এলোকেশী কন্যা পর্ব ১০+১১+১২

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১০+১১+১২
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদ আশেপাশে তাকিয়ে মেঘকে কোথাও না দেখে উঠে দাঁড়াল। এই ছেলেটা একদন্ড স্থির থাকে না। বাসাতে যেমন চঞ্চল বাইরেও তেমন। রোদ বিরক্ত নিয়ে মেঘকে খুঁজতে সামনের দিকে পা বাড়াল। মেঘ হাঁটু গেড়ে বসে আলোর রুমে রাখা মাটির কলস থেকে পানি ঢালছে। তাড়াহুড়ো করে পানি ঢালতে গিয়ে অনেকখানি পানি মেঝেতে পড়ে গেল। মেঘ দ্রুত উঠে পাপোশ দিয়ে পানিটুকু ঢেকে দিলো। যাতে কেউ দেখে বুঝতে না পারে। এই গোপন কাজটা করে মেঘ দাঁত বের করে হেসে উঠে দাঁড়াল। তখন রোদ রুমে এসে মেঘকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “পানি কী করবে, খাবে? আর আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছিলে?”

“দাভাই, একটা মানুষ পানি খাবে।”
“কোন মানুষ?”
মেঘ পানি হাতে নিয়ে মকবুলের কথাটা রোদকে জানাল। কথাটা শুনে রোদের কপালে ভাঁজ পড়ল। একটা মানুষকে তো আর কেউ এমনি আঁটকে রাখে নি। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! তাছাড়া এখানকার মানুষ গুলোও সুবিধার না। আগ বাড়িয়ে কিছু করে বিপদে পড়া যাবে না। যা করতে হবে জেনে বুঝে ভেবে করতে হবে। তাছাড়া ওদের একটা ভুল পদক্ষেপে আলোরা বিপদে সম্মুখীন হতে পারে। আর এটা সে কখনোই চায় না।
রোদ কিছু একটা ভেবে আলোকে মৃদু স্বরে ডাকল। আলো রোদের ডাক শুনে চুলার আঁচ কমিয়ে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। রোদ তখন দুই পকেটে হাত গুঁজে অকপটে জিজ্ঞাসা করল,
“ওই ছেলেটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?”
আলো ঘাড় ঘুরিয়ে মকবুলের দিকে একবার তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে কম্পিত কন্ঠে বলল,
“সে খুনী। তাকে খুনের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”
”কাকে খুন করেছে আর কেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আলো চোখ মুছে রোদের দিকে তাকিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
“ভালোবাসলে নাকি কঠিন মূল্য চুকাতে হয়। আমার বান্ধবীও ওকে ভালোবেসে খুন হয়ে নিদারুন ভাবে মূল্য চুকিয়েছে। ওই পাষাণ মানুষটা নিজে হাতে আমার বান্ধবীকে খুন করেছে। এর মধ্যে কেন বা কিন্তুর সঠিক মানে আমি জানি না, আর বুঝিও না। মূখ্য কথা ওরা ভালোবেসে পাপ করেছে। এখন তার শাস্তি ভোগ করছে।”
কথাটা বলে আলো চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে হেঁটে স্থান ত্যাগ করল। রোদ অবাক চাহনি নিয়ে আলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো এভাবে বলার কারণটা সে বুঝল না। ‘ভালোবাসা’ শব্দটা প্রতিবার উচ্চারণ করার সময় ওর কথায় ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছিল। ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করে ওর চোখ দু’টো রাগে দপদপ করছিল। আলো হয়তো কোনো কারণে ভালোবাসাতে বিশ্বাসী না। অথবা কারণ বশত সে ভালোবাসাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। আর সেটা ওর বলা কথার ধরণ থেকে স্পষ্ট। নরম এবং সরল মনের মেয়েটাকে এত কঠিন কথা বলতে দেখে রোদ বেশ অবাক হয়েছে। রোদ ওর নিচের ঠোঁট কামড়ে পাশ ফিরে দেখে মেঘ নেই।
সে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইরে বের হয়ে দেখল, মেঘ দু’টো ইটের উপর দাঁড়িয়ে একটা ছেলেকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। তবে ছেলেটা বেশ লম্বা হওয়াতে ঠিক মতো পানি খেতে পারছে না। রোদ আশে পাশে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। মেঘেরও ইটের উপর দাঁড়িয়ে পানি খাওয়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে কাউকে না দেখে রোদ সেদিকে এগিয়ে গেল। আলোর কথা শুনে সে বুঝছে, এখানে নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে। রোদ মেঘকে কোলে তুলে মকবুলকে পানি খাওয়াতে সাহায্য করল। পানি খাওয়াতে পেরে মেঘের মুখে বিশ্বজয় করা হাসি ফুটল। রোদ মেঘকে কোল থেকে নামিয়ে মগটা বাড়িতে রেখে আসতে বলল। নাহলে কেউ ওদের দেখলে খুব বকবে। মেঘ রোদের কথা শুনে দৌড়ে মগ রাখতে চলে গেল। মকবুল ওদের চিনে না। এর আগে কখনো দেখেও নি। তাই সে কিছু বলার আগে রোদ বলল,

“আমাদেরকে আপনি চিনবেন না। তবে শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারেন।”
“আপনেও চইলা যান। আমার পাছে আপনারে দেকলে ছা ছা ছাস্তি দেওন হইবে।”
মকবুল অনেক কষ্টে কথাটা বলে ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকাল। ওর জন্য এই নির্দোষ মানুষ গুলো শাস্তি পাক, সে মোটেও চাচ্ছে না। ছেলেটা সত্যিই খুব খারাপ হলে রোদকে চলে যাওয়ার বলত না। আলোর বলা কথা আর মকবুলের হাবভাব দেখে রোদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হলো। সে কিছু একটা ভেবে মকবুলকে জিজ্ঞাসা করল,
“চোখে দেখা সব ঘটনা সত্যি হয় না। কখনো কখনো এর পেছনেও কিছু অজানা সত্য লুকিয়ে থাকে। শুধু এতটুকুই বলতে পারি, আপনার এই নিকৃষ্ট কাজে কেউ ভালোবাসার মতো পবিত্র বন্ধনকেও ঘৃণা করছে। পবিত্র ভালোবাসাকে অখ্যাতিকর বলে আঙ্গুল তুলছে।”
কথাটা বলে রোদ আর দাঁড়াল না। মকবুল কথাগুলো শুনে ছলছল চোখে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে দু’একবার উচ্চারণ করল,

”বলোবাছি, আমাল বালোবাছার পিরিও মানুচতাকে। এতা না কেউ দেকবে আল না কেউ জানবে।”
কথাটা বলে মকবুল মৃদু হাসল। ওদিকে মেঘ মকবুলের বাঁধন খোলার জন্য জেদ ধরেছে। সে রশি কাটার জন্য আলোর থেকে আঁশবটি চাচ্ছে। আলো পড়েছে মহাবিপদে। মকবুলের রশি কাটা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। এই ভুল মোটেও করা যাবে না। রোদ মেঘের জেদ দেখে রাগ সংযত করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চুপ করে বসো। আমি তোমার মুখে আর একটা টু শব্দও শুনব না। নাহলে এর ফল খুব খারাপ হবে।”
রোদের রাগের আভাস পেয়ে মেঘ গুটিশুটি হয়ে আলোর পাশে বসল। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার মকবুলের দিকে তাকাল। লোকটার মুখ দেখে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন যে শুধু শুধু লোকটাকে এত কষ্ট দিচ্ছে, কে জানে!
আলো ততক্ষণে ওর রান্না সম্পূর্ণ করে ওদের খেতে দিলো। মেঘ মন খারাপের সুরে বায়না ধরল এখন আলোর হাতে খাবে। আজ কেন জানি মেঘ একটার পর একটা বায়না করতেই আছে। এজন্য রোদ বিরক্ত হয়ে আলোর সামনেই পুনরায় ওকে বকলো। আর সব জায়গায় সব জেদ শোভা পায় না। রোদ নিজে মেঘকে খাইয়ে দিতে ওর দিকে এগিয়ে গেল। মেঘ অভিমান করে উল্টো ঘুরে ওর দিকে পিঠ করে বসল। অর্থাৎ সে রাগ করেছে। তখন রোদেকে অবাক করে আলো মেঘের মুখে খাবার তুলে দিলো। রোদ যদিও এতটা আশা করে নি। সে কিছু বলতে গেলে আলো ইশারায় নিষেধ করে রোদকে ভাত বেড়ে দিলো। রোদ এর আগে কখনো খুদের ভাত খায়নি। তবে এখানে এসেই ওর এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছে। আলো একে একে রোদকে সব পদের তরকারি তুলে দিয়ে মেঘকে খাওয়াতে লাগল। রোদ আর বসে না থেকে হাত ধুয়ে একলোকমা ভাত তুলে মুখে দিলো। একে একে সব পদ একটু করে খেয়ে সে বেশ অবাক হলো। কারন প্রতিটা পদে ভিন্ন ধরনের সুস্বাদু একটা স্বাদ রয়েছে। হাঁসের মাংসটা একটু বেশিই ঝাল ঝাল। তবে খেতে দারুন লাগছে খেতে। মেঘের তো চাটনি টা খুব পছন্দ হয়েছে। এজন্য সে মুখ ফুটে বলেই ফেলল,

“বউমনি, যাওয়ার সময় এই খাবারটা একটু দিও তো। এটা খেতে খুব মজা।”
মেঘের কথা শুনে আলো হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
দাদীমা গোসল সেরে মুনের মায়ের কাছে ভাত নিয়ে গেছে। মুনের মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাই উনি প্রায় সময় ওখানেই থাকেন। আলো মেঘকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। রোদ অনেকদিন পর আজ তৃপ্তি করে খেয়েছে। ওর বাসায় বুয়াদের হাতের রান্না খেয়ে মুখে একটা অরুচি এসে গিয়েছিল। মেঘ তো পেটপুরে খেয়ে পা টান টান করে শুয়ে আছে। খাওয়ার ছলে ক্ষণিকের জন্য সে মকবুলের কথা বেমালুম ভুলে গেছে।
পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টি আসার সময় অসয়ম নেই। আকাশে মেঘ জমলেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এখন আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যখন তখন অঝরে বৃষ্টি নামতে পারে।
তাই রোদ ফিরে যাওয়ার জন্য মেঘকে তাড়া দিতে লাগল।
আলো মেঘকে, মোয়া, তিলের নাড়ু আর চাটনি দিলো। মেঘ তো খুব খুশি। মেঘদের সঙ্গে আলোর হয়তো আর দেখা হবে না। একথা ভাবলেই সে মনে চাপা একটা কষ্ট অনুভব করছে। ওর মনে হচ্ছে, মেঘরা ওর খুব কাছের কেউ। এজন্য বিদায় বেলায় সে কষ্ট পাচ্ছে।
মেঘ তো বউমনি! বউমনি! করে আবার গল্প জুড়ে দিয়েছে। তোতাপাখির মতো কতশত বুলি আওড়াতে আছে। আলো মেঘের এমন আদুরে ডাক শুনে মলিন মুখে হেসে বলল,

“মেঘবাবু, আমাকে আর বউমনি ডাকবে না কেমন। এখন থেকে মিষ্টি ডাকবা। ‘বউমনি’ সম্বোধনে আমার কেমন যেন লাগে।”
কথাটা শুনে রোদ ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে আলোর দিকে তাকাল। আলো তাকাতেই ওদের দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। আলো দ্রুত ওর দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। তখন মেঘ দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তোমাকে আমি বউমনি বলেই ডাকবো। এই বারণ আমি মোটেও শুনব না, হুম।”
মেঘের কথা শুনে রোদ আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এই ছেলে প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া। সে কারো কথাতেই কর্ণপাত না। ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
“হুম।”
কিছুদূর এগিয়ে দিতে আলো ধীর পায়ে ওদের পিছু আসল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা বুনো বানর দেখা গেল। বানরটা লাফিয়ে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। বানর দেখে মেঘ ভয়ে পেছনে ঘুরে আলোকে জাপটে ধরে। আলোর পেছনে রোদ থাকায় আলো রোদের বুকে ধাক্কা খেলো। সাথে সাথে রোদ ওদের দু’জনকে কোনোমতে ধরে ফেলল। আলো নিজেকে রোদের থেকে ছাড়িয়ে একটা লাঠি দিয়ে বানরটাকে তাড়িয়ে দিলো। তারপর তিনজনে পুনরায় গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগল। আর একটু সামনে এগোলেই ওদের রিসোর্ট। রোদ আলোকে আর আসতে নিষেধ করে ওর থেকে বিদায় নিলো। এবং আলোকে দেখে শুনে সাবধানে ফিরে যেতে বলল। মেঘ মন খারাপ করে আলোর গলা জড়িয়ে ধরে আদর দিলো। আলো ছলছল চোখে মাথা নিচু করে চলে আসতে যাবে, তখন রোদ ওকে পিছু ডেকে বলল,

“আলো, ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষগুলো নিষ্ঠুর নয়। পরিস্থিতি তাদের নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করে। ভালোবাসার মানুষ যেমন উন্মাদের মতো ভালোবাসতে জানে। তেমনি ভালোবাসা রক্ষার্থে নিষ্ঠুরের মতো আঘাত হানতেও পারে। যদি পারো তো মকবুলকে বাঁচিও। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ অথবা চাওয়া যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। তবে এখন জোর দিয়ে বলছি, ওর জায়গা আমি থাকলে আমিও হয়তো একই কাজ করতাম। আজ মকবুলের প্রতি ঘৃণা নয় বরং আমার সন্মানটা দ্বিগুন হারে বেড়েছে। তুমি সাবধানে থেকো, আসছি।”
কথাটা বলে রোদ মেঘের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ভুলেও আর একবারও পিছু ফিরে তাকাল না। ফিরলে হয়তো দেখত, অশ্রুসিদ্ধ চোখে এক মায়াবিনী হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ মকবুলকে সাপোর্ট করছে!
মুনের ভালোবাসার শেষ পরিণতি হলো, মৃত্যু। তাও প্রাণপ্রিয় ভালোবাসার মানুষটার হাতে। তবুও রোদ মকবুলকে দ্বিগুন সন্মানের কথা বলল।
তাহলে রোদের কথা শুনে এটাই স্পষ্ট যে, রোদও মকবুলের মতোই চিন্তা ধারার মানুষ। আচ্ছা, সব পুরুষের চিন্তায় কী এতটা নিচু মনের? কে জানে হবে হয়তো! এই প্রশ্নের উত্তর ওর এখনো অজানা।
আলো চোখ মুছে রোদের প্রতি একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। দিনকে-দিন ভালোবাসা নামক জিনিসটার
প্রতি ওর ঘৃণা জন্মেই যাচ্ছে। চোখের সামনে এসব দেখলে আদৌও কী ঠিক থাকা যায়! তাও আবার বোনের মতো বান্ধবীকে এমন নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখলে। সে তো পারছে না! তবে আলো এই মূহুর্তে খুব করে চাচ্ছে, ওর লাল রঙ্গা হৃদয়টাতে চিরতরের জন্য মরিচা পড়ে যাক। যাতে সে ভুলেও কখনো কাউকে ভালোবাসতে না পারে। ভালোবাসা নামক কাটাযুক্ত পুষ্পকে সে ওর হৃদয়ে জায়গা দিতে চায় না, কিছুতেই না। কখনো না!
আলো ভেবেছিল, রোদ হয়তো সবার থেকে একটু আলাদা। আর যাই হোক, ওর চিন্তা ভাবনা বাকিদের মতো নিচু মনের না। কিন্তু না! রোদের কথাগুলো থেকে বোঝা গেল, সেও মকবুলের মতোই একজন। তাহলে সব পুরুষ এক! আর তাদের এই নিচু মনের চিন্তা-ধারাও।
তাই আলো পুরুষ আর পুরুষের ভালোবাসার প্রতি ওর মনে জমা রাখল, ‘ঘৃণা, ঘৃণা এবং একরাশ ঘৃণা। আদৌও এই ঘৃণা ওর মন থেকে মুছবে কী না, সে তাও জানে না।’

-‘এলোকেশী’-
[১১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ঘন আঁধারে ডুবে গেছে চারিপাশ। অচেনা পাখিগুলো ক্লান্ত শরীরে ফিরছে আপন নীড়ে। পশ্চিমাকাশে সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। প্রকৃতিও তার অঢেল রূপমাধুরী নিয়ে সবুজের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। মৃদু বাতাসের সাথে ভেসে আসছে অনাদরে বেড়ে ওঠা বুনো ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ। দূরের পাহাড়ে জন্মানো গাছ গুলোকে এখন বেশ ঘন সবুজ দেখাচ্ছে। স্বচ্ছ আকাশে ধীরে ধীরে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি হওয়ার পূর্ব মূহুর্তের মতো এখন আবহাওয়াটাও বেশ শীতল।
রোদরা রিসোর্টে ফিরে কফিসহ হালকা নাস্তা অর্ডার করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। দুই ভাই এখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। রোদ হাত দিয়ে ওর চুল ঝাঁড়া দিলে মেঘও তাই করছে। রোদ টি-শার্ট ঠিক করলে, মেঘও
অকারণে ওর টি-শার্ট টেনে ঠিক করছে। মেঘের কান্ড দেখে রোদ মৃদু হেসে বলল,

”কিছু বলবে?”
“হুম! বউমনিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো।”
“কেন?”
মেঘ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগল। আলোকে ছেড়ে যেতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। এই কথাটা সে মুখে বললেও রোদকে বোঝাতে অক্ষম।
এত খুঁজে রোদের ‘কেন’ এর উত্তর দিতে পারল না মেঘ। তাই নিরাবতাকে সঙ্গী করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তাছাড়া কথাটা সাহস করে বললেও এখন একটু ভয়ও পাচ্ছে। যদি দাভাই রেগে যায়!
মেঘকে চুপ থাকতে দেখে রোদ আধশোয়া হয়ে বসে শান্ত কন্ঠে বলল,
”তোমাকে তোমার বউমনির কাছে রেখে যাই? আমাকে তো আর দরকার নেই। এখন বউমনিই তোমার সব। কাল সকালে তোমাকে আলোর কাছে রেখে আমি সত্যিই ঢাকায় চলে যাব।”
একথা শুনে মেঘ গুটিগুটি পায়ে রোদের দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসল। রোদের এক হাতের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করতে করতে মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলল,
“না দাভাই! তুমি বউমনিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করো। তারপর আমাদের সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে চলো। তোমাদের দু’জনকেই আমার চাই, প্লিজ দাভাই!”

মেঘের মুখে বিয়ের কথা শুনে রোদ ভ্রু কুঁচকে উঠে সোজা হয়ে বসল। মেঘ যে সরাসরি বিয়ের কথা বলবে রোদ মোটেও আশা করে নি। এইটুকুন বাচ্চা অথচ ওর চিন্তা ভাবনা বেশ গভীর। রোদকে উঠে বসতে দেখে মেঘ ওর মাথাটা আরো নিচু করে নিলো। ওর থুতনী গিয়ে ঠেকে গেছে একদম বুকের সাথে। তাছাড়া আজ সারাদিন দাদাই ওকে বেশ কয়েকবার বকেছে। হয়তো এখনো বকবে! তাই মেঘ একটু অভিমান করে মাথা নিচু করে আছে। কিন্তু রোদ তেমন কিছু না বলে মেঘের কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“তোমার বউমনি আমাকে বিয়ে করবে না। সে আমার উপরে রেগে আছে। আমার বলা কথায় কষ্ট পেয়ে, খুব কেঁদেছেও। হয়তো সে আর কোনোদিন আমার মুখও দেখতে চাইবে না। এখন বলো, তাকে কীভাবে ঢাকায় নিয়ে যাব?”
আলো কেঁদেছে শুনে মেঘ নাক ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি বউমনিকে বকেছো? না বকলে, বউমনি কাঁদল কেন দাভাই?”
“উহুম, শুধু কয়েকটা সত্য কথা বলেছি।”
রোদের এত কঠিন কথা বুঝতে না পেরে মেঘ ড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। রোদ ব্যাপারটা বুঝে মেঘের চুলে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসল। তখন ওয়েটার এসে অর্ডারকৃত খাবার দিয়ে তাৎক্ষণিক চলে গেল। ওরা দু’জনে মিলে নাস্তা সেরে বেলকণিতে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে। সেই সাথে আকাশ কাঁপিয়ে মেঘও গর্জন তুলেছে। গর্জনের সাথে সাথে পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। রোদ বেলকণির পেতে রাখা চেয়ারটাতে বসল। ঠান্ডা বাতাসে শরীর ও মন দু’টোই জুড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘও আদুরে বিড়াল ছানার মতো রোদের কোলের উপর চুপটি করে বসল। তারপর অনবরত চলতে থাকল তার কথার ঝুলি।
ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মাটির বুকে নিদারুন ভাবে আঁছড়ে পড়ছে। গত বৃষ্টির রাতে আলো ওদের সঙ্গে ছিল, অথচ আজ নেই!

রোদ মেঘকে কোলে নিয়েই রুমের জানালার থাই আঁটকাতে গেল। মেঘ ওকে নিষেধ করে বৃষ্টির পানিতে হাত ভিজিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। বৃষ্টির ফোঁটা হাতে পড়লে নাকি ওর কাতুকুতু লাগছে। মেঘ রোদের হাতটাও টেনে জোর করে ভিজিয়ে দিয়ে হাসতে লাগল। মেঘকে এভাবে হাসতে দেখে রোদ মুচকি হেসে ওকে আরো কাতুকুতু দিলো। মেঘ তখন ছটফট করে হাসতে হাসতে রোদকে নিষেধ করতে লাগল। তারপর দুই ভাই অনেকটা সময় খুনশুঁটি করে রাতে খাবার খেয়ে বাজি ধরে গেম খেলতে বসল। যে হারবে সে অপর জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। বাজি মোতাবেক মেঘ হেরে রোদের মাথায় হাত বুলিয়ে চুল টানতে লাগল। মেঘের ছোট ছোট হাতে আদুরে ভাবে হাত বুলানোতে রোদের চোখ দু’টো ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। একটুপরে, রোদ মেঘকে নিষেধ করে পাশে শুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল। মেঘও রোদের পেটের উপর পা তুলে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল।
এখন বাজে রাত বারোটা একুশ। পাহাড়ি অঞ্চলে এখন গভীর রাত। এখানে শহুরে পিচ ঢালা রাস্তার মতো ঝকঝকে লাইটের ঝলকনি নেই। চারপাশে জঙ্গল আর জঙ্গল। সেই সাথে বন্যপ্রাণী এবং পাহাড়ি মশাদের উৎপাত। তাছাড়া লাইট বলতে এখানে কেরোসিন তৈরী কুপি। যদিও কেউ কেউ শোলার প্যানেল ব্যবহার করে। তবে টানা বৃষ্টির দিনে একটু সমস্যা হলেও তারা মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। কারণ এমনই হয় পাহাড়িদের ত্রুটিযুক্ত দৈনন্দিন জীবন যাত্রা।
ঘন কালো মেঘে আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বজ্রপাতের উচ্চশব্দে চারপাশটাও যেন কেঁপে উঠেছে। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ করে একনাগাড়ে চলছে বৃষ্টির নৃত্য। সবুজ শ্যাওলা পড়া উঠানে অনেকখানি পানি জমে গেছে। সুনসান নিরাবতা চারিপাশ! শুধুমাত্র শোনা যাচ্ছে প্রবল বাতাসের শনশন শব্দ, টিনের চালে বৃষ্টির নাদ আর কোলা ব্যাঙের ডাক।

আলো অন্ধকার রুমে জানালার পাশে চুপ করে বসে আছে। বাইরে তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন জঙ্গলে বৃষ্টির রাত আরো অন্ধকার রুপ ধারণ করেছে। মকবুল এই বৃষ্টির মধ্যে গাছে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা শরীর আর ঠান্ডা বাতাসে ওর পুরো শরীর হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আলো জানালার দিয়ে ওর করুণ অবস্থা দেখে মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একটা মানুষের এত কষ্ট স্বচক্ষে দেখা যায় না। প্রায় চার ঘন্টা ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আর মকবুল বৃষ্টির মধ্যে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে পাহারা দেওয়া লোক দু’টো বৃষ্টি কারণে অনেক আগেই চলে গেছে।
কাঁদতে কাঁদতে আলোর হঠাৎ রোদের কথাগুলো মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠল। সে রাগের বশে রোদের কথাগুলো একবার ভেবেও দেখেনি। রোদ হঠাৎ মকবুলকে বাঁচাতে বলল কেন? আর মকবুলের জায়গায় সে থাকলে একই কাজ করত, এই কথায় বা কেন বলল? তাহলে কি রোদের সঙ্গে মকবুলের কথা হয়েছে? কি কথা হয়েছে? আর কথা না হলে, রোদ জোর গলায় ওকে এই কথাগুলো বলল কেন? এই প্রশ্নগুলো ইতিমধ্যেই আলোর পুরো মস্তিষ্কে কিলকিল করতে লাগল। রোদরা কাল চলে যাবে। ওর দেখা সে চাইলেও আর পাবে না। এখন এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল মকবুলই দিতে পারবে। দিনের বেলায় মকবুলের সাথে সে কথা বলতে পারবে না। তাছাড়া কালকে মকবুলের হাত কাটা হবে। তাহলে এখনই
মোক্ষম সময়! আলো শরীরে ওড়না জড়িয়ে রান্নাঘরে থেকে কিছু একটা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। এই উত্তরগুলো ওর জানা চাই-ই চাই। নাহলে সে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না, আর পাবেও না। আলো সতর্কতার সাথে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ধীর পায়ে মকবুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মকবুল চোখ মেলে আলোকে দেখে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“আলোবু! আমি জানতাম তুমি আছবা। আসতে দেলী কললা ক্যান? আমি ভাবছিলাম, তুমি লুকাইয়া আমালে একটু কেতে (খেতে)দিবা। কুন্তু না, তুমিও আমালে না খাওয়াই রাখলা আলোবু।”

একথা শুনে আলো অন্যদিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মুনের কথায় মকবুল ওর বড় হয়েও ওকে আলোবু ডাকে। আলো হাতের বাটি থেকে ভাত বের করে কাঁপা হাতে ওর মুখের সামনে ধরল। প্রচন্ড ক্ষুদার্থ মকবুল করুণ চোখে আলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো।আলো ব্যাপারটা বুঝে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে মকবুলকে নিজে খাইয়ে দিতে লাগল। আজ বিবেকের কাছে হার মেনে, সে এসেছে ওর বান্ধবীর খুনীকে খাওয়াতে। মকবুলকে খাইয়ে আলো খুব শান্ত কন্ঠে বলল,
“কেন এমন করলেন মকবুল ভাই? এমনটা না করলে কী খুব ক্ষতি হতো?”
“আলোবু, আমাকে মাফ করে দিও।”
কথাটা বলে মকবুল গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছলছল চোখে উপরে তাকাল। বৃষ্টি গতি একটু কমেছে। আলো কিছু একটা ভেবে নিরুত্তর থেকে আস্তে করে মকবুলের বাঁধন খুলে দিলো। পৃথিবীর বুকে এখন মুন নেই। মকবুল নাহয় বেঁচে থাকুক। তাছাড়া পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। আর মকবুল তো জলজ্যান্ত মানুষ। এছাড়াও রোদও কেন জানি চায় মকবুল বাঁচুক। বাঁধন খোলাতেও মকবুলের কোনো হেলদোল নেই। সে একই ভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আলো বৃষ্টির জলে অশ্রু লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“চলে যান, মকবুল ভাই! এখান থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যান।”
কথাটা বলে আলো অন্য দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। কষ্টে ওর দম আঁটকে আসছে। তখন আকস্মিক কিছু দেখে মকবুলের পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে জোর গলায় কিছু বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়েছে ফেলেছে। তবুও সে অনেক কষ্টে এতটুকুই উচ্চারণ করল,

“ছ ছ ছরে যাও আলোবু, ছরে যাও।”
ততক্ষণে যা অঘটন ঘটার ঘটে গেছে। যেটার জন্য ওরা কেউ প্রস্তুত ছিল না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ওদের সঙ্গে ঠিক সেটায় ঘটল।
পরেরদিন খুব সকালে রোদ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। মেঘ হাত পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রোদ ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়াতেই ওয়েটার এসে দরজা নক করল। রোদ দরজা খুললে, ওয়েটার জানতে চাইল সে ময়না পাখি নিবে কী না! কালকে রাতের ঝড়ে পাখিরা আহত হয়ে আর উড়তে পারে নি। সকালে সেই পাখিগুলোকে কয়েকজন ধরে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে। আহত পাখি ছাড়াও নাকি সুস্থ পাখিও আছে। রোদ মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে ওর পাশে কোলবালিশ দিয়ে ওয়েটারের সঙ্গে নিচে গেল। আর হঠাৎ করে এখন পাখি পেলে মেঘ খুব খুশিও হবে। রিসোর্টের অনেকে পাখি নিতে দরদাম করছে। রোদ সেখানে গিয়ে চোখ বুলিয়ে সব পাখিদের দেখে নিলো। তারপর সব আহত পাখিসহ পাঁচটা সবুজ টিয়া এবং দু’টো ময়না পাখি নিলো। তারপর ওয়েটারকে ডেকে যদি সম্ভব হয় তো ওই আহত পাখিগুলোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলল। সে আবার পশু পাখির কষ্ট দেখতে পারে না। মনে হয় ওদের কষ্ট ওর বুকে গিয়ে লাগে। ওয়েটার রোদের কথামতো পাখি চিকিৎসকের নাম্বার যোগাড় করতে চলে গেল।
রোদের পাখি গুলোর দাম মোট তেরো হাজার সাতশ আটত্রিশ টাকা হলো। রোদ পাখি ওয়ালাকে দাম দিয়ে সুস্থ পাখিদের খাঁচা নিয়ে রুমে চলে গেল। একটু পরে ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। তাই রোদ ওদের অপ্রোয়েজনীয় জিনিসপত্র ট্রলিতে গুছিয়ে এক পাশে রাখল। ময়না পাখির চিঁ চিঁ শব্দে মেঘের আরামের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সে বিরক্ত হয়ে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। তারপর মুখ কুঁচকে চোখ খুলে ওর সামনে দু’টো খাঁচা দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর সে দ্রুত খাঁচার কাছে গিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

“দাভাই, এগুলো আমার? ওয়া কত্ত সুন্দর, উ বাবা এত্তগুলো পাখি! লা লা লা, এগুলো সব আমার।”
মেঘের কান্ড দেখে রোদ হেসে ওকে টেনে ফ্রেশ করাতে নিয়ে গেল। তারপর দুই ভাই নাস্তা সেরে একেবারে রেডি হয়ে নিলো। মেঘ ওর খাবার থেকে পাখিদেরও খাইয়েছে। সে তো পাখি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। রোদ ওয়েটারকে ডেকে ওদের ট্রলি আর পাখিগুলোকে নিচে নিয়ে যেতে বলল। তারপর সে সব দেখে শুনে মেঘের হাত ধরে আস্তে ধীরে নিচে নামল। আহত পাখিগুলোর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় নি। রোদ ওই পাখি গুলোকেও সাবধানে ওদের সঙ্গে নিলো। তারপর
রিসিপশনে রুমের চাবি আর যাবতীয় বিল পরিশোধ করে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

-‘এলোকেশী’-
[১২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
রোদকে পুনরায় ব্যস্ত শহরের কর্মচঞ্চল জীবনেই ফিরতে হচ্ছে। প্রকৃতির নির্মল বায়ু ছেড়ে, ওকে পূর্বের মতো আবার দূষিত বায়ু শরীরে মাখতে হবে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার বদলে যানজট আর হাজারও ব্যস্ততার ভিড়ে দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করতে হবে। সময়ের সংকটে হয়তো এভাবে আর বৃষ্টির নৃত্যও উপভোগ করতে পারবে না। হুম, ঢাকাতেও বৃষ্টি হয়।
তবে ঢাকার আর এখানকার বৃষ্টি দেখাতেও বেশ কিছুটা ভিন্নতা রয়েই যায়! মনে হয়, এখানকার বৃষ্টি প্রাণপূর্ণ। আর ঢাকার বৃষ্টি গুমোট ধরা। এমন খোলা আকাশ, পাহাড়, রক্তিম সূর্য, সবুজের সমারোহে আবার দেখা হবে কী না, তাও জানা নেই। আর, আর সেই সরল মনের মিষ্টি মেয়েটা! ওর সঙ্গে কী আদৌও দেখা হবে? আচ্ছা, সে কী ওদেরকে মনে রাখবে? এর উত্তর হয়তো হ্যাঁ, অথবা না! মানব জীবন চলতে থাকে তার আপন গতিতে। আর ছোট্ট এই জীবনে প্রতিনিয়ত কতশত মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কথা হয়, আবার সময় পেরোলে তাদের ভুলেও যায়। তেমনি আলোর নামের মেয়েটির কথা, সে ও কী ভুলে যাবে? সত্যিই কী ভোলা যাবে, তার স্বার্থত্যাগী সাহায্যের কথা? তার সরল মায়াবী মুখ আর মিষ্টি হাসির কথা? নাকি ওর কথা কারো স্মৃতির পাতায় বন্দী হয়ে মনের এক কোণে জমা থেকে যাবে? যদি এভাবেও থাকে তো থাকুক না, মন্দ কী তাতে!

রোদ গাড়িতে বসে এসব কথা ভেবে মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ মন ভার করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হয়তো আলোকে খুঁজছে। তখন ওদের গাড়িটা চলতে শুরু করল নিদির্ষ্ট পথের উদ্দেশ্যে।
রিসোর্ট ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই ভিড়ের কারণে ওদের গাড়িটা থেমে গেল । অনেক গাড়ি আর এত মানুষের জটলায় রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। রোদ ব্যাপারটা বোঝার জন্য জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকাল। হৈচৈর কারণে তেমন কিছু বোঝা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার খুব বিরক্ত হয়ে পাহাড়ি ভাষায় বললেন,
“এই চুতি* ছামনে তেকে সল! নাইলে তোদেল উপ্রে দিয়া গালি(গাড়ি) উতায়া দিমু নে।”
উনার গালি শুনে রোদ আড়চোখে একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে কথা বাড়াল না। এখন এই বিষয়ে কথা বাড়ালেই মেঘ গালিটা বুঝে ফেলবে। এবং জিজ্ঞাসা করবে এটার মানে কী! কিন্তু ড্রাইভারের গালি শুনে একজন পাহাড়ী যুবক তেড়ে এসে বলল,
“তুপ ছালা। বেছি কথা কইলে তোরে ওই পাহালের নিচে পুঁতি দিমু।”
“তুই চুপ হালামজাদা।”
এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে হতে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। রোদ কোনো রকম ওদের থামিয়ে ওই যুববকে সুন্দর করে জিজ্ঞাসা করল,

“ভাই, রাস্তায় জ্যাম কেন? আসলে হয়েছে টা কী?”
যুবকটা রোদকে ভালো ভাবে পরখ করে লুঙ্গিতে কাছা মেরে বলল,
“মেলা বিছতির কালণে পাহালের মাটি নলম হয়ে ঢসে গেচে। পাহালের নিচেল মানুচলা ছেই মাটিল নিচে চাপাও পলেছে। ওদেলই লাছ লিতে এছব গালি (গাড়ি) যাতেছে।”
যুবকটার একথা শুনে রোদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“কোন পাহাড়?”
“এই লাস্তা দরে খানিক হেঁতে ওই ছামনের (হিলক) নামেল মেলা উঁচু পাহালতা।”
(বিঃদ্র- এই নামের সেখানে কোনো পাহাড় নেই। কেউ আবার খুঁইজেন না। গল্পের স্বার্থে নামটা ব্যবহার করলাম)

আলোর বাড়ির পেছনের উঁচু পাহাড়টার নাম বলে যুবকটা স্থান ত্যাগ করল। একথা শুনে রোদ পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর সচল মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সে কিছুক্ষণ থম মেরে ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের সামনে যেতে বলল। রোদের আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে উনি আর কিছু বলার সাহস করলেন না। দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের সামনে চলে গেলেন। রোদ মেঘকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে রিসিপশনের সামনে চলে গেল। ওদের রুম এখনো বুক হয় নি। সে খোঁজ নিয়ে পুনরায় ওই রুমটা নিলো এবং পাখির খাঁচা আর ট্রলি ওয়েটারকে রুমে রাখতে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিলো না। অবুজ মেঘ এসবের কিছু বুঝতে পারছে। তবে আন্দাজ করতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। নাহলে দাভাই এত তাড়াহুড়ো করত না। রোদ মেঘকে নিয়ে আলোর বাড়ির রাস্তা ধরে সাবধানে হাঁটতে লাগল। এখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে! প্রকৃতি কী কারণে আজ এত রুষ্ট কে জানে! আকাশেও ঘন কালো মেঘ জমেছে। যখন তখন বৃষ্টির গতি আরো বাড়তে পারে। বৃষ্টিতে কারণে কাদা পানিতে রাস্তার একাকার অবস্থা। হাঁটাও যাচ্ছে না ঠিকমতো। এত কাদার মধ্যে মেঘও রোদের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছে না। বার বার পা পিছলে যাচ্ছে। তাই মেঘ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,

” দাভাই, আমি তোমার সাথে হাটতে পারছি না। একটু আস্তে চলো না, আমার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
একথা শুনে রোদ মেঘের কাদা মাখানো পায়েই কোলে তুলে হাঁটতে লাগল। চিন্তায় ওর পুরো শরীর ঘামে ভিজে জবজব অবস্থা। মেঘ এখনো বুঝতে পারছে না, কি হচ্ছে? আর দাভাই এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছে? রোদের চিন্তিত মুখ দেখে সে জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ আর না পেরে রোদকে জিজ্ঞাসা করল,
“দাভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রোদ মেঘের দিকে একবার এক পলক তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“যে পাহাড়ের নিচে তোমার বউমনির বাড়ি। সেই পাহাড় টা কালকে রাতে ঢসে গেছে। আর বাড়িগুলো পাহাড়ের মাটির নিচে চাপা পড়েছে।”
একথা শুনে মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে ঢোক গিলে কান্নারত কন্ঠে বলল,
“দাভাই, বউমনি কী তাহলে মরে গেছে?”
কথাটা বলে মেঘ রোদের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রোদ ওকে কত কী বুঝিয়েও থামাতে পারছে না। এভাবে গেলে ওরা ওখানে পৌঁছাতে পারবে না। বউমনির খবরও জানা যাবে না। তাই মেঘ রোদের কোল থেকে নেমে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। তারপর কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা ওখানে পৌঁছে যা দেখল, তাতে রোদ আর মেঘ দুজনেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাহাড়ের একপাশ ঢসে ছোট্ট গ্রামটার উপর পড়েছে। যার কারণে গ্রামের মানুষদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অনেকে প্রান হারিয়ে।চারিদিকে অসহায় মানুষগুলো আত্মীয় স্বজন হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আত্মনার্দ করে কাঁদছে। কেউ কেউ প্রাণপনে চেষ্টা করছে তাদের আপন মানুষগুলো কে উদ্ধার করতে। কালকে রাতে অনেকজন পাহাড়ের ভেজা মাটির নিচে চাপা পড়ছে। এখন তাদের মৃত লাশ টেনে বের করা হচ্ছে। সারি সারি ভাবে অনেক লাশ শুয়ে রাখা হয়েছে।

উদ্ধার কর্মীরা মাটি সরিয়ে লাশ উদ্ধার করছে। কোদাল দিয়ে মাটিতে কোপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাশদের হাত, পা, মাথা, কেটে চলে আসছে। তখন লাশের রক্তে ভেজা মাটিটাও লালবর্ণ ধারণ করছে। গ্রামটা যেন এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে কান্নার আহাজারি, মৃত্যু, লাশ, আর রক্ত। উফ! রুদ্ধশ্বাস করা একটা পরিস্থিতি।
রোদ মেঘ আর না দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আলোর খোঁজ করতে লাগল। অজানা ভয়ে দু’জনেই তটস্থ হয়ে উঠেছে। অনেক খুঁজে আলোকে না পেয়ে ওরা ব্যর্থ হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। মেঘ তো কান্না করেই যাচ্ছে। ওদের বাবা মা মারা যাওয়ার পর, রোদ এই প্রথম মেঘকে এতটা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখছে। রোদ কোনোমতেই ওকে থামাতে পারছে না। খুব প্রিয় কাউকে হারিয়ে মানুষ যেমন পাগলের মতো কাঁদে। মেঘও ঠিক সেভাবেই কাঁদছে। যেন আলোই ছিল ওর বাঁচার শেষ অবলম্বন।
তারপর দু’জনে হাল না ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার খুঁজতে লাগল। সবাই যার যার আপন মানুষ নিয়ে ব্যস্ত। কাকেই বা জিজ্ঞাসা করবে! রোদ মেঘকে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে চারদিকে চোখ বুলালো। কিন্তু ওদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটা কোথাও নেই! কোথায় গেল সে? তাহলে কী মায়াবী মুখের মিষ্টি হাসিটা আর দেখা হবে না? মেঘের কথায় কী ঠিক হবে?
এসব ভেবে রোদ শুকনো একটা ঢোক গিলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। কেন যেন ওর দম আঁটকে আসছে। বুকের ভেরতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমন লাগার কারণটাও ওর অজানা।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৭+৮+৯

হঠাৎ মেঘ বউমনি বলে চিৎকার করে ডেকে সামনের পথে দৌড় দিলো। রোদ মেঘের ডাক শুনে সেদিকে তাকিয়ে সেও
মেঘের পিছু গেল। আলো তিনটা লাশের সামনে থম মেরে বসে আছে। রোদ আলোর করুন অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে আগে নিজেকে শান্ত করল। আলোর সামনে মৃত তিন ব্যাক্তি মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। উনাদের টেনে বের করার কারণে, উনাদের পুরো শরীরে কাদা মাটি লেপ্টে আছে। তাই মুখটাও অস্পষ্ট।
রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে তিনটে লাশকে ভালো করে দেখল। উনাদের মধ্যে একজন দাদীমা, মকবুল আর আরেকজন অচেনা মহিলা৷ অচেনা মহিলা হলেন মুনের মা।
রোদ উনাকে কখনো দেখে নি বিধায় চিনে না।
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে আলোর পাশে বসে যত্ন করে আলোর চোখের পানি মুছে দিলো। আলোর কান্নার কোনো শব্দ নেই! অথচ অঝরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। মেঘ আদুরে সুরে আলোকে বার বার কাঁদতে নিষেধ করছে। রোদ আলোর মনের অবস্থা বুঝে হাঁটু গেড়ে বসে আলোর মাথায় আলতো করে এক হাত রাখল। হঠাৎ মাথায় কারো ভরসার হাত পেয়ে আলো অশ্রুভেজা চোখে একবার তাকিয়ে, রোদকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। এই কান্নায় সে কষ্ট কমিয়ে বুকের দহন নেভাতে চাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে কই! কষ্ট তো বেড়েই চলেছে, অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলেই যাচ্ছে। আলোর কান্না দেখে মেঘও উঠে রোদের কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। শুধু রোদ পারছে না, ওদের কিছু বলতে আর না থামাতে। দু’জনেই ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে।

আলো কাঁদতে কাঁদতে রোদের শার্ট খামচে অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগল,
“আমার আর কেউ রইল না, কেউ না! দাদীমা, দাদীমা গো! আমাকে রেখে যেও না দাদীমা, আমি মরে যাব। সত্যিই মরে যাব। একা এই পৃথিবীতে আমি বাঁচতে পারব না? হে মাবুদ! তুমি আমার সব কেড়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে কেন, কেন? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না, কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্টে আমার দম আঁটকে যাচ্ছে। আমি কার জন্য বাঁচব গো আল্লাহ, কার জন্য!”
আলো এসব বলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। ওর সাথে রোদ মেঘও নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ওরা খুব ভালো করে জানে কাছের মানুষগুলোকে হারানোর ব্যথা। এই অভিজ্ঞতা ওদের আছে বলেই, ওরা অনুভব করতে পারছে আলোর কষ্টটা। ওর বিলাপ করা আত্ননার্দের যন্ত্রণাটা। আলো কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে রোদের বুকের শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। রোদ তবুও কিছু বলছে না। শুধু আলতো করে আলোকে ওর বাহুডোরে আগলে রেখেছে।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৩+১৪+১৫