এলোকেশী কন্যা পর্ব ৩৭+৩৮+৩৯

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৩৭+৩৮+৩৯
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ওরা পৌঁছাল প্রায় বারো’টা নাগাদ। ওদের দেখে আকাশ বিশ্রী একটা গালি দিয়ে গিয়েও থেমে গেল। বিশেষ করে আলো আর নিতুকে দেখে।
কালকে থেকে কাজ করতে করতে ওর জান শেষ,
আর হতচ্ছাড়া বন্ধুগুলো এতক্ষণে আসল।কেন একটু তাড়াতাড়ি আসা যেতো না? বাড়িটা বড় উঠান ওয়ালা! তার একপাশে একদল বাচ্চারা কোরআন তেলাওয়াত করছে। সুমধুর সেই সুর! বাচ্চাগুলো হয়তো কোনো মাদ্রাসার ছাত্র।তাদের কোরআন তেলাওয়াতের শুদ্ধ উচ্চারণে’ই বোঝা যাচ্ছে। তার একটুদূরে রান্না-বান্নার কাজ চলছে। বাবুর্চিগণ ব্যস্ততার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন,যেন হাফ ছাড়ারও সময় নেই। আশেপাশের তিনটা গ্রামের মানুষের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে।

গ্রামবাসীরা আজ দুপুরে এখানে নিমন্ত্রিত।আর পাশের বড় মাঠে প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে একবারে প্রায় পাঁচ’শজন খেয়ে উঠতে পারবে। তাছাড়া দান-খয়রাত, দোয়া- মহফিল এবং কবর জিয়ারত করা কালকে হয়ে গেছে। আজ শুধু মানুষ খাওয়ানো হবে। বন্ধুদের সাথে কথা বলে আকাশ হালকা পাতলা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল। অনেকে দাঁড়িয়ে রোদদের দেখছে। ঢাকা শহরের মানুষ বলে কথা। আকাশের আব্বু আম্মুসহ চাচারাও এসে কথা বললেন।রোদ’রাও বিনয়ীভাবে সালাম দিয়ে খবরা-খবর জানল। একটুপরেই খাওয়ানো শুরু হবে নয়তো রাত হয়ে যেতে পারে। রাত হলে তো আরেক সমস্যা।তাতে আবার গ্রাম! তাছাড়াও অনেক মানুষের ব্যাপার! আকাশ বন্ধুদের সঙ্গে কথার বলার মাঝে বাইরে থেকে ডাকল পড়ল। আকাশের বাবা খুব রেগে চেচাঁমেচি করছেন।এতগুলো মানুষ খাবে অথচ খাওয়ানো মানুষরা এখনো আসে নি। এভাবে দু’একটা কথার মাঝে অনেকে জড়ো হয়ে গেল।
বাইরে এতজনের চেচাঁমেচি শুনে রোদ’রাও বের হয়ে ঘটনা শুনল। এতগুলো মানুষ, কীভাবে কী করবেন?এচিন্তায় আকাশের বাবার প্রেসার বেড়ে গেল। যে এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন উনি লাপাত্তা! আজ বুঝি মান-সন্মান শেষ। আকাশ সবাইকে শান্ত হতে বলাতে ধমক খেয়ে চুপ থাকল। রোদ আর রোহান আকাশের বাবার পাশে বসল৷ উনি কিছু বলার আগে রোদ বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

”আংকেল, আমরা নয়জন আছি।আশেপাশের
দশ বারোজন ছেলেকে ডাকুন আর এই বাড়ির কয়েকজন।”
রোদের কথা শুনে আকাশকে রোদকে টেনে দ্রুত মোড়ের দিকে গেল। হাতে সময় নেই, আগে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। নয়তো সব শেষ! মোড়ের চা’য়ের দোকানটা বখাটেদের আস্তানা।
আশা করা যায়, খাওয়াতে ওরা ভালোই পারবে ওরা। আকাশ ওদেরকে বুঝিয়ে কাজে লাগানোর কথা বলল। আর বোঝানোর ক্ষেত্রে রোদ বেশ পটু। রোদকে টেনে নিয়ে যাওয়া দেখে আকাশের বাবা খুব বিরক্ত হলেন, বকলেনও। এখন বন্ধুর সাথে গলাগলি করার সময়। অপদার্থ একটা!
কাজের কথা হচ্ছিল অর্কমাটা ছেলেটাকে টেনে নিয়ে চলে গেল। এটা আর মানুষ হবে না। রোদ চা’য়ের দোকানে ঢুকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সালাম দিলো। ক্যারাম খেলা, আড্ডা দেওয়া,চা খাওয়া বাদ দিয়ে সবাই ওর দিকে তাকাল। রোদ তখন মুচকি হেসে বলল,

“আপনারা আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? চা, সিগারেটের, বিল আমি দিবো।”
একথা শুনে একজন রোদের আগা-মাথা পরখ করে নিলো। অন্যজন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কী করতে হইব?”
“খাওয়াতে হবে। শেখ বাড়িতে আপনাদের জন্য যে আয়োজন করা হয়েছে, তার জন্য’ই। আর আমার কেন জানি মনে হয়েছে, গ্রামের মানুষের কদর গ্রামের মানুষই বোঝে। অর্থাৎ আপনাদের
গ্রামের মানুষদের অাপ্যায়ন আপনারাই ভালো করতে পারবেন। তাছাড়া আমরা তো একদিনের অতিথি, কাউকে চিনিও না জানিও না। হয়তো
তেমনভাবে খাওয়াতেও পারব না।এজন্য সাহায্য চাচ্ছি! তাছাড়া এত সুন্দর গ্রামের সন্মান বজায় রাখা আপনাদের’ই দায়িত্ব, তাই না?”
“তা ঠিক।”
“গরমে এই কাম করুম না।” (অন্যজন)
” কাজ শেষে আমি আপনাদের খুশি করব।”
রোদের এ-ইঙ্গিত বুঝতে কারো সময় লাগল না।
টাকার কাছে সবাই কাবু। রোদ গল্প করতে করতে ওদের চা, সিগারেট খাওয়াল। ফ্রি হয়ে গল্পও করল। নিরংহকার দেখে রোদকে ওরা বেশ পছন্দ করল। বসেই তো থাকবে কাজটা করলে সমস্যা কী? তাছাড়া সবাই গ্রামের চেনা-জানা মানুষ।প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই রাজি হয়ে গেল।

রোদের টেকনিকটাও কাজে লাগল। লোক পাচ্ছে না, একথা সে প্রকাশ করল না। নয়তো এদেরও রাজি করানো যেতো না। ভাবত, ঠেলায় পড়েই এসেছে। এখানে আছে তেরোজন, রোদরা বন্ধুরা নয়জন, বাড়ি থেকে সাতজন। তাহলে হবে মোট ঊনত্রিশ জন। রোদ ওদেরকে ছয়জনকে যোগাড় করতে বলল। পঁয়ত্রিশজন পেলে ভালো হতো।
কারণ গ্রামের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, বাড়ির সব মানুষ। এতজনকে খাওয়ানো তুচ্ছ ব্যাপার না।কাল ঘাম ছুটে যাবে! ছেলেগুলো একে অপরের বন্ধুদের কল দিয়ে ডাকল। এবং আশ্বস্তও করল আরো ছেলে পাওয়া যাবে। বখাটে হলেও সবাই বেশ মিশুক। রোদের সঙ্গে অল্পতেই মিশে গেছে।
একটুপরে ছয়জন না আসল এগারোজন।এখন হলো চল্লিশ জন। রোদ সবাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসল। আর আকাশকে আড়ালে ডেকে বলল,
“ছেলেগুলোকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর। নয়তো খুধা পেলে গায়েব হয়ে যাবে।”

রোদের কথামতো আকাশ আগে ছেলেগুলোকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করল। রোদ ভুল কিছু বলে নি। এরা কামচোর! অবশেষে সমস্যার সমাধান হলো; সবাই হাফ ছেড়েও বাঁচল। নয়তো কী যে হতো!ছেলেগুলো খেয়ে ঝটপটকাজে লেগে গেল। ততক্ষণে গ্রামের লোকেরা আসতে শুরু করেছে। রোদ প্রতিটা টেবিলে খাওয়ানোর লোক নির্ধারণ করে দিলো, নতুবা ঝামেলার সৃষ্টি হবে। একবার হট্টগোল হলে পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ওদের দায়িত্ব হবে যার যার টেবিলে নজর রাখা। যাতে খেতে কারো সমস্যা না হয়। তারপর শুরু হলো; খাওয়ানোর যুদ্ধ। বন্ধুরাও খাবারের গামলা তুলে কাজে লেগে গেল। না পরোয়া করল গরম আর না ভিড়। রোদ আশেপাশে মেঘদের খুঁজে পেলো না। দু’জনে কোথায়, কে জানে! রোহানের হাতে ভাতের গামলা আর রোদের হাতে ডালের।একটু পর, রোহান এসে ডালের গামলা রোদকে দিয়ে ভাতেরটা নিলো। মানুষ ডাল কম খায় আর যা কম খায় তা চায় কম। ফলে দেওয়ার কষ্টও কম হবে। ওর এই যুক্তি দেখে রোদ আর কথা বাড়াল না। নয়তো এখানেই রাত হবে। সব কয়টাকে সে ভালো করেই চিনে। সময় যত অতিবাহিত হতে লাগল মানুষের ভিড়ও তত বাড়তে লাগল।তিন ব্যাচ উঠার পর, রোদ শোভনকে বলল নিতুদের ডাকতে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছি ওরাও খেয়ে নিক। শোভন মুখে মাংস পুরে বলল,

“নিতু কে?”
“তোর শশুড়ের মেয়ে।”
এবার শোভনের ওর বউয়ের কথা মনে পড়ল।
তাই তো! ওর বউ কোথায়? সে তো ভুলেই গেছে ওর বউ আছে। আর নিতুর পুরো নাম ‘মুনিয়া ইসলাম নিতু।’ কেউ মুনিয়া ডাকে; কেউ নিতু!
এজন্য শোভনেরও মাঝে মাঝে গুলিয়ে যাচ্ছে।
নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই হয়তো। শোভনের
হাসি দেখে রোদ বিরক্ত হয়ে ভাতের গামলা নিয়ে চলে গেল। ওর এক একটা বন্ধু এক এক গুনের অধিকারী। হাজারবার বলেও এরা শুধরাবে না।
আলো মেঘ এবং নিতুসহ আকাশের বোন’রাও এসে বসল। আকাশ তখন হন্তদন্ত হয়ে এসে রোদকে বলল,
“মেঘদের রুমে খেতে দে ভাই, এত ভিড়ে খেতে পারবে না।”
”ওদের সব পরিবেশেই মানিয়ে নেওয়া শিখতে হবে। কাছের বলে এত খাতিরের দরকার নেই, কাজে যা!”
আকাশ এত বলেও রোদকে রাজি করাতে পারল না। অগত্যা সে স্থান ত্যাগ করল।এখানে সবাই নিমন্ত্রণিত। তাহলে ওরা কেন আলাদা খাবে?

তাছাড়া সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।এই গুন আয়ত্ত করা আবশ্যক । তাছাড়া এই নিয়ে সমালোচনা হতে পারে।এটা গ্রাম, ভুললে চলবে না। এদিকে আলো চুপ করে বসে রোদকে দেখছে। হাসি মুখে রোদ মানুষদের খাবার দিচ্ছে। ওর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে।
নাকেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।ওর চুলের গোড়া থেকে ঘাম ঝরে ঘাড় বেয়ে সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে বাহু দিয়ে ঘামার্ত মুখটা মুছছে। পান্জাবিটা ভিজে ওর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি’টা দেখা যাচ্ছে। তবে ব্যস্ত রোদকে দেখতে বেশ লাগছে! হঠাৎ আলোর মনটা খারাপ হয়ে গেল। রোদকে সে এখন অবধি কিছু খেতে দেখে নি। তখন নাস্তা করার আগেই চেচাঁমেচি শুনে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর তার দেখায় নেই।
মাঝ-রাস্তায় একটা স্যান্ডুইচ খেয়েছিল। এখন বাজে দুই’টা সাতচল্লিশ! রোদ না খেয়ে থাকতে পারে না; ওর সমস্যা হয়। অথচ আজ যেন তার খেয়ালই নেই। আলো রোদের খাওয়া নিয়ে বসে ভাবতে থাকল।

এতকিছুর মধ্যে একবারও ওর মনে হলো না যে,’ রোদকে মেয়েরা দেখছে, হাসাহাসি করছে, নজর রাখছে, ওর হিংসা হচ্ছে, রোদকে লুকিয়ে রাখতে মন চাচ্ছে। সচরাচর গল্প আর মুভিতে যেমনটা দেখা যায়। এসব কোনো ভাবনায় ওর মস্তিষ্কে আসল না। কারণ এসব বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীদের ভাবনা। শুধু রোদের না, যারা যারা কাজ করছে সবার’ই একই অবস্থা! তার মানে এই না সুদর্শন শুধু রোদ’ই। তাছাড়া কাজ করলে ঘামবেই আর ঘামলে পরণের পোশাকটা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টাবে’ও। এটা নিয়ে অহেতুক ন্যাকামির কিছু নেই। তবে এই ঘাম বুকে বসে ঠান্ডা লাগার ভয় আছে। কী আর করার! সবাই ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে।আলো নিজে খাচ্ছে আর মেঘকেও খাওয়াচ্ছে। রোহান ওদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। রোদ ফোনে কথা বলে ওর বরাদ্দকৃত টেবিলে গিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“কারো ভাত আর লাগবে?”
ওর কথার প্রত্যুত্তরে সম্পর্কে ভাবি হয় উনি হেসে বললেন,
“না ভাই, একটার অত্যাচারেই রাইতে ঘুমাইতে হারি না।”

একথা শুনে রোদ হতবাক! উনার কথাটা প্রথমে কেউ ধরতে পারে নি। পরে বুঝে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। আলো বুঝেছে যে রোদ ‘কেউ ভাত নিবে নাকি’ জিজ্ঞাসা করেছে! কিন্তু ওই ভাবিটা ‘ভাত ও আর, এই দু’টো শব্দকে একসাথে জুড়ে দিয়েছে। রোদ সরল মনে স্বাভাবিকভাবে জানতে চেয়েছিল অথচ ভাবি উল্টো ধরে বসে থাকল।
উনার জবাবে রোদ কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো।এমন শব্দ সে কখনো উচ্চারণ না। ভাবির উপরে কেন জানি আকাশের খুব রাগ হলো। তাই সে এগিয়ে এসে বলল,
“ভাবি, মজা তার সাথেই করা উচিত, যার সাথে মজা করার সম্পর্ক জায়েজ।”
“রাগো ক্যারে?”
“আপ…।”
অবস্থা বেগতিক দেখে রোদ ইশারায় আকাশকে থামিয়ে দিলো। দু’টো শব্দের জন্য এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। রোদ ভাবে নি কথাটা উনি এভাবে ধরবে। তাই পরিবেশ ঠান্ডা করতে রোদ’ই মুচকি হেসে বলল,
”কেউ আর ভাত নিবেন?”

ওর একথা শুনে সবাই একদফা হেসে খেতে শুরু করল। মেয়েরা কতরকম ভাবে যে কথা প্যাচাতে পারে ;এটা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ! এজন্য’ই ভেবে চিন্তে কথা বলা অাবশ্যক। এই খাওয়ানো চলল, রাত আট’টা অবধি। সবার শেষে খেলো ওরা বন্ধুরা। খাবারের গন্ধে ওদের ক্ষুধা হারিয়ে গিয়েছিল। যদিও আলো সবাইকে একগ্লাস করে
শরবত খাইয়েছিল।রোদকে তো একা দেওয়া যায় না, তাই সবার জন্য’ই করেছিল। ওদের এখন বেহাল দশা! তাই মেয়েরাই ওদেরকে খাবার বেড়ে দিলো। রাতেই ওদের ফোরার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হলো না। আকাশের বাবা বিকেলে সবার জন্য পোশাক কিনে এনেছেন। ছেলেগুলো আজ অনেক করেছে। নয়জন বন্ধু গোসল সেরে কলপাড়ে কাপড় ফেলে এসেছে। কারো ধোয়ার ধৈর্য্য নেই! তারা একে অপরকে বলেও ছিল,’ভাই ধুয়ে দিস।’ কিন্তু নয়জন’ই উধাও। আলো হাত ধুতে গিয়ে কাপড়গুলো দেখে আকাশের আম্মুকে খুঁজে বের করল। উনার থেকে ডিটারজেন নিয়ে নয়জনের পোশাক ধুতে শুরু করল। সবগুলোর পোশাকে ডাল আর মাংসের ঝোলের দাগ।এটা না ঘষে তুললে দাগ থেকে যাবে। রোহান পানি নিতে এসে আলোর কাজ দেখে হতবাক।মেয়েটা পাগল নাকি? বন্ধুর বউ কাপড় ধুয়ে দিচ্ছে, ছিঃ! লজ্জাজনক একটা ব্যাপার। কলপাড়ে অন্ধকার হওয়াতে কেউ ওকে খেয়ালও করে নি। রোহান হাতের জগটা রেখে বলল,

”পাহাড়ি ফুল সাইড দাও আমি পানি তুলে দিচ্ছি।”
“না, না, আমি পারব ভাইয়া।”
রোহান শুনল না। সে কল চাপতে থাকল আর আলো কাপড়গুলো ধুতে লাগল। কল চেপে এত পানি তুলতে আলোর কষ্টও হচ্ছিল।যাক রোহান আসাতে ভালোই হয়েছে। দু’জনে টুকটাক গল্পও করছে। আকাশ পা ধুতে গিয়ে ওদের দেখে সেও এগিয়ে আসল। আলোর কাজ দেখে আকাশও অবাক। ওদের জিন্সপ্যান্ট গুলো পানিতে ভিজে ভারী হয়ে গেছে। আলো প্যান্টগুলো বালতির পানিতে ধুয়ে টেনে আর তুলতে পারছে না।খুব ভারী! আকাশ দ্রুত নিয়ে ওকে সাহায্য করল। তারপর তিনজনে মিলে সব কাপড় ধুয়ে উঠানে বাঁধা রশিতে মেলে দিলো। তখন মেঘের ডাক শুনে আলো দ্রুত পায়ে সেদিকে গেল। আকাশ আর রোহান একে অপরের দিকে তাকাল। আজ দুই বন্ধুরই আলোর প্রতি সন্মান’টা বেড়ে গেল।
ওরা ওর কাজে যতটা না অবাক হয়েছে তারচেয়ে শতগুনে খুশি হয়েছে। রোহান বলল,
“যে যেমন সঙ্গী’ও পায় তেমন।”
“তা ঠিক।”
তারপর ওরা’ও চলে গেল ওদের রুমে। ব্যাচেলার
বন্ধুরা এক রুমেই থাকবে। কী আর করার ওদের বউ নেই!

রোদ একবার আলোকে খুঁজতে এসে ওদের দেখে সরে গিয়েছিল। এবং আলো আর বন্ধুদের প্রতি ওর গর্ব’ও হলো।সত্যি বলতে, সু-সম্পর্ক গড়তে পবিত্র মন’ই যথেষ্ট। সব জায়গায় লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে নেই। আলো পারত, রোদেরগুলো ধুয়েই সরে যেতে। অথচ সে তা করে নি। ওর কষ্ট হবে জেনেও সব কাপড় ধুয়ে দিয়েছে। কারণ সে জানে, সর্বদা হাত চিৎ নয় উপুর করাও জানতে হয়। তবে’ই না সম্পর্কের শেকল মজবুত হয়।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৩৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

গভীর রাত! নিস্তব্ধ রজনীতে আঁধারের রাজত্ব।
আঁধার যেন পৃথিবীকে অন্ধকার করে’ই তৃপ্ত হয়। দূর আকাশের চাঁদটা মিটিমিটি আলো ছড়াচ্ছে। তারা নেই! মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। হয়তো মেঘের সাথে লুকোচুরির শখ জেগেছে; তাই চাঁদকে একা ফেলে’ই চলে গেছে।স্বার্থছাড়া সবাই অদৃশ্য! তারাদের মতো মানব জাতিই তার উদাহরণ!
কথায় আছে, রাত যত গভীর হয় পাপ তত বেড়ে যায়। অদ্ভুতভাবে, পাপ ঢাকতে মানুষ রাতকেই বেছে নেয়। কেন? এর উত্তর অজানা। তবে রাত নিকষ কালো বিধায় পাপকর্ম রাতকেই কলুষিত করে। যাতে আঁধারের মাঝে সব পাপ ঢাকা পড়ে যায়।ঘন জঙ্গল আঁধারে ভয়ংকর রুপ নিয়েছে। কেমন যেন শরীর শিউরে ওঠা অন্ধকার। আজ এখানে গড়ে ওঠেছে জঙ্গিদের আস্তানা।মশালের
আলোয় ওরা ফুত্তিতে মগ্ন। কারণ এক জঙ্গির ছেলে বয়সন্ধিকালে পা দিয়েছে।তাকে এখন বন্য শকূর শিকার ও নারীদেহের প্রতি উন্মোদনা বাড়াতে হবে। তাকে বুঝতে হবে, সে পুরুষ! আর পুরুষের তুষ্টিসাধন নারীর দেহে। এই খুশিতে ওরা বন্য শুকুরের পঁচা মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছে আর হইহল্লা করছে। পঁচা মাংস আগুনে পুড়ে বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই গন্ধে ওরা উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।একপাশে অর্ধনগ্ন মেয়েরা গল্প করে পরক্ষণে’ই খিলখিল করে হেসে উঠছে।যেন না হাসাটা ঘোর অপরাধ। অদূরে বসা পুরুষেরা ওদের কামনার দৃষ্টিতে দেখছে। পুরুষদের আকৃষ্ট করতে শকুরের কলিজার তৈরী জিনিসটা ঠোঁটে লাগাচ্ছে। যাকে বলে, বাক্যহীন আহ্বান! জিনিসটা দেখতে ঠিক
আচারের মতো হলেও গন্ধ’টা খুব’ই বিশ্রী।যুবতী মেয়েদের এমন কাজে মাঝবয়সী মহিলারা দূরে বসে হাসছেন। যেন এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।কেন করবে না? শরীরটা তো চাহিদা মিটানোর জন্যই।এমন অসুস্থ চিন্তা-ধারার মানুষ উনারা।
যদিও এদের প্রতিটা কর্মে বেহায়াপনা স্পষ্ট। যার মাত্রাও তারা অতিক্রম করে ফেলে। সেসব বলা সম্ভব না! এদের লাজ-লজ্জার বালাই নেই’ই। যা আছে, বেহায়াপনা, যৌনতা,আর নারীদেহের পিপাসা। এর মধ্যে একজন যুবক উঠে যুবতীর হাত ধরে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। আর বাকিরা খিলখিল করে হেসে বলল,

“ভোলের (ভোরের) আগে আছিছ।”
“আছ্ছা।”

মতি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে শুয়ে কাতর হয়ে কাতরাচ্ছে। ওর করুণ দশা! তার সহ্যশক্তি
যেন লোপ পেয়েছে। সে একটা সময় মেয়ে তুলে এনে ধর্ষণ করত। তাদের অমানবিক অত্যাচার করে প্রাণনাশ করত। অসহায় মেয়ের আতনার্দ ওর কাছে মধুর মনে হতো। সাথে ওর পুরুষত্বের জোর বৃদ্ধি পেতো। মেয়েরা যত ছটফট করত, সে হিংস্রতা তত বাড়িয়ে দিতো। নারীদেহ পেলে সে যেন হিংস্র জন্তুতে পরিণত হতো। তার না থাকত হুশ আর না দয়ামায়া! কত রকমভাবে কতশত মেয়েকে মেরেছে তার হিসাব নেই৷ করেই বা কী হবে? কার্যসিদ্ধি হলেই হলো। আর অন্যের কষ্ট অনুভব করা সময় তার কখনোই ছিল না। তবে সঙ্গমের সময় যে মেয়েদের রক্তক্ষরণ হতো না, তাকে সে বেশি কষ্ট দিয়ে মারত। সে ভাবত, এই মেয়ে সতী না। নিশ্চয়ই যেঁচে পুরুষের কাছে দেহ সপে দিয়েছিল।এসব মেয়েদের বাঁচার অধিকার নেই! এরাই পুরুষ জাতিকে বিনাশ করবে। এসব ভেবে সে মেয়েগুলোর জন্য নিজে শাস্তি নির্ধারণ করত। তন্মধ্যে একটা, গনধর্ষণ। এটাই উপযুক্ত শাস্তি! গণধর্ষণের ফলে রক্তক্ষরণে যতক্ষণ না মেয়েটা রক্তশূণ্য হয়ে মারা যাচ্ছে, ততক্ষণ ওরা থামত না। মেয়েগুলো সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু ভিক্ষা চাইত। চিৎকার করে কেঁদে মরার আঁকুতি মিনতি করত। ওদের কান্না দেখে মেয়েগুলোকে সে বেশি আঘাত করত।তবে এমনভাবে আঘাত করত, মরবে না তবে মরার মতো ছটফট করবে।

তখন মতি উৎফুল্লের সুরে বলত,
“আহা, ছুক (সুখ) মানেই বেডি’ল শলীল।”
ঘন্টা পেরিয়ে দিন আর দিন পেরিয়ে মাস। মাস পেরিয়ে বছরের আগমন। সময় বসে নেই। গুটি গুটি পায়ে চলতেই আছে। তেমনি মানুষের পাপ কর্মগুলোও। পাপের ঘরা পূর্ণ হলে পাপ মোচনের সময়ও এসে যায়। সঠিক সময়ে কার্যসিদ্ধি করে
প্রকৃতি সন্তোষপ্রদ। এটা প্রকৃতি আর পাপের এক অনবদ্য খেলা।এজন্য হয়তো আজ খেলার গুঁটি পাল্টেছে। ভুল চালে লন্ডভন্ড হয়েছে; জীবনের পাসা। এখন মতির না আছে গলার জোর আর না পুরুষত্বের! জঙ্গি মেয়েদের খপ্পরে শক্তি শেষ।
সে ছিল নারীর দেহের পাগল আর জঙ্গি মেয়েরা পুরুষের। দুই দল’ই কেউ কারো থেকে কম নয়।
এটা সভ্য সমাজের কাছে লজ্জার হলেও, ওদের কাছে নিছক একটা ব্যাপার।রোজ সন্ধ্যার পরপর প্রতি ঘন্টায় জঙ্গি মেয়েরা মতির কাছে আসে। ওকে উত্তেজিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। যখন লাভ হয় না, তখন প্রচুর মারে। মার খেয়ে মতি অবচেতনও হয়ে যায়। গত কয়েকদিন যাবত না খেয়ে থাকার ফলে ওর করুণ অবস্থা। মারের সাথে জঙ্গি মেয়েদের অমানবিক অত্যাচার।সে সহ্য শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া শক্তিশালী পুরুষে ক্ষেত্রেও প্রতি ঘন্টায় পনেরোজন মেয়েকে সামলাতে সম্ভব নয়। সামলাতে পারে না বলেই; মারের উপর মার। কেন পারবে না? সে তাহলে কেমন পুরুষ? এমন পুরুষ মরে যাওয়াই ভালো। এসব শুনে মতি ডুকরে পেরে কেঁদে উঠে, ওর যে পুরুষত্বের অহংকার শেষ। যে নারীকে সে পায়ে
মিশে মারত, সেই নারী জাতিই ওর দিকে আঙুল তুলছে। এরচেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? ছিঃ!

মতি এবার সঠিক জায়গায় এসে পড়েছে।সে তো ভুলে গিয়েছিল, বাবারও বাবা থাকে। এতদিন মেয়েদের ধর্ষণ করে প্রাণ নিতো। অথচ আজকে মেয়েদের কাছে’ই হার মানছে। শরীর, পুরুষত্ব, এবং যৌবনেরও ক্ষয় আছে। এই শরীরের জোর সারাজীবন এক থাকে না। একথাটা মতি ভুলেই গিয়েছিল। তবে হাস্যকর হলেও; এরা প্রায় সবাই মাত্রারিক্তভাবে যৌনসংগমে আসক্ত।আরএদের শরীর, মন, ও মস্তিষ্কজুড়ে যেন সর্বদা কামস্পৃহা ঘুরপাক খায়। এটা আদৌ মানসিক রোগ নাকি শয়তানী মনবাসনা, জানা নেই। মতিকে আজও মেরে, একটা মেয়ে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“এতাকে মেলে ফেলাই উছিত। ছালা’ল শলীলে ছক্তি’ই নাই।”
ওদের মধ্যে একজন গালে হাত দিয়ে আফসোস নিয়ে বলল,
“শহলের ওই ব্যাডাকে পছন্দ হইচিল আমাল। ইচ! ওলে পেলে খুব ভালো হতো লে।”
মেয়েটার কথা তার পাশের জন কিছু বুঝল না। সে কার কথা বলছে? এই অবধি শহরের অনেক ছেলেকে বলি হতে দেখেছে, ঘনিষ্ঠও হয়েছে। তাই সে বুঝতে না পেরে কৌতুহলবশত’ই জিজ্ঞাসা করল,
“কুন শহুলের ব্যাডা লে?”

“ওই যে ছুতু বাছুল’ও ছিল ছাতে। ওতা ওল ছুতু ভাই। ওলে বলি দেওয়াল কতাও চিলো, আমি কাচে গিচেছিলাম তাই বুমিও কলেছিল। বাছুরটা প্রেচ্ছাব করচিলো না তাই তুই মেলেওচিলি।ওই ব্যাডার কথা বলচি।”
“ওহ, এবাল বুজেচি।”
এই দু’জন এতক্ষণ রোদ’দের কথা বলছিল।ওরা সেদিন ভাগ্যগুনে বেঁচে গিয়েছিল। কারণ মেঘকে বলি দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে খবর এসেছিল, ওদের একজনকে বিষধর সাপে কামড়েছে। তার অবস্থা খুব খারাপ, সাপের বিষ শরীরে ছড়িয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে। আর ব্যাক্তিটা জঙ্গি প্রধানের ছোট ভাই। না গেলে পরে ওদেরকেই বলি হতে হবে। এজন্য মেঘের অর্ধ শরীর মাটিতে পুঁতে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলি সম্পূর্ন করার জন্য। আর জঙ্গি মেয়ের মুখে থুথু দেওয়ার জন্য রোদকে ওরা খুব মেরেছিল। রোদ ওদেরকে শরীরের স্পর্শ করতে দিচ্ছিল না, বার বার নড়ে চড়ে বাঁধা দিচ্ছিল।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা স্পর্শগুলো খুব অস্বস্তিকর।
সেটা ছেলে/মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে’ই।রোদের তখন ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছিল, মনে মনে আল্লাহর নাম জপে যাচ্ছিল। সে বার বার নড়ে ওদেরকে বলছিল,
“এমন করবেন না প্লিজ! কী পেলে ছাড়বেন? বলুন, আ আমি তাই দিবো।”
“তোল শলীল চাই আমাদেল।”

কথাটা বলে ওরা আবারও রোদের শরীরের সঙ্গে ঘেষে দাঁড়াল। কেউ ওর শরীরে হাত বুলাচ্ছে তো কেউ ঠোঁটে। পঁচা গন্ধে রোদ বমি করার আগেই ওরা সরে গেল। খালি পেটে বমিও আসছে না।
শুধু ইয়াক! ইয়াক! করছে। রোদের আচরণে ওরা রেগে শার্টের বোতাম খুলতে যাচ্ছিল।তখন স্থান ত্যাগের আদেশ আসল। উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পেরে একজন রেগে জোরপূর্বক রোদের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। রোদ ছটফট করলে স্বজোরে চুল আর বুকে খামচে ধরল। পরপর বেশ কয়েকজন একই কাজ করে সরে গেল। ততক্ষণে ব্রেণের খুব
চাপ পড়াতে রোদ অবচেতন হয়ে গেয়েছিল।সেই সাথে, এই দৃশ্যটা ওর মনে দাগ কেটে গেয়েছিল।
মেয়েটাকে আফসোস করতে দেখে নিজেও হতাশ হয়ে বলল,
“জীবনে পুথুম আমাদেল থেকে ব্যাডা মানুষ ছাল(ছাড়) পেলো। থাক, মুন খালাপ কলিস না।”
“ওই ব্যাডার ঠুট’টা অনেক বেছিই সুন্দল চিলো।এজন্য জোল কলে আগে ঠুটেই আদল কলতে গেচিলাম। আল ওই বাছুলটাও বলো(বড়) হলে ভাইয়েল মুতোনই হবে!”

“হুম।”
রোদকে ঘনিষ্ঠভাবে না পেয়ে দু’জনে আফসোস করতে থাকল। হঠাৎ ওদের চোখ গেলো মতির দিকে। একজন মাঝবয়সী মহিলা মতিকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করছে। তখন একজন পুরুষ উপস্থিত হয়ে বললেন,
“কী হয়েচে ওল?”
”মলে নি, হুছ নাই।”
“ওল আব্বা ওলে মেলে( মেরে) ফেলতে বলেচে। শুনেচি ধর্লণ(ধর্ষণ) কলা ওল নেছা।তাই আমি আমাদেল বেডিদেল জন্য ওলে এনেচি।”
একথা শুনে ওই মহিলা মতির পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“আমাদেল বেডিদেল মজা দিতে পালে না।এলে শেছ কলে দে।”
এসব বলতে বলতে উনারা স্থান ত্যাগ করলেন
।আর মতি ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে গেল। ওর বাবা ধরে আনতে বলেছ? কেন? নিজের ছেলের সঙ্গে এটা করতে পারল? কষ্ট হলো না, বিবেকে বাঁধল না? মতির একথা শুনে মস্তিষ্কে শূন্য লাগছে। অবশেষে এই ছিল ভাগ্যে? বাবার মন মতো চলতে গিয়েই সে অমানুষ হয়েছে, ধর্ষণ করেছে, পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, মায়েদের গায়ে হাত তুলেছে, বিশ্রীসব গালি শিখেছে।
ওর মা ওকে এসব করতে নিষেধ করেছিলেন, এসব পাপ এটাও বুঝিয়েছিলেন। একথা মতি বাবাকে বলে দিয়েছিল। তখন মাতবর ওর মাকে কাজের লোক দিয়ে গনধর্ষণ করিয়ে মেরে ছিলেন।উনার লাশ’টা কী করেছিলেন, জানা নেই! মতিকে এই বুঝিয়ে ছিলেন, ‘বেডি মানে পাপ।’

সে বাবার কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল।আর
তখন থেকেই ওর মনে মেয়েদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। মতি আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের হিসাব মিলাতে লাগল। হঠাৎ ওর মস্তিষ্কে একটা ঘটনা নাড়া দিলো। প্রথম যাকে ধর্ষণ করেছিল, তার বয়স ছিল মাত্র নয়। সঙ্গমের জন্য শরীরটা ছিল অপরিপক্ব। মতিও তখন আনাড়ি! অন্য বাবা’রা ছেলেকে ভালো কিছু শেখায়, আর ওর বাবা শিখিয়েছিল, ধর্ষণ করা। ধর্ষণের কষ্ট’টা কীভাবে দ্বিগুন বাড়ানো যায়? মাতবর ওকে এটা দেখিয়েছিলেন। মতি লজ্জা পেলেও কিছু বলে নি। বরং বাধ্য ছেলের মতো উপভোগ করেছিল। মেয়েটা অপরিপক্ব থাকায় মাতবর ব্রেড ব্যবহার করেছিলেন। মেয়েটা তখন আতনার্দ করে বাঁচার জন্য ছটফট করছিলো। তখন মাতবর ওর কাঁধ চাপড়ে হেসে বলেছিলেন,
“পুলুষ(পুরুষ) মানুছের মুনে দয়া-মায়া থাকতে নাই। কাপুলুষ’লা এই ছময় দয়া দেখায়। বেডি মানুছ যত ছতপত কলবে পুরুষ মানুছ’লা তত
খুছি হয়। তুই সু-পুলুষ হবি বাপ।শুন, খবলদার মুনে দয়া-মায়া আনবি না।”

মতির কানে এখন ওই কথাগুলোই শুধু প্রতিধ্বনি হচ্ছে। বাবার কথামতো এতদিন এসব করেছে।অথচ সেই বাবা ওকে মেরে ফেলতে বলেছে৷ এত কিছু করে ওর প্রাপ্তির খাতা শূন্য। মাতবর নিজে বাঁচতে ছেলেকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে। জঙ্গি এক মেয়েকে মাতবর উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এটা পরীক্ষা করতে; এই মেয়েদের কত দম।আর একথা জঙ্গি প্রধান জানার পর, মাতবরকে হত্যার হুকুম দিয়েছিলেন। রাতে জঙ্গিরা হত্যা করতে আসলে মাতবর নিজের দোষ ছেলের উপর চাপিয়ে বলেছিলেন,
” আমাল ব্যাডা এই কাজ কলেছে। ওলেই ধলে নিয়ে যান।”
এজন্য জঙ্গিরা মতিকে তুলে এনে বন্দি করেছে।
আর ওর পুরুষত্বের জোর দেখতে প্রতি ঘন্টায় অত্যাচার করছে। মতি আজ আফসোস করছে, খুব আফসোস! সে ঠকেছে; তাও বাবার কাছে।
আজকে ওর পাপবোধ আর অনুশোচনা হচ্ছে।
নিজের প্রতি খুব করুণাও হচ্ছে। এসবভেবে সে মনে মনে আওড়ালো,
“তুমালে আব্বা দাকতেও আমাল ঘৃণা লাকচে। কু্ব আপছোছ হচ্ছে, তুমাল লক্ত আমাল এই শলীলে, ছিঃ!”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৩৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

একসপ্তাহ পর,
মৃত্যু! প্রতিটা প্রাণীর জীবনে শুদ্ধতম সত্য। এটা অপ্রিয় হলেও গ্রহন করতে হবে।সৃষ্টি হলে বিনাশ অনিবার্য! মাতবর মারা গেছেন আজ তিনদিন।
মাতবরের শোকে গ্রামবাসীদের না হলো কষ্ট, না ঝড়ল একফোঁটা অশ্রু! তবে উনার চ্যালারা খুব
কেঁদেছে, যাকে বলে কুমিরের কান্না! ছোট্ট রবি, বাবাকে কাফনে মোড়া দেখে ভয়ে কাছে যায় নি। মাতবরের সহধর্মিণীরা জীবন্ত লাশের মতো চুপ করে দেখছেন। মতি তো নিঁখোজ! এজন্য সকল
গ্রামবাসীরাই মাতবরের দাফন সম্পূর্ণ করলেন। তবে উনাকে শেষ গোসল করানো হয় নি। উনার শরীর ধরা যাচ্ছিল না, মাংস খসে যাচ্ছিল।সেই মাংসে পোকা কিলবিল করে বেরিয়ে আসছিল। এজন্য গোসল না করিয়ে দাফন করা হয়েছে।
যখন প্রাণ ছিল, তখন মাটিতে বসতেন না।পঁচা বা বাসি খাবার খেতেন না। শরীরে শক্তির জন্য কত কিছুই না করতেন অথচ আজ সব বিফলে।
সবার শরীরে মাটির নিচে পঁচন ধরে আর উনার মাটির উপরেই! অত্যাচার, পাপকর্ম, হিংস্রতা, লোভ, নেশা, কোনোকিছু করতেই কমতি রাখেন নি। পাপের ঘরা পূর্ণ করেই বিদায় নিলেন।শূন্য হাতে এসে শূন্য হাতেই ফিরে গেলেন। নির্ধারিত সময়টুকুতে পাপের সাগরে নিজে ডুবলেন, সাথে ছেলেকেও ডুবালেন। অদ্ভুত মানুষ এবং তাদের চিন্তা-ভাবনা!

পৃথিবীটা হলো রহস্য ক্ষেত্র। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রহস্যের বেড়াজালে বিশাল এক রহস্যের সৃষ্টি। রহস্যের এই খেলায় প্রকৃতিও আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে।তেমনি মাতবরের মৃত্যুও! উনার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। উনি স্বাভাবিভাবে মরেন নি, মেরে ফেলা হয়েছে। আর এই কাজে জড়িত সহধর্মিণীগণ।
খাবারের সাথে এক ধরনের বিষাক্ত পাতার রস খাইয়েছিলেন। ফলস্বরূপ অস্বাভাবিকভাবে রক্ত চলাচল বেড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান।
অসুস্থ অবস্থাতেও মাতবর উনাদের অত্যাচার করতেন। নিজে মারতে না পেরে চ্যালাদের হুকুম দিতেন। উনাদের ধৈর্য্য সীমাও অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। এজন্য দেহ আর মনে কিঞ্চিৎ শান্তির জন্য একাজ করেছিলেন।এবার উনারাও বাঁচার মতো বাঁচবেন। তার আগে এখানকার মানুষদের মুক্ত করবেন।কুৎসিত নিয়ম-কানুনের রীতি বন্ধ করবেন। রীতির নামে পাপকর্ম এবং পাপীদেরও বিনাশ করবেন। সুন্দর এই পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার সবার আছে৷ সবাই
সুস্থ একটা পরিবেশ চায়। নিরাপত্তা আর স্বপ্ন পূরণের সুযোগ চায়। মাতবরের ক্ষমতা ব্যবহার করে উনারা এসব করবেন। পাপকর্মকে ঢেকে সৎ কর্মের আবির্ভাব করবেন। ক্ষমতা এমন একটা জিনিস, সময়াসাপেক্ষে মানুষকেও অমানুষ করে তোলে। ক্ষমতার জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।

এখন না আছে মাতবর; না মতি! এই ক্ষমতা অন্যজনকে দিলে আরেকটা মাতবর গড়ে ওঠার সম্ভবনা বেশি। তাই ক্ষমতা নিজেরা নিয়ে গ্রাম পরিচালনা করবেন। যে গ্রামে মেয়ে মানে পাপ, সে গ্রামে মেয়েরাই নতুন ভাবে সব গড়ে তুলবেন৷
সকল পাপকে মাটি চাপা দিয়ে সৎকর্মের সূর্য উদয় করবেন। এখন উনারাই হবেন; এই গ্রাম পরিচালিতা।
মাতবরের ক্ষমতা নিয়ে মতবিরোধ হলেও উনারা কঠোর হয়ে সামলে নিয়েছেন। উনারা চারজন নতুনভাবে নিজেদের তৈরীও করেছেন। উনাদের চোখের মণি রবি। ছোট্ট রবিকে উনারা মানুষের মতো মানুষ করবেন। নারী হচ্ছে, ভাঙ্গা গড়ার কারিগর। এক নারী ভাঙ্গে তো আরেক নারী নিঁখুতভাবে গড়ে। তেমনি এক পুরুষে কলুষিত করে তো এক নারী পাপমোচন করে। এটাও যে
সৃষ্টিকর্তার নিদারুণ এক খেলা!

দাদীমার বাড়ির উপর থেকে কাল মাটি সরানো হয়েছিল। খাট, জিনিসপত্র, সরাতে গিয়ে একটা গর্ত পাওয়া গেছে। সেই গর্ত খুঁড়ে টাকাও পাওয়া গেছে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ লাখ টাকা! সব টাকা গ্রাম পরিচালিকাদের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। সবার মুখে মুখে একই কথা, দাদীমা এত টাকা কোথায় পেয়েছে? কার টাকা? এখানে কীভাবে আসল? টাকাগুলো দিয়েই বা কী করা যায়?
শেষের প্রশ্নের উত্তর গ্রাম পরিচালিকারা ঘোষণা করবেন। এজন্য আজ সবাই বড় মাঠে উপস্থিত হয়েছেন,চার পরিচালিকা নিজেদের শরীর পর্দায় ঢেকে আসন গ্রহন করলেন। গ্রামবাসী উনাদের সুন্দর একটা নাম দিয়েছেন, শুভাননা।যার অর্থ সুন্দর ও শুভপ্রদ অবয়ববিশিষ্ট সাহায্যকারী।এই এক নামেই উনাদের চারজনকে ডাকা হবে।আর গ্রামবাসী সবাই অশিক্ষিত নন, কেউ কেউ দূরের স্কুলে শিক্ষকতাও করেন। এক শিক্ষকই উনাদের এই নামকরণ করেছেন। তো বিচার শুরুর আগে শুভাননা’রা সবার বক্তব্য শুনে নিলেন।অনেকে
সাহায্য প্রার্থণা করলেন, তো কেউ সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে বললেন। সব শুনে শুভাননা’রা নিজেরা আলোচনা করে বললেন,

”আলো কুথায় আমলা জানি না। ছে আছবে নাকি তাও জানি না। তাই তাকাগুলো গেলামের কাজে লাগাব।”
গ্রামবাসী একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, পরের বাক্য শোনার অপেক্ষা করল। তখন উনি আবার বললেন,
“একতা স্কুল, মছজিদ, হাকিমেল দুকান, আল একটা বাজাল কলব। যাতে পলাশুনা, নামাজ, চিকিৎছা, আল দলকারী জিনিছপত্র কিনা-বেচা কলতে পারেন। শহুলেও নিয়া যাবেন, এখানেও বেছবেন। তাহলে অন্যদেল কিনতে আল শহুলে যাওয়া লাগব না।”
উনার এই প্রস্তাবটা গ্রামবাসীর খুব পছন্দ হলো।
এমন হল খুব ভালো হবে৷ হাকিমের দোকানটা হলে, সবাই সেখানে যাবে৷ হাকিমকে গ্রাম-গ্রাম ছুটে বেড়াতে হবে না। সাথে কয়েকজন উনাকে সাহায্য করবে এবং দেখে দেখে চিকিৎসা করাটা
শিখেও নিবে। যাতে হাকিমের অবর্তমানে ওরা সেবা করতে পারে। স্কুলটাও খুব দরকার, শিক্ষা মানে জানা, বোঝা এবং কাজে লাগানো। যত জানবে তত এর মর্ম বুঝবে ও ধীরে ধীরে কাজে লাগাবে। শুভাননাগণ বাড়িতে ভেবে-চিন্তে সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।এই গ্রামের যেগুলোর দরকার উনারা যেগুলো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যখন কারোর সৎকর্মের মনোবাসনা সৃষ্টি হয়,অনেক সময় অর্থের জন্য সেটা আটকে যায়। সেই মনোবাসনা যদি অটল থাকে, তাহলে
আজ অথবা কাল সৃষ্টিকর্তা একটা পথ দেখিয়ে দেন। দাদীমার বাড়ি থেকে এত্তগুলো টাকা পাবে এটা কল্পনাতীত। সৃষ্টিকর্তা ঠিকই শুভাননাদের একটা পথ খুলে দিলেন। কারণ তাদের চাওয়া ছিল; শুদ্ধ এবং অটল। উনারা এখানকার এক শিক্ষককে দিয়ে টাকা ভাগ করালেন, স্কুল, মসজিদ, দোকান আর বাজারের জন্য। এসব কাজ সম্পূর্ণ করতে শুভাননাদের হিসাব বুঝিয়ে টাকা নিতে হবে। একজন শিক্ষিত এবং বিশ্বস্ত
মানুষকে দিয়েই এসব কাজ করানো হবে। আর এই কাজ শুরু হবে আগামীকাল থেকে।

আজ শুক্রবার! শরীরে এনার্জি লোড নেওয়ার দিন।আহা! ঘুম আর ঘুম! সারাদিন ঘুমিয়ে পার করলেও মন্দ হয় না। আজ সকল ব্যস্ততা থেকে মুক্তি। শান্তি! শান্তি আর শান্তি! শান্তিতে আজ ছড়াছড়ি! এজন্য’ই রোদ আর মেঘ ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু সকাল নয়টার দিকে, আলো ওদের জোর করে টেনে তুলে নাস্তা করাল। ওমা, এটা কেমন অত্যাচার?তাছাড়া ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো বিরাট অপরাধ। একথা আলোকে কে বুঝাবে? সে তো
ওদের ঘুমের জান কবজ করে ফেলেছে।গতরাতে দুই ভাই বাজি ধরে গেম খেলেছে। আর এখন ভুশভুশ করে ঘুমানোর ফন্দি এঁটেছে।ওরা জানে আজ শুক্রবার! কোনো কাজ নাই; সারাটাদিন ঘুমাবে। কিন্তু হলো কই! দুজনের কারোর’ই ঘুম পুরো হয় নি। মেঘ দাঁড়িয়ে দেওয়ালে মাথা রেখে হা করে ঘুমাচ্ছে। কারণ ওর ঘুম’ই জীবন, ঘুম’ই মরণ। এছাড়া জীবনে শান্তির কী বা আছে? ঘুম তো ঘুম’ই; দাঁড়িয়ে বা বসে। এদিকে রোদ বিরক্ত হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছে। আগে একটু-আধটু ভয় পেলেও, এখন ভয়ের ছিঁটেফোঁটাও নেই। ওর
সুখের দিনগুলো যে কই গেল? এসব ভেবে রোদ চোখ বন্ধ করতেই আলো খোঁচা মেরে বলল,
“এই! এই চোখ খুলুন বলছি।পানি দিলাম, এই দিচ্ছি কিন্তু।”
“একটু প্লিজ।”
“একটু না, এক কোণাও না, একফোঁটাও না। কী হলো, উঠুন!”

একথা বলে আলো ভেজা টাওয়াল দিয়ে ওদের মুখ মুছিয়ে চুলে চিরুণী করে দিলো।এতে ওদের
ঘুম হালকা হয়ে গেল। বিরক্ত হলেও কেউ কিছু বলল না। দু’জনের মুখ দেখে আলো হেসে চুল কাটতে পাঠাল। মেঘ আলোর গালে আদর দিয়ে বলল,
“যাচ্ছি বউমনি!”
রোদও একই রকমভাবে আদর দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“যাচ্ছি বউ!”
একথা বলে দু’জনে বিদায় নিয়ে চলে গেল।আর আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়া দেখল।
চতুর মানুষরা সুযোগ লুফে নিতে জানে; যেমন রোদ! এই মানুষটা যে এত ফাজিল বিয়ের আগে বুঝে নি। আজকাল হুট করে এসে আদর দিয়ে উধাও! সে কিছু বুঝেতে উঠতেও পারে না।এসব ভেবে আলো লাজুক হেসে রান্নাঘরে চলে গেল।
রাকা দুই সপ্তাহের ছুটিতে বাড়িতে গেছে। ওর বড় বোনের বাবু হয়েছে, তাই দেখতে। রান্নাঘরে গিয়ে আলো দুপুরের আয়োজন করতে লাগল। রবি আর সাগরকে নারকেলসহ কিছু জিনিস আনতে পাঠিয়ে। রান্না প্রায় শেষের দিকে তখন দুই ভাই ফিরে এলো। মেঘের হাতে দু’টো আইসক্রিম।সে রান্নাঘরে পা ঝুলিয়ে বসে আইসক্রিম আলোর মুখে ধরল। আলো এক কামড় নিতেই রোদ ছো মেরে নিয়ে চলে গেল। মেঘ তখন রেগে চিৎকার করে বলল,
“দাভাই, তুমি একটা ইয়ে।”
” কী য়ে?
“তুমি একটা, তুমি একটা, হ্যাঁ তুমি একটা জীবাণু।”
“তোরা হচ্ছিস ব্যাঙ, সারাদিন করিস ঘ্যাঙর, ঘ্যাঙ!”

কথাটা বলে রোদ হাসতে হাসতে চলে গেল।আর
মেঘ হেরে গিয়ে করুণ চোখে তাকাল। ওই দু’টো আইসক্রিমের বেশির ভাগ মেঘ’ই খেয়ে নিতো।
তারপর গোসল দিলে নির্ঘাত ওর ঠান্ডা লাগত।
এজন্য রোদ একটা নিয়ে চলে গেল। বাকি’টা দু’জনে ভাগ করে খাবে। সত্যিই ওটা ওরা দু’জন ভাগ করে খেলো। তারপর আলো দুইপিস মাংস তুলে দিয়ে বলল,
“মেঘবাবু লবণ হয়েছে নাকি দেখো তো?”
“আচ্ছা।”
ছোটরা এমন কিছু দায়িত্ব পেলে কেন জানি খুব খুশি হয়। মেঘও হলো! পা দুলিয়ে ফুঁ দিয়ে একটু একটু করে মাংস দু’টো খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর ওর মনে হলো, লবণ হয়েছে নাকি খেয়াল করা হয় নি। তাই সে আমতা আমতা করে বলল,
“বউমনি, মাত্র দু’টো মাংসতে লবণ বোঝা গেল না। আরো দু’টো দাও।”
আলো হাসি চেপে রেখে আরো দু’টো মাংস তুলে দিলো। মেঘ খেয়ে কিছুই বুঝতে না পেরে বলল,
“লবণ কীভাবে দেখব?”
আলো এবার হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে গেল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬

দুষ্টুটা প্রতিবার’ই তাই করে। বউমনিকে হাসতে হেসে মেঘও হাসল। বউমনি হাসলে ওর খুশি লাগে। আলো চুলা বন্ধ করে ওকে নিয়ে উপরে চলে গেল। তারপর দ্রুত গোসল সেরে নামাজের জন্য রেডি হতে বলল। আর সে ওদের পান্জাবি বের করে বিছানার উপর রাখল। দু’জনকে মসজিদে পাঠিয়ে নিজেও গোসল সেরে নামাজ পড়ে নিলো। দুপুরে খেয়ে তিন’জনে ঘুম দিলো। বিকালে দুষ্টুমি, খুনশুটিতে সময় কেটে রাত নেমে এলো। আলো আর মেঘ যার যার পড়া সম্পূর্ণ করে রাতে খেয়ে নিলো। এদিকে মেঘ ওর রুমে গেম খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে গেছে। রোদ তখন মেঘের পাশে আধশোয়া হয়ে কাজ করছিল।মেঘ ঘুমাচ্ছে দেখে ওকে সুন্দর করে শুইয়ে, সে উঠে দাঁড়াল! মেঘের যে রুমে মন চায় তখন সে রুমে ঘুমায়। ওর জন্য সব রুম উন্মুক্ত। আর এদিকে, আলো সব গুছিয়ে এসে চুল আঁচড়াতে বসেছে। অবশেষে চুলের জট খুলতে না পেরে খোঁপা করে নিলো। জট খোলার ধৈর্য্য এখন নেই। সে উঠে মেঘের রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে রোদের সাথে ধাক্কা খেলো। রোদকে কিছু বলতে না দিয়ে আলো মেঘকে দেখে আসল। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে বেরিয়ে আসল। উঠাতে গিয়ে দুষ্টুটার ঘুম ভাংলে আর ঘুমাবে না, তাই কেউ’ই উঠাল না।
ওদের রুমের দরজা খোলা থাকে, ঘুম ভাংলে সে ওই রুমে চলে যাবে। রোদ ওর দাভাইয়ের দায়িত্ব পালন করল আর সে বউমনির! দুষ্টটা যে ওদের প্রাণ ভোমরা। আলো ফ্রেশ হয়ে চুপ করে রোদের পাশে শুয়ে পড়ল।রোদ এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে বলল,

“পারমিশন কবে পাবো?”
“কীসের?”
রোদ প্রত্যুত্তর না করে ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হাসল। আলো উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। রোদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল,
“পরবা?”
” কি?”
রোদ এবার একটু কাছে এসে আদুরে সুরে বলল,
“আদরের গয়না।”
রোদের কথায় আলো না বোধক মাথা নাড়িয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে নিলো৷ আর রোদ শব্দ করে হেসে উঠল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪০+৪১+৪২