সংকটময় প্রেম পর্ব ১৩

সংকটময় প্রেম পর্ব ১৩
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

গহিন জঙ্গল। আমি দৌঁড়াচ্ছি। শুঁকনো পাতার মর্মর ধ্বণি গুঞ্জন তুলছে ভয়ানক রোমর্ষক। বড় বড় গাছ-গাছালি পিছনে ফেলে ছুটছি তো ছুটছি। জুতো জোড়া প্রায় ছিড়ে গেছে। দৌঁড়াতে হচ্ছে কষ্ট। আমি পিছনে ফিরলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জঙ্গলে ভিতরে ধীরে ধীরে হচ্ছে অন্ধকার। আমি প্রানপন চেষ্টা করে ছুটছি।

হয় বাঁচবো, নয়তো মরবো। তবুও ধরা দিবো না সেই নর পিশাচের হাতে। আশিক আমাকে তখন এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলোই বেহুঁশ করে দেয়। ওর শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড়ে নেতিয়ে পড়ি এক প্রকার পড়ে আর কিছু মনে নেই। কোথায় এনেছে বলতে পারছি না। গাড়ির ভিতর গহিন জঙ্গলের রাস্তার ধারে যখন নিজেকে একা পাই। পাশেই রাস্তার উল্টোদিকে যেন কি করছিলো তারা, জানানেই আমার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি সেই সুযোগই দৌঁড়। দেহে এবার আর শক্তি নেই। পাথরের টুকরোয় বেজে মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। হাত পা ছিলে গেলো।হাটু আর মাথায় ও ভালোই চোট পেয়েছি বুঝতে পারছি। আমি নিজেকে টেনে বসালাম গাছের নিচে কোনো রকম। হু হু করে কেঁদে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। খুব কষ্ট লাগছে। এই কেমন পরিস্থিতিতে পড়েছি আমি। এসব কবে শেষ হবে? আর কবেই বা মুক্ত শ্বাস নিতে পারবো।

পরক্ষণেই ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে নহলের আপত্তিকর পরিস্থিতির ছবিটি ভেসে উঠলো, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। এমন একটি হৃদয় ঘাতক দৃশ্য কেন আমার চোখেই পড়লো।যখন তার বাবুইপাখি তার পাশেই ছিলো, তাহলে আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলো? এবার সব ঘোলাটে লাগছে। তখনি কর্ণপাত হলো, কারো পদ ধ্বনি। আমি গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। লুকিয়ে পড়লাম ঝোপটাতে।

” জান… তুই খুব জ্বালাচ্ছিস আমায়। বেড়িয়ে আয়। আমি ধরতে পেলে তোর অবস্থা খারাপ করে ফেলবো।”
আমার দেহে ঠান্ডা স্রোত বয়ে চলে গেলো। একদম পাথরের মতো বসে গেলাম। এই ছেলের হাতে ধরা পড়ে নিজের সবটা বিসর্জন দিয়ার থেকে মরে যাওয়া শ্রেয়। কিন্তু আজ বোধহয় ভাগ্য আমার উল্টো দিকে বাহমান। বদমাশ লোকটার হাতেই ধরা পড়ে গেলাম। আশিক বেখাপ্পা হাসলো।হেঁচকা টেনে ধরলো আমার বাহু শক্ত করে। আমি ব্যথা ভয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলাম। আশিকের চোখে মুখে প্রতিশোধের স্পৃহায় দেখে থরথর করে কাঁপছি।
“প্লিজ আশিক আমাকে ছেঁড়ে দাও!”

আশিক শুনলো না। উল্টো ঠাটিয়ে চর বসালো আমার গালে। আমি ছিটকে পড়লাম মাটিতে। ও এবার নিজ কোমরের বেল্ট খুলে নিলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার শরীরের বেল্ট ধারা আঘাত করে বসলো। আমি গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগলাম। আশিক হাসতে লাগলো। যেন আমার প্রতিটি চিৎকার তার মনে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে। সে বলল,
” তোর জন্য আমার কত গুলো বছর নষ্ট হয়েছে জানিস? তোকে আমি হাজার টুকরো করে পানিতে ভাসিয়ে দিলেও বুকের জ্বালা কমবে না।”

আমি কাকুতিমিনতি করতে লাগলাম। বেল্টের আঘাতে আমার শরীর ফেঁটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি নেতিয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে। আমার শ্বাস ভাড়ী হচ্ছে, ভাড়ী হচ্ছে চোখের পলক। আমি এবার ধিক্কার দিলাম তারে,
” তোর কর্মফল পেয়েছিস তুই। আরো পাবি, আরো বেশি পাবি। এবার তোর মৃত্যু অনিবার্য। আমার বরটা কে জানিস তো? এক বার জানতে পারলে তোকেই গুম করে ফেলবে।”
আশিক হো হো করে হাসলো,

” কই তোমার বর? দেখি না তো? ও-হে… সে তো তোকে তার বউই ভাবে না।”
বলে আবারো হাসতে লাগলো সে। আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো আশিকের তিক্ত কথায়। সত্যিই তো সে তো আমাকে তার অর্ধাঙ্গ ভাবে না। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আশিক তখন ঝুঁকে এলো। তার কন্ঠে এখন তেজ নেই। উল্টো নরম সুরে বলল,

” আমার হয়ে যা কুহু। আমি তোকে রাজরানী করে রাখবো! আর যদি রাজি না হোস.. তাহলে দাসী করে রাখবো।”
আমি এক দলা থুতু ফেললো আশিকের মুখে,
” তোর স্বপ্নে এই ইচ্ছে পূরণ হতে দিবো না আমি। তার থেকে মরার পথ বেছে নিবো।”
আশিক খেপে গেলো তাতে। মুখের থুতু মুছে চেপে ধরলো আমার গলা। হিসহিসিয়ে বলল,
” মৃত্যুর এত শখ তোর। এমন মৃত্যু দিবো তোর, যে মানুষ কেন পশু পাখি তোর কাছে আসতে ভয় পাবে।”

আশিক এবার আমার জামায় স্পর্শ করলো। বুঝতে দেড়ি নেই, কি হতে চলেছে আমার সঙ্গে। আমি আবারো চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু লাভ হলো না। সে আমার কাছে ঘেঁষে আসতেই বন্দুকের গুলির শব্দ হতে লাগলো, পর পর কয়েকবার। এক প্রকার ফিল্মি স্টাইলেই যেন সময় মতো কোনো ফেরেস্তার আগমন ঘটলো। মনে মনে হাজার শুকরিয়া করলাম আল্লাহর কাছে। পর মুহূর্তে চিৎকার করতে লাগলাম,

” হেল্প, প্লিজ হেল্প।”
এতে যেন আশিক ভরকে গেলো। চেপে ধরলো আমার মুখ। যেন কোনো রা না বের হয়। কিন্তু আমি চেঁচিয়ে যাচ্ছি। অনেক চেষ্টা করছি কেউ শুনুক আমার কন্ঠ। কিন্তু আশিক তা হতে দিচ্ছে না। সে তার রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলো। পড়নের শার্ট খুলে বেঁধে দিলো দু’হাত। আমার চলার শক্তি নেই বললেই চলে প্রতিবাদ করার মতো। আশিক আমাকে কাঁধে তোলে নিলো। আমি ফুপিয়ে উঠলাম।

কোনো কি আশা নেই বেঁচে ফিরবার মতো? আমি নিজের ভার টুকু ছেড়ে দিলাম। হেরে যাওয়া মানুষের মতো। যেন একদম ১০ বছর বুড়ো হয়ে গেছি। ঠিক তখনি আশার আলোর মতো এক চিরচেনা কন্ঠ ভেসে এলো কানে। আমার চোখে মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটলো। সারা শরীরে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো কি যেন বয়ে গেলো। এক চিলতে হাসি ফুটলো ঠোঁটে। আমার সব ডর মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো। আমি আশিকের পিঠে জোরে কিল বসালাম। যার ফলে আশিক ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো। আর আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। অনেক কষ্ট বাঁধা হাত দিয়ে মুখ খুলে এবার চিৎকার করতে লাগলাম,

” ইউসুফ ভাই… ইউসুফ ভাই প্লিজ হেল্প।”
আশিক ততক্ষণে হুঁশে ফিরলো। তার পরিকল্পনায় এক গাদা পানি ঢেলে দেওয়াতে কসিয়ে চর বসালো। ঠোঁট ফেঁটে এবার তরল পদার্থ বেড়িয়ে এলো। টনটন করছে ব্যথায় গাল। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি সে। পাশের একটি বড় পাথর তুলে নিলো সে। রাগে ফোসফোস করতে করতে বলতে লাগলো,
” তুই আমার হবি না, আমি কারো হতেও দিবো না। ”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত বড় পাথর আমার শরীরের কোনো অঙ্গ পতঙ্গে পড়লে নির্ঘাত থেতলে যাবে? আমি চোখ বুঝে ফেললাম খিঁচে। এই লোকের থেকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো। আমি মনে মনে কালেমা পড়ে নিলাম। অনেক পাপ করেছি, হয়তো তার শাস্তিসরূপ এই নরপিশাচের হাতেই মরতে হচ্ছে আমাকে? আমি শরীরের ভার ছেড়ে নেতিয়ে পড়লাম। কিছু সুখের স্মৃতি ভেসে উঠলো পর পর চোখে। আমার ছোট বেলা, আমার মা-বাবা, আমার প্রথম প্রেম… প্রথম ভালোবাসা “ইউসুফ ভাই”

আমি চোখ বুঝলাম। ঠাস করে তীব্র শব্দ হলো। আমি চোখ খুললাম চট করে। নিজের সামনে ইউসুফ ভাইকে দেখে স্বপ্ন ভেবেই বসলাম। এসব তো সিনেমাতেই সম্ভব তাই না? শেষ মুহূর্তে নায়ক এসে তার নায়কাকে বাঁচিয়ে নিবে? এইটাই তো স্বাভাবিক? তবে বিশ্বাস হলো, পাশেই আশিকে পরে ধাপড়াতে দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তার মানে সব সত্যি?

একদম সত্যি? আমি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলাম ইউসুফ ভাইয়ের দিকে।তিনি বেধারক পেটাচ্ছে আশিককে। আমি বিস্মিত। তার বরাবর শান্ত, গম্ভীর চোখ জোড়ায় আজ হারিয়ে ফেলার ভয় স্পষ্ট বুঝতে পাড়ছি। বিচলিত সে। তার কঁপালের বলি রেখা, এলো মেলো চুল, মুখের ফ্যাকাসে রং আর পরনের পোশাকে কুঁচকে যাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটি কতটুকু পেরেশানিতে ছিলো।

ইউসুফ ভাই আমার কাছে ছুটে এলেন। তার পিছনে বডি গার্ডের স্কট। আশিককেও ধরে রেখেছে তিন চার জন। ইউসুফ ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। অপরূপ সুন্দর বিলাই চোখ জোড়ায় আজ জল টলমল করছে। এটি বুঝি আমার জন্য? উনি আমার রক্তে মাখা গালে হাত রাখলেন, ভাবটা এমন যেন ব্যথা তিনি পেয়েছেন! পরক্ষণেই তার সেই বাবুইপাখির সাথে কাটানো মুহুর্ত ভেসে উঠলো আমার অক্ষিপটে। আমি মাথা নত করে ফেললাম। তার প্রতি অভিমান ভার হলো এক ঘর। ইউসুফ ভাই কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

” ঠিক আছিস তুই?”
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। উঠার বৃথা চেষ্টা করলাম।শরীর কাঁপছে আমার। কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। কোনো রকম অভিমান জড়ানো কন্ঠে বললাম,
” আপনি কেন এসেছেন এখানে? কি জন্য এসেছেন? জান আপনার বাবুইপাখির কাছে যান। আমি কে হই আপনার। মরে যেতে দিন রাস্তা ক্লিয়ার হবে উল্টো আপনার।”

ইউসুফ ভাইয়ের মুখ থমথমে হয়ে গেল। আমাকে টেনে দাঁড় করালো। ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম। উনি বললো,
” অনেক ফালতু কথা বলেছিস, আর একটিবার কোনো কথা বললে, আমি তোকে মেরে গুম করে দিবো এখানে।”
আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। আমার অভিমান এই লোকের চোখে পড়লো না, আমার দেহের ক্ষত কি তার চোখে পড়লো না, পড়লো না কি আমার চোখের কোন ভেসে উঠা। আমি বুক ভরা হাহাকার নিয়ে বললাম,

সংকটময় প্রেম পর্ব ১২

” শুকরিয়া আমাকে বাঁচাবার জন্য, এবার আমি যেতে পাড়বো। ”
বলেই আমি পা ছেঁছড়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু দেহো টা আর সাথে দিলো না লুটিয়ে পড়লাম। তার আগেই শক্ত দু’টো হাত আমাকে আগলে নিলো। আমার ছলছল নয়ন থেকে গড়িয়ে পড়লো জল।

সংকটময় প্রেম শেষ পর্ব (ক)