এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৯+২০+২১

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৯+২০+২১
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

হাসি-কান্না আর সুখ-দুঃখের সমীকরণে আমাদের ছোট্ট
জীবন। কখন কোথায় গিয়ে জীবন থমকে যায়, কেউ বলতে পারে না। এটাও বাস্তবিক দিক! আর ভাগ্যের খেলা, এটার রীতিনীতি কোনো নিয়মকানুন বলে কিছু নেই৷ অদৃশ্যভাবে এটা চলতেই থাকে। না কেউ দেখতে পারে আর না কেউ আটকাতে পারে। তবুও মানবজাতি ভাগ্যেবিশ্বাসী! সেই ভাগ্যের পরিণতি হোক প্রাপ্তির বা অপ্রাপ্তির।
যেমন ভাগ্যে না থাকলে আলোর আজ সব হারিয়ে এখানে আসত না। আপনজনকে হারিয়ে অচেনা কাউকে ভরসা করত না। সেও তো এমনটা চাইনি। তবুও তো হলো! ওর এই ভাগ্য ওকে এখানে এনেছে। এসব ভেবে আলো নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিলো। ঘুমন্ত মেঘ কোলবালিশ জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটা সত্যি খুব মায়াবী। খুব অল্প সময়ে আলোর মনে জায়গা করে নিয়েছে। মেঘের প্রতি আলোরও গভীর একটা টান অনুভব হয়। মনে হয় ওর খুব, খুব আপন কেউ!

রিসোর্টে মেঘের বলা কথাগুলো আলোর কানে এখনো বাজে৷ এইটুকুন বাচ্চা অথচ কতটা বুঝদার! এই বয়সেই বাবা মাকে হারিয়ে কত কষ্ট বুকে চেপে রাখে। দাভাই কষ্ট পাবে দেখে বলেও না। অকারণে বাবা মায়ের জন্য জেদও করে না। আর
ওই মানুষটার কলিজা তো এই দুষ্টুটা। উনিও মনে হয় মেঘের জন্য বাঁচার শক্তিটুকু অর্জন করেছেন। পাহাড়ে মেঘেকে না পেয়ে রোদের করুণ অবস্থা সে স্বচক্ষে দেখেছে। রোদের সেই ব্যাকুলতা দেখে ওরও মন কেঁদে উঠেছিল। ওদের ভালোবাসা দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। আলো আনমনে এসব ভেবে মেঘের কপালে একটা আদর দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলো।
এই ঘুমটা ওর বড্ড দরকার! নাহলে কতশত চিন্তারা এসে ওকে একদন্ডও শান্তি দিবে না।
রোদ অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের থেকে সব সমস্যার কথা শুনল। দশ লাখ টাকার হিসাবে গড়মিল দেখা দিয়েছে৷ এত
টাকার হিসাব কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। অথচ রোদও এই টাকা তোলে নি। তাহলে? রোদ একে একে ফাইল চেক করে আকাশকে ডেকে পাঠাল। সেই টাকার ব্যাপারটা দেখাশোনা করে। আকাশ জানাল, সে দুই ঘন্টা পর সব হিসাব মিলিয়ে আসছে। রোদ ম্যানেজারকে যেতে বলে গত কয়েকদিন কিছু কাজের ফাইলগুলো দেখতে লাগল।
রোহান সিটি বাজাতে বাজাতে রোদের বাসায় প্রবেশ করল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ড্রয়িংরুমে কেউ নেই! রোহানকে দেখে একজন সার্ভেন্ট এসে কুশল বিনিময় করল। রোহান হাসি মুখে উত্তর দিয়ে মেঘের খোঁজে রুমের দিকে পা বাড়াল। এবং বলল সে আজ দুপুরে এখানে খাবে। মেঘকে চমকে দেওয়ার জন্য রোহান শব্দহীন পায়ে মেঘের রুমে প্রবেশ করল। মেঘ নেই! কোথায় গেল?
মেঘ রোদের রুমে ভেবে সে যাওয়ার সময় মাঝখানের রুমে উঁকি দিলো। সে মূলত ফ্যানের শব্দ পেয়ে উঁকি দিয়েছে। এই বাসায় মেয়ে! কেমনে সম্ভব? তাও আবার মেঘকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। মেঘ তো সহজে যার তার কাছে যায় না, তাহলে কে এই যুবতি? রোহান বেশ অবাক হলো। মেয়েটা পাশ ফিরে
ঘুমানোর জন্য রোহান তার মুখটা দেখতেও পেলো না। চুলের জন্য মুখটা আড়াল হয়ে আছে৷ সে আর দেখার চেষ্টা করল না। মেঘকে ঘুমাতে দেখে রোহান ড্রয়িংরুমে বসে সার্ভেন্টকে ডেকে বলল,
“রোদ কই? ওই মেয়েটা কে?”
“মেহবুব স্যার অফিসে গেছে। আর মেয়েটাকে আমি চিনিনা। তবে স্যার বলেছে, মেয়েটা এখন থেকে এখানে থাকবে। ওই মেয়েটার নাম ‘আলো’।”

সার্ভেন্ট এতটুকু বলে রোহানকে কফি দিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
রোহান কফির মগে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
” তা এই কন্যা দিনের আলো নাকি সূর্যের আলো? ব্যাপারটা খুঁচিয়ে দেখতে হচ্ছে তো।”
তখন একটা মেয়ে হাই হিলের কটকট শব্দ তুলে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসল। রোহান মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই এখানে কেন?”
রিমি নামের মেয়েটা উত্তর দিলো,” রোদ আসতে বলল। কেন আসতে পারি না?”
“একদম কথা প্যাঁচাবি না ডাইনি।”
ওদের কথার মাঝে আকাশ এসে সোফায় বসে শরীর এলিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড ক্লান্ত! রিমি মৃদু হেসে আকাশের চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিলো। রিমির কাজই ওর চুল এলোমেলো করে দেওয়া। নাহলে মেয়েটা মনে হয় শান্তি পায় না। যে করেই হোক আকাশে চুল এলোমেলো করবেই।

রোহান চুপ করে একমনে ফোনে চ্যাট করছে। সে ভালোমতো
জানে এরপরের কাহিনী কী হবে? আকাশ প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে রিমির স্পর্শ অনুভব করছে। হঠাৎ স্বজোরে চুলে টান পড়াতে আকাশ ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। রিমিকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে আকাশও রিমির চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। ব্যস, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। এটা রোহানদের মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই সে বিরক্ত হয়ে ফোন স্কলে মনোযোগ দিলো। রিমি আকাশের চুল ছেড়ে তেড়ে গিয়ে রোহানের চুল ধরল। সে কোনো বিরক্ত হবে? রোহান গালি দিয়ে রিমিকে চুল ছাড়তে বলছে, কিন্তু কে শুনে কার কথা! রিমির এক হাতের মুঠোয় রোহানের চুল আর অন্য হাতে আকাশের। ওরা সমানে চিৎকার করছে। তিনজনের চিৎকারে আলোদের ঘুম ভেঙ্গে দু’জনেই দৌড়ে সিঁড়ির কাছে আসল। একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে দু’জনে ওদের মারামারি দেখছে।রোদ বাসায় ফিরে ওদের মারামারি দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসেই শুরু করে দিয়েছিস? আকাশ ফাইল এনেছিস?”
“হুম।”

আকাশ চুল ঠিক করে ফাইলটা রোদের দিকে এগিয়ে দিলো। এবার হিসাব বরাবর! কালকে গিয়ে রোদ নিজে এর সমাধান করবে। এসব বিষয়ে আলোচনা করে রোদ রিমিকে বলল,
“ফ্রি আছিস কখন? কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল।”
”তুই! আমার সঙ্গে? তাও শপিং!”
রিমির রিয়েকশক দেখে আকাশ আর রোহান শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর রোদের পরবর্তী কথাটা শুনে তিনজনেই চোখ বড় বড় তাকাল। কারণ রোদ বলেছে, লেডিস জিনিসপত্র কিনতে ওর সাহায্য করতে। এসব বিষয়ে সে আনাড়ি! তখন মেঘ দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নেমে ওদের কাছে গেল। দুষ্টু মেঘকে পেয়ে ওরা কাতুকুতু দিতে লাগল। মেঘের তো হাসি থামে না। সেও উচ্চশব্দে হেসে ওদেরও কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করছে। আলো চুপ করে এসব দেখে রুমের দিকে পা বাড়াল। ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে কী না সে বুঝতে পারছে না। যদি রোদ বিরক্ত হয়? অথবা ওই মেহমানরা যদি ওকে পছন্দ না করে? মূলত এসব ভেবেই সে রুমে যাচ্ছিল। হঠাৎ রোদ আলোকে যেতে দেখে ডেকে নিচে আসতে বলল। ততক্ষণে সবার নজর আলোর উপর। আলো মৃদু পায়ে ওদের সামনে গিয়ে সালাম দিলো। রোহানরা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সালামের উত্তর নিলো। ওদের এভাবে তাকাতে দেখে আলো একরাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আলোকে পাশে রিমিকে দেখিয়ে বলল,

“বউমনি, এটা কটকটি(রিমি)। পাশের জন হচ্ছে (আকাশ) সোনাপতি বিটকেল আর ওইটা মিস্টার চিংগাম।”
এত সুন্দর মানুষগুলোর নাম শুনে আলো বেশ অবাক হলো। শহরের মানুষ এমন নাম হতেই পারে ভেবে সে চুপ থাকল। শহরের মানে বলে কথা! রোদ খেয়াল করল রোহান, রিমি, আর আকাশ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু জানার প্রবল ইচ্ছায়। বিশেষ করে মেঘের মুখে বউমনি ডাক শুনে ওদের হার্ট এ্যার্টাক করার উপক্রম। রোদ ব্যাপারটা বুঝে আলোকে ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। আলোও
জানল এরা তিনজনে রোদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আকাশ রোদের অফিসে চাকরি করে। রোহান একজন সাংবাদিক আর রিমি ফ্যাশান ডিজাইনার। রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে অল্প কথায় ওর এখানে আসার কারণটা জানাল। সব শুনে ওরা কেউ আলোকে স্বান্ত্বণার বাণী দিলো না দেখে
আলোর ভালো লাগল। রিমি আলোর থুতনী ধরে মুচকি হেসে বলল,
“দোয়া রইল, তুমি অনেক বড় হও! আর হ্যাঁ, আমরা কিন্তু খুব কথা বলি, তাই মেপে গুনে কথা বলতে পারব না। এখন তুমি পরিবারের একজন। আর এই পরিবারটা আমাদের কাছে কী কয়েকদিনেই বুঝে যাবে।”

“জি।”
তখন মেঘ ভ্রু কঁচকে রিমির কথার প্রতিবাদ করে বলল,”এই কটকটি, আমার বউমনি আরো বড় হবে কেন? এখনই তো মেলা বড় আছে। তুমি দেখি কানাও আছো!”
মেঘের একথা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর আড্ডা শেষ করে সবাই দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসল। আলো মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে আর ওদের ঝগড়া দেখছে। এরা সবাই খুব মিশুক! ওদের কান্ড দেখে না হেসে পারছে না। ওর মনটা এখন বেশ ভালো হয়ে গেছে। বিষন্নতা দূর করতে বন্ধুদেরও প্রয়োজন আছে। সে আজ খুব করে অনুভব করছে। আকাশ আর রোহান রিমিকে কথার খোঁচা মেরে রাগিয়ে দিচ্ছে। মেঘ ওদের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে আর রিমি রাগে ফোসফাস করছে।
তবে রোদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সে পূর্বের মতোই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে ওরা সন্ধ্যার পূর্বে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। রিমি রোদকে বলল কালকে শপিংয়ে যাবে। কালকে সকালে সে কিছু ফ্রি আছে।
তিনজনে হাসি মুখে আলোর থেকে বিদায় নিলো। আলোও তাদের আবার আসতে বলে সাবধানে যেতে বলল। তখন রোহান দাঁড়িয়ে গিয়ে মুচকি হেসে আলোকে বলল,

“তোমার একটা নাম দিলে তুমি রাগ করবা?”
আলো না বোধক মাথা নাড়াতে গিয়ে হঠাৎ করে রোদের দিকে চোখ পড়ল। এই মেয়ে আসলেই অদ্ভুত! কথা বললে মনে হয় ওর খুব কষ্ট হয়। যে যাই বলুক, নাড়া সে নাড়াবেই।
রোদকে তাকাতে দেখে আলো মাথা নাড়ানো থামিয়ে মুখে উত্তর দিলো,”জি না।”
রোহান আলোর উত্তর শুনে বলল,
“আজকে থেকে তোমাকে আমি ‘পাহাড়ি ফুল’ বলে ডাকব।”
“আচ্ছা।”
“পছন্দ হয়েছে?”
“জি।”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রিমিরা হাসি মুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তারপর মেঘ খুব বায়না ধরল সে নুডলস খাবে। মূলত এটা ওর দেরীতে পড়তে বসার বাহানা। এদিকে দেরী করে পড়তে বসলে একটু পড়ে ঘুমের বাহানা দেখিয়ে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু সার্ভেন্ট পাঁচ মিনিটের মধ্যে নুডলস রান্না করে দিলো। একটু সময় নিয়ে করবে তা না! মেঘ বিরবির করে সার্ভেন্ট বকে চুপ করে খেতে বসল। রোদ ফোনে কথা বলতে বলতে এসে সামনের সোফায় বসল। মেঘ ততক্ষণে খাওয়া শুরু করছে। যত ধীরে গতিতে খাওয়া যায় সে খাচ্ছে। যেভাবেই হোক এই সময়টুকু পার করতেই হবে। নাহলে দাভাই ওকে পড়াতে বসাবে। আর পড়তে বসলে ওর পেটের ভেতর মোচড় দেয়, মাথা ঘুরে, বমি পায়, ওয়াশরুমেও যেতে হয়, সাথে বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস ও করে। তাই পড়া থেকে বাঁচার জন্য এই তার মোক্ষম একটা পরিকল্পনা। এদিকে আলো মাথা নিচু করে হাত গুটিয়ে বসে আছে। সে বুঝতে অক্ষম, কাঁটা চামচ দিয়ে কীভাবে নুডলস খাবে? সে তো এই কাজে অভিজ্ঞ নয়! তবে পারে না শিখতে তো লজ্জা নেই। এটা ভেবে আলো সাহস করে হাতে চামচ তুলে নিলো। এবং বার দু’য়েক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। পারছে না দেখে আলো চামচ রেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।

রোদ এতক্ষণ আলোর চেষ্টা দেখে উঠে আলোর পাশে বসল। আলো অস্বস্তি নিয়ে আড়চোখে রোদের দিকে তাকাতে গিয়ে ধরা খেলো। রোদ সুন্দর ভাবে কয়েকবার আলোকে দেখিয়ে দিলো। আর বলল আলোকে একা একা চেষ্টা করতে। এবার সে পারবে। আলো চামচ নিয়ে নুডলস তুললেও মুখ অবধি নিতে পারল না। তার আগেই চামচের নুডলসটুকু কামিজের উপর পড়ল। রোদ আলোর হাতের উপর হাত রেখে নুডুলস তুলে আলোর মুখের সামনে ধরল। খাবে না বললে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগত। তাই আলো রোদের দিকে একবার তাকিয়ে নুডলসটুকু মুখে নিলো। ওর পাশের দুষ্টুটা যে মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। একথা সে খুব ভালো করেই জানে। তবে আলো পারছে না দেখে মেঘ হাসছে না, রোদ আলোকে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে হাসছে। রোদ মেঘকে হাসতে দেখে ধমক দিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে পড়তে বসবে। আমি তোমার সব পড়া চেক করব।”
“আচ্ছা।”

মেঘ ধীরে সুস্থে খেয়ে হেলেদুলে ওর রুমে গিয়ে পড়তে বসল। আর যাওয়ার আগে আলোকে তাড়াতাড়ি রুমে যেতে ইশারা করল। আলো গেলে সে পড়া বাদ দিয়ে গল্প করতে পারবে। আহা, তখন এমনি এমনি পড়ার সময়টুকুও চলে যাবে। আর আলোও যেন রোদের সামনের থেকে পালাতে পারলে জানে বাঁচে। সে এই অবধি রোদকে ভুলেও হাসতে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। সব সময় গম্ভীর ভাব। রোদ স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও ওর গলা শুকিয়ে যায়। কেন যে এমন হয় কে জানে! আলো এসব ভেবে উঠতে গেলে রোদ ওর হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে যেতে বলেছি?”
আলো দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। পরক্ষনেই ওর মনে পড়ল রোদ মাথা নাড়াতে নিষেধ করেছিল। আলো চোখ তুলে তাকানোর সাহস না পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।আবার সেই একই ভুল! এখন এই মানুষটা আত্মা কাঁপানো ধমক না দিলেই হয়। কিন্তু রোদ তেমন কিছু না করে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। বসো, আর আমি যা জানতে চাচ্ছি উওর দাও।”
“জি।”

আলো নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। রোদ মনে হয় খুব জরুরি কিছু বললে। এজন্য হয়তো ওকে বসতে বলল। কিন্তু কী বলবে? এটা ভেবে ওর গলা শুকিয়ে মরুভূমি তে পরিণত হয়েছে। পানির অপর নাম জীবন সে উপলব্ধিও করতে পারছে৷ রোদ আলোর দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে খেতে ইশারা করল। আলো পানি খেয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“বলুন, কী বলবেন?”
“তুমি কোন ক্লাস অবধি লেখাপড়া করছো? আর এখন কী করবে কিছু ভেবেছো?”
রোদের করা পরের প্রশ্নের উত্তরটা আলোরও অজানা। যার মাথা গোছার ঠাঁই’ই নেই, সে আর জীবন নিয়ে নিয়ে ভাববে।
আত্মবিশ্বাস, জোর, চিন্তা, পরিকল্পনা শক্তিটুকু সে হারিয়ে ফেলেছে। নিঃসঙ্গতায় ওকে জীবনের সঠিক সূত্র ভুলতে বাধ্য করেছে। এখন তো শুধু দেখার অপেক্ষা জীবন ওকে নিয়ে আবার কোন খেলায় মেতে ওঠে। আদৌ কী সে এই অচেনা শহরে টিকবে পারবে? রোদকে তাকাতে দেখে আলো মলিন হেসে উত্তর দিলো,

“আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। দাদীমার উদ্যোগে এতটুকু হয়েছে। যাদের তাঁতে কাপড় বুনে বিক্রি করলে খাবার জুটত।
তাদের কাছে পড়াশোনা’টা বিলাসিতা। ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে আগে কর্ম করতে হয়। আর কর্ম করতে গেলে পড়াশোনাতে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই যে কোনো একটা বেছে নিতে হয়, পড়াশোনা অথবা কর্ম! আমিও সবার মতো তাই করেছি।পাহাড়ি এলাকার খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে আমি। সাদা মাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত! কাঁটা চামচে খাওয়া, এত গুছিয়ে কথা বলা, নজরকাড়া বেশভূষা, চাল-চলনেও আকৃষ্টতা, এসবের কিছুই পারি না আমি। আর পরবর্তী পরিকল্পনা আমার জানা নেই। সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। দেখা যাক এবারও ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। আর আমি শুধু এতটুকুই জানি এই পরিবেশে আমি বড্ড বেমানান!”

কথাগুলো বলে আলো চোখের পানি লুকাতে মাথা নিচু করে নিলো। তবে জীবন নেই ওর আফসোস নেই। হঠাৎ দাদীমার কথা মনে হওয়াতে চোখে পানি এসে গেছে। দাদীমা থাকলে ওকে জীবন নিয়ে ভাবতে হতো না। রোদ আলোর কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“একটা মানুষ সবদিক থেকে পারফেক্ট হতে পারে না। তুমি পারো না, নিজ উদ্যোগে শিখে নাও। শিখতে লজ্জা কিসের? তবুও লজ্জার জন্য সবার থেকে পিছিয়ে পড়ো না। বর্তমানে তোমার অভিভাবক আমি। সেটা তুমি চাইলেও না চাইলেও। মূলত দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক বলেই তোমাকে সঙ্গে এনেছি। এনে যে তোমাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দিবো, তাও কিন্তু নয়! এখন আমি চাচ্ছি, তুমি পড়াশোনা শুরু করো। একটা লক্ষ্য স্থির করো। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে জীবন তোমাকে কিচ্ছু দিবে না। তাই বলছি, মনের জোরে কিছু একটা করে দেখাও। আর কাঁটা চামচে খেতে পারলেই কী সভ্য হয়? উহুম, মোটেও না। এটা অযৌক্তিক কথা! আর সভ্য একটা পরিবেশে চলতে গেলে সবাইকেই নিয়ম-কানুন, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, জানতে হয়। তুমিও আস্তে ধীরে জেনে নিবা। পারি না, পারব না, হবে না, হচ্ছে না, এসব শুধু অজুহাত। মনে থেকে চেষ্টা করো অবশ্যই তুমিও পারবে। এগুলো কঠিন কিছু না। আর আমি খুব শীঘ্রই একটা সার্টিফিকেট বানিয়ে তোমাকে কলেজে ভর্তি করে দিবো। এখন সুযোগ পাচ্ছো কাজে লাগাও। বোকাদের মতো পিছিয়ে যেও না। শুধু মনে রেখো, মেয়েরা বিয়ে আর বাচ্চা পালা ছাড়াও আরো অনেক কিছু করতে পারে। সাহসী হও! আর কিছু করে দেখাও। যাতে সবাই তোমাকে তোমার নামে চিনে। কারো বউয়ের অথবা মায়ের পরিচয়ে নয়, বুঝলে?”

“জ জি!”
আলো মনোযোগ সহকারে রোদের কথাগুলো শুনে গেল। এই প্রথম রোদ ওর সঙ্গে এতগুলো কথা বলল। তবে কথাগুলোর মর্ম সে অবশ্যই দিবে। রোদের ফোনে কল আসাতে রোদ উঠে চলে গেল। মূলত জরুরি কল দেখে উঠতে হলো। আর আলো ছলছল চোখে রোদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এই ঋণ সে কীভাবে শোধ করবে? আদৌ কী শোধ করা যাবে? আগে কোনটা শোধ করবে? অসহায় একটা মেয়েকে বাঁচানো, তার দায়িত্ব নেওয়া, নিরাপদ আশ্রয়, ভরসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, নতুন স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করা, নাকি বাঁচার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া, কোনটা? এসব ঋণের মূল্য না সে দিতে পারবে। আর না সেই ঋণ শোধের সামর্থ্য ওর আছে। এসব ভেবে আলো দুই হাতে মুখ ডেকে নিরবে অশ্রু ঝরাতে লাগল। হঠাৎ মেঘের চিৎকারে আলোর ভাবনার ছেদ ঘটল। থামাথামির নাম নেই, সে বউমনি! বউমনি! করে ডেকেই যাচ্ছে। আলো চোখ মুছে চেঁচিয়ে বলল,

“আসছি!”
“দাভাইকে বলো পরে প্রেম করবা। আর এখন তাড়াতাড়ি এসো। নয়ত আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”
একথা শুনে আলো একপ্রকার দৌড়েই মেঘের রুমের দিকে গেল। আর রোদ ফোনে কথা বলে কল কেটে বাগানের দিকে পা বাড়াল। মেঘটাও না কখন যে কী বলে! কথাবার্তার ঠিক নেই। ওর লাগামহীন কথাবার্তার জন্য রোদ যে ঠিক কতবার লজ্জায় পড়েছে, তার হিসাব নেই। নিষেধ করলে তো দুষ্টুটা ওকেই উল্টো যুক্তি দেখায়। তারপর যথাসময়ে ওরা খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। মেঘ আলোর কাছে শুয়েই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
নিকষ কালো পুরো রাতকে বিদায় দিয়ে নতুন দিনের সূচনা হলো। কালকে মাঝ রাতে মতি আহত হয়ে বাড়িতে ফিরেছে।শিকারী হয়ে গিয়ে নিজেই কারো হাতে শিকার হতে যাচ্ছিল। কোনোমতে জান নিয়ে ফিরে এসেছে। এই নিয়েই চেচাঁমেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে। শুয়ে থেকেই কাকে যেন বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছে। হাকিম রাতে এসে চিকিৎসা করে গেছেন। চিকিৎসার সময় সামান্য ব্যাথা পাওয়াতে মতি স্বজোরে হকিমকে লাথি মেরেছে। চেয়ার উল্টো পড়ে হাকিম প্রচন্ড ব্যাথা পেলেও কিছু বলতে পারে নি। মাতবরের ছেলে বলে কথা!

আর মাতবর গম্ভীর হয়ে উঠানের চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। উনি ভয়ংকর বিপদের আশঙ্কা করছেন। যদি ভুলক্রমে
ও উনার ভাবনা সত্যি হয় তাহলে মতির মৃত্যু অনিবার্য। আর মতির এই একটা ভুলই সবার প্রাণনাশের জন্য যথেষ্ট। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। তাছাড়া মৌচাকে ঢিল মেরে মৌমাছির কামড় খাবে না তা তো হবে না। উনার এই আশঙ্কা সত্যি হলে উনি নিজেই মতিকে মেরে ফেলবে। একটুও বুক কাঁপবে না আর খারাপ লাগা তো বহুদূর। ছেলে গেলে আবার ছেলে জন্ম দেওয়া যাবে। তাও নিজের প্রাণ খোয়ানো যাবে না।
পাখির কিচিরমিচির নয় বরং গাড়ির হর্ণের শব্দ আলোর ঘুম ভাঙ্গল। এখানকার সকাল মনে হয় এভাবেই শুরু হয়। আলো থম মেরে কিছুক্ষণ বসে ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে গেল। পুরো বাড়িটা ওর এখনো ঘুরে দেখা হয়নি। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আলো একটা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। মেঘ তখন দৌড়ে এসে আলোর পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হাসল। আলো ওই রুমটার ভেতরে ঢুকে দেখল বড় বড় মেশিন। এসব দিয়ে কী করে? আলো নিজে উত্তর না খুঁজে মেঘকে জিজ্ঞাসা করল,

“মেঘ এগুলো দিয়ে কী করে?”
মেঘ আশেপাশে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বউমনি, এগুলো দাভাইয়ের জিম করার জিনিসপত্র। জিম করলে শরীরে অনেক শক্তি হয়। আমিও ওই মেলাদিন আগে জিম করতাম। তারপর আমার শরীরে মেলা শক্তি হয়ে গেছে তাই আর করি না।”
“ওহ!”
আলো একটা বলের মতো জিনিস তুলে হাতে নিলো। তারপর নাড়াচাড়া করে ওজন পরীক্ষা করে রেখে দিলো। পাশ ফিরে একটা চেয়ারে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা লম্বা লাঠির দুই মাথায় ভারি ভারি কী যেন লাগানো। এটা আবার কী? আলো অনেকটা কৌতুহলবশত ওটা তুলে আর নামাতে পারছে না। জিনিসটার ওজনে ওর প্রায় হাত ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। মেঘও টেনেটুনে নামাতে পারল না। আলো ভয়ে কেঁদে মেঘকে বলল,

“মেঘবাবু, কিছু একটা করো। নাহলে আজ এটার নিচে পড়ে মরেই যাব।”
মেঘ নখ কামড়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে আজ গর্ব করে ওর শক্তির কথা বউমনিকে বলল। বউমনিও কত খুশি হলো। অথচ এখন কোনো সাহায্য করতে পারছে না। ইস! কী লজ্জা! মেঘ আর কোনো উপায় না পেয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে বউমনি, আজ সকালে কিছু খাই নি তো তাই শরীরে শক্তি পাচ্ছি না। দাঁড়াও, ব্যাপারটা আমি দেখছি।”
“তাড়াতাড়ি!”
মেঘ এবার দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে রোদের রুমে গেল।কিন্তু রোদ রুমে নেই! সার্ভেন্টের সাহায্য নিতে হবে ভেবে মেঘ দ্রুত সিঁড়ির কাছে চলে গেল। রোদ ভোরে উঠে নামাজ পড়ে মনিং ওয়াক সেরে কেবল বাসায় ফিরল। এভাবেই ওর সকাল শুরু হয়। রোদের ওর পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। ঘামের ভেজা টি-শার্ট’টা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। কানের পাশ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে টি-শার্টের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।রোদ
টাওয়াল দিয়ে ঘাম মুছে পানির গ্লাস হাতে নিতেই মেঘ সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“দাভাই! তাড়াতাড়ি বউমনিকে বাঁচাও! বউমনি বড় ডাম্বেলের নিচে চাপা পড়ে গেছে। তুমি এসো, তাড়াতাড়ি!”

রোদ হাতের গ্লাসটা রেখে দ্রুত পায়ে জিম রুমে প্রবেশ করল। আলো ততক্ষণে ফুঁপিয়ে কেঁদে চোখ, নাক, ঠোঁট লাল করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে হেঁচকিও তুলছে।আলোর অবস্থা দেখে রোদ দ্রুত ডাম্বেল সরিয়ে আলোকে টেনে তুলল। মেঘ পাশে দাঁড়িয়ে মুখ কাঁচুমাঁচু করছে। ইস! আর একটু শক্তি থাকলেই সে বউমনিকে উদ্ধার করতে পারত। রোদকে দেখে লজ্জায় আলো মাথা নিচু করে নিলো। এভাবে ফেঁসে যাবে জানলে সে এই রুমেই আসত না। এখন নিশ্চয়ই রোদ রেগে ওকে আস্ত গিলে খাবে। ওর লালবর্ণ ভয়ার্ত মুখ দেখে রোদ শান্ত কন্ঠে বলল,
“এই শরীর নিয়ে জিম, ভালোই! তা করা হয়েছে নাকি আমি সাহায্য করব?”
রোদের একথা শুনে আলো দিকবিদিক ভুলে ছুটে পালালো।
সে ভুলেও আর এই রুমে পা রাখবে না। ইস! কি লজ্জা! কি লজ্জা! আলোর দেখে মেঘও দৌড়। নাহলে দাভাইকে ওকে উত্তম-মাধ্যম দিতে পারে। আর ওদের দৌড় দেখে রোদ মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল। দু’টোই ফাজিল না মহাফাজিল!

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
”আফা ওই মাইয়াডা কেডা? ছ্যার কী বিয়া করছে নি?”
সাবিনা খালার কথা শুনে সার্ভেন্ট রাকা ড্রয়িংরুমে তাকাল। আলো মেঘের সঙ্গে বসে গল্প করছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলাপ চলছে। কেউ শুনলে যেন মহাপ্রলয় ঘটবে। রাকা দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে সবিনা খালার দিকে তাকাল। সাবিনা খালা এই বাসায় ঝাড়-মোছের কাজ করেন। সেই সাথে গোয়েন্দাগিরি করাও উনার স্বভাব। এটা না করলে উনি একদন্ডও শান্তি পান না। মনে হয় পেটের মধ্যে কথার জ্যাম বেঁধে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগেন। আর কোষ্ঠকাঠিন্য খুব ছ্যাচড়া একটা রোগ। এই রোগ থেকে মুক্তি পেতেই উনি এই পথ বেছে নিয়েছেন। সময় -সূচী এবং কোনো নিদির্ষ্ট ব্যাক্তি নেই। যখন তখন যার তার উপরে গোয়েন্দাগিরি করা উনার স্বভাব। সেটা কারণে বা অকারণে! রাকার থেকে উত্তর না পেয়ে উনি আবারও একই কথা বললেন। রাকা হাতের প্লেটটা রেখে নিচু স্বরে বলল,

“জানিনা, তবে মেহবুব স্যার বলেছে এখানেই থাকবে।”
“মাইয়া কী ছ্যারের ঘরেই থাকছে নি আফা?”
“জানি না।”
কথাটা বলে রাকা বিরক্ত হয়ে কাজের বাহানা দেখিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওর এসব ভালো লাগে না। সে শান্তি প্রিয় মানুষ! কুটকাচালি, ফুসফাস, থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। তাছাড়া রোদ এসব দেখলে চাকরির মায়া ত্যাগ করতে হবে। আর সে এত ভালো চাকরি হারাতে ইচ্ছুক নয়। রাকাসহ বাসা সার্ভেন্টে মোট পাঁচজন। তিনজন মেয়ে আর দুইজন ছেলে। রাকা, সাবা, মিনা, রবি, আর সাগর। এরা সবাই ভিন্ন কাজে নিযুক্ত আছে। মিনা আর সাবা কয়েকদিনের ছুটিতে আছে। তাছাড়া ঝাড়-মোছ, মালি, ড্রাইভার, দারোয়ান এরা আলাদা। রোদের বাবা মা নেই! রোদ সারাদিন অফিসে থাকায় বাসায় সময় দিতে পারে না। তাই বাসার সব কাজ সে মানুষ দিয়েই করায়। তবে রোদের কড়া নিষেধ আছে কুটকাচালি থেকে বিরত থাকার। এসব ওর অপছন্দ! এসব ওর চোখে পড়লে সেই মুহূর্তেই চাকরি শেষ। সাবিনা খালা তবুও থামার মানুষ না। যেদিন রোদের চোখে পড়বে সেদিন বুঝবে। রাকার থেকে
সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে সাবিনা খালা আলোর উপর কড়া নজর রাখল। আলো রোদের কে? উনার জানা চাই-ই চাই। কেন জানবে না? এতদিন এই বাড়িতে কাজ করছে এটা জানা উনার অধিকার।

সকালে নাস্তা সেরে আলোকে সাবধানে থাকতে বলে দুই ভাই বেরিয়ে গেল।মেঘকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রোদ অফিসে যাবে। আজ বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল। মেঘ তাড়াতাড়িই চলে আসবে। আলো ওদের যেতে দেখে মন ভার করে ওর রুমে চলে গেল। একা একা সময় কাটাতে কিছু একটা করা দরকার। তাই সে ভাবল পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবে। এখানেই যেহেতু থাকবে, সব চিনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মূখ্য কথা সময়টা কাটলেই হলো। মেঘ চলে আসলেই ওর আর কিছু লাগবে না। এসব ভেবে আলো রুম থেকে বের হতেই একজন মহিলা ওর পথ আটকে পান খেয়ে লাল করা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“মা জননী আপনে যেন কেডা? আপনেরে তো ঠিক চিনলাম না।”
হঠাৎ উনার আগমনে আলো ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেল।
এই মহিলা ওর দরজার পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে খেয়াল করে নি। আলো বুকে থুথু দিয়ে জোরপূর্বক হাসল।আর উনার কথার জবাব কী বলা উচিত আলো ভেবে পেলো না। হঠাৎ ওর মেঘের কথা মনে পড়ায় কিছু ভেবে মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,

“আমি মেঘের বউমনি।”
সাবিনা খালা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ওর পথ থেকে সরে দাঁড়াল। তারমানে রোদের বউ! রোদ বিয়ে করেছে অথচ উনি জানেনই না। এজন্যই বড়লোকের বাড়িতে কাজ করতে নেই। এরা নিমুকহারাম হয়! বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এলো, তবুও একটা কথা বলল না। গরীব তাই হয়তো। এসবে ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খালার দুই হাতে বালতি আর ঝাড়ু দেখে আলো বুঝল, উনি রুম পরিষ্কার করতে এসেছেন। তাই উনার কাছে বাঁধা না দিয়ে আলো স্থান ত্যাগ করল। সাবিনা খালা বিরবির করতে করতে নিজের কাজে মন দিলেন।
একটুপরে, রিমি হাত ভর্তি শপিংব্যাগ নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলো। রিমিকে দেখে আলোর মুখে হাসি ফুটল। একা একা রুমবন্দি হয়ে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। পাহাড়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যাস। আর এখানে এসে ইট পাথরের তৈরী বিল্ডিংয়ে বন্দি হয়ে নিঃশ্বাসটা যেন আটকে আসছিল। রিমি সার্ভেন্টকে পানি দিতে বলে সোফায় বসল। আলো মিষ্টি হেসে রিমির কুশল বিনিময় করল। রিমিও মুচকি হেসে উত্তর দিয়ে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে আলোকে নিয়ে রুমের দিকে গেল। সাবিনা খালা আলোর রুম পরিষ্কার করছে অগত্যা ওদের রোদের রুমে যেতে হলো।

রিমি বেডে বসে হাত ভর্তি শপিংব্যাগের জিনিসপত্র বের করে আলোর সামনে রাখল। পুরো বেড জিনিসপত্রে ভরে গেছে। আলো সেদিকে একবার তাকিয়ে মুখ তুলে রিমির দিকে তাকাল। রিমি আলোর দৃষ্টির মানে বুঝে পা তুলে বসে হেসে বলল,
“রোদের হুকুম, একটা মেয়ের প্রয়োজনীয় যা যা দরকার সব নিয়ে আসতে। শুধু মেকাবের জিনিস ছাড়া। তো মহারাজের হুকুম পেয়ে আমিও এসব নিয়ে হাজির হলাম। সে এ ব্যাপারে আনাড়ি।”
আলো এতকিছু দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সে তো এসব কিছু চায়নি, তাহলে? অকারণে রোদ এতগুলো টাকা নষ্ট করল। আলোর মলিন মুখ দেখে রিমি টপস, স্কার্ট, কুর্তি, লং কামিজ, ফেসওয়াশ, হ্যান্ডব্যাগ, স্লিপারসহ আরো অনেক
কিছু বের করে আলোকে দেখাচ্ছে। এখানে হেয়ার ওয়েল
থেকে শুরু করে নেইল কাটার অবধি সব আছে। সব ব্র্যান্ডের জিনিস! কোনটা কী কাজে ব্যবহার হয় রিমি সেটাও বলল। আলো মলিন হেসে ছলছল চোখে হুম, হ্যাঁ, করছে দেখে রিমি ওর হাত ধরে বলল,
“আলো, কয়েকটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো। তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়। রোদ তোমাকে অপমান করার জন্য এসব আনতে বলে নি। এর পেছনেও যথেষ্ট একটা কারণ আছে।

রোদ শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং চতুর একটা ছেলে। সে কথায় নয়, বরং কাজে ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। রোদ সব জেনে বুঝে আমাকে এসব আনতে বলেছে। কেন জানে? এর কারণ মেয়েলি কিছু জিনিসের কথা হুট করে কাউকে বলা যায় না, বিশেষ করে কোনো ছেলেকে। একটা মেয়ের মাসে কত কী প্রয়োজন হয় সেটা কেবল আমরাই জানি, তাই না? আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছ?”
আলো মাথা নিচু করেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। রিমি ওর মুখটা তুলে চোখে পানি মুছিয়ে বলল,
“সেটাই, খুব প্রয়োজন হলেও তুমি রোদকে বলতে পারতে না। তাছাড়া রোদ খুব কম সময় বাসায় থাকে। কখন কী লাগে বলা তো যায় না। এজন্যই রোদ আমাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে।যাতে তুমি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়ো। তাছাড়া যেহেতু এখানেই থাকবা তাই সবকিছুর প্রয়োজন আছে। আমি ভেবে চিন্তে সব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই এনেছি। যেগুলো প্রত্যহ দিনে আমাদের কাজে লাগে। আর আমার বন্ধুটা রাগী হলেও এতটাও খারাপ না আলো। সে আর যাই করুক,কারো দায়িত্ব পালনে ত্রুটি রাখে না।”
আলো ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে আবারও মাথা নাড়াল। সে এসব ঋণ কীভাবে শোধ করবে? রোদ ওকে কেন এত ঋণী বানাচ্ছে? সে কী জানে না, এই মেয়েটা আর ঋণের ভার সহ্য করতে পারছে না। ঋণের ভারে যে সে নুইয়ে পড়ছে। বিবেকে বাঁধছে। আলোকে স্বাভাবিক করতে রিমি টপস স্কার্টের সাথে ওড়না নেওয়ার কৌশলটাও দেখাল। সে ফ্যাশান ডিজাইনার বিধায় ফ্যাশান সম্পর্কে ধারণা দিতে বেশ পটু। ওর অভিজ্ঞতা ওকে পটু করেছে। আলো চুপ করে রিমির কাজ, কথাবার্তা,

অঙ্গভঙ্গি, সব খেয়াল করছে। রিমি দেখতে বেশ নজরকাড়া। ওর কথা বলার অার্ট’টা দারুণ। আলোর মতো কথা বলতে বলতে মাঝপথে ভুলে যায় না। অথবা থতমত খায় না। আলো দৃষ্টি সরিয়ে ড্রেসগুলো দেখে আমতা আমতা করে বলল,
“আপু, আমি এমন ড্রেস আগে পরি নি। তাই কেমন জানি লাগছে।”
“ওরে বোকা রে আগে পরো নি, এখন পরবা! আর এগুলো সব মার্জিত পোশাক। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, ব্যাপার না।”
কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অথচ ওরা খেয়ালই করে নি। গল্প করতে করতেই ওরা সব জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলো। এদিকে মেঘ চিৎকার করতে করতে রুমের দিকেই আসছে। সে স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। আর এসেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। মেঘ দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“বউমনি ভয় টয় করো নি তো? আমি তো তোমার চিন্তায় মন দিয়ে ক্লাসও করতে পারি নি। ওমা, কটকটি কখন আসলা?
আমার জন্য কিছু আনো নি?”

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৬+১৭+১৮

রিমি ওর ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে মেঘকে দিলো। মেঘ সেটা নিয়ে দাঁত বের করে হাসল। তারপর তিনজনে বেরিয়ে সুইমিংপুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসল। ওদের দেখে সাবিনা খালা কাজ সেরে মুখ বাঁকিয়ে বিদায় নিলেন। ওইদিকে রোদ
সুজনকে ওর কেবিনে ডেকে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে। ওকে না বলে টাকা তোলার কারণ জানতে চাচ্ছে। সুজনকে শুধু ঘাম মুছছে আর আমতা আমতা করছে। এভাবে ধরা খাবে সেও কল্পনা করে নি। ওকে চুপ থাকতে দেখে রোদ দশ লাখ টাকা আর রেজিগনেশান লেটার কালই জমা দিতে বলল। না হলে ওর নামে কেস ফাইল করতে বাধ্য হবে। সুজন ছলছল চোখে হাত জোড় করে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। রোদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সুজন নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে বলল,
“প্রিয় মানুষটার ক কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই না বলে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি ভাইয়া। আসলে সূচির হার্ট অপারেশন করতে দশ লাখ টাকার খুব দরকার ছিল। তুমি তখন ঢাকার বাইরে ছিলে। অনেক চেষ্টা করেও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।”

একথা শুনে রোদ উঠে স্বজোরে সুজনের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রাগে ওর পুরো শরীর কিড়মিড় করছে। অথচ ওকে দেখতে যথেষ্ট স্বাভাবিক লাগছে। হাবভাব এমন যেন এটা হওয়ারই ছিল। সুজন গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে থাপ্পড় খাবে সে মোটেও কল্পনা করে নি। রোদ ঠান্ডা মাথায় সুজনের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বেশ ধারালো কন্ঠে বলল,
“টাকা কী তোর বাবা দিয়ে যায়? নাকি বাতাসে উড়ে আসে? যে যখন তখন এসে টাকার নিয়ে যাস?”
কথাটা বলে রোদ সুজনের বুকে স্বজোরে ধাক্কা দিলো। সুজন চেয়ার ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, রোদ ওকে মেরেছে, কলার ধরেছে, ধাক্কাও দিয়েছে। সে এখনো অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২২+২৩+২৪