এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৪

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরবর্তী মুহুর্ত থেকে আরম্ভ হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। রাস্তাঘাট পানিতে পূর্ণ। ভিজে জবজব অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে অগ্ৰসর হচ্ছি বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাত্রিবেলায় অফিসে কর্মীদের প্রবেশ নিষেধ। সেই নিষেধ মেনে ভেতরে ঢুকতে অগ্ৰাহ্য করা হলো আমাকে। ঠান্ডায় মাথা ভার হয়ে আছে। দু-বার কাশি দিয়ে ধীরে গতিতে হাঁটছি। উন্মানের মতো ছুটে চলার ফাঁকে কতক্ষণ শ্বাস নিলাম দীর্ঘ করে।

ছিমছাম নিরিবিলি রাস্তায় দেখা মিলল একটি দ্রুতগামী প্রাইভেট কারের। হেডলাইডের আলো চোখে পড়তেই কুঁচকে এলো চোখের পাতা। দুকদম সমুখে এসে থেমে গেল গাড়ি। ‘কিট্টির মাম্মি’ শব্দ দুটো কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করতে করতে গাড়ি থেকে নামল উদিতা ও ঊষা। আচমকা ঝাপ্টে ধরল আমায়। ঊষা বলে উঠে, “কিট্টির মাম্মি তুমি এখানে একা একা বৃষ্টিতে ভিজতেছ? আর আমরা তোমাকে কত খুঁজে এলাম। পেলাম না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বললাম, “তোমরা গাড়ি থেকে কেন নেমেছ বাচ্চারা, জ্বর আসবে।”
“তোমার আসবে না বুঝি? জ্বর কখনো দেখে না তুমি ছোটো না-কি বড়ো।” বলেই ঊষা কোমরে হাত দিল। গাড়ির দ্বার খুলে ছাতা সমেত বেরিয়ে এলো অভ্র। দুই মেয়েকে ছাতার নিচে রাখার পাশাপাশি আমাকেও রাখল, নিজে ভিজছে। ছাতার ডাট ধরে অভ্রকে নিচে রাখলাম। ঠান্ডা গলায় বললাম, “আমি ভিজে গেছি ইতোমধ্যে, আরেকটু ভিজলে কোনো ক্ষতি হবে না। আপনি ভিজবেন না প্লীজ।”‌

অভ্র হাসলেন। তাড়া দিয়ে বললেন, “ঊষা উদিতা ব্যাক সিটে গিয়ে বসো। আপনিও ভেতরে আসুন। মেঘ ফোন দিয়ে বলেছে, আপনি জ্বর নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এখন বৃষ্টিতে ভিজছেন। টাইফয়েড হয়ে যাবে।”
ছাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পতিত হয়ে ঝুমঝুম শব্দ করছে। হাওয়া বেড়ে বৃষ্টির মাত্রা কমে গেছে। ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছি। ঊষা উদিতা ছুটে গেছে গাড়ির ভেতরে। ভাবাবেগ না পেয়ে অভ্র স্যার হাত ধরে টেনে ফন্ট সিটে বসালেন। তৃতীয়বারের মতো নিজের জ্যাকেট খুলে আমার শরীরে প্যাঁচিয়ে দিয়ে বলেন, “শীত করছে বেশি?”

“না, আমার কিট্টি কোথায় বলতে পারেন? আমি অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু, দাড়োয়ান ঢুকতে দেয়নি।” গোঙানির সাথে বললাম। অভ্র স্যারের একটি কথায় প্রবোধ পেলাম, “কিট্টি আমাদের বাড়িতে। ওকে আমি আমার সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য নিয়ে আসিনি, ভিজে যাবে।”

কাঁচের সাথে মাথা ঠেস দিয়ে বার কয়েক উষ্ণ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। ভেজা শরীরে জ্বর যেন তরতর করে বেড়ে গেল। পানি জমা গর্তে গাড়ির চাকা পড়তেই মাথায় আঘাত লাগল। গোঙানির শব্দ বেড়ে গেল। আচমকা বাহুডোরে টেনে নিলেন অভ্র স্যার। বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে গেলাম। অভ্র স্যার বলেন, “ঊষা, তোমার কিট্টির মাম্মি-কে কোথায় নিয়ে যাবো? বাড়িতে না-কি তার বাড়িতে?”
“ওখানে। সেদিন চাচ্চু কিট্টির মাম্মি-কে নিয়ে কত কথা শোনাল তোমাকে। বাবাই, একটা কথা বলব?”
“বলো।”

“কিট্টির মাম্মি-কে আমাদের মাম্মি বানিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলো-না। আমরাও মাম্মি পারো, তোমারও বউ হবে।”
“তোমাদের আমি কতবার বলেছি, আমিই তোমাদের বাবাই আমিই মাম্মি। আমাদের বাড়িতে তোমাদের মাম্মি আসবে না। অগ্নি যদি মোম-কে বিয়ে করে, তবে তোমরা একটা মাম্মি পাবে।”
পরবর্তী দৃশ্য আমার মস্তিষ্ক ধারণ করল না। অসাড় হয়ে আসা শরীর এবার চেতনা হারাল।

রাত্রি শেষ হয়ে দিনের সূচনা হওয়ার পাশাপাশি ঘুমেরও ইতি ঘটল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সর্বপ্রথম দৃষ্টি মেলে তাকাতেই নজরবন্দি হলো চিরচেনা দুই শিশুর মুখশ্রী। উভয়ের কপালে চুমু দিয়ে উঠে বসলাম। ধীরে ধীরে স্মৃতি পাতায় দৃশ্যমান হলো গতরাতের ঘটনা। নিজের পরণে শুষ্ক ও অন্য পোশাক দেখে চমকে উঠলাম। হতভম্ব হয়ে বললাম, “একি, কে আমার পোশাক পাল্টেছে?”

“আমরা পাল্টাই নি তো, কে জানো পাল্টে দিয়েছে। চিনি না কিট্টির মাম্মি।” ঊষা বলে।
আধঘণ্টা পর অভ্র এলো একটা প্যাকেট নিয়ে। হোটেল থেকে গরম গরম নাস্তা ও সাথে কিছু ওষুধ। রান্নাঘর থেকে মেঘ বা লতার থালা এনে বলে, “খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপরে আবার ঘুম দিয়েন। জ্বর নিয়ে না-খেয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঠিক নয়। আমার মা বলতো, ক্লান্ত শরীরে জ্বর জেকে বসে।”

অভ্র যেতে নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হুট করে বলে ফেললাম, “আপনি খাবেন-না?”
“না, আমার তেলের খাবারে বদহজম হয়। ক্রমাগত ঢেকুর উঠতে থাকে। ঊষা আর উদিতার সমস্যা হয়না। আপনি ওদের নিয়ে খেয়ে নিন।”
“আপনি না খেয়ে থাকবেন?”
“না খেয়ে কেন থাকব? আমি এখন অফিসে যাবো। স্টার্ফদের দিয়ে কিছু এনে খেয়ে নিবো।”
“ওদের নিয়ে যাবেন-না? ওদের আপনি আমার কাছে রাখার ভরসা পান-না, এম আই রাইট?”

“জানি না, আপনি রেস্ট নিন। ওরা দুজন আপনার কাছে থাকুক। দুপুরের খাবার আমি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।” আমি জবাব দিলাম না। অভ্র স্যার এগিয়ে গেলেন সমুখে। পুনরায় বললেন, “আগামীকাল সকালে আমি কাঁটাগঞ্জে যাবো, আপনি কি যাবেন আমার সাথে?”

বামহাত বিছানায় রেখে ভর দেওয়ার চেষ্টা করতে ব্যথাটা প্রকট হয়ে উঠল। ডান হাত দিয়ে ক্ষতটা স্পর্শ করে বললাম, “আরেকটু ডান দিকে হলে একদম উপরে চলে যেতাম। বাই দা ওয়ে, আপনি চাইলে আমি অফিসে জয়ে‌ন করতে পারি। কিন্তু নতুন শোরুমে যাবো না।”
“প্লীজ? আমার রিকোয়েস্ট। না করবেন না।”
“উত্তরটা তো আপনি নিয়েই নিলেন।” আমার কথাতে অভ্র স্যার হাসলেন। অতঃপর বেরিয়ে গেলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। অভ্র স্যারের মেয়ে দুটো লক্ষীমন্ত্র। নিজ হাতে খাইয়ে দিল আমায়।

সূর্যের রোদ হালকা হতেই বারান্দায় গিয়ে বসলাম আমি। অভ্র এখনো আসেনি ঊষা ও উদিতাকে নিতে। পাঠানো খাবার দিয়ে আমাদের দুপুরের খাবার সম্পন্ন হয়েছে। মেঘ ও লতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে তারা সকালের দিকে বাড়িতে থাকে না। ঊষা উদিতার সাথে যোগ দিয়ে হাসতে ব্যস্ত যখন, তখনই করাঘাত পড়ল দরজায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে পা বাড়ালাম। আমার পিছু পিছু সেখানে গেল ঊষা ও উদিতা।

“কেমন আছো, ক্যান্ডেল?”
অগ্নি দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। প্রথমবার দেখাতে অভ্র স্যার মনে হয়েছে বিধেয়, কিন্তু ক্যান্ডেল শব্দটাকে অগ্নি মনে হয়েছে। ঊষা ও উদিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তোরা এখানে? রাতে তোরা এখানেই ছিলি?”
“হম।” ঊষা।

“অভ্রও এখানে ছিল?” অগ্নির এমন প্রশ্নে আমি ‘হ্যাঁ’ আর ঊষা ‘না’ বলে উঠলো। অগ্নি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “মিথ্যা বলা শিখে গেছিস দেখছি। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
ঊষা চুপ করে গেল। অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি কেউ হই না তোমার, তাই না?”
“মানে?”

“কেউ হলে নিশ্চয়ই নতুন ফ্লাটে ওঠার আগে আমাকে একবার জানাতে।”
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। পুনরায় অগ্নি বলে, “বাদ দাও, ভেতরে আসব?”
“আসুন। স্যরি, ভুলে গিয়েছিলাম।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৩

অগ্নি ভেতরে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণ ফ্লাটে নজরবন্দি করে। বিছানায় বসে বলে, “তোমার অসুস্থতার কথা আর বাড়ির ঠিকানাটা আমি অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। কীভাবে হাতে ব্যথা পেলে এটা আগে বলো।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৫