এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৩+১৪+১৫

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৩+১৪+১৫
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আলো কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে রোদের বুকে লুটিয়ে পড়ল। এত ধকল ওর শরীরেও আর কুলাচ্ছে না। রোদ আলোকে বুক থেকে সরিয়ে ওর গালে আস্তে করে টোকা দিয়ে ডাকতে লাগল। কিন্তু সাড়াশব্দ নেই! অতিরিক্ত কান্নার ফলে ওর ফর্সা মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে, মায়াবী চোখ দু’টোও বেশ ফুলে গেছে।
আলোর চোখ বন্ধ দেখে মেঘ শুকনো ঢোক গিলে এক পা পিছিয়ে গেলো৷ ওর আম্মুও এভাবে চোখ বন্ধ করে আর ফিরে আসে নি। ওকে একা ফেলে মাটির নিচে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। তাহলে বউমনিও আর ফিরবে না। মেঘ এসব ভেবে ভেজা চোখে পরপর কয়েকবার পলক ফেলে ঢোক গিলে বলল,

“দাভাই, বউমনি কী আমাদের সঙ্গে আর কথা বলবে না? মেলা রাগ করেছে? অনেক কষ্ট পেয়ে বউমনি আম্মুর কাছে চলে গেল?”
মেঘের একথা শুনে রোদ কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেলো না। অবুজ বাচ্চাটা কত কী ভেবে বসে আছে। যদিও সে নিজের চোখে ওর আম্মুর চলে যাওয়া দেখেছে, তাই হয়তো! রোদ মৃদু হেসে মেঘকে কাছে ডেকে সুন্দর করে বোঝাল, ‘বেশি কান্নার ফলে আলো জ্ঞান হারিয়েছে। একটুপরে আবার ঠিক হয়ে যাবে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোদের কথা শুনে মেঘ শান্ত হয়ে বসে আলোর মুখের দিকে তাকাল। বউমনি সুস্থ হলে সে অনেক ভালোবাসবে৷ কখনো আর কষ্ট কষ্ট দিবে না, ভুলেও না! ওর আম্মু ওকে ফাঁকি দিয়েছে। বউমনিকে সে ফাঁকি দিতে দিবে না, কিছুতেই না। তারপর রোদ মেঘ বসিয়ে রেখে পানি এনে আলোর জ্ঞান ফিরালো। কালকে রাত থেকে কান্নার ফলে ওর দু’চোখের পাতা ফুলে ব্যাথায় টনটন করছে। পরনের হলুদ রংয়ের থামি কাদা পানিতে ভিজে শরীরেই শুকিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি থেমে একচিলতে রোদের দেখা মিলেছে। অদ্ভুত সুন্দর কাঁচা মিষ্টি রোদ! সেই রোদে না আছে তেজ আর না রুক্ষতা। প্রকৃতি যেন রাগ সামলে কেবল ক্ষান্ত হয়েছে। এখনো লাশ উদ্ধারের কাজ চলছে৷ ইত্যিমধ্যে অনেকের দাফন কার্যও সম্পূর্ণ করা হয়েছে। গত কাল রাত থেকে অতিরিক্ত কান্না আর অনাহারে থাকার ফলে ওর শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। রোদ ব্যাপারটা বুঝে আলোকে একটু পানি খাইয়ে উঠে দাঁড় করাল। এবং তখনই পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেলো। পায়ের দিক থেকে প্যান্ট কিছুটা উপরে জড়ানোর কারণে ঠান্ডা কিছু সে খুব সহজে অনুভব করতে পেরেছে। তাই সে আলোকে ধরেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। আলোর কাদা লেপ্টানো ভেজা চুল ওর পায়ে ঠেকেছে। আর রোদ আলোকে খোঁপা করা অবস্থায় বেশি দেখছে। তাই ওর চুল এবং খোঁপা দেখে লম্বা কতটুকু অনুমান করা যায় নি। আর রোদ চেষ্টাও করে নি। কারণ একটা মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখা মানে মনে নিষিদ্ধ অনুভূতিকে প্রশয় দেওয়া। তাছাড়া নারী লম্বা কেশই তো বেশ! এটা নিয়ে এত মত্ত হওয়ার কিছু নেই। আর হলেই সর্বনাশ! আলোর ভেজা খোলা চুল ওর হাঁটুর অনেকটা নিচে পড়ছে। ঘনত্বটা ভেজা চুলের জন্য তেমন বোঝা যাচ্ছে না।রোদ আপাতত সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আলোকে একটা গাছে নিচে বসিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেল। মেঘ চুপটি করে আলোর পাশে বসে আলোর হাতটা ওর হাতের মুঠোয় নিলো। আলোর ওর ছোট ছোট হাতে আদর দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে আবার কাঁদতে লাগল। এই হাত দু’টোও যেন ভরসার হাত, ওর পাশে থাকার নিদারুণ এক আহ্বান।

এখন সকাল পেরিয়ে দুপুর। লাশ দাফন করতে হবে। রোদ বেশ কয়েকজনের সাহায্যে তিনটে লাশের গোসল সম্পূর্ণ করল। আলো ওদের তিনজনকে কাফনে মোড়ানো দেখে আবার কাঁদতে লাগল। এদিকে লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। রোদ দুইজন মাঝবয়সী মহিলাকে ডেকে বিনয়ীভাবে আলোর খেয়াল রাখতে বলে মেঘকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আলো চিৎকার করে নিষেধ করছে উনাদের নিয়ে না যেতে। সে একা হয়ে যাবে। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর একরাশ নিঃসঙ্গতা ওকে গিলে খাবে। আলোকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সে ব্যাকুল হয়ে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। কার জন্যই বা কাঁদবে দরদের দাদীমা, বড় ভাইয়ের মতো মকবুল, নাকি মায়ের মতো বান্ধবীর মায়ের জন্য! তিনজনেই তো ওর খুব কাছের। তিনজনের শোকে জর্জরিত হয়ে ওর দমটা যেন আঁটকে আসছে। মস্তিষ্কটা একটু বিশ্রাম পেতে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। চোখ দু’টোও অবাধ্য হয়ে বুজে আসছে। একপর্যায়ে আলোর শরীরটা সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

এই নির্মম পরিস্থিতিতে সে বুঝতে অক্ষম, মানব দেহে প্রাণ না থাকলে শরীরের কোনো মূল্য থাকে না। প্রাণহীন সুন্দর শরীরটা তখন জমা পড়ে বাতিলের খাতায়। অবশেষে ঠাঁই মিলে তিন হাত মাটির নিচে অন্ধকার এক ঘরে। সেই ঘরেই শরীরের পঁচন ধরে পোকাদের খাদ্য হয়ে ধীরে ধীরে মিশে যায় মাটির সঙ্গে। আর এই কঠিন সত্য থেকে না কেউ বাঁচতে পারে, আর না কাউকে বাঁচাতে পারে। অথচ জীবিত থাকতে এই শরীর নিয়েই কত্ত বড়াই, কত্ত অহংকার!
বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল তিনজনের দাফন কার্য সম্পূর্ন করতে। পরিস্থিতি মোতাবেক কখন কাকে প্রয়োজন হয় কেউ বলতে পারে না। উদাহরণস্বরুপ, দাদীমা একদিন বিপদের দিন রোদকে অাশ্রয় দিয়েছিলেন। আর আজ উনার কবরে প্রথম মাটি পড়ল রোদের হাত থেকে। কে জানত, এমন হবে!
তবুও তো হলো!
রোদ মেঘ ওইদিকের সব কাজ সেরে ফিরে এলো আলোর কাছে৷ আর এসে দেখে আলো জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর আশেপাশে কেউ নেই। যাদের রেখে গিয়েছিল তাদের চিহ্নটুকুও নেই। রোদ মহিলা দু’টোকে বিশ্রী একটা গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। পৃথিবীতে এতটা নিম্ন অমানবিক মানুষও তাহলে আছে, ছিঃ! মেঘ দৌড়ে গিয়ে আলোর গালে হাত দিয়ে আদুরে সুরে ডাকছে,

“বউমনি! ওহ্ বউমনি! আমরা ফিরে এসেছি, বউমনি!”
রোদ আলোর দিকে এক পা বাড়াতেই কয়েকজন লোক ওর পথ আটকে দাঁড়াল। সকাল থেকেই উনারা রোদকে লক্ষ্য করছিলেন। এই ছেলে কে? এর আগে তাকে কখনো দেখে নি, তাহলে? আর আলোর সাথে ওর কী সম্পর্ক? মূলত এসব জানতেই এই পরিস্থিতিতে ছুটে এসেছেন। উনাদের এভাবে পথ আটকানো দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই ঝামেলা সৃষ্টি করবে। তাই রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে মুচকি হেসে বলল,
” কিছু বলবেন?”
“আপনে কেদা? আলো আপনের কে হয়?”
“তেমন কেউ না। আর কিছু?”
কথাটা শুনে উনারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। রোদের কথাটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেউ না হলে ওর জন্য এতকিছু করছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে। তখন গ্রামের প্রধান বিচারক ওখানে উপস্থিত হলেন। এবং সুদর্শন একটা যুবককে দেখে পুরো ঘটনা বিস্তারিত জানলেন। তারপর সব শুনে অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“আপনে এহনই চইলা যান। এখানে আল কুনুদিন আছবেন না। তাছালা আমাদেল গেলামে বাইলেল মানুচ থাকতে পালে না। আল আলোল তো কঠিন শাছ্তি পাওনা আচে। ওলে আল ছাহায়্য করলে আপনেও শাছ্তি পাবেন।”
একথা শুনে রোদের কপালে সূক্ষ্ম ভাবে একটা চিন্তার ছাপ পড়ল। তবে সে কৌতূহল থামাতে না পেরে কথার ছলে জিজ্ঞাসা করল,

“শাস্তি কেন? ওর অপরাধ কী?”
“ওই কাইল লাইতে মকবুল্যালে নাকি ছাইলা দিছে। এজন্যি কঠিন শাছ্তি ছে পাবেই।”
কথাটা বলে উনি রেগে হনহন করে স্থান ত্যাগ করলে। এখন পুরো গ্রাম ঘুরে দেখে তারপর নাকি আলোর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। রোদ ভ্রু কুঁচকে উনার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে, পুনরায় এক পা বাড়াবে তখন একজন মহিলা ওর পিছু ডাকলেন। রোদ উনাকে দেখে চট জলদি বলল,
“আন্টি ওই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে৷ আমি একটু পরে আপনার সঙ্গে কথা বলি?”
”না আব্বাজান, তুমি ছুদু আমাল এক্কখান কথা শুইনা যাও।”
“জি বলুন।”
“মাতবরের ব্যাডার লগে(বিচারক) আলোল নাকি বিয়া দিয়া দিবো। ওই ব্যাডা পাক্কা একখান জানুয়ার। শরীলে মানুচের ওক্ত নাই। বেডির মানুচের শরীলেল পুকা সে। তাছালা এই গেরামেও মেলা খারাপ খারাপ ছব নিয়ম-কানুম আছে বাপ, ছেছব তোমালে এহন কওয়া যাইবে না। তুমি আলোলে নিইয়া যাও বাজান। নাহলে এই ফুলেল মুতন বেডির কপালে মেলা কস্ত আছে। নিয়া যাও বাপ, তাড়াতাড়ি নিয়া যাও।”

কথাটা বলে উনি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গেলেন। রোদ দ্রুত পায়ে হেঁটে অনেক খুঁজে পানি এনে আলোর জ্ঞান ফেরাল। এই জায়গা এখন বেশ ফাঁকা। রোদ আলোকে ধরে উঠিয়ে বসাল। তারপর ওর দুই গালে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তাকাও, আর আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। তোমার আবেগকে সাইডে রেখে এখন মস্তিষ্ক খাটিয়ে কথাগুলো ভাবো। তুমি এখন একা! আর তোমাকে নিয়ে এখানকার অনেকে নোংরা পরিকল্পনা করছে। আমরা চলে গেলেই তারা তোমার উপরে হামলে পড়বে। তাছাড়া সবাই জেনে গেছে তুমি মকবুলের বাঁধন খুলেছো। ওরা এখন তোমাকে কঠিন শাস্তি দিতে চাচ্ছে।”
আলো একথা শুনে জোরপূর্বক হেসে বলল, “ভালোই তো হবে মরে যাব।”
রোদ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে আলোর চোখে চোখ রেখে বলল,”ভীতুর মতো কথা বলো না। দাদীমা মারা গেছেন। আর উনার মাগফেরাত কামনা করার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে। এত বছর উনি তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এখন এটা করা তোমার মুখ্য দায়িত্ব। আলো এখন ব্যথিত হয়ে হাল ছেড়ে বিপদ ডেকো এনো না।”
“তাহলে কী করব?

“আমাদের সঙ্গে চলো। কথা দিচ্ছি, আমার দেহে প্রান থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিব না।”
রোদের একথা শুনে আলো ফ্যাল ফ্যাল ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। ওকে কিছু বলার সুযোগটুকু না দিয়ে রোদ মেঘকে বলল, আলোকে নিয়ে দ্রুত সামনে এগোতে। রোদের কথা শুনে মেঘ চট করে উঠে আলোকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
রোদও উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওই মহিলার দিকে একবার তাকাল। উনি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। রোদকে তাকাতে দেখে উনি হাতের ইশারায় দ্রুত সরে যেতে বললেন। তাই রোদ আর দাঁড়াল না মেঘদের নিয়ে
রিসোর্টের পথে হাঁটা ধরল। এখানে এক সেকেন্ড থাকা মানে নিজেদের বিপদে ডেকে আনা।

এই গ্রামে অহরহ বিশ্রী নিয়ম-কানুন প্রচলিত আছে। সুন্দরী অল্প বয়সী কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে, জোরপূর্বক হলেও মাতবর তাকে বিয়ে করেন। এবং তার সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়টুকু উনার কাছেই রাখেন। তারপর সেই সন্তান মেয়ে হলে তাকে বিশ্রীভাবে অপয়া খেতাব দেন। এবং ছেলে হলে উনার মর্জি মোতাবের উনার কাছেই রেখে দেন। অথবা সেই মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। এছাড়াও, এই গ্রামে সুন্দরী কোনো যুবতী থাকলে উনার ছেলে সিংহের মতো থাবা বসাতে দেরী করে না। সে ইজ্জত নিয়ে খোলায় বেশ পটু! রাতের আঁধারে এমনও হয় বাবা মাকে হুমকি দিয়ে সে যুবতিকে তুলে নিয়ে যায়। এবং ভোরের আজানের পর পর সেই মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আর এখানে অসহায় বাবা মায়ের কিছু করার থাকে না। শুধু নিরবে চোখের অশ্রু ফেলা ছাড়া। তবে আলো নজরকাড়া সুন্দরী হলেও কেউ কখনো ওর দিকে তাকানোর সাহস করে নি। কারণ কারো শক্তপোক্ত ছায়া অদৃশ্য ভাবে সর্বদা ওকে মায়াজালের মতো
ঘিরে রেখেছে। চুম্বকের মতো ওর সব বিপদ শুষে নিয়েছে।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রায় এক ঘন্টা পর মাতবর তার লোককে বললেন আলোকে ডেকে আনতে। এখন বিচার কার্য শুরু করা হবে৷ ওই শহুরে ছেলেটাকে উনার বেশ সন্দেহ হচ্ছে। তাছাড়া ছেলেটা কথাতে বেশ চটপটে। আর শহুরের মানুষ গুলো মোটেও সুবিধার না। এরা যখন তখন একটা ভয়ানক কান্ড ঘটিতে ফেলতে পারে৷
আর ওই ছেলে যতই বলুন আলোর ওর কেউ না। তবুও কেন জানি একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। চাইলেও সঠিক হিসাবটা মিলেও মিলছে না। তাছাড়া যতই খারাপ পরিস্থিতিই আসুক আলোকে হাত ছাড়া করা যাবে না। সে হচ্ছে, সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো অতি মূল্যবান কেউ। আর ওকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার এটাই মোক্ষম সুযোগ। তাছাড়া উনি উনার আদরের একমাত্র ছেলে মতিকে কথা দিয়েছেন। আলোকে উনি নিজে মতির হাতে তুলে দিবেন। তখন নাহয় মতি ওই ফুলটাকে দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে ছিঁটকে ফেলে দিবে। আর নষ্ট ফুল কোনো কাজে লাগে না। তাই সেটাকে যত্ন করার মানেও হয় না। মতি আবার ফুল নষ্ট করতে বেশ পটু! ওর একপ্রকার নেশায় পরিণত হয়েছে, রোজ নতুন নতুন ফুল নিয়ে খেলা করার। ছেলে এই কাজে মাতবরের বেশ গর্ব হয়। কারণ পুরুষের কাজই তো পুরুষত্ব ফলানো। সেটা হোক ন্যায় বা অন্যায়। তাছাড়া এই গ্রামে ন্যায় আর অন্যায় বলে কিছু নেই। সব আইন উনার নিজের হাতে। মাতবরের পরিকল্পনা এখন অবধি ঠিক আছে, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।

মাতবর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মুখে একটা বিশ্রী হাসি ফুটিয়ে অনেক কথায় ভাবছেন। এসব ভেবে কেন জানি উনার পৈশাচিক এক আনন্দ হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা প্রকাশ করছেন না। অবশেষে উনার এতদিনের অপেক্ষার প্রহর আজ সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। উনি ঠোঁট কামড়ে হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালেন। অদূরে উনার নয় নাম্বার পুত্র লবি(রবি) মাটিতে বসে খেলা করছে৷ ওর বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছর। দেখতে পাহাড়িদের মতোই। মা নেই! কিছুদিন আগে ওর মাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে এখন অন্যের ঘরের ঘরণী। আর রবিকে মাতবরের বিশ্বস্ত কাজের লোক রহমান দেখাশোনা করেন। আর এখন অবধি মাতবরের মোট বউয়ের সংখ্যা বারো জন।

তবে বর্তমানে উনার বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনজন স্ত্রী। বাচ্চা প্রসবের সময় মারা গেছেন দুইজন, একজনকে উনি স্বজ্ঞানে নিজে হাতে খুন করেছেন। আর বাকি ছয়জনকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এসব কাজে কখনো উনার বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগে নি। বরং বেশ আনন্দ পান উনি, পৈশাচিক এক আনন্দ! আর সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটায় নেশা এবং নারীর শরীরে উন্মাদ হয়ে।
উনি আগাগোড়ায় প্রচন্ড কঠোর হৃদয়ের মানুষ। যার হৃদয়ে না আছে ন্যূনতম বিবেক, আর না মায়া। কঠোরতা যেন উনার রক্তে মিশে আছে। এজন্যই নিজের স্ত্রীদের চোখের পানিতে উনার কঠোর হৃদয় গলে না। তবে এখানে আরেকটা সত্য লুকায়িত আছে। উনি উনার সব ছেলেদের উনার নিজের বাড়িতেই রাখেন। তবে মেয়েগুলোর খোঁজ কেউ বলতে পারে না। হঠাৎ করে মেয়ে বাচ্চা নিঁখোজ হওয়াতে বাচ্চার মায়েরা যখন কান্নাকাটি করেন, তখন উনি হাসি হাসি মুখে বলেন,’বাচ্চাকে উনি নিজে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে এসেছেন। মেয়ে বাচ্চা অাপদ, তারা নাকি কোনো কাজের না। তাই আপদ দূর করেছেন।’
উনার একথা বাচ্চার মায়েরা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতেন না। হঠাৎ একদিন আরেকটা মেয়ে বাচ্চা হারানোতে মায়ের খুব কান্নাকাটি দেখে, উনি বিরক্ত হয়ে একটা পাহাড়ের নাম বলেছিলেন। সেই পাহাড়ের নিচে অনেক খুঁজে সত্যিই দুই দিনের বাচ্চার মৃত শরীর পাওয়া গেছে। এবং পাহাড় থেকে সরাসরি পাথরের উপরে পরাতে মাথার খুলি ফেটে ঘেলু বের হয়ে গিয়েছিল। নিষ্পাপ বাচ্চাটার শরীরে কারো নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল। মাতবর রেগে নিজে বাচ্চাটার শরীরে অসংখ্য নখের আঁচড় বসিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিলেন।

এই ঘটনার পর থেকে সবাই উনার কথা বিশ্বাস করেছিলেন, আর জেনেও ছিলেন উনি প্রচন্ড পাষাণ। যে নিজের বাচ্চাকে এভাবে মারতে পারে। সে অন্যের অবস্থা কী করবে আল্লাহ জানে! মূলত উনার এই পাষণ্ড রুপের জন্য গ্রামের কেউ মুখ খুলতে পারে না। ভয়ে নতজানু হয়ে থাকে। আর উনি সবার এই ভয়টাকেই স্বার্থসিদ্ধি জন্য কাজে লাগায়। নিজের মর্জি
মতো নিয়মকানুন সৃষ্টি করে গ্রাম পরিচালনা করেন। উনার ছেলে মতিও যেন উনারই আরেকটা কপি। মনে মায়া দয়া কিচ্ছু নেই। সেও মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। এজন্য রাগ মেটাতে মেয়েদেরর শরীর খুবলে খেতে পছন্দ করে। ওর কবল থেকে বাঁচতে যখন কোনো মেয়ে চিৎকার করে, সে তখন মেয়েটার উপর আরো নৃশংস ভাবে অত্যাচার চালায়। ওর জন্য এভাবে কত মেয়ের প্রাণ গেছে তার হিসাব নেই। পরে ব্যাপারটা চেপে যেতে মাতবর মেয়েটির বাবা মাকে ভয় দেখিয়ে গ্রামে সালিশ বসিয়ে বলেন, ওই মেয়ে শহুরে এক ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। আর উনার পরিচিত একজন দেখে কথাটা উনাকে জানিয়েছেন। অথবা বলেন সেই মেয়েকে উনি শহরে পাঠিয়েছে, কাজের জন্য। ওখানে সে ভালো থাকবে। এখানে এভাবেই মিথ্যার উপরে মিথ্যা ভর করে দিনগুলো কাটছে। সবাই সবকিছু জেনে বুঝে প্রাণের ভয়ে চুপ থাকে।

তবে এখানে সেই জাহেলিয়াত যুগের মতো কেউ চায়না মেয়ে বাচ্চা হোক। কারণ এই গ্রামে মেয়ে বাচ্চা মানে অভিশাপ। সুন্দর হলে তো কথায় নেই! তারও অনিশ্চিত জীবনের গল্প হয় আর পাঁচজনের মতোই কলুষিত।
এক ঘন্টার জায়গায় প্রায় আড়াই ঘন্টা হতে চলল। কিন্তু ওই লোকগুলো আলোকে নিয়ে এখনো ফিরেনি। মাতবর রেগে লোকগুলোকে গালমন্দ করে আরো একদল লোক পাঠালেন। এবং বললেন, ওই মেয়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে উনার সামনে উপস্থিত করতে। উনাকে বসিয়ে রাখার অপরাধে আগে খুব কঠিন একটা শাস্তি দিবেন। তারপর ওর বাকি অপরাধের বিচার করবেন। একটুপরে, দুইদল লোক ফিরে এসে ভয়ার্ত গলায় জানালেন আলো এবং ওই ছেলে কাউকেই তারা খুঁজে পায়নি। তারা নাকি পালিয়েছে। মাতবর হুংকার দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে চিৎকার করে মতিকে ডাকলেন। মতি সেখানে উপস্থিত হতেই মাতবর ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন,
“শহুলেল(শহরের) ওই চুতি** পুলাডাই এই কাম কলছে। তুই গিয়া আছেপাছেল ছব লিছোর্ত কুঁজ। আল ওদেল পেলে তালাতালি আমাল চোখেল ছামনে আন।”

মতি ওর বাবার রাগান্বিত মুখ দেখে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে, “আছ্ছা আব্বা” বলে লোকজন নিয়ে স্থান ত্যাগ করল। মাতবর আরো লোক লাগিয়ে পুরো গ্রামটা আবার তন্নতন্ন করে খোঁজার আদেশ দিলেন। কোনোভাবেই ওদের পালাতে দেওয়া যাবে না। আর আলোর নিঁখোজের কথাটা চারদিকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। কেউ কেউ মনে মনে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করলেন না। আলো নাহয় পালিয়ে বেঁচেছে, উনাদের তো এখানে থাকতে হবে। আর এখানে থাকতে হলে না চাইলেও মাতবরের কথাতেই সম্মতি দিতে হবে। নাহলে মৃত্যু! তবে গ্রামের অন্যরা আলোকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। মুখে যা আসছে উনারা তাই বলছেন। আজ সকালে রোদকে যারা দেখেছে, মাতবারের কাছে ভালো সাজতে তারা ওদের নিয়ে বানোয়াট কথা বানিয়ে পুরো গ্রামে রটিয়ে দিলেন। কথাগুলো এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন এটাই সত্যি। কেউ কেউ তো মুখ ঝামটা দিয়ে মৃত দাদীমাকেও ছেড়ে কথা বললেন না। যেন সব দোষ দাদীমার।

এদিকে মতি দশ করে একটা দল তৈরী করে রিসোর্টে খুঁজতে লাগাল। তিনটে দল একসঙ্গে রিসোর্টে গুলোতে খুঁজতে শুরু করেছে। আজ যদি ভাগ্যক্রমেও ওরা ধরা পড়ে, তাহলে ওদের কপালে কী আছে, ওরা ঠিক কল্পনাও করতে পারছে না। মতি ওর দলবল নিয়ে রিসোর্টের ম্যানেজারদের সাথে হাঙ্গামা করে সব রুম তল্লাশি করছে। জোর করে বাঁধা দিলেই ভাংচুর শুরু করছে। বিশ্রীভাবে গালাগাল করছে। রোদরা উঠেছিল ছিলো রিমঝিম রিসোর্টে। মতি খুঁজতে খুঁজতে সেই রিসোর্টের দিকেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
রোদরা রিসোর্টে পৌঁছে ম্যানেজারকে বলে আরেকটা রুম বুক করেছে। ওরা সেই রুমেই এখন অবস্থান করছে। মেঘ তো আলোর কাছে থেকে সরছে না। আলোর তো এখনো কাঁদতে কাঁদতে বেগতিক অবস্থা। তাছাড়া ওর পুরো শরীরে কাদামাটির সাথে চুলেরও বেহাল দশা। রোদ মেঘ আর আলোকে রুমে থাকতে বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। মেঘ তোতাপাখির মতো আলোকে অনবরত কত কী বলছে। বার বার হাসানোর চেষ্টা করছে, তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আলো শুধু নাক টেনে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। রোদ আলোর জন্য কয়েকটা ড্রেস এনে রুমে ঢুকতে যাবে, তখন মেঘের কথা শুনে রোদ ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মেঘ আলোর কোলের উপর বসে আলোর চোখ মুছে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতে লাগল,

“জানো বউমনি, তোমার মতো আমরাও একা। আমাদেরও বাবা মা নেই। আমি আর দাভাই অনেক বড় বাসায় একা থাকি। আমাদের অনেক কিছু আছে। কিন্তু আদর করার কেউ নেই। তবে দাভাই আমাকে খুব ভালোবাসে, আর আমিও বাসি। আর এখন দাভাই ছাড়া আমি তোমাকেও খুব ভালবাসি। কেন জানো? কারণ তোমার কাছে আসলে আমি আম্মু! আম্মু! গন্ধ পায়। আর এই গন্ধটা আমার মেলা মেলা পছন্দ। বউমনি আমার আম্মুর মতো আমাকে ভালোবাসবা?”
এইটুকুন!
মেঘের এই কথা শুনে আলোর ততক্ষণে কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। সে নিষ্পলক ভাবে চেয়ে আছে মেঘের নিষ্পাপ মুখের দিকে। মেঘের আবদার শুনে আলোর চোখ দিয়ে কেন জানি ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে গেলো। আলোকে কাঁদতে দেখে মেঘ উত্তেজিত হয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
“না, না, আমাকে ভালোবাসতে হবে না। তবুও তুমি কান্না করো না বউমনি। আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমার কান্না দেখে। প্লিজ বউমনি আর কেঁদো না।”

একথা শুনে আলো মেঘকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রোদও সতর্কতার সাথে ওর চোখের পানি মুছে নিলো। এরপর ওদের থামাতে শব্দ করে রুমে এসে আলোকে একটা ড্রেস এগিয়ে দিলো। আলো রোদকে দেখে মেঘকে ছেড়ে মাথা নিচু করে নিলো। মেঘও ওর মুখ মুখে মিষ্টি হাসল। রোদ আঙ্গুল দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে আলোকে দ্রুত গোসল সেরে নিতে বলল। আর মেঘকে বলল রোদের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। রোদের কথা শুনে মেঘ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে বিনাবাক্যে উঠে চলে গেল। রোদ পাশ ফিরতেই দেখল আলো ওয়াশরুমের দরজার কাছে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ সেদিকে এগিয়ে আলোকে জিজ্ঞাসা করল,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
আলো মাথা নিচু করে কান্নারত কন্ঠে বলল,

“আমি কখনো এরকম গোসলখানা ব্যবহার করি নি। কোথায় কী করব? ঠিক বুঝতে পারছি না আমি?”
রোদ ব্যাপারটা বুঝে ওয়াশরুমে গিয়ে আলোকে সব দেখিয়ে দিলো। তারপর সে চলে আসতে যাবে তখন আলো পুনরায় ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। মানুষটাকে কিছু বলতেও ওর বিবেকে বাঁধছে। ওর জন্য তো কম কিছু করছে না। রোদ ওকে আবার কাঁদতে দেখে বলল,
“কী সমস্যা বলো? তোমার আর কিছু কী লাগবে? আমাকে বলতে পারো।”
আলো ওর ভেজা চোখ দুইহাত দিয়ে মুছে নিলো। তারপর ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে একবার ঠোঁটে ভিজিট বলল,
“আসলে আমার চুলে কাদামাটিতে একাকার অবস্থা। আর আমি একা কখনো আমার চুল পরিষ্কার করি নি। দাদীমা সব করে দিতো। পুকুর হলে পারতাম। কিন্তু এখানে একা কী করে, কী করব।”
আলোর কথা শুনে রোদ ওকে আশ্বস্ত করতে মৃদু হেসে বলল,
” আচ্ছা আমি তোমাকে সাহায্য করছি? তুমি এখানে এসে দাঁড়াও।”

একথা বলে রোদ একটা সুইট চেপে আলোকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করাল। তারপর ঝিরিঝিরি পানিতে ধুঁয়ে যেতে লাগল আলোর পুরো শরীর। রোদ এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে আলোর চুলের কাদা ছুটাতে লাগল। এঁটেল মাটি সহজে ছুটছেও না। রোদ এই প্রথম কোনো মেয়ের চুল স্পর্শ করল। এটাই ওর প্রথম অভিজ্ঞতা। এজন্য হয়তো ওর হাতটা মৃদু ভাবে কাঁপছে। রোদ নিজেকে যথেষ্ট সামলে আলোর চুলের মাটি ছুটাতে ছুটাতে বিরস কন্ঠে বলল,
“এত বড় চুল রাখার কী দরকার? একটু ছোট করলেই হয়।
যেহেতু তুমি নিজে সামলাতে পারো না।”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদের কথা শুনে আলোর মুখটা আরো মলিন হয়ে গেলো। সত্যিই তো, একা সামলাতে না পারলে চুল কেটে ফেলায় শ্রেয়। এতদিন নাহয় দাদীমা সব করে দিতো। এখন তো আর দাদীমা নেই! কে বা চুল পরিষ্কার করে যত্ন করে তেল লাগিয়ে বেঁধে দিয়ে বলবে,”হইল শান্তি? বাপ রে বাপ আমার জানডা শ্যাষ কইরা দিলো। খালি চুল, চুল,আর চুল!”
দাদীমা এসব নিয়ে রাগারাগি করে একটুপরে আদর করে আর ডাকবে না। সবচেয়ে সুন্দর থামিটা ওর জন্য তুলে রাখবে না। ওর পছন্দের খাবার কেউ দিলে না খেয়ে ওকে এনে দিবে না। জ্বর আসলে ঝাল করে আর মুড়ি মাখিয়ে দিবে না। এসব করার মানুষটাই তো চিরতরে হারিয়ে গেলো। কে বা করবে? এখন তো সে এতিম!
আর বরাবরই চুল হচ্ছে আলোর দূর্বল পয়েন্ট। দাদীমার মতো করে সে কখনোই যত্ন করতে পারবে না। তাই হয়তো চুলগুলোও আর থাকবে না। অযত্নে দিন দিন ঝরে পড়ে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া আপন মানুষ গুলোই তো স্বার্থপরের মতো ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আর চুল তো চুলই!

এদিকে রোদ মুখে ওই কথাটা বললেও আলোর চুলে হাত দিয়ে বেশ অবাক হয়েছে। কারণ আলোর চুল যেমন ঘন তেমনি কুচকুচে কালো। রোদ নিজেই হাঁপিয়ে গেছে এত লম্বা চুলের কাদা ছুটাতে গিয়ে। কোনো রকম সে কাদা ধুয়ে আলোর চুলে শ্যাম্পু দিয়ে দিলো। আলো এর আগে কখনো চুলে শ্যাম্পু ব্যবহারে করে নি। এক ধরনের মাটি ব্যবহার করত। এখন রোদকে নিষেধ করার মন-মানসিকতা ওর নেই। তাই যা হচ্ছে চুপ করে সায় দিচ্ছে। হঠাৎ আলোর চোখে শ্যাম্পুর ফেনা ঢুকে চোখ জ্বলতে শুরু করল। রোদ ওর ছটফটানি খেয়াল করে চোখে পানির ঝাপটা দিতে বলল। আলো তাই করল। পরপর কয়েকবার শ্যাম্পু করিয়ে রোদ বাকিটুকু সম্পূর্ণ করতে বলে স্থান ত্যাগ করল। ওর যতটুকু করার চোখ সংযত রেখে করে দিয়েছে।
মেঘ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে শুয়ে রোদের ফোনে গেম খেলছে। ওর ট্যাবে চার্জ নেই, বন্ধ হয়ে ট্রলিতে পড়ে আছে। রোদ মেঘকে উঠে বসিয়ে তোয়ালে এনে মেঘের মাথা মুছিয়ে দিলো। তারপর উলট-পালট করে লাগানো মেঘের শার্টের বোতাম ঠিক করে দিলো। এলোমেলো চুল গুলোও আঁচড়ে দিলো। এর বিনিময়ে মেঘ রোদকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো। রোদও প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে ওর রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার ওর্ডার করল।

একটুপরে, আলো গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সে কাঁচা হলুদ আর লাল রঙের সংমিশ্রণের একটা কামিজ পড়ছে। দেখতে বেশ লাগছে! থামিতে সে এতদিন অভ্যস্ত ছিলো। পূর্বে কখনো কামিজ না পড়াতে ওর একটু অস্বস্তি লাগছে। তবে ব্যাপারটা বুঝতে দিচ্ছে না। এদিকে ওর ভেজা চুলের পানি ঝরে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে ওর কোনো খেয়ালই নেই।
মেঘ আলোকে দেখে খেলা বন্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। থামির বদলে কামিজে আলোকে একটু অন্যরকম লাগছে। ঠিক শহরের মেয়েদের মতো। মেঘের তো আলোকে এভাবে দেখতে বেশ লাগছে। তখন রোদের সঙ্গে দুইজন ওয়েটার খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। রোদ সেগুলো রাখতে বললে ওয়েটার রেখে চলে গেলো। মেঘ কেন জানি মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। মেঝেতে এত পানি দেখে রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোয়ালে এনে আলোর চুল মুছে দিলো। আগে মেঘকে নিয়ে হিমশিম খেতো এখন আরেকজন এসে জুটেছে। মেঘ মাথাটা আরো নিচু করে মুখে হাত দিয়ে হাসি আঁটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ওকে এভাবে হাসতে দেখে আলো করুণ দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকাল। অর্থাৎ আমি মুছে নিতে পারব।

রোদ জবাব না দিয়ে চুল মুছে তোয়ালে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। কে জানত, কারো চুল তাকে যত্ন করে মুছে দিতে হবে। তবুও হচ্ছে, একেই মনে হয় বলে ভাগ্য! তবে রোদ এতে মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। কারণ সে জানে, ওরা তিনজনেই এখন পরিস্থিতির শিকার। আর মেয়েটা তো কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ প্রায়। সেই সাথে ওর শরীরের কাঁপুনি তো আছেই।এমতাবস্থায় কীভাবেই বা মেয়েটাকে দায়িত্বহীনের মতো একা ছেড়ে দিবে। সে তো পারবে না। এসব ভেবে রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল। মেঘ আলোর মন খারাপ দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বউমনি, তোমার চুলগুলো কেটে আমাকে দিবা? আমার রুমের দোলনাটা না ছিঁড়ে গেছে। ওটা বাঁধতে নাকি মেলা মজবুত কিছুর দরকার। তোমার চুল দিয়ে বাঁধলে মনে হয় ভালোই হবে।”

মেঘের একথা শুনে আলো মলিন মুখে জোরপূর্বক হাসল। আলোকে হাসানোর জন্য মেঘ এরকম কতশত কথা বলছে, তার হিসাব নেই। মেঘের কাহিনী বুঝতে পেরে রোদও মুচকি হাসল। তারপর ওদের খেতে ডাকল। মেঘ লাফিয়ে গেলেও আলো উঠল না। দাদীমাকে ছাড়া সে কখনো খায় নি। আজ তো দাদীমা ওকে ছেড়ে চিরতরের জন্য চলে গেছে। তাছাড়া কষ্টগুলোও বেহায়ার মতো গলার কাছে এসে জটলা বেঁধে আছে। সে না চাইলেও, বার বার অশ্রুকণাগুলো অঝরে
ঝরে যাচ্ছে। আলোকে উঠতে না দেখে রোদের এবার খুব রাগ হলো। সে উঠে আলোকে টেনে দাঁড় করিয়ে খাবারের সামনে বসিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“প্রায় সাড়ে তিনঘন্টায় তোমাকে নিয়ে কীভাবে রাঙামাটিতে পৌঁছালাম তোমার ধারণা আছে? আমাদের জীবনের রিস্ক নিয়ে তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। এইটুকুন কী বুঝতে পারছ? এত দৌড় ঝাপের মধ্যে মেঘ সারাদিন কিচ্ছু খায়নি।তুমি না খেলে এখন সেও জেদ ধরবে! তাই বলছি, জেদটা না দেখলেই নয়?”

“দাভাই, বউমনিকে বকছো কেন?”
“মেঘ, আমি এখন প্রচন্ড রেগে আছি! তাই কথা না বাড়িয়ে দু’জনে খাওয়া শুরু করো।”
রোদের গম্ভীর কন্ঠ শুনে কেউ আর টু শব্দ করার সাহস করল না। মাথা নিচু করে নিজেদের প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করল। অহেতুক কথা বলে কেউ আপাতত ধমক খেতে রাজি না। রোদ শব্দহীন ভাবে মেঘের প্লেট নিয়ে ওকে খাইয়ে দিতে লাগল। নাহলে ড্রেস নষ্ট করতে মেঘের দুই মিনিট লাগবে না। খেতে না চাইলে সে মূলত এই কাজটাই বেশি করে। আলোর নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে খেতে গিয়ে একপর্যায়ে হেঁচকি উঠে গেলো। রোদ মেঘের মুখে খাবার দিয়ে দ্রুত আলোর দিকে পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে আলো মুখ তুলে দেখে রোদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কিছুটা ভয় নিয়েই পানি দিয়ে কয়েকবার খাবার গিলে খেলো। তাছাড়া গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ওর অবস্থা দেখে রোদ শান্ত কন্ঠে খেতে নিষেধ করে কয়েকটা ওষুধ এগিয়ে দিলো। মাথাব্যথা, গ্যাস্টিক, আর জ্বরের ওষুধ। আলো সেগুলো হাতে নিয়ে বিনাবাক্যে খেয়ে উঠে পড়ল। মেঘেরও ততক্ষণে খাওয়া শেষ। রোদ খাবার নিয়ে কেবল খেতে যাবে, তখন কেউ এসে দরজায় স্বজোরে আঘাত করল। দরজার বাইরে অনেক জনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। আলো আর মেঘ ভয় পেয়ে রোদের পেছনে লুকিয়ে ওর টি-শার্ট আঁকড়ে ধরল। কেউ বিশ্রীভাবে ওদের গালাগাল করছে। রোদ উঠতে গেলে আলো কাঁপতে কাঁপতে ওকে আঁকড়ে ধরে নিষেধ করছে। দরজা খুললেই ওদের ঘোর বিপদ। মাতবররা এখানকার খোঁজ পেলো কীভাবে? তাহলে কী ওদের কেউ ফলো করছিলো? এসব ভেবে রোদের কপালে চিন্তায় ভাঁজ ফুটে উঠল। ওদের এত কষ্ট তাহলে বিফলে গেল? আলো দরজার বাইরের চেচাঁমেচি শুনে ভয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রোদ ওকে কাঁদতে নিষেধ করলে শুনছে না, আবার ওকে ছাড়ছেও না। ভয়ে তো মেঘের অবস্থাও খুব খারাপ। তখন কেউ একজন স্বজোরে দরজায় লাথি মেরে পাহাড়ি ভাষায় বলল,

“দলজা খুল ছালা। আমাল বউলে নিয়ে ফুলতি (ফুর্তি) কলা। আইজ তোরে মেলে পুঁতে দিবো মা**।”
“বছ দলজা তাইলে ভাঙ্গি ফেলি? ওই কুত্তাল বাচ্চালে আইজ তাজা কবল(কবর) দিবো.”
“হুম, তাই কল।”
দরজা কয়েকজন মিলে ধাক্কা দিতেই রোদ সাইডে সরে আস্তে করে দরজা খুলে দিলো। তখন হুড়মুড় করে ছেলে গুলো রুমের মেঝেতে গিয়ে পড়ল। ব্যথা পেয়ে তাৎক্ষণিক উঠতে উঠতে একজন গিয়ে রোদের কলার চেপে ধরল। ওদের গলা ফাটানো চিৎকারে রিসোর্টেের সবাই ছুটে এসেছে। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। মেঘ সোফার পেছনে লুকিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এদেরকে জঙ্গি ভেবে মেঘের অবস্থা আরো খারাপ। এরা দাভাইকে বকছে। তাহলে তাকেও খুব
কষ্ট দিবে। ওইদিনের মতো চড় মারবে, হাত কেটে দিবে, মুখে পাতা গুঁজে নাক চেপে ধরবে। ব্যথা পেয়ে কাঁদলে আবার চড় মারবে। এবার মনে হয় একেবারে মেরেই ফেলতে এসেছে। মেঘ মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে করুণ চোখে আলোর দিকে তাকাল। রোদের কলার চেপে ধরা দেখে আলো অতিরিক্ত টেনশনে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। মাতবরের লোকেরা অবশেষে ওর খোঁজ পেয়েই গেছে। অর্থাৎ ওর জীবনে আয়ূ এখানেই শেষ। আর যাই হোক, মাতববর ওকে সুন্দর ভাবে কখনোই বাঁচতে দিবে না। হয় ওকে খুবলে খাবে, নয়তো মৃত্যুদন্ড!

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১০+১১+১২

এদিকে রোদের সঙ্গে ছেলেগুলোর হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। অকারণে ওরা বিশ্রীভাবে গালাগালি করছে। রুমের জিনিস ভাংচুর করছে। দু’জনের হঠাৎ চোখ পড়ল মেঝেতে পড়া থাকা এক সুন্দরী যুবতীর দিকে। আলোকে দেখে দু’জন হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল। মেঘ ওদের দেখে ভয়ে আলোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
”না ,না, বউমনি! বউমনি বাঁচাও! যাব না, যাব না বউমনিই! আমি ভয় পাচ্ছি, তোমরা এদিকে এসো না। এসো না প্লিজ, দাভাই! দাভাই বাঁচাও!”
ছেলে দু’টো মেঘের কথায় খুব বিরক্ত হয়ে মেঘকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। মেঘ ছিঁটকে গিয়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। মূলত সোফার সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে মাথায় আঘাত পেয়েছে। হঠাৎ মেঘের কান্নার শব্দ শুনে রোদ সেদিকে তাকাতেই, একজন রোদের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিলো। রোদ এক পা পিছিয়ে নিজেকে সামলে স্ট্যাম্প কেড়ে নিয়ে সেই ছেলেকে পরপর দু’টো বসিয়ে দিলো। অন্যজন বাহাদুরি দেখিয়ে এগিয়ে এলে তাকেও দিলো।

রোদ ওদের বার বার বলছিলো, বসে নাহয় ঠান্ডা মাথায় কথা বলুক। এভাবে তো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কিন্তু ছেলেগুলো ওর কোনো কথায় শুনছিলো না। অহেতুক চেচাঁমেচি করে আরো ঝামেলা সৃষ্টি করছিলো। রোদ ওর শরীরের অসংখ্য আঘাত সহ্য করলেও, মেঘের কান্না সহ্য করতে পারে না। আর কেন জানি বার বার মেঘের উপরেই আঘাতগুলো এসে পড়ে। বাচ্চাটা এমনিতেই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। তার উপরে এদের অহেতুক চেচাঁমেচিতে মেঘ আরো ভয় পেয়ে চুপসে গেছে।
রোদের এভাবে মারাতে ব্যাপারটা আরো গোলমেলে হয়ে গেলো। পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে হাতের বাইরে চলে যেতে লাগল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৬+১৭+১৮