এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৩

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৩
ইফা আমহৃদ

টিনাকে লক্ষ্য করে দোয়াতের কালি ছুঁড়ে দিল FD বস। টিনা আঁতকে উঠলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠে, “হাউ ডেয়ার ইউ? সাহস হয় কীভাবে আমার গায়ে কালি ছোড়ার?” বলেই কলার টেনে ধরল।
“যাকে যেটায় মানায়, তাকে সেটাই দিতে হয়।” ডিজাইন আঁকতে আঁকতে বললাম আমি। কলার ছেড়ে দিল। প্রচণ্ড রেগে আমার ডিজাইন করা পৃষ্ঠা ছিনিয়ে নিল এক প্রকার।

অতঃপর করল কয়েক টুকরো। হতভম্ব হয়ে একবার ছেঁড়া কাগজগুলো দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার টিনার দিকে। সে বুকে দুহাত গুঁজে বিদ্রুপ করে বলে, “যার অবস্থান যেখানে, তাকে সেখানেই মানায়। একটি ফ্যাশন প্রতিযোগিতা জিতিয়ে নিজেকে কী মনে করছ? আমার বাড়িতে কত মুকুট টফি আছে, ধারণা আছে তোমার? যদি আমার মুখে তেল না দিতে, আমিই জিততাম।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“হয়েছে আপনার ঠ/প/বাজি? তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে যান। আপনি যাতে ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, তাই নতজানু হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলাম। এখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেও দিতে পারব।” আঙুল তুলে বললাম। টেবিলের উপর পানি ভর্তি গ্লাসটা মুঠোবন্দী করে নিল অনায়াসে। অতঃপর টেবিলের উপর আঘাত করে করল কয়েক টুকরো। ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল গ্লাস। পরক্ষণে সেই ভাঙা গ্লাসের টুকরো দিয়ে আমার কাঁধে আ/ঘাত করল। এত দ্রুত ঘটল সবকিছু, নিজেকে সরাতে পারিনি।

ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম। সাদা রঙের কামিজটা রক্তে ভিজে গেছে। কয়েক টুকরো হয়তো অপ্রত্যাশিত ভাবে গেঁথে আছে কাঁধে। দ্বিতীয়বার একই ভাবে আঘাত করতেই পিছু হটতে বাধ্য হলাম, বিধেয় লাগল না। উপস্থিত ফ্যাশন ডিজাইনাররা ভয়ে শিথিল হয়ে গেল। FD বস স্টার্ফকে বলে, “দ্রুত অভ্র স্যারকে ডেকে নিয়ে এসো। যাও।”
স্টার্ফ চলে যেতে টিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “টিনা কাঁচের টুকরো ফেলে দাও বলছি, তুমি যেটা করছ সেটা ঠিক নয়।”

টিনা নিজের সিদ্ধান্তে অটল। দ্বি মুহুর্ত পূর্বেই অভ্র স্যার হাজির হলেন। ধারালো কণ্ঠে বলে, “আমার অফিসে ঢোকার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে? গতকাল আপনি যা করেছেন, আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আপনি আমার অফিসে ঢুকে আমার ডিজাইনাকে মা/রার চেষ্টা করেছেন। FD র সাথে মিসবিহেব করেছেন।”
টিনা কাঁচের টুকরো ফেলে দিয়ে বলে, “স্যরি স্যার, আমি রাগের মাথায় এইসব করে ফেলেছি।”

“রাগ আমারও আছে, আমার রাগ অতিরিক্ত ভয়ংকর। তাই বলছি, চুপচাপ বেরিয়ে যান। নাহলে আপনার ফেলে দেওয়া কাঁচের টুকরো দিয়ে গলা কা/ট/তে ভুল করব না। আর আমার টার্গেট আপনার মতো মিস্ হয় না।”
ভয়ে ভয়ে বলে টিনা, “পুলিশ আপনাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে?”

“কিছু টাকা ছড়ালে, তোমার মতো টিনা যে এই পৃথিবীতে ছিলো। সেটা মুছে যাবে।” বলেই অভ্র স্যার কাঁচের টুকরো তুলে নিলেন। অবিলম্বে টিনা ছুটল। অভ্র স্যার পুনরায় বললেন, “ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়না, মুন্তাসির শাহরিয়ার অভ্রর আপনার মতো মডেলের প্রয়োজন নেই। (স্টার্ফকে উদ্দেশ্য করে) ইমিডিয়েট ডাক্তারকে কল করে আসতে বলুন। সিরিয়াস ইস্যু। কাঁচ ভেতরে রয়ে গেলে সমস্যা হবে।

ডাক্তার এসে কাঁচ তুলে হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। অভ্র স্যার সম্পূর্ণ সময় পাশে বসে ইন্সট্রাকশন দিয়েছে। আমি শুধু দেখেছি। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আপনি ফ্যাশন সেন্স না নিয়ে, ডাক্তার হতে পারতেন। আপনার ভেতরে সেই ট্যালেন্ট আছে।”
অভ্র এক গাল হাসলেন। কিছুটা বিদ্রুপ করা বললেন, “আমার স্ত্রী ডাক্তার ছিলেন। গাইনী বিশেষজ্ঞ। এখন আমার রাগ কমে গেছে, আগে রাগ ছিল নাকের ডগায়। একবার গ্লাস চেপে ধরেছিলাম। ভেঙে কাঁচ হাতে ফুটেছিল। আমি আর তুলি নি। ওভাবেই ব্যান্ডেজ করে নিয়েছিলাম। পরে হাত পে/কে কী একটা অবস্থা হয়েছিল।”

“তারপর?” কৌতুহল নিয়ে আমিন।
“তারপর আর কী? আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি হাতে ব্যান্ডেজ। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল‌। ও জানে। আমি তো ওকে সহ্য করতে পারতাম না। কীভাবে আড়াই বছর থেকেছি, আমিই জানি।” অভ্র স্যার অনুভূতি পূর্ণ হয়ে গেলেন। সবকিছু সন্দেহজনক লাগছে‌।

হাত নড়াতে পারছি না। তাই চাকুরির প্রথম দিনেই অভ্র স্যার আমাকে ছুটি দিয়ে দিলেন। ব্যাগপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় অভ্র স্যার একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি কথা বলে নিয়েছি। এই ঠিকানায় চলে যাবেন। একটা ফ্লাটে তিনজনের সাথে রুম সেয়ার করে থাকবেন।”
ডানহাত দিয়ে কাগজটা নিলাম, বামহাতে ব্যান্ডেল। ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলাম। রিকশায় বিশ টাকার বিনিময়ে পৌঁছে গেলাম কাগজে লেখা ঠিকানায়। ভাড়া মিটিয়ে কাঙ্ক্ষিত তিন তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম।

আমার রুমমেট দুইজন মেয়ে। তিন রুমের ফ্লাটে তারা দুজনে বসবাস করছেন কয়েকমাস যাবৎ এবং আরেকজন খুঁজছে। উভয়ে ভার্সিটিতে পড়ে। শরীরটা ভালো নেই বলে, তাদের সাথে তেমন কথা হয়নি। আসার পর থেকে শুয়ে আছি শুধু। মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। ঠান্ডা লাগছে। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ। মাথায় পানি দিতে উঠে বসলাম। আমার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে আসবাবপত্র নতুন। একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল ও একটা আলমারি।

নিচে তেমন জায়গা নেই বললেই চলে। তিন ঘরের ভেতরে একটা ঘরের ভেতরে ওয়াশরুম, অন্য দুইটাতে একটা। আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে গেলাম। ট্যাপ ছেড়ে কিছুক্ষণ মাথায় পানি দিলাম। অতঃপর বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। মাথায় পানি দেওয়ার ফলে পূর্বের তুলনায় ভারী হয়ে আছে। পূর্বের ন্যায় কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম না। ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে। রান্নাঘরে কাজ করছিল লতা নামের মেয়েটি। ধপাস শব্দ পেয়ে ছুটে এলো নিকটে। আমাকে ধরে চ্যাঁচিয়ে বলে, “মেঘ, এদিকে আয়। দেখ তো মেয়েটা মাটিতে পড়ে আছে।”

মেঘ ছুটে এলো। ইতোমধ্যে লতা কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে বলে, “মোম, ঠিক আছো?”
“হম। ঠিক আছি। মাথাটা ঘুরে গেছিল। আমাকে ধরে একটু ঘর পর্যন্ত নিয়ে যাবে।” আমার কথায় সায় দিয়ে দুজনে ধরে ধরে ঘরে‌ নিয়ে গেল। মাথার নিচে বালিশ দিয়ে বলে, “তোমার শরীর উষ্ণ। জ্বর এসেছে।”
“হ্যাঁ, দুপুরে যখন দেখলাম। সুস্থ ছিলে। হঠাৎ জ্বর এলো কীভাবে?” তাল মিলিয়ে লতা।

“হাতে একটু ব্যথা পেয়েছি। ব্যথার কারণেই বোধহয় জ্বর এসেছে। আমাকে একটু পানি দিতে পারবে।” আমার আকুল আবেদনে মেঘ পানি নিয়ে এলো। এক ঢোক পান করলাম। লতা বলে, “তাই হবে। তোমাকে এখানে রাখার ব্যবস্থা করেছে অভ্র স্যার। তুমি তার ইমপ্লোয়ি, তোমার অসুস্থতার খবর তাকে জানানো উচিত।”

“তিনি আমার বস, আমার জন্য এইটুকু করেছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি আর তাকে ঝামেলায় ফেলতে চাইনা। প্লীজ বলবেন না।” গোঙানির তালে তালে বললাম। মেঘ বলে, “তাহলে তোমার বাড়ির কারো ফোন নাম্বার দাও, ফোন করে তাদের বলি।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১২

‘বাড়ির কেউ’ বলতেই সর্বপ্রথম কিট্টির কথা মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি করে আসতে গিয়ে কিট্টির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। রাত আনুমানিক আটটা ছাড়িয়েছে। অফিস পাঁচটা বাজে ছুটি হয়। এখন গেলে কিট্টিকে পাবো তো? সকালে একটা গাজর খেয়েছে। সারাদিন না-খেয়ে আছে। সারারাতও না খেয়ে থাকবে। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা জড়িয়ে বের হলাম পার্স নিয়ে। মেয়ে দুটো এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বারণ করল শত। কিন্তু আমার কিট্টির জন্য আমি বাধ্য হলাম।

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৪