এলোকেশী কন্যা পর্ব ২২+২৩+২৪

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২২+২৩+২৪
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

সুজন এখনো রোদের দিকে অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওর কাছে রোদকে বড্ড অচেনা লাগছে। সে কর্মচারি বাদেও রোদের মামাতো ভাই। মামার বিশেষ অনুরোধে রোদ চাকরিটা ওকে দিয়েছিল। ভাইয়ের সঙ্গে রোদ এমনটা করতে পারল? ওর বিবেকে বাঁধল না? সুজন রোদকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। রোদ তখন ক্রোধ নিয়ে সুজনের দিকে একটা ফাইল ছুঁড়ে দিলো। আর ফাইলটা ছিঁটকে গিয়ে পড়ল সুজনের পায়ের কাছে।। সুজন সেটা তুলে দেখে মাথায় নিচু করে নিলো। ওর সব জারুজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। উফ! এত পাক্কা খেলোয়াড় হয়েও ধরা পড়েই গেল। ধুর, চালে সামান্য ভুল করে ফেলেছে। রোদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হেলান দিয়ে বসে ঘৃণিত কন্ঠে বলল,
” তিন দিনের মধ্যে আমার সব টাকা চাই-ই চাই। আর ওই’টা বেরিয়ে যাওয়ার দরজা।”
“ভাই, প্লিজ একটা সুযোগ দাও।”

রোদ মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বলল। সুজন আর কিছু বলার মুখ না পেয়ে বেরিয়ে গেল। সুজনের প্রিয় মানুষটা অর্থাৎ সূচির কোনো অপারেশন হয় নি। সুজন সব মিথ্যা বলেছে। আর সেই টাকা নিয়ে সে নেশা করেছে। সুজন নেশা করে জেনে সূচির তিন মাসে আগে ওর সাথে ব্রেকআপ করেছে। কারণ এভাবে মিথ্যা বলে সুজন ওর থেকেও টাকা নিতো। সূচি ওকে সময়ও দিয়েছিল, নিজেকে এই পথ থেকে শুধরানোর। কিন্তু এর বিনিময়ে সুজন ওকে বিশ্রীসব গালাগাল করেছে, নোংরা অফারও অবধি দিয়েছে।
এসবে অতিষ্ঠ হয়ে সূচি সুজনের সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না। সে সুজনের থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।রোদের ভাই বলে ওকে ছাড় দিলেও একজন নেশাখোরকে ছাড় দেওয়া যায় না। মিষ্টি কথায় মন ভুলালেও না। কারণ নেশাখোরদের কোনো জাত-ভাস নেই। আজ সে না জানিয়ে টাকা নিচ্ছে, নেশা উঠলে কাল চুরি করতে দু’বার ভাববে না। আর রোদ এটা কখনোই মানবে না। কারণ এসব ওর কঠোর পরিশ্রমের ফল। সে একটু একটু করে নতুন করে সব গড়ে তুলেছে, শুধুমাত্র বাবার কষ্ট বৃথা যেতে দিবে না ভেবে। আর
ভাইয়ের মতো ভাইয়ের জন্য প্রাণ দেওয়া যায়। কিন্তু একজন নেশাখোরের জন্য চুল পরিমাণ ছাড়ও দেওয়া যাবে না। সে যতই পরম আত্মীয় হোক। কালকে আকাশ প্রমানসহ এসব তথ্য রোদকে দেখিয়েছে। তাই রোদও আর ভাইরাস রাখল না। কারণ সে বেইমানী সহ্য করতে করে না। ওর কলিজায় জায়গা দেওয়া মানুষও যদি বেইমানী করে, তার দিকেও থুথু ফেলে দূরে সরাতে দু’বার ভাববে না। কেন জানি সে মানুষটাই এমন!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওদিকে রিমি জুরুরি কল পেয়ে তখনই চলে গেছে। আলো মেঘকে দুপুরে গোসল করিয়ে খাইয়ে,আড্ডা দিয়ে, অনেকটা সময় কাটাল। তারপর বিকালে দু’জনে বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে, গাছে পানি দিলো। রং বেরংয়ের ফুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেখল। মেঘ একটা লাল গোলাপ ছিঁড়ে আলোর খোঁপাতে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না! তাই আলো নিজেই ফুলটা খোঁপাতে ফুল গুঁজে মুচকি হেসে বলল,
“মেঘবাবু আমাকে কেমন লাগছে?”
“ওয়াও লাগছে।”
আলোর খোঁপার ফুলটা আলতো করে ছুঁয়ে মেঘ সেকি খুশি।
নরম ঘাসের উপর দু’জনে খালি পায়ে হাঁটাল। একে অপরের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলল। তারপর মাগরিবের আজান দেওয়াতে দু’জনেই বাসায় চলে এলো।মেঘ দৌড়ে যেতে যেতে আলোকে বলল ‘সে হিসু করে এখনই আসছে। খুব জুরুরি বিভাগ।’ মেঘের এমন কান্ড দেখে আলো হেসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। একটুপরে, মেঘ নাচতে নাচতে রুমে প্রবেশ করে, আলোকে কাঁদতে দেখে বেশ অবাক হলো। আলো বালিশে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদছে। হঠাৎ বউমনি কাঁদছে কেন? কষ্ট হচ্ছে? পেটে ব্যাথা, নাকি মাথাব্যথা? বউমনি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলো না তো? মেঘ কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও পাচ্ছে না। আলোকে এভাবে কাঁদতে দেখে মেঘের চোখেও পানি জমে গেছে। মেঘের উপস্থিতি টের পায়নি বিধায় আলো এখনো কাঁদতে ব্যস্ত। মলিন মুখে মেঘ আলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ওর রোদের কথা মনে হলো। দাভাই! হ্যাঁ, দাভাইকে জানালে ভালো হবে ভেবে মেঘ দৌড়ে চলে গেল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে মেঘ অন্য ফোন থেকে রোদকে কল দিলো।এখন বাজে সন্ধ্যা ছয়’টা পঁয়ত্রিশ।রোদ ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় জ্যামে আটকে গেছে। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে সে গাড়িতে বসে আছে। হঠাৎ বাসার নাম্বার থেকে কল পেয়ে রোদ রিসিভ করে কিছু বলার আগে মেঘ বলল,

“দা দাভাই, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। বউমনি মেলা কাঁদছে। ”কাঁদছে কেন?”
“জানি না আমি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
“এই তো আর কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।”
“আচ্ছা।”
কথাটা বলে মেঘ কল কেটে দৌড়ে আলোর কাছে চলে গেল। আলো ওয়াশরুমে থেকে হাত মুখ ধুয়ে চুলে চিরুণী করছিল। ওর এমন ভাব যেন কিচ্ছু হয় নি। মেঘকে দেখে আলো মুচকি হেসে ওর পাশে বসতে বলল। মেঘ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে পাশে বসে আলোর মুখে দিকে তাকাল। বউমনি আর কাঁদছে না দেখে মেঘ মিষ্টি হাসল। আলোর মেঘের চুলগুলো আঁচড়ে নিজের চুলে চিরুণী করে খোঁপা করে নিলো। মেঘ আলোর মুখে মুখে তাকাচ্ছে, কিন্তু কিছু বলছেনা দেখে আলো অন্য গল্প জুড়ে দিলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর রোদ বাসায় ফিরে দেখে আলো মেঘকে কাতুকুতু দিচ্ছে। আর মেঘকে খিলখিল করে হাসছে৷ ওদের দেখে রোদ আর না দাঁড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। দাদীমার কথা মনে করে আলো কাঁদছিল ভেবে রোদ আর ব্যাপারটা ঘাটলো না। সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা সেরে মেঘকে কিছুক্ষণ পড়িয়ে ওরা রাতের খাবার খেয়ে নিলো। এখন বাজে রাত সাড়ে এগারো টা। মেঘ অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে।
আলো চুপ করে ওর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের ব্যস্ত নগরী দেখছে। এই শহরটা বড্ড অদ্ভুত! এত রাতেও গাড়ি চলছে, কত্ত মানুষের সমাগম, লাইটের ঝলকানি। অথচ পাহাড়ে সন্ধ্যার পর পরই আর কাউকে দেখা যায় না। সব ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথ চেনারও উপায় নেই। আলোর মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো, এই শহরের মানুষগুলো কী ঘুমায় না? রাস্তার লাইট গুলো বন্ধ হয়ে কী নিশ্চুপ নগরী হয় না? অন্ধকার কী এই নগরীটাতে পুরোপুরি গিলে খেতে পারে না? এটা শহর বলেই কী সব মাফ! আলো উত্তর না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদের বেলকণিতে তাকাল। সেখানে নীল রংয়ের একটা লাইট জ্বলছে। সবকিছু নীল দেখাচ্ছে! শুভ্র রংয়ের টাওয়াল’টাও নীলে ডুবে রশিতে ঝুলছে। মৃদু বাতাসে কখনো নড়েও উঠছে।

তখন রোদ রুমের দরজা নক করে শব্দহীন পায়ে আলোর রুমে প্রবেশ করল। আলো রোদকে দেখে মাথা নিচু করে মৃদু কন্ঠে বলল,
“কিছু বলবেন?”
“ছাদে চলো।”
কথাটা বলে রোদ সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল। আলোর থেকে উত্তর জানার প্রয়োজন মনে করল না। আলো মলিন হেসে রোদের পিছু পিছু ছাদে গেল। ছাদে পা রাখতেই একটা দমকা বাতাস এসে পুরো শরীরে শিহরণ বইয়ে দিলো। মাথার ওড়নাটা এলোমেলো করে দিলো। নির্মল বাতাস আর ফুলের গন্ধে মনটা ক্ষণিকের জন্য ভালো হয়ে গেল। মুখে ফুটল মিষ্টি হাসি! রোদ রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে দূর প্রান্তরে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠ বলল,
“এখানে থাকতে কী খুব খারাপ লাগছে?
” জ জি না। ”

রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে জানাল, আগামীকাল শুক্রবার! আর কালকেই দাদীমা, মকবুল আর মুনের মায়ের জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। যে মসজিদে রোদের বাবা মায়ের জন্য প্রতি শুক্রবার দোয়া করা হয়। সেখানেই মূলত এই আয়োজন করা হয়েছে। যদিও এই মসজিদটা রোদের টাকা এবং নিদর্শনায় বানানো। তবুও সে একথা কাউকে বলে না। মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর! আর মুসলিমদের ইবাদত খানা। আল্লাহ ওকে সামর্থ্য দিয়েছে তাই মসজিদটা বানিয়ে দিয়েছে। তবে, এটা আমার! আমার তৈরীকৃত মসজিদ, আমার টাকার! এসব বলে বেড়ানোর মন মানসিকতা রোদের নেই। আর যাই হোক, সে কখনো বড়াই করা পছন্দ করে না। বড়াই করার জন্য মসজিদটাও গড়ে নি। সে মূলত করেছে, ওর বাবা মায়ের জন্য দোয়া কুড়াতে। বাবা মায়ের সাথে পরিস্থিতি মোতাবেক দাদীমা’রাও এখন জুড়ে গেছে। উনারা মারা যাওয়ার পর উনাদের জন্য কিছু করাও হয়নি।
আলো চুপ করে রোদের কথাগুলো শুনল। সে ভুলেও রোদের থেকে এতকিছু আশাও করে নি। অথচ রোদ এখন অবধি যা করেছে বা করে যাচ্ছে, সবটাই ওর কাছে অধিকতর পাওয়া। সচারচর আপন মানুষরাও তো এসব করে না। অথচ এই মানুষটা! আলোকে চুপ থাকতে দেখে রোদ ওর দিকে ঘুরে বলল,

“জানি, এখানে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে তুমি যতক্ষণ না নিজে এটা তোমার বাসা ভাববে, ততক্ষণ এখানে তোমার মন টিকাতে পারবে না। আমার আম্মুর পরে, এই সংসারটা যত্নে আগলে রাখার মতো কেউ আসেনি। আর আসবে কী না তাও জানি না। এখানে কেউ হাতে গড়ে কিচ্ছু শেখাবে না। সবকিছু নিজের ভেবে আপন করে নাও। আর দেখছোই তো, বর্তমানে সব কাজ সার্ভেন্টরাই করে। শুনে নাও,তাদের থেকে তোমার অধিকারটা কিন্তু সর্বদা বেশি। ওদের জন্য নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। কারণ তুমি হচ্ছো মেঘের বউমনি! আর মেঘ হচ্ছে এই বাসায় প্রাণ! তুমি সামান্য মন খারাপ করলে মেঘ কাঁদতে শুরু করে। ঠিক আজকের সন্ধ্যার মতো। মানিয়ে নাও আর সংকোচ ত্যাগ করো।”
রোদের কথা শুনে আলো অবাক চাহনি নিয়ে রোদের দিকে তাকাল। ওর কান্নার কথা তাহলে রোদ মেঘ দু’জনেই জানে।
আলো একপ্রকার অপরাধবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। মূলত ওর জন্য দুই ভাই কত কিছু করছে। আর সে বোকার মতো কান্না করে ওদেরকেই কষ্ট দিচ্ছে। এই ব্যাপারটা সত্যিই দৃষ্টিকটু লাগছে। আলোর অস্বস্তি সরাতে রোদের যতটুকু যা বলার বলে দিয়েছে। দেখা যাক, আলো রোদের কথা ধরতে পারে নাকি? বুঝতে পারে নাকি রোদের ইঙ্গিত! রোদ সময়টা দেখে আলোকে নিচে চলে যেতে বলল। আলোও বিনাবাক্যে রোদের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলো।
পরেরদিন পূর্বাকাশে সূর্য তার উপস্থিতি জানিয়ে নতুন দিনের সূচনা করল। মিষ্টি রোদের আলো ছড়িয়ে পড়ল পুরো শহর জুড়ে। সেই সাথে নতুন একটা সকালের উদয় হলো আলোর জীবনে। আলো সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে, ছাদে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাল। এখানকার সকালের মৃদু বাতাসটা পাহাড়ের মতো না হলেও, মন্দ না! আলো চোখ বন্ধ করে আজকের সারাদিনের কার্যক্রম মনে মনে ভেবে নিলো।

তারপর গেল রান্নাঘরে। রাকার এক পাশে দাঁড়িয়ে কীভাবে কী করতে হয় বুদ্ধি খাঁটিয়ে জেনে নিলো। এই যেমন, গ্যাসের চুল, মিক্সার, ওভেন, কফি মেকার, প্রেসার কুকার, রাইস কুকারসহ ইলেকট্রনিক জিনিসের ব্যবহার আর কি। রাকাও খুব সুন্দর করে সবটা বুঝিয়ে দিলো। সকালে রোদ আর মেঘ নাস্তা করতে বসে সার্ভেন্টকে ডাকার আগে আলো খাবার বেড়ে দিলো। রোদ’রা সকালে সাধারণত, ব্রেড, জ্যাম, বাটার, ফলের জুস, ডিম সিদ্ধ, দুধ, অমলেট খায়। অথচ আজ সেদ্ধ আটার রুটি, মাংস, আলুর ভাজি, আর ডিম দেখে অবাক হলো। কারণ রোদ সকাল বেলায় এসব খাবার এড়িয়ে চলে। তবে আজ কেন জানি কিছু না বলে খাওয়াতে মন দিলো। আলো তখন মেঘকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল,
“জানো মেঘবাবু, সকালের খাবারটা পেট ভরে খাওয়া উচিত।”
“কেন?
“সারারাত না খাওয়ার ফলে শরীরের অঙ্গগুলো অচল হতে থাকে। আর প্রত্যকটা অঙ্গকে সচল করতেই খাওয়া উচিত।
সকালের খাবার রাজার, দুপুরের প্রজা, আর রাতের খাবার
ভিক্ষুকের মতো হওয়া উচিত। যদিও আমি তেমন কিছু জানি না, তবে আমার দাদীমা বলতেন। আমি উনার থেকে জেনেছি আর কি!”
কথাগুলো বলে আলো আড়চোখে একবার রোদের দিকে তাকাল। খাবার দেখে রোদ রেগে যায় নাকি এটাই ভাবছিল। কিন্তু তেমন কিছু হলো না দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচল। সে একটু ভয়ে ভয়েই ছিল। তখন রোদ আলোর দিকে না তাকিয়ে গ্লাস রেখে বলল,
“আমার উদ্দেশ্যে বলছো ভালো করেই বুঝছি। নাস্তা সম্পর্কে সার্ভেন্টকে জানিয়ে দিও। আর আমরা বেশি ঝাল কিছু খেতে পারিনা। এটা শুধু মাথায় রেখো! পরবর্তীতে পিঞ্চ না করে, যা বলার সরাসরি বলবে। তোমার কাজে কেউ বাঁধা দিবে না। আর হ্যাঁ, একটুপর রবি তোমার কলেজের সব বই এনে দিবে। আজ সন্ধ্যার পর তোমরা দু’জন আমার কাছে পড়তে বসবে। আর মনে করিয়ে দিতে যেন নাহয়।”

পুরো কথা শুনে আলো হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতে গিয়ে থেমে গেল। ছাতার মাথা এই অভ্যাস ওর কবে যাবে, কে জানে! রোদ খেয়ে উঠে মাহফিলের আয়োজনের কাজ কতটুকু এগোলে দেখতে গেল। আজ বিকালে মসজিদেই আয়োজন করা হয়েছে। আলোও খেয়ে সব গুছিয়ে মেঘকে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল।
ওদিকে মাতবর তার সহধর্মিণীর উপর প্রচন্ড রেগে বেধড়ক মারলেন। যতক্ষণ না উনার রাগ কমলো। উনার রাগের মূখ্য কারণ খাবার দিতে দেরী হয়েছে। কেন দেরী হবে? বাড়িতে কী এমন কাজ যে দেরী হবে? সাহসই বা কী করে হয় উনার কাজে বিলম্ব করার! তাছাড়া বিশ্রী গালাগালের সাথে উনার ভাষ্যমতে, ‘উনার বউয়ের শরীরে জং ধরেছে তাই মেরে জং ছুটালেন। মেয়ে মানুষকে সোজা করার জন্য মাইরের উপরে আর কিছু নেই।’
মতি অদূরে বসে বসে সব দেখল। না বাবাকে থামাল আর না কিছু বলল। বরং সম্পর্কে মায়ের মতো একজনকে ব্যাথায় ছটফট করতে দেখে মিটিমিটি হাসল। ব্যাপারটা ওর কাছে খুব মজা লাগল। সে প্রায়ই এই মজাগুলো উপভোগ করে।
আর ওই মহিলা মেহগুনির কাঁচা ডালের মার খেয়ে ছটফট করে মাটিতেই জ্ঞান হারালেন। তখন মতির এক চ্যালা দৌড়ে এসে জানাল, সকালে পাহাড়ে ঘুরতে আসা একটা মেয়েকে ওরা ধরেছে। মেয়েটা নাকি একা ছিলো। আর দেখতেও খুব সুন্দরী! মতি হেসে ওর চ্যালার কাঁধে চাপড়ে বলল,
“কেউ এঁতো কলিছ নি তো? আমি কুন্তু কালো এঁতো কিচু খাই না।”
মতির কথা শুনে চ্যালা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়াল।
অর্থাৎ মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখে নি। মতি খুশি হয়ে সেদিকে পা বাড়াল। আহত হয়ে ওর শরীরটা বেশ অচল লাগছিল। যাক সচল করার কিছু পেয়ে গেল।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আধুনিক যুগের খবরাখবর খুব দ্রুত ছড়াতে সময় লাগে না।
সেটা হোক সত্য অথবা মিথ্যার বেড়াজাল! রং-তামাশার ছলে সিরিয়াস ব্যাপারগুলোও আজকাল তুচ্ছ হয়ে দাড়ায়।তখন সত্য-মিথ্যার গল্পও ভাইরাল যায়। মজা নেওয়ার জন্য কেউ আর সত্য মিথ্যা খুঁজতে যায় না। কিন্তু পাহাড়ের কিছু দূর্গম এলাকাগুলোর খবর না চাইলেও চাপা থেকে যায়। জঘন্য অত্যাচার রীতি-নীতি কথা সবার অজানা থেকে যায়। এই সভ্য পৃথিবীতে এখনো কোথাও কোথাও অসভ্যতার যুগের মতো কিছু রীতি প্রচলিত আছে। সেই এলাকাগুলোতে ভালো খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তো অনেক দূর অনেকে পোশাকের সভ্য ব্যবহারও জানে না। যদিও তাদের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা এভাবেই অভ্যস্ত! আর যুগ যুগ ধরে এখনো এভাবেই চলে আসছে। অথচ এই সত্যটা অনেকেরই অজানা। জঙ্গিদের থেকেও অসভ্য জাতি এখনো পৃথিবীর আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। কথাটা বিশ্বাস যোগ্য না হলেও সত্যি! জনশূন্য পাহাড়ের জঙ্গিদের থেকে মতি, মাতবরের মতো মানুষগুলো সভ্য হলেও, তারা অমানুষ! আর অমানুষ কোনো জাতির মধ্যে পড়ে না। তাদেরকে মানুষ বলে গণ্য করাও বৃথা!
এই যেমন; কালকে সকালে এক সুন্দরী যুবতী পাহাড়ে ঘুরতে এসে নিঁখোজ। এত খুঁজে তার কোনো হদিস মিলছে না। ওর নিঁখোজের সংবাদ শুনে তাৎক্ষণিক তার বাবা- মা আর ভাই ছুটে এসেছে। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মেয়েকে খুঁজে বের করার। ওর মমতাময়ী মায়ের তো কেঁদে পাগলপ্রায় অবস্থা। বাবা আর কলিজার ভাইটাও নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। প্রতিটা পাহাড়ের নিচে নদী, ঘন জঙ্গল অথবা কোথাও পাথরের স্তুপ! পা পিছলে পড়ে গেলেও হদিস পাওয়া অসম্ভব। অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয়ে উনারা ফিরে গেলেন। এখন উনারা নিরুপায়! শত চাইলেও উনাদের হাতে আর কিছু নেই। শুধু মাত্র অশ্রু ঝরানো ছাড়া। হায় আফসোস! উনারা জানতেও পারলেন না, উনাদের খুব আদরের মেয়েটা এক মানুষ রুপি অমানুষের হাতে পড়েছে। ওরা মেয়েটার শরীরটা খুবলে খেয়ে ঘন জঙ্গলে ফেলে এসেছে। একটু পানির জন্য ছটফট করতে করতে মেয়েটার শরীর প্রাণ ত্যাগ করেছে। হাজারও আঁকুতি মিনতি করে সে জানে বাঁচতে পারে নি। ওর আঁকুতিতে কারো মন গলে নি। বরং পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে। পরে ওর সুন্দর দেহ’টা বন্য বানরগুলো টেনে আছড়ে কামড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখানে বানরগুলোও ভাগ বাসাতে কার্পণ্যতা করল না। ক্ষুদার্থ প্রানীরা ওই দেহ’টাকে বেশ মজা করে লুপে পুটে খেয়েছে। আর মেয়েটা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিরবে আল্লাহর কাছে অসংখ্য অভিযোগ জানিয়ে গেল। এটা তার কোন পাপের শাস্তি? এত করুণই বা হলো কেন এই শাস্তিতা? এসবের উত্তর না পেতেই মেয়েটা এই পৃথিবীটা থেকে বিদায় নিয়েছে। তার চিরতরের জন্য একটা আফসোস থেকে গেছে, বাবা-মা, ভাই আর তার প্রিয় মানুষটার মুখ শেষবারের মতো দেখার আফসোস! এই আফসোস কখনোই আর মিটবে না।

সেই সাথে নিরবে আকাশ, বাতাস, গাছ-পালা, আর মেঘপুঞ্জ সাক্ষী হয়ে থাকল মেয়েটার এই করুণ পরিণতির। জানলোও না কেউ আর দেখলেও না। সত্যি এটাই, প্রকৃতি শুধু উন্মোচন নয় বরং লুকাতেও পারদর্শী!
সময়ের সঙ্গ নিয়ে ব্যস্তটাকে ঘিরে কেটে গেল দুইটা সপ্তাহ।
এই দুই সমাপ্তে আলোর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। যদিও এই পরিবর্তন সে নিজেই থেকে এনেছে। রোদের বলা কথাগুলো সে ভেবে ধরতে পেরেছে। বুঝেছে, রোদ তাকে কী ইঙ্গিত করেছিল। সত্যি বলতে আলো আগে একটু ভয় পেতো বাসার কোনো কাজ করতে। বা কিছু ধরতে। যদি রোদ বকে বা রাগ করে। কিন্তু রোদের বলা কথাগুলো থেকে ওর ভয়টা কেটে গেছে। এখন বাসার টুকটাক কাজ, মেঘের সঙ্গে দুষ্টুমি, পড়াশোনা, রোদের বকা, রিমির সাথে আড্ডা, সময়গুলো সে এভাবেই কাটাচ্ছে। রিমিও ওকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ফ্রি টাইমে এসে ওকে বিভিন্ন ব্যাপারে বুঝিয়েছে, সতর্ক করেছে, এবং কিছু মূল্যবান উপদেশও দিয়েছে। সব মিলিয়ে আলো অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।
আজকে আলোর কলেজ জীবনের প্রথমদিন। সকাল থেকেই ওর ভয় লাগছে। কেন? এর কারণ অজানা! সে কলেজ ড্রেস পরে বইখাতা গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে রোদের রুমে গেল। রোদ ওকে কলেজে রেখে অফিসে যাবে। আজ রবি মেঘকে স্কুলে রেখে এসেছে। তবে মেঘ যাওয়ার আগে আলোকে বার বার সাবধানে যেতে বলেছে। কেউ কিছু দিলে খেতেও নিষেধ করেছে। রোদ মেঘকে সর্বদা যেসব উপদেশ দেয়, আজ মেঘ সেসব উপদেশ আলোকে দিয়েছে। আলোও সুবোধ বালিকার মতো সব শুনেছে। আলো রোদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নক করার আগে রোদ ভেতরে আসতে বলল। কীভাবে বুঝল কে জানে? রোদ ওর হাতের ফাইলগুলো রেখে আলোর দিকে ঘুরে বলল,

“কাঁদছো কেন?”
আলো পূর্বের মতো মাথা নিচু করে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ কিছু না। অথচ চোখ জোড়া লাল হয়ে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। নাক’টা লাল হয়ে গোলাপী ঠোঁটে জোড়া মৃদুভাবে কাঁপছে। তার কান্না আটকানোর বৃথা প্রয়াস আর কী! রোদ ব্যাপারটা বুঝে মৃদু হেসে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই, আলো রোদের পায়ের কাছে ধপ করে বসে শব্দ করে কেঁদে দিলো। মুখে কোনো কথা নেই শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সব কষ্ট’রা যেন তাকে জাপটে ধরে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে চাচ্ছে। রোদ হাঁটু গেড়ে বসে ওর অশ্রু মুছে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“উহুম, কাঁদবে না, আমি আছি তো!”
আলো লালবর্ণ অশ্রুভেজা চোখ তুলে রোদের দিকে তাকাল! এই মানুষটা ওর জন্য অনেক করেছে। সর্বদা শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পাশে রয়েছে। এই মানুষটার জন্য আজ উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পুনরায় বাঁচার জন্য অদম্য ইচ্ছেশক্তি জুগিয়েছে। তার এই ঋণ কখনো শোধ করার নয়।
তবে জীবনে একটাবার সুযোগ আসলে সে অবশ্যই মানুষটার জন্য কিছু করবে। ঋণ শোধের জন্য নয়! আত্মতৃপ্তির জন্য!
আলো রোদের দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে। মুখে কিছু বলার যে শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন রোদ মৃদু হেসে পুনরায় ওর চোখ মুছিয়ে বলল,

“তোমার জন্য কিছু করা স্বার্থক তখন হবে, যখন তুমি লক্ষ্যে পৌঁছাবে। উহুম, একদম কাঁদবে না। আজ কলেজে প্রথমদিন যাচ্ছো একটা লক্ষ্য নিয়ে। তবে শেষ দিন এর সাফল্য নিয়েই ফিরো। আমার চাওয়া-পাওয়া, আবদার, উপদেশ, যা’ই বলো আমার কষ্টটা বৃথা হতে দিও না। নিজেকে এমন ভাবে তৈরী করো, যাতে তোমার জন্য আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাহয়। আর না কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারে, রোদ ঠকে গেছে। কী পারবে না?”
“হুম, যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
“কষ্ট ছাড়া জীবনে সাফল্য মিলে না। চেষ্টায় তোমাকে সাফল্য পাইয়ে দিবে, ইনশাআল্লাহ!”
কথাটা বলে রোদ উঠে দাঁড়িয়ে আলোকে দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আলো শক্ত করে রোদের হাতটা আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। তারপর রোদ আলোকে শক্ত হতে বলে দু’জনে বাসা থেকে বের হলো। রোদ রবিকে সঠিক সময়ে মেঘকে আনার কথা জানাল। গাড়িতে উঠে বসতেই রোদের ফোনে রিমি, আকাশ, আর রোহান ভিডিও কল দিয়ে আলোকে উৎসাহ দিলো। তিনজনে দুষ্টুমি করে ওকে হাসালো। সাথে মনের সব
ভয়কে কিক মেরে সরিয়ে জয়কে আঁকড়ে ধরতে বলল। ওরা
তিনজনে জোর দিয়ে বলল, আলো পারবে! ওদের সঙ্গে কথা বলে আলোর আত্মবিশ্বাসটা আরো বাড়ল। ‘এই জীবনে কিছু পারো না পারো অন্যকে উৎসাহ দেওয়া শিখো। তোমার এই উৎসাহটুকু হতে পারে অন্যের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র।
যদি না পারো, তাহলে অন্যের আনন্দে সামিল হওয়া থেকেও দূরে থাকো। কারণ এর যোগ্যতা অর্জনে তুমি অক্ষম!’
তারপর কলেজে পৌঁছে রোদ আলোকে ওর ক্লাসরুম দেখিয়ে দিলো। এবং জানাল ছুটির পর সে নিজে নিতে আসবে। আলো ছলছল চোখে আশেপাশে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। ওকে সাবধানে থাকতে বলে রোদ কলেজে থেকে বেরিয়ে গেল, ভুলেও আর পিছু ফিরে তাকাল না। কারণ সে জানে, আলো ওর দিকেই অশ্রুসিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তাছাড়া রোদ যতক্ষণ এখানে থাকবে আলো স্বাভাবিক হবে না। কারো সঙ্গে কথাও বলবে না বরং থম মেরে বসে থাকবে।ওর বন্ধু নির্বাচন ওকেই করতে হবে। এজন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে। আলো বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। খুব একা লাগছে! এখানকার কাউকেই সে চিনে না। এর পূর্বে মুন ছাড়া কোনো বন্ধু ছিল না ওর। এখানে আগ বাড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলবে? সে তো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তখন দুইজন মেয়ে পেছনে থেকে ফিসফিস করে বলল,

“বফ চলে তাই কাঁদছে। আহা কত্ত ভালোবাসা।”
“তাই হবে।”
তখন একটা ছেলে গলা পরিষ্কার করে আলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আলো চোখ মুছে ছেলেটার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলেটা ক্যাবলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে বলল,
” ইয়ে, রোদ ভাই তোমার কে হয়? তুমি কী ভাইয়াদের বাসায় থাকো?”
আলো ওর স্বভাবসুলভ মাথা নাড়াল। ছেলেটা হেসে জানাল, ওর নাম সাফি। রোদদের পাশের বাসার দো’তলায় ওরা ভাড়া থাকে। ওর সঙ্গে রোদকে দেখেই মূলত কথা বলতে এসেছে। সে আলোর সহপাঠী! ছেলেটার কথা শুনে আলোর ভালোই মনে হলো, তাই সেও টুকটাক কথা বলে স্যার আসলে ক্লাসে মন দিলো। সাফি ওর বন্ধুদের ডেকে আলোর পরিচয় করিয়ে দিলো। সাফির বন্ধুদের মাঝে একজন ছেলে আর দুইজন মেয়ে। রাজ, সাবা, আর রুকু। ওরা মোটামুটি ভালোই মিশুক। ওদের সঙ্গে আলোর সময়টা বেশ ভালোই কাটল। পরপর চারটা ক্লাস করে একটার দিকে ছুটির ঘন্টা পড়ল। সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। আলো সাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাইরে এসে দেখে রোদ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে মেঘ উৎসুক হয়ে ডানে বামে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। আলো খুব ভালো করে জানে মেঘবাবু তাকেই খুঁজছে। আলো হেসে সাবার থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের কাছে গেল। মেঘ আলোকে দেখে হামলে পড়ে বলল,
“জানো? তোমার জন্য কত্ত চিন্তা হচ্ছিল আমার! শুধু মনে হচ্ছিল, যদি হারিয়ে যাও।”
একথা শুনে রোদ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“এজন্য আমাকে মিটিংয়ে অবধি যেতে দিলে না?”
“হুম।”
ওদের দুই ভাইয়ের কথা শুনে আলো ফিক করে হেসে দিলো। তারপর তিনজনে মিলে গাড়িতে উঠে বসল। মাঝরাস্তায় রোদ গাড়ির থামিয়ে আইসক্রিম আর কোকাকোলা নিয়ে ওদের দিলো। ব্যস, খেতে খেতে আবার শুরু হয়ে গেল দু’জনের বকবকানি। পনেরো মিনিটে তিনজনে বাসায় পৌঁছে দেখে রোহান আর রিমি বসে আছে। ওদের দেখে মেঘ দৌড়ে গিয়ে রোহানের কোলে উঠে পড়ল। সোফাতে শুয়েই দু’জনের কুস্তি শুরু হয়ে। আলো আর রোদ ওদের সাথে কথা বলে ফ্রেশ হতে গেল। রোদ যেতে যেতে ফোন করে আকাশকেও বাসায় আসতে বলল। সবাই আজ দুপুরে একসাথে খাবে। আলো একেবারে গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হলো। ওর ভেজা চুল খোঁপা করে মাথায় সুন্দর করে ওড়না টানা।
রোদ দেখেও কিছু বলল না। কেন জানি সে চাচ্ছে না, কেউ আলোকে খোলা চুলে দেখুক। কেন চাচ্ছে তারও অজানা!
একটুপর, আকাশ আসলে ওরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসল। হাসি-ঠাট্টা, খুনশুটির মধ্যে খাওয়ার পর্ব চুকালো। তারপর ড্রয়িংরুমে বসে আলোর থেকে কলেজের প্রথম দিনের গল্প শুনল। আলোকে স্বাভাবিক দেখে রোদ মুচকি হাসল। কারণ আলোর আশেপাশে শক্ত বলয় তৈরী করা আছে। সেটা কেউ জানবে না। আর রোদই সাফিকে আলোর সঙ্গে কথা বলতে বলেছিল। নাহলে এই বোকা মেয়েটা চুপ করেই বসে থাকত!

পেট পুরে খেয়ে সবাই রোদের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলো। কেউ বেডে, কেউ সোফায় তো কেউ মেঝেতে শুয়ে পড়ল। আলো ওর রুমে চলে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু রিমি ওকে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। তারপর আড্ডা দিতে দিতে অনেকে ঘুমিয়েও গেল। এটা তো মেঘের সহ্য হওয়ার কথা না, হলেও না! তাই মেঘ শুয়ে থেকেই গলা ফাটিয়ে গান ধরল
“খ্যাতা বালিশ নিয়া শুটিং করুম তোর লগে মাইয়া। ওই হই হই।”
ওর চিৎকারে যারা ঘুমিয়েছিল তারা হুড়মুড় করে উঠে বসল।
বিশেষ করে রোহান, আকাশ আর রিমি। এরা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। রোদ বেডে বসে অফিসের ফাইল চেক করছিল।
ওই তিনজনের অবস্থা দেখে আলো আর মেঘ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ওদের হাসি দেখে রিমিও বোকার মতো হাসল। আর আকাশ বুকে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, হলো টা কী? মেঘ এই ভুলভাল গান দিয়েই ওর হার্ট এ্যার্টাক করে দিচ্ছিল।
আকাশের অবস্থা দেখে ওদের হাসি দ্বিগুন বেড়ে গেল। আর রোহান কারো হাসির ঝংকারে মুচকি হাসল।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
প্রায় দশদিন পর,

সন্ধ্যার পর রোদ অফিস থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। আলো কিংবা মেঘ আশেপাশে নেই! কিন্তু মেঘের রুম থেকে ফুল ভলিউমে গানের সাউন্ড ভেসে আসছে। পড়া বাদ দিয়ে ওরা গান শুনছে! রোদ উঠে দেখতে গেল মেঘের রুমে হচ্ছে টা কী? এদিকে আলো রোদের ব্ল্যাক টাওজারের সাথে ব্লু টি-শার্ট আর মেঘ আলোর লাল ওড়না’টা পেঁচিয়ে পরেছে।
কিছুটা শাড়ির মতো করে আর কি! সাথে কোমর দুলিয়ে ঢং করে হাঁটছে আবার নাচছেও! আজ সকালে রোদ বলেছিল, আজ ওর ফিরতে অনেক রাত হবে। অফিসের কোনো একটা কাজে বাইরে যাচ্ছে। রোদ নেই, তাই কোনো পড়াশোনা হবে না। শুধু মজা আর মজা!

আলো রোদের মতো করে হাঁটা, হাসা, রেগে কথা বলা, এসব অভিনয় করে মেঘকে দেখাচ্ছে। আর মেঘ অভিনয় দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। রোদ চুপ করে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। আলোকে এভাবে দেখবে সে মোটেও কল্পনা করে নি। কারণ ওর সামনে আলো যথেষ্ট ভদ্র হয়ে থাকে। এমন ভাব যেন, ওর মতো ভদ্র মেয়ে দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না। ওকে দেখে বোঝাও যায় না, সে দুষ্টুও বটে। এদিকে নাচতে গিয়ে মেঘ বেচারার কুঁচি খুলে গেল। এই নিয়ে মোট তিনবার খুলল। আলো বুদ্ধিমতির মেয়ের মতো ওর কোমড়ে বেল্ট বেঁধে দিলো। যাতে আর না খুলে! তারপর দু’জনে মিলে আবার উরাধুরা নাচ শুরু করল। যদিও নাচের কোনো আগা গোড়া নেই। রোদ আঁড়ালে দাঁড়িয়েই ওদের নাচের ভিডিও করে নিলো। তারপর নিঃশব্দে মেঘের রুমের সোফায় গিয়ে বসল। তাতেও ওদের কোনো হেলদুল নেই। ওরা আছে ওদের ধ্যানে। ভাবটা এমন, পৃথিবী উচ্ছনে যাক তবুও এখন নাচ’টা আগে। হঠাৎ নাচতে নাচতে আলোর চোখ পড়ল সোফার দিকে। রোদ চুপ করে বসে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে
মূলত অপেক্ষা করছে কখন এদের লাফালাফির সমাপ্ত হয়।

আচানক রোদকে দেখে আলো চমকে উঠে ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওকে থামতে দেখে মেঘ নাচতে নাচতে সামনে তাকাল। রোদকে দেখে সেও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেমে গেল। তখনও গান বাজছে,’ ওহ সাকি, সাকি রে, সাকি! সাকি!’
রোদকে দেখে আলো টি-র্শাট টেনে টুনে মুখ কাঁচুমাচু করছে।
আর মেঘ রোদের দিকে একবার তো আলোর দিকে একবার তাকাচ্ছে। ওদের দু’জনকে থামতে দেখে রোদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাহ! তোমরা তো দারুণ নাচতে পারো। তোমাদের নাচের একটা স্কুল খুলে দিবো? আলো তোমাকে তো পুরোই রোদের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, রোদের কার্বন কপি। রোদের মতো হাসা, হাঁটা, রেগে কথা বলা, পারফেক্ট! হুম, মানলাম তোমার সাহস আছে। সমস্যা নেই, তোমার সাহসের পরীক্ষা আমি খুব শীঘ্রই নিবো। মেঘ তোকে একদম মেয়ে লাগছে। রাস্তায় টাকা তুলে আর বলে না, টাকা দে! টাকা দে! তোকে কাল ওদের কাছে রেখে আসব। তোর যখন মেয়ে হওয়ার এতই শখ। কী
বলিস তুই?”

রোদের কথা শুনে আলো আর মেঘের করুণ অবস্থা। রোদের তো এখন আসার কথা না। তাহলে? আসবে না জেনেই তো একটু মজা করছিলো। কে জানত, জল্লাদ’টা চলে আসবে? ছিঃ! কী একটা অবস্থা। এসব ভেবে আলো আর মেঘ দু’জনে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইস! কি লজ্জা, কি লজ্জা! যেতে যেতে দু’জনে পণ করল জীবনে আর এমন কিছু করবে না। ওদের এমন কান্ডে রোদ হাসতে লাগল। এতদিন বাসায় এই দুষ্টুমি গুলোই সে খুব মিস করত। বাসাটা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। রোদ সর্বদা চায়, এই দু’টো পাখিই পুরো বাসা জুড়ে ডান ঝাপটে বেড়াক। তাদের হাসির শব্দে বাসার প্রতিটা দেওয়াল প্রতিধ্বনি হোক। মেঘ’টা আবার আগের মতো দুষ্টু হয়ে বাসাটা মাতিয়ে রাখুক। রোদের এই চাওয়াটা হয়তো পূর্ন হতে যাচ্ছে। একটুপর, রোদ ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ওদের দু’জনকে পড়তে বসালো। দু’জনেই মাথা নিচু করে বিরবির করে পড়ছে। রোদ আলোর বইয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাইন মার্ক করে মেঘকে বলল,

“মেঘ তোমার রেজাল্ট কার্ড দেখাও।”
একথা শুনে মেঘ রেজাল্ট কার্ড এনে রোদকে দিলো। রোদ দেখে বলল,
“তোমার বানানো রেজাল্ট কার্ড তোমার কাছেই রেখে দাও। যেটা স্কুল থেকে দিয়েছে, ওটা আমাকে দেখাও।”
মেঘ আজ রোদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। সে শুধু পারছে না চিৎকার করে কাঁদতে। তাও কোনোরকমে নিজেকে সামলে আসল রেজাল্ট কার্ড এনে রোদের হাতে দিলো। আর দৌড়ে গিয়ে আলোর পিছনে লুকালো। মেঘ জানে, এখন ওর সাথে কী হবে? এজন্য আর কিছু না ভেবে ওর কানকে প্রস্তুত করে রাখল। ঠিক তখনই, রোদ মেঘের রেজাল্ট কার্ডে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে বলল,
“এটা কী? তুই পাঁচটা সাবজেক্টে ফেল করছিস? তোকে হোম টিউটর কী শিক্ষায়?”
মেঘ উঁকি দিয়ে একবার রোদের দিকে তাকাল। রোদ রাগে গজগজ করছে! এজন্য মেঘ ভয় পেয়ে আবার মুখ লুকাল। রোদ উঠে মেঘকে ধরতে গেলে, মেঘ আলোকে নিয়েই ঘুরছে।
আলো পড়েছে দুই ভাইয়ের মাঝখানে। রোদ মেঘকে ধরতে গেলে মেঘ আলোকে রোদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। আলো না চাইলেও রোদের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। আর এই ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। তাই সে মুখ কাঁচুমাচু করছে। মেঘের এই কাজে রোদ আরো রেগে চিৎকার করে বলল,

“তুই কী কোনোদিনও শুধরাবি না? একটাতে ফেল করলে মানা যায়, তাই বলে পাঁচটাতে ফেল করবি? পরীক্ষার খাতায় আদৌও কিছু লিখেছিলি ?
একথা শুনে আলো ভয়ে ভয়ে রোদের থেকে রেজাল্ট কার্ডটা নিলো। মেঘের রেজাল্ট দেখে আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
বাংলাতেঃ ১৮
ইংরেজীতেঃ ০৯
গণিতেঃ ০৭
বিজ্ঞানেঃ ২৩
সমাজেঃ ৩০
ইসলামশিক্ষায়ঃ ৪০
ড্রয়িংঃ ৬৯
শারীরিক শিক্ষাঃ৫৬
রোদ আলোকে সামনে থেকে সরিয়ে মেঘকে ওর সামনে এনে দাঁড় করাল। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে। রোদ ওর মুখ তুলে বলল,
“আট’টা সাবজেক্টের মধ্যে পাঁচটাতেই ফেল করছিস। তোর আর পড়াশোনার দরকার নেই! তোকে রিকশা কিনে দিবো, তুই কালকে থেকে রিকশা চালাবি।”

রোদের কথা শুনে মেঘ সুন্দর করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে রিকশা চালাবে। রোদ শুধুু পারছে না ওকে তুলে আছাড় দিতে। এত কষ্ট করে পড়িয়ে এমন রেজাল্ট করলে, কীভাবে হবে! রোদ মেঘের কান টেনে মেঘকে এক পা তুলে দাঁড়াতে বলল। আপাতত এখন এটাই ওর শাস্তি। মেঘ কান ছুটিয়ে আবারও আলোর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে কেঁদে দিলো।
মানুষ ফেল করে আবার মানুষই তো রিকশা চালায়। আর সে বললই রিকশা চালাবে, তাহলে দাভাই কেন বকবে? সে খুব কষ্ট পাচ্ছে দাভাই কী বুঝছে না? তারমানে দাভাই ওকে আর
ভালোবাসে না! রোদ কিছু বলার আগে আলো মেঘকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইস! এইটুকুন সময়ে বাচ্চা’টা কান্না করে মুখ লাল করে ফেলেছে। আলো ওর ওড়না দিয়ে মেঘের মুখটা মুছিয়ে একটু পানি খাওয়ালো। মেঘ ফুঁপাতে ফুঁপাতে আলোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আলো ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে আদরে সুরে থামতে বলছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ বলল,
“বউমনি, দাভাই আমাকে শুধু বকা দেয়। আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”
আলো মেঘের অভিমানি কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“না মেঘবাবু, দাভাই তোমাকে আগের মতো খুব ভালোবাসে। তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বকেছে। দেখো, দাভাই কত্ত লেখাপড়া জানে। তোমাকেও তো দাভাইয়ের মতো হতে হবে।পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। যাতে সবাই বলে রোদের মতো মেঘও সবদিক থেকে বেস্ট।”

“হুম।”
তারপর এই নিয়ে দু’জনে আরো অনেক কথা বলতে থাকল। আলোর কথা ছলে মেঘকে রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। নয়তো মেঘ মুখ ফুলিয়ে অভিমান নিয়ে বসে থাকত।আর এই বাচ্চাটার জীবনে সব থাকলেও, ছন্দছাড়া। রোদ যথেষ্ট চেষ্টা করেও মেঘের সব অভাব পূরণ করতে পারে নি৷ যদিও যেটা ওর প্রয়োজন সেটা পূরণ করা সম্ভবও না। যেমন, বাবা মা!
আলো ঘুমন্ত মেঘের কপালে আদর দিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিলো। দুষ্টুটার বেশ রাগও আছে ভেবে আলো মুচকি হাসল। তারপর নিঃশব্দে রোদের রুমে গিয়ে দেখল, রোদ উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। আলো নক করে ওখানে দাঁড়িয়ে বলল,
“আসবো? বেশি সময় নিবো না।”
“এসো।”
রোদ আলোকে দেখে উঠে বসল। আলো কিছু বলতে চাচ্ছে, সেটা রোদও বুঝল। আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে রোদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘ এখনো ছোট। ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেই হতো, তাই না?”
একথা শুনে রোদ মৃদু হেসে হাতের গ্লাসটা রেখে শান্ত ভাবে উত্তর দিলো,
“আমি জানতাম, তুমি আমার রুমে এসে এসব নিয়ে কিছু বলবে! তাহলে শোনো, বাচ্চারা কাউকে ভয় না পেলে ভালো কথা কর্ণপাত করা তো দূর। নিজের ভুলগুলোও সংশোধন করতে চায় না। এর আগে মেঘকে আমি এভাবে বকা দেইনি। কারণ তখন ওকে বোঝানোর মতো কেউ ছিল না। এখন তুমি আছো! তুমি ওকে বুঝালে মেঘ ঠিক বুঝবে। মেঘ তো আমার প্রাণ! ওকে আমি কষ্ট দিতে পারি, তুমিই বলো? আমি শুধু ওকে ভয় দেখায়, যাতে দুষ্টুমিটা একটু কম করে।”

এলোকেশী কন্যা পর্ব ১৯+২০+২১

আলো রোদের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

” আপনার কথা বুঝলাম। তবে আপনিও একটা কথা শুনে রাখুন। ওকে ধমকানোটা আমার একটুও পছন্দ নয়। আপনি এমনটা আর করবে না। মেঘকে আমি যথাসাধ্য বোঝাব। এভাবে শাষণ করলে মেঘের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে।
সে ভাবতে পারে, বউমনি আসার পর দাভাই অনেক বদলে গেছে। আগে দাভাই ওকে বকতো না। কিন্তু এখন মারতেও আসে। মেঘ বাচ্চা, সে বুঝবে না আপনি ওর ভালোর জন্যই ওকে বকছেন। আশা করি, কথাগুলো আপনাকে সঠিকভাবে বুঝাতে পেরেছি, আসছি।”

রোদ চুপ করে আলোর কথাগুলো শুনল। তবে এর উত্তরে কিছু বলল না। কারণ আলোর যুক্তিও হেলা করার মতো না।
আলো একটু এগিয়ে থেমে পিছু ফিরে বলল,

“কথা বলতে আমিও পারি। এতদিন প্রয়োজন হয়নি তাই বলি নি। মেঘ আমাকে দু’টো আসনে বসিয়ে। একটা বউমনি আর অন্যটা মা। ওর দু’টো আবদারই আমি সাদরে গ্রহন করেছি।
সরাসরি ওর মা না হলেও বউমনির আড়ালে মা হয়েই ওকে সারাজীবন আগলে রাখব। তবুও আপনাকে কিছু বলতে দিবো না।”

রোদ ততক্ষণে আলোর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোর রাগান্বিত মুখটা দেখে রোদ মুচকি হেসে আলোর চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার কথার সূত্র অনুযায়ী বউমনি হয়ে ওকে মায়ের মতো সারাজীবন আগলে রাখবে। বেশ, তা বউমনি হবে কীভাবে? আমার বউ হয়ে?”

একথা জবাব দেওয়ার ভাষা আলো এই মূহুর্তে খুঁজে পেলো না। ওর সাহসটাও নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সব শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। একরাশ অস্বস্তি এসে ওকে জাপটে ধরল। কথাগুলো গলাতে জমা হয়ে কুন্ডুলী পাঁকিয়ে ফেলল। সাহসী তাৎক্ষণিক আলো মাথা নিচু করে ঝকঝকে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। রোদ হঠাৎ এমন কিছু বলবে ওর ধারণাও বাইরে ছিল। আলোর অস্বস্তিতে ভরা মুখটা দেখে রোদ শান্ত কন্ঠে বলল,
“ভেবে জানিও। এখন রুমে যাও।”

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৫+২৬+২৭