এলোকেশী কন্যা পর্ব ৭+৮+৯

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৭+৮+৯
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

মেঘকে এভাবে ছুটতে দেখে রোদ দ্রুত হাঁটু গেড়ে বসে ওকে বুকে জাপটে ধরল। অকস্মাৎ মুখ থুবড়ে পড়লে মেঘ পুনরায় পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেতো। তখন ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হতো। মেঘ নামার জন্য খুব ছোটাছুটি করলেও রোদ ওকে কিছুতেই ছাড়ল না। আলো ততক্ষণে দৌড়ে ওদের চোখের আড়াল হয়ে গেছে। রোদ কোনোমতে মেঘকে শান্ত করিয়ে ওই মহিলার কাছে গিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে জিজ্ঞাসা করল,
“ওখানে কী হয়েছে? আর আপনার কথা শুনে মেয়েটা এভাবে দৌড়ে চলে গেল কেন?”
“ওই ছামনের পাহালে মুন নামের একখান মাইয়ার কল্লাকাটা লাছ পাওয়া গেচে। মুনে হয়, ওই অমানুচ জুঙ্গিলা ওলে এবা করচে।”
কথাটা বলে মহিলাটা ভয়ার্ত চোখে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। রোদকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিলো না। জঙ্গি নিয়ে এখানকার সবার মনে একটা আতঙ্ক আছে। এজন্য উনি আর কথা বাড়ালেন না। রোদ মূল ঘটনা জেনে মেঘকে নিয়ে রিসোর্টের দিকে পা বাড়াল।

এই নির্দয় বন্য জঙ্গিদের কবলে আর কতজন প্রাণ হারাবে, কে জানে? তাছাড়া প্রশাসনের দিক থেকেও এখন অবধি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। কিন্তু কেন? এর কারণ এখনো অজ্ঞাত। এখানকার স্থানীয় পাহাড়ি মানুষগুলোও জঙ্গিদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দিন কাটাচ্ছে। উনাদের এই ভয়ের সমাপ্তি কবে হবে কারো জানা নেই।
রোদকে আলোর বাড়ির দিকে যেতে না দেখে মেঘ ছলছল চোখে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বলল,
“দাভাই, আমরা মিষ্টির কাছে যাব না? মিষ্টি এভাবে দৌড়ে চলে গেলে কেন?”
“ওর একটা জরুরী কাজ মনে পড়েছে তাই এভাবে দৌড়ে গেল। আমরা নাহয় পরে তোমার মিষ্টির সঙ্গে দেখা করতে যাব!”
মেঘ কিছুটা মুখ ভার করে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,”আচ্ছা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোদ মৃদু হেসে টুকটাক কথা বলতে বলতে মেঘকে নিয়ে রিসোর্টে প্রবেশ করল। রোদ মূলত ইচ্ছে করেই আলোর পিছু গেল না। কারণ মুনের গলা কাটা লাশ দেখলে মেঘ খুব ভয় পেতো। রোদ নিষেধ করলে মেঘ উঁকিঝুঁকি মেরে আগে লাশই দেখত। তাছাড়া নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বাচ্চাদের ঝোঁকটা কেন জানি একটু বেশিই থাকে। আর মেঘ তো আরো এক ধাপ এগিয়ে। দাভাই কেন নিষেধ করলে? দেখলে কী হবে? কেন দেখব না? এসব ভেবে সে কৌতুহল বশত আগে লাশ পরীক্ষা করতে যেতো।
যেখানে গলা কাটা লাশ দেখে বড়রাও থমকে যায়। সেখানে মেঘ তো নিতান্ত একটা বাচ্চা। মূলত এজন্যই রোদ ওকে নিয়ে রিসোর্টে ফিরে এসেছে। তবে আলোর জন্য ওর কেন জানি খুব চিন্তা হচ্ছে। রোদ মুনকে চিনে না। সেদিন রোদের জ্ঞান ফেরার পর সে মুনকে দেখেনি। মুন ততক্ষণে ওকে পাগল ভেবে ভয়ে পালিয়েছিল। আলোর সঙ্গে মুনের কী সম্পর্ক? রোদ তাও জানে না। আলোর এভাবে ছুটে যাওয়া দেখে, রোদ মুনকে আলোর নিকট আত্মীয় ভেবে নিলো। ওর কাছের কেউ নাহলে তো এভাবে ছুটে যেতো না।
রোদ রুমে ফিরে মেঘকে বসিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওষুধ খাইয়ে নিজেও খেলো। গত রাতে রোদ ওয়েটারকে একটা ফোনের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিল, কিন্তু এখনো কোনো খবর নেই।

অফিসের কোনো খবর নিতে পারে নি। ওদিকে কী হচ্ছে কে জানে! মেঘ এখনো মুখ ভার করে বিছানায় চুপটি করে বসে আছে। ওর অবুজ মনে বড্ড অভিমান জমেছে। আলো কেন ওকে বলে গেল না? একটু বলে গেলে কী হতো? কালকে রাতে মেঘ আলোকে ওর পছন্দের চিপ্স, চকলেট, কিন্টার জয়, কোকাকোলা, ডোরা কেক দিলো। আর আজ আলো ওকে না বলেই দৌড়ে চলে গেল। এই নিয়েই মেঘের অবুজ মনটা খুব খারাপ। রোদ সামনের সোফায় বসে নিশ্চুপ হয়ে মেঘকে দেখছে। মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে মেঘের মুখটা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চঞ্চল বাচ্চাটা ভয়ে মিইয়ে গেছে। ওর মাথায়, হাতে, পায়ে, সাদা ব্যান্ডেজ। মন খারাপের ছাপ স্পষ্ট ওর ফর্সা গলুমলু মুখটাতে। মেঘের এমন নিস্তব্ধতা
দেখে রোদ উঠে মেঘকে কোলে নিয়ে পুরো রুম পায়চারী করতে লাগল। মেঘ রোদের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলাচ্ছে। এভাবে থাকতে থাকতে মেঘ ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে গেল। রোদ মেঘকে শুইয়ে কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে পাশে একটা কোলবালিশ দিলো। তারপর মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিচে গেল
আলো প্রাণপণে দৌড়ে মুনদের বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ি ভর্তি মানুষে গিজগিজ করছে। মুনের মা উঠানে বসে বিলাপ করে কাঁদছেন। তবে মুনের লাশ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আলো কাঁদতে কাঁদতে এই ঘর ও ঘর খুঁজে মুনকে পেলো না। আলোর দাদী আলোকে এভাবে ছুটতে দেখে জোর করে থামিয়ে বললেন,

“মুনরে কব্বর দিতে নিয়া গেছে। ওর কল্লা বস্তা সিলাই করা সূচ দিয়া কোনোমতে আঁটকায়া কব্বর দিবে।”
কথাটা বলে দাদী আঁচলে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। আলো একথা শুনে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। কালকে রাতে সে মুনকে দাদীর কাছে রেখে গিয়েছিল। মুন রাতে বাইরে কেন গিয়েছিল? আর কে বা ওর এই অবস্থা করেছে? জঙ্গিরা তো বৃষ্টির দিনে এদিকে আসে না। তাহলে?
এসব প্রশ্নই আলোর মনে হানা দিলো। উত্তর না পেয়ে সে হাঁটুতে মুখ গুজেঁ নিরবে কাঁদতে লাগল। মুন ওর দুই বছরের ছোট। সে খুব চঞ্চল আর সরল মনের একটা মেয়ে। মুনরা এখানকার আদিবাসী। ছোট থেকেই আলোর কোনো বান্ধবী নেই, মুনই ছিল ওর বোনরুপী বান্ধবী। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দু’জনের একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা, চলাফেরা, খুনশুটি নিয়ে ওদের দিন গুলো কাটছিল। কিন্তু আজ মুন ওকে একা রেখে নিষ্ঠুরের মতো চলে গেল।

একটুপরে প্রতিবেশীদের কানাঘুসাতে শোনা গেল, মৃত মুনকে বিবস্ত্র অবস্থায় কলা বাগানে পাওয়া গেছে। আর ওর কাটা মাথাটা একটুদূরে আলাদা ভাবে পড়ে ছিল। আলো এসব সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে ওর বাড়িতে চলে গেল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।চোখ বন্ধ করলেই মুনের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জ্বলজ্বল করে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বার বার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে মুনের বলা,’আলোবু’ ডাকটা। মুন ছিল, শ্যামবর্ণের নাক বোঁচা ছোট চোখের পাহাড়ি একটা মেয়ে। সে প্রায় আলোর হাতটা ওর কোলে নিয়ে আক্ষেপের সুরে বলত,’আলোবু তোমাল ছামী তোমালে মেলা ভালোবাছবে। তুমি কত্ত ফছসা (ফর্সা)। দেখতেও মাছাল্লাহ কত্ত সুন্দল।’
প্রায় একথা শুনে আলো একদিন ভাবলেশহীন ভাবে ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল,”ফর্সা হলে স্বামী নামক মানুষটা বেশি ভালোবাসে? একথা আদৌ কী সত্য?”
মুন খিলখিল করে হেসে উত্তরে বলেছিল,”হুম, তুমি তো জানো আলোবু সুন্দল জিনিছের দাম ছব ছময় বেশি। আল তোমাল মতো সুন্দল ফুল তো ছবাই পেতে চায়।”

মুনের একথা শুনে আলো চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। গ্রাম, শহর, দেশ, বিদেশ, সব জায়গায় মানুষ কেন জানি সাদা চামড়াকে একটু বেশিই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর
এই মনোভাব হয়তো কেউ চাইলেও কখনো পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ সমাজের এক একজন মানুষ ভিন্ন মতের অধিকারী। কেউ কেউ তো গায়ের রং নিয়ে প্রতিবাদী ভাষণ দিয়ে নিজেও খুঁজে সাদা চামড়ার মানুষ। দিন শেষে ভালো মানুষের মুখোশ ছেড়ে সবাই নিজের রুপেই ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো শ্যামবর্ণ মায়াবতীরা মনের কোণে আক্ষেপ লুকিয়ে রাখে। প্রতিনিয়ত এসব দেখে নিজেদের তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে। সাদা চামড়ার মানুষের পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করে।
আলো বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলো। সে চোখ মুছে দেখে দাদী ওর পাশে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আলো উঠে বসে কিছু বলার আগেই দাদী চিন্তিত সুরে বললেন,
“কইল রাইতে বাড়িতে..।”
উনি কথা শেষ করার আগে আলো উত্তর দিলো,”বৃষ্টির জন্য ফিরতে পারি নি। আর সন্ধ্যা হওয়াতে আমার ভালোর জন্যই উনি আসতে নিষেধ করেছিলেন।”
দাদী জহুরি চোখে আলোকে পরখ করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“ওই পোলা তোরে বিরক্ত করেনি তো? আলো সত্যি কইরা ক আমারে!”
“না, উনারা যথেষ্ট ভালো মানুষ দাদীমা।”
তখন হঠাৎ বাইরে হৈচৈ শুনে আলো দাদীকে নিয়ে দ্রুত পায়ে বাইরে বের হলো। অনেক মানুষ জটলা করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে দাদী আলোকে নিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলে। স্থানীয় মকবুল নামের একটা ছেলেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। দু’একজন যা পারছে তাই দিয়েই ওকে মারছে। আলো মকবুলকে অবস্থায় দেখে চমকে উঠল। তাৎক্ষণিক আজগুবি সব চিন্তা এসে ওর মাথায় ভর করল। সব চিন্তাকে মনের বিরুদ্ধে বিদায় দিয়ে সে মকবুলের দিকের তাকাল। ততক্ষণে মার খেয়ে মকবুলের রক্তারক্তি অবস্থা। মকবুলকে এভাবে মারতে দেখে দাদী পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলেন। এবং উনার থেকে জানা গেল , ‘মকবুল মুনকে খুন করেছে। আর ওর রুম থেকে রক্তমাখা বড় রামদা পাওয়া গেছে।’
একথা শুনে আলো হতভম্ব হয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। ওর জানামতে মুন আর মকবুল একে অপরকে খুব ভালোবাসত। তাহলে খুন করবে কেন? আলো আর কিছু ভাবতে না পেরে মাথা ধরে ওখানেই বসে পড়ল। প্রিয় মানুষটাকে এভাবে মারা যায়? তার মৃত্যুর ছটফটানি সহ্য করা যায়? আচ্ছা, মুনের রক্তাক্ত শরীর দেখে মকবুলের হৃদয় কাঁপে নি? বিবেকে কী একবারও বাঁধে নি? মুনের আঁকুতি মকবুলের কানে পৌঁছায় নি? এসব প্রশ্ন আলোর পুরো মস্তিষ্কে জুড়ে কিলবিল করছে। ওর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। আলো মুনের পরিণতি দেখে বিরবির করে উচ্চারণ করল,” দরকার নেই আমার এমন ভালোবাসার। আমি ব বা বাসব না কাউকে ভালো। ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ দু’টোই নিষ্ঠুর। আমি ভুলেও ভালোবাসার পুষ্প ফুটাব না আমার হৃদয়ে, ফুটাব না! কখনো ফুটাব না!”

কথাটা আওড়াতে আওড়াতে আলো ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
দুপুরের কড়া রোদকে উপেক্ষা করে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে রোদের উত্তাপ কমে আবহাওয়া শীতল হয়ে উঠেছে। ঘন মেঘ জানান দিচ্ছে বৃষ্টির আগমনি বার্তা। মৃদু বাতাসের গতি বাড়তে বাড়তে ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। রাস্তার ধূলো-বালি বাতাসের তোড়ে অবাধ্য হয়ে উড়তে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মাটির বুকে আছড়ে পড়তে শুরু করল। বৃষ্টির কারণে উড়ন্ত ধূলো গুলো পুনরায় রাস্তায় শান্ত হয়ে পড়ে রইল। ততক্ষণে
বৃষ্টি যেন প্রচন্ড আক্ষেপে পদবলয় পরে ঝমঝম শব্দ করে নৃত্য করতে ব্যগ্র।
রোদ দ্রুত জানালার থাই গ্লাস লাগিয়ে ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থাই গ্লাস দিয়ে অাবছা ভাবে বৃষ্টির নৃত্য দেখা যাচ্ছে। আকাশে আরো ঘন মেঘ এসে ভীড় করেছে। এখন মধ্য দুপুর। অথচ কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে মনে হচ্ছে ঠিক সন্ধ্যা বেলা। রোদ প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বাইরে দৃষ্টি রেখে আনমনে অনেক কথায় ভাবছে। তবে সব কথার সঠিক উত্তর মিলছে না। ওর এখনো অজানা, জঙ্গিরা ওদের কেন মারে নি? কেনই বা তারা মেঘকে বলি না দিয়ে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল? ওরাই বা হুট করে কোথায় চলে গেছে? এমন নানান ভাবনা এসে রোদের মনে উঁকি দিচ্ছে। আদৌ এসব উত্তর খুঁজে পাবে কী না তাও জানে না। জীবনে ঘটে যাওয়ার অনেক ঘটনারই সঠিক উত্তর সহজে মিলে না। কিছু কিছু উত্তর না চাইলেও গোপন থেকে যায়।
রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মেঘ চুপটি করে ওর পাশে দাঁড়িয় আছে। রোদ মেঘকে দেখে মুচকি হাসলে মেঘ ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো। অর্থাৎ কোলে নাও। রোদ ওকে কোলে নিলে মেঘ আদুরে ভাবে ওর গলা জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ কাঁধে ভেজা কিছু অনুভব হতেই রোদ অস্থির হয়ে বলল,

“মেঘ কী হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে, কাঁদছ কেন সোনা? আমাকে বলো, এই মেঘ!”
কথাটা বলে রোদ মেঘকে বুককে সরাতে চাইলে মেঘ আরো শক্ত করে ওর গলা আঁকড়ে ধরল। ওকে হঠাৎ কাঁদতে দেখে রোদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে আদুরে সুরে মেঘকে থামতে বলছে, বার বার জিজ্ঞাসা করছে কী হয়েছে? কিন্তু মেঘ কিচ্ছু বলছে না। রোদ নিজেকে শান্ত রেখে বিছানায় বসে আলতো করে মেঘের পিঠে হাত বুলাচ্ছে। তখন মেঘ রোদের কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“দাভাই, আম্মু যাব। তুমি এখনই আম্মুকে আমার কাছে আসতে বলো। আমি আম্মুর জন্য কষ্ট পাচ্ছি দাভাই।”
কথাটা বলে মেঘ ফুঁপিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। মেঘের কথা শুনে কষ্টের তীর এসে যেন রোদের বুকে গিয়ে বিঁধল। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থম মেরে নিরুত্তর হয়ে বসে রইল। তারপর মেঘের মতো রোদও পরপর কয়েকবার মনে মনে আওড়ালো,”আম্মু! কই তুমি আম্মু!”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[০৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

বিকালের দিকে অাদিবাসীদের গ্রাম প্রধান মকবুলকে নিয়ে বিচার বসিয়েছেন। মকবুল কিছু বলছে না। যা হচ্ছে মাথা নিচু করে মুখ বুঁজে সব মেনে নিচ্ছে। পুরো গ্রামের লোক এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সবাই রেগে চিৎকার করে মকবুলের কঠিন শাস্তি চাচ্ছে। যাতে কেউ পরবর্তীতে এই নির্মম অপরাধ ভুলেও করার সাহস না করে। বিচারক পুরো ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনে মকবুলকে বললেন,
“তুই মারচোচ ক্যান মুনরে? যা কচ্চি ছতিক জবাব দে।”
“মুন আমার সাতে ভালোবাছার অভিনয় করেচে তাই ওরে মেরেচি।”
কথাটা শুনে উপস্থিত সবার মাঝে ফিসফিস করে কানাঘুষা শুরু হলো। মুনের মায়ের অবস্থা ভালো না। মেয়ের শোকে কাতর হয়ে উনার বেগতিক অবস্থা। তাই এই বিচারে উপস্থিত হতে পারেন নি। তবে মকবুলের এই কথাটা উপস্থিত কেউ বিশ্বাস করলেন না। কারণ মুন এমন মেয়েই ছিল না। আর করলেও এত নৃশংস ভাবে খুন করতে হবে? মকবুলের এমন যুক্তিহীন কথা শুনে অনেকে রেগে মকবুলকে মারতে গেল। বিচারক দাঁড়িয়ে কোনোমতে সবাইকে শান্ত করিয়ে পুনরায় বিচারকার্য শুরু করলেন।

মকবুল মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। তবে ওর চোখে মুখে আফসোসের চিহ্নটুকু নেই। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে খুন করেও ওর বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ হচ্ছে না। মকবুলের বাবা মা এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। এই অপরাধের জন্য কঠিন একটা শাস্তি মকবুল পাবে, উনারাও জানেন। এই পরিস্থিতিতে উনারা শত চাইলেও আর ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না।
অনেক ভেবেচিন্তে বিচারক জনসম্মুখে একটা রায় ঘোষণা করলেন। মুনকে নৃশংস ভাবে মারার কারণে মকবুলের এক হাত কাটা হবে। এবং তাকে সমাজচ্যুত করা হবে। সেই সাথে তাকে কেউ কখনো কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তার সাথে ভুলেও কোনো প্রতিবেশী উঠা বসা করতে পারবে না। আর করলে তাকেও কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ মকবুল এখন থেকে একঘরা। এমনকি সে ওর বাবা মায়ের সঙ্গেও আর থাকতে পারবে না। বিচারক এই রায় শুনিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। আর মকবুলের বাবা মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। তবে বাকিরা এই রায়ে খুব একটা সন্তুষ্ট না হলেও মেনে নিলো।
আলো মকবুলের বিচার দেখতে যাওয়ার সাহস পায়নি। সে বাড়িতেই থম মেরে বসে আছে। মকবুলকে সে খুব ভালো জানত এবং সন্মানও করত। অথচ আজকে এই পরিস্থিতি

অবিন্যস্ত ভাবে সব উলটপালট করে দিলো। তবে মুনের এমন নির্মম পরিণতি আলোর মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে। এই দাগ ওর মন থেকে আদৌ মুছবে কী না তাও জানে না। এখন কারো ভালোবাসা দিয়ে, ওর হৃদয়ে প্রণয়ের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয় কী না শুধু দেখার পালা।
সন্ধ্যার পূর্বে দাদী মলিন মুখে বাড়িতে ফিরে জানালেন, আগামী পরশুদিন মকবুলের ডান হাত কাঁটা হবে। সে যাতে রাতের আঁধারে পালাতে না পারে। তাই রোদ বৃষ্টির মধ্যেও ওকে গাছে বেঁধে রাখা হবে। এবং দুই জন মকবুলকে সর্বদা পাহারা দিবে। ওর শাস্তি সম্পূর্ন না হওয়া অবধি একফোঁটা পানিও তাকে দেওয়া হবে না। এসব শুনে আলোর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে গেল। যে চিরতরে চলে গেছে, তার জন্য অন্যজনকেও অচল করে দিচ্ছে। উফ! কী নির্মম এক পরিণতি!
সময়ের চাকা ঘুরে মধ্যখানে একটা দিন কেটে গেল। কালকে রোদদের ফিরে যাওয়ার কথা। আজ আকাশের অবস্থা একটু ভালো। তাই ওরা এসেছে আলোর সঙ্গে দেখা করতে। আলো ওর ছোট্ট দোকানটা খুলে কেবল টুলের উপর বসেছে। তখন রোদ আর মেঘকে দেখে আলো ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ওরা প্রথমে আলোর বাড়িতে গিয়ে ওকে না পেয়ে এখানে এসেছে।
মেঘ আলোকে দেখে দৌড়ে এসে দুই হাত কোমরে রেখে নাক ফুলিয়ে বলল,
“ওই যে পিছনের দিনে আমাকে না বলে চলে আসলে কেন? জানো, আমি কত কষ্ট পেয়েছি।”
আলো মেঘের কথা শুনে মলিন মুখে জোরপূর্বক হেসে বলল,” আমি খুব দুঃখিত মেঘবাবু। আসলে জরুরি দরকারে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।”

“ওহ।”
মেঘ আলোর দোকানের জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। আর তোতাপাখির মতো কতশত বুলি আওড়াচ্ছে। রোদ এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনের কথা শুনছিল। রোদকে দেখে আলো তাড়াহুড়ো করে ওর টুল এগিয়ে বসতে দিলো। রোদ ওকে ব্যতিব্যস্ত হতে নিষেধ করে টুল টেনে এক পাশে বসল। আশে পাশে বেশ কয়েকটা দোকান। পর্যটকরা ঘুরে ঘুরে তাদের পছন্দসই জিনিস কিনছে। দরদাম করতে করতে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটিও হচ্ছে। রোদ সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলোর দিকে তাকাল। মেয়েটার মলিন মুখশ্রী দেখে স্পষ্ট , সে ভালো নেই। কিছুক্ষণ আগেও হয়তো কেঁদেছে। ওর চোখসহ টিকালো নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। পরিহিত মেরুন রংয়ের থামির সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে ওড়না নিয়েছে। ফর্সা শরীরে গয়না বলতে কিচ্ছু নেই। যাকে বলে একদম সাদামাটা। রোদ এবার নিজে থেকেই কথা বলল,
“তোমার পুরো নাম কি?
রোদের কথা শুনে আলো মৃদু হেসে উত্তর দিলো, “আমার পুরে নাম আতকিয়া ইবনাত আলো। সবাই আমাকে আলো বলে ডাকে।”
রোদ ওর নাম শুনে পুরো দোকানে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“বাহ! অনেক সুন্দর নাম। তা তুমি কী এই পোশাক গুলো নিজে বানাও?”
“জি।”

“আসলে কালকে আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। এজন্য আজ আমরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
ওরা চলে যাবে শুনে আলোর মনটা কেন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। সে বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ছোট করে উত্তর দিলো, “ওহ।”
তখন কয়েকজন পর্যটক এসে আলোর দোকানে এটা ওটা দেখে না কিনেই চলে গেল। ব্যাপারটা রোদের কাছে খারাপ লাগলেও বুঝতে দিলো না। এমন অনেকে আছে। যারা অযথা দোকানদার খাঁটিয়ে পছন্দ হচ্ছে না বলে চলে যায়। তবে এই নিয়ে আলোর মধ্যে কোনো খারাপ লাগা দেখা গেল না। এটা ওর কাছে এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। ওর দোকানে যা আছে সব মেয়েদের জিনিসপত্র। তাই আলো মেঘকে দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সে পুরো দোকানে চোখ বুলিয়ে তাঁতের তৈরি একটা গামছা মেঘকে দিলো। ছোট সাইজের গামছা পেয়ে মেঘের চোখ দু’টো চকচক করে উঠল। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ওয়াও! গামছাটা খুব সুন্দর হয়েছে বউমনি।”
মেঘের ‘বউমনি’ ডাকটা আলো ঠিক বুঝতে না পেরে বলল, কী বললে মেঘবাবু?”

আলোর কাছে ধরা খেয়ে মেঘ আড়চোখে একবার রোদের দিকে তাকাল। তারপর দাঁত বের করে হেসে সাহস নিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি খুব ভালোবেসে বউমনি ডাকলাম। তুমি রাগ করো না প্লিজ!”
মেঘের কথা শুনে রোদের মধ্যে কোনো জড়তা কাজ করল না। সে টুলের উপর বসে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পাহাড় দেখছে। মেঘের কথা আলো তেমন ভাবে আমলে না নিয়ে মুচকি হাসল। কালকে ওরা চলে যাবে। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। তাই সে নিষেধ করে বাচ্চাটার মন খারাপ করল না। রোদ মেঘের কথাটা এড়াতে, আলোকে টুকটাক প্রশ্ন করে অনেক কিছুই জানতে পারল। আলোরও ওদের সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওর মনটা একটু হয়েছে।
একটুপরে, আলো ওদের বসতে বলে সামনের দোকান থেকে পাঁকা পেঁপে , আখ, আর পেয়ারা কেটে ধুয়ে এনে ওদের খেতে দিলো। রোদ এখানেও এই মেয়ের অতিথিপরায়ণতা দেখে বেশ অবাক হলো। সে আসা অবধি দেখছে দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয় নি। তবুও মেয়েটার মধ্যে মন খারাপের রেশটুকুও নেই। মেঘ পাঁকা পেঁপে দেখে ফট করে তুলে খেতে লাগল। তারপর মুখ ভর্তি পেঁপে নিয়ে অস্পষ্ট ভাবে রোদকে বলল,

“উম! উম দ দা দাভাই এ একটা খাও, দারুণ খেতে।”
রোদ মেঘকে আস্তে ধীরে খেতে বলল, নাহলে আবার ওর গলায় আঁটকে যেতে পারে। রোদের পেঁপে পছন্দ না। তাই না খেয়ে চুপ করে বসে আছে। আলো নিজে উঠে রোদের দিকে পেঁপে এগিয়ে দিলো। রোদ ভদ্রতা সূচক একটা পিস তুলে মুখে নিয়ে বেশ অবাক হলো। সত্যিই পেঁপেটা দারুণ খেতে, খুব মিষ্টি! ঢাকায় হ্যারিকেন নিয়ে খুঁজলেও এমন মিষ্টি পেঁপে পাওয়া যাবে না। মেঘ তো এবার রোদকে পেঁপের ভাগ দিতে নারাজ। তাই আলো হেসে রোদের জন্য আরেকটা আনতে চাইল। রোদ ওকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করল। তারপর রোদ গামছা আর ফলের টাকা আলো দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু আলো টাকা না নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“উপহারের টাকা নিতে নেই। আমি গরীব, আমার সাধ্যমতে মেঘবাবুকে একটা উপহার দিয়েছি। আপনি টাকা দিয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না।”
আলোর কথা শুনে রোদ রুমালে মুখ মুছে মুচকি হেসে বলল,
“বেশ, উপহারের টাকা নিও না। তবে ফলের টাকাটা নাও। এবার টাকা ফিরিয়ে দিলে আমরা সত্যিই আর আসব না, আগেই জানিয়ে দিচ্ছি।”

-‘এলোকেশী’-
[০৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আলোর কথা শুনে রোদ মুচকি হেসে বলল,”বেশ, উপহারের টাকা না’হয় নিও না। তবে ফলের টাকাটা নাও। এবার টাকা ফিরিয়ে দিলে সত্যিই আমরা আর আসব না, আগেই জানিয়ে দিচ্ছি”
“বউমনি লজ্জা পেও না, নাও।”
”ধরো।”
তবুও আলো মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। টাকাটা নিতে ওর কেন জানি খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তাছাড়া ভালোবেসে কাউকে কিছু খাইয়ে দাম নেওয়াটা বড্ড বেমানান। আর এই মূহূর্তে আলো সেটা রোদকে বোঝাতে অক্ষম। আর রোদও নাছোড়বান্দা। এই পরিস্থিতিতে আলোকে একরাশ অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরেছে। ওর মস্তিষ্ক বলছে, ‘টাকাটা অনায়াসে গ্রহন করতে।’ কিন্তু ওর অবুজ মনটা প্রতিবাদী সুরে বলছে, খবরদার না! টাকাটা নিলেই ভালোবেসে কিছু করাটা ফিকে হয়ে যাবে।’ আর সব জায়গায় টাকার খেলা চলে না। কিছু কিছু জায়গায় টাকাকে গো হারান হারতে দেওয়া উচিত। বিশেষ করে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কাছে। যদিও বাস্তবিক ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিপরীত কিছু ঘটে। পরিস্থিতি মোতাবেক টাকা হারিয়ে দেয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে। প্রাণপণে লড়াই করেও প্রাপ্তি মিলতে দেয় না। এভাবে টাকার জোর জিতে যায়। আর হেরে যায় নিগূঢ় ভালোবাসাটুকু।
এই কয়েক মিনিটের মধ্যে আলো একবার এসব কথা ভেবে নিলো। সে মস্তিষ্ক আর মনকে পাত্তা না দিয়ে বিবেকের কথা শুনল।
আলোকে চুপ থাকতে দেখে রোদ মেঘের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”মেঘ চলো। আমাদের এখন রিসোর্টে ফিরতে হবে।”
“আর একটু থাকি দাভাই?”

“জেদ করবে না মেঘ। ভালো ছেলেরা অকারণে জেদ করে না।”
রোদের কথা শুনে আলো অন্য দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,”এ একশ টাকা দেন।”
আলোর কথা শুনে রোদ মেঘ দু’জনেই পাশ ফিরে ওর দিকে তাকাল। আলো মুখ কাঁচুমাচু করে অন্য দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল মোচড়াচ্ছে। রোদের ওয়ালেটে সব এক হাজার টাকার নোট। তাছাড়া ওর প্যান্টের পকেটে খুচরা থাকলেও সে ইচ্ছে করেই বের করছে না। সে মূলত এই মেয়েটার জেদ দেখতে চাচ্ছে।
সকাল থেকে আলোর দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয়নি। রোদ চাচ্ছে, আবডালে আলোকে একটু সাহায্য করতে। আর মেয়েটা ওর থেকে টাকা নিতে নারাজ। হয়তো একেই বলে আত্মসন্মানবোধ!

রোদ মুচকি হেসে এক হাজার টাকার নোট আলোর দিকে পুনরায় এগিয়ে দিলো। আলো উপায় না পেয়ে টাকাটা ধরে মেঘকে নিয়ে ফলের দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। রোদ টুলের উপর চুপ করে বসে ওদের যাওয়া দেখছে। আলোর জায়গায় অন্য কেউ হলে টাকাটা হয়তো এভাবে ফিরিয়ে দিতো না। অথচ এই মেয়েটা! মেয়েটা সত্যিই সরল মনের।
ওইদিকে আলো মেঘকে বিভিন্ন ধরনের ফল, মোয়া, ভাজা বাদাম, এবং নানান ধরনের আচারসহ অনেক কিছু কিনে দিলো। ফলের দোকানে আগের দেড়’শ এবং এখনকার কেনা ফল মিলে সাড়ে তিন’শ টাকা দিলো। এতগুলো জিনিস পেয়ে মেঘের তো আর খুশি ধরছে না। সে খুশিতে তৃপ্তির হাসি হেসে আয়েশ করে পেয়ারাতে কামড় দিচ্ছে। আলো জিনিস গুলো কিনে ওর দোকানে ফিরে আসল। তারপর অবশিষ্ট টাকাটা
রোদের হাতে দিলো। আলোর এমন কাজে রোদের খুব রাগ হলেও বুঝতে দিলো না। তবে সুযোগ পেলে সেও অবশ্যই সৎ ব্যবহার করবে।

তখন বেশ কয়েকজন মেয়ে এসে দোকানের সামনে উপস্থিত হলো। রোদকে দেখে নিজেরা ফিসফিস করে কী যেন বলছে, আবার মুখ টিপে হাসছে। একটা মেয়ে আলোকে উপেক্ষা করে রোদকে জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞাসা করল। রোদ তো কোনোটারই সঠিক মূল্য জানে না। তাই সে আলোকে দাম বলতে ইশারা করল। তখন একজনের কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আরেকটা মেয়ে বলল,
“তা আপনার নাম কি ভাইয়া? আর আপনি কোন রিসোর্টে উঠেছেন?”
মেয়ে গুলো আলোর দেখানো জিনিসপত্র না দেখে রোদকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে। এই দোকানে সুদর্শন একজন যুবককে দেখে ওরা বেশ অবাক হচ্ছে। তাই কৌতূহল বশত নানান প্রশ্ন করছে। মেঘ ওদের মাঝখানে বসে একবার রোদের দিকে তো একবার মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আবার আলোকে দেখছে। মেয়ে গুলোর হাবভাব বুঝতে পেরে রোদ উঠে আলোর থেকে দাম জেনে অকপটে মেয়েগুলো বলল,

“আপনারা কী সত্যি কিছু নিবেন? নিলে বলুন, আমি নিজে আপনাদের সেগুলো দিচ্ছি। আর না নিলে ওই যে ওটা চলে যাওয়ার রাস্তা।”
রোদের মৃদু হাসি মিশ্রিত ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে মেয়েগুলো একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর একটা করে জিনিস পছন্দ করে রোদকে দাম জিজ্ঞাসা করতে লাগল। রোদ মৃদু স্বরে আলোর থেকে দাম জেনে মেয়ে গুলোকে জানাল। মেয়ে গুলো তাদের পছন্দ মতো আরো জিনিস দেখতে লাগল।আর আলো রোদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সে যে দাম বলেছে, রোদ তার চেয়ে পঞ্চাশ টাকা বেশি বলেছে। এর মধ্যে একটা মেয়ে ওর হাতে নীল কাঁচের চুড়ি পরতে পরতে রোদের ফোন নাম্বার চাইল। রোদ কথাটা শুনে এর প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলল,
“এই থামি দু’টো দেখতে খুব সুন্দর। আপনি চাইলে নিতে পারেন।”
রোদের এমন উত্তর মেয়েটা মোটেও আশা করে নি। সে বুঝল রোদ খুব চতুর বটে। এজন্য কথা শুনেও এভাবে এড়িয়ে গেল। মেয়েগুলো প্রায় বারো থেকে চৌদ্দ জনের মতো ছিল। তন্মধ্যে কয়েকজন গায়ে পরা হলে বাকিরা যথেষ্ট ভদ্র ছিল। ওরা সবাই নিজেদের পছন্দসই কিছু না কিছু কিনল। তারপর দাম মিটিয়ে একে একে স্থান ত্যাগ করল। ওদের দেখে আরো কয়েকজন এসে দোকানে ভিড় করল। রোদ নিজে তাদেরও পছন্দসই জিনিস গুলো দিলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে রোদ চার হাজার দুই’শ সাতাশ টাকার বিক্রি করল। বৃষ্টির কারণে কয়েকদিন ধরে আলোর দোকানে একদমই বিক্রি হয় নি।

পর্যটকরাও বৃষ্টির কারণে পাহাড়ে ঘুরতে আসে নি। আর ওদের দোকান গুলোই চলে পর্যটকদের কেন্দ্র করে। আজ এতগুলো টাকা বিক্রি হতে দেখে আলোর মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠল। রোদ টাকা গুলো আলোর দিকে বাড়িয়ে দিলো। সে আলোকে তখন চাইলেও সাহায্য করতে পারে নি। তাই এখন এভাবে সাহায্য করল। আর কাস্টমারকে তেল না মারলে দোকানে বিক্রি হয় না। সে তেল না মারলেও, মেয়ে গুলোর কৌতুহল বশত ওর সঙ্গে কথা বলাটাকেই কাজে লাগাল। অন্য সময় হলে অনেক আগেই এখান থেকে উঠে চলে যেতো। শুধু আলোর জন্য এতটুকুন করল। তাছাড়া আলো এই অবধি ওদের অনেক সাহায্য করেছে। ওর জন্য কিছু করতে পারলে ওর নিজেরও ভালো লাগবে। তবে আলো বেশ বুঝেছে, রোদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং চালাক। নাহলে কথা দিয়ে মেয়েগুলো এত সহজে কাবু করে এত টাকা বিক্রি করতে পারত না। যদিও এখান থেকেও আলো রোদের নিরহংকারের পরিচয় পেয়েছে। তাছাড়া রোদদের বেশভূষা উচ্চমানের হলেও ওরা বেশ মিশুক।

আলোর মুখে মিষ্টি হাসি দেখে রোদ একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ওর ভাষ্যমতে, মেয়ে মানেই মায়াবিনী। কখন না জানি এই মেয়ে ওকেই কঠিন মায়াতে জড়িয়ে ফেলে।আর সে কারো মায়াতে জড়াতে ইচ্ছুক নয়। এভাবেই তো বেশ আছে! আচানক আলোকে জিনিসপত্র গুছিয়ে দোকান বন্ধ করতে দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখনই দোকান বন্ধ করছ কেন? সারাদিনে তো আরো বিক্রি হতে পারে।”
রোদের কথা শুনে আলো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“উহুম, আপাতত আর লাগবে না। এই টাকাতে আমাদের অনেক দিন চলে যাবে। আল্লাহর রহমতের উছিলায় আজ আপনারা আমার সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন, তাই হয়তো এত টাকা বিক্রি হলো। আর এখন আমি অনেক অনেক খুশি। তাই দাদীমাকে এই কথাটা জানাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাচ্ছি।”

রোদ ওর এই কথার জবাবে আর কিছু বলল না। মাত্র চার হাজার টাকা বিক্রি হওয়াতে আলো কত্ত খুশি। ওর তৃপ্তির হাসিতে মুখে আলাদা এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। অথচ রোদের কোটি কোটি টাকা লাভ করেও হাসতে ইচ্ছে করে না। আলোর মতো খুশি রোদের মনে কখনোই জাগে নি। শুধু মনে হয়েছে, সে কষ্ট করেছে তাই প্রাপ্তি মিলেছে। তবে আলোকে হাসতে দেখে রোদ মুখেও মৃদু হাসি ফুটল। যেটা আলোর আর নজরে পড়ল না।
এদিকে আখ খেতে গিয়ে মেঘ মুখে গুঁতো খেয়ে বসে আছে। ওর দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রোদ কিছু বলার আগে আলো পানি এনে মেঘকে কুলি করাল। অনেক টাকা বিক্রি হলো আর মেঘরা কালকে চলে যাবে। আর হয়তো চাইলেও আর দেখা হবে না। তাই আলো আজ দুপুরেই ওদের নিমন্ত্রণ করল।
রোদকে কিছু বলতে না দিয়ে মেঘ লাফিয়ে উঠে রাজি হয়ে গেল। এই ব্যাপারটা রোদের কাছে দৃষ্টিকটু লাগল। মেয়েটা এই পর্যন্ত ওদের জন্য অনেক করেছে। তাই সে আর আলোর কষ্ট বাড়াতে চাচ্ছে না। তাছাড়া রোদ সেদিন দেখেছে, ওদের খেতে দেওয়ার সময় আলোর মুখের সংকোচ ভাবটা। আলো সেদিন ওদের খেতে দিতে লজ্জা পাচ্ছিল, রোদ ব্যাপারটা অতি সহজে বুঝেছিলও। তাই সে আর মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছে না। আর এই ব্যাপারটা রোদ আলোকে বুঝতে না দিয়ে বলল,

“আজ না, পরবর্তীতে যখন আসব তখন তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করব। আকাশের অবস্থাও ভালো না। এখন আমাদের ফিরতে হবে।”
কথাটা শুনে আলোর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। সেদিনের খাবার রোদের পছন্দ হয়নি। তাই হয়তো রোদ আর যেতে চাচ্ছে না। একথা ভেবে আলো লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। রোদের কথা শুনে সে জোর করার সাহসও পেলো না। আর জোর করার অধিকারও ওর নেই। আলো মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে সামনে পা বাড়াল। আলোর মলিন মুখ দেখে মেঘ রেগে রোদের দিকে আর তাকাল না। বরং রোদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোড়ামুড়ি করতে লাগল। আলো আশা নিয়ে আর একবার পেছনে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। রোদও কেন জানি ওর মলিন মুখ দেখে খুব খারাপ লাগছে। তাই মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে আলোকে পিছু ডেকে বলল,
“না বলেছি বিধায় একাই চলে যাচ্ছ, আমাদেরকে কী আর সঙ্গে নেওয়া যায় না?”
এই কথা শুনে আলো থমকে দাঁড়িয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল,”আপনারা যাবেন?”
“হুম চলো।”

মেঘ ততক্ষণে দৌড়ে গিয়ে আলোর আঙ্গুল ধরে সামনে হাঁটা ধরেছে। আর রোদ ফলের ঝুড়ি নিয়ে ওদের পেছনে হাঁটছে। আলোর মুখে পুনরায় হাসি ফুটেছে। এই মেয়েটার মায়াবী মুখটাতে মিষ্টি হাসি বেশ মানায়। মলিন মুখটা ওর জন্য বড্ড বেমানান। তাই রোদ চাইলেও পারল না, মেয়েটার মুখের হাসি কেড়ে নিতে।
আলো ওদের নিয়ে নিচে নামতে নামতে আঙ্গুল দিয়ে পাহাড় দেখাল। পাহাড় নিয়ে দু’একটা তথ্যও জানাল। মাথার উপরে
স্বচ্ছ নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে সারি সারি মেঘের ভেলা। কয়েকটা নাম না জানা পাখি উড়ে যাচ্ছে তাদের নিজ গন্তব্যে। পাহাড়ের মাটিতে জন্মেছে অসংখ্য গাছপালা। ওই অদূরে পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মেঘ পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়া দেখে মুখ হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। আলো ওর হাসির কারণ বুঝলেও রোদ ঠিকই বুঝল। দুষ্টুটার মাথায় সব সময় দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরে। আশপাশের গাছ থেকে বুনো পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।

গল্প করতে করতে আলো ওদের নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। দাদীমা এখন বাড়িতে নেই। হয়তো মুনের মায়ের কাছে গিয়ে বসে আছে।
আলো মেঘ আর রোদ কে মাদুর পেতে বসতে দিলো। রোদ বসে পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সেদিনও সে খেয়াল করেছে, আলোর বাড়িটা ছোট হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দাদীমার রুমের পাশেই একটা তাঁত রাখা। এটা দিয়েই আলো কাপড় বুনে। আলো ওর বাড়ির বিপরীত পাশে গিয়ে বেশ কয়েকটা কমলা ছিঁড়ে আনল। সেখানে সেই লাগিয়ে কমলার গাছগুলো। ছোট সাইজের কমলা হলেও খেতে খু্ব মিষ্টি! রোদ কমলার খোঁসা ছিঁড়ে দিচ্ছে আর মেঘ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। রোদ আলোকে দাদীমার কথা জিজ্ঞাসা করল। আলো জানাল, একটু পরেই দাদীমা চলে আসবে। আলো দাদীমার হাতে বানানো বাটি ভর্তি মোয়া এনে ওদের খেতে দিলো। তারপর ওদের বসতে বলে, সে ঝটপট রান্নার কাজে লেগে গেল। একটু পরে, একজন শ্যামবর্ণ হ্যাংলা পাতলা যুবক এসে একটা হাঁস দিয়ে গেল। আলো হাঁসটা কেটে পরিষ্কার করে ঝাল করে ভুনা করলো পাকু মরিচ দিয়ে (মুম্বাই মরিচ)। এই এলাকার মানুষ এটাকে পাকু মরিচ বলে।

উঠানে একটা সাদা বাচ্চা ওয়ালা মুরগি দেখে মেঘ গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। সে মুরগির থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে বাচ্চা গুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ওয়া, ওয়া কত্ত সুন্দর বাচ্চাগুলো।”
রোদ মেঘকে দেখে সুন্দর করে বলল,”মেঘ খুব কাছে যেও না। মুরগি রেগে যাবে।”
“আচ্ছা দাভাই।”
মেঘ ওখানেই বসেই শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে একটা একটা করে বাচ্চা গুনতে লাগল। মুরগিটা বাইশটা বাচ্চা নিয়ে পুরো উঠান জুড়ে ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার বাইশটা বাচ্চাই কালো। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে রোদের দিকে একবার তাকিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল। এত সুন্দর বাচ্চা না ধরে সে শান্তি পাচ্ছে না। আর ধরতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলল। মুরগি রেগে কক কক শব্দ করে ওকে দৌড়ানি দিলো। আর মেঘ দাভাই! বউমনি! উু উু বাঁচাও! বলে চিৎকার করছে আর দৌড়াচ্ছে। সে যেদিকে যাচ্ছে মুরগিটাও সেদিকে যাচ্ছে। আর মুরগির পেছনে পিকপিক শব্দ করতে করতে বাচ্চা গুলো আসছে।
তখন দাদীমা এসে মেঘকে মুরগির থেকে উদ্ধার করল। মেঘ মনে মনে মুরগিকে অনেক বকা দিয়ে আলোর পাশে গিয়ে পিঁড়া নিয়ে বসল। দাদীমা রোদের সাথে টুকটাক কথা বলে উনার রুমে চলে গেলেন।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৪+৫+৬

মেঘ আলোর পাশে বসে সমানে বকবক করছে, আর মোয়া খাচ্ছে। আলো খুদের ভাত, বুনো হাঁসের মাংস, মাছ ভাজা, শাক পাতা আর আমড়ার চাটনি রান্না করছে। মেঘের হঠাৎ চোখ গেল অদূরে বেঁধে রাখা একটা মানুষের দিকে। সে আবার উঠে ওইদিকে হাঁটা ধরল। রোদ একমনে ফোন স্কল করছিল। আর আলো রান্নার ব্যস্ততায় রোদের কাছে যাচ্ছে ভেবে আর খেয়াল করল না। মেঘ কৌতুহল বশত গুটি গুটি পায়ে ওই মানুষটার সামনে গিয়ে বলল,
” কী হয়েছে? তোমার মুখে এত রক্ত কেন? কে মেরেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
হঠাৎ বাচ্চার কন্ঠে শুনে মকবুল ধীরে ধীরে ওর চোখ দু’টি খুলল। ফুটফুটে একটা বাচ্চা কোমরে হাত দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী সুন্দর আদুরে ভাবে কথাগুলো বলছে! মকবুলকে তাকাতে দেখে মেঘ পুনরায় একই কথা বলল। মকবুল শুকনো একটা ঢোক গিলে খুব কষ্ট উচ্চারণ করল, “পা পানি খাব।”

“দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।”
কথাটা বলে মেঘ দৌড়ে চলে গেল পানি আনতে। মকবুলকে এখনো গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে একফোঁটা পানিও দেওয়া হয় নি। বিচারকের কড়া আদেশ তাকে কেউ পানি দিবে না। কেউ আদেশ অমান্য করলে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। অবুজ মেঘ এসবের কিছু জানে না। সে শুধু জানে, কোনো তৃষ্ণার্ত ব্যাক্তি পানি চাইলে তাকে পানি দিতে হয়। এতে আল্লাহ খুব খুশি হয়। আর আল্লাহ খুশি হলে যা চাওয়া যায়, সব পাওয়া যায়!

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১০+১১+১২