এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৬

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

৫০ % ছাড় নতুন ডিজাইনের পোশাকে। শোরুম উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সকল বিক্রেতাদের দেওয়া হচ্ছে। ‘সাদার ভেতরে নীলের কম্মিনেশন’ একটা থ্রী পিস সামনে রেখে বলেন অভ্র, “কেমন লাগে?”
“সুন্দর।”
“এটা আপনার।”
“আপনার ব্যবসায় লোকসান হবে তো।”

“হবে না, নিন। আমার জন্য আপনার দুইটা থ্রী পিস ন/ষ্ট হয়েছে। গ্ৰাম থেকে এসেছেন, হয়তো দুই চারটার বেশি নিয়েও আসেন নি।” ততক্ষণে শোরুমের ম্যানেজার এলো।‌‌অতঃপর অভ্র স্যার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। গ্ৰামের ভেতর দিয়ে মাটির রাস্তা। কদম ফুল ফুটে আছে গাছে। যেহেতু প্রতিটি পোশাকের উপর ছাড়, তাই গ্ৰামে মেয়ে বউও এসেছে শাড়ি কিনতে। অভ্র স্যারকে বিরক্ত করতে রিংটোন বাজল ফোনের।‌ লালচে রুদ্র ভাঁজ ফেলে ফোনটা সাইলেন্ট করে পুনরায় পকেটে রাখলেন। দ্বিতীয়বার ফোন বাজলে একই কাজ করলেন। কিন্তু তৃতীয়বার সেই কাজ করলেন না। ম্যানেজার সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “দেখুন তো কী বলছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আশেপাশে চ্যাঁচামেচি হওয়ায় দখিনা দরজা দিয়ে বাইরে নামলাম। বাজতে বাজতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার বাজল। ‘শ্যামল ওকিল।’ রিসিভ করে বাক্য উচ্চারণ করার পূর্বেই ওপাশ থেকে বলতে শুরু করল, “অভ্র স্যার আপনি কাঁটাগঞ্জ থেকে দ্রুত বের হয়ে আসুন। আপনার না/মে মা/ম/লা দায়ের করা হয়েছে।”
“কী? কে দায়ের করেছে? কেনই বা?”

“আজ নয়টার দিকে মডেল টিনা-কে কেউ পি/টিয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফ্লাটের প্রতিবেশীরা তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। থা/নাতে মা/ম/লা নেয়নি বলে আদালতে গিয়ে সরাসরি করেছে। অভ্র স্যার শোরুম উদ্বোধনে গেছে, তাই পুলিশ সেদিকে গেছে।”
এখন সময় একটা। আটটা চৌদ্দ থেকে অভ্র স্যার আমার সাথে ছিলেন। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে তিনি বলেন, “শুনছেন, অভ্র স্যারকে একটু বলুন নয়তো ফোনটা তাঁকে দিন।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, আমি তাঁকে জানাচ্ছি।” কল বিচ্ছিন্ন করে মরিয়া হয়ে উঠলাম অভ্র স্যারকে খুঁজতে। পূর্বের স্থানে পেলাম না। ম্যানেজার নেই, ফোন নেই। কীভাবে যোগাযোগ করব? স্টার্ফদের উদ্দেশ্য করে বললাম, “অভ্র স্যার এখানে বসে ছিলেন। কোথায় গেলেন তিনি?”
“বেরিয়েছেন জমি দেখতে। আশেপাশে অনেক জমি আছে। সেগুলো কিনে শোরুম বড়ো করবে, এতে গ্ৰামের মানুষ চাকুরিজীবীও হবে।”

খুঁজতে বের হলাম। সকালে কিছু খেতে না পারার কারণে পা জোড়া চলছে না। কয়েকজন পুলিশ দেখতে পেলাম রাস্তায়। ভয়ের মাত্রা তড়তড় করে বেড়ে গেল।
অদূরে তিন দল পুলিশ অভ্র স্যারের সাথে কথা বলছেন। খোলসা করে কিছু না বলে বারবার অনুরোধ করছে তাঁদের সাথে যেতে। নিজ ফোনের বাটন চেপে অভ্র স্যারের ফোনে কল করলাম। হাতের ফোনটা লুকিয়ে অভ্র স্যারের সমুখে গিয়ে বললাম, “আপনাকে বারবার কল করছে, ওদিকে গিয়ে একটু কথা বলে নিন। জরুরি।”

“পরে কথা বলবেন। আমাদের সাথে একটু চলুন।” (পুলিশ)
‘মোমবাতি’ জ্বলজ্বল করতে দেখে আমার দিকে চমকে তাকিয়ে বলেন, “আমি কখন কার সাথে কথা বলব, আমি বুঝব।”
ফোন নিয়ে চলে গেলেন দূরে। বিরতি কলে ‘আসছি’ বলে আমি পা বাড়ালাম। অভ্র স্যার বললেন, “কী হয়েছে, কল করেছেন কেন?”

“ওনারা আপনাকে অ্যা/রে/স্ট করতে এসেছে।”
“কেন?”
“এত বলার সময় নেই। চলুন পালাই, পরে বলব।”
“আমি কখনো পালাই না মিস্ মোমবাতি।”
“শোরুম উদ্বোধন হওয়ার দিন মুন্তাসির শাহরিয়ার অভ্র অ্যা/রে/স্ট হলেন‌। যদি এটা আপনার সম্মানের হয়, তাহলে পালাবেন না।”

পরক্ষণে বামহাতে প্রবল টান অনুভব করলাম। উপলব্ধি করলাম ছুটছেন অভ্র স্যার। আমি ছুটলাম।
লাউ গাছের জন্য ব্যবহৃত মাচা দেখতে পাওয়া গেল। অনেকটা পথ দৌড়ে আসার ফলে পায়ে ব্যথা করছে। অভ্র স্যার মাচার ভেতরে বসলেন। তাকে দেখা গেল না। ফিসফিস করে বললেন, “মোমবাতি, দ্রুত ভেতরে আসুন।”
“একটুকু জায়গাতে দুজন থাকা মুশকিল। তাছাড়া আপনাকে পুলিশ ধরতে এসেছে। আমাকে ধরবে না।” কামিজে লেপ্টে থাকা কার্দমের আস্তরণ ফেলতে ফেলতে বললাম আমি।

“কান টানলে মাথা আসে। আমাকে ওখান থেকে আপনি নিয়ে এসেছেন। এখন আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন তাহলে আমি নিশ্চয়ই আশেপাশেই থাকব। জলদি আসুন নাহলে আমি বের হলাম।”
নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দীর্ঘক্ষণ ভেবে মাচার নিচে আশ্রয় নিতে ঢুকলাম।
পরনে লাল টকটকে জামা। সবুজের মাঝে লালকে আকর্ষণ করতে ভুলে না। অভ্র স্যার হাতের বাহু ধরে টান দিল। হুমকি খেয়ে পড়লাম তার কাঁধে। বেঁধে রাখা অবাধ্য চুলগুলো খুলে গেল কাঁটা ভেঙে। ফিসফিস করে বলেন, “একদম নড়বেন না।”

কথন উচ্চারণ করার নির্গত হওয়া প্রতিটি নিঃশ্বাস বিচরণ করল ললাটে।
সাজিয়েছি এক ফালি সুখ, রাজি আছি আজকে বৃষ্টি নামুক।
তুমি আমি ভিজব দুজনে খুব
বর্ষা দিলে।

বিকাল চারটা আটান্ন। ‘পুলিশ’ থেকে এখন মুক্ত বললেই চলে। গ্ৰাম থেকে গ্ৰামান্তরে এসেছি। ছোটো একটা ব্রীজের পাশে সারিবদ্ধ কয়েকটা দোকান। লেখা- শ্যামল পাড়া। কচি লাউ রান্নার গন্ধ পাচ্ছি। কতদিন হয়েছে লাউয়ের তরকারি খাওয়া হয়নি। একটা টং দোকানে দুজনে বসলাম। আগ্ৰহ নিয়ে দোকানিকে বললাম, “এখানে কোনো হোটেল পাওয়া যাবে?”
“হোটেল পাওয়া যাবে না তবে আমার কাছে ভাত, ডাল আর লাউয়ের তরকারি পাবে। প্লেট ত্রিশ টাকা।”

অভ্র স্যারের দিকে ‘না’ করা প্রশ্নের উত্তর নিতে দৃষ্টি মেলালাম। ভেজা চুলগুলোর পানি ঝেড়ে অভ্র স্যার বললেন, “আপনি ওনাকে এক প্লেট দিন, আমি খাবো না।”
“ভেতরে আসেন আপনি।” আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন। দোকানির পেছনে আমি গেলাম। দোকানের পেছনে আরও একটি দোকান যেখানে চেয়ার টেবিল বিছানা। মহিলা নেই বললেই চলে, সব পুরুষ। কমবেশি সবার শরীরে কাঁদা লেগে আছে। দোকানি বললেন, “তাঁরা মিস্ত্রি।”

এত পুরুষের মাঝে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ফিরে এলাম। মুখ কালো করে বললাম, “খাবো না।”
“কেন?” ভ্রু কুঁচকে।
“এতগুলো পুরুষের মাঝে কেমন জানো লাগে।”
“চলুন। আমি বসছি।”
লাউয়ের তরকারি দিয়ে গরম গরম ভাত পরিবেশন করলেন তিনি। ডাল পানির চেয়ে গাঢ় নয়। প্রথম লোকমা মুখে তুলতে বেশ লাগল। লোকমা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “খাবেন?”

“না, আপনি খান।”
“খাবেন?”
“না।”
“শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, খাবেন?”
“চাচি আরেক প্লেট দিন।”
“এইতো বললেন খাবেন না। এখন আবার কী হলো?”
“এতবার স্বাদছেন। না খেয়ে উপায় আছে। এমনিতেই ক্ষুধায় চৌ-চৌ করছে। লাউ বলে খাচ্চি না।”
দুপুরের অপ্রত্যাশিত খাওয়া শেষ করে দোকানের টুলের উপর বসে চা খাচ্ছি। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “ড্রাইভারকে বলে গাড়ি নিয়ে আসতে।”

ফোনটা এগিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “আপনার ফোন এখন না খোলাই ভালো। আমার টা দিয়ে কল করুন।”
“কেন? আমার ফোন তো বন্ধ করিনি।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৫

হতভম্ব হয়ে চায়ের কাপ সরাতে হলাম বিস্মৃতি। উষ্ণ তাপে ওষ্ঠ পু/ড়ে গেল। বললাম, “ভালো করেছেন। আমরা এখানে আছি পুলিশের জানতে দেরি হবে না। এতই যখন ধরা দেওয়ার শখ, তাহলে শুধু শুধু কেন একটা পথ এলাম?”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৭