এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৮+২৯+৩০

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৮+২৯+৩০
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

“উফ! রাক্ষসীর মতো কামড়াচ্ছো কেন?”
কথাটা বলে রোদ আলোকে জোর করে দোলনায় বসিয়ে দিলো। আলো ওড়নাতে নাকের সর্দি মুছে এখনো ফুঁপাচ্ছে।
এই মানুষ ওকে খুব অত্যাচার করছে, খুব! আর রোদ দেখতে চাচ্ছিল, আলো রেগে গেলে কী করে? ওর রাগের পরিসীমা কতটুকু! প্রচন্ড লেগে সে কী করে? রোদ ভেবেছিল, আলো ওকে কঠিন কিছু কথা শুনাবে, অপমান করবে, দরকার হলে দু’চার থাপ্পড় দিবে। কিন্তু এই মেয়ে কিছু করল না, শুধু অশ্রু ঝরানো ছাড়া। হ্যাঁ আর একটা জিনিস করছে, ওড়নাতে নাক মুছে নাকটাকে লাল করে ফেলেছে। দেখতেও বেশ লাগছে!

এতটুকু সময়ে রোদ আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করল, রেগে গেলে আলো কথা বলতে পারে না। হয়তো রাগের চাপে ওর মস্তিষ্ক বাক্য গঠন করতে পারে না। এই সমস্যার মানুষ অহরহ আছে। আগের তুলনায় আলোর রাগ আর ফুঁপানো কমেছে। তখন ওর অবস্থা দেখে অবস্থা দেখে রোদ মুচকি হেসে গলা পরিষ্কার করে বলল,
”এত অভিমান কেন শুনি?”
“মান-অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, সব আপনাদের জন্যই? আমরা করতে পারব না? কেন হ্যাঁ, কেন? একবারও তো ভাবলেন না আমার কষ্ট হচ্ছে নাকি? আমি কেমন আছি? এসব করার মানে’টা আমি এখনো বুঝি নি। আগেই বলতেন আমাকে সহ্য হচ্ছে না।”
কথাগুলো বলে আলো হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। ওর ফর্সা মুখটা কান্নার ফলে লালবর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দু’টো ফুলে উঠেছে। নাকটার তো বেহাল দশা। গোলাপি ঠোঁট জোড়াও ফুঁপানোর সাথে সাথে কেঁপে উঠছে। বেহায়া বাতাসে সামনের চুলগুলোকে অবাধ্য করে তুলেছে। হালকা বেগুনি রংয়ের থ্রি পিছটা শরীরে ফুটে উঠেছে। রোদ আলোর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তোমার অভিযোগগুলো একটাও সত্যি নয়। তুমি ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো। আমাদের ভালোর জন্যই তোমাকে এড়িয়ে চলেছি! তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও। কোনো ভণিতা করবে না।”
আলো চোখ মুছে নাক টেনে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সরাসরি উত্তর দিবে। রোদ ওর দিকে তাকিয়েই অকপট বলে উঠল,
“সত্যি, সত্যিই মেঘের বউমনি হবে?”
আলো মাথা নিচু করে নিলো। এই উত্তর ওর জানা নেই। তবে
রোদ জানত, আলো উত্তর দিতে পারবে না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক এজন্যই, আমরা তোমাকে এড়িয়ে চলেছি। তুমি এখন আমাদের কাছে অতিথি পাখির মতো। হঠাৎ করে আমাদের জীবনে এসেছো, আবার চলেও যাবে। অথচ দিন-দিন মেঘ তোমার উপরে পুরোপুরি ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর আমার মতে, ঠিক হচ্ছে না। আম্মু মারা যাওয়ার পর মেঘকে আমি অনেক কষ্টে সামলেছি৷ ঠিক কতটা কষ্ট করেছি, বলে বোঝানো যাবে না। এখন মেঘ তোমার মাঝেই আম্মুকে খুঁজে বেড়ায়। আম্মুর মতো করেই তোমার থেকে আদর পেতে চায়। সে বাচ্চা এতকিছু বুঝে না। আবার দেখো, তোমাকেও আমি জোর করতে পারব না। করলে, তুমি সারাজীবন আঙ্গুল তুলে বলবে আমি তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছি। আশ্রয়ের নাম করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছি। তোমার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছি। আর একথাগুলো মানতে পারব না আমি। তুমি তোমার জায়গায় অটল। আর তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সন্মান করি। তাই সবদিক বিবেচনা করে এটা করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ তোমার চলে যাওয়াটা মেঘ সহ্য করতে পারবে না। তাই আমি এখন থেকে কৌশলেই তোমার মায়া কাটাতে চাচ্ছি। যাতে অবুজ বাচ্চাটা পুনরায় ধাক্কা না খায়। এছাড়াও
তুমি আমি দু’জনেই অবিবাহিত। আশেপাশের অনেকে চোখে তুমি পড়েছ। উনারা আমাদের সামনে কেউ না কিছু বললেও আড়ালে ঠিকই আঙ্গুল তুলবে। যেহেতু সমাজে বাস করি তাই চাইলেও কারো মুখ বন্ধ করতে পারব না। এটা মানতেই হবে! আর, আর আমিও মানুষ, আমার মন বলেও কিছু আছে। তোমার প্রতি আমি দূর্বল হবো না, এর গ্যারান্টি দিতে পারব না। কারণ একই বাসায় থাকছি, খাচ্ছি, সময় কাটাচ্ছি, এমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর মনের উপরে কারো’র জোর চলে না। হ্যাঁ, তাই বলে ভেবো না রোদ মেহবুব তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমার জন্য মেয়ের অাকাল পড়বে না। রুপে, গুনে, আমার জন্য পারফেক্ট কাউকে পেলেও, আমার ভাইয়ের জন্য মা রুপী বউমনি খুঁজে পাবো কী না এটা পরের কথা। মূখ্য কথা মেঘের তোমাকে চায়, আর তোমাকেই নাকি লাগবে! তাছাড়া বিয়ে, বউ নিয়ে আমি এখনো কিছু ভাবি নি।

সেটা অজানা থাক! শোনো, আমার ভণিতা পছন্দ না বলেই সরাসরি জানালাম। এখন কথাগুলো কী ভাবে নিবা তোমার ব্যাপার। পারলে, আমার কথাগুলো ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভেবে এর
সমাধান খুঁজে বের করো।”
রোদের কথাগুলো আলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনল। ওর ভুল ধারণাগুলোও একনিমিষে ফিকে হয়ে গেল। রোদ এতটা গভীরভাবে ভেবেছে, সে কল্পনাও করে নি। এমন চিন্তা-ধারা ওর মস্তিষ্কেই আসে নি। তাছাড়া রোদের বলা যুক্তিগুলো ওর অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। সে নিজের জায়গায় একদম স্বচ্ছ। ওর কথাগুলো দিয়েই, বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ, ডানে, বামে কী হবে বা হতে পারে। সে কথার মাধ্যেমেই তা বুঝিয়ে দিলো।
সেই সাথে রোদ যে নিদারুণ বুদ্ধিসম্পূর্ণ একটা মানুষ সেটাও বোঝা গেল। এই প্রথম রোদ ওর সাথে একবারেই এতগুলো কথা বলল, বোঝাল! তবে এতকিছুর পরে এখন ওর কী করা উচিত? পরবর্তী পদক্ষেপ নিতেই সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে উঠে দাঁড়িয়ে রোদকে বলল,
“আমার জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন?”
“জীবনকে আর একটাবার সুযোগ দিতাম।”

কথাটা বলে রোদ সামনে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেষে দাঁড়াল। রোদ জানে, আলোর সমস্যাটা ঠিক কোথায়। কেন সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। যদিও ওর বলা কথাগুলো আলো জানত না, অথচ ওর প্রতি রেগে অভিযোগের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে।
মনে ভুল ধারণা পোষণ করে কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। এজন্য রোদ সত্যিটা জানাল। এখন আলো যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই’ই হবে। ওর নেওয়া সিদ্ধান্তের উপরেই এখন সব নির্ভর করবে। দেখা যাক, আলোর সিদ্ধান্ত কী হয়! রোদ আলোর জবাবে জীবনকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলল, কারণ ওর ভাষ্যমতে, ভালোবাসা তিতা না মিঠা নিজে পরখ করে দেখা উচিত। কোনটার কেমন স্বাদ নিজে যাচাই করা উচিত।তিতা আর টক দু’টো জিনিস খেলেই মানুষ প্রথমে মুখ বিকৃত করে। তার মানে এই না দু’টো একেবারেই অখাদ্য। অখাদ্য হলে তিতা আর টক বলে কিছু হতো না। এই দু’টো জিনিসের প্রতি কারো চাহিদাও থাকত না। ঠিক তেমনি; ভালোবাসাও!
টক, ঝাল, তিতা,মিষ্টির সংমিশ্রণে নিদারুণ একটা অনুভূতি।
মৃদু বাতাস দু’জনের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আলোকে চিন্তায় মগ্ন দেখে রোদ বলল,
“রুমে যাও অনেক রাত হয়েছে।”
“আমি আপনার যোগ্য নই।”
“বুঝলাম।”

কথাটা বলে রোদ আলোকে নিচে যেতে ইশারা করল। কথায় কথা বাড়ে। ধারালো যে তীর ছুঁড়েছে এতেই কাজ হয়ে যাবে।
আলো উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে রোদ সামনে দৃষ্টি রেখে বলল,
“যতদিন না তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে, ততদিন এভাবেই সময় কাটবে। আশা করি এই নিয়ে অযথা যুক্তি আরোপ করবে না, যাও।”
আলো ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। অর্থাৎ
ওর সিদ্ধান্ত না জানানো অবধি রোদ মেঘকে আলোর কাছে আসতে দিবে না। এমনকি সে নিজেও এড়িয়ে চলবে। নিজের জন্য নয়, ভাইয়ের জন্য রোদকে স্বার্থপর হতে হচ্ছে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। গতসপ্তাহে মাঝরাতের দিকে মেঘ খারাপ স্বপ্ন দেখে রোদের কাছে ছুটে এসেছিল। কেঁদে চোখ মুখ লাল করে নেতিয়ে পড়েছিল। রোদ ওকে শান্ত করিয়ে স্বপ্নের কথা জানতে চেয়েছিল। স্বপ্ন’টা ছিল; ‘আলো ওকে রেখে কোথাও চলে যাচ্ছে। মেঘ কেঁদে থামতে বললেও আলো থামছে না। আম্মুর মতো করে বউমনিও তাকে রেখে চলে গেছে।’সেদিন রাতে মেঘ কেঁদে কেঁদে তার বউমনিকে চেয়েছে। বউমনিকে সারাজীবন বাসায় আঁটকে রাখতে শেকল বানাতে বলেছে। যাতে বউমনি ওকে রেখে কোথাও যেতে না পারে। তাই রোদ ভেবেচিন্তে আলোর জন্য শক্তপোক্ত অদৃশ্য এক শেকল তৈরী করতে চাচ্ছে। আর শেকলটার নাম, ‘কবুল।’

একমাত্র এটাই আলোকে আঁটকানোর উপযুক্ত শেকল। রোদ যথাশীঘ্রই ওকে আটকেও ফেলবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা!
এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে রোদ ওর রুমে চলে গেল। ঘড়িতে টিকটক শব্দ করে সময় অতিরিক্ত হয়ে ভোরের দেখা মিলল। চারদিকে আলো ফুটে নতুন এক প্রানবন্ত সকালের উপস্থিতি জানান দিলো। ব্যস্ত নগরীও ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ঘড়িতে বাজে আট’টা তিন। রোদ বাসায় নেই! মেঘ আর আলো দু’জনে মুখোমুখি খেতে বসেছে। মেঘ মিষ্টি হেসে কিছু বলার আগে আলো উঠে চলে গেল। একবার পিছু ফিরে তাকালোও না। মেঘ ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু ঝরাল। বউমনিও ওকে আর ভালোবাসে না। মাথা দু’হাতে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বিরবির করে
বলল,
“সবাই আমাকে রেখে চলে যায়। কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ না।”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মেঘ মুখ তুলে তাকাল। সাথে
সাথে ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে গেল। আলো বসে পরোটা ছিঁড়ে মেঘের মুখের সামনে ধরল। মেঘ ঠোঁট উল্টো শব্দ করে কেঁদে দিলো। সে ভেবেছিল, বউমনি ওর সাথে কথায় বলবে না। স্বপ্নের মতো অনেক দূরে চলে যাবে। আম্মুর মতো এত ডাকলেও আর আসবে না। মেঘ মুখে খাবার নিয়ে আলোকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপাতে লাগল। আলো মেঘের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আমাকে কষ্ট দিয়ে এখন কাঁদা হচ্ছে?”
“সরি, খুব সরি বউমনি।”

আলো এক পলক তাকিয়ে চুপ করে ওকে খাওয়াতে থাকল। মেঘও ভদ্র বাচ্চা হয়ে খেতে থাকল। বউমনি রেগে নেই দেখে মেঘ মিষ্টি হাসল। ওর সব মন খারাপ এক নিমিষেই দূরে হয়ে গেল। দাভাই তো বলেছিল, কয়েকদিন বউমনির সাথে’ হাইড এ্যান্ড সিক’ খেলবে। এটা অনেক মজা খেলা! আর বউমনি হেরে গেলে সারাজীবন এই বাসাতেই থেকে যাবে। কোথাও যাবে না! আর না যাওয়াটাই হবে বউমনির হেরে যাওয়ার শাস্তি। এজন্য সে বউমনির কাছে আসে নি। কষ্ট পেলেও দূরে দূরে থেকেছে। যাতে বউমনিকে সারাজীবন ওর কাছে রেখে দিতে পারে। তবে একয়েকদিনে বউমনি ঘুমিয়ে গেলে, দাভাই আর সে মাঝরাতে এসে বউমনিকে দেখতে যেতো। বউমনির কপালে আদর দিতো, আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পড়াতো। অফিসে থাকাকালীন রাকা আন্টি বউমনির অনেক ছবি তুলে পাঠাত, কখনো ভিডিও কলে দেখাত। ফোন করে সব খবর দিতো। দাভাইও তো অফিসে গিয়ে লেপটপে নিয়ে বউমনিকে দেখত। বউমনি এসব কিছুই জানে না। বউমনিকে সে খুব ভালোবাসে। এজন্য দাভাইয়ের কথায় রাজি হয়েছে। মেঘকে চুপ থাকতে দেখে আলো মুখটা মলিন করে বলল,
“তোমাদের জন্য আমি আর কোনোদিন রান্না করব না।”
“কেন?”
” আমার রান্না করা খাবার ফেলে দেওয়া হয়। তাহলে রান্না করে কী হবে?”
একথা শুনে মেঘ মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। ওর খুব হাসি পাচ্ছে। আজ সকালে দাভাই যাওয়ার সময় ওকে বলে গেছে, বউমনি সেদিনের কথা জিজ্ঞাসা করবেই, করবে।

বউমনি সত্যিই তাই’ই করল। তবে দাভাই এটাও বলেছে, সব সত্যি এখন বউমনিকে বলা যাবে না। তাহলে ওরা হেরে যাবে আর বউমনি ওদের রেখে চলে যাবে। আর মেঘ এটা কখনো হতে দিবে না। আসলে সেদিনের খাবারগুলো ফেলে দেওয়া হয় নি। সেগুলো নিয়ে গিয়ে দুই ভাই গাড়িতে বসে খেয়েছিল। আর রাকাকে ফেলে দেওয়ার কথা বলতে বলেছিল। যাতে ওদের পরিকল্পনা সফল হয়। তারপর আলো রেগে বেরিয়ে গেলে রোদ সাফিকে পাঠিয়েছিল। সাফি তো কলেজের গেট থেকে ফিরে গিয়ে আলোকে এনেছিল। শুধু রোদের কথায়! আর বাকি রইল, সেদিনের জ্বরে আলোর অবচেতন হওয়ার ঘটনা। রাকার মেসেজ দেখে রোদ তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাসায়
ছুটে এসেছিল। এসে দেখে আলো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোনো হেলদোল না থাকায় রোদ নিজে আলোর কপালে জলপট্টি দিয়েছিল। পরে শরীর ঘেমে জ্বর কমলে তারপর রোদ ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ছিল। জুরুরি নাহলে সে কখনোই আলোকে ফেলে যেতো না। তবে গিয়ে দশ মিনিট পর পর রাকাকে ফোন করে খোঁজ নিয়েছিল। যেন তার প্রাণটা এখানেই পড়ে আছে। এসব কথা বোকা মেয়েটার অজানায় থেকে যাবে৷ সে ক্ষুণাক্ষরে কিছু টের পায় নি, আর পাবেও না। তার ভাবতেও আসবে না, রোদ নিজেকে হাইড করে ওর জন্য নিরাপত্তার আস্তরণ বিছিয়েছে। যদিও রোদের যা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এত সহজে ধরাও সম্ভব না। এসব ভেবে মেঘ এখনো মিটিমিটি হাসছে, ওকে হাসতে দেখে আলো উঠে বাগানে চলে গেল। এই দু’টো তে ওর উপরে মানসিক অত্যাচার করছে। এভাবে চললে সে খুব শীঘ্রই পাগল হয়ে যাবে। মেঘ ততক্ষণে নাচতে নাচতে আলোর পিছু ছুটল। বউমনির রাগ সে ভাঙ্গিয়েই ছাড়বে!

প্রায় ছুটির দিনগুলোতে রোদের সব বন্ধুরা মিলে একসাথে জগিং সেরে, বাইরে নাস্তা করে। তারপর অর্ধবেলা মন খুলে আড্ডা দেয়। এই ব্যস্ত জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ক্লান্তিটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। সাথে মনে এনার্জি তৈরী হয়। এতদিন মেঘও সবার সঙ্গে যোগ হতো। আলো বাসায় একা তাই রোদ আনে নি। সে আজ বউমনির রাগ ভাঙ্গাক। রিমি আর রোহান উপস্থিত নেই। রিমি কেন জানি এদেরকে পছন্দ করে না। তাই বেশির ভাগ সময়’ই এড়িয়ে চলে। আর রোহান ঢাকার বাইরে থাকায় যোগ হতে পারে নি। সবাই মিলে এখন একটা বড় কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছের নিচে বসে আছে।
পাশেই সুখু মামার চায়ের দোকান, দারুণ চা বানান উনি।এক কথায় লা জবাব! রোদের বন্ধুদের মধ্যে শোভন ছেলেটা গত দুই সপ্তাহ হলো বিয়ে করেছে৷ ওকে নিয়ে সবাই মজা করছে।
রোদ বরাবরের মতোই চুপ করে শুনছে আর প্রয়োজনে অল্প কথায় উত্তর দিচ্ছে। তখন আকাশ শোভনের কাঁধে হাত রেখে শয়তানি হেসে বলল,
“মাম্মা, কী, কেমন চলছে দিনকাল?”
শোভন হাসতে হাসতে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল বিন্দাস। রুপম তখন বলে বসল,” ভাই ভাবির কোন জিনিসটা তোকে বেশি আকৃষ্ট করে?”

একথা শুনে শোভন অকপটে উত্তর দিলো,” মুনিয়ার বক্ষ বিভাজনের কালো তিলটা। উফ রে! ভাবলেই শরীর শিরশির করে।”
শোভনের একথা শুনে পরিবেশটা হঠাৎ নিরব হয়ে গেল।আর রুপম উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। শোভন উত্তর’টা এভাবে দিবে সে কল্পনাও করে নি। বন্ধুদের মধ্যে কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই ফ্রি হলেও ওরা মেয়েদের অসন্মান করে না। হোক সে কারো বোন অথবা বউ! রুপম ভেবেছিল, শোভনের উত্তর হবে, মুনিয়ার হাসি, চোখ, চুল অথবা মিষ্টি কন্ঠ। সচরাচর একজন স্বামী যে উত্তরগুলো দিয়ে থাকে। এর মধ্যে আকাশ শোভনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“বাহ্, দারুণ তো। আমাদেরকে দেখার বা ছোঁয়ার সুযোগ দে ভাই।”
আকাশের কথাটা বলতে দেরী হলেও শোভনের উঠে কলার ধরতে দেরী হয় নি। আকাশ শক্ত করে শোভনের কলার চেপে ধরল। ওদের দু’জনের কথায় আর কাজে বাকিরা হতবাক। রোদ দ্রুত উঠে আকাশের কলার ছাড়িয়ে শোভনকে বলল,
“সবাই জেনেই গেলো তাহলে সমস্যা কোথায়?”
“রোদ!!

“গলা আস্তে, গলাবাজি ঠিক তোকে মানাচ্ছে না। আস্তে বল, আমরা সবাই শুনছি! তার আগে আমার কথাগুলো শোন, তোর বউকে দেখলে এখন তোর বলা কথাটাই সবার মাথায় আসবে। কুৎসিত কিছু ভাবনার জাল বিছাবে সবার মস্তিষ্ক জুড়ে। কেন জানিস? কারণ তুই’ই তোর বউয়ের ব্যাক্তিগত কিছু আড়াল করতে পারিস না। তাকে বন্ধুদের সামনে সন্মান দিস না। সেখানে আমরা তো বাইরের কেউ, ভাই! সুযোগ পেলে মজা নিতে কিন্তু কেউ’ই কম করব না। আজ আমরা নয়জন জানলাম কাল আঠারোজন জানবে। ব্যাপারটা খুব শোভনীয় হবে তাই না? দেখিস, তখন আবার বলিস না বন্ধুরা বেইমান। কারণ চিনি তুই ছিটাচ্ছিস আর স্বাদ নিতে পিঁপড়া আসবেই। সেটা হোক তোর সামনে অথবা অগোচরে। হোক সে তোর পরম বন্ধু অথবা শত্রু।”
রোদের কথা শুনে শোভন অবাক হয়ে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“তোদের’ই তো বললাম ইয়ার। তোরা আমার কলিজার বন্ধু।
তোদের বলব না তো কাকে বলব?”

ওর কথা শুনে হামিদ নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে সুন্দরভাবে বলল,
“হুম, বলার কথাগুলো অবশ্যই বলবি। শুধু বেডরুমের একান্ত কথাগুলো বাদে। যাতে ভাবির প্রতি আমাদের মনে সন্মান বাদে অন্য কিছুর সৃষ্টি না হয়।।”
শোভনের কাছে আর বন্ধুদের বড্ড অচেনা লাগছে। অদ্ভুত ব্যবহার করছে সবাই। আকাশ শোভনের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রোদ ওকে আটকে শোভনের সামনে গিয়ে বলল,
“চোখের সামনে উন্মুক্ত কিছু দেখেও যখন চোখ আর মনকে সংযত রাখতে পারবি, তখন বুঝবি তুই সুপুরুষ! তবে বউয়ের ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। সাথে এটাই মরে রাখিস
,বউয়ের গোপন কথা সবাইকে জানানো বীরত্বের কাজ নয়।
এটা কাপুরুষতা! তোর থেকে আমরা এসব কখনোই আশা করি নি। ভাই তুই আমি আমরা সবাই একই জাতের। তুই’ই
একবার ভাব, তিলের কথা’টা যদি সারাদিন তোর মাথায় ঘুরে
। তাহলে রাতে স্বপ্নেরও তুই এটাই ভাববি। আর স্বপ্নে ভাবলে ফলাফল কী হবে বুঝতেই পারছিস! এখন তুই বলতে পারিস, আমার বউকে নিয়ে তোরা ভাববি কেন? এর উত্তর’টা হচ্ছে, আমাদের আশেপাশে শয়তান বলে কিছু আছে। এসব ভাবনা শয়তানই মনে এনে দেয়। আলাদা করে কাউকে ভাবতে হয় না। শয়তান খোঁচালে মানুষ নিষিদ্ধ কাজগুলোতে লিপ্ত হয়।
ফলস্বরূপ, তোর বউকে অসন্মান করে নিজেও ছোট হচ্ছিস। কথাটা শুনে আমাদেরও নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। সব বাদ,
আমরা আমরাই তো তাই না; এখন ভুলটা শুধরে নে।”

রোদের কথা শুনে শোভন এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে এভাবে ভেবে দেখে নি। সে আজ অনুধাবন করতে পারল, নিঃস্বার্থ বন্ধুদের মর্ম। এজন্য এরা সবাই ওর কলিজার বন্ধু।
শোভন রোদকে জড়িয়ে ধরল তবে কিছু বলল না। কী বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। রোদ শোভনকে ইশারায় আকাশকে দেখিয়ে দিলো। আকাশ অদূরেই উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। শোভন আকাশকে জড়িয়ে ধরে ভেজা গলায় সরি বলল। ওর ভুল’টা বুঝে অনুতপ্ত হলো! আকাশও আর রাগ করে থাকতে পারল না, বন্ধু তো! শোভনের ছলছল চোখ দেখে সবাই ওকে জড়িয়ে ধরল। হৈ-হুল্লোড়ে সবার মুখে হাসি ফুটল। ব্যস, ভুল সংশোধন হলো, সেই সাথে ওদের বন্ধুত্বটাও অটল থাকল।
মূলত এই ভুলগুলোতে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে, বন্ধত্ব নষ্ট হচ্ছে, সুইসাইডও করছে। রুমডেট করে বন্ধু/বান্ধবীকে বিশ্বাস করে জানাচ্ছে। সেই বন্ধু গোপনে ভিডিও করে সোশ্যাল সাইডে ছেড়ে দিচ্ছে। কলিজার বান্ধবীগুলোও নিজ দায়িত্বে একথা ছড়াচ্ছে। হাব-ভাব এমন যেন কিছুই বুঝে না। এমনও হচ্ছে; সেই বন্ধু গফ/বউকে বিশেষ ভাবে পাওয়ারও হুমকি দিচ্ছে। নয়তো ভিডিও ভাইরাল!

অন্যদিকে,স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে বলতে পরকিয়াতে আসক্ত। কে স্বামী, আর কে বাচ্চা? সব ফেলে বউ স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে গায়েব। এখানে
না কিছু বলার আছে; আর না করার। মূলত শোভনের মতো ভুলগুলোই এসব কর্মের প্রথম ধাপ। বন্ধুত্বে অন্ধবিশ্বাস আর কী! যুগ হিসেবে এখন অহরহ এসবই ঘটছে, লাজ-লজ্জা বিবেককে বিসর্জন দিয়ে মানুষ এসবে আসক্তও হচ্ছে।
এখন বাজে দুপুর বারোটা সাতান্ন। আলো আর মেঘ গোসল সেরে ড্রয়িংরুমে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল। রোদের গাড়ির হর্ণ শুনে মেঘ দৌড়ে ওর রুমে গেল। যাতে দাভাই বুঝতে না পারে সে বউমনির সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কারণ খেলায় এই নিয়ম নেই। আলো মেঘকে এভাবে যেতে দেখে হতবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে আছে। রোদ বাসায় ডুকে আলোর দিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রোদকে দেখে আলো চোখ সরিয়ে নিলো। এখানে আর বসা যাবে না।
স্বয়ং জল্লাদ এসে উপস্থিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভাষণ শুরু করবে। এসব ভেবে আলো নিঃশব্দে উঠে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে চলে গেল। আর রোদ ভেজা চুলের লাল থ্রি পিছ পরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। আলো যে ওকে দেখে পালিয়ে গেল, এটা রোদেরও বুঝতে বাকি নেই। পালিয়ে আর যাবে কই, বেলাশেষে ওর নীড়েই ফিরতে হবে।
প্রায় পনেরো দিন পর,

রোদ আর আলো বন্ধ রুমে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাত তখন একটা চৌত্রিশ। চারদিকে নিস্তব্ধতা! আলো মাথা নিচু করে কাঁদছে আর রোদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এখনই গিলে খেয়ে ফেলবে। নয়তো চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দিবে। মেয়েটা ওর কোনো কথা শুনে না। যখন যা বলে বিপরীত কাজটাই সে করে বসে থাকে। কেন করবে? কেন তার কথা শুনবে না? শুনতে হবে! ওর সব কথা শুনতে আলো বাধ্য। আজ রোদও এই মেয়ের জেদ দেখবে। কতক্ষণ জেদ ধরে থাকে সে তাই’ই দেখবে। আলো মাথা নিচু করে তখনো ফুঁপাচ্ছে। রোদকে ওর প্রচন্ড ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, কোনো অশরীরী রোদের উপর ভর করেছে। সেই অশরীরী’ই ওকে ধমকাচ্ছে, জোর করছে!
রোদ তখন পুনরায় গম্ভীর কন্ঠ বলে উঠল,
“কিস মি নাও এ্যান্ড দ্যাট অন দ্যা লিপস্!”

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৩০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

“কিস মি নাও এ্যান্ড দ্যাট অন দ্যা লিপস্!”-
রোদের কথা শুনে আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। একোন পাগলের পাল্লায় পড়ল সে। প্রচন্ড জ্বরে রোদের শরীর টলছে, মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে। অথচ জেদ ধরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। টানা তিন ঘন্টা ভিজে মেঘ আর রোদ বাগানে ফুটবল খেলেছে। এত ডেকেও আলোর কথা কেউ শুনে নি। বিকালে এত ভেজার কারণে মেঘের শরীর গরম হওয়ার আগে’ই ওষুধ খাইয়েছে। কিন্তু বড়’টা কারো কথা শুনলে তো! উনি নিজের মর্জি মতো চলো। কারো কথায় পত্তা দেন না উনি।এই বাসায় তাকে কিছু বলার মানুষও নেই! বাকিরা আগ বাড়িয়ে কিছু বলে বকা খেতে ইচ্ছুক নয়! আর বললেও, জল্লাদ’টা কারো কথা শুনবে না। এখন জ্বর বাঁধিয়ে নতুন বায়না ধরেছে। তার নাকি ইয়ে লাগবে, আদর কী! এটা কী হাতের মোয়া, চাইলেই পাওয়া যাবে। যত্তসব ঝামেলা! আলো রেগে চুপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই নিয়ে তেরো বার সে এই আবদার করল।
তেরো দিনে নয়, এই মুহূর্তেই তেরো বার। রোদ তখন মেঝেতে ধপ করে বসে চুল খামছে ধরে বিরবির করে বলল,
“আমি ঘুমাতে চাই! একটু, একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই। ওই মেয়েটা আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। চোখ বন্ধ করলে ওই দৃশ্য চোখে ভাসে। ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না আমি। প্লিজ! প্লিজ আলো! আমার কথা শোনো, প্লিজ!”
রোদের বলা পুরো কথা শুনে আলো ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রোদ
কী বলল? মেয়ে, কোন মেয়ে? রোদ কার কথা বলছে? কেন ঘুমাতে পারে না রোদ? তাহলে কী পূর্বে রোদের কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো? এসব ভাবনাগুলো আলোর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ওর মাথা কাজ করছে না। রোদ কী বলছে? সে কী আফসোস করছে? আলো এসব আর ভাবতে পারছে না।

সে চুপ করে দাঁড়িয়ে বিষ্ময় নিয়ে শুধু রোদের দিকে তাকিয়ে রইল। যদিও আলোর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আর অর্ধেক কথায় বিচার করা বোকামি। এতে সমাধান হয় না বরং আরো জট বাঁধে। কিন্তু সচরাচর অনেকে এটাই করে থাকে। এখন দেখা যাক, আলো কী করে!
আর রোদ ওই জঙ্গি মেয়েদের কথা বলছে। বিশেষ করে ওর সামনে মেঘের বলি আর ওই মেয়েগুলোর ব্যবহার সে ভুলতে পারে নি। ওর মন আর মস্তিষ্কে ঘটনা’টা গেঁথে আছে। প্রতিটা রাতে স্বপ্নে ওদের দেখে সে এখনো আঁতকে উঠে। শুধু মনে হয় ; ওরা মেঘকে কেড়ে নিচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে! স্বপ্নে ঘটলেও ওর কাছে সব’টা বাস্তবিক লাগে। সে ভুলে যায়, আল্লাহর রহমতে ওরা বেঁচে ফিরেছে। ওই ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা রোদের মনে বিশ্রীভাবে দাগ কেটে গেছে। আর ওই মেয়েটার ঠোঁটের কালো জিনিসটার গন্ধ মনে হয় সে এখনো পায়। তখন ওর গা গুলিয়ে বমি হয়ে যায়। কতদিন রাতে উঠে সে বমি করেছে তার হিসাব নেই। এখন রোদ সম্পূর্ণভাবে মাছ-মাংস এড়িয়ে চলে। মাংস খেতে গেলে পঁচা মাংসের কথা মনে পড়ে। ছিঃ! কী বিশ্রী সেই গন্ধ! যে ছেলেটা মাছ-মাংস ছাড়া একবেলাও খেতে পারত না। সে এখন সবজি দিয়ে খেয়ে উঠে পড়ে। ওর
আম্মু থাকলে হয়তো খেয়াল করত। আম্মুও নেই, ওর খেয়াল রাখার মানুষও নেই। এজন্য রোদ আর আফসোস করে না। সে ভাগ্য মেনে নিয়েছে।

আজ জ্বরের ঘোরে রোদের একটা কথা মনে হচ্ছে, ওই জঙ্গি মেয়ের ছোঁয়া ওর শরীর থেকে আলো মুছে দিতে পারবে। ওই মেয়েটা জোরপূর্বক ঠোঁট দিয়ে রোদের ঠোঁটে স্পর্শ করেছিল।
এজন্যই রোদ আলোকে ডেকে ‘কিস মি নাও এ্যান্ড দ্যাট অন দ্যা লিপস্’ বলল। কিন্তু আলো তো এসবের কিছুই জানে না৷
তাই সে ভুলভাল ভাবনা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রোদ
আলোকে নিরুত্তর থেকে আর জোর করল না। নিশ্চুপ হয়ে মেঝেতে বসে চুল খামছে ধরে মাথা নিচু করে নিলো। আলো হঠাৎ খেলায় করল; রোদের অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা করে মেঝেতে পড়ছে। রোদ নিঃশব্দে কাঁদছে! আলো হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। রোদ কেন জানি নিজেকে সামলাতে পারছে না। ওর শরীরের প্রতি ঘৃণা আসছে। আর কতদিন এই নোংরা শরীর বয়ে বেড়াবে? এসব ভেবে রাগে জেদে রোদ গ্লাস ভেঙ্গে কাঁচ তুলে নিলো। আজ ওই নোংরা মুছবে নয়তো নিজেকে শেষ করবে। ওই স্পর্শ আর মানতে পারছে না। মরে যেতে ইচ্ছে করে ওর। সে ছেলে হয়েও নোংরা স্পর্শ মানতে পারে না।কেন পারে না? সেও জানে না, তবে পারে না!
রোদের হাতে কাঁচ দেখে আলো দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে গেল।

ওড়নাটা টান দিয়ে রোদের চোখ বেঁধে পায়ের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে গেল। রোদ ততক্ষণে শান্ত হয়ে গেছে। যেন সে কিচ্ছু
বুঝে না। আলো আর কিছু ভাবারও নেই, বলার নেই! কারণ এই মানুষটা এখন ওর নিজের। যাকে দশদিন আগে কবুল বলে বৈধভাবে পেয়েছে সে, তাও স্ব-ইচ্ছায়। তাহলে আবদার ‘টা মানতে আর বাঁধা কীসের! রোদ অন্যায় কিছু তো চাচ্ছে না। আবদার, দাবি, চাওয়া, যায় হোক সে বৈধ ভাবে’ই চাচ্ছে।
এসব অবান্তর ভাবনার ছেদ কাটিয়ে আলো সন্তর্পণে রোদের হাত থেকে কাঁচ’টা নিয়ে ফেলে দিলো। কাঁচ’টা পড়ে নিশ্চুপ রুমে একটা শব্দের সৃষ্টি হলো। আলো বার দু’য়ের ঢোক গিলে উষ্ণ ছোঁয়ায় রোদের অধর স্পর্শ করল। জ্বরের প্রচন্ড তাপে রোদের ঠোঁট’টাকে আলোর জ্বলন্ত কয়লা মনে হলো। কয়েক মিনিট রাখলে ওর ঠোঁটও ঝলসে যেতে পারে, এতটা উত্তাপ!
কয়েক সেকেন্ডে আলো রোদের অধরসহ কপাল ছুঁইয়ে সরে গেল। ওর নিজের শরীরও প্রচন্ড কাঁপছে। প্রথম স্পর্শ তাও নিজে থেকে এগিয়ে এসে! অঢেল লজ্জা আর অস্বস্তিবোধের সংমিশ্রণ এই অনুভুতিটা। রোদ তখনো চোখ বাঁধা অবস্থায় থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বরফে জমে গেছে। রোদ শরীর থেকে নোংরা স্পর্শ চিরতরে মুছে ফেলতে চাচ্ছিল। এবং এক মেয়ের স্পর্শ মুছতে অন্য মেয়ের সান্নিধ্য আবদার করেছিল।

কিন্তু এই মেয়ের স্পর্শে ওর শরীরে যেন বৈদ্যুতিক শক খেলে গেল। মাথা’টা ঝিমঝিম করছে, ঠোঁট’টাও অবশ লাগছে। কি আশ্চর্য! হঠাৎ শরীরে এমন অনুভূত হচ্ছে কেন? কিছুক্ষণ আগেও তো ঠিক ছিলো। তাহলে? নাকি মেয়েদের সংস্পর্শ’ই স্বাভাবিক হয় না? আলো ওড়না’টা খুলে দিলে সে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। না কোনো কথা বলল, না চোখ তুলে তাকাল! কিচ্ছু ভাবতে পারছে না, ওর প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। তবে আজ রোদ ঘুমাবে, শান্তির ঘুম ঘুমাবে। রোদের এমন কাজে আলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে পানি এনে পাশে বসল। রোদের শরীরে ১০৩’ জ্বর! আলো উঠে রোদকে জোরপূর্বক ওষুধ খাইয়ে জলপট্টি দিতে থাকল। রোদ চোখ খুলে মুচকি হেসে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো। জ্বর বাঁধিয়ে বাঘ আজকে মিঞাও হয়ে গেছে। নাহলে এতক্ষণ আলোকে ধমকে কাবু করিয়ে রাখত। এসব ভেবে আলো টানাটানি করে রোদের টি-শার্ট’টা খুলে শরীর মুছে দিলো। তখন রোদ বিরবির করে বলল,
“টি-শার্ট খুললে ভালো কথা টাওজারে হাত দিও না। আমার লজ্জা লাগছে।”
রোদের কথা শুনে আলো দাঁত মুখে খিঁচে নিজেকে সামলে নিলো। রাগে ওর পুরো শরীর কিড়মিড় করছে। বন-মানুষটা
এই অবস্থায়তেও ওকে ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে। আলোকে চুপ থাকতে দেখে রোদ আবার বলল,
” মনের বিরুদ্ধে এসব করার দরকার নাই, রুমে যাও।”
“এখনো তেজ কমছে না তাই না? খাটাশ লোক, আমাকে না খোঁচালে হয় না?”
“উহুম, মোটেও হয় না।”

একথা’টা বলে রোদ চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলো। পরেরদিন সকালটা শুরু হলো; দুষ্টু রোদ আর মিষ্টি আলোর ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মাধ্যমে। জানালার থাই’টা অতিক্রম করে প্রস্থবরাবর
রোদ রুমে প্রবেশ করেছে। বোঝায় যাচ্ছে, আজকে নিদারুণ রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। পুরো রুমটাতে কাঁচা সোনার মতো ভুরিভুরি আলোর উপস্থিততে আঁধার যেন তার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। খানিকক্ষণ পরে, ছোট্ট একটা চড়ুই পাখি ঠোঁট দিয়ে থাই গ্লাসে দু’টো টোকা দিয়ে গেল। হয়তো সে বলতে দিতে এসেছিল, ‘ওঠো আর কত ঘুমাবে? দেখো কী সুন্দর সকাল।’ চড়ুইয়ের ঠকঠক শব্দে রোদ চোখ খুলে তাকাল। আচমকা ওর দৃষ্টি আটকালো; লালবর্ণ একজোড়া চোখ আর মলিন একটা মুখের দিকে। আলোকে দেখে রোদ তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সকালবেলায় আলোর কী হয়েছে? কাঁদছে কেন? পড়ে ব্যথা পেয়েছে নাকি?এসব ভেবে রোদের আলোকে ভাবে ভাবে পরখ করে নিলো। কিন্তু তেমন কিছু পেলো না। আলো তখনো শান্ত দৃষ্টি নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ নাকি মনের কথা বলে। তেমনি আলোর
চোখ দু’টোতে কিছু জানার আঁকুতি দেখা যাচ্ছে। রোদ ওর
বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলোর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“সকাল বেলায় মুখের এই অবস্থা কেন? কোনো সমস্যা?”
আলো জবাবে উত্তর না দিয়ে ছলছল চোখে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ অনেক সমস্যা। রোদ ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বলল,
“আমি জানি আমাদের মধ্যে কিছু হয় নি। খবরদার আমার দিকে ভুলভাল কাজের আঙুল তুলবে না। নয়তো মরে তক্তা বানিয়ে দিবো।”
রোদের কথা শুনে আলোর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এসব সে কখন বলল? এই ছেলে এত বেশি বুঝে কেন? কালকে রাতে তেমন কিছু হলেও সে এতটা অবাক হতো। যতটা সে অবাক হয়েছে রোদের কথা শুনে। আলোর মনে কী চলছে, বোঝার চেষ্টা করে রোদ ব্যর্থ হলো। তবে কিছু একটা হয়েছে নিশ্চিত।

আজকে শুক্রবার বিধায় রোদের তাড়াহুড়ো নেই। এজন্য সে পুরো কাহিনী জেনেই ছাড়বে। একটা মানুষ অযথা তো আর কাঁদে না। কিছু তো হয়েছে’ই, সেটা কী? রোদ স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপারটা জানতে চাইল। আলো ‘দাদীমা’ বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”
“না, স সত্যটা জেনে গেছি।”
“কোন সত্য?”
“যেটা আমার থেকে আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন।”
রোদের আর বুঝতে বাকি নেই আলো কীসের কথা বলছে। এটা হওয়ারই ছিল। আজ অথবা কাল আলোকে সত্যিটা সে জানাত। এসব জানা ওর দরকার। আর কিছু কিছু জিনিস লুকানো যায় না; যেমন সত্য কথা। না চাইলেও সেটা একদিন সঠিক সময়ে ধরা দেয়। দুইদিন আগে আর পরে। তাই আলো জেনে গেছে দেখেও রোদ একদম স্বাভাবিক থাকল। হাবভাব এমন যেন এটা সামান্য ব্যাপার। ওদের কারো মুখে কথা নেই।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ২৫+২৬+২৭

ব্যাপারটা আলোকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে রোদ আগে মুখ খুলল,
“জানি কষ্ট হচ্ছে তোমার। তবুও সত্যিটা তোমাকে মেনে নিতে হবে। শোনো, প্রতিটা মানুষের মধ্যে দু’টো সত্তা থাকে, ভালো আর খারাপ। এটা সবার মধ্যেই বিদ্যামান। তবে একটা মানুষ দু’টো সত্তাকে একসাথে দৃশ্যমান করতে পারে না। সময় বুঝে তার সত্তা গুলোর রুপ দৃশ্যমান করে। বিশেষ করে স্বার্থে টান লাগলে খারাপ রুপ’টা আগে বেরিয়ে আসে। তখন চেনা যায় ওই মানুষটাকে। তোমার দাদীমার সঙ্গেও তাই ঘটেছে।এজন্য উনার রাস্তা থেকে মুনকে সরিয়ে ফেলেছে। যাতে মুন সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। এটা নির্মম সত্য। আর মকবুল সে হচ্ছে নিঃস্বার্থ একজন প্রেমিক। অথচ দেখো তার পরিণতি কতটা হৃদয়বিদারক।”

সারারাত কান্নার ফলে আলো আর কাঁদছে পারছে না। তবুও নিরবে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে। বেহায়া চোখ দু’টোও আজ বড্ড অবাধ্য। হৃদয়টা জ্বলছে বিধায় আপনাআপনি অশ্রু ঝরছে। আসলেই কী তাই? কী জানি, হবে হয়তো! আলো চুপ করে
রোদের পাশে শুয়ে পড়ল। মাথা ঘুরছে। মস্তিষ্কটাও অকেজো লাগছে। নিজের জীবনটাকে ওর ভাসমান কচুরিপানার মতো লাগছে। যার না আছে পিছুটান আর না স্থায়ী ঠিকানা। নদীর বেপরোয়া স্রোতের টানে যতক্ষণ ভেসে যাওয়া যায়। বাঁচতে হলে ভাসতে হবে। ঠিক, কষ্টের সাগরে ভাসা মানব জাতির মতো। রোদ আলোর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে অশ্রু মুছিয়ে দিলো।আলো চুপ করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।
এমনটা তো না হলেও পারত; তাহলে কেন হলো? জীবনের সমীকরণ’টা দিন দিন যেন জটিল হতেই আছে। কবে থামবে এসব? তখন রোদ আলোর কপালে আদর দিয়ে বলল,
“আছি তো আমি।”
একথা শুনে আলো রোদের হাতটা আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।

এলোকেশী কন্যা পর্ব ৩১+৩২+৩৩