সংকটময় প্রেম পর্ব ১১

সংকটময় প্রেম পর্ব ১১
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমি রাগের দমকা কমাতে শুঁকনো ঢুক গিললাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,
” বউকে বুকে নিয়ে পরনারীর নাম নিতে লজ্জা করে না? নেতাদের বুঝি সত্যি ক্যারেক্টারে দোষ থাকে???”
ইউসুফ হতভম্ব হয়ে গেলেন যেন। গোল গোল চোখে চেয়ে রইলেন শুধু। তার ভাব খানা এমন যেন আমি আষাঢ় মাসের গল্প করছি। উনি কিছু বললেন না।

কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে উল্টো পাশে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। তার এহেন কান্ড রাগ বাড়লো বৈকি কমলো না। রাগে গজরাতে গজরাতে আমি শুয়ে পড়লাম। এবং ইউসুফ ভাই আর তার বাবুইপাখির গুষ্টি তুষ্টি করতে লাগলাম। মনে মনে পণ করে ফেললাম, এই বাবুইপাখিটা কে তাকে এবার ধরতেই হবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পূর্ব আকাশে সূর্য উদয় হয়। গুন গুন গান করে পাখিরা ভোরের নিস্তব্ধতা দূর করছে। সোনালী এক ফালি আলো বড় জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। অন্ধকার ঘরময় ঝলমল করছে আলোর চাকচিক্যময় সামগ্রীতে ঠাঁসা রাস্তায়। আমি দুঃখ দুঃখ মনে হাঁটছি। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের হুইসলার। মন চাইছে এক ছুটে চলে যাই স্টেশন। হারিয়ে যাই গন্তব্যহীন কেনো পথে। কেনো? কেনো আমার ছোট মন, প্রান চঞ্চল হয়ে উঠছে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুত করেই উড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। হরতাল করতে চাইছে মনের বিরুদ্ধে! আমি সত্যি হাটা ধরলাম।

বৃষ্টি বিলাস বাড়ির বাগান পেড়িয়ে মূল ফটকে চলে এলাম। কিন্তু দরজা বন্ধ। দারওয়ান চাচা নেই। হয়তো ঘুমুচ্ছেন। আচ্ছা এই মুহূর্তে কারো ঘুম নষ্ট করা ঠিক হবে? না হয় একটু হলো? পরমুহূর্তেই মন পাল্টে গিয়ে বসে পড়লাম বাগানের মাঝ খানের দোলনা টায়। এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনের উথাল-পাথল প্রশ্নের সব উত্তর খুঁজতে শুরু করে দিলাম। আমার মনের প্রথম প্রশ্ন? কে সে ওই বাবুই পাখি??? কে সে?? মনটা আবার বিতৃষ্ণায় ভড়ে গেলো। হতাশ চোখে আকাশ পানে চাইলাম। আকাশ পরিস্কার হলেও ক্ষনিকের মন খারাপের মেঘ রূপে উড়াউড়ি করছে।

কি সাবলীল তাদের ভঙ্গি। ইউসুফ ভাই ঘুমুচ্ছে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে আমার বুক থুকথুক করে উঠছিলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো এই সুদর্শন বিলাই চোখ ওয়ালা আমার অর্ধাঙ্গ?ভাবতেই বিতৃষ্ণা তৃষ্ণা জুড়ায় মনে। এক ছুটে রান্না ঘরে গিয়ে ঘটঘট করে পানি পান করলাম। এবার শান্তি লাগছে। পরক্ষণেই চুলোর উপর নজর পড়লো। এ মুহূর্তে বাড়ির সবাই ঘুম। কাজের লোক পর্যন্ত সজাগ নেই। আমার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেলো। বহুত শুনেছি,
” ছেলেদের পেটের মাধ্যম হয়ে নাকি মনের মাধ্যম পর্যন্ত পৌঁছানো যায়? ”

আমার মুখে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠলো। আমি ঘটাংঘট ছুড়ি তুলে নিলাম পাক্কা রাধুনির মতো। কিন্তু এখানেই আমার মনের খুশি উবে গেলো। আমি যে কিছুই রান্না করতে পারিনা। আমার কান্না পেলো। কেন মা আমাকে রান্না করা শিখালো না ভেবেই রাগ উঠলো। এর বিকল্প কি হতে পারে ভাবতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোন নামক যাদুর বাক্সটা বের করে ফেললাম। এবং ইউসুফ ভাইয়ের জন্য কোনো ঝামেলা ছাড়াই একটু ঝটপট খাবার রান্না করা যায় তা সার্চ করতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম খুব সহজ একটি খাবার। যদিও রান্না ক’ খ আমার জানা নেই।

তাই প্রথমে ইউটিউব ওন করে একে একে যা যা লাগবে সব সামনে রাখলাম। এবার যেভাবে যা দিয়েছে তাই করলাম। বিপত্তি বাজলো তখন যখন সবজি কাটতে হলো। আমি সবচি কাটতে গিয়ে সব এবারো থেবড়ো করে ফেললাম। তারপর চুলায় গরম তেল ঢেলে দিলাম। এদিকে সব কোনো রকম করে পেঁয়াজ কাটার সময় হলো বিপদ। দু’ তিন টুকরো করতেই ধাক লেগে গেলো চোখে। তাতেই জ্বলতে শুরু করলো আমার চোখ। তার উপর চোখে পানি মুছলাম পেয়াজ কাটার হাতেই। এবার আর চোখে কিছু দেখতেই পাচ্ছি না।

চ চোখের বন্যা শুরু হয়েছে। ঝাঁঝালো ধাকে আমার নাজেহাল। হুট করে আমি নড়াচড়া করতে করতেই গরম তেলের কড়াইয়ে হাত লাগিয়ে ফেলি। ওমনি ধপাস করে পড়লো হাতের উপর আমার। আমি এবার গগনবিদারী চিৎকার করলাম। দৌঁড়ে এলো কেউ। আমি চোখ আর হাতের টন টন জ্বলা দাঁত চেপে সহ্য করতে পারলাম না হেঁচকি তুলে কান্না শুরু। তখনি কেউ ধমকে উঠলো,
” এই বেকুব মেয়ে? তুমি এসব কি করেছিস?”

আমার দুঃখের মাঝে ১০০ গুন দুঃখ বাড়িয়ে দিলো এই ব্যক্তিটি। ব্যথিত্ব হাত টেনে ধরে কই একটু আদরু, আহ্লাদে পানি ঢালবে? নাহ্ সে তার তেজী কন্ঠে আমাকে আরো বকছে? আমার চোখ এখনো বন্ধ। ফুপিয়ে যাচ্ছি। অভিমানে সরিয়ে নিতে চাইলাম হাত। কিন্তু পাড়লাম না। আচ্ছা আজ যদি তার বাবুইপাখি এখানে থাকতো? তাহলে কি সে এমন করে বকতে পাড়তো? নাহ্! মোটেও না। আমার কান্না বেগ বেড়ে গেলো। এই বদ লোকটি আবারো ধমকে উঠলো। এবার আমার কান্না পুরোপুরি কমে গেলো। অভিমানের বুক টা ভাড়ী হলো। একদম চুপ করে গেলাম। মুখে যেন কুলূপ লেপলাম। ইউসুফ ভাই আমাকে উঠলেন। বললেন,

” এখানে কি করতে এসেছিলিস তুই? রান্না ঘরটার ঘুষ্ঠির তুষ্টি করে দিয়েছিস।”
আমি চুপ। উনি আমার দু’টো সিনে পানির কল ছেড়ে ধরলেন। আবার বললেন,
” চোখ বুঝে আছিস কেন? কি সমস্যা? ”
আমি এবারো চুপ। উনি যেন ক্ষেপে গেলেন তাতে, মাথায় জোড়ে একটি চাটি মেরে বললেন,
” মুখে কথা বলবি? নাকি যেটুকু তেল আছে তা জ্বিবে ঢালবো? ”

আমি ছিটকে দু’কম সরে গেলাম কি ডেঞ্জারাস লোক বাবা। না জানি তাই করে বসে, এই নেতা, খেতার আবার ভরসা নেই। এমন করিতেও পারে। আমি শুকনো ঢুক গিলাম। কান্নার দমকা রয়ে গেছে স্বরে। বললাম,
” চোখ জ্বলছে, পেঁয়াজের ধাক লেগেছে। ”

বিপরীতে তার কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। সে সুন্দর করে আমার হাত দুটো ধরে বাহিরে নিয়ে গেলেন। সোফায় বসিয়ে দিলেন। এরপর আবার যেন কোথাও চলে গেলেন। কষ্ট হলো। একটুও গুরুত্ব নেই তার আমার জন্য? এইটুকু না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখ খুলবো তার আগেই অনুভব করলাম ঠান্ডা ভেজা কাপড়। আমার চোখে চেপে ধরেছেন উনি। আমি বিস্মিত সত্যি উনি ফিরে এসেছেন? আমার জন্য এতটুকু কেয়ার করছেন? ভাবতেই খুশি হয়ে গেলো আমার মন। ধীরে ধীরে এবার উনি ফু দিতে লাগলেন।

তার উঞ্চ গরম শ্বাস আমার চোখে মুখে বাড়ি খাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার সুশ্রী রূপ দেখছি মুগ্ধ হয়ে। সফেদ মুখে চিন্তার ছাপ। তার মানে এই ব্যক্তিটিও আমায় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে? ভাবতে ঠোঁটে এক চিলতে হাসির ঝলক ফুটলো। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো ইউসুফ ভাইয়ের চোখ জোড়ার অতল গহ্বরে। তার দেহের মাতাল করা গন্ধ আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ঠে কোথাও যেন মিষ্টি সুরে গান বাজছে। মধুর ধুন গিটারের তারগুলোতে অনুরণন তোলে বারবার। আমি ড্যাব ড্যাব করে তার সাম্য সুন্দর্য দু-চোখ ভরে দেখছি। আরাম আরাম অনুভব হচ্ছে এ মুহূর্তে। কিন্তু ওই যে বেরসিক লোক। আবারো দমকে উঠলেন। ভ্রু-কুচকে বললেন,

” চোখ দিয়ে আমায় গিলছিস কেন? তুই জানিস না? আমাকে হজম করা কঠিন? ”
আমি থতমত খেয়ে ফেললাম। চোর ধরা পড়ে গেলে ঠিক যেমন হয়? আমার এখন সেই অবস্থা। আমি চোরা চোখে আবার চাইলাম। অবশ্যই এই লোকটি আবার আমাকে কথার মায়াজালে ফেলতে চাইছে? আমি তা কিভাবে হতে দেই? আমার সাথে তো v/s তার বাবুইপাখির লড়াই নিশ্চয়ই। আমি মুচকি হাসলাম। আমার দু ‘ হাতের বাহুডোর আবদ্ধ করে ফেললাম। লাজুক হাসি নিয়ে তাকে ঝুঁকিয়ে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,

” আপনাকে দেখে বড্ড প্রেম প্রেম পাচ্ছে ইউসুফ ভাই। নিজেকে যে কন্ট্রোল করতে পারছিনা। মন চাইছে গিলে নয়, আপনাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। গিলে খেলে কি সে মজা পাবো নাকি? গিলে খেলে আপনাকে খাবার স্বাদ না আমার মুখ বুঝবে না আমার দাঁত। তবে কিভাবে বলেন তো পাকস্থলী তা হজম করবে?”
বলেই উনার গালে ভেজা চুমু একে দিলাম। উনি কেশে উঠলেন। বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখতে লাগলেন। হয়তো আমার কথা আর কাজে উনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি সেই মজা পাচ্ছি। ভিতরে ভিতরে হেসে কুটকুট হচ্ছি। উনি আমাকে এক প্রকার ধাক্কিয়ে দূরে সরে গেলেন।

” মনোরমা আমাকে চা দেও।”
বলতে বলতে বড় পা ফেলে একপ্রকার গায়েব হয়ে গেলেন। তার এহেন কান্ডে এবার না হেসে পাড়লাম না। আমি সোফায় গা এলিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তটা টিভি স্ক্রিনে এডভার্টাইজমেন্ট এর মতো বার বার ভাসছে। মনে হচ্ছে এখনো পড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। ওর শরীরে মন মাতানো সুগন্ধের সমারোহ আমার দেহের আনাচে-কানাচেতে। আমি খুশি, এইটুকুন মুহূর্তেই তাকে হেনস্তা করতে পেরে মেলা খুশি।এতটাই যে আমার হাতের পোড়ার ব্যথাই ভুলে গেছি। সব থেকে বড় কথা…

সে তো জানতেও পারেনি, তার সফেদ গালে, তার অর্ধাঙ্গিনীর স্পর্শ রয়ে গেছে। নির্ঘাত সেই বাবুইপাখি এই লিপস্টিকের দাগ দেখে দূরে ভেগে যাবে? নয়তো ঝগড়াঝাটি হবে তুমুল। এরপর ব্রেক আপ! আমি ভেবেই শয়তানী হাসি দিলাম। এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমার রিনা খানের অভিনয় প্লে করলাম। এবার বুঝবে ঠেলা। কতটা সংকটময় এই কুহুর প্রেম।

সংকটময় প্রেম পর্ব ১০

পরবর্তী পর্ব মঙ্গলবার পাবেন ইন শা আল্লাহ।

সংকটময় প্রেম পর্ব ১২