সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (খ)

সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (খ)
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

করিডরে পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে ক্ষন পল পর পর পায়ের শব্দে।
আমি মায়ের সাসনে বসে আছি, হাজারটা প্রশ্ন আমার চোখের নোনাপানিতে।আমার ছলছল নয়নে মা তাকাতে পারলেন না। আমাকে উঠিয়ে পাশের চেয়ারে বসালেন। আমার অবস্থা দেখে মা ধরা গলায় বললেন,

” ইউসুফ… ইউসুফ তোকে ধোকা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।”
আমি স্তম্ভিত হলাম। মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন অক্সিজেন পাচ্ছে না। আমি থম মেরে বসে রইলাম ডায়েরির প্রতিটা অক্ষর আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে। মায়ের কথার সঙ্গে কিছুই মিল পাচ্ছি না। আমি৷ যেন পাথর হয়ে গেলাম। শান্ত গলায় মায়ের হাতে হাত রেখে বললাম,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” মা… মাগো… আমি তোমার বড্ড খারাপ মেয়ে। আমি তোমার ভালো হতে পাড়িনি। কিন্তু ইউসুফ ভাই… সে তোমাদের আপন সন্তান না হয়েও আপন থেকে কম নয়। কেমন তার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো? বলোতো? সে একজন ভালো ছেলে, ভালো নাতি, ভালো নেতা, ভালো বর। শুধু শুধু এমন মানুষটার নামে অপবাদ কেন দিচ্ছো মা?”

মা এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার যেন হুট করেই বয়স বেড়ে গেছে ১০। কাঁচা পাকা চুল ধরছে মাথায়। আমার মনটাও কেমন যেন করছে, আনচান আনচান। যেন মনের পাখিটা ধাপড়াচ্ছে, বেড়িয়ে পড়তে চাইছে। আমি আরো শক্ত করে চেপে ধড়লাম মায়ের হাত খানা। মা বললেন,

“তোর ইউসুফ ভাইয়ের বড় অসুখরে কুহু। ও ভালো নেই। ওরা তোর ইউসুফ ভাইকে নিয়ে গেছে দেশের বাহিরে ট্রিটমেন্টের জন্য। ও…. ওর বাচ্চার গ্যারান্টি ৩০% পার্সেন্ট। ও যাবার আগে বলে গেছে, আমি যেন বলি তোকে সে তোকে ঠকিয়ে চলে গেছে দূরে।”

এবার আর কান্নার দমক আটকাতে পাড়লাম না। উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুটে নিজের কেবিনে চলে গেলাম। তার রেখে যাওয়া ডায়েরিটা আমার বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদলাম হু হু করে। এভাবে কেনো চলে গেলেন উনি? আমাকে একটি বার বললে কি হতো? তার বাবুইপাখিটা বুঝি এতটাই অবুঝ?

সময় গড়াতে লাগলো তিনেক। মাসের শেষ পর্যায়। আমি আমার বাবার বাড়ির ছাদে বসে আছি। দীর্ঘসময় বিচ্ছেদের, আমার আর আমার জীবনের। দীর্ঘসময় বিচ্ছেদের আমার অনুভূতি, আমার আবেগের। আজ কতটা দিন পাড় হলো… ইউসুফ ভাই নামক ব্যক্তিটির একটা শব্দের স্বর শোনা হলো না আমার কানে। গোধূলী লগ্ন।

ফুরফুরে বাতাস যেন গান গাইছে। ইউসুফ ভাই ছাড়া বিষন্নতায় কাটানো আরো একটি বেলা কাটিয়ে ঘনিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে। আমার হাতে ইউসুফ ভাইয়ের ডায়রিটা। প্রতিদিন এই ডায়রির ভাজে লিখা প্রতিটি কথার উত্তর আমি লিখি, পড়ি। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। আজকেও লিখতে বসে গেলাম। নাম ঠিকানা না জানা চিঠি গুলো। যা অবহেলা হয়তো এখনো পড়ে আছে ইউসুফ ভাইয়ের ডাকঘরে। আমি ছোট শ্বাস ফেললাম। কলম ঘুরিয়ে লিখতে বসলাম,
” ইউসুফ ভাই,

এই নিয়ে ১৩ বার লিখা আপনাকে আমার অনুভূতি গুলো। জানিনা কখনো আপনি পর্যন্ত আমার চিঠি গুলো পৌঁছায় কিনা। তবে সত্যি বলতে আমি আপনাকে খুব মিস করি। নীল আকাশের বুকে আমি আপনাকে খুঁজি, রাতের তারাতেও আপনায় খুঁজি।সোনালী এক মুঠো রোদের আপনার স্পর্শ খুঁজে পাই। বিষন্ন বিকেলে আপনার এক চিলতে হাসির ঝলক দেখতে পাই। অথচ পুরোটা ইউসুফ ভাইকে আর পাই না।

বড্ড অভিমান হয় আমার জানেন? বাবা আজ মাকে বলছিলেন, তারা আমাকে আবার বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি তো চাই না। আমি চাই আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত আপনার অর্ধাঙ্গীনি হয়ে থাকতে। আমার স্মৃতিতে বাঁচতে। আচ্ছা ইউসুফ ভাই আপনার মনে আছে, ছোট বেলায় একবার খেলার ছলে আপনি বলে ছিলেন, তুই আমার বউ। তুই আমার বউ থাকবি সবসময়। দেখুন না।

আজ সত্যি আমি আপনার বউ। অথচ সেই বউটাকে দেখার জন্য আপনি নেই। জানেন বাবা এখন অসুস্থ হচ্ছে, মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ছেলেটা থাকলে আজ আমার এত কষ্ট করতে হতো না। বুঝলাম, আপনি আমার বাবার বয়সকালের খুটি, মায়ের সব থেকে আদরের বাঁদর ছেলে, নানা ভাইয়ের অবসরের সঙ্গী। মামা-মামীর সাহারা। আর আমার……! অথচ দেখেন, আপনি আমাদের পাশে নেই। নেই আমাদের সুঃখ দুঃখে। আপনি জানেন এখন আমার চকলেট আইসক্রিম ফুচকা ভালো লাগে না। আপনি চলে যাবার পর যেন সব রং ধুয়ে মুছে সাদা আর কালো হয়ে গেছে। আমার রংহীন বিবর্ণ জীবনটা রাঙ্গাতে কি ফিরবেন না আর??”

আর লিখতে পারলাম না। বুক ফাঁটা কান্না আমার চোখের কোন বয়ে চলছে। ঠিক তখন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেলো আকাশটা। হুট করেই নেমে গেলো বৃষ্টি। ঝুপ বৃষ্টিতে ভিজে টাইটুম্বুর আমি। ভেসে যাচ্ছে চিঠির প্রতিটি পাতা। আমি চেয়ে দেখছি। বড্ড অসহায় লাগছে। আজ যদি ইউসুফ ভাই পাশে থাকতো? ইউসুফ ভাইয়ের বাবা-মার বড্ড অভিমান আমাকে নিয়ে। তাদের ধারণা তার ছেলের করুন অবস্থার জন্য আমি দায়ী। শুধু তারা নয় আমি নিজেও তাই ভাবি, আমার হুটহাট রাগ আমার জীবনের কাল, সেদিন না আমি সেখান থেকে পালাতাম, না খপ্পরে পড়তাম আশিকের। আর না ইউসুফ ভাই ফাইট করতেন, আর হয়তো আজ সে….!

আমি হাটুতে মুখ গুঁজে নিলাম। কেঁপে কেঁপে উঠলো পিঠ আর বুক। নোনাজল মিশে গেলো বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটাতে। ঠিক তখনি একটি চিরচেনা সুবাস মাখামাখি খেলো আমার চারপাশ। মুচকি আসলাম, প্রতিবার ভ্রম হয়ে আসে সে, মরীচিকা হয়ে হারিয়ে আজ তার ব্যতিক্রম হলো না। মস্তিষ্ক খেলে মাঝে মাঝে, আমার সাথেও খেলছে, এই খেলাটা মধুর লাগে আমার কাছে। ক্ষনিকের জন্য হলেও দোলা দিয়ে যায় অন্তরে। আমি সেভাবেই চোখ বুঝে বসে থেকে বললাম,

” ক্ষনপল দেখা দিয়ে আবারো-তো হারিয়ে যাবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে!”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। তাই আবার বললাম,
“কথা বলাটাও কি বারণ বুঝি। এত অভিমান? ”
প্রত্যুত্তর ভেসে এলো,

“অভিমান নেই।”
” তাহলে কি? রাগ!”
এবার হাসলো ঠোঁট,
” বাবুইপাখির উপর আমার কোনো রাগ নেই।”
আমি এবার মুখ তুলে তাকালাম। অলস কন্ঠে বললাম,
” তবে কেন এত দূরত্ব। ”

ইউসুফ ভাইয়ের ছাড়া মুর্তি আমা গা ঘেষে বসলেন। পাশে ভিজে যাওয়া চিঠিটা গড়গড় করে পড়লেন। তার সুন্দর মুখটা ফ্যাকাসে। শুকিয়েছে মনে হচ্ছে। তাহলে কি ইউসুফ ভাই সত্যি খুব অসুস্থ? ইউসুফ ভাই বললেন,
” দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতেই এসেছি।”
আমার অভিমানী গলা,

” প্রতিবার তাই বলেন, বড্ড খারাপ লোক আপনি। কিছুক্ষণ পর আবার হারিয়ে যাবেন।”
শেষ কথাটি কম্পন হলো কন্ঠে। তিনি নিস্তেজ চাইলেন। ভিজা চুলের গাছি কানের পিছনে গুঁজে দিলেন,
” তোর ১২ টা চিঠি আমি পড়েছি।”
চমকে উঠলাম আমি। পরক্ষণেই বললাম,
“খেলা কেন করছেন আমার অনুভূতি গুলো নিয়ে।”
উনি এবার আমার গালে স্পর্শ করলেন। কেঁপে উঠলাম তার শীতল স্পর্শে। হুহু করে উঠলো বুক। ঘোলাটে হলো নজর,
“এবার বিশ্বাস হলো তো?”

আমি জড়িয়ে ধরলাম ঝাপটে। বৃষ্টি এখনো কমেনি। দিন শেষে মানুষটা আমার পাশে ভাবতেই যেন পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।
“ইউসুফ ভাই আপনি ফিরে এসেছেন।”

আমি তার বুকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলাম। আজ যেন শান্তি লাগছে। খুব সুখী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি সেভাবেই কতক্ষণ কাটিয়ে দিলাম জানা নেই। ভেজা শরীরে বসে থাকতে থাকতে জ্ঞান হারাই তার বুকে। যখন চোখ খুলে নিজের ঘরে আবিস্কার করি নিজেকে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই দুঃখে কষ্ট ভেঙ্গে পড়লো হৃদয় আবারো ধোয়াশা। সত্যি সে নেই….! কিন্তু আমার ভাবান্তর ভেঙ্গে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন খাবারের প্লেট নিয়ে তিনি। গম্ভীর থমথমে কন্ঠে শানিত গলায় বললেন,

” দিন দিন এত শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন? তুই কি সিনেমার নায়কা হবি নাকি? এই সব ভুলে যা।”
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। হঠাৎ করেই যেন সব খুশি গুলো আমার ঝুলিতে ভরে গেলো। আমি উঠে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে বললাম,

” আমি শুধু আপনার জীবনের নায়কা হতে চাই ইউসুফ ভাই। কি নিবেন আপনার নায়কা হিসেবে?”
ইউসুফ ভাই খেক করে উঠলেন। তার অবতারণে সে ফিরে গেছেন ভাবতেই যেন খুশিতে বুক ভরে যাচ্ছে,
” ইউসুফ ভাই… আপনি আমার প্রাণের সামী।”
ইউসুফ ভাই বিষম খেলেন।খুক খুক কেশে উঠলেন,

সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (ক)

” নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার।”
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে তার গলায় ঝুলে পড়লাম,
” আপনার প্রেমে হয়েছি আমি বেহায়া, নির্লজ্জ।”
ইউসুফ ভাই তার নকলগম্ভীরতা ধরে রাখতে পাড়লেন না। হু হা করে হেসে উঠলেন। কুহুকে আবদ্ধ করলেন বুকে। ফিসফিস করে কানের কাছে গিয়ে বললেন,

সমাপ্ত