এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৫

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৫
ইফা আমহৃদ

“ভাঙা কাঁচের টুকরো-টা হাতের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে আপনাদের মডেল টিনা। আরেকটু হলেই.. । বাদ দিন কেমন আছেন বলুন।” বলতে বলতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। অগ্নিও এলেন পেছনে। ঊষা ও উদিতা দু-হাতে দৃঢ় করে আবদ্ধ করে রেখেছে আমায়। অগ্নি আশেপাশে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে, “সেদিন বললে-না? তুণি টিনার বাড়িতে গিয়েছিলে ক্ষমা চাইতে। ওর এড্রেস টা দাও।”

“এড্রেস দিয়ে কী করবেন?”
“বললাম না দিতে, কথা না বলে দ্রুত দাও।” প্রথমবার বাক্যটুকু উচ্চ স্বরে বলে, পরবর্তীগুলো নম্র গলায় বলে। আমার সুবিধার ঠেকল না। দিতে চাইলাম না, আমতা আমতা করে শুধালাম, “আসলে তখন আমি চিন্তিত ছিলাম, এড্রেস শোনার পরই ছুটে গিয়েছিলাম। এখন মনে নেই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অগ্নি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা ‘শু-তাক’ টা সর্বশক্তি দিয়ে ফেলে দিল। ঊষা ও উদিতা চিৎকার করে উঠল। অতঃপর আমার হাত টেনে ধরে বললেন, “একটা কথা তিনবারের বেশি আমি বলি না। শেষবারের মতো বলছি, এড্রেস টা দাও।”
ঝড়ঝড় করে বললাম ঠিকানা। অগ্নি মুচকি হাসল। হাতটা না ছেড়ে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, “তাই তেমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাম, যাতে পুনরায় মনে পড়ে ঠিকানা। অগ্নি জানে, কখন কী করতে হবে।”

“ঠিকানা জেনে আপনার কী লাভ, শুনি?”
“তোমাকে বলে কী করব, দরজাটা বন্ধ করে ওদের নিয়ে বসে থাকো।” বলেই অভ্র পুনরায় বেরিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই ধাড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমি উদিতা ঊষার হাত ধরে ঘরে চলে এলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, “ডোন্ট ওয়ারি পাখিরা। আমি আছি।”
অভ্র এলো অফিস শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে। মেয়েরা বাবাকে কেঁদে কেদে দিল। অভ্র হতাশ হলো। দুই মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, “কী হয়েছে ঊষা উদিতা? কাঁদছ কেন মা?”

“চাচ্চু এসেছিল বাবাই। আমাকে ধমক দিয়েছে। বাবাই তুমি কিট্টির মাম্মিকে বিয়ে করে নাও। তাহলে চাচ্চু আর আমাদের বকতে পারবে না।” কাঁদতে কাঁদতে বলে ঊষা। ঊষার কথায় ডায়ে-বায়ে মাথা দুলিয়ে সাড়া দিল উদিতা। অভ্র স্যার প্রত্যুত্তর না দিয়ে দুই মেয়েকে একসাথে কোলে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “কালকে সকাল আটটাতে আমি আসব। তৈরি হয়ে থাকবেন।”

দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। ধরফরিয়ে উঠে বসলাম আমি। হৃৎপিণ্ড যেন এখনো উঠানামা করছে। থামার নাম নেই। বিছানায় ছেড়ে উঠে খুলে দিলাম দরজা। অভ্র স্যারকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আটটা চৌদ্দ। মাথার পশ্চাৎ ভাগে হাত বুলাতে বুলাতে পিছিয়ে গেলাম। অভ্র স্যার ভেতরে ঢুকে বললেন, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না, আমি তৈরি হয়েছেন। উনিশ বার কল করেছি, ফোন বন্ধ। বাধ্য হয়ে চলে এলাম।” দাঁতে দাঁত চেপে গোঙানি তুলে বলেন অভ্র স্যার। চট জলদি ছুটে গেলাম ফোনের কাছে। লাল বাটনে চেপে রেখেও খুলতে পারলাম না ফোনটা। রাতে শোবার আগে এলার্ম দিয়ে শুয়েছিলাম। বাজা তো দূরের কথা বন্ধ হয়ে আছে। অভ্র স্যারকে শান্তনা দিতে বললাম, “একটু অপেক্ষা করুন। পাঁচ মিনিটের মাথায় আমি তৈরি হয়ে আসছি।”

“জাস্ট পাঁচ মিনিট। নাহলে আমি আপনাকে পাঁচ মিনিট পরের অবস্থায় কোলে নিয়ে ছুটব।” অভ্র স্যারের এরূপ লাগামহীন কথায় চক্ষু হলো চড়কগাছ। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে থাকার পর অভ্র স্যার রুদ্র গলায় বলে উঠলেন, “আর চার মিনিট।”
টনক নড়ে উঠল। ছুটে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে। দ্বার বন্ধ করে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলাম। মুখমণ্ডলের পানি মুছতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। দেহে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আশেপাশে তাকিয়েও ওড়নার সন্ধান পেলাম না। হতভম্ব হয়ে গেলাম। অভ্র স্যারের সামনে আমি ওড়না বিহীন ছিলাম ভেবেই লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে মিরে গেলাম। ছিঃ! ছিঃ!

দরজার ফোকটে মাথা গলিয়ে দিয়ে অভ্র স্যারের উপস্থিতি দেখলাম। বিছানার উপর বসে থাকা কিট্টির শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পিছনে মাথা কাত না করে অগোছালো ওড়নাটা ছুড়ে দিল পেছনে। কেচ ধরে পুনরায় ভেতরে চলে গেলাম আমি।
শহর থেকে বেশ দূরে কাঁটাগঞ্জ। গ্রামের ভেতরে তার অবস্থান। মাটির ছোটো রাস্তা দিয়ে অভ্র স্যারের গাড়ি ধীর গতিতে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে। বাইরে ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পতিত হচ্ছে। কর্দমময় রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল গাড়ি। অভ্র স্যার কয়েকবার চেষ্টা করেও পারলেন না চালাতে। অতঃপর বিরক্তির সাথে নামল গাড়ি থেকে। ডিকিতে দুবার জোরে ধাক্কা দিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে, “ধ্যাত।”

“এখন কী করবেন স্যার? সামনে এগোবেন না-কি পিছিয়ে যাবেন?”
“পিছনে তোমার জামাই বাড়ি? যে এগুবো? চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকো। আমি সামনে থেকে ঠেলে দেখছি, এই কাঁদা থেকে বের করা সম্ভব কি-না।” বলেই অভ্র স্যার তার ব্যবহৃত ব্লেজারটা খুলে কাঁচের ফাঁক দিয়ে নিজের আসনে রাখলেন। জুতো ও মোজাও রাখলেন গাড়ির ভেতরে। প্যান্ট ফোল্ড করে উপরে গুটিয়ে চললেন গাড়ি ঠেলতে।

সর্বশক্তি দিয়েও গাড়ির পূর্বের স্থান থেকে এক চুলও সরাতে পারলেন না। অধৈর্য হয়ে গাড়ির দ্বার খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ছিপি খুলে পান করলেন পানি। রাগে লাল হয়ে বললেন, “ইচ্ছে করছে সবকিছু ফেলেই এভাবে চলে যাই।”
“আমি দেখছি, কী করা যায়।” বলে প্রবেশদ্বার খুলে গ্ৰামের মাটিতে পা রাখলাম। অভ্র স্যার তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বলেন, “মশাকে দেখেছ, কখনো গন্ডারের রক্ত চুষে খেতে? তোমার কাছে গাড়িটা গন্ডারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।”
কৃষকেরা ধান রোপন করছে ক্ষেতে। কাঁদা উঁচিয়ে সেদিকে গিয়ে সাহায্য চাইলাম, “শুনছেন, আমরা বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করবেন?”

“কী সাহায্য?” একজন কৃষক বলে।
“কাঁদার ভেতরে গাড়িটা আটকে গেছে। কিছুতেই বের করতে পারছি না। আপনারা যদি একটু ধাক্কা দিতেন, খুব উপকার হতো।”

“আমাদের গ্ৰামে এসে বিপদে পড়েছেন। এই মিন্টু, বাবলু, ফিরোজ, রশীদ, স্বপন এদিকে আয়। গাড়ি ধাক্কা দিতে হবে।”
দলবেঁধে ছয়জন হাজির হলো। একত্রে ধাক্কা দিয়ে কাঁদার ভেতর থেকে উপরে আনতে সক্ষম হলো। অভ্র স্যারের কানে ফিসফিস করে বললাম, “গাড়ি তুলতে লোক আসবে আবারআ নতুন করে গাড়ি বুক করে কাঁটাগঞ্জে যেতে যত টাকা লাগবে আমাকে দিন।”

“কেন?”
“দিতে বলেছি, তাই।”
ওয়ালেট হাতরে তিন হাজার টাকা দিলেন অভ্র স্যার। মুঠো করে টাকাটা প্রথম কৃষকের মুঠোয় দিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “এটা রাখুন।”
“টাকা লাগবে না।”
“এটা আমাদের ভালোবাসা। ‘না’ করবেন না। প্লীজ।” অভ্র স্যার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তখন। অনুরোধের স্বরে বলেন, “আমারও তাই মতামত। না করবেন না।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৪

তাঁরা ‘না’ করলেন না। পুনরায় ধানক্ষেতে নামতেই আমি আর অভ্র স্যার রওনা দিলাম গাড়ির দিকে। মাথায় পরপর কয়েকবার টোকা দিয়ে বললাম, “মাঝে মাঝে মানুষের বুদ্ধির কাছে শরীরের শক্তিও হাল মেনে নেয়।”
আচমকা অভ্র হাত টেনে কাঁদার দিকে ঝুঁকিয়ে রাখলেন।

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৬