আর কিছু বলতেও পারে না।
তাছাড়া রোদ আলোর কোনো কাজে বাঁধা দেয় নি। বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করে সাহায্যের! তবে জ্বালাতন করে কান্না ঠিকই করাই! আলো কাঁদে আর সে দেখে মিটিমিটি হাসে! ইচ্ছাকৃতভাবে আলোকে কাঁদানোর সে সারাজীবনই করে যাবে।
এতে কী সুখ পায়? একমাত্র রোদই জানে! তবে
ওদের সম্পর্কে পূর্ণতা এনে আলো ওকে ওয়াদা করিয়েছিল।
১. যত কিছুই হোক; আমরা রেগে আলাদা ঘুমাব না।”
২. পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, ঝগড়া করে কেউ পাঁচ মিনিটের বেশি কথা না বলে থাকব না।”
রোদ সেদিন হাসি মুখেই ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলো।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪০+৪১+৪২

কারণ শর্ত দু’টির গভীরতা সে বুঝেছিলো।তাই দ্বিমত পোষণ করে নি। আলো মেঘকে শুইয়ে আদর দিয়ে বাইরে গিয়ে বসল। রোদও নিঃশব্দে
আলোর পাশে বসে আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রাখল। ঝড়ো বাতাস বইছে! মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ অঝরে বৃষ্টিও শুরু হলো। গাছের পাতাগুলোও বৃষ্টির তালে তালে নৃত্য করতে লাগল। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ হচ্ছে। ঢেউ খেলানো টিনের চালা বেয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে যাচ্ছে। শুকনো মাটি ভিজে পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। পঁচা ডোবা থেকে ব্যাঙ ডাকছে। তাদের ঘ্যাঙর ঘ্যাং ডাক’টা বৃষ্টির শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা কুকুর দৌড়াদৌড়ি করে আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। রাস্তায় ওরা শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। তখন শো শো বাতাসের শব্দে বৃষ্টির ঝাপটা রোদদের শরীর ভিজিয়ে দিলো। তবুও উঠলও না, সরলোও না!

বরং দু’জনেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল, শক্ত করে ধরে রাখা ওদের হাতের বাঁধনে। এটা অদৃশ্য শেকল!
আলো বামহাতে রোদের গালের বৃষ্টির পানিটুকু মুছে বলল,
“ভিজলে অসুস্থ হবে, চলো।”
একথা শুনে রোদ মুচকি হেসে আলোর হাতের উল্টো পিঠে আদর দিয়ে খুব’ই মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“অসুস্থ তো সেই কবেই হয়েছি। ‘এলোকেশী’ নামক অসুখে আমি মারাত্মকভাবে মর্মঘাতী। আমার এই অসুস্থতা না কখনো সারবে; আর না সারতে দিবো।”
রোদের কথা শুনে আলো মৃদু হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা এই ব্যাধির প্রতিষেধক কী?”
” তুই নামক আমার সুখপাখি।”

( লেখাঃনূরজাহান আক্তার (আলো)) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন