এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৫+২৬+২৭

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৫+২৬+২৭
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদের বলতে দেরী কিন্তু আলোর ছুটে পালাতে দেরী হয় নি।
ওর পক্ষে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ানোও সম্ভব না। লজ্জায় নয়! বরং সে এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখার পণ করেছে। ভয়
পায় সে, প্রচন্ড ভয়! বিশেষ করে মুনের পরিণতি দেখার পর। ওর মস্তিষ্কে এখন একটা কথায় ঘুরপাক খায়, ভালোবাসার মানুষের কাছে যদি নিরাপদই না থাকে। তাহলে এ কেমন ভালোবাসা? এই ভালোবাসা দিয়ে কী হবে? কাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস ছাড়া কী সম্পর্ক টিকে? উহুম, মোটেও না! কারণ প্রতিটা সম্পর্কে বিশ্বাস খুঁটিস্বরুপ। আর সেই খুঁটি নড়বড়ে হলে ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ দু’টোই ঠুনকো। সেদিন রোদ আলোর চোখে ভালোবাসার প্রতি ঘৃণার দেখেছে। সেও খুব ভালো করে জানে, মুনের জন্য আলোর মনে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। আর ওর ঘৃণার তীব্রতা বেশ প্রখর। তবে আলো এটা ভাবছে না, একটা মুদ্রার দু’টো পিঠ থাকে। একটা সাদৃশ্য হলে অন্যটা নিচে চাপা পড়ে থাকে৷ আর দু’টো পিঠ দেখতে হলে মুদ্রাটা তুলে স্বচক্ষে পরখ করতে হয়। তবেই না সত্যটা জানা যায়। অথচ বোকা মেয়েটা জেদ করে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে। ব্যাপারটা এমন ভালোবাসবোও না আর বাসতেও দিবো না। তবে রোদ জেনে বুঝে আলোকে সময় দিচ্ছে। দেখা যাক, কী হয়!

রাতের আঁধার কাটিয়ে পরেরদিন রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিনের সূচনা হলো। রোজকার রুটিন মাফিক মেঘ গেল স্কুলে, আর আলো কলেজে। আর রোদ আজ বাসাতেই আছে। সুজনের বাবার সঙ্গে রোদের কাল বেশ ঝামেলা হয়েছে। টাকা সময় মতো ফেরত না দেওয়াতে পুলিশ সুজনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনদিন পর রোদের টাকা ফেরত দেওয়ার পর পুলিশ ওকে ছেড়েছে। রোদের এমন কাজে সুজনের বাবা মা খুব রেগে আছে। মামাতো ভাই বলে কী একটু ছাড় দেওয়া যেতো না? মাত্র দশ লাখ টাকায় তো! রোদের তো কম নেই, তাহলে? মূখ্য কথা রোদ একবারও উনাদের সন্মানের কথা ভাবল না।
যদিও এসব শুনেও রোদের কোনো হেলদোল নেই। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর যারা ওদের খোঁজ করেনি। একবার এসে দেখেও নি ওরা কেমন আছে? কী করছে, কী খাচ্ছে? ছোট্ট মেঘকে সে একা কীভাবে সামলাচ্ছে? তাহলে আজ সে কেন ভাববে? তবুও সে মামার কথায় সুজনকে অফিসে রেখেছিল। কিন্তু সুজন!
সে যাই হোক, এমন সুবিধাবাদীদের জন্য ওর মনে আত্মীয়তা আসে না। কারণ এরা যে প্লেটে খায়, সে প্লেটে থুথু ফেলতেও দ্বিধা করে না!

সাবা আর মিনা নামক দুইজন সার্ভেন্ট ছুটি শেষ করে আজ ফিরেছে। গতকাল রিমি রোদকে জানিয়েছিল, তার নাকি দুইজন সার্ভেন্ট দরকার। এখন ব্যস্ততা বেড়েছে, বাসায় রান্না করে খাওয়ার সময় পাচ্ছে না। রোদ ওকে বলেছিল, এখানে চলে আসতে। রিমি শোনে নি। বরং দ্রুত সার্ভেন্টের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছে। এজন্য রোদ সাবা আর মিনাকে রিমির বাসায় যেতে বলল। আজ থেকে ওরা ওখানে থাকবে। সাথে
এটাও আশ্বস্ত করল, ওখানে ওদের কোনো সমস্যা হবে না। রিমি যথেষ্ট বিনয়ী! সাবা আর মিনা রোদের কথায় সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিলো। এখন রাকা, সাগর আর রবি থাকল রোদের বাসায়। খানিকক্ষণ পর, সাবিনা খালা এসে রোদকে ড্রয়িংরুমে দেখে বিশ্বজয় করা হাসি হাসলেন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কিছু একটা ভেবেও নিলেন। হুম, এটাই মোক্ষম সুযোগ! সেই সাথে টাকা হাতানোরও। এমন কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন উনি। খালা যেসব বাসায় কাজ করেন, ওই সাহেব’রা উনাকে গোপনে আরো একটা কাজ দিতে বলেন। কাজটা হলো, সাহেবদের বউয়ের খবর সাহেবদের কানে পৌঁছানো। যেমন, বাসার কখন কে আসল, পুরুষ নাকি মাহিলা, মেডাম ফোনে কার সঙ্গে কথা বলল, কথা বলার ভঙ্গি কেমন ছিল, দিনে কতবার বাইরে গেল এসব। আর এসব কাজ উনি বেশ ভালোই করেন। তবে খালা সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশাতেও ভুল করেন না। সত্য আর মিথ্যার সংমিশ্রণ বানোয়াট তথ্য নিয়ে সাহেবদের কানে দিয়ে টাকা হাতায়। সাহেবরাও বিশ্বাস করে উনাকে ভালোই মজুরি দেয়, সাথে মেডামের প্রতি কড়া নজর রাখতে হবে। আর আলোকে উনার প্রথমদিন থেকে অপছন্দ।

কারণ সুন্দরী মেয়েদের অহংকার বেশি। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না এদের। আর আলো সহজ সরল ব্যাপারটা সহজে ধরতে পারবে না। এই সুযোগ রোদের মনে বিষ ঢাললেই, ব্যস কেল্লাফতে! সাবিনা খালা মুখটা মলিন করে রোদের সামনে গিয়ে বললেন,
“ছ্যার, মেডামের উপ্রে একটু নজর রাইখেন। ইয়ে আইজকাল মেডামের মতিগতি ভালা মুনে হইতাছে না।”
একথা শুনে রোদ লেপটপ থেকে চোখ সরিয়ে খালার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল। ওর তাকানোর মানে বুঝে খালা কন্ঠ নিচে নামিয়ে বললেন,
“মেডাম ওই সাফির লগে কতি কতি জানি যায়। ছাদেও দেহি রোজ হাসাহাসি করে।”
একথা শুনে রোদ উঠে দাঁড়িয়ে একটা নোটবুক নিয়ে আসল।এখানে বাসার কাজের লোকদের বেতন সংক্রান্ত সব নোট করা থাকে। রোদ সেটাতে একবার চোখ বুলিয়ে ওয়ালেট থেকে চকচকে দশ হাজার নিয়ে খালাকে দিলো। টাকাগুলো খালা খপ করে নিয়ে সুন্দর করে হাসলেন। মাত্র দু’টো খবরে দশ হাজার টাকা, বাপ্রে! উনি মনে মনে ভাবলেন এবার থেকে রোদকে রোজ এমন খবর দিবেন। আহা! রোজ দশ হাজার টাকা! উনার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রোদ মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে বলল,
“কালকে থেকে আপনার আর আসার প্রয়োজন নেই। ভালো থাকবেন।”

কথাটা বলে রোদ উঠে লেপটেপ নিয়ে রুমে চলে গেল। নিজে না কিছু বলল আর না বলার সুযোগ দিলো। সাবিনা খালার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এটা কী সর্বনাশ হলো? যদিও রোদ উনার সব কার্যক্রম সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল। কথায় আছ, ‘ অভাবে স্বভাব নষ্ট।’ তো উনার হয়েছে এই দশা। রান্নাঘর থেকে চাল, ডাল, তেল, চুরি করাও উনার অভ্যাস। রাকা ,মিনা, উনাকে বার বার নিষেধ করলেও শোনেন নি। গরীব মানুষ বলে রোদ এতদিন সব জেনেও চুপ ছিল। তাছাড়াও উনি মেঘকে আদর করার নামে গাল চটকে লাল করে দেয়, অকারণে খ্যাচম্যাচ করে, মেঘ যেন না বলে তাই চকলেট দিয়ে আদর করেও দিতেন। মেঘ চকলেট পেয়ে গলে যেতো। এই অবধি সব ঠিকই ছিল। কিন্তু উনি আলোকে গতদিনে ছোটলোক, ফকিন্নি, এবং অহংকারী বলে গালাগাল করেছে। এজন্য সেদিন সন্ধ্যায় আলো কেঁদেছিল। এই বড় বাসাটা শুধু সার্ভেন্টের ভরসায় ফেলে রাখা যায় না। তাহলে দু’দিনে নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় বসতে হবে। আর এজন্যই বাসার ভেতরে আনাচে- কানাচে দু’চারটা সিসি ক্যামেরা আছে। এটা রোদ ছাড়া কেউ জানে না। সেখানকার ফুটেজ থেকেই রোদ মূলত এসব দেখেছে। খালা এতদিন এসব করেও থামেন নি। আজ আবার স্বশরীরে দাঁড়িয়ে আলোর নামে মিথ্যাও বলছে। যাতে বাসায় অকারণে অশান্তি সৃষ্টি হয়। অনেক হয়েছে আর না। তাই রোদ আজ একেবারেই ছাটাই করে দিলো। তাছাড়া
এসব মানুষ বাসায় থাকা আর খাল কেটে সাদরে কুমিরকে ডাকা, দু’টোই সমান! বেচারা খালা চোখের পানি মুছছে আর বার বার উপরে তাকাচ্ছে। এই বাসায় থেকে এটা ওটা নিয়ে গিয়ে বিক্রিও করতেন, আজ থেকে সব বন্ধ। উনি চোখ মুছে অভিশাপ দিতে দিতে বিদায় নিলেন। রাকা বাগান থেকে এসে এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। রোদ ওদের সবাইকে যথেষ্ট সাহায্য করে, তবুও খালা এমন করেন। রাকা, মিনা, এতদিন নিষেধ করলে, শুনেনই নি। বরং সংসারের অভাবের
কাহিনী শুনাতেন। বেশ হয়েছে! অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। এবার মজা বুঝে!

আজকের দিনটা খুব খারাপ যাচ্ছে। মাতবরের ছোট ছেলে রবি পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেছে। পাঁচ বছরের বাচ্চাটা ব্যাথায় ছটফট করে কাঁদছে। হাকিম এসে দেখে জানালেন, এখনই শহরে নিয়ে যেতে হবে। বাম হাতের কব্জির হাড় ভেঙে বাইরে বেরিয়ে গেছে। উনার এই চিকিৎসা কাজে আসবে না। বরং ইনফেকশন হয়ে হাতে পঁচন ধরতে পারে। একথা শুনে মাতবর প্রচন্ড রেগে হাকিমকে স্বজোরে ধাক্কা দিলেন। হাকিম তাল সামলাতে না পেরে ছিঁটকে পড়ল আঁশবটির উপর। চিৎ হয়ে পড়ার কারণে উনার পিঠ কেটে রক্ত ঝরতে লাগল।তবুও উনি ভয়ে টু শব্দ করলেন না। বরং উঠে দাঁড়াতেই মাতবর উনাকে ঘুষি মেরে দিলেন। আজ পর্যন্ত গ্রামের কাউকেই উনি শহরের ডাক্তারের কাছে যেতে দেন নি, আর আজ ছেলেকে দিবে? গেলে কী সন্মান থাকবে? হাকিম এই অন্যায় প্রস্তাব কীভাবে দিলেন? উনার এত সাহস হলো কীভাবে? মাতবর হাকিমকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“মলে মলুক, তাও এই তিকিৎসায় কলতে হবে। আমি শুহুলে যাতে দিবো না।”

হাকিম উনার কথায় সম্মতি জানিয়ে চিৎকার শুরু করলেন। তবে উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সঠিক চিকিৎসা করার। রবি দেখতে বেশ মায়াবী। বড্ড মায়া লাগছে বাচ্চাটার কষ্ট দেখে। হাকিম আর বসে না থেকে উনার মতো করে চিকিৎসা শুরু করলেন। মাতবরের আজ শালিশ আছে; বিধায় উনি চলে গেলেন। কালকে রাতে একজোড়া ছেলে-মেয়েকে ধরা হয়েছে। তারা নাকি ঝোঁপের ঝাড়ে লুকিয়ে কথা বলছিল। হাকিমের রাগ উনি ওই ছেলে মেয়ের উপরে তুলবে ভাবলেন। এমন শাস্তি দিবেন, যাতে ভয়ে সবার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। যথারীতি শালিশের কার্য শুরু করা হলো। ছেলে-মেয়ে দু’টো পাহাড়ি আদিবাসী। ছেলেটা সাবেদ আর মেয়েটা পূর্ণি। তারা একে অপরকে পছন্দ করে। সাবেদ নাকি গত দুইদিন খুব অসুস্থ ছিল। তাই কিছুটা সুস্থ হয়ে আজ পুর্ণিকে জানাতে এসেছিল। এসে দাঁড়াতেই কয়েকজন দেখে ওদের ফেলেছে।

পালাতে যাতে না পারে তাই গাছের সঙ্গেও বেঁধে রেখেছিল।
এই গ্রামে প্রেম-ভালোবাসার নিয়ম নেই। এজন্য কঠোর শাস্তি
পাবে দু’জন। পূর্ণির কলিজায় সাহস বেশি তাই এতরাতে বের হয়েছিল। ভয় ডর থাকলে সে এমন করতো না। তাই মাতবর অনেক ভেবে চিন্তে ঘোষণা করলেন,
”এই বেডির আজ লাইতেই পুনেলোজন (পনেরো) জুয়ান বেডার লগে সহুবাছ (সহবাস) করতে হবে।”
মাতবরের রায় শুনে সাবেদ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। তার আবেগের শাস্তি এখন প্রিয় মানুষটাকে পেতে হচ্ছে। আর এই রায়ের সর্বশেষ পরিণতি পূর্ণির নির্মম মৃত্যু! কারণ পনেরো জন যুবকের অত্যাচার চৌদ্দ বছরের পূর্ণি সহ্য করতে পারবে না। আর পূর্ণির মৃত্যু সাবেদের মেনে নেওয়া অসম্ভব প্রায়। সে পারবে না মানতে, কিছুতেই না! এদিকে রায় শুনেও পূর্ণির কোনো হেলদোল নেই। সে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ওর প্রাণপ্রিয় মানুষটার কান্না দেখছে। ভালোবাসার মানুষটাকে ওর জন্য কাঁদতে দেখে ছলছল চোখেও পূর্ণি মুচকি হাসল। সে তাহলে ভুল মানুষকে ভালোবাসে নি। আজকের পরিস্থিতিতে সেটা প্রমান পেয়ে গেল। পূর্ণির খুব বলতে ইচ্ছে করছে,
”কাইন্দো না সাবেদ। আমি আজ বাঁচলেও তুমাল না বাঁচলেও তুমাল।”

কথাটা ওর বলা হলো না গলাতেই জটলা বেঁধে রইল। তবে এই রায়ে একদল যুবক ততক্ষণে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। তারা খুব খুশি! আজ রাতে তাহলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। পূর্ণি আর সাবেদ মাতবরের থেকে একটু দূরে মাথা কত বসে আছে। সাবেদ আর পূর্ণির বাবা-মাকে বিচারে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় নি। উনারা বাড়িতে বসে অশ্রু ঝরাচ্ছেন।
এর মধ্যেই পূর্ণি একটা অভাবনীয় কাজ করে বসল। যেটা ছিল সবার কল্পনাতীত। সে একলোকের হাত থেকে করাত কেড়ে মাতবরের দিকে ছুঁড়ে মারল। ভাগ্যক্রমের নিঁশানাও সঠিক জায়গায় লেগে গেল। ধারালো করাত’টা ক্যাত করে মাতবরের বাহুতে গেঁথে গেছে। অকস্মাৎ এই ঘটনায় উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পরপরই হৈচৈ শুরু করে দিলো। গাঢ় রক্ত দেখে সবাই দৌড়ে গিয়ে মাতবরকে ঘিরে ধরল। আজ মতি এবং তার দলবল কেউ’ই এখানে নেই। এই সুযোগে সাবেদ পূর্ণির হাতটা আঁকড়ে ধরে বিপরীত পথের দিকে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। বাঁচাতে হবে! প্রিয় মানুষটাকে যেভাবেই হোক ওর’ই বাঁচাতে হবে। সাবেদ তার সকল ভয়কে দূরে ছুড়ে পূর্ণিকে নিয়ে ছুটে চলল অনিদির্ষ্ট এক পথের দিকে। গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে আবার দৌড়াতে লাগল। ওরা
জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই দেখল, বনভোজনে আসা একটা বাস সামনে দাঁড়ানো। বাসটা যাবে রাঙামাটির দিকে।

মূলত কয়েকজন ছেলে ব্যাক্তিগত কাজ সারতে বাস থামাতে বলেছিল। সাবেদ আর কিছু না ভেবে পূর্ণিকে নিয়ে বাসের ছাদে উঠে দ্রুত শুয়ে পড়ল। যাতে ওরা কারো নজরে না পড়ে। পূর্ণি পুরো শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। শীত নয় প্রচন্ড ভয়ে! সাবেদ পূর্ণিকে ওর বাহুডোরে বন্দী করে কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিলো। এই শেষ মুহূর্তে এসে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে ওরা ভাবতেও পারে নি। দুই মিনিটের মধ্যেই বাসটা চলতে শুরু করল। আর সাবেদ শক্ত করে পূর্ণিকে জড়িয়ে ধরে রাখল। ওইদিকে মাতবরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অনেকেরই পূর্ণিদের খেয়াল করে নি। উনাদের মস্তিষ্কে তখন ধরে নি ওরা পালিয়ে যেতে পারে। ভেবেছিল, আগে মাতবরকে দেখুন পরে ওদের ব্যবস্থা হবে। তবে যারা ওদের পালাতে দেখেছে, তারা কেন জানি আজ চুপ থেকেছে। যেতে দিয়ে উনারা ওদের কাজে নিরবে সম্মতি জানিয়েছে। অনেক তো হলো, আর কত!

রোজ মেঘ স্কুল থেকে বাসায় চলে আসে। অথচ আজ আসে নি। আলো কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মেঘের অপেক্ষায় আছে। রোদ নাকি মেঘকে অফিসে যেতে বলেছে। কিছুক্ষণ আগে রবি এসে আলোকে জানাল। অনেকক্ষণ বসে থেকে মেঘ না আসাতে আলো রোদকে কল দিলো। সে গত কয়েক দিনে ফোনের ব্যবহার আয়ত্ত করতে পেরেছে। রোদ ওকে সুন্দর একটা ফোনও দিয়েছে। দুই বারের বেলায় রোদ কল রিসিভ করলে আলো বলল,
“হ্যালো, শুনছেন? আ আমি আলো।”
“বলো?”
আলো বার দু’য়েক ঢোক গিলে বলল,” ম মে মেঘ আসছে না কেন? আমি অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি।”
“এবার থেকে মেঘের স্কুল ছুটির পর সরাসরি অফিসে চলে আসবে। পূর্বে মতো সারাদিন এখানেই থাকবে। আর সন্ধ্যায় একেবারে আমার সাথে ফিরবে। তোমাকে ওকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। তুমি তোমার কাজগুলোই সঠিকভাবে করো, রাখছি।”
কথাটা বলে রোদ নির্দয়ের মতো কল কেটে দিলো। আর আলো ফোনের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মেঘ না থাকলে সে একা বাসায় থাকবে কীভাবে? আর ওর সময়টুকু বা কাটবে কী করে? এসব ভেবে আলো চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে গেল। রোদ মেঘকে ওর থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছে, কিন্তু কেন?

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আলোও দুপুরে খেয়ে না শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেল। রোদের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। রোদ কেন একথা বলল? তার অপরাধ কী? নাকি এটা অজ্ঞাত কারণে রোদের রাগের বহিঃপ্রকাশ, কোনটা? আলো এত ভেবে কেনো উত্তর পেলো না। ওদিকে মেঘ পুরো অফিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আগেও সে সারাদিন রোদের সাথে অফিসেই থাকত। অফিসের মধ্য মণি সে। এ কয়েকদিনে আলোকে পেয়ে অফিসের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। আজ আবার আগের মেঘ হয়ে গেছে। অফিসের
স্টার্ফগুলোও যেন ওকে চোখ হারায়। দুষ্টু মেঘকে সবাই খুব
ভালোবাসে। এমনও দিন গেছে স্টার্ফদের হাতে মেঘ খাবার
খাবার খেয়েছে। কেউ কেউ ওর জন্য আলাদা করে খাবারও আনত। আনলে আবার খাইয়েও দিতে হতো। কোনোদিন না
আনলে মেঘবাবুর সে কি রাগ! মুখ ফুলিয়ে প্রায় সারাটাদিন আশেপাশে ঘুরঘুর করত, কিন্তু কথা বলত না। অনেকে এনে শুধু ওকে রাগানোর জন্য দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলত, আজ আনে নি। তখন মেঘের কান্ড দেখে না হেসে থাকা যেতো না। রোদ এসব দেখে মেঘকে বকতোই সাথে স্টার্ফদেরও। সবাই চুপ করে শুনতো! তারপর রোদ চলে যাওয়ার পর মেঘ এবং স্টার্ফরা হেসে লুটোপুটি খেতো। এটা ছিল রোজকার রুটিন। আজ মেঘকে পেয়ে সবাই যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। মেঘের তো গল্পই শেষ হচ্ছে না ওর বউমনিকে নিয়ে। কতশত গল্প শোনাল সবাইকে তার হিসাব নেই। হঠাৎ আলোর কথা মনে হতেই মেঘ দৌড়ে রোদের কেবিনে চলে গেল। রোদ একমণে তখন নিজের কাজ করছিল। রোদের ফোনটা নিয়ে মেঘ আলোকে ফোন দিতে গেলে রোদের কথা শুনে থেমে গেল।

মুখটা ভার করে রোদের কোলে উঠে বুকের সঙ্গে লেগে কাঁধে মাথা রাখল। মন খারাপ হলে সে একাজটাই করে। মেঘকে এভাবে বুকে নিয়ে রোদ মিটিং অবধিই করেছে। কতশত রাত এভাবে বসে অফিসের কাজ করেছে। আম্মুর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মেঘ এভাবে রোদের বুকেই ঘুমিয়ে যেতো। ঘুম ভেঙে মেঘ কাঁদবে ভেবে রোদ বেশি নড়তোও না। একইভাবে ওকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখত। অফিসের চাপ, পড়াশোনা, মেঘের দেখাশোনা, সবদিক সামলাতে রোদের খুব কষ্ট হতো। মনে হতো, মেঘকে নিয়েই মরে যেতে। প্রথম সন্তান হিসেবে রোদ যথেষ্ট আদরের ছিল। মা ভক্ত রোদ ছিল ওর আম্মুর প্রাণ।
অথচ আম্মু দায়িত্বের সাগরে ডুবিয়ে ওকে একা রেখেই চলে গেছে। দিনগুলো হয়তো চলে গেছে, কিন্তু সেসব কথা স্মৃতির পাতায় আজও জলজল করছে। মেঘের মন খারাপ দেখে রোদ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে বলল,
“ছোট সাহেব কী পিৎজা খাবে?”
“হুম খাবে।”

মেঘের কথা শুনে রোদ মুচকি হেসে সাতটা পিৎজা অর্ডার করল। কারণ একটা করলে স্টার্ফদের দিয়ে মেঘের ভাগে কিছু থাকত না। আর দুষ্টুটা একাও খাবে না। মেঘ চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ওভাবেই ঘুমিয়ে গেছে। দশ মিনিটের মধ্যে পিৎজা ডেলিভারী দিয়ে গেল। কিন্তু মেঘ ঘুমাচ্ছে দেখে রোদ আর ডাকল না। একটুপরে আকাশ রোদের কেবিনের এসে ইশারায় দেখিয়ে বোঝাল, ‘ওরা দুপুরে খাবে কখন?’ রোদ ‘একটুপরে’ বলে মেঘের দিকে তাকাল। হাতের কাজটা সেরে মেঘকে ডেকে খাইয়ে দিবে। আকাশ সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল। ওইদিকে আরেকজনও এখনো খায় নি। রাকা ফোন করে কেবল জানাল। সব জ্বালা-যন্ত্রণা এসে রোদের ঘাড়েই পড়ে। তবুও না আছে বিরক্ত না আছে কোনো অভিযোগ। তবে রোদও রাকাকে বলেছে, আলোকে ডেকে ওর কথা বলে জোর করে খাওয়াতে। নয়তো বাসায় ফিরে আজ ওর খবর আছে। রাকা ‘আচ্ছা’ বলে আলোকে রোদের ভয় দেখিয়ে জোর করে এনে খেতে বসিয়েছে। আর আলো নাক টানছে, ফুপাচ্ছে, আর খাচ্ছে। রোদকে সে কত রকমের গালি দিচ্ছে একমাত্র সেই জানে। এত অত্যাচার ওর সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ খাবার আটকে গেলে পানি খেয়ে শব্দ করে বলল,

“সব সময় এমন করে, সব সময়। উনি যা বলবে তাই’ই হবে, কেন রে? আমাকে মানুষ মনে হয় না? কী এমন ক্ষতি করেছি আমি? খারাপ মানুষ একটা! থাকব না আমি চলে যাব। এত এত অত্যাচার করলে থাকা যায় নাকি? সে নিজেকে কীভাবে হুম? চলে যাব তো, যেদিকে মন চাই চলে যাব।”
ফুঁপাতে ফুঁপাতে কথাগুলো বলে আলো ওড়নাতে নাক মুছে উঠে চলে গেল। সেও কথা বলবে না! কেন বলবে? ওর কী রাগ নেই? অন্যসময় মেঘ বউমনি! বউমনি! করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আর আজ কারোর খেয়াল নেই, বাসায় একটা মানুষ ওদের অপেক্ষায় আছে। তা থাকবে কেন? সে কী কেউ হয় নাকি? হয় না তো, সে কারো কেউ হয় না! এজন্য তো ওর কথা কারো মনেও পড়ে নি। এতসব অভিযোগ নিয়ে আলো বালিশে মুখ গুজেঁ শুয়ে পড়ল। আজ ওর অভিমানের পাল্লা বেশ ভারী। একরাশ অভিমান এসে জমা হয়েছে ওর মনের কোণে।

আচ্ছা আলো যদি জানত, যে ওর বলা প্রতিটা শব্দ কেউ স্পষ্টভাবে শুনেছে। অভিমানেপূর্ণ মুখশ্রীটা কেউ দু’চোখ ভরে দেখেছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওড়নায় নাক মুছতে দেখে কেউ নিঃশব্দে হেসেছে। ফুঁপানোর সময় ওর কম্পিত ঠোঁট জোড়া দেখে কারো হৃদস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য থমকে গেছে৷ নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টায় ঠোঁটে যে দাঁতের দাগ বসে গেছে। সেটা স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠাতে কারো বুকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ওর এলোকেশে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটা কেউ পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছে। সেই সাথে কেউ ওর খোঁপাতে কাঠ গোলাপ গুঁজে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। এসব খবর আদৌ কী সে জানে? নাকি মুখ ফুলিয়ে শুধু অভিমান করতেই জানে? যদিও এসব জানতে চাইলেও তাকে কেউ একজন জানতে দিবে না। এর উত্তরটা অজানা! আর এটাও বলবে না, সে কেউ’টা ওকে আড়াল থেকেই বড্ড বেশি ভালোবাসে!

ওদিকে মাহবরের চিকিৎসার জন্য হাকিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উনি পাশের গ্রামে ওষধি গাছ তুলতে গেছেন। আর ফিরতে নাকি রাত হবে। কয়েকজন উনার খোঁজে বেরিয়েছে, খুঁজে পেলেই হয়। কোন আদাড়ে বাদাড়ে গাছ তুলতে গেছে, কে জানে! মাতবরের হাতের রক্ত ক্ষরণ কমছে না। ধারালো করাতের কোপে রগ কেটে শোচনীয় অবস্থা। আর যার হাতে করাত ছিল সে ব্যাক্তিও পলাতক। নাহলে তারও জান নিতো মতি। মাতবরের অবস্থা দেখে সবাই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
না জানি কখন কী হয়! মতি তো পাগলের মতো সাবেদ আর পূর্ণিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের পেলে সর্ব সম্মুখে সে টুকরো টুকরো করবে। পূর্ণি ঠিক কত্ত বড় কলিজা সে তাই’ই দেখবে। হাকিমকে না পেয়ে অন্য একজনকে ডেকে রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করা হলো।
রক্ত ক্ষরণের কারণে মাতবর অনেকটাই নেতিয়ে গেছে। পূর্ণি আর সাবেদ সেই বাসের ছাদেই আছে। বাস রাঙামাটিতে নয়, সরাসরি ঢাকায় যাবে। কারণ বাসের ছেলে- মেয়েরা ঢাকায় থেকে এসেছিল। পূর্ণি একদৃষ্টিতে সাবেদের দিকে তাকিয়ে আছে। কত্ত ভালোবাসে মানুষ তাকে। সেই মানুষটার হাত ধরেই আজ অজানা শহরের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। না আছে ওদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর না আছে টাকা-পয়সা। শুধু আছে একবুক ভালোবাসা আর অগাত বিশ্বাস। ওরা দু’জনে আহামরি সুন্দর, উচ্চ -শিক্ষিত, বিত্তবান, কোনটাই নয়! এক বেলা অনাহারে থাকা গরীব ঘরের দু’টো ছেলে মেয়ে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোই অবস্থা! তবুও দু’জনে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার সঠিক মর্ম বুঝে। কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রিয় মানুষটাকে আগলে নিতে জানে। এখন দেখার পালা, অচেনা শহরে তাদের কী উপহার দেয়! তাদের অস্বস্তি টিকে থাকবে। নাকি চিরতরের নিঃশেষ হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।

বিকেল গড়িয়ে পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যায় নেমে এলো। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তবুও মেঘের আসার নাম নাই। রাগে আলোর পুরো শরীর কিড়মিড় করছে। মনে হচ্ছে, ওই দু’টোকে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে টানা একঘন্টা পিটাতে পারলে বেশ শান্তি পেতো। বিশেষ করে রোদ নামক খাটাশটাকে। নিজেকে কীভাবে সে? অত্যাচারী মানুষ একটা! আজ আসুক বাসায়। ওর একদিন কী আলোর এক বছর। এমন ব্যবহারে কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে, মানে হবেই!যদিও রোদের সামনে কিছু বলার সাহস ওর নেই। তাই মনে মনে বলে রাগ কমানোর চেষ্টা আর কী! আর মনে মনে বলতে তো সমস্যা নেই! আলো নামাজটা পড়ে বই নিয়ে ওর রুমেই পড়তে বসল। আজ ওর অনেক পড়া বাকি আছে। যে ভাবেই হোক সম্পূর্ণ করতেই হবে। নাহলে কালকে কলেজে যেতে পারবে না। কারণ সে কারো হাসির পাত্রী হতে চায় না। আজকাল ওদের ক্লাসে পড়াশোনা নিয়ে পাল্লা-পাল্লি হচ্ছে। কেউ কারো থেকে পিছিয়ে পড়তে রাজি না। একজন না পারলে অন্যজনের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটছে। সেই হাসি দেখে অপরজনের জেদটা দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে। পুরো কলেজে এখন এই নিয়ে বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। শিক্ষকরা আগে তুলনায় অনেকটা এ্যার্লাট হয়ে গেছে। উনারা চাচ্ছেন
ছাত্র-ছাত্রীদের জেদটাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। জেদটাই ওদের অনেকদূর নিয়ে যাবে। পড়াশোনায় জেদ স্টুডেন্টদের অনেক পরিশ্রমী করে তোলে। আর পরিশ্রম হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। আলো পরপর ওর সব পড়াগুলো সম্পূর্ণ করল। এখন বাজে বারোটা বিশ। আলো মুখটা ভার করে উঠে নিচে গেল। কই রোদ মেঘ কেউই তো নেই। তারা কী এখনো আসে নি? রাকা আলোকে দেখে খেতে দিতে এগিয়ে আসল।আলো রাকার পিছু রান্নাঘরে গিয়ে বলল,

“আপু, ওরা আসে নি? কখন আসবে কিছু বলেছে?”
“স্যার তো অনেক আগে ফিরে, খেয়ে, শুয়ে পড়েছে।”
“ওহ আচ্ছা। আমি এখন খাবো না আপু, আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন।”
কথাটা বলে আলো ঝাপসা চোখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। দু’একবার পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। সে মেঘের রুমে উঁকি মেরে দেখল, মেঘ নেই! তাহলে মেঘ আজ রোদের কাছে শুয়েছে। রোদ এসব ইচ্ছে করেই করছে, এটা আলোরও বুঝতে বাকি নেই। এসবের কোনো মানে হয়? উনি কেন এমন করছে? আর করে হবেটা কী? এসব ভেবে আলো গুটিগুটি পায়ে রোদের রুমের দিকে গেল। ওর রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। আর দরজায় বড় বড় করে রঙ্গিন কালি দিয়ে লিখা, ‘ডো’ন্ট ডিস্টার্ব।’
আলো মাথা নিচু করে ওর রুমে এসে শুয়ে পড়ল। পরেরদিন খুব সকালে উঠে নিজে রান্না করে ফ্রেশ হতে গেল। একেবারে রেডি হয়ে এসে রোদদের সঙ্গে নাস্তা করবে ভেবে। কিন্তু এসে ওর রান্না করা খাবারগুলো একটাও টেবিলে দেখল না। তাই রাকাকে ডেকে আলো জিজ্ঞাসা করল। রাকা উত্তর দিলো,

”আমি কেবল ডাস্টবিনে ফেলে আসলাম।”
“ক কে কেন?”
“স্যার বলেছে, এসব খাবার উনি খাবেন না। তাই এখুনি যেন ফেলি আসি। আর বাসায় নাস্তা করার মুডও উনার নেই। তাই মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।”
আলো আর কিছু বলল না কলেজ ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। চোখ মুছতে মুছতে জেদ ধরেই একা হাঁটা ধরল। রবি এত ডাকলেও শুনল না। কিছুদূর যেতে আলোর সাফির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তারপর বাকিটা পথ সে গল্প করতে করতে সাফির সঙ্গেই গেল। অথচ সাফি ক্ষুণাক্ষরেও টের পেলো না, ওর পাশের মেয়েটা বুকের ভেতরের তোলপাড়। সে যে এখন চিৎকার করে কেঁদে বুক ভাসাতে চাচ্ছে। একথা কেউ বুঝল না। কান্নারা এসে গলায় জটলা পাঁকিয়ে দম আটকে দিচ্ছে। একথা না কেউ জানল আর না কেউ বুঝল। কেবল মেয়েটা একাই কষ্টটা উপলব্ধি করল।

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদের এমন লুকোচুরির আড়ালে কেটে আরো তিন’টে দিন। এই তিনদিনে আলো চাইলেও রোদের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। মেঘকে একদন্ড কাছে পায় নি। তোতাপাখির মতো করে মেঘ বউমনি বলে ছুটে আসে নি। রোদ সেই সুযোগই দিচ্ছে না। ওর ফোনও ধরে না। গতকাল রাতে রোদ নাকি রাকাকে কড়া ভাবে জানিয়েছে, ‘আলো ভুলেও যেন ওর অফিসের না যায়, তাহলে খুব খারাপ হবে।’

এই তিন’টে দিন ওর কেমন গেছে কেবল সেই জানে। অস্বস্তি আর অভিমান ওকে জাপটে ধরেছে। যার ভরসায় এসেছিল এখন সেই এমন করছে। কোন লজ্জায় এখানে থাকবে ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক এই কারণে আলো এখানে আসতে চাচ্ছিল না। সে জানত, ওর সঙ্গে ঠিক এমনটাই হবে। কয়েকদিন পর সবার কাছে সে বোঝা হয়ে যাবে। হলোও তাই! ওর ভয়টাই সত্যি হলো। রোদ ওকে সহ্য করতে পারছে না বিধায় এড়িয়ে চলছে। মেঘকেও কাছে আসতে দিচ্ছে না। ওর তৈরী খাবার খাচ্ছে না। রোদ কী জানে না এসবে আলো খুব কষ্ট পাচ্ছে, সে পারছেনা ওর অবহেলা সহ্য করতে। মেয়েটা ওদের ভরসা করেই আবার বাঁচতে চেয়েছে। কান্না, খাওয়াতে অনিহা, রাত জাগা, চিন্তামগ্ন, সব মিলিয়ে ওর শরীর’টা খুব খারাপ যাচ্ছে। শরীরে জ্বরও আছে। আলো আজ সকালে উঠে নি, খায় নি, কলেজেও যায় নি। নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। রাকা কয়েকবার ডেকেও তুলতে পারল নি। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

রোদ মেঘকে স্কুলে রেখে ফোন’টা সাইলেন্ট করে মিটিংয়ে ব্যস্ত। আজকে মিটিং’টা একটা রেস্টুরেন্টে হচ্ছে, ওর সাথে আকাশও আছে। রাকা রোদকে বেশ কয়েকবার কল করেও পেলো না। পরে রবি অফিসে ফোন করে জানল; রোদ এখন মিটিংয়ে ব্যস্ত। আজ আর অফিসে আসবে না। জুরুরি কাজে বাইরের যাবে, ফিরতে অনেক রাত হতেও পারে। রাকা আর কিছু অপেক্ষা করল। সেকেন্ডের কাটাও টিকটিক করে সময় গড়াতে লাগল। অর্ধদিন পেরিয়ে গেল তাও আলো বের হচ্ছে না। রাকা বসে না থেকে রবি আর সাগরকে ডেকে কাঠমিস্ত্রি অথবা চাবিওয়ালাকে ডেকে আনতে বলল। ওর দরজার লক ভাঙ্গতে হবে, এভাবে বসে থাকলে হবে না। অনেক খুঁজে রবি একজন কাঠমিস্ত্রিকে এনে রুমের লক ভাঙ্গতে সক্ষম হলো। রাকা দ্রুত রুমে ঢুকে দেখে আলো জ্বরে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে। ফর্সা মেয়েটা মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। রাকা রবিকে ডাক্তারকে খবর দিতে বলে ওয়াশরুমে ছুটল পানি আনতে।
পানির ছিঁটা এবং কিছুটা নিঃশ্বাস রোধ করে আলোর জ্ঞান ফিরল। জ্বরের উত্তাপে ওর শরীর ঘেষে বসা যাচ্ছে না।রাকা আলোকে উঠে বসিয়ে একটু পানি খাওয়াল। রুমাল ভিজিয়ে
কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলল,

“কষ্ট হচ্ছে?”
”না আপু।”
এতটুকু বলে আলো চোখ বন্ধ করে জীবনের হিসাব কষতে লাগল। ওর এই ছোট্ট জীবনে শূন্যতার সংখ্যা বেশি। এসবই হয়তো ওর প্রাপ্য! তবু আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
আররাকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এমন মুখচোরা মেয়ে সে খুব কম দেখেছে। এত জ্বরেও নাকি কষ্ট হচ্ছে না। কাউকে বলেও নি।
এমন কেন মেয়েটা? একটুপরে, রবি রোদের পরিচিত ডাক্তার এনে আলোকে দেখাল। ডাক্তার জ্বর মেপে ওষুধ দিয়ে বিদায় নিলেন। রাকা আলোকে নাস্তা করিয়ে নিজে ওষুধ খাওয়াল।

রাকা ওর শরীর মুছে জলপট্টি দিতে থাকল।আলো চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়েও গেল। ওকে ঘুমাতে দেখে রাকা হাফ ছেড়ে বাঁচল। আলোর জন্য খু্ব চিন্তা হচ্ছিল।ওদিকে আকাশ মেঘকে নিয়ে ওর বাসায় গেল। আজ মেঘ সারাদিন এখানেই থাকবে। জুরুরি কাজে রোদকে নাকি ঢাকার বাইরে যেতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। এজন্যই মেঘ এখানে! আকাশের ভাগ্নে রিফাতকে পেয়ে মেঘ খেলায় মজে গেছে। দু’জনে সমবয়সী আর মিশুকও বটে। মেঘ এর আগেও রিফাতের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। রিফাত ওর ভালো বন্ধু। খেলার ছলে মারলেও কিছু বলে না। বরং মুখ কাঁচুমাচু করে রিফাতই উল্টে সরি বলে। এজন্য রিফাতকে মেঘ পছন্দ করে। আজ অনেকদিন পর রিফাতকে পেয়ে মেঘের আর কিছু লাগবে না। খেলার সঙ্গী বলে কথা। আকাশ খেলার ছলে দু’জনকেই খাইয়ে দিলো। দু’জনে কার্পেটের উপরে বসে নানান রকমের খেলনা নিয়ে খেলছে। একটুপরে বিপত্তি’ও বাঁধল। মেঘ প্লেন নিবে আর রিফাত দিবে না। আর এই নিয়ে দু’জনে ফিসফিস করছে। আকাশের জন্য মেঘ কিছু বলতেও পারছে না। তাই মেঘ রিফাতকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল,

“প্লেন না দিলে আমি আমার পোষা ভূতকে দিয়ে তোকে মার খাওয়াব। এমন মার মারবে তুই মুতু করে দিবি।”
রিফাত চোখ বড় বড় তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,
“তোর ভূত আছে? কী কালারের ভূত রে? ওদের নাম কি?”
মেঘ মুখ বাঁকিয়ে একটু ভাব নিয়ে উত্তর দিলো,
“হাওঝাও ভূত, ঝুনঝুনি ভূত, ঘুরান্টি ভূত, টিউপিউ ভূত,ঘন্টি ভূত, এমন আরো অনেক আছে। তবে তোর মতো বেদ্দপকে সব বলা যাবে না।”

রিফাত ভয়ে ঢোক গিলে প্লেনটা মেঘকে দিয়ে দিলো। ভূতকে সে প্রচুর ভয় পায়। ওদের নামগুলোও সব ভয়ওয়ালা, বাবা!
তারপর দু’জনে আবার খেলায় মন দিলো। গুটিগুটি পায়ে সময় গড়িয়ে দুপুর হলো তারপর এলো বিকালের আগমন।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সন্ধ্যা নামতেও বিলম্ব করল না। আর
এখন বাজে রাত নয়’টা আটত্রিশ। লাইটের ঝলকানিতে রাত এখন দিনের মতো পরিষ্কার। আলো কেবল গোসল সেরে ওর বেলকনিতে বসল। ঘামে শরীর চ্যাট চ্যাট করছিল এখন বেশ লাগছে। জ্বরটাও নেই!আলোর দৃষ্টি এখন আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে। মিটিমিটি করে নক্ষত্র গুলো আকাশের বুকে নিদারুণভাবে জ্বলছে। দেখতে বেশ লাগছে। আচমকা হর্ণের শব্দে আলোর ভাবনার ছেদ ঘটল। সে কিছুটা চমকে উঠে সদর দরজার দিকে তাকাল। একটা সাদা গাড়ি গেট দিয়ে প্রবেশ করছে। এটা রোদের গাড়ি! অন্ধকার বেলকনিতে বসে আলো উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। তখন ঘুমন্ত মেঘকে বুকে নিয়ে রোদ গাড়ি থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করল। মেঘ কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে! ঘুমাবেই তো সারাদিন খেলে, বকবক করে, দুষ্টুমি করে, সে বড্ড ক্লান্ত। রোদ বাসায় ঢুকে রাকার সঙ্গে কথা বলে ওর রুমে চলে গেল। মেঘকে শুইয়ে সে ফ্রেশ হয়ে নিচে খেতে গেল। রিফাত, মেঘ, দু’জনেই নাকি একসাথে খেয়েছে। সারাদিন খেলায় মজে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছে।

রাকা আলোর রুমের দরজা নক করে জানাল, রোদ খেতে ডাকছে। আর দুই মিনিটের মধ্যেই যেতে হবে। রাকার কথা শুনে আলো নিঃশব্দে নিচে গিয়ে রোদের থেকে দুরত্ব নিয়ে বসল। ভেজা চুল দেখেও রোদ কিছু না বলে খেয়ে উঠে চলে গেল। ওকে যেতে দেখে আলো মাথা নিচু করে মলিন হাসল।
তারপর অনিচ্ছায় সত্ত্বেও দু’লোকমা খেয়ে ছাদে চলে গেল। এখন থাকা’টা খুব প্রয়োজন। আলো ছাদের দোলনায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। নিরবে অশ্রু ঝরে ওর হাতের কব্জি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওর বেহায়া চোখ দু’টো অকারণে অশ্রু ঝরাচ্ছে। এই কান্নার না আছে শব্দ আর না আছে আতনার্দ। তখন ওর পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠল,
“কাঁদছ? কিছু হয়েছে?”
খুব পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আলো পাশ ফিরে তাকাল।

রোদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে। এতকিছুর পর কী সুন্দর ভাবে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কিছু হয়েছে?’ এটা মানুষ নাকি রোবট? একরাশ অভিমান নিয়ে আলো অন্য দিকে তাকাল। আজ প্রায় চারদিন রোদ ওর সঙ্গে কথা বলছে। অথচ এই কয়েকদিন ওর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। উনি আসলেই অনুভূতিহীন মানুষ একটা। আলোকে চোখ মুছতে দেখে রোদ বলল,
“কোনো কিছু অভাব তো রাখি নি তাহলে কাঁদছ কেন? আর কেনই বা এত অভিমান, হুম?”
একথা শুনে আলো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তেজী গলায় উত্তর দিলো,
“জুতা মেরে গরু দান করতে এসেছেন? চেয়েছি বিলাসিতা?

সব দিয়ে কুকুরের মতো ব্যবহার করে জানতে এসেছেন, কী হয়েছে? আপনি অনেক উপকার করেছেন, দয়া করে আর
একটা উপকার করেন। আপনার পা ধরছি, আর একটাবার দয়া করুন আমাকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আলো রোদের পা ধরে বসে পড়ল। রোদ লাফ দিয়ে উঠে ওর পা ছাড়িয়ে নিলো।এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে নাকি? এসবের মানে কী? কী লাগবে সুন্দর করে বললেই তো হয়!রোদ ওকে কাঁদতে দেখে গম্ভীর ভাবে বলল,
“তোমার কান্না দেখতে এখানে আসি নি। যা বলার মুখে বলো নয়তো গেলাম।”
আলো চোখ মুছে উত্তর দিলো,” আমাকে রাঙামাটি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এখানে আমি আর একমুহূর্তও থাকতে চাই না।”
“কেন?”
“জানি না। আমি রাঙামাটি যেতে চাই, ব্যস! কারো দয়া নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। কারো অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতাও আমার নেই।

আলোর কথা শুনে রোদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ” অবহেলা? তা কে করল অবহেলা?”
রাগে ক্ষোভে আলোর চোখ ফেটে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল। সে কথা বলতে পারছে না। রোদের এমন ব্যবহার ওর কাছে অপমান মনে হচ্ছে। সব জেনে রোদের কথাগুলো ওর শরীরে সূচের মতো বিঁধছে। আলো সহ্য করতে না পেরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সে এই মুহূর্তেই এখান থেকে বিদায় হবে। দরকার হলে নিজের ইচ্ছায় গাড়িতে নিচে চাপা মরবে, তবুও আর এখান থাকবে না। অনেক হয়েছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। হঠাৎ হাতে টান পড়াতে আলো থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রোদ ওর হাত ধরে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব যেন সে কিছু করেই নি। আলো হাতটা ঝাড়া মেরে প্রচন্ড রেগে রোদের বুকে ধাক্কা মেরে বলল,
“সমস্যা কী আপনার? আর কত অপমান করবেন আমাকে?
গরীব বলে কী মানুষ মনে হয় না? নাকি ভাবেন যে গরীবদের অপমানবোধ নেই।”

রোদ মিটিমিটি হেসে ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলো। ওর হাসি দেখে আলোর রাগটা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। ওর কথা শুনে রোদ হাসছে। ওর কান্না দেখে রোদের খুব হাসি পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ওর, রোদের এই ব্যবহার কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আলো ওখানে বসে মাথা নিচু করে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের পানির ফোঁটাগুলো ছাদের মেঝেতে জমা হতে লাগল। কষ্টগুলো যত তীব্র হচ্ছে কান্নাগুলো জটলাবেঁধে অশ্রু হয়ে ঝরে যাচ্ছে। রোদ আলোর পাশে বসে চুপ করে ওর কান্না দেখতে লাগল। ওর কাছে ভালোই লাগছে। রোদ ওকে না নিষেধ করল, আর না থামানোর চেষ্টা করল। আলো উঠে চলে যেতে চাইলে এবারও পারল না। রোদ যেতে দিচ্ছে না! অর্থাৎ কাঁদবে খুব ভালো কথা। আমার সামনে বসে কাঁদো। আলো কামড় দিয়ে হাত ছাড়াতে চাইলে রোদ ‘উফ’ শব্দ করে অন্য হাতে ওকে আটকাচ্ছে। ওর ব্যবহারে আলো না পারছে সহ্য করতে, আর না পারছে স্থান ত্যাগ করতে। সে দাঁড়িয়ে শুধু ফুঁপাচ্ছে!