সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (ক)

সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (ক)
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

শেষ বৃষ্টির টিপ টিপ ফোঁটার সুন্দর ধ্বনি তৈরি করছে। ভেসে আসছে বাগানের ঝোঁপ ঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আমি পিটপিট করে চোখ খুললাম। ঘন কালো আঁধার ঘরটাতে করিডরের বাল্ব এর আলোয় কিছুটা ঘুচেছে। যতটুকু বুঝতে পারলাম এটি হসপিটালের কোনো কেবিন। আমার মাথায় চিন্তার ভাজ পড়লো।হসপিটালের ধবধবে সাদা চাদরে হাত বুলিয়ে, অফুরন্ত ভাবনা গুলো ডানা মেললো। আশিকের শেষ পরিনতি কি হয়েছিলো? ভেবেই সজাগ হলো মস্তিষ্ক। ইউসুফ ভাই কই? মা-বাবা? নানাজান? আয়দা? সব কই? আমাকে একা ফেলে চলে গেলো এই নির্জন অন্ধকার রুমটিতে?আমি বহু কষ্টে উঠবার চেষ্টা করলাম। শরীরে কোনো জোর নেই। অসাড় দেহখানি। ঠিক তখনি একজন নার্স এসে ঢুকলো আমার কেবিনে। আমাকে জেগে দেখে কেবিনের লাইট জ্বালালো। চওড়া হাসলো,

” মেম আপনি জেগে গেছেন? আজ দু’দিন পর আপনার হুঁশ ফিরলো। ”
কবিনের আলোর ঝলমলে তড়িৎ-গতিতে আমার চোখে কাটার মতো লাগলো। ধীরে ধীরে চাইলাম। ভাড়ী লাগলো চোখের পল্লব। নার্সের কথা শুনে হতবাক। চকিতে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
” দু’দিন হুশ ছিলো না?”
নার্স মাথা নাড়ালো। তার কাজ শেষ করে আমাকে রেষ্ট করতে বলে বের হতে নিতেই আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
” আমার বাড়ির সবাই?”
মুচকি হাসলো এবার উনি,
” আপনার হাসবেন্ডের কথা জানতে চাইছেন তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি উত্তর দিলাম না, ইচ্ছেই করলো না। ইউসুফ ভাইয়ের উপর জমে থাক অভিমান হয়তো আটকালো তার কথা জিজ্ঞেস করার?। আমাকে উত্তর দিতে না দেখে উনিই বললেন,
” উনি গত পরশু সারারাত ছিলেন আপনার পাশে নির্ঘুম কাটিয়ে আপনার খেয়াল রেখেছেন, এক চুল নড়েননি পর্যন্ত। তবে কাল দেখিনি তাকে। আপনার বাবা-মা আছেন বাহিরে, পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ইউসুফ ভাই আমার পাশে ছিলেন ভেবেই মনের ভিতর প্রজাপতি রং ছড়ালো। এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি কাতুকুতু দিতে লাগলো । কিন্তু পরক্ষণেই নার্সের শেষ বাক্যটুকু বিবর্ন করলো প্রজাপতির রং। পাংশুটে মুখ আমার। ইউসুফ ভাই গত কাল কেনো ছিলো না আমার পাশে? কেনো? হোয়াই? এক বুক হতাশা নিয়ে আবারো শুয়ে পড়তে নিলাম। বুকটা ভাড় লাগছে। খুব করে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার অর্ধাঙ্গকে। আহ্ করে শ্বাস ছাড়লাম। বেডের পাশেই থাকা ছোট টেবিলটার উপর কিছু একটা দেখে চমকালাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠলাম।

আরে…. এ তো সেই ডায়েরি, বাবুইপাখির ডায়েরি। কিন্তু এখানে কেন? মনের কোনে আবারো প্রশ্নের তুফান শুরু হলো। কাকে কি জিজ্ঞেস করবো? কিছুই বুঝতে পারছি না। ভয়ংকর রকমের বুক কাঁপছে, দেহ কাঁপছে, হাত পা কাঁপছে। ঠান্ডা শীতল স্রোত বইছে শিরা-উপশিরায়। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। শুকনো ঢুক গিললাম আমি। কম্পন হাতে ডায়েরিটা কাছে নিলাম। ঠিক সেই আগের মতোই আছে এখনো ডায়েরিটি জ্বলজ্বল করছে “বাবুইপাখি ” নামটি। আমার বুকের বাম পাশে তীব্র ধারালো ছুরি যেন কেউ চালাচ্ছে। এতদিনে বুঝি উদঘাটন হবে সেই বাবুইপাখিটির?? আমি ডায়েরি খুললাম। একটি চিরকুট আয়দার,

” কুহুপু,ভাইয়ার ডায়রিটি তোমার কাছে পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব ছিলো। যখন হয়তো ডায়রিটি পড়বে, ভাইয়া তোমার থেকে ততক্ষনে বহুদূর থাকবে।”
বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো আমার। আয়দার কথার আগা-মাথা কিছুই ঢুকলো না আমার মগজে। ইউসুফ ভাই কি কোথাও গেছেন? কাকে জিজ্ঞেস করি? মনটা কেমন অস্থির হতে শুরু করলো। চোখ জোড়া বার বার গিয়ে ঠেকলো দরজায়। এই বুঝি আসবেন ইউসুফ ভাই? ক্ষন পল বিলম্ব হলো। বাবা-মাকে ডেকেও কারো পাত্তা পেলাম না। গেলো কই সব? আমি অস্থির মনটা নিয়েই পেইজ উল্টোলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো আমকর ছোট বেলার ফোকলা দাঁতের হাসির একটি ছবি। যার নিচে গোটা গোটা হস্তাক্ষরে লিখা,

” আমার প্রাণের স্পন্দন, আমার বাবুইপাখি। ”
সঙ্গে সঙ্গে আমার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ইউসুফ ভাইয়ের বাবুইপাখি-টা বুঝি আমি??? আমার বুকের হৃদপিণ্ডটা ধ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। হাত কাঁপছে। কেন? আমি পেইজ উল্টোলাম এক এক করে। প্রতিটি পাতায় যেন ইউসুফ ভাইয়ের মনটা খুলে রেখে দিয়েছেন উনি। কি সুন্দর সাবলীল প্রতিটি শব্দ।

ডায়েরি *
কুহুকে প্রথম যখন আমি দেখি, বাচ্চা মেয়েটি তখন ৬ মাসের, অ.. অা.. ও… করে কি যেন সারাক্ষণ বলতেই থাকে মেয়েটি। গোল গাল ভোরাকৃত মুখটাতে সব সময় ওর ছোট ছোট হাতের বুড়ো আঙুল মুখে দিয়েই রাখতো। আমার দেখতে খুব ভালো লাগতো। একটু পুতুল যেন। যখন সে হামাগুড়ি দিয়ে হাটতে শিখে, তখন সে হুটহাট আমার ঘরে চলে আসতো। এসেই আমার পায়ের সাথে লেপ্টে যেত। তার ভাষা কত কি বলতো। কোলে উঠার বায়না ধরতো। আমি শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলেই, আমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে ওর পিছনে পড়ে থাকতাম।

ধীরে ধীরে চোখের সামনে আমার চঞ্চলা বাবুইপাখিটি ফুড়ুৎ করেই বড় হয়ে গেলো। সে-বার ওর দাঁত পড়েছে প্রথম এতে সে বড্ড৷ নারাজ। দাঁত নেই বলে সকলেই ক্ষেপায়, সে অভিযোগ করে আমার কাছে। কাজিনরা সব তখন এক জোট, বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। সবাইকে সেদিন ধমকে উঠি আমি। ওর চোখের কান্না, ফ্যাকাসে মুখটা আমি কখনো সহ্য করতে পারতাম না। দিন শেষে হাসি হাসি মুখটা দেখলে আমার বুকে প্রশান্তির স্রোত বইতো। এক আকাশসম.. অনুভূতির নহর খেলা করতো ঢেউ তুলে। দিন যেতে লাগলো।

কুহুর শৈশব থেকে কৈশোরের কোঠায় পৌঁছে গেলো। বেরে গেলো এক অদৃশ্য দেয়াল। যে মেয়েটি ছোট বেলায় চিপস, চকলেটের জন্য বায়না ধরতো, সে এখন লাজুকলতা, আমাকে দেখলেই কেমন যেন চুপসে যেত। ভয় পেতো। আমার দারুণ লাগতো ওর ভয়ার্ত গোল গোল দৃষ্টি জোড়া দেখতে। একবার বাড়িতে ফিরে শুনি কুহুর বাবা-মা খুব চিন্তিত। মেয়েকে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দিবেন। সে কথা শুনতেই সেই রাতে আর ঘুম হলো না আমার। কুহু চলে যাবার পর থেকে অস্থির জীবন পাড় হতে লাগলো। কেমন জানি খালি খালি সব।

নিজেকে সব থেকে গুটিয়ে নিতে লাগলাম। কুহুকে অনেক মিস করতে লাগলাম। মা নাকি সন্তানের মনের হাল অবস্থা বুঝে যায়, তাই হলো। আম্মু আমার মনের অবস্থা বুঝে গেলো। সে রাগ করেনি আমার মনের বাড়ন্ত অনুভূতির জন্য। উল্টো কুহুকে দেশ ছাড়া করার কাহিনি বলল। সেদিন খুব রাগ হয় আমার। যাদের জন্য দেশ ছাড়তে হয় কুহুর সেই আশিককে আমি ইহচ্ছে মতো কেলিয়ে আসি। কিন্তু শা*লা কোনো ভাবে বেঁচে যায়। আমি দিন গুনতে থাকি। কুহু চলে যা্বার পর একটি কথা আর আমার সাথে বলেনি। আমি ওর ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম সব সময় ফোলো করতাম।

প্রোফাইল চেঞ্জ হতো, কভার চেঞ্জ হতো, মাস যেত, দিন যেত, রাত যেত। কুহুকে কাছে পাবার বিতৃষ্ণা ামাকে কুড়ে কুড়ে খেতো। কুহু জানে না, তার অগোচরে কত কিছু ওর জন্য আমি করেছি। কুহুর শৈশব থেকে কতটা আগলে আগলে রেখেছি। ওর বিপদে পাশে না থেকেও ছায়া হয়ে রয়েছি। আমার বাবুইপাখিটা খুব সরল মনের মানুষ। ওই মনটাকে নিয়ে যারা খেলতে চেয়ে তাদের জ্যান্ত পুড়িয়েছি। যারা ওর দিকে আঙ্গুল তুলেছে, তাদের হাত ভেঙ্গে দিয়েছি। কুহু দূর বিদেশ অথচ সেখানেও সে রয়েছিলো আমার ছায়াতলে। ওর প্রতিটি খবর আমি পেতাম।

ওর মনের খবর আমি জানতাম। কুহুর মনে আমায় নিয়ে তৈরি সুপ্ত অনুভূতি গুলো অজানা ছিলো না আমার। আমি সব জানতাম। কুহুর প্রতিটি চোখের জলের হিসাব, ঠোঁটে হাসির হিসাব, প্রতিটি সুখের হিসাব আমার কাছে আছে।আমি কুহুকে পেতে চাই, একান্তে কাছে চাই, আবদ্ধ করতে চাই ভালোবাসায়। আমি বাসায় জানালাম। সকলের মাঝে ইদ ইদ ভাব যেন। বিপত্তি হলো তখন যখন খুশির নহরে এক ফোঁটা বিষ নষ্ট করে দিলো সব আমার হুট করেই জ্ঞান হারানোর ফলে। যখন ফিরলো জ্ঞান জানতে পারলাম পৃথিবীর সুখ আমার জন্য বেশি দিনের নয়।

লড়াই করছি যে কোনো সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করাবার। আমি শক্ত হয়ে গেলাম, নড়ে উঠলো আমার দাম্ভিকতা, পৃথিবীর বুকে আমরা কিসের অহং দেখাই? কখন কার ডাক এসে পড়ে, কেউ জানে না। তবে আমার কুহু? এত কিছুর পর-ও, এতটা ভালোবার পর-ও কুহু আমার হবার নয়। এই ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি, বুকের ভিতরটা চুরমার হয়।নিজের উপর রাগ হয়, অভিমান হয় আল্লাহর উপর। কেনো এতটা সীমিত আয়ু আমার? কেনো আমার বাবুইপাখির সাথে একটু সুখময় রাত-দিন পাড় করতে পারবো না? কেনো পথ চলাটা দীর্ঘ হবে না।

কেনো ছোট বেলার মতো ওর আবদার গুলো পূরণ করতে পারবো না, কেনো ওর কোলে মাথা দিয়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বাদ দিতে পারবো না, এক থালায় ভাত মাখিয়ে আদরের সাথে আমার প্রিয় নারীকে খাওয়াতে পারবো না? কেনো তার মুখশ্রী দেখতে দেখতে দীর্ঘ সময়টা পাড় করতে পারবো না? কেনোই বা তাকে করতে পারবো না আমার অর্ধাঙ্গীনি? এই ভেবেই পুরো পৃথিবীতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার যে উপায় নেই, নিজের জীবনের গ্যারান্টি নেই। নেই নিঃশ্বাসের।

ইউসুফ ভাইয়ের ডায়রি পড়ে আমি কেঁপে উঠলাম, হাত থেকে পড়ে গেলো ডায়রিটা। বাতাসের তালে তালে উল্টোতে লাগলো পাতার পর পাতা। আমার চোখ ভিজে উঠলো, অজান্তেই গাড়িয়ে পড়লো জল টুকু। আমি কাঁপছি মৃদুমন্দ। দেহখানী ধীরে ধীরে যেন ঠান্ডা বরফ হচ্ছে। মস্তিষ্ক যেন আশেপাশের সব কিছু স্থীর হয়ে গেছে বলে জানান দিচ্ছে। আমি যেন অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছি গম্ভীর তলদেশে।

ইউসুফ ভাইয়ের কি হয়েছে?? আমার পুরো পৃথিবী যেন এখন অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এক ছুটে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। পায়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছিলা। চাপ পড়ায় আবারো রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না, পা ছ্যছরিয়ে বেড়িয়ে এলাম। আমার মাকে দেখেই তার বুকে লুটিয়ে পড়লাম। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার আর্তনাদ পুরো করিডোর জুড়ে।

” মা, মা, মাগো? ইউসুফ ভাই ভালো নেই, সে কই? আমি তাকে দেখতে চাই, সে কই মা, সে কেনো নেই এখানে, মাগো বলো না কই ইউসুফ ভাই?”
আমার মা আঁচলে মুখ লুকালেন। বাবা অন্য দিকে চলে গেলেন। তারদের এহেন কান্ডে আমার বুকের ভিতর থক করে উঠলো। আমি মায়ের পায়ের কাছে ধাম করে বসে পড়লাম। বুকে ফাঁটা কান্না এবার দম আটকে আসছে।

সংকটময় প্রেম পর্ব ১৩

” মা , ও মা। বলো না? ইউসুফ ভাই ঠিক আছে।”
আমার ছলছল নয়নে মা তাকাতে পারলেন না। আমাকে উঠিয়ে পাশের চেয়ারে বসালেন। আমার অবস্থা দেখে মা ধরা গলায় বললেন,
” ইউসুফ ”

সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (খ)