এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৭

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৭
ইফা আমহৃদ

“এবার মূল ঘটনা আমাকে খুলে বলুন তো, হঠাৎ পুলিশ কেন আমাকে অ্যারে/স্ট করতে চাইছে?” বলতে বলতে নিজের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ করে দিলেন। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা দোকানিকে দিয়ে ব্রীজ পেরিয়ে মাটির রাস্তা ধরলাম। অভ্র স্যার নিজেও এলেন বিল মিটিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “মডেল টিনা হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর এপার্টমেন্টের সবাই সাক্ষ্য দিয়েছে, আপনি তাঁকে মে/রেছে/ন?”

“কী? কিন্তু কখন?” কণ্ঠে উদাসীনতার আভাস পাওয়া গেল তার।
“আজ সকাল নয়টার দিকে।”
“তখন তো আমি আপনার সাথে রাস্তায় ছিলাম।”
“হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছি। থানাতে মামলা নেয়নি বলে আদালতে সরাসরি করেছে। আদালতের রায় অনুযায়ী পুলিশ এখানে আসতে বাধ্য আর আপনাকে ধরতেও বাধ্য।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এখন কোথায় যাচ্ছি?”
“যেখানে ফোন বন্ধ করেছেন, তার থেকে কিছুটা দূরে।”
“সন্ধ্যা নেমে গেছে, উদিতা ঊষার ঘুম ভাঙার আগে আমাকে ওদের কাছে থাকতে হবে।”

আকাশের দিকে তাকালাম। তাঁরা নেই, নেই চাঁদ কিংবা তার খণ্ড চিত্র। সাইনবোর্ডে লেখা ‘শ্যামল পাড়া।’ চিবুকে তর্জনী বিচরণ করে বললাম, “সম্ভব নয়, বৃষ্টি আসবে। একটু বৃষ্টি হলে গ্ৰামে যানবাহন পাওয়া যায় না। তার উপর পুলিশ খুঁজছে।”
ব্রীজ থেকে অনেকটা দূরে এসে পৌঁছেছি ইতোমধ্যে। চারদিক ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে আবৃত। গ্ৰামাবাসীরা উল্টো দিকে ছুটছে। যেন মেলা বসেছে। উৎকণ্ঠা নিয়ে একজনকে‌ জিজ্ঞেস করলাম, “শুনছেন, সবাই এদিকে কোথায় যাচ্ছে?”

“গন বিবাহে যাচ্ছে। প্রতিবছর এই দিনে গ্ৰামের দুস্থ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিবাহের আয়োজন করে গ্ৰামের প্রধান। আমার মেয়েরও বিয়ে আজকে। সেখানেই যাচ্ছি। এবার পনেরোটা বিয়ে হবে।” বলেই তিনি অগ্ৰসর হলেন তার গন্তব্যের পানে। উক্ত দিকে অগ্ৰসর হওয়ার প্রয়াস করতে বাহু টেনে দমিয়ে দিলেন অভ্র স্যার। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কোথায় যাচ্ছেন?”

“গন বিবাহের আয়োজনে। বাংলা মুভি দেখেছেন, ‘তোমাকেই খুঁজছি’ রিয়াজ শাকিল অভিনীত? সেটা দেখার পর আমার বহুদিনের ইচ্ছে গন বিবাহ দেখা।”
“আপনাকে কি বললাম, শুনতে পান-নি? আমাদের ফিরতে হবে।”
“এখন রাস্তায় আপনি কাউকে খুঁজে পাবেন না। কার কাছে বাসস্ট্যান্ড জিজ্ঞেস করবেন?” বাহু ছাড়িয়ে অগ্ৰসর হলাম গন বিবাহের আসরের দিকে। অভ্র স্যার উপায়হীন হয়ে আমার পেছনে পেছনে এলেন। ‘মেয়েদের ছেড়ে থাকেন-না’ ঠিক আছে, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে হবে।

গ্ৰামের মাঝেও রঙ বেরঙের আলো দিয়ে সাজানো বিয়ে বাড়ি। ভিড় ভাট্টা ঠেলে ভেতরে যাওয়া শুধু অসম্ভবই নয়, নিষিদ্ধ। স্টেজের উপর রাখা ত্রিশটা চেয়ার। যার ভেতরে চৌদ্দ জন কণে ও চৌদ্দ জন বর আসন দখল করে আছে। পাশাপাশি একজোড়া চেয়ার ফাঁকা। তারা আসন দখল করলে বিয়ের পড়ানোর কাজ শুরু হবে। কাজি সাহেব গ্ৰাম প্রধানকে তাড়া দিয়ে বলেন, “কতক্ষণ লাগবে মশাই। এখন ‘না’ শুরু করলে শেষ হতে আরও দেরি হয়ে যাবে।”
“দু’জন তো এলো না এখনো।”

“চৌদ্দ টা বিয়ে পড়াতে অনেক সময় লাগবে, সেই সময়ে তারা এসে পড়বে। সবার শেষে না-হয় তাদের বিয়ে পড়াবো।”
“আপনি যা ভালো বোঝেন, তাই করুন।”
কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করল। তিনটা বিয়ে সম্পূর্ণ শেষ হতে ঘণ্টা খানেক সময় নিল। পরবর্তী বিয়ে ও আমার হাঁটু ব্যথা একই সাথে শুরু হলো। হাঁটু ধরে শুধালাম, “পায়ে ব্যথা করছে। চলুন, চলে যাই।”

গন বিবাহের আসরে বিবাদ ঠেকাতে পুলিশের টহল চলছে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলাম উভয়ে। পুনরায় ভিড়ে ফিরে এলাম। অভ্র স্যার সৌজন্য হেসে বললেন, “পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনি আমাকে একটা সেরা জায়গায় নিয়ে এসেছেন। তার জন্য ফিরে গিয়ে আপনাকে একটা পুকুর কে/টে দিবো।”
“আশ্চর্য তো। পুকুর দিয়ে আমি কী করব?”

“পুকুরে চুবিয়ে রাখবো।” দাঁতের সাথে দাঁতের সংঘর্ষ সৃষ্টি করে বলে। ভিড় ক্রমশ কমতে শুরু করেছে‌। রাত্রি গাঢ় হওয়ার নিমিত্তে গ্ৰামবাসীরা ফিরছে বাড়ির দিকে।
পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেতে নববধূ ও বরের পোশাক পরিধান করলাম উভয়ে। চৌদ্দ নাম্বার বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করে কাজি সাহেব যখন পনেরো নাম্বার বর-বধূ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। তখন সন্ধান পেল আমাদের। কাজি সাহেব দূর থেকে ডেকে উঠলেন, “আপনারা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আবহাওয়া দেখেছেন, বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টি আসলে বিদ্যুৎ চলে যাবে। তার আগে আপনাদের বিয়েটা পড়ানো শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে।”

“বিয়ে?” দু-জনে একসাথে উচ্চস্বরে উচ্চারণ করলাম। অভ্র স্যার আমার দিকে রুদ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। গ্ৰাম প্রধান এসে বললেন, “কী হলো, তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? একেই সবার শেষে এসেছ, আর দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি যাও।”

দুজন পুলিশ দেখে হিতাহিত চেতনা হারিয়ে নববধূর আসনে নিয়ে বসলাম আমি। ‘মোম, মোম, মোম।’ তিনবার ডেকেও যখন আমার সাড়া পেলেন না, তখন তিনিও আসন দখল করে নিলেন। কাজি সাহেব লিখতে লিখতে অভ্র স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নাম?”

“মুন্তাসির শাহরিয়ার অভ্র।”
“পিতার নাম?”
“শাহরিয়ার কবির।” অভ্র স্যারের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে আকর্ষণ করে বললেন, “তোমার নাম?”
“মোম। পিতা মরহুম লতিফ সিদ্দিকী।” আমার উত্তরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অভ্র স্যার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “বিয়ে করার কী শখ।”

অগত্যা দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হলো। নববধূ ও বরের জন্য বরাদ্দকৃত পনেরোটি বাসর ঘরের মধ্যে একটি বাসর ঘরে রাখা হলো আমাকে। গোলাপ ফুলের সুবাস। সম্পূর্ণ ঘরে ফুল না থাকলেও পাপড়ির ছড়াছড়ি। বাটন ফোনটা বের করে অগ্নির সাথে যোগাযোগ করার প্রয়াস করলাম। নেটওয়ার্ক নেই। টিনের ঘরের জানালার ফোকট দিয়ে হাত বের করে দিলাম বাইরে। এক কাঠি নেটওয়ার্ক এলো। পুনরায় চলে গেল। অভ্র স্যারের ফেরার খবর নেই। চোখের পাতা ভিজে উঠল। অভ্র স্যার আমাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করবেন না। উল্টো সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করবেন। নিজের পুরনো জামা কাপড়গুলো আঁকড়ে ধরে রইলাম। অজানা সম্পর্কের সূচনা হলো।

আলো আঁধারের লেখা শেষ করে সূচনা হয়েছে নতুন একটি দিনের। তখন বাইরে আঁধার। আধশোয়া অবস্থায় ঘুম ভাঙল। হাই তুলে আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে পেলাম না কোনো পুরুষকে। শেরয়ানীটার নিচে একটা চিরকুট হাওয়াতে উড়ে যাওয়ার প্রয়াস করছে। হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা ধরলাম। লেখা,

‘গতরাতের ঘটনাগুলো মন থেকে মুছে পূর্বের জীবনে ফিরে যাবেন। আপনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি আমার মেয়েদের কাছে ফিরে গেলাম। আপনিও শহরে ফিরে আসুন।’

চিরকুটটার দুপিঠ দেখে সৌজন্য হেসে দীর্ঘ শ্বাস নিলাম। কালরাতে এটা প্রত্যাশায় ছিল। গতরাতের বেনারসিটা খুলে সালোয়ার-কামিজ পরিধান করলাম। বেনারসিটা বিছানায় রেখে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। গতরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাথে নেমে আসা আমার জীবনের সবচেয়ে শুভ ও অশুভ ক্ষণটা গতকালই বিদায় নিয়েছে।

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৬

দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম, ‘আপনি যদি কখনো নিজ থেকে আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ না করেন। গতকালের রাতটা চোখের পাতার মতো পালটে ফেলেন তবে আমি আর চোখের পাতার উলটা পলক ফেলে স্মৃতিচারণ করব না।’

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৮