এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪০+৪১+৪২

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪০+৪১+৪২
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ইচ্ছেশক্তি মানুষের বাঁচার সম্ভবনা বাড়ায়। কিন্তু ইচ্ছেশক্তি হারিয়ে ফেললে প্রতিটা লড়াই কঠিন হয়ে যায়! তেমনি মতি বাঁচার ইচ্ছেশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষমতা, জোর, পুরুষত্ব, অহংকার সব ওর ফিকে মনে হচ্ছে। এত সুন্দর শরীরটাও যেন অপ্রয়োজনীয় এক বোঝা! গতরাতে জঙ্গিরা ওকে অবচেতন দেখে ফেলে গিয়েছিল। ওর অর্ধমৃত শরীর টানার ইচ্ছে ওদের ছিল না। তাই যাওয়ার আগে প্রচুর মেরে রাগ তুলে ফেলে গেছে! এই সুযোগে মতি পালিয়ে বাঁচতে পারত; অথচ সেটা করে নি। জীবনের যুদ্ধ হেরে আপনজনের থেকে ঠকে নিজের প্রতিই করুণা হচ্ছে ওর। রোদের কড়া তাপে কিছুক্ষণ হলো ওর জ্ঞান ফিরেছে। সে অনেক কষ্টে উঠে পাহাড়ের কিনারে দাঁড়াল।মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না সে। এত পাপ নিয়ে আদৌও বাঁচা যায়? এতদিন অনুভব করে নি বিধায় অনুশোচনা হয় নি। কিন্তু এখন যে নিজের প্রতিই ঘৃণা হচ্ছে।পুরো মস্তিষ্কে মৃত্যু নামক শব্দটা জায়গা দখল করেছে। মতি চোখ বন্ধ করে ওর পাপের কথাগুলো চিন্তা করল। তাৎক্ষণিক চোখের সামনে ভেসে উঠল, কতশত মেয়ের আতনার্দ, রক্ত, আর ওর আপন মায়ের মুখখানা! মা, ওর মা! উনার মৃত্যুর জন্য সেও দায়ী ছিল। এই পাপ কী দিয়ে মুছছে সে? আদৌ মোছা যাবে? হয়তো না! জীবন তাকে চরমভাবে ঠকিয়েছে।পাপে ডুবে সে পাপিষ্ঠের রুপ নিয়েছে। এসব ভেবে সে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে বুক চাপড়ে আকাশের দিকে তাকাল। দম আটকে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মতি হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কেঁদে কেঁদে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইল। ওর প্রতিটা কর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো। ওর মা কে ব্যাকুল হয়ে ফিরে আসতে অনুরোধ করল।

মেয়েগুলোর সাথে করা অমানবিক অন্যায়ের জন্য নিজেকে প্রচন্ড আঘাত করল। তাদের কষ্ট সে অনুভব করতে পেরেছে। ওর অশ্রুতে আজ ছলনা নেই; তবে যা আছে শুধু অনুতাপ আর পাপবোধ! ওর কান্না, পাহাড়, আকাশ, পাথর, মাটি গাছপালা, এবং নামহীন পাখি সাক্ষী হয়ে রইল। ওর বলা কথাগুলো পাহাড়ে প্রতিধ্বণি হয়ে ফিরে আসল। সে পাগলের মতো চিৎকার করে ওর পাপকর্মের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে। হঠাৎ মতি ওর বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে সেখানেই লুটিয়ে পড়ল। গলাটা তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে।একটু পানি পেলে ভালো হতো। এত কষ্ট হচ্ছে কেন? মতি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে অপষ্টভাবে উচ্চারণ করল,
-“মা, মা গো, মাফ কলো মা! আমি মেলা পাপ কলেছি। ওহ্ আল্লাহ তোমাল এই পাপী বান্দালে মাফ কলো। ”
এসব বলে মতি ছটফট করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল! সে সত্যিই না ফেরার দেশে পাড়ি দিলো।
সৃষ্টিকর্তা ওকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সকল পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে মৃত্যু বরণ করল
সে।মায়ের অশ্রুতে নাকি আল্লাহর আঁরশ কেঁপে ওঠে। তো মৃত্যুপথচারী এক মায়ের শেষ সময়ের চাওয়াটুকু ছিল,
-”আল্লাহ, আল্লাহ গো আমাল পাগল ব্যাডাকে ছঠিকতা বুঝাল তৌফিক দান কলো মাবুদ।ওলে মলাল(মরার) আগে ক্ষমা চাওলার সুযোগটুকু দিও লহমানীর লহীম। ওল সহজ মৃত্যু দিও লে মাবুদ। আমি ওলে তোমাল ভলছাতে লেখে গেলাম মাবুদ। এই অভাগী মায়েল এ দোয়াতুকু কবুল কলো, গো আল্লাহ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মতির মায়ের এই চাওয়াটুকু সৃষ্টিকর্তা রেখেছেন।
আমাদের সৃষ্টিকর্তা এতটাও কঠোর নন। সমুদ্রের পানির সমান পাপ করে মাফ চাইলেও উনি মাফ করে দিবেন। তবে মাফ চাওয়ার মতোনই চাইতে হবে। ওর মায়ের কথাটা মতির অজানায় থেকে যাবে। ওর মায়ের দোয়া আর সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণায় সে মূল্যবান সুযোগটুকু পেয়েছে। মা, ছোট্ট একটা শব্দ হলেও ব্যাপ্তিটা বিশাল। যেটা কারো সঙ্গে তুলনা করে চলে না। কী আশ্চর্য! আত্মহত্যা করতে এসে মতি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করল। এটা ছিল, সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত মতির জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত চমক! উনি চাইলে কত কী’ই না পারেন। মা অর্থাৎ মমতাময়ী এজন্য এতকিছুর পরেও দোয়া করে গিয়েছেন। সন্তান খারাপ যতই খারাপ হোক মা কখনো মুখ ফিরাতে পারেন না। মতির মা’ও পারেন নি।অবশেষে মায়ের দোয়া ও সৃষ্টিকর্তার রহমত ওর উপরে ছিল। ওর মৃত্যুটা স্বাভাবিক পাপকর্মের হিসাব তাকে দিতেই হবে। এটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এর থেকে কারো ছাড় নেই! পাহাড়ের কিনারে থাকা মতির দেহটা হঠাৎ গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। উঁচু পাহাড় থেকে সেটা পড়ল, বড় এক পাথরের উপর। সাথে
সাথে ওর দেহটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাথার খুলি ভেঙে মগজ বেরিয়ে গেল৷ওর দেহটা হয়তো
এখানেই পঁচে গলতে শুরু করবে। রক্তের গন্ধে বন্য প্রাণীদের ছুঁটে এসে খাদ্য বানাবে, কতশত পাখিরা ঠুকরে খাবে ওর দেহটাকে। পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। প্রবাদ’টার জলজ্যান্ত প্রমান
মাতবর আর মতির শেষ পরিণতি। অবশেষে পাপ এবং পাপিষ্ঠের বিনাশ।

শুভাননা’রা একদল লোকের সাথে আলোচনায় বসেছেন। উনারা দীদামার টাকার ভাগ চাচ্ছেন।
দাদীমা নাকি উনাদের দলের লিডার ছিলেন।আর উনি অনেকদিন ধরে নেশাদ্রব্য পাচারের কাজে যুক্ত ছিলেন। পর্যটকদের ভয় দেখি বিভিন্ন জেলায় সেসব পাচার করতেন। গোপনে লোকও পাঠাতেন। উনি এতটাই হিংস্র ছিলেন, না শব্দ শুনতেন না। উনার মুখ্য কথা ছিল, ‘করো নয়তো মরো।’ কেউ রাজি না হলে সত্যি সত্যিই তাকে মেরে ফেলতেন।উনার স্বামী মারা যাওয়ার পর, আপনজনদের থেকে লাঞ্ছিত হয়ে উনার মনে জেদের সৃষ্টি হয়েছিল।মন ও মস্তিষ্কে কথাটা ডুকে গিয়েছিল, টাকায় সব। আর টাকা থাকলে সব হাতের মুঠোয়, মান-সন্মান, সমাজ, কদর, এবং আপনজনরাও। আর গার্মেন্টের কর্মী হলে দু’বেলা খাবার ছাড়া কিছু পাবেন না। উনার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। বর্তমান যুগে সৎ মানুষের ভাত নাই। সেখানে মেয়ে হলে খুবলে খেতে কেউ দ্বিধাও করবে না। এজন্য ঢাকায় থাকাকালীন’ই উনি এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।তারপর এখানে এসে লোকচক্ষুর আড়ালে এসব করতেন। আর এই টাকা ছাড়াও উনার অনেক টাকাও ছিলো। তবে এর হদিস কেউ জানে না।

এছাড়াও এখানে আরেকটা চক্র’ও তৈরী হয়েছে, গোপনে এবং সতর্কতার সাথে! বিগত চারবছর ধরে এসব চলছে। যদিও এসব এখনো কেউ টের পায় নি। এখানে জঙ্গি আর জংলী দু’টো দল’ই মিশে আছে। আত্মগোপন করতে জঙ্গিরা জংলী রুপ নিয়েছে। পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে এরা বাস করে। আর রাত হলে বেহায়াপনাতে মেতে ওঠে।
জংলীদের সাথে থেকে জঙ্গিরাও এমন হিংস্র হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে ওরা ছিল ছদ্মবেশী। কিন্তু জংলীদের সাথে থেকে জীবন যাত্রা, খাদ্যাভাসা, বেশভূষা সবকিছু বদলে ফেলেছে। তবে জংলীরা এমনিতেই খুব ভয়ানক। ওদের চিন্তা-ভাবনাও কুৎসিত। জঙ্গিদের সঙ্গ দিতে ওরা এর ফায়দাও উঠিয়েছে। প্রথম প্রথম জঙ্গিরা জংলীদের কথা শুনত না, তখন জংলী জঙ্গিদের মারতেও দ্বিধা করে নি। এজন্য অনেক জঙ্গিকে প্রাণও দিতে হয়েছে। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে দুই দল’ই মিশে গেছে। এখন জংলী আর জঙ্গিকে আলাদা করা মুশকিল। ওরা এমনভাবে জাল বিছিয়েছে এখন অবধি কেউ টের পায় নি। আর সুযোগে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
জংলী ; যারা অসভ্যতার যুগের মতোন জীবন যাপন করে। তাদের পোশাক, অর্ধনগ্ন বা পশুর চামড়া/পাতা! পছন্দের খাবার পঁচা মাংস, শূকর, এবং বন্য প্রাণী।
জঙ্গি; যারা সভ্য সমাজের আড়ালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

(বিঃদ্রঃ- আশা করি বুঝেছেন জঙ্গি শব্দটা কেন ব্যবহার করেছি। আর কিছু জানার থাকলে কমেন্টে বলবেন।)
তবে জংলীদের সংখ্যা বেশি থাকায় ওদের দাপট বেশি ছিল। ওরা যা বলতো তাই করতে হতো।তা নাহলে মেরে ফেলত। এজন্য জঙ্গিরাও গোপনে একটা কৌশল অবলম্বন করল। ওরা জংলীদের ইয়াবা সেবনে আসক্ত করল। ফলে, জংলীদের ছেলে/মেয়ে সবার যৌনস্পৃহা বেড়ে গেল। ওদের মস্তিষ্ক, মন ও দেহে যৌনচিন্তা প্রখরভাবে গেঁথেও গেল। ওর ধীরে ধীরে এটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে
লাগল। এছাড়াও, জঙ্গি ওদের এলএসডি নামক নেশা করিয়েছে। ইয়াবা বাড়ায় প্রচুর যৌনস্পৃহা আর এলএসডি বাড়ায় হিংস্রতা। এমনও হয়েছে অন্যকে বলি দিতে গিয়ে নিজের গলাতেই কোপ বসিয়েছে। এই কাজ অনেকজন করেছে। এভাবে জংলীদের সংখ্যাও তারা কমিয়েছে এবং এসব দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ নেশাদ্রব্য বন্ধ করাতে জংলীরা কেমন পাগল হয়ে যাচ্ছিল।কী হচ্ছে? শরীরে কিছু চাচ্ছে কিন্তু কী? তারা বুঝতে পারত না। আর এই রাগ তুলত,পাহাড়ে ঘুরতে আসা মানুষগুলোকে ধরে। নিমর্মভাবে তাদের
মারত। নেশাদ্রব্য না পাওয়াতে জংলীরা অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। এদের পেছনে অযথা টাকা নষ্ট করে লাভ নেই। তাই জঙ্গিরা ওদের মরতে দেখেও দেয় নি। বরং গোপনে খুব মজা নিয়েছে।

তবে দাদীমা এসবে জড়িত ছিলেন না, উনি শুধু জঙ্গিদের নেশাদ্রব্য পৌঁছে দিতেন। আর মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন! এসব শুনে শুভাননাগণ একে-অপরের দিকে তাকালেন। কার মনে কী থাকে ধরাও যায় না। দাদীমা এসব করতেন এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।লোকগুলো পুনরায় টাকা দেওয়ার জন্য উনাদের তাড়া দিতে লাগলেন।
তখন শুভাননাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড় উনি বললেন,
“তাকাগুলো তো আমাদেল কাছে নেই। আমলা ওগুলো কাজে লাগিয়ে ফেলেচি। বিছাছ না হলে, এই বালিটা (বাড়িটা) খুঁজে দেকেন।”
একথা শুনে লোকগুলো দ্রুত উঠে তন্নতন্ন করে সব জায়গা খুঁজল।কিন্তু পেলো না! চেচাঁমেচিও করা যাবে না। গ্রামবাসী জেনে গেলে, ব্যাপারটা
সুখকর হবে না। লোকগুলো টাকা না পেয়ে রেগে বললেন,

“একথা যেন পাঁচকান না হয়! হলে খুব খারাপ হবে। আপনারা আপনাদের কাজ করুন, আর আমাদেরটা আমরা। কেউ কারো কাজে বাঁধা হবো না। আর এখন থেকে আমরা কেউ কাউকে চিনি না। ভালো থাকবেন আর এই কথাগুলো মনে রাখবেন।”
এদের সাথে লড়তে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কারণ এতে ক্ষতি ছাড়া কিছুই হবে না।তাই উনারা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন।অর্থাৎ তাই হবে! তারপর লোকগুলো আশেপাশে চোখ বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করল। এই টাকা কত আসবে যাবে, ত্রিশ লাখ’ই তো। আর টাকাগুলো সত্যিই বাড়িতে নেই। ওই শিক্ষকের বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখা হয়েছে। শুভাননাগণ আন্দাজ করেছিলেন
এমনকিছু হতে পারে। তাই আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। মাতবরের কার্যক্রম উনাদের স্বচক্ষে দেখা, তাই হয়তো সহজে সতর্ক হয়েছিলেন।তবে লোকগুলোর কথা উনারা নিজেদের মধ্যেই চেপে গেলেন।এসব গ্রামবাসীকে জানানো মানে বিপদ ডেকে আনা। আর দাদীমার টাকা উপার্জনের পথটা হয়তো অসৎ, কিন্তু টাকাগুলো? টাকা কী বুঝে, সৎ আর অসৎের পার্থক্য!তবে টাকাগুলো এবার ভালো কাজে লাগানো হবে। এতে যদি গ্রামবাসীর উপকার হয় তাতে মন্দ কী!

মাত্র দুইদিন পর আলোর কলেজে পরীক্ষা। ওর দিনের অর্ধভাগ পড়াশোনাতেই কেটে যায়।তবে মেঘের কোনো কাজে হেলা করে না। বরং দায়িত্ব পালনে অটল থাকে। রাকা নেই, রান্নাগুলো ওর করা লাগছে। আলো দুপুরের রান্না করছে আর সুযোগ বুঝে বইয়ের চোখ বুলিয়ে বিরবির করে পড়ছে। রোদ কয়েকবার এসেছিল, ওকে সাহায্য করতে এবং বলেছেও বাইরে থেকে নাহয় খাবার আনবে। আলো শুনে নি! সে পাহাড়ি এলাকার পরিশ্রমী মেয়ে; আদরের আহ্লাদী না।এত সহজে হাল ছাড়বে না। তাছাড়া এখানে কষ্টের কাজ’ই তো নেই। এই কাজটুকু সামলানো কষ্টকরও নয়, বরং আনন্দের। কারণ নিজের সংসারের কাজ। একটুপরে মেঘ স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলো। তারপর ব্যাট হাতে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“বউমনি, আমি একটু খেলতে গেলাম।”
“রোদের মধ্যে খেলবে না, শরীর খারাপ হবে।”
”আচ্ছা।”

মেঘ নাচতে নাচতে খেলতে চলে গেল। বড়দের সাথে আজকে খেলা হবে। বড় বলতে, ওর এক ক্লাস বড় ভাইদের সঙ্গে। রোদ সারাদিন বাসায় বসে অফিসের কাজগুলো করছে। মেঘকে ওর কাছে আসতে না দেখে রোদই নিচে গেল। মেঘ নেই! তারমানে খেলতে চলে গেছে তাকে দরকার নেই, তার বউমনি তো আছেই। রোদ রান্নাঘরে গিয়ে পকেটে হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, আলোর ঘামার্ত নাকটা ওর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে বলল,
”শুনেচি, মেয়েদেল নাক গামলে নাকি ছামী’লা খুব ভালুবাছে।তাইলে, তোমাল ছামী কী তুমাকে ভালুবাছে আলো?”
রোদ পাহাড়িদের মতো করে সুর টেনে কথাগুলো বলল। এই ছেলের মধ্যে ফাজিলদের সব গুন’ই বিদ্যামান। তাছাড়া মেঘের দাভাই এটা ভুললেও চলবে না। মাত্র কয়েকটাদিন সে পাহাড়ি ভাষাও আয়ত্ত করে ফেলেছে। ওকে খোঁচাতে সে আবার বলছেও। আলো ঠোঁট কামড়ে হাসি আঁটকে ওর রান্নায় মন দিলো। নয়তো হেসে ফেললে ফাজিল টা মজা নিবে। রোদ কাজু বাদাম খেতে খেতে আলোকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আলে এ ছুলি এত লজ্জা কীছের ছুনি? আমিই তো লে।”
আলো এবার শব্দ করে হেসে ফেলল।এই ছেলে সত্যিই ফাজিল; না মহাফাজিল। রাগ, জেদ, বুদ্ধি, শয়তানি, সবটা যেন সঠিক সম-পরিমাণে
আয়ত্ত করেছে। ওর বলার ধরণ দেখে আলো না হেসেও পারল না। আলো হাসতে হাসতেই ওকে বলল,
”আপনি আসলেই অসভ্য?”
“অসভ্যের কী করলাম, হুম? আর বউয়ের কাছে অসভ্য না হলেই তো সমস্যা।”
” কি সমস্যা? ”
কথাটা বলে আলো গলায় হাত দিতে যাচ্ছিল। রোদ দ্রুত আটকে দিলো, মরিচ কেটে গলাতে হাত দিচ্ছে, এই মেয়ে পাগল নাকি! রোদ নিজে আলোর গলায় ঘামে লেপ্টানো চুলগুলো সরিয়ে
থুতনির নরম মাংসে ঠোঁট ছোঁয়াল; তারপর বাঁকা হেসে বলল,
“বউয়ের কাছে অসভ্য না হলে, আমার পাখিটা অন্যের ডালে গিয়ে বসবে। আর আমাকে বুড়ো আঙ্গুল বলবে শালা হারবাল খা।”
“হারবাল কি দাভাই?”
রোদের পেছনে দাঁড়িয়ে মেঘ বলে উঠল! এসময় মেঘকে ওরা কেউ’ই আশা করে নি। আর আলো তো রোদের কথায় এবং কাজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এই অসভ্যটা কী করল এটা? তার এমন ভাব যেন কিচ্ছু করে নি। এদিকে মেঘকে কিছু একটা বলে বোঝাতে হবে। তাই রোদ’ই মুচকি হেসে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,

“বড়দের শক্তি হওয়ার ওষুধ।”
“ওহ!”
বড়দের শুনে মেঘ আর আগ্রহ দেখাল না। ওর বলটা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। রোদ পেছনে ঘুরে দেখে আলো নেই। এই মেয়ে কই গেলো? সে তো এসেছিল; মিষ্টি বউটাকে একটু জ্বালাতে। কারণ
সারাদিন পড়লে পড়া মস্তিষ্কের থাকবে না।আর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু বিনোদনেরও দরকার।
যাতে মনটা ফ্রেশ হয়ে মস্তিষ্ক পড়াটা ধরে রাখতে পারে।এজন্য সে ইচ্ছে করে ফাজলামি করছিল। কিন্তু মেয়েটা বুঝলে তো! হ্যাঁ, বুঝে ঠিকই তবে উল্টোটা। রোদ আলোকে খুঁজে না পেয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে চলে গেল, পরে দেখে নিবে।
আর আলো চিপায় থেকে বেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। নয়তো রোদ ওকে জ্বালিয়ে মারত, খুব’ই অসভ্য মানুষটা! এসব ভেবে, আলো মিটিমিটি হেসে রান্নার কাজে মন দিলো। ঘন্টা দু’য়েক পর মেঘ ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরল।ওরা খেলায় হেরে গেছে! দুইদিন পর আবার খেলা হবে। সাগর তখন মাসকাবারির বাজারগুলো রান্নাঘরে তুলে রাখছিল। চালের বস্তা দু’জনকে ধরে আনতে দেখে মেঘ বলল,

“ওমা এটাই ধরে আনতে পারছো না। ইয়ে খাবে তোমরা, তাহলে শক্তি হবে।”
রবি হাসতে হাসতে মেঘের গাল টেনে বলল,
“কী মেঘবাবু?”
“হারবাল খাবা হারবাল।”
একথা শুনে সাগর আর রবি দুজনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এই ছেলে কী বলে? হারবালের কথা জানল কোথা থেকে? আলোকে দেখে ওরা লজ্জায় মুখ কাঁচুমাচু করতে লাগল। ইস! দুষ্টুটা
ওদের বে-জায়গায় লজ্জায় ফেলে দিলো। আর আলো সব শুনেও না শোনার ভাণ ধরে চলে গেল। বেচারাদের লজ্জা বাড়াতে চাচ্ছে না সে।
তাছাড়া কী বা করবে? সব নষ্টের গোড়াতো তো ওই, ‘রোদ মেহবুব।’

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

জীবনটা খুব সুখময় মনে হয় তখন; যখন প্রিয় মানুষটা পাশে থাকে। তার ছোট ছোট আবদার, খুনশুটি, যত্ন আর ভালোবাসা গাঢ়ভাবে হৃদয় স্পর্শ করে। প্রনয় আর প্রাপ্তি এসে পরিপূর্ণ হয়।
তখন একরাশ প্রশান্তি এসে মন ছেঁয়ে যায়।এত ভালোবাসা পেয়ে বড্ড লোভও হয়। বেহায়া মন খুব করে চায়, সময়টা যদি থমকে যেতো।সুখময় একটা মুহূর্তে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস, বছর, যুগও পেরিয়ে যেতো। অথবা বুকের গহীনে তাকে লুকিয়ে রাখলেও বেশ হতো।সারাজীবনের
জন্য প্রণয়ে ডুবে স্থির হয়ে গেলেও মন্দ হতো না।
সবকিছু তখন সুখময় স্বপ্নপুরী মনে হতো। প্রিয়
মানুষটাও সর্বদা পাশে এবং কাছে থাকত। মন প্রাণ উজাড় করে পাগলের মতো ভালোওবাসত।
এমন হলে বেশ হতো! হয়তো সবার সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। কিন্তু কারো কারো হয় তো! কারো
কারো জীবনে প্রনয় জিনিসটা খুব সহজেই ধরা দেয়। প্রণয়ের পূর্ণতাও সুমিষ্ট হয়। এমন জুটিরা সত্যি’ই সৌভাগ্যবান। জীবন তাদের মূল্যবান প্রাপ্তি পেতে সহায় হয়। আর বাকিরা পরিস্থিতির শিকার নয়তো ভাগ্যের পরিহাস। তাদের প্রাপ্তি; বুকভর্তি কষ্ট আর মুখেভর্তি মিথ্যার হাসি।

রাত তখন এগারোটা সাতাশ। নিকষকালো রাত ধরণীকে আঁকড়ে ধরেছে। আকাশে চাঁদ তারা’রা
গল্প জুড়ে দিয়েছে। ক্ষণিকে আবার মিটমিট করে উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কী সুন্দর প্রকৃতির একটা একটা সৃষ্টি। যে যার স্থানে নিদারুণ সুন্দর! কারো সঙ্গে কারোর তুলনা চলে না। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সূর্য সুন্দর আর ঘন রাতের আঁধারে চাঁদ। ফুলেরা গাছে সুন্দর আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। যে যার জায়গায় সৃষ্টিকর্তা নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। ধরণীর নিয়মমাফিক সন্ধ্যার পরপরই পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে।তারা
হয়তো ছানাদের আহার করিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছে। ছানাগুলোও মায়ের উম পেয়ে চুপটি করে আছে।শুধু ব্যস্ততা শেষ হয় নি, মানব জীবনের। প্রয়োজনের তাগিদে যে যার আপন উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে ! এই চলার অন্ত নেই!
রাতে খেয়ে আলো মেঘকে ঘুম পাড়িয়ে রোদের পাশে এসে বসল। প্রশ্নের পাহাড় তুলে সব শুনে তবেই দুষ্টটা ঘুমিয়েছে। তার প্রশ্নেরও শেষ নেই!
আলোও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে সঠিক উত্তর’টা দেওয়ার। যাতে অবুজ মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি না হয়। রোদ আলোকে একবার দেখে ফোন স্কল করতে করতে বলল,
“কিছু বলবে?”
“আপনি কী ব্যস্ত?”
রোদ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো,
“না।”
আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু রোদ রাগ করবে ভেবে, বলতে পারছে না। ওকে চুপ থাকতে দেখে রোদ বলল,

” রাগ করব না, বলো।”
“চুলে তেল দিয়ে দেন। আমার মাথা ঘুরছে তেল না দিয়ে।”
রোদ ইশারায় ওকে তেল আনতে বলে ঠিক হয়ে বসল। আলো তেল এনে ওর সামনে টুলে টেনে বসল। যেমনভাবেই হোক দিয়ে দিলেই হবে।রোদ একবার তেল আর ওর চুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
”কীভাবে শুরু করব?”
আলো সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। রোদও বুঝে কাজ শুরু করল। তবে এই
মেয়ে এত সহজে কাছে আসে না। অথচ আজ তার মধুর বায়না! কাহিনী তো আছেই। কিন্তু কী? এখন জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলবে না। তাই রোদ আর কথা বাড়াল না। কথার ছলে নাহয় পরে জেনে নিবে।
মূলত আলোর বৃদ্ধাঙ্গুল একটু কেটে গেছে, তেল দিতে গিয়ে চুল ঢুকে রক্তও বেরিয়ে গেছে। এখন ব্যথায় টনটন করছে। সে আবার চুলে তেল না দিয়ে থাকতে পারে না, মাথা ঘুরে। সমস্যাটা ওর ছোট থেকেই; যাকে বলে পুরনো অভ্যাস। রোজ রাতে তেল না দিলে ঘুমও আসে না।
রোদ আনাড়িভাবে তেল দিতে দিতে সহজ করে, নিজের মতো দিতে থাকল। বড় চুলে তেল দিতে সমস্যা হলেও; মন্দ লাগছে না।তাছাড়া পছন্দের জিনিসে বিরক্ত আসে না। বরং অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিধায় মৃদু হাসছে। বিয়ে, বউ, সংসার, আবদার নিয়ে, ওর কখনো ভাবা হয় নি। বউয়ের বড় চুল হবে; তেল দিয়ে দিবে! এমন আদুরে সব আহ্লাদ মনে পোষণও করে নি।সে ছোট থেকে কাঠখোট্টা প্রকৃতির সে। তবে এসব না ভাবলেও ওর ভাগ্যে ছিল। তাই হয়তে এই মুহূর্তের সৃষ্টি!

আলো এখনো চোখ জোড়া বন্ধ করে আছে।ওর ঘুমে চোখ জোড়া বুজে আসছে! বেশ লাগছে!
গতরাতে অর্ধেক চুলে তেল দিয়ে আর পারে নি, হাত ধরে গেছে। বিরক্তিতে পরে আর দেওয়া হয় নি। তার আগের দিনেও তাই হয়েছে! ঘন লম্বা চুলের জন্য দিতে কষ্ট হয়। রাকা থাকলে রোজ সেই দিয়ে দেয়। রাকা নেই তাই আজ বাধ্য হয়ে রোদকে বলল। যদিও ধমক খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। হঠাৎ রোদ বলল,
“বড় চুল রাখার কারণ কী?”
“যাতে চুল দিয়ে বরকে বেঁধে রাখতে পারি।”
মুখ ফসকে কথাটা বলে আলো জিহবা বের করে কামড় বসাল। ছিঃ! এটা কী বলে ফেলল। রোদ মুচকি হেসে পুনরায় বলল,
“এত কিছু থাকতে চুল দিয়ে? যদি বাঁধা না থাকে?”
আলো ঘাড় ঘুরিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসল। রোদের কথাটা ওর পছন্দ হলো না।কেন হবে না? যত্ন করে বড় করেছে, সবাই কত্ত প্রশংসা করে। বড় চুলে নাকি ওকে দেখতেও বেশ লাগে। আবার কত মেয়ে ওর চুল দেখে হিংসাও করে। আড়চোখে বার বার তাকায়। তাহলে বর কেন বাঁধা থাকবে না, হুম? এ্যাঁ, মামার বাড়ির আবদার নাকি? তাকে বাঁধা থাকতেই হবে।এসব ভেবে আলো নিচু স্বরে বলল,
“সে প্রশংসা নাই বা করল।তবে বাঁধা থাকবে না কেন? এত যত্ন তো তার জন্যই করি। যদিও মুখে কিছু না বললেও, আমি সব বুঝি।”
“ওহ আচ্ছা।”

কথাটা বলে রোদ হেসে ইচ্ছে করেই ওর চুলে টান দিলো। আলো ব্যথা পেলেও কিছু বলল না;বরং হাসল। বাড়তি কিছু বললে যদি তেল না দিয়ে দেয়। এর তো আবার নাকের ডগায় রাগ! রোদ শুধু নিঃশব্দে হাসল। আলো আগে ওকে একটু আধটু ভয় পেতো। কিছু বলতে গেলেও থতমত খেয়ে কেঁদে ফেলত। কিন্তু বিয়ের পর ভয়টা কেটে
যাচ্ছে, ওদের সম্পর্কটাও সহজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে একে অপরকে বুঝতে শিখছে। হয়তো প্রণয়ের প্রথম ধাপ একেই বলে! সত্যি বলতে, সম্পর্কটা ঠিক চারা গাছের মতো। এটাকে যত সময় নিয়ে যত্ন করা হবে।এটা তত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে কলি ফোটাবে। হোক সেটা ফুলের বা প্রণয়ের! দু’টোই পবিত্র ফুল!
আলো বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে আর কঠিন চ্যাপ্টার গুলো রোদকে দেখাচ্ছে। রোদ সহজ ভাষায় ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।আর না বুঝলে, রোদের দু’একটা টোকাও খাচ্ছে। অনেক সময় নিয়ে তেল দেওয়া শেষ করে রোদ হাত ধুয়ে আসল। ঘড়িতে বাজে বারো’টা সতেরো! আলো চুলে খোঁপা করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। কাল সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। ঘুমেও চোখ বুজে আসছে! রোদ মেঘকে দেখে এসে আলোকে বলল,
“কাল দুপুরে রোহানদের বাসায় যেতে হবে। রেডি থেকো।”
“যেতেই হবে?”
“হুম।”
“আচ্ছা।”
এভাবে কথা বলতে বলতে দু’জনে ঘুমিয়ে গেল।

একটুপরে, রোদ চোখ খুলে আলোকে পরখ করে নিলো। তারপর সতর্কতার সাথে আলোকে ওর বাহুডোরে টেনে থুতনীর নিচে আদর দিলো। এই কাজটা সে প্রতি রাতে করে। গাল, কপাল, ঠোঁট, সব রেখে আলোর থুতনীর নিচেই আদর দেয়।
প্রেমিক পুরুষদের এক এক একজনের পছন্দ এক এক ধরনের। কেউ প্রেয়সীর কপালে, কেউ গালে অথবা ঠোঁটে আদরের স্পর্শ দিতে পছন্দ করে। কিন্তু রোদের পছন্দ’টা একটু ভিন্ন। আগে থেকেই ব্যতিক্রমী সে।আলোর থুতনীর নিচটা ওর বেশি পছন্দ। তাই হয়তো! তাছাড়া কপালে স্পর্শ দিলে হয়, আর্দশ প্রেমিক। ঠোঁটে দিলে, লুচ্চা প্রেমিক। তাহলে রোদ কোন পর্যায়ের প্রেমিক? এর উত্তরটা হয়তো অাবিষ্কার করা হয় নি।
রোদের বাহুডোরে আলো আদুরে বিড়ালছানার মতো গুটিয়ে গেল। পরক্ষনে মুখ লুকিয়ে মুচকি হাসল। আচ্ছা, রোদ কখনো বুঝবে? প্রতিরাতে ওর এই কাজের সাক্ষী, আলো নিজে! কিছু কিছু জিনিস মুখে বলতেও নেই, বুঝাতেও নেই। শুধু অনুভব করে হৃদয়ে পুষে রাখতে হয়।এসব ভেবে আলো চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল।
পরেরদিন সকালে চড়ুই পাখিটা এসে থাই গ্লাসে টোকা দিচ্ছে। পাখিটা রোজ এমন করে! হয়তো সকালের আগমনী বার্তা জানাতে হাজির হয়।
সেই শব্দে আলোর ঘুমটা ভাঙ্গলেও সে একচুলও নড়তে পারল না। রোদ পাশ ফিরে বালিশ ছাড়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আর ওর পিঠের নিচ দিয়ে আলোর চুল চাপা পড়ে মেঝে থেকে তিন ইঞ্চি উপরে ঝুলছে। অর্থাৎ উঠতে গেলে রোদকে ডাকতে হবে। নয়তো চুল ছাড়ানোও সম্ভব নয়।
আলো উপায় না পেয়ে মৃদু স্বরে রোদকে ডাকল,

“আমার চুলে লাগছে, উঠুন। উফ, এই যে এই বর মহাশয়! ”
রোদ তিন বারের বেলায় চোখ খুলে চুলগুলো সরিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেল। আলো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।ধুর,
এক কাজ বার বার করতে বিরক্ত লাগে।তাছাড়া রান্না করার আগে চুল ভালোভাবে না বাঁধলেও, আরেক সমস্যা। এজন্য চুলের কাটা’টা নিতে সে রোদের উপর দিয়ে হাত বাড়াল। ওর খোলা চুল রোদের গলায় স্পর্শ করাতে রোদ খুব কাতুকুতু অনুভব করল। শরীরটা আচমকা শিরশির করে উঠল। আলো সরে যাওয়ার আগেই রোদ ওকে জাপটে ধরল। আলো ছাড়া পেতে জোর খাটাতে গেলে রোদ বলল,
“ঘুম ভাংলো কেন এলোকেশী, হুম? এখন তো শাস্তি পেতে হবে!”
“মেয়েদের এত কাছে আসতে নেই, সরুন।”
“আসলে কী হয়?”
“মেয়েদের শরীরে কলংক লাগে।”
“কীসের কলংক?”
“প্রণয়ের।”
কথাটা বলে আলো রোদকে সরিয়ে চুলে খোঁপা করে কাটা আটকে নিলো।যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই রোদ বলে উঠল,
“তাহলে এই কলংকে তোমাকে আমি শতশত বার কলংকিত করব।”
রোদের কথা শুনে আলো পিছু না ফিরে মুচকি হাসল। কারণ এই একই রোগে সেও আক্রান্ত। আর এই রোগের একমাত্র নিরাময়দাতা; রোদের মেহবুব।

শুভননাগণ খুব সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন।মূলত কাজ কতদূর এগোলো দেখতে এসেছেন।
প্রথমে হাকিমের দোকানের কাজটা শুরু হয়েছে। কারণ এটার প্রয়োজন বেশি। অনেকে উনাদের সালাম দিচ্ছে, কুশল বিনিময় করছে। মাতবর থাকাকালীন কেউ উনাদের এতটা সন্মান করে নি। হয়তো ভয়ে! তবে সময় বদলাচ্ছে নিজেদের সন্মান নিজেরা অর্জন করছেন। রবিও উনাদের আঙ্গুল ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।আজকাল
ওর খুব ভালো সময় কাটে! সবার সঙ্গে খেলতে পারে, মায়েদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারে। কতশত আবদার করতে পারে। এখন কেউ মারেও না, বকেও না।
কয়েকদিন ধরে গ্রামবাসীদের মুখে আফসোসের বাণী শোনা যাচ্ছে। মাতবর নাকি দরদী মানুষ ছিলেন। পূর্ণির পাপের জন্য উনার এই অবস্থা হয়েছিল। শেষে পাক-পবিত্র না করে’ই দাফন করতে হলো। আহারে! সব পূর্ণির পাপের জন্য!
তবে মাতবর না পেয়েছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ, আর না স্বাভাবিক মৃত্যু! উনার কপালে দাফন জুটলেও, পবিত্র অবস্থায় কাফন পরানো সম্ভব হয় নি। অপবিত্র অবস্থায়ই কবর দেওয়া হয়েছে।
আর মতি পেয়েছিল ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ। তবে তাকে দাফন করা হয় নি।

মতি ধর্ষণের পর মেয়েদের নগ্ন দেহটা পাহাড়ের
উপর থেকে ফেলে দিতো।যেভাবে ওর মৃত দেহটা পড়েছিল। মেয়েদের লাশগুলো ওখানে গলে পঁচে নিঃশেষ হয়ে যেতো। কখনো জঙ্গলের হিংস্র বন্য প্রাণীদের খাবার হতো। এসব কষ্ট তাকে অনুভব করতে হতো।কারণ মানব জাতি অন্যকে আঘাত করতে পারদর্শী।আর সেই আঘাত নিজে পাওয়া না অবধি এর ব্যথাও বুঝে না। এজন্যই হয়তো মতির ভাগ্যতে এমন কিছু ছিল। এত পাপকর্মের পরে ওদের কপালে এতটুকু জুটেছে, এটাই বেশি নয় কি! ওরা যদি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে পেতো,
তাহলে সৎকামী আর অসৎকামীর মধ্যে তফাত থাকত না। এজন্য প্রকৃতি তাদের শাস্তিটা ভিন্ন ভাবে তুলে রেখেছিল।
শুভাননাদের হঠাৎ একটা বাড়িতে চোখ পড়ল। একজন মহিলাকে কাঁদতে দেখে উনারা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মহিলাটা মোনাজাতে অঝরে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। সেই কান্নার না আছে শব্দ, না আতনার্দ। উনার একটাই ছেলে ছিল, সে মারা গেছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে। বেশ কয়েক বছর আগে মেয়েটাকেও কারা যেন ধর্ষণ করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
এখন স্বামী ছাড়া উনার কেউ নেই।শুভাননাগণ সব শুনে কিছু বলার ভাষা পেলেন না, জেনে বুঝেও চুপ থাকলেন! শুধু স্বান্ত্বণা দিতে এতটুকু বললেন ,
“বুবু কাঁনদো না, দুয়া কলো। তোমাল দুয়াটুকুই ওদেল কাজে লাকবে।”
এভাবে অনেক কিছু বলে উনাকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন। মায়ের মন তো। স্বান্ত্বণাতেও শান্ত হয় না। ছেলে মেয়ের জন্য অঝরে অশ্রু ঝরে যায়।
শুভাননা’রা ওখানে কিছুক্ষণ বসে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। পাপকে উনাকে নিজে হাতে শেষ করেছেন, নয়তো ছোট্ট রবিও আজ বেঁচে থাকত না।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

– ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’-
মেঘ আহ্লাদে আটখানা হয়ে গানটা বার বার গাইছে। কারণ, বউমনি আজ স্কুলে যেতে নিষেধ করেছে। রোজ স্কুল না গেলে কতই না ভালো হতো। ইস! জীবন পুরো লেমন কালার হয়ে যেতো। লেমন কালার মেঘের খুব পছন্দ। রোদের কালো আর আলোর সবুজ! তিনজনের পছন্দ ভিন্ন ধরণের। তবে ওদের মায়া, টান, আস্থা, ভালোবাসা, স্নেহ/শ্রদ্ধাবোধ অন্তঃকরণ থেকে। এজন্য হয়তো বন্ধনটা এত মজবুত। মেঘ একহাতে ডোরাকেক খাচ্ছে আর অন্যহাতে বউমনির ওড়না ধরে পিছু ঘুরছে। আম্মুর আঁচল ধরেও সে এভাবে ঘুরত। অকারণে
এভাবে ঘুরতে ওর ভালো লাগে। সাথে বকবক তো আছেই। রোদ নাস্তা সেরে তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে অফিসে গেছে। আলো হাতের কাজ সেরে মেঘের রুমে গেল। মেঘের সব কাপড়-চোপড় অগোছালো হয়ে এদিক-ওদিক পড়ে আছে।বই খাতার পৃষ্ঠা ফ্যানের বাতাসে উঠে ফড়ফড় শব্দ করছে। রিমোট কনট্রোল প্লেন, গাড়িসহ হরেক রকমের খেলা মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। কালার পেন দিয়ে টেবিলে আঁকিবুঁকি করা। এমনকি ওর পরিহিত টি-শার্টেও। গতকাল রাতে বেডেশীটে কলমের কালি ফেলে সে চিপায় লুকিয়ে রেখেছে। যাতে কেউ বকতে না পারে। কিন্তু এখন ওটা আলোকে বের করতে দেখে, মেঘ জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁত বের করে হাসল।আলো হেসে বলল,

“কলমটা দুষ্টু ছিল, মেঘবাবু?”
“হুম, এমনি এমনিই এমন হয়েছে। আমি কিছু করি নি বউমনি।”
আলো মুখ টিপে হেসে রুম গুছানো শুরু করল।
আর মেঘ গাড়ির উপর বসে রুমে জুড়ে চালাতে শুরু করল। বাচ্চাদের বসে চালানো গাড়িগুলো যেমন হয়, তেমনই। নীল রংয়ের গাড়িটা দেখতে খুব সুন্দর! রোদ ভাইয়ের কোনো আবদার’ই অপূর্ন রাখে না। সাধ্যের মধ্যে যখন যা চায় তাই এনে হাজির করে। আর মেঘের আবদারের শেষ থাকে না। আলো রুম গুছাতে গুছাতে সূরা ইয়াসিনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করতে লাগল। মেঘও আলোর সাথে সাথে বলতে থাকল। তবে আলো পিছু ফিরে তাকাল না। নয়তো মেঘ লজ্জা পেয়ে বলা থামিয়ে দিবে। আলো এই কাজটা রোজ করে। সূরা ইয়াসিনের প্রথম পাঁচটা আয়াত মেঘ না দেখে বলতে পারে। ওর বুলিতে শুনতেও বেশ লাগে! আলো এখন গান গাইলে, মেঘও তাই করত। কিন্তু সে অবসর সময়টাকে এভাবে কাজে লাগায়। মেঘ প্রথম প্রথম খুব লজ্জা পেতো, বলতে চাইত না। কিন্তু ধীরে ধীরে লজ্জা ভেঙ্গে আলোর সঙ্গে তাল মিলায়। মেঘ রোদকে সালাম দিতে লজ্জা পেতো। কিন্তু এখন বিনয়ী ভাবে রোদসহ আলোকেও সালাম দেয়। আলো ওকে বুঝিয়েছে; সন্মান করলে, তবেই সন্মান পাওয়া যায়। সবাই ভালোও বলে।

যদিও এটা প্রায় অনেক ছেলে/মেয়েদের সমস্যা। নিজের বাবা-মাকে সালাম দিতেও লজ্জা পায়।পরিবারে সালাম প্রচলিত থাকলে সমস্যাটা হয় না। ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। অনেকে জেনে বুঝে শুধরায় না, কারণ লজ্জা। ছেলেরা গলা ছেড়ে প্রেমের গান গাইতে লজ্জা পায় না৷ অথচ শব্দ করে দু’টো আয়াত বলতে লজ্জা পায়। যুগ হিসেবে এটা স্বাভাবিক। কারণ ছোট থেকে তারা নিজেকে এভাবে তৈরী করেছে। গাছ যেমন ফল তেমন! একথা তিতা হলেও সত্যি! এসব ব্যাপারে
মেয়েরা আরো এক ধাপ এগিয়ে। খোলা চুলে একপাশে ওড়না নিয়ে মেকাব করে ঘুরবে।রং ঢং করে ছাদে ছবি তুলে ন্যাকামিও করবে। অথচ বাবা-মা সালাম দিতে গেলে, লজ্জায় মরি মরি। এনার্জি শেষ! অনেকে বড় হয়ে বাবা-মাকে কবে সালাম দিয়েছে, তাও ভুলে গেছে। একজন
সন্তানের জন্য, এটা গর্বের কথা নয়! তবে লজ্জা কাটিয়ে বাবা-মাকে বিনয়ীভাবে সালাম দিলে, উনারা হয়তো কিছুক্ষণ থম মেরে তারপর সুন্দর করে উত্তর দিবে। মূলত থম মারার কারণ, অবাক, খুশি, গর্বের সংমিশ্রণ অনুভূতি। এমন মুহূর্তে হয়তো উনাদের চোখে আনন্দের অশ্রু জমতে পারে। আর এটা হবে, সন্তানদের প্রাপ্তি। হয়তো বড় ভাবী/বোন /ভাই/ চাচী দেখে হেসে বলেও ফেলবে,
“কি রে পাম দিচ্ছিস, কিছু লাগবে? অতি ভক্তি কিন্তু চোরের লক্ষণ।”
উনাদের এমন কথায় থেমে গেলে চেষ্টা বৃথা।
আজ হাসবে কালকে ঠিকই বলবে,ছেলে/মেয়ে’টা ভদ্র। আর ভালো কিছু করতে গেলে, হাসাহাসি, কটু কথা, উপহাস, পেরিয়ে সফলতা। প্রচেষ্টা এখানে মুখ্য বিষয়! তাছাড়া ‘যার যোগ্যতা যত কম সে উপহাস করে তত বেশি।’ কারণ নিজে পারে না অন্যকে পারতে উৎসাহ দেয় না। এটা মস্তিষ্কে গেঁথে রাখা উচিত। আর সন্মান এমনি আসে না, এটা অর্জন করে নিতে হয়। হোক কর্মে বা ব্যবহারে!
(বিঃদ্রঃ- অন্য ধর্মেরও আপু/ভাইয়াও আমার গল্প পড়েন। এটা আমার সৌভাগ্য। তাই বলছি, আপনারা নিজেদের অভিবাদনবিশেষ বাক্যটি একইভাবে কাজে লাগাতে পারেন। কে বলছে, মূখ্য কথা নয়। শিক্ষা নিতে চাইলে, পিঁপড়ার থেকেও নেওয়া যায়। ভুল বললে অনুগ্রহপূর্বক মাফ করবেন; ক্ষুদ্র জ্ঞানের এই মানবীকে। আর দুঃখিত গল্পের মাঝে বিরক্ত করার জন্য।)

এখন বাজে বারোটা চার! সূর্যটা রেগে প্রখরভাবে তাপ বাড়াচ্ছে। বাতাস নেই! গাছপালা থম মেরে নিজেকে পুড়িয়ে অন্যকে ছায়া দিচ্ছে। ভ্যাপসা গরম! ক্লান্ত পথিকরা গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। উফ! এতে যেন শরীর ও মন শীতল হয়ে যাচ্ছে। গাছের ডালে দু’টো কাক বসে রক্ষে কন্ঠে কা কা শব্দে ডাকছে। ওরা অভিযোগ জানাচ্ছে, আজকের আবহাওয়ার জন্য। কালো কুকুরটা বসে জিহ্বা বের করে ধুঁকছে। গরমে সেও অতিষ্ঠ।
সে তো রোগ, শোক, কষ্টের কথা বলতেও পারে না।
তৃষ্ণার্ত পথিকরা ফুটপাতের শরবতের দোকানে ভিড় জমিয়েছে। লেবু, পানি, চিনি আর বরফের তৈরী শবরত! তাদের স্বাস্থ্যকর /অস্বাস্থ্যকরের ব্যাপারে খেয়াল নেই। কড়া রোদে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা পানি পেলেই যেন প্রাণটা বাঁচবে, মাত্র এক গ্লাসই তো! এতে আর কী হবে? কেউ বা ডাবের দোকানে দরদামে ব্যস্ত। বিক্রেয়া দিচ্ছে না, ক্রেতাও ছাড়ছে না। দু’পক্ষই
নাছোড়বান্দা! বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে, কলেজ/ ভার্সিটির স্টুডেন্টরা হাতে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে হইহল্লায় মগ্ন!
আজকের আবহাওয়াতে জন জীবন অতিষ্ঠ। কী আর করার প্রকৃতি যে বড্ড রুষ্ট!

আলো কাজ সেরে মেঘকে গোসল করিয়ে সেও করে নিলো। একটুপরে, রোদ বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আলো তখন মেঘকে হালকা কিছু খাবার খাওয়াচ্ছিল। একটুপরে, ওরা রোহানদের বাসায় যাবে। ওখানে কখন খাবে, না খাবে ঠিক নেই। এজন্য বুদ্ধি করে কিছু খাইয়ে দিলো কারণ মেঘ ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। রোদ আলোকে দ্রুত রেডি হতে বলে ফোনে কথা বলতে লাগল।
রোহান আটবার ফোন দিয়েছে। কখন আসবে?
দেরী হচ্ছে কেন? সমস্যা কী? এসব বলে পাগল করে দিচ্ছে। আলো মেঘকে রেডি করিয়ে, সবুজ আর কালোর সংমিশ্রণের থ্রি-পিস পরে নিলো।
চুলে সাধারণ খোঁপা করে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। ছোট একজোড়া দুল, গলায় চেইন, হাতে স্বর্ণের ব্যাচলেট আর একটা অাংটি। রোদের পরিয়ে দেওয়া একজোড়া কালো পাথরের নুপূর।
ঠোঁটে লিপবাম আর চোখে কাজল। স্বর্ণের গয়নাগুলো সে পরেই থাকে, বাড়তি হচ্ছে ওর কাজল আর লিপবাম। সচরাচর মেয়েরা বাসায় যতটুকু গয়না পরিহিত থাকে, তেমন। রোদ উঠে আলোকে বামে-ডানে, এদিক-ওদিক, ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। সব ঠিকঠাক দেখে সাদা শার্ট’টা পরতে পরতে খোঁচা মেরে বলল,
“কম খাবে, দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছো।”
“ধন্যবাদ।”
রোদের উদ্দেশ্যে আলো বুঝতে পেরে কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। সে উত্তর দিলে, রোদ ওকে আরো খোঁচাতে থাকত, কী দরকার? রোদ মুচকি হাসল! না মেয়েটা দিন দিন চালাক হয়ে যাচ্ছে।

তারপর তিনজনে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে এসে বসল। রোদ ড্রাইভ করতে করতে একবার আলোর দিকে তাকাল। আলোর মধ্যে এখন
অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঢাকায় এসে আলোর মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। নির্মল বায়ুতে ছেড়ে, ঢাকার দূষিত বায়ুর অচেনা শহর বলে হয়তো।পানিতে চুল ঝরে যাচ্ছিল দেখে খুব কেঁদেছিল। শ্যাম্পুর ব্যবহার আর এখানকার পানির জন্য সমস্যাটা হচ্ছিল। চোখে নিচে কালি জমে সিগ্ধ মুখটা চুপসে থাকত। কম ঝালের খাবার খেতে পারত না। কাঁচা মরিচ অথবা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ভাত খেতো। আর রোদের থেকে পালাতে পারলে যেন জানে বাঁচত! কিন্তু এখন ধীরে ধীরে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। কামিজ পরতে আলোর সমস্যা হতো, সেও বুঝত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। এখানে থামি চলবে না। ওকে কামিজে অভ্যস্ত হতে হতো। এখন চুলও আর ঝরে না। চুপসানো মুখে এখন স্নিগ্ধতার আভা স্পষ্ট। চোখ দু’টো যেন মায়াগহ্বর।একবার আটকে গেলে মুক্তি পথ নেই! আগের তুলনায় স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়াতে, দেখতেও বেশ লাগে।
সময় আর নিজের চেষ্টায় আলো নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। রিমিও খুব সাহায্য করেছে। মেঘের ডাকে রোদ ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে তাকাল। ওরা দু’জনে ফিসফিস করে আলোচনা করে কিছু বলার আগে রোদ বলল,
“হবে না।”
“কী হবে না দাভাই?”
“আইসক্রিম।”

রোদের কথা শুনে দু’জনের মুখটা চুপসে গেল। পুরো কথা না বলতেই বুঝে গেল। রোদ গাড়ির
স্পিড বাড়িয়ে দিলে, পনেরো মিনিটেই রোহানের বাসায় পৌঁছাল। তিনজনে বাসায় প্রবেশ করে দেখে ওদের আগেই সবাই এসে গেছে। রোহানের বাসায় আজ সবার দাওয়াত। রোদ হাতের ফল মিষ্টি রেখে কুশল বিনিময় করে সোফায় বসল। রোহানের বাবা-মা এসে ওদের সঙ্গে কথা বলল। রোহানের মা হেসে আলোর থুতনী ধরে আদুরে সুরে বললেন,
“তুমি আসলেই পাহাড়ি ফুল।”
আলো উনার প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল। এই কথার জবাবে কিছু বলা যায়? সে তো খুঁজে পেলো না। উনি সবাইকে বসতে বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। রোহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোরা বস, আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
রোহান ওর আম্মুকে কাজে সাহায্য করতে গেল।
কাজের মেয়েটার জ্বর। এজন্য সব কাজ উনাকে করতে হচ্ছে। সোফাতে বসে রান্নাঘর দেখা যায়,
আলো রোহানের কাজ দেখে উঠে সেদিকে গেল।
রোহানকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়ে, নিজে হাতে হাতে কাজ করতে লাগল। সে জানে, রোহানের আম্মুর চারমাস আগে অপারেশন হয়েছে। উনি এখনো অসুস্থ! উনাকে সাহায্য করার জন্য রোদ আগে বলেছিল। তাছাড়া ওরা বসে থাকবে,আর অসুস্থ মানুষটা কাজ করবে, এটা দৃষ্টিকটু।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৩৭+৩৮+৩৯

রোহানের আম্মু আলোর ব্যবহারে খুশি হয়ে রোদের দিকে তাকালেন। রোহান ঠিকই বলেছে, মেয়েটা রোদের জন্যই পারফেক্ট। তখন নিতু শোভনের দিকে তাকিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলল,
“বলেছিলাম না, মেয়েটা ভালো সাজতে এসব করে। গোঁয়ো মেয়ে। যেখানে যায়, কাজের লোক হয়ে যায়।”
নিতুর হয়তো খেয়াল করে নি শোভনের পাশের রোদ আছে। ওর কথা রোদ স্পষ্ট শুনেছে। তবে জবাব দিলো না কারণ এটা সঠিক সময় নয়। শোভন মুখ কাঁচুমাচু করে নিতুকে চোখ রাঙাল। রিমি কিছু বলতে গেলে রোদ থামিয়ে দিলো। বাকিরা গল্পের তালে থাকায় খেয়াল করে নি।
আলো তখন তরকারি নিয়ে ডায়নিং টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ দ্রুত গতিতে দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। সে তাল সামলাতে না পেরে, হাতের কাঁচের বাটিটা মেঝেতে উচ্চশব্দে আছড়ে পড়ল। আর গরম তরকারি গিয়ে পড়ল ওর পায়ে। এমন শব্দ শুনে সবাই ছুটে আসল।
সবাই ভেবেছিল, রোহানের আম্মু পড়ে গেছে।

রোদ দ্রুত আলোকে চেয়ারে বসিয়ে, দৌড়ে পানি এনে ওর পা চুবিয়ে দিলো। রোহান বরফ এনে আলোর পায়ে ঘষতে লাগল। ইস! ফর্সা পায়ে ফোসকা পরে গেছে। রোদ রোহানের থেকে বরফ নিয়ে ফুঁ দিচ্ছে আর আলতো করে বরফ ঘষসে। যেন ব্যথা সে পাচ্ছে।
তাছাড়া সে থাকতে বন্ধুকে বউয়ের পায়ে হাত দিতে দেওয়া যায় না। বেমানান দেখায়! আর রোহানের বাবা-মাও এখানে উপস্থিত আছেন। উনারাই বা কী ভাববেন? যদিও উনারা খোলা দিলের অমায়িক মানুষ। তবুও পরিস্থিতি যেমনই হোক, বুঝে কাজ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
এতকিছুর পরেও আলোর এদিকে হুশ নেই, তার দৃষ্টি ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণির দিকে।

এলোকেশী কন্যা শেষ পর্ব