এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১২

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১২
ইফা আমহৃদ

ডান চোখ নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাল। মোছার স্পৃহা নেই। আঙুলের ভাঁজে আঙুল রাখেন অভ্র স্যার। ঈষৎ কেঁপে উঠলাম। গাড়ির গতি কমিয়ে বললেন, “স্মৃতি? তা জড়িয়ে থাকতে পারে। তবে সবসময় স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে নেই।”

“এটা আমার মায়ের থ্রী পিস। আমরা তো গ্ৰামের মানুষ, গ্ৰামের বউয়েরা থ্রী পিস পরে না। মাও পরেনি। যত্নে তুলে রেখেছিল। গ্ৰাম থেকে আসার সময় মায়ের স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম। আমার তো মা নেই যে, আবার স্মৃতি গড়তে পারব।” বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অভ্র স্যারের ধরে রাখা হাতটাতে অজান্তেই ললাট ঠেকালাম। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছি। আচম্কা অনুভব করলাম আমি তার অতি নিকটে। মাথা তুলতেই নজরবন্দি হলো তার মুখশ্রী। ইতস্তত নিয়ে সরে এলাম। জড়তা নিয়ে অভ্র স্যার বললেন, “এই মুকুট আপনার প্রাপ্য। আপনি মাথায় পড়তে পারেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি কখনো কারো জিনিস নেই না, বুঝেছেন?”
“চু/রি করার সময় ঠিকই নেই, তাই না?” ব্যঙ্গ করে বলেন। অভ্র স্যারের এরূপ কথায় আঁতকে উঠলাম বেজায়। আমতা আমতা করে বললাম, “কী? কী বলতে চাইছেন?”

“সেদিন অফিসে তুমি আমার ওয়ালেট চু/রি করেছো, সেটাই বলতে চাইছি। অতঃপর তার ফিফটি পার্সেন্ট অংশীদার দিয়েছ অগ্নিকে। সেটা আমি বলতে চাইছি।” বলেই অভ্র স্যার গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হলেন। কিছুক্ষণ পর পুনরায় বললেন, “আপনি চাইলে আবার শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসে জয়েন করতে পারেন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।”
মুখ ফুটে কিছু বলার পূর্বেই অভ্র স্যারের ফোন বেজে উঠল। অগ্নি নামটা জ্বলজ্বল করছে। রিসিভ করে বলেন, “আমরা রাস্তায়, কিছুক্ষণের ভেতরে চলে আসব। ঊষা উদিতা ঘুমিয়েছে?”

ওপাশের কিছু শুনতে পারলাম না। অভ্র স্যার রেগে কল বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। অতঃপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি আপনার জন্য ফ্লাট ঠিক করে রেখেছি, কালকে আপনি সিফ্ট হতে পারবেন। অগ্নির সাথে যোগাযোগ রাখবেন না।”
“কেন?” একরোখা জবাব!

“আপনার কোনো ক্ষতি হলে তার দায় আমি নিবো না তাই। আমার সাথে প্রিয়ার বিয়ে হওয়ার পেছনে দায়ী অগ্নি। তার কু/কর্মের ফল হিসেবে নিজের ভালোবাসা অস্বীকার করে আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ঘরে দুটো রাজকন্যা আছে..। বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘের গর্জনে কানে হাত দিলাম। বজ্রপাতে আমার খুব ভয় হয়। আকুতি মাখা কণ্ঠে বললাম, “প্লীজ তাড়াতাড়ি চলুন।”

ঘুম থেকে উঠতেই পায়ে ব্যথা অনুভব করলাম। গতকাল হাই হিল পরে হাঁটার কারণে ছিলে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যথা করছে। কাল রাতে তেমন অনুভব না হলেও এখন অনুভূত হচ্ছে। কিট্টি ঘুমিছে আছে বিছানায়। কাঁথাটা ওর শরীরে প্যাঁচিয়ে দিয়ে উঠে গেলাম। আজ থেকে অফিসে যাবো। তৈরি হয়ে ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম অভ্র স্যার বের হয়েছেন অফিসের উদ্দেশ্যে। গম্ভীর ভঙ্গিমা। গতরাতে অগ্নির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে তাঁরা। কারণ অজানা তবে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনেছি। ভাবনার ছেদ ঘটল অভ্র স্যারের চুটকির শব্দে। বললেন, “এত তাড়াতাড়ি উঠেছেন?”

“অফিসে যাবো, (ইতস্তত নিয়ে) আপনিই তো জয়েন করতে বললেন।”
“ওহ্। খেয়েদেয়ে চলে আসবেন।” বিরক্তির সাথে। অপ্রস্তুত গলায় বললাম, “একটু অপেক্ষা করবেন। এখন থেকে আমি আপনার অফিস চিনি না, আমাকে নিয়ে যাবেন সাথে? আমি শুধু ব্যাগটা নিয়ে আসছি।”

হিংস্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। থমকে গেলাম তার দৃষ্টি দেখে। একপা একপা করে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আমি পিছিয়ে গেলাম। সোফার সাথে ধাক্কা লেগে বসে পড়লাম। তবুও নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসছেন তিনি। সোফার সাথে সেঁটে গেলাম। সোফার উপর থেকে গাড়ির চাবিটা নেওয়ার বাহানায় দুজনের দুরত্ব গুছিয়ে বাজখাঁই গলায় বলেন, “চেনেন না, চিনে নিবেন। এখন থেকে আপনাকে একাই যেতে আসতে হবে। আপনি আপনার ড্রাইভার নয় যে, আপনার জন্য অপেক্ষা করব। (বিরতি দিয়ে) আসার সময় ফ্লাটের ভেতরে আপনার যা আছে, নিয়ে আসবেন। আজকেই আপনাকে নতুন ফ্লাটে শিফ্ট করে দিবো।”

চাবি আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে অভ্র স্যার বেরিয়ে গেলেন। আজ তার বলা কথাগুলো হৃদয়ে আঘাত হেনেছে। আমারই ভুল হয়েছে তার বাড়িতে থাকাটা। চোখ ভরে এলো জলে। মুঠোফোনটা বেজে চলেছে ঘরে। ছুটে গেলাম। মামা ফোন করেছে। রিসিভ করতেই মামা বললেন, “মোম আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি মা? এখনো ফসল ঘরে তুলিনি হাত খালি। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আবার সামনে ফুলের পরীক্ষা। ফরম পূরণ করতেও টাকা লাগবে।”

“আচ্ছা, একটু পর পাঠিয়ে দিচ্ছি।” কল বিচ্ছিন্ন করে ব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করলাম, আনুমানিক আঠারো হাজার আছে। এক হাজার নিজের জন্য রেখে বাকিটাকা মামাকে পাঠাবো। ফ্রিজ থেকে কয়েকটা গাজর ব্যাগে নিলাম। জামা কাপড় সহ আমার ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘুমন্ত কিট্টিকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম অফিসের উদ্দেশ্যে।

নিজের মনকে সায় দিয়ে খাতায় রুপ দিচ্ছি মনের সেই ডিজাইনের। শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসের জন্য এটাই আমার প্রথম কাজ। কিট্টি টেবিলের উপর বসে গাজর খাচ্ছে। এমন সময়ে কয়েকজন প্রেস মিডিয়ার লোক ঢুকল হাউসে। ফ্যাশন প্রতিযোগিতা জেতার জন্য অভ্র স্যারের সাথে কনফারেন্স করতে চাইছে। হোরগোল শুনে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন অভ্র স্যার। একজন অনুরোধ করে বলে, “স্যার, আমরা আপনাকে মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি যদি উত্তর দিতেন।”

“আমার সময় নেই, আমি আপনাদের মাত্র তিনটা প্রশ্নের উত্তর দেবো। ভেবে চিন্তে প্রশ্ন করবেন।”
“ওকে স্যার। আমাদের প্রথম প্রশ্ন, টিনা ম্যাম ছাড়া ‘শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসের’ মডেল হিসেবে আমরা কাউকে কল্পনাই করতে পারি না। সেখানে এমন একজনকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করলেন কীভাবে?” অভ্র স্যার মৃদু হাসলেন। চিবুকে হাত দিয়ে বলেন, “টিনা পেশাগত ভাবে আগে কোথাও মডেলিং করে নি। ‘শাহরিয়ার হাউসে’ ফাস্ট। সুযোগ দিয়েছিলাম আর প্রতিযোগিতা মডেলের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে পোশাকের গুণাবলির উপর।”

“আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল, জেতার পরে কেমন লেগেছিল।” সাংবাদিকের প্রশ্নে অভ্র স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকিয়ে ছিলাম বলে চোখাচোখি হলো। উত্তরে বলেন, “এত প্রতিযোগিতা জিতেছি, কিন্তু গতকাল জেতার পরের অনুভূতিটা হাজারগুন বেশি ছিল, আন-অ্যাক্সপেক্টে ছিল। ধন্যবাদ আমার ফ্যাশন ডিজাইনার মোমবাতি।”
সন্তুষ্ট হলাম নিজের নাম শুনে। যাক! তৃতীয় প্রশ্ন করলেন, “আগামী পরশুদিন কাঁটাগঞ্জে আপনাদের নতুন শোরুম উদ্বোধন করা হবে। সেই সম্পর্কে কী বলবেন?”

অভ্র স্যার হতভম্ব হয়ে মুখে হাত দিলেন। হাঁসফাঁস করে বললেন, “ও মাই গড, প্রতিযোগিতার চিন্তায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। নতুন যেহুতু, তাই সেখান থেকে ক্রয় করলে প্রতিটি পোশাকে ফিফট্টি পার্সেন্ট ছাড়। ধন্যবাদ।”
অভ্র স্যার নিজের তিনটি প্রশ্নে উত্তর দিয়ে থামতেই প্রেস মিডিয়া আমাকে এসে ধরল। “আমার অনুভূতি কেমন? কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া এতবড়ো কোম্পানির পোশাক শো করলাম কীভাবে? হ্যান, ত্যান।” অভ্র স্যার আরও একবার আমাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতে তাদের রিকোয়েস্ট করল যেতে। অতঃপর তার চললেন গন্তব্যে। পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হলাম। অভ্র স্যার বললেন, “আপনি কি যাবেন নতুন শোরুমে?”

সকালে বলা তার কথাটির প্রত্যুত্তরে বললাম, “না! বসের সাথে যাবে মডেলরা, পিএম, জিএফ, ম্যানেজার। ফ্যাশন ডিজাইনারদের সাজে না।” অভিমানে ডিজাইন করছি।
FD বস আমার হাত ধরে দোয়াত কলম দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে আরেকটু আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। মুগ্ধ হয়ে কাজ দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম মডেল টিনা দাঁড়িয়ে আছে অভ্র স্যারের কেবিনের বাইরে। FD বসকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “দেখেছেন স্যার, লজ্জা নারীর ভূষণ। কিন্তু মডেলদের লজ্জার ‘ল’-ও হয় না।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১১

“নিজেকে কী ভাবত কে জানে। আমার সাথে কত বা/জে ব্যবহার করেছে, তার হিসেব নেই। কিছু বললেই বিচার দিবে বলে ভয় দেখাতো। অভ্র স্যারের প্রিয় বলে চুপ ছিলাম।”
“তাই না-কি? সবার মুখে শুনেছি আপনি ভালো ডিজাইন করতে পারেন। একটু এপ্লাই করবেন?”
“মন্দ হয় না।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৩