সংকটময় প্রেম পর্ব ১২

সংকটময় প্রেম পর্ব ১২
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

বাহিরে আজ তপ্ত রোদ। রোদের তেজে পুড়িয়ে ছাড় খার করবে হয়তো সব কিছু। তবে বাহিরের রোদ থেকে শীতল আমার রূহ। ঠোঁটের কোনে আমার লাজুক হাসি। তপ্ত দিনেও আমার কথা ভাবা বাদ দিয়ে আবারো জুটে গেলাম ইউসুফ ভাইয়ের দুপুরের খাবার তৈরি করতে। আজ জিদ ধরেছি খাবার আমি নিজ হাতেই করবো রান্না। মনোরমা তাতে বড্ড ভয়ে আছে।

তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এই বুঝি তার গলায় কেউ ছুরি চালিয়ে দিবে। আমার সেদিকে হুঁশ নেই। আমার এখন একটাই গন্তব্য ইউসুফ ভাইয়ের দুপুরের খাবার। মনোরমা এতে আমাকে অনেক সাহায্য করছে। ইউসুফ ভাইয়ের পছন্দের খাবার মুড়ি খন্ড আর কলিজা ভুনা সাথে গরম গরম সাদা ভাত। তার সাথে ডিম অমলেট করা। সব কিছু অলমোস্ট রেডিই। সকালের পোড়া জায়গায় টা আবার জ্বলছে। কিন্তু আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে। নিজ হাতে প্রথমবার ইউসুফ ভাইয়ের জন্য কিছু করতে যাচ্ছি। এত খুশি কেন হচ্ছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খাবার সব গুছিয়ে দিলো মনোরমা। আমি নিজেও বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটলাম খাবার নিয়ে। গন্তব্য ইউসুফ ভাইয়ের অফিস। বুকের ভিতর দুরুদুরু করছে। সকালের অকস্মাৎ ঘটনায়, ইউসুফ ভাই ভরকে আছেন নিশ্চয়ই। আমাকে দেখে এবার না হার্ট অ্যাটাক করে। হয়তো আবার দু’ তিনটা চর থাপ্পড় দিতেও পারেন। মনে মনে হাসলাম আমি।

গাড়ি ছুটছে, বড় বড় দালান, পথচারী মানুষ, দোকানপাঠ পিছনে ফেলে স্বাই করে থেমে গেলো গাড়িটি ইউসুফ ভাইয়ের বিশাল বড় অফিসটা সামনে। ক্ষনিক ভয় হচ্ছে। প্রথমবার না বলে কয়ে, হুট করে আসা অফিসের লোকজন কি যেন ভাবে? পরক্ষণেই শীরউঁচু করে সামনে এগিয়ে গেলাম। কি ভাবিবে? আমি এই অফিসের মালিকের এক মাত্র ছেলের আদরের পুত্র বধূ। কে কি বলবে, না বলবে তাতে আমার জেনে কি কাজ? আমি হুড়মুড় করে ডুকে গেলাম। নিচে বসে থাকা সুন্দরী রিসিপশনের মেয়েটি বললাম,

” আপনাদের বসের কেবিন কোনটা?”
মেয়েটি নিচু হয়ে কিছু করছিলো। আমার কথায় ভ্রু -কুচকে তাকালো। যেন অতি বিরক্তি হলো আমার উপস্থিততে! বলল,
” স্যার বিজি আছেন। আপনি কে? আর কি কাজ?”
আমি মেয়েটির কথায় কিছুটা অবাক হলাম। এই মেয়ে আমাকে চেনে না? অবশ্যই না চেনার কথা। বিয়েটা আমাদের যে
সিনেমাটিক হয়েছে তাতে চেনাই স্বাভাবিক। আমি গলা পরিস্কার করলাম। মুখের ভাব অত্যাধিক গম্ভীর করে বললাম,
” আপনার স্যারের বিবিজান আমি।”
মেয়েটি চমকে গেলো যেন। পরক্ষণেই হেসে ফেললো,

” মেম এমন অনেকেই আসে স্যারকে তার গার্লফেন্ড, বান্ধবী, কত কিছু বলে পরিচয় দেয়। তবে আপনার টা ইউনিক ছিলো, সোজা বিবিজান। আপনি ও নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কেউ? ”
মেয়েটি যেন, হাসতে হাসতে এবার মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাবে। আমার এবার রাগ উঠে গেলো। ফোন থেকে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিয়ের ছবি বের করে তুলে ধরলাম মেয়েটির মুখ বরাবর। মেয়েটি যেন এবার হা হয়ে গেলো। মুহূর্তে অন্ধকার নেমে এলো হাসি মুখে। বলল,

” আই এ্যাম সরি মেম। আমি জানতাম না। ডেইলি এত মেয়ে স্যারকে প্রেম নিবেদনের জন্য আসে, কি বললো। আমি ভেবেছি আপনিও। আমি দুঃখীত।”
আমি আরো ভাব নিলাম। মেয়েটির কথা অগ্রাহ্য করে বললাম,
“আপনার স্যারের রুম?”
মেয়েটি থতমত খেয়ে বলল,
” মেম স্যার সত্যি বিজি আছেন। ”
আমি বাঁকা চোখে তাকাতেই মেয়েটি হাত উঁচু করে বলে উঠলো,
” 5th ফ্লোর।”

আমি আর দাঁড়ালাম না। গটগট করে চলে গেলাম লিফট করে পাঁচতলা। মেয়েটির পাঙ্গসুটে মুখ দেখে সেই মজা লাগেছে আমার। লিফটি আপন গতিতে এসে থামলো তার গন্তব্য। লিফট থেকে বের হতেই মৃদু শীতল মিষ্টি বাতাস স্পর্শ করে গেলো আমার দেহে। দোল দিয়ে গেলো আমার মনে। শিরশিরানি অনুভূতি। উপরে তেমন কাউকে চোখে পড়লো না।

একটি কেবিনের সামনে জ্বলজ্বল করছে একটি নেইম-প্লেট ” ইউসুফ চৌধুরী ” আমি নামটি স্পর্শ করলাম এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই মানুষটি আমার অর্ধাঙ্গ। গর্বে বুকটা ভরে গেলো। আমি নক না করেই ঠেলে ঢুকে গেলাম ভিতরে কোনো কিছু না ভেবেই। কিন্তু কখনো ভাবিনি এত বড় সারপ্রাইজ পাবো ভিতরে ঢুকতেই আমার ভাবনার বাহিরে ছিলো।

একটি সুন্দরী রমনী যার পড়নে বিদেশি ওয়েস্টার্ন ড্রেস সে ঝুঁকে আছে ইউসুফ ভাইয়ের উপর। ইউসুফ ভাইয়ের ভাবলেশহীন মুখ গম্ভীর করে আছে।মেয়েটির শুধু পিছন থেকে তার মেদহীন আকর্ষনী দেহ দেখা যাচ্ছে। আমার শরীরে থপথপ করে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। সকাল থেকে এত কষ্ট করেছে ঠিক এই রকম একটি দৃশ্য দেখার জন্য? আমার চোখ ফেঁটে জল বেড়িয়ে গেলো। দরজা খোলার শব্দে তারাও তাকালো আমার পানে। সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলো পা থেকে মাটি আমার। একদম মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা। মেয়েটি আর কেউ না, ইউসুফ ভাইয়ের কাজিন নহল। যাকে দেখেই আমার চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। তাহলে বুঝি এই সেই “বাবুইপাখি ” ভাবতেই হৃদয় ভাঙ্গন হলো। ইউসুফ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। নহল কোমড় সোজা করে দাঁড়ালো। বাঁকা হেসে বলল,

” হে’ই কুহু যে এখানে হঠাৎ?”
আমি উত্তর দিলাম না। এই মুহূর্তে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। যদি নহলই তার বাবুইপাখি হয়? আমাকে কেন বিয়ে করলো সে? আমার এবার শ্বাস নিতে কষ্ট হলো। শক্ত চোখে তাকিয়ে দেখলাম দু’দিন আগে হওয়া আমার অর্ধাঙ্গকে, ঠান্ডা ভাবাবেগ তার। যেন সব স্বাভাবিক। উনি ধীরে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। পকেটে হাত গুঁজে, উদাসীন গলায় বললেন,
” এখানে কি করছিস তুই?”

আমি হতবাক। এক পলক তাকালাম তার দিকে। তার এত বড় কু-কর্ম আমার সামনে খুলে গেলো, অথচ লোকটির কোনো ভাবান্তর নেই। আমি যে তার ঘরের বউ সে কি ভুলে গেছে? নাকি তার বাবুইপাখির কাছে আমার দাম নেই? দাম তো নেই। কেনো থাকবে? এই বাবুইপাখি তার সমস্তটা জুড়ে বিরাজমান। তবে নহল? এই দুমুখো সাপ তার বাবুইপাখি? যার নাকি হাজার টা ছেলের সাথে রঙলীলা? আমার মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। চোখের জল টুকু মুছে নিলাম। এই অশ্রুটুকুর দাম ও নেই এই লোকের কাছে। আমি হতাশার শ্বাস ছাড়লাম। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললাম,

” খা.. বা.. র, খাবার এনে ছিলাম আপনার জন্য। মনে হচ্ছে আর লাগবে না। আপনার কোয়ালিটি টাইম নষ্ট করার জন্য দুঃখীত। আপনি থাকুন আপনার বাবুইপাখির সাথে। আসছি।”
বলে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলাম সেখান থেকে। আর এক মুহূর্তও না দাম আটকে না হয় মরবো আমি। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। চারপাশের মানুষ আমাকে দেখছে। তাতে আমার কোনো কিছু যায় আসে না। আমি এক দৌঁড়ে নিচে চলে এলাম। গাড়িতে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। বুকের ভিতরটা এত ব্যথা কেন করছে? ড্রাইভার চাচা অবাক হয়ে চেয়ে আছেন আমার দিকে। কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও বুঝতে পারছি দ্বিধায় পড়ে গেছেন। আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। চাচাকে বললাম,

” খাবার টা সামনে ওই বাচ্চাটাকে দিয়ে আসেন।”
চাচা নড়লেন না। আমি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললাম,
“আমি ঠিক আছি চাচা, আপনি দিয়ে আসুন।”

চাচা বেড়িয়ে গেলেন। এই সুযোগে আমি ও নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। ইউসুফ ভাইয়ের বাড়িতে আর যাবার ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। তাই আনমনে হেটে চললাম। এই শহরের তেমন কিছু আমার চেনা নেই। পর পর কিছু ইন্সিডেন্ট হয়ে যাওয়াতে আমার বাহিরে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে সবাই। আজ মুক্ত বাতাসে হেটে ভালোই লাগছে। গন্তব্যহীন পথে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। নীলচে আকাশে সিঁদুর রাঙ্গা মেঘ খেলা করছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে কাঠগোলাপের সুবাস। আমি এদিকে সেদিকে চাইলাম। হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এসেছি।এবার হুঁশ ফিরলো আমার। ফিরে যাবার রাস্তাটাও বেমালুম ভুলে গেছি। হাতের ফোনটাও গাড়িতে ফেলে এসেছি। নিজের বোকামীতে নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে। এত কেন রাগ আমার? রাগের মাথা সব সময় উল্টো পাল্টা করে ফেলি। আমি নিজেকে নিজেই ঝেড়ে যাচ্ছি। তখনি পিছন থেকে কেউ হেঁচকা টান দিলো আমাকে। আমি ঘুরে গিয়ে পড়লাম তার বুকের উপর। ভয়ে খিঁচে চোখ বুঝে আছি। কানের মাঝে তার বাক্য পৌঁছাতেই সঙ্গে সঙ্গে তাকালাম।

” জান…।”
ভয় এবার কুঁকড়ে খেলো আমার দেহ… আমি ধাক্কা দিয়ে দূরে যেতে চাইতেই আমার হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো ব্যথা চিৎকার করে উঠলাম,
” আ…শি…ক তুই! ছাড় আমাকে।”
এক প্রকার চেচামেচি করতে লাগলাম। আজ বুঝি আমার শেষ দিন? আশিক হাসলো। বলল,
” অনেক দিন পর খাঁচার পাখি খাঁচায় বন্দী হবে।”
আমি ওর কথায় বিস্মিত,
” কি করতে চাইছিস তুই?”
“অবশ্যই পুজো করবো না।”

আমি এবার ছোটাছুটি বেশি করতে লাগলাম। নিজের কথা বোকামিতে এভাবে ফেঁসে যাবো ভাবানাতেই ছিলো। তবে কি সত্যি আমার দিন আজ শেষ হবে? আমি আশে পাশে তাকালাম। শূন্য রাস্তায় আশিক আর তার চেলাপেলা ছাড়া কেউ নেই। আমি চোখের জল ছেড়ে দিলাম। ওর পায়ের কাছে বসে পড়লাম। হাত জোর করে বললাম,
” প্লিজ আমাকে যেতে দাও।”
আশিক ভিলেন মার্কা হাসি দিলো। এক হাটু গেড়ে আমার সামনে বসলো। আমার মুখ চেপে ধরলো শক্ত করে। হিসহিসিয়ে বলল,

সংকটময় প্রেম পর্ব ১১

” পুরোনো সব হিসাব আজ ক্লোসড করবো। ”
আমি চকিতে তাকালাম। আশিকের চোখে মুখে খেলা করছে হিংস্রতা। এবার কি হবে? কি করবো আমি? এই নিরবচ্ছিন্ন জায়গায়, নিজের সবটুকু বিসর্জন দিতে হবে? হতে হবে কালকের খবরের হেড লাইন? আচ্ছা ইউসুফ ভাই কই? সে কি আমাকে খুঁজবে? পড়বে তার বিলাই চোখ জোড়া হতে দু’ফোটা জল??

সংকটময় প্রেম পর্ব ১৩