এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৬+১৭+১৮

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৬+১৭+১৮
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ওই ছেলেগুলোর একজন অবচেতন আলোর মুখটা দেখে দুই পা পিছিয়ে গেল। সে কিছুটা থতমত খেয়ে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বলল। ওরা যাকে খুঁজছে সে এই মেয়ে না। ছেলেটার একথায় পুরো রুম জুড়ে নিরবতা ছেঁয়ে গেল। রোদ
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেঘকে বুকে আঁকড়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসল আলোর সামনে। আলোর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মেঘ হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে আলোকে ডাকছে। রোদ এক হাতে আলোর গালে আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে ডাকছে,
“আলো, আলো, এই মেয়ে চোখ খুলো।”
“বউমনি উঠো। ওহ্ বউমনি!”

রোদ হাত দিয়ে আলোর নিঃশ্বাসের গতি আর নাড়ি পরীক্ষা করল। নাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। অতিরিক্ত ভয় আর টেনশনে ওর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ না হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। দুই ভাইয়ের ব্যাকুলতা দেখে ছেলেগুলো একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ব্যাপারটা এমন হবে ওরাও ভাবে নি। তখন কয়েকজন পুলিশ এসে ছেলেগুলোকে আগে একদফা মেরে পুরো ঘটনা শুনল। ছেলেগুলো বেধড়ক
মার খেয়ে চিৎকার করতে লাগল। পুলিশ ডেকেছে রিসোর্ট কতৃপক্ষ। তারা এটাও জানিয়েছে, গত দুইদিন ধরে এই ছেলেগুলো যখন তখন রিসোর্টে এসে ঝামেলা করছে। রুমে রুমে ঢুকে পর্যটকসহ সবাইকে খুব হেনোস্তা করে। অযথা গালাগালি করছে। অকারণে দুইজন ওয়েটারকে খুব মেরে আহত করেছে। এসব করার কারণ ছেলেগুলোর থেকে জানা গেল, ওরা একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছে। সেই মেয়ে তার স্বামীকে ফেলে অন্যজনের সঙ্গে পালিয়েছে। এবং এরা খবর পেয়েছে তারা এই রুমে তারা আছে। মেয়েটা ওদের বসের বউ! তাই সবাই তাকে হন্ন হয়ে খুঁজছে। আর মেয়েটাকে খুঁজে না পেলে ওদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। তাই খবর পেয়ে না দেখেই এই রুমে আক্রমন করেছে। মার খেয়ে ছেলেগুলো কাতরাতে কাতরাতে এসব জানাল। মূখ্য কথা, এখানে একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আর ভাগ্যক্রমে, রোদরা এমন ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখানে এসেছে। তাই ওরাও ভয়ে পেয়েছে। এসব শুনে রোদের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। না জানি ওদের আর কত ঝামেলায় পড়তে হয়। তবে ভুলেও সে ওদের সমস্যার কথা কাউকে বুঝতে দিলো না। বিপদ এখনো কাটে নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোদ বিরবির করে উঠে ওয়াশরুম গেল পানি আনতে। সে যে এই মেয়ের আর কতবার জ্ঞান ফেরাবে; আল্লাহ মালুম। রোদ
পানি ছিঁটিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে আলোর জ্ঞান ফেরালো। আলো চোখ খুলে ছেলেগুলোকে দেখে রোদের হাত আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিলো। রোদ ওকে আলতো করে বাহুডোরে জড়িয়ে কোনোমতে শান্ত করল।
যে ছেলেটা রোদের গায়ে হাত তুলেছে; সে মার খেয়ে তখনো মেঝেতে পড়েছিল। পুলিশ দেখে সাহস পেয়ে মেঘ স্ট্যাম্প তুলে সেই ছেলেকে পর পর দু’টো বসিয়ে দিলো। পুলিশ ওকে ধরতে ধরতে ঘুরে আরেকজনের মাথায় বারি দিলো। যে ওকে লাথি মেরেছিল। মারের উপর মার খেয়ে ছেলে দু’টো ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। একজন পুলিশ মেঘকে কোলে তুলে নিয়ে কোনোমতে আটকাল। মেঘ ওদের আরো মারার জন্য ওকে ছাড়তে বলে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে। পুলিশের থেকে
নিজেকে ছাড়াতে না পেরে সে হাতের স্ট্যাম্পটাই ছুঁড়ে মারল।
সেটা গিয়ে পড়ল একজনের হাঁটুর উপর। এইটুকুন বাচ্চার
রাগ দেখে দুইজন পুলিশ মুখ টিপে হাসল। রোদ উঠে মেঘকে কোলে নিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করল। এবং এটাও জানাল, এরা জঙ্গিরা না। তবে একটু দুষ্টু লোক। এটা বলার কারণ মেঘের মন থেকে যেন জঙ্গিদের ভয়টা দূর হয়।

পরিবেশটা শান্ত হলে পুলিশ ওদের বুঝিয়ে ছেলেগুলোকে নিয়ে চলে গেল। এবং রোদকে আশ্বস্ত করল এদের উপযুক্ত শাস্তি দিবে। রোদ পুলিশের কথায় বিশ্বাসী না। সে জানে, পুলিশ টাকা খেয়ে এদের আজই ছেড়ে দিবে। আর ছেড়ে দিলেও পুলিশকে এর কৈফিয়ত অবশ্যই দিতে হবে। তাছাড়া
ছেলেগুলো মা তুলে রোদকে বিশ্রীসব গালি দিয়েছে। আর এটাতে রোদের খুব লেগেছে! এদের উচিত একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। এজন্য সে থানার নাম্বার নিলো। আর জানাল ঢাকায় গিয়ে অবশ্যই যোগাযোগ করবে। এবং সেটা সঠিক মানুষকে দিয়ে।
এখন সন্ধ্যায় ঠিক পূর্ব মুহূর্ত। ওদের সময়গুলো এত বিশ্রী কাটছে বলার মতো না। রোদ এখনো কিছু খেতে পারে নি। খাবারগুলো ওভাবেই পড়েছিল, পরে ওয়েটারকে নিয়ে যেতে বলেছে। সে ছোট থেকেই ঠান্ডা খবার খেতে পারে না। কেন সেও জানে না! এদিকে মেঘ আর আলো শুয়ে গল্প করতে করতে দু’জনেই ঘুমিয়ে গেছে। ওদের একা রেখে রোদ ইচ্ছে করেই নিচে যাচ্ছিল না। ততক্ষণে ওর খাওয়ার ইচ্ছেটাও কেন জানি হারিয়ে গেছে। প্রচন্ড মাথাব্যথাতে চোখ দু’টো লাল দেখাচ্ছে। এখন কিছু খেয়ে ওষুধ নেওয়াটাও জরুরি। সে অসুস্থ হলে এই দু’জনকে কে দেখবে! রোদ এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসির পাওয়ার কমিয়ে চলে গেল। আজ সে একটা জিনিস খেয়াল করেছে। আলো ওকে কিছুটা ভয় পেলেও বিপদের সময় ভরসা করে আবার ওকেই আঁকড়ে ধরে। ওর এই ভয়টাকেই সে এবার কাজে লাগবে। রোদ নিচে গিয়ে খেয়ে আলোদের রুমের সোফাতে শুয়ে পড়ল। মেঘের ঘুম ভেঙ্গে ওকে না পেলে আবার কাঁদতে শুরু করবে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে রোদের ক্লান্ত দু’চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো। তারপর রাতটা রিসোর্টে থেকে,পরেরদিন নতুন একটা সকালের আগমন ঘটল।

রোদ খুব সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে মেঘকে ঘুম থেকে উঠাল। আজ ওরা ঢাকায় ফিরে যাবে। ওদের যাওয়ার কথা শুনে আলোর মুখটা শুকিয়ে গেছে। নিঃশব্দে কয়েকফোঁটা পানিও গড়িয়ে গেল ওর ফর্সা গাল বেয়ে। সে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমের এককোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।তখন রোদ মেঘের চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“তো কী করব?”
“রেডি হও, আমাদের সাথে যাবে। বাড়তি কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করো না।”
একথা শুনে মেঘের খুশি যেন আর ধরে না। সে ওর পছন্দের গান ছেড়ে নাচতে শুরু করেছে। কিন্তু আলো ওদের আর কষ্ট বাড়াতে চাচ্ছে না। এই মানুষগুলো ওর জন্য অনেক করেছে।
ওদের আর কত বিপদে ফেলবে? অনেক তো হলো।ওরও তো বিবেক বলে কিছু আছে। তাছাড়া ছোট থেকেই সে পাহাড়ি অঞ্চলে বড় হয়েছে। শহরের গিয়ে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। তখন রোদরা বিপদে পড়বে, বিরক্তও হবে। ওর যুক্তিহীন কথা শুনে রোদের প্রচন্ড রাগ হলেও যথেষ্ট শান্ত গলায় বলল,

“কথা শেষ? শোনো তাহলে, ঢাকায় নাহয় মাতবর। তুমি একা থাকতে পারবে না। এক মিনিট সময় দিলাম, ভেবে আমাকে জানাও।”
রোদের দেওয়া দু’টো অপশনই আলোর জন্য বেশ কঠিন। সে উপায় না পেয়ে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। রোদ দেখেও কিছু বলল না। বরং ঘড়িতে সময় দেখে ওকে তাড়া দিতে লাগাল। আলো কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে রেডি হতে গেল। আর রোদের মুখ ফুটল বাঁকা হাসি। মেঘও কিছু বলছে না শুধু মিটিমিটি হাসছে। তারপর ওরা হালকা নাস্তা সেরে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা এখান থেকে যাবে চট্টগ্রামে। তারপর সেখান থেকে ফ্লাইটে করে ঢাকায়। আলো গাড়িতে উঠে বসতেই মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। ওর যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিষ্ঠুর পরিস্থিতি অজানা এক পথে পাড়ি দিতে ওকে বাধ্য করছে। এমনটা না হলেও পারত। এখানেই তো বেশ ভালো ছিলো সাধারণ একটা মেয়ে হয়ে।
মেঘ আলোকে কাঁদতে দেখে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ওর কান্নাকাটি মোটেও ভালো লাগছে না। আলোর কান্নার শব্দ শুনে রোদ একবার তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলল,

“কাঁদছ কেন? আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এটাই হয়তো তোমার ভাগ্যে ছিল।”
কথাটা বলে রোদ মুখ ফিরিয়ে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আলো আর মেঘ পেছনের সিটে আর রোদ ড্রাইভারের পাশে। যাতে আলো রোদেরর জন্য অস্বস্তিবোধ না করে। মেঘ ওর ট্যাব বের করে আলোকে কত কী দেখাচ্ছে আর হাসছে। মেঘের কথা শুনে আলোও আর চুপ থাকতে পারল না। দুষ্টুটা ওকে হাসিয়েই ছেড়েছে। আর কান্নার সময় কেউ ঝুঁকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, হাসি তো পাবেই। মেঘ আলোর দিকে ঝুঁকে গালে হাত দিয়ে বসে ওর কান্না দেখছিল। ওর তাকানো দেখে আলো ফিক করে হেসে দিলো। ওকে হাসতে দেখে মেঘ মাথা চুলকে দাঁত বের করে হাসল। তারপর দু’জনেই একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। ওদের ঘুমাতে দেখে রোদ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দু’টোতে কান মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা পথে যাওয়ার পর রোদ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামল। ফ্রেশ হয়ে ড্রাইভারকে সাথে করে খেয়ে মেঘদের জন্য খাবার প্যাক করে নিলো। ওদের ডাকলে কেউ আর ঘুমাবে না। এত লং জার্নিতে ঘুম নাহলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে। রোদ জানে ক্ষুদা লাগলেও আলো মুখ ফুটে কিছু বলবে না। কিন্তু মেঘ, ঘুম থেকে উঠেই আগে খাবার চাইবে। ওদের গাড়িটা আবার নিদির্ষ্ট পথ ধরে চলতে শুরু করল। এখনো কারো ঘুম ভাংগে নি। ওরা আরো দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে সজাগ হলো। রোদ পানি এগিয়ে দিয়ে মুখ ধুয়ে দু’জনকে খেয়ে নিতে বলল। মেঘ তো বিরিয়ানী দেখে সিটেই লাফিয়ে উঠে বলল,

“উু উু বিরিয়ানীই! দাভাই এটা কিসের মাংসের বিরিয়ানী?”
“বিড়ালের।”
“এজন্যই খেতে মজা হবে মনে হচ্ছে। ইয়ে দাভাই, আমি হিসু করব, গাড়ি থামাও!”
“জুরুরি?”
মেঘ আড়চোখে একবার আলোর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল,” হুম, হুম, মেলা জুরুরি বিভাগ!”
রোদ একটা রেস্তোরাঁয় গাড়ি থামিয়ে মেঘকে ওয়াশরুমে রেখে রাখল। তারপর আবার এসে আলোকে চোখ মুখে পানি দিয়ে আসতে বলল। আরো অনেকটা পথ ওদের যেতে হবে। এভাবে একনাগাড়ে বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে। আর
এই মেয়ে যে মুখচোরা প্রয়োজন হলেও ওকে বলবে না। তাই লজ্জায় না ফেলে রোদ এভাবে বোঝাল। আলো রোদের কথা শুনে নেমে লেডিস ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এই অবধি সব ঠিকই ছিল, কিন্তু বিপত্তি বাঁধল মেঘকে খুঁজে না পেয়ে।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

এদিকে মেঘকে ওয়াশরুমে না পেয়ে রোদ পুরো রেস্তোরাঁ হন্ন হয়ে খুঁজল। সে কোথাও নেই! আলো এক কোণে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এই মাত্রই দুষ্টুটা ওয়াশরুমে ঢুকল। এইটুকুন সময়ের মধ্যে কোথায় গেল? ওর সঙ্গে খারাপ কিছু হলো না তো? আবার কোনো বিপদে পড়ল না তো? এসব ভেবে আলোর হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। মেঘকে সেভাবে কেউ খেয়াল করে নি, তাই ওর কথা কেউ
বলতে পারছে না। ওয়াশরুম, গাড়ি, এবং পুরো রেস্তোরাঁর কোথাও সে নেই। রোদ দ্রুত পায়ে রেস্তোরাঁর বাইরে এসে ঘার ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকাচ্ছে। সামনের রাস্তায় শাঁ শাঁ শব্দ করে দ্রুত বেগে গাড়ি চলছে। এবার চিন্তায় রোদের মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। আলো চোখ মুছে দৌড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ ওর চোখ গেল অদূরে একটা ভাঙ্গা গাড়ির নিচে। মেঘ গাড়ির নিচে বসে একটা বিড়াল ছানাকে আদর করছে। আর মুখ নাড়িয়ে কীসব বলছে। আলো রোদকে ডেকে আঙ্গুল দিয়ে সেদিকে তাকাতে ইশারা করল। রোদ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে গিয়ে দেখে মেঘের সারা শরীরে মাটি লেগে আছে। আর ওর হাতে সাদা রঙ্গের আদুরে একটা বিড়াল ছানা। রোদ দ্রুত দুই পা পিছিয়ে নাকে রুমাল চেপে ধরল। ততক্ষণে একের পর এক হাচ্চু! হাচ্চু! আর হা হাচ্চু!বিড়ালের পশমে রোদের ব্যাপক এলার্জি। সে শত চেষ্টা করেও হাঁচি থামাতে পারে না। তাই বিড়ালের থেকে নিজেকে যথেষ্ট দূরে রাখে। রোদকে এভাবে হাঁচি দিতে দেখে মেঘ ভয়ার্ত চোখে তাকাল। ওর তো মনেই ছিল না দাভাইয়ের সমস্যার কথা। সে করুণ দৃষ্টিতে একবার বিড়াল ছানার দিকে তো একবার আলোর দিকে তাকাচ্ছে। অর্থাৎ আমাকে বাঁচাও বউমনি। আলো কিছু একটা বলার আগে রোদ প্রচন্ড রেগে হুংকার দিয়ে বলল,

“এটা তাড়াতাড়ি সরাও মেঘ। আমি খুব রেগে যাচ্ছি, হাচ্চু!”
“না, আমি একে সঙ্গে নিয়ে যাব দাভাই।”
“কখনো না।”
কথাটা বলে রোদ দুই পা এগোতেই মেঘ দৌড়ে গিয়ে আলোর পেছনে লুকালো। আলো পড়েছে মহাবিপদে! এখানে সে বা কী বলবে! এরা কেউই তো কম না। দুই ভাইয়ের কথার যুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। রোদ আগের যুগের নতুন বরদের মতো নাকে রুমাল চেপে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এক পা এগোতেই মেঘ ওর দিকে বিড়ালছানা ছুঁড়ে মারার অভিনয় করছে। রোদ তখন থেমে যাচ্ছে। পরপর হাঁচি দিতে দিতে ওর বেহাল দশা। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে।

রোদের করুণ অবস্থা দেখে আলোও মেঘকে নিষেধ করছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! বিড়ালটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। এটা সে নিবেই নিবে। মেঘ আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বিড়াল নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। তারপর ওর পরনের নতুন শার্ট দিয়ে বিড়ালটাকে ঢেকে রাখল। যাতে রোদ এসে খাবলা দিয়ে না ফেলে দিতে পারে। ওইদিকে ড্রাইভারও তাড়া দিচ্ছে যাওয়ার জন্য। আলো আড়চোখে একবার রোদকে দেখে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল। রোদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মুখে রুমাল বেঁধে সেও গেল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল তার আপন গতিতে। আলো হাত ধুয়ে মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর মেঘ মাংসের হাড় নিয়ে বিড়ালকে খাওয়াচ্ছে। ছানাটাও বেশ সুন্দর কুটকুট করে হাড় চিবুচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে মেঘের তো খুশির অন্ত নেই। আর রোদ সামনের সিটে বসে মুখে হাত দিয়ে হাঁচি দিচ্ছে। সে শুধু পারছে না মেঘসহ ওই বিড়ালটাকে তুলে আছাড় দিতে। রাস্তায় থেকে কুকুরছানা, বিড়ালছানা, ভেড়ার বাচ্চা তুলে আনা মেঘের একটা বদ অভ্যাস।

গতমাসে ভেড়ার বাচ্চা নেওয়ার জন্য সে কী কান্না। রোদ কোনোমতে ওকে বুঝিয়ে শান্ত করেছিল। একবার প্রতিবেশীর খরগোশ এনে বাসায় লুকিয়ে রেখেছিল। পরে এই নিয়ে কম অশান্তি হয় নি। সে নাকি খরগোশটা প্রথমে কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেশি ওকে দেয় নি, বরং খুব বকেছিল। কেন দিবে না? আর দিবে না তো বকবে কেন? এসব ভেবে মেঘ উনাকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। ওর জন্য একটার পর একটা অশান্তি লেগেই থাকে। তবুও রোদ ভুলেও ওকে বকতে পারে না আর মারা তো দূর। এখন যেমন সে চাইলেই বিড়াল ছানাটাকে ওখানেই ফেলে আসতে পারত। এতে মেঘ খুব কষ্ট পেতো! হয়তো কান্নাও করত। তার কষ্ট হচ্ছে হোক না,তবুও ভাইটা ভালো থাক।

আলো মেঘকে খাইয়ে এক লোকমা মুখে পুরে আড়চোখে রোদের দিকে তাকাল। মানুষটাকে সে খেতে দেখে নি। উনি কী খাবে না? এত বেলা হলো কখন খাবে? নাকি খেয়েছে? ওকে তাকাতে মেঘ বিড়ালের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“বউমনি, আমার দাভাই দেখতে অনেক সুন্দর। চুপিচুপি না সুন্দর ভাবে দেখো।”
মেঘের একটা শুনে রোদ একটা হাঁচি দিয়ে আলোর দিকে তাকাল। আলো ততক্ষণে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে। ইস! মানুষটা ওকে কী ভাবল? এই মেঘটাও না।রোদ আলোর থেকে চোখ সরিয়ে পুনরায় ঘুরে বসল। মেঘ আলোকে লজ্জা পেতে দেখে মিটিমিটি হাসছে আর মনের সুখে কোকাকোলা খাচ্ছে। তখন রোদের সেলফোনটা বিকট শব্দ করে বেজে উঠল। রোদ কলটা রিসিভ করে হুম, হ্যাঁ, না তে উত্তর করতে করতে প্রচন্ড রেগে কথা বলতে লাগল। রাগে শুধু পারছেনা অপর পাশের ব্যাক্তিটাকে গিলে খেতে। আলো আর মেঘ ওর রাগী কন্ঠ শুনে নিজেদের আরো গুটিয়ে নিলো। কেউ আর কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। মেঘ ভয় পেলেও ওর খাওয়া থামে নি, সে ইঁদুরের মতো কুটকুট করে চিপ্স খাচ্ছে। বিড়াল ছানাটাও ভয়ে একটু পিছিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসল। আলো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ সর্বশেষ কথাটা বলল,

“দশ লাখ তো দূর, আমি ফিরে দশ টাকার হিসাবে গড়মিল পেলে ওর খবর আছে!”
কথাটা বলে রোদ কল কেটে পানি খেয়ে সিটে হেলান দিলো। এইটুকু সময় রুমাল সরিয়ে কথা বলাতে ওর হাঁচি শুরু হয়ে গেছে। সে পুনরায় মুখে রুমাল মুখে বেঁধে চোখ বন্ধ করে নিলো। মেঘ তখন আলোর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“এটা নতুন কিছু না। অনেক কিছু বাকি আছে, আগে বাসায় তো চলো।”
মেঘের কথা শুনে আলো কিছু ভয়ে পেয়ে মনে মনে বলল,”এ তো দেখি আরেকটা মাতবর। আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমাকে রহম করো গো মাবুদ। ”
ওদের ফিসফিসানি কথা শুনে রোদ চোখ বন্ধ করে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“আচ্ছা, তোমার বাবা -মাকে তো দেখলাম না।”
” আমার রক্তের সম্পর্কের আর কেউ বেঁচে নেই।”
আলোর কথা শুনে রোদ তাৎক্ষণিক কথা কাটাতে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অনেক ঘুরাঘুরি হলো। বাসায় গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করবে। তা না হলে কী হবে, আশা করি আমাকে আর বলতে হবেনা।”
”আরে না। এবার এত এত পড়ব যে একদিনেই ডাক্তার হয়ে যাবো।”
“দেখা যাবে।”

আলো ওদের দুই ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসল। এভাবে গল্প করে, ঘুমিয়ে, অনেক রাতে ওরা চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাল। ওই রাস্তায় বাস ট্রাকের মারাত্মক এক্সিডেন্টে শতশত গাড়ি জ্যামে আটকে গিয়েছিল। সেই জ্যাম ছুটতেই এত দেরী। ওরা আজও ঢাকাতে পৌঁছাতে পারল না। অনেক চেষ্টা করেও তো সম্ভব হলো না। এতক্ষণ একনাগাড়ে বসে থাকতে থাকতে আলো মেঘ খুবই ক্লান্ত। আর আলো এর আগে কখনো এত লম্বা জার্নি করে নি। তাই কষ্টটা একটু বেশি হচ্ছে। ওদের নিয়ে আপাতত টানাটানি না করে উত্তম। একথা ভেবে রোদ একটা আবাসিক হোটেলের দুইটা রুম বুক করল। হোটেলটা বেশ উন্নতমানের। ড্রাইভার ততক্ষণে উনার প্রাপ্য মজুরি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। হয়তো আরেকটা ট্রিপ নিয়ে আজ রাতেই রাঙামাটি ফিরে যাবেন। রোদ একেবারে ওদের রাতের খাবার অর্ডার করে রুমে প্রবেশ করল। আলো দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ঝাপসা চোখে সোফায় গিয়ে বসল। ওর প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে। মেঘ অনেকক্ষণ আগে রোদের বুকে ঘুমিয়ে গেছে। রোদ ওকে শুইয়ে দিয়ে আলোকে জিজ্ঞাসা করল,

“শরীর বেশি খারাপ করছে?”
আলো জবাবে মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রোদ ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে, অনেক জ্বর। জ্বরের জন্য পুরো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠিক করে দাঁড়াতেও পারছে না। রোদ এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই মেয়ে এই তোমার জ্বর আসল কখন? আমাকে বলো নি কেন?”
আলোর থেকে উত্তর না পেয়ে রোদের মন চাচ্ছে থাপড়ে গাল লাল করে দিতে। এত জ্বর নিয়ে চুপ করে আছে, ফাজিল একটা। রোদ আলোকে দাঁড় করিয়ে ফ্রেশ হতে একেবারে ওয়াশরুমে রেখে আসল। কয়েকদিন ধরেই ওর খুব ধকল যাচ্ছে, শরীরে আর কুলাচ্ছে না। মূলত এজন্যই জ্বর এসেছে। রোদ ঘুমের ঘোরেই মেঘকে খাইয়ে আলোকেও খাওয়ালো। তারপর ট্রলি থেকে জ্বর আর মাথা ব্যথার ঔষধ এনে খাইয়ে আলোকে ঘুমাতে বলল। আলোও ভদ্র মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করল। জ্বরটা আরো বাড়ছে। মাথা ব্যথায় ঘুমও আসছে না।
সে চোখ বন্ধ করে আছে ঠিকই। কিন্ত চোখের কোণা বেয়ে অঝরে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে গেলে বেশ হতো।
রোদ ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে এসে দেখে আলো নিরবে কাঁদছে। আলোর ঘুমের সমস্যা হবে বলেই সে পাশের রুমে গিয়েছিল। রোদ আলতো করে আলোর মাথায় হাত রেখে বলল,

“মাথাব্যথা কমে নি?”
“উহুম!”
রোদ আলোর পাশে বসে আস্তে আস্তে ওর কপাল ম্যাসাজ করতে লাগল। একটু আরাম পেয়ে আলোর চোখ দু’টো ঘুমে বন্ধ হয়ে আসল। ক্লান্ত শরীরে ঘুমটা যেন ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। তারপর রোদ ওঠে পানিতে রুমাল ভিজিয়ে আলোর কপালে রাখল। জ্বরের উত্তাপে রুমালটা সাথে সাথে গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রানবন্ত মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে পাংশুটে
হয়ে গেছে। রোদ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
“রেখে আসলে যে কী হতো, আল্লাহ মালুম! যে মুখচোরা একটা মেয়ে।”

রোদ হঠাৎ খেয়াল করল আলো বিরবির করে কিছু একটা বলছে। রোদ কান পেতে ওর অস্পষ্ট কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল। এবং সারমর্ম বুঝল কেউ জোরে ধমকালে ওর জ্বর আসে। রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরে বসে অনেক রাত অবধি জলপট্টি দিতে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পর আলোর জ্বরটা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। তখন রোদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওখানে বসেই ঘুমিয়ে গেল। ওর শরীরটাও খুব ক্লান্ত। গত কয়েকদিন ধরে ওর উপর দিয়েও কম ধকল যাচ্ছে না। তার উপরে এত লং জার্নি! পরেরদিন খুব সকালে কিছুটা সুস্থবোধ করেই আলোর ঘুম ভেঙ্গেছে। ওর শরীরে এখন জ্বর নেই। ততক্ষণে মেঘ উঠে লাফালাফি শুরু করেছে। বিড়াল আর পাখির গভীর শোকে সে বসে ডোরা কেক খাচ্ছে। তার মুখটা বন্ধ নেই! ওদের অনবরত বকবকানি শুনে অগত্যা রোদকেও উঠতে হলো। তাছাড়া তো উপায় নেই। তারপর তিনজনে নাস্তা সেরে সব গুছিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে নিলো। এবং যথাসময়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছাল। বিড়াল ছানাটাকে মেঘ কালকে রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়েছে। রোদের কষ্ট হচ্ছে দেখে। সে দাভাইয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। প্রথমে ভেবেছিল একটুপরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি বরং রোদের হাঁচিটা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তাই মেঘও আর জেদ করে নি। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর ওরা ঢাকায় পৌছাল। তারপর নিজেদের গাড়ি করেই বাসার পথে রওনা দিলো।

আর আলো পদার্পণ করল নতুন এক শহরে অচেনা মানুষের ভিড়ে। শুধুমাত্র কারো ভরসার হাতকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার আকাঙ্খায়। ওর রঙ্গিন স্বপ্নগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দেখার প্রবল বাসনায়। হয়তো এখান থেকে শুরু তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। আর নয়তো এখানেই শেষ তার জীবনের নব্য গল্প।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ওরা প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছাল। রোদ আগে নেমে দরজা খুলে মেঘদের নামতে ইশারা করল। মেঘ লাফ দিয়ে নেমে চিৎকার করতে করতে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল। সবাইকে তো জানাতে হবে সে আজ বাসায় ফিরেছে। রোদ ওকে দৌড়াতে নিষেধ করে আলোর দিকে তাকাল। আলো দুরুদুরু বুকে ঢোক গিলে আস্তে ধীরে নামল। ভ্যাপসা গরমে এসি গাড়ি থেকে নেমে অবস্থা আরো খারাপ। মনে হচ্ছে পুরো শরীরে আগুন লেগে গেছে। বাতাসও নেই! গাছপালা গম্ভীর রুপ নিয়ে থম মেরে আছে। আবহাওয়াও যেন প্রচন্ড রেগে তাপমাত্রা দ্বিগুন হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আজ কেন এত রাগ কে জানে! এখন বাজে এগারোটা সাত। অথচ সূর্যের কড়া তাপ দেখে মনে হচ্ছে মধ্য দুপুর।

আলো গাড়ি থেকে নেমে এক সাইডে সরে দাঁড়াল। ড্রাইভার ট্রলি বাসায় রেখে গাড়ি পার্ক করতে গেলেন। রোদ অদূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ওর কথা শুনে স্পষ্ট জরুরি কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। হয়তো অফিসের কোনো ব্যাপারে। একা একা বাসায় প্রবেশ করাটা আলোর কাছে বেশ দৃষ্টিকটু লাগছে। তাই সে দাঁড়িয়ে রোদের অপেক্ষা করছে। আর মেঘ তো একাই চলে গেছে। মূলত সে ওয়াশরুমে গেছে। যাওয়ার
আগে আলোকে ইশারায় সেটাই বুঝিয়েছে। আলো ওখানে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলালো। রোদরা যে এত উচ্চবিত্ত আলো ভাবে নি। তবে ওদের চাল-চলন ব্যবহারে বুঝেছিল ওরা বেশ ভদ্র এবং স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। তাই বলে এতটা! আর না বোঝার মূখ্য কারণ ওদের মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র পায়নি। উচ্চবিত্তদের মতো সামান্য ব্যাপারে নাক কুঁচকাতেও দেখে নি। বরং মিশুক ভাবে দু’জনের মধ্যেই বিদ্যামান। কিন্তু এখানে এসে পা রাখতে না রাখতেই ওর ভুলটা ভেঙ্গে গেল। সেই সাথে আলো লজ্জায় আর মাথা তুলে তাকাতে পারল না। একরাশ আফসোস এসে ওকে আঁকড়ে ধরল।

এত উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেদের সে প্রথমদিন কলার মোচা আর ডিম দিয়ে খেতে দিয়েছিল। আর শুতে দিয়েছিল শক্ত কাঠের বিছানায়। অথচ তারা থাকে রাজ প্রসাদের মতো বাড়িতে আর হয়তো খাবার খায় বেশ উন্নতমানের। সম্ভবত
চক্ষু লজ্জায় কিছু বলতে পারে নি। এসব ভেবে আলোর কেন জানি নিজেকে খুব ছোট মনে হলেও, পরক্ষণে আবার ভাবল সে তার সামর্থ্য অনুয়ায়ী করেছে। ওর কষ্টের উপার্জন দিয়ে ওদের যথাসাধ্য আপ্যায়নের চেষ্টা করেছে। রোদ বা মেঘ তো ওকে ছোট করেনি। বরং ওদের সঙ্গে সহজে মিশে গেছে। এটা ভেবে তাৎক্ষণিক মিষ্টি হেসে আশপাশটা অবলোকন করল।
রোদদের রাস্তায় পাশে সাদা রংয়ের দো’তলা বাড়িটা বেশ আর্কষনীয়। বিশেষ করে বাড়ির নকশাটা! রাজকীয় একটা ব্যাপার আছে। বাড়িতে ঢুকতেই পিচচালা রাস্তার একপাশে ফুলের বাগান। সেখানে নাম না জানা অসংখ্য ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েক ধরনের ফুলও ফুটেছে! রাস্তার দুই ধারে চা পাতার মতো গাছগুলো ডিজাইন করে কাটা, অপর পাশে একটা সুইমিং পুল। নীল স্বচ্ছ পানি সেখানে টলমল করছে। বাগানের মাঝখানে সাদা রঙ্গের একটা দোলনা এবং তার পাশেই পানির ফোরায়া। ঝিরঝির করে মাছের মুখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। সেই পানি একটা বাচ্চা ছেলে হাত পেতে ধরছে। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।

আলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদ দ্রুত কল কেটে ভেতরে প্রবেশ করল। ওর খেয়ালই নেই আলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কথার তালে সব ভুলে গেছে। আলো বাড়ির ভেতরের সৌন্দর্য দেখে আরেকদফ অবাক হলো। তবে সেটা প্রকাশ করল না। এভাবে তাকাতে দেখে যদি কেউ হাভাতে ভাবতে পারে। সে গরীব! তবে হাভাতে তো নয়! তাই নিজেকে যথেষ্ট সামলে মেঘের পাশে বসল। মেঘ সোফাতে উপুড় হয়ে শুয়ে গেম খেলছে। রোদ অপর সোফায় বসে কাউকে পানি দিতে বলল। তাৎক্ষণিক একজন সুন্দরী মেয়ে এসে ওদের পানি দিয়ে গেল। আলোর ঠিক সামনে কাঠ আর ঝকঝকে মোটা কাঁচের তৈরী সেন্টার টেবিল। অনেক বড় ড্রয়িংরুমে বিভিন্ন আসবাবপত্র , নামী দামী শোপিস, এক সাইডে রাজকীয় সোফা, দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের পেইন্টিং, অপর দেওয়ালে
বিশাল বড় একটা দেওয়াল ঘড়ি। ঘড়িটা তখনই টিকটিক ঢং ঢং শব্দ করে সঠিক সময় জানান দিলো। আলো চমকে উঠে ধরফড় করে উঠে বুকে থুথু দিলো। ওকে ভয় পেতে দেখে মেঘ খিলখিল করে হেসে উঠল। আর রোদ ভ্রু কুঁচকে নিলো।
ভয় পেলে বুকে থুথু দিতে হয়? এটা কেমন সাইন্স? এটা তো জানত না। মেঘ তখন হাসতে হাসতে উঠে বসে বলল,

“বউমনি, আমাদের বাসা পছন্দ হয়েছে?”
“হু হুম, বাড়িটা জান্নাতের মতো সুন্দর করে সাজানো।”
একথা শুনে রোদ একবার তাকিয়ে ফোন স্কল করতে লাগল।
পাহাড়ি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রামের মেয়েটা এর আগে এতকিছু দেখেনি। বিলাসিতা জিনিসটার সঙ্গে সে পরিচিতও না। তাই হয়তো অতি সহজেই জান্নাতের সাথে তুলনা করে ফেলল।
আর জান্নাতের সঙ্গে তুলনা করা মানে বিরাট ব্যাপার। যদিও
সুখ সমৃদ্ধ ভালোবাসাপূর্ন প্রতিটা পরিবারই এক একটা জান্নাত। অথচ ওর জায়গায় উচ্চশিক্ষিত মর্ডান কোনো মেয়ে থাকলে, সো নাইস, দারুণ, ওয়াও, অসাধারণ, বিউটিফুল, এসব বলে সৌন্দর্যের প্রশংসা করত। নয়তো অকপটে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করত।
রোদ ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে, ঘুম দাও।”
“এখন?”
“হুম, চলো বউমনি।”

মেঘ আলোকে এক প্রকার টেনে দোতলায় নিয়ে গেল।রোদও উঠে আলোকে একটা রুম দেখিয়ে দিল। রোদ আর মেঘের মাঝখানের রুমটা আলোর। মেঘ নিজ দায়িত্বে আলোকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। কোথায় কী রাখা দেখিয়েও দিচ্ছে।পড়াশোনা বাদে সে সব বিষয়ে পটু। এসব কাজে তো তাকে বলতেও হয় না। সে যেন একাই একশ! রোদ চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবার থেমে গিয়ে বলল,
“ওই ড্রেস গুলোর একটা আপাতত পড়ো। বাইরে গেলে আর কয়েকটা কিনে দিবো।”
আলো উত্তর না দিয়ে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। রোদের কেন জানি খুব রাগ হলো। সে কিছু বললেই মেয়েটা এভাবে মাথা নাড়ায়, নয়তো চুপ থাকে। বিনাবাক্যে জবাব দেওয়া সম্ভব নাহলে তবে দুই একটা কথা বলে। এটা কেমন ব্যবহার?
এমন করার মানে কী?রোদ রাগটা কোনোমতে সামলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“মুখে বলতে কী হয়? বোবার মতো মাথা নাড়াও কেন?”
“বু বুঝেছি, ও ওই ড্রেসেই হবে সমস্যা নাই!”

রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে হনহন করে চলে গেল। রোদের প্রস্থানে আলো হাফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ যেন দম টা আটকে ছিল। তারপর তিনজনে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রুমে চলে গেল। মেঘ আলোর রুমেই আছে। দু’জন শুয়ে ফিসফিস করে কীসব গল্প করছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। ব্যাপারটা মোটেও তা না। আর ওদের তো গল্পের কোনো সমাপ্ত পার্টও নেই। এই চলছে তো চলছেই। রোদ দরজা নক করে রুমে ঢুকে সাবধানে থাকতে বলে অফিসে চলে গেল। ওর যাওয়াটা খুব জরুরি। নাহলে আজ রেস্ট করত। তাছাড়া বাসায় শেফ থেকে শুরু করে সব কাজের জন্য লোক নির্ধারণ করা আছে। তারাই সব কাজ সম্পূর্ন করে সঠিক সময়ে ওদের খেতে ডাকবে।

আজ প্রায় তিনদিন ধরে মাতবরের লোকেরা আলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওকে না পেয়ে মাতবরের মস্তিষ্ক যেন বিগড়ে গেছে। মতি সেই রাগ তুলতে গত রাতে দু’টো মেয়ে তুলে এনেছিল। তাদের অমানুষের মতো ধর্ষণ করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়েও রেখেছে। মেয়ে দু’টোর আঁকুতি ওর কঠিন হৃদয়ে নাড়া দেয় নি। ওদের ছটফটানি আর চিৎকারে সে আরো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। ওর পুরো শরীরে যেন কাম উত্তেজনা দ্বিগুন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে পৈশাচিক আনন্দে বিভোর ছিল। ছেলের দেখে মাতবরও রাগ কমাতে মেয়ে দু’টোর শরীর খুবলে খেয়েছে। কার্য শেষে ওদের নিস্তেজ নগ্ন শরীরে লাথি দিতে উনি ভুলেন নি। লাথি, গালাগালি, এবং থুথু ছিটিয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন।
উনার আবার ননভার্জিন মেয়ে মোটেও পছন্দ না। ননভার্জিন মেয়ে উনার দু’চোখের বিষ। উনি নিজে ননভার্জিন করলেও।
অসহ্য ব্যথাযুক্ত শরীরে লাথির আঘাতে মেয়ে দু’টোর প্রান যায় যায় অবস্থা। নিভু নিভু চোখে তারা হয়তো আল্লাহকে বিচার জানাচ্ছিল। নিরবে অশ্রু ঝরিয়ে বাবা-মা আর ছোট ভাই-বোনদের মুখটা স্মরণ করছিল। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে আফসোসে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ছিল। নিরবে নিজের জীবনকে বড্ড তুচ্ছ ভেবে ঘৃণা করছিল। অবশেষে অল্প বয়স,শারীরিক অত্যাচার, এবং অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে ওদের প্রাণপাখি উড়ে গেল। তারা মৃত লাশে পরিণত হলো। চিরতরের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল। এবং প্রান যাওয়া পরপরই তাদের চুলের মুঠি ধরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। নগ্ন শরীরে লাশ হয়ে তারা ঝুলতে থাকল। নিষ্পাপ চোখ দু’টো বন্ধ করে যেন ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। নিষ্ঠুর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে ওরা মুক্তি পেলো। ওদের একজনের বয়স দশ আর আরেকজনের তেরো। সদ্য বেড়ে ওঠা নিষ্পাপ দু’টি ফুল। আজ অমানুষদের কবলে পড়ে দু’টো ফুলই অকালে ঝরে গেল। না দিলো ওদের বাঁচতে আর না দিলো শান্তিময় মৃত্যু!

মাতবর মতিকে উনার রুমে ডেকে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন। আর জানালেন গ্রামের মেয়ে আর না তুলতে। এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনকে উনারা তুলে এনেছেন। এমন করলে গ্রামবাসী জেনে যাবে ক্ষিপ্ত হয়ে বেঁকে বসবে। তখন ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে। একথা শুনে মতি বেশ বেজার হয়ে বলল,
“আব্বা, শলীল ঠান্ডা না হইলে আমাল ঘুম আছে না। একথা লাখতে আমি পালব না।”
“আলে বাই** গেলাম থেকি তুলি আনতে নিছেদ কললাম। তুই অন্য জায়গা থেকি আনবি।”
” কুন জায়গা থেকি আব্বা?”
“পাহালে কত সুন্দল সুন্দল বেডিলা ঘুরতে আছে ৷ ওদেলই ছুযোগ বুঝে তুলি আনবি। আল শহুলেল বেডিগো গতর নরম হয়, দেখবি মজা বেছি পাইবি।”

একথা শুনে মতির চোখ দু’টো চকচক করে উঠল। সে নারীর দেহের পাগল। নারীর দেহের কথা শুনলেই ওর পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে। আর এই শিরশিরানি কমে কারো দেহকে খুবলে খেয়ে। মতি মাতবরকে আজ সন্ধ্যার পরপরই রেডি থাকতে বলল। আজকেই ওরা শহরের একটা না একটা ফুল
তুলবে। সে যে করেই হোক। ওরা এবার শহরের ফুলের ঘ্রাণে উন্মাদ হবে। এসব বলে বাবা ছেলের মুখে বিশ্রী একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। আবার কোন মায়ের বুক খালি হবে কে জানে! কার ভাগ্য কাকে এখানে টেনে আনবে তাও অজানা। শুধু জানা এইটুকু কেউ নিঃশেষ হবে আর সেটা নির্মম ভাবে। না পারবে কিছু বলতে, আর না পারবে নিজেকে বাঁচাতে। শুধু থাকবে আত্মচিৎকার, কষ্ট, ছটফটানি,অশ্রু, সতিচ্ছেদ, রক্ত, অতঃপর মৃত্যু। ব্যস, এই খেলা এখানেই শেষ।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৩+১৪+১৫

গভীর পাহাড়ে লুকায়িত জঙ্গিদের একটা দল মাতবরদের থেকেও নিকৃষ্ট। যদিও এদের সঙ্গে ওদের কোনো মিল নেই। তবে দু’টোই অমানুষ বর্বর এবং নিকৃষ্ট জাতি। মাতবর সেই দলের অন্তর্ভুক্তও নয়। তবে উনি ওই জঙ্গিদের ভয় পান। এর যথাযথ কারণও আছে বটে। সেই জঙ্গিরা গত সপ্তাহে ঘুরতে আসা তিন বন্ধুকে অপহরণ করেছিল। এবং তিনজনেরই করুণ অবস্থা করে দুইদিন পর বলি দিয়েছে। ছেলেগুলোর টাটকা রক্তে তাদের উপাসকের আরাধনা করেছে। জঙ্গি মেয়েরা টানা দুইদিন ধরে তাদের ফায়দা উঠিয়েছে। টগবগে যুবক পেয়ে ওরা হাত ছাড়া করে নি। ছেলেগুলো একপর্যায়ে
অবচেতন হলে তাদের শরীরে আগুনের ছ্যাকা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছে। শুকূরের কলিজা দিয়ে তৈরী জিনিসটা ওদের জোরপূর্বক খাইয়েছে। ছেলেগুলো আর সহ্য করতে না পেরে কাঁদলে জঙ্গি মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠেছে। তাদের কাছে ব্যাপারটা খুব মজার ছিল। তারপর ছেলেগুলোকে আধমরা হয়ে বলি হতে হলো।

একদিকে মতি আর মাতবের কাছে নারীর দেহ অতি তুচ্ছ। আর অন্য দিকে লাজ-লজ্জা ভুলে জঙ্গি মেয়েরা পুরুষের শরীরের পাগল। জঙ্গি গোষ্ঠীর পুরুষরাও কিছু বলে না। এটা তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং তারা আরো উল্লাসে মেতে ওঠে। পাপ করতে করতে এদের মন থেকে বিবেক, অনুশোচনা, অপরাধবোধ, একেবারেই মুছে গেছে। আর ভদ্র সমাজের ছেলে-মেয়েগুলোও পৃথিবীর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ডুবতে এখানে আসে। ধরাকে সরা জ্ঞান ভেবে মর্জি মতো চলাফেরা করে। তারপর নিজেদের অসাবধনতায় এদের হাতে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ফলস্রুতিতে ভয়ংকর এক পরিস্থিতির শিকার হয়। তাছাড়া প্রতিটা জায়গা অর্থাৎ গ্রাম, শহর অথবা পাহাড়ি র্দূগম অঞ্চলের সবখানে ভালো মন্দের এক একটা ঘটনা লুকায়িত থাকে। আশ্চর্যজনক ভাবে এই ব্যাপারে ভালোটা সব সময় প্রকাশিত হয় বিধায় সবাই জানে। আর খারাপটা অপ্রকাশিত থেকে যায়। আর প্রকাশিত হবে কীভাবে? এখানে মিডিয়া, টিভি, সোশ্যাল সাইড, লাইভ তো দূর নেটওয়ার্ক অবধি নেই। আর না আছে কোনো নিরাপত্তা। এজন্যই এসব ঘটনা মাটিচাপা পড়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা ভালোর টানে ছুটে এসে অসাবধানতায় মুখ থুবকে খারাপের কবলে পড়ে। কত মায়েদের বুক খালি হয়।
যার মূখ্য উদাহরণ রোদ, মেঘ আর ওই তিনটে ছেলে।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৯+২০+২১